ত্রিধারে তরঙ্গলীলা | পর্ব – ১

বাচ্চাটি গোল গোল চোখে তাকিয়ে ছিল৷ দীর্ঘসময় তাকিয়ে থাকার পর তুলতুলে নরম দেহটি যেন ছটফটিয়ে ওঠল৷ সুহাস খেয়াল করছিল মিষ্টি মুখের মায়াবি বাচ্চাটি তাকে দেখছে। হঠাৎ শুনতে পেল আধো আধো কণ্ঠে বাচ্চাটি তাকে ডাকল,
‘ পাপাহ, পাপপাহ! ‘
সুহাস চমকাল। শিরশিরে অনুভূতি হলো দেহ জুড়ে৷ স্নায়ুতে চঞ্চলতা বাড়ল। নিজের দু’পাশে তাকিয়ে
সুক্ষ্মভাবে পরোখ করল কাকে ডাকছে। এদিকটায় তো সে ছাড়া কেউ নেই! বাচ্চাটি যার কোলে সে একজন বলিষ্ঠ পুরুষ। ধারণা করেছিল সেই পুরুষটিই বাচ্চার বাবা। তাহলে বাচ্চাটা তার দিকে তাকিয়ে কেন, পাপা ডাকছে? গলা শুঁকিয়ে গেল সুহাসের৷ খেয়াল করল তার বুক কাঁপছে। বাচ্চাটি তৃতীয়বার উচ্চারণ করল, পাপাহ! সুহাসের শারীরিক সমস্ত শক্তি যেন হরণ করে নিল সেই ডাক। দিশেহারা হয়ে আশপাশে তাকাল সে। দূরে দাঁড়িয়ে প্রাকৃতিক পরিবেশের ফটোশুট করছে সৌধ। সে ভীত কণ্ঠে সৌধকে ডাকল। ক্যামেরা গলায় দাঁত ক্যালিয়ে এগিয়ে এলো সৌধ। সুহাস তার কাঁধে হাত রেখে কাঁপা কণ্ঠে বলল,
‘ দোস্ত, নামীর প্রেগ্ন্যাসি রিপোর্ট অনুযায়ী আমাদের বেবির বয়স এখন কত? ‘
‘ হঠাৎ এই প্রশ্ন? ‘
প্রশ্ন করল সৌধ। ভ্রু কুঁচকে সুহাসের মুখোমুখি দাঁড়াল সে। এতে বাচ্চাটি সুহাসের চোখের আড়াল হলো। সুহাস অস্থির কণ্ঠে বলল,
‘ সরে দাঁড়া। ও আমাকে পাপা ডাকছে। সামনে থেকে সরে দাঁড়া। ও আমাকে পাপা ডাকছে। ‘
সুহাসের আকুল কণ্ঠে বিস্মিত হলো সৌধ। তড়াক করে ঘুরে দাঁড়াতেই দেখল, একজন বলিষ্ঠ যুবক ফুটফুটে এক বাচ্চাকে নিয়ে গাড়িতে ওঠল। কিছু সময়ের ব্যবধানে গাড়িটা চলেও গেল। তৎক্ষনাৎ সুহাস উন্মাদের মতো বলতে লাগল,
‘ সৌধ, বাচ্চাটা চলে গেল! ও আমাকে পাপা ডেকেছে দোস্ত। প্লিজ ওদের আটকা। ‘
বলতে বলতেই এক ছুট দিল৷ পেছন পেছন সৌধও ছুটল। সুহাসকে পেছন থেকে জাপ্টে ধরে বলল,
‘ সুহাস পাগলামি করিস না। কার না কার বাচ্চা। তোকে কেন পাপা বলবে? কোথাও ভুল হচ্ছে দোস্ত।’
সুহাস তীব্র ক্রোধ নিয়ে সৌধর কলার চেপে ধরল। ক্রোধে ফেটে পড়ে বলল,
‘ একটা বাচ্চা আমার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর পাপা ডাকল। একবার না, দুইবার না পরপর তিনবার। আর তুই বলছিস আমার ভুল হচ্ছে? ‘
‘ তা নয়তো কী? ওটা তোর আর নামীর সন্তান? জীবন এতই সহজ? এটা কী নাটক, সিনেমা আশ্চর্য!’
কপট রাগ দেখিয়ে সৌধ এ কথা বলতেই দপ করে নিভে গেল সুহাস। বলল,
‘ হতে পারে না? ‘
থমথমে সে প্রশ্নে সৌধ ওর কাঁধ চেপে বলল,
‘ দোস্ত, আমরা নামীকে খুঁজে বের করব। তুই প্লিজ ধৈর্য্য ধর। ‘
‘ আমাদের সন্তান ঐ বয়সীই তো সৌধ? ‘
একমুহূর্ত চুপ রইল সৌধ। বোধহয় মনে মনে হিসেব কষল। এরপর উত্তর দিল,
‘ আট বা ন’মাস তো হবেই। ‘
‘ এ বয়সে বাচ্চারা মা, বাবা ডাকে না? ‘
সুহাসের অসহায় মুখটা দেখে খুব মায়া হলো সৌধর। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মাথা ঝাঁকাল সে। অস্ফুট হাসি ফুটল সুহাসের অধর কোণে। বিড়বিড়িয়ে বলল,
‘ শিশুরা বাবা, মা চিনতে ভুল করে না। ‘
সৌধ ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘ আমাদের ভাতিজি বা ভাতিজা যাইহোক না কেন। সে তার বাবাকে দেখেইনি। চিনবে কী করে? ‘
সুহাস চটে গেল। তীব্র ক্ষোভ নিয়ে বলল,
‘ এর জন্য দায়ী নামী। ওকে আমি ছাড়ব না সৌধ। একবার শুধু ওকে পাই। ছাড়ব না কিছুতেই। ‘
সৌধ বাঁকা হাসল। বন্ধুর বুকে চাপড় দিয়ে বলল,
‘ ছাড়িস না। ‘
কথাটা বলেই লেকের পাশ ধরে হাঁটতে লাগল সৌধ। সুহাসকে ইশারায় বলল এগুতে। সুহাস পিছন ফিরে একবার তাকাল। ঝকঝকে পরিষ্কার রাস্তার দিকে তাকিয়ে রইল করুণ চোখে। এরপরই শুনতে পেল সৌধের ডাক।
‘ সুহাস, কাম অন। ‘
বুকের ভেতর হাহাকার করে ওঠল। ভয়ানক সেই শূন্যতা সুহাসের বুকের ভেতরটা যেন ক্ষতবিক্ষত করে দিতে লাগল। গত ষোলমাস ধরে সে এই শূন্যতাকে লালন করছে। যে শূন্যতা ক্ষণিক পূর্বের ঘটনায় আরো প্রকট হলো। তার ভেতরের পিতৃসত্তা তীক্ষ্ণ ভাবে জেগে ওঠেছে ‘পাপাহ’ শব্দের তিন ডাকে। বাচ্চাটা কেন তাকে পাপাহ ডাকল কেন?
সুদূর বাংলাদেশ থেকে সুইজারল্যান্ডের জেনেভা শহরে এসেছে সুহাস৷ বন্ধু সৌধকে নিয়ে৷ তাদের এখানে আসার আজ দ্বিতীয় দিন। দ্বিতীয় দিনেই এমন একটি ঘটনার সম্মুখীন হয়ে সুহাস যেন আরো উন্মাদ হয়ে গেল। যাদের খোঁজে এ শহরে পা রেখেছে তাদের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠল দ্বিগুণ। তার মন বার বার বলছে বাচ্চাটা তাকে এমনি এমনি পাপাহ ডাকেনি। সৌধ বুঝাল,
‘ সুহাস এ বয়সে বাচ্চারা যে বুলি প্রথম শেখে। সবাইকে তা বলেই ডাকে৷ ঐ বাচ্চাটা হয়তো ঐ একটা ডাকই শিখেছে। তাই তোকে পাপা ডেকেছে। ‘
সুহাস অসহায় চোখে তাকিয়ে বলে,
‘ আমাকেই কেন? এ সময়ে কেন আমাকে ওটা বলে ডাকল। ‘
‘ আরে মাম্মা, ঐ বেবিটা কি জেনে বসে আছে তুই কোন সময়, কোন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিস। বা’ল আমার, ভাল্লাগে না। এই যে দিওয়ানা হইছ না। এইটা এখন না হয়ে তখন হলে কাজে দিত। ‘
সুহাস যেন নিভে গেল। বিড়বিড় করে বলল,
‘ একবার শুধু ওকে পাই, একটাবার শুধু পাই। ‘
সৌধ তাচ্ছিল্য করে বলল,
‘ পেলে কী করবি? আই লাভ ইউ বলার নাম করে আই হেইট ইউ বলবি। চুমু দেবার নাম করে কামড়ে দিবি। আদর করার নাম করে মেরে অজ্ঞান বানিয়ে ফেলবি। জানা আছে না আমার? শুধু কি আমার পুরো গ্যাং জানে তোর কাণ্ড। আহারে বেচারি… ওর কোনো দোষই আমি দিতে পারি না। ‘
এ পর্যন্ত বলেই সুহাসের দিকে চোখ পড়ল সৌধর৷ একদম শান্ত চোখে তাকিয়ে আছে সে। ধূসর রঙা ঐ চোখ দুটোর শান্তভাব পিল চমকে দিল তার। পরোক্ষণেই বাংলাদেশে হওয়া বন্ধুর করুণ দশার কথা স্মরণে এলো। দমে গেল সে। ভরসার সহিত হাত রাখল বন্ধু সুহাসের কাঁধে। বলল,
‘ বন্ধু নামীকে তো খুঁজে পাবই। তোকে শুধু কথা দিতে হবে যেভাবেই হোক ওকে কনভিন্স করবি৷ ওকে কনভিন্স করে দেশে নেয়ার দায়িত্ব তোর। বউ তোর, বাচ্চা তোর দায়িত্বও তোর। আমি আর কোনো ঘটকালি করতে পারব না। নয়তো শেষে বাঁশটা আমারি যাবে। ‘
সুহাস মুখ ফিরিয়ে উদাস নয়নে বসে রইল। বিশাল রেস্তোরাঁর কাঁচের দেয়াল ভেদ করে তার দৃষ্টি পড়ল জেনেভা শহুরের রাস্তায়। সুইজারল্যান্ডের দ্বিতীয় বৃহত্তম জনবহুল শহর জেনেভা। এ শহরেই থাকে নামী। শুনতে অবাক লাগলেও সুহাসের হৃদয়ে তীরাঘাত করা রমণীর নাম নামী। ডক্টর. নামী রহমান। উহুম সুহাসের ভাষায় নামীদামী ডক্টর। নামী যে কারো নাম হতে পারে সুহাস ভাবতেও পারেনি৷ তাই তো প্রথম সাক্ষাতে নাম শুনেই বলেছিল,
‘ কী নামীদামি? আমাকে পছন্দ হয়েছে তো? ‘
এই শহরের কোথায় থাকে নামী জানে না সে। শুধু জানে এ শহরেই আছে সে। যাকে খুঁজে পেতে খুব বেশি কাঠখড় পোহাতে হবে না বোধহয়। কারণ ইতিমধ্যেই বাংলাদেশ থেকে নিধির ম্যাসেজ এসেছে। নামী জেনেভা শহরের একটি প্রাইভেট হসপিটালে কর্মরত রয়েছে। শুধু তাই নয় সেই হসপিটালের মালিকের সঙ্গেই আমেরিকা থেকে জেনেভায় এসেছে সে। সুহাসের চোখ মুখ কুঁচকে গেল। নামীর সঙ্গে ঐ লোকটার পরিচয় কীভাবে? কীভাবেই বা তার সঙ্গে এতদূর আসার দুঃসাহস দেখাল? তীব্র ক্রোধ জেগে ওঠল অচেনা লোকটার ওপর। বিড়বিড় করে বলল,
‘ শা’লা তোদের খোঁজ পেলে তোকে আগে ক্যালাব। ‘
পরোক্ষণেই কাচুমাচু মুখে বলল,
‘ এই না আমি এখন ভদ্র ছেলে। ওসব করা যাবে না। তাহলে নামীদামী পটবে না। ‘
সৌধর ডাকে হুঁশ ফিরল তার।
‘ সুহাস এই সুহাস, কোথায় হারালি। ধূর বা’ল আমার। ‘
‘ ছিঃ সৌধ ভাই। এসব বলে না। ‘
সুহাস আচমকা কথাটি বলেই হো হো করে হেসে ওঠল। হেসে ফেলল সৌধ নিজেও। রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে গাড়িতে ওঠল দুই বন্ধু। উদ্দেশ্য নিধির পাঠানো ঠিকানায় যাওয়া। যেখানে গেলেই তারা পৌঁছাতে পারবে ডক্টর.নামী রহমান অবধি৷ সুহাসের বুক ধকধক করছে। তীব্র উত্তেজনায় বসে থাকতে পারছে না। হাসফাস করছে কেমন। সৌধ তার নাজেহাল অবস্থা দেখে জানালার কাঁচ নামিয়ে দিল। আচমকা জেনেভা শহরের ঝকঝকে বাতাস ছুঁয়ে দিল ওকে। চোখ বুঁজে লম্বা একটি শ্বাস নিল সুহাস। বিড়বিড়িয়ে বলল,
‘ অপরিচিত দেশ, অপরিচিত শহর। অথচ এ শহরের বাতাসে প্রিয়তমার গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে। কী আশ্চর্য! কী ভয়ানক কাণ্ড! আহ নামীদামি, তুমি বড়োই আশ্চর্যজনক মহিলা! ‘
সহসা হৃদয় গভীরে উষ্ণ অনুভূতি ছুঁয়ে যেতেই সুহাস ডুব দিল অতীতে। মন, মস্তিষ্ক জুড়ে হানা দিল সেই নামীদামি রমণীটি। পাঁচটা বছরের অপ্রিয় প্রিয় মুখ দীর্ঘ সাত বছরের বিস্তর অতীত।
_______________________
‘ কী বলছ বাবা! আমার কি বিয়ের বয়স হয়েছে? ‘
বাবার আবদারে বিস্মিত হলো সুহাস। মাত্র ২১ বছর বয়স তার। মেডিকেল কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। গ্রীষ্মের ছুটিতে বাবার সঙ্গে তার এক আত্মীয়ার বাড়িতে এসেছে। এসেই জানতে পারে সেই আত্মীয়া বাবার কলেজ বান্ধবী। যিনি মারা গেছেন আজ দু’বছর। তার একমাত্র মেয়ে নামীকেই বিয়ে করতে বলছেন বাবা। সুহাস কিছুতেই রাজি হলো না। একে তো সে স্টুডেন্ট মানুষ। আবার সুন্দরী গার্লফ্রেন্ডও আছে। এদিকে নামী নামের মেয়েটা দেখতে অসুন্দরীই বলা যায়! দূর থেকে দু’বার দেখেছে। চোখে ধরেনি একটুও। নাক ছিটকাল সুহাস। ঐ মেয়েটা তার সঙ্গে বড্ড বেমানান। কিন্তু সোহান খন্দকার। অর্থাৎ সুহাসের বাবার জেদ নামীকেই সে পুত্রবধূ করবে। বাবার জেদের কাছে সুহাসের জেদ তুচ্ছ হয়ে গেল। সোহান সাহেব ছেলেকে হুমকি দিলেন,
‘ তুমি যদি নামীকে বিয়ে না করো। আমি তোমার মাকে ডিভোর্স দিব! ‘
সুহাস কেঁপে ওঠল। মাকে সে নিজের জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবাসে। সে শুনেছে, বাবার সঙ্গে তার মায়ের বিয়েটা হয়েছিল অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে। মা রাজি থাকলেও বাবা রাজি ছিলেন না। দাদা আর নানা মিলে জোর করে বাবা মায়ের বিয়ে দিয়েছেন।
ফলে এত বছর সংসার হলেও একে অপরের মাঝে বনিবনা হয়ে ওঠেনি। বাবার প্রতি মায়ের ভালোবাসা থাকলেও মায়ের প্রতি বাবার একবিন্দু ভালোবাসা জন্মায়নি৷ এই যে সংসার। এই যে তারা দু’টো ভাইবোন। কেবল দায়িত্ব থেকেই তাদের পৃথিবীতে এনেছেন সোহান খন্দকার। যা একদিন ঝগড়ার সময় মুখ ফস্কে ছেলে, মেয়ের সামনেই বলে ফেলেছেন সোহান। এছাড়া সুহাস তার মা অর্থাৎ ডক্টর. উদয়িনীর মুখে শুনেছিল, বোন আলো পেটে আরার পর থেকে আজ পর্যন্ত বা মার সঙ্গে এক বিছানায় রাত কাটায়নি। কথাটা অবশ্য সরাসরি শোনেনি। শুনেছিল আড়াল থেকে। এসব থেকেই তারা দুই ভাই, বোন বুঝে নিয়েছে বাবা, মায়ের সম্পর্কের জটিলতা। ছোটোবেলা অনেক চেষ্টা করত বাবা, মায়ের মধ্যে ভালোবাসা তৈরি করার। বড়ো হবার সঙ্গে সঙ্গে সেই উদ্যম হারিয়ে ফেলে ওরা। কারণ, এখন ওরা বুঝে গেছে সংসার ছাড়া ভালোবাসা পূর্ণতা না পেলেও ভালোবাসা ছাড়া সংসার পূর্ণ হয়৷ তার বাবা মা করেছে পূর্ণ। এ শহরে এমন শতশত সংসার আছে। যা ভালোবাসাহীন। তবুও স্বামী, সন্তান দিয়ে পরিপূর্ণ। তার মায়ের সংসারটা ঠিক সেরকমই একটি সংসার। যেই মহিলা ভালোবাসাহীন একটি সংসার আঁকড়ে এতগুলো বছর বেঁচে আছে। যেই মহিলা পঁচিশ বছর ধরে এক তরফা ভাবে স্বামীকে ভালোবেসে সংসার করছে। সেই মহিলাকে কত সহজে ডিভোর্স দেয়ার কথা বলতে পারল সোহান খন্দকার। কী নিষ্ঠুর মানুষটা৷ কী নিষ্ঠুর বাবা! সুহাস দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করল। বাবার দিকে তাকাল করুণ চোখে। বাবা নিজ সিদ্ধান্ত অটুট। সুহাস সহসা বলল,
‘ মায়ের মতো মানুষ বলে পার পেয়ে যাচ্ছ বাবা। অন্য কেউ থাকলে তোমার কপালে দুঃখ ছিল। ‘
বাবা হাসলেন। তাচ্ছিল্য ভরে। বললেন,
‘ তুমি আমাদের সন্তান সুহাস। উদয়িনী আমার মস্ত বড়ো ক্ষতি করলেও আমি তার মস্ত বড়ো ক্ষতিটা করতে পারলাম না। কারণ সে তোমার মা, আমার স্ত্রী। তার সম্মান রক্ষা করাটা আমার দায়িত্ব। সোহান খন্দকার জীবৎকালে নিজের দায়িত্ব অস্বীকার করেনি। কৃপণতাও দেখায়নি। ‘
মেডিকেল স্টুডেন্ট হিসেবে তৎক্ষনাৎ সুহাসের মনে একটি কথা চলে এলো৷ মুখ ফস্কে বলেও দিল,
‘ তুমি মায়ের সব নিড পূরণ করছ না বাবা! ‘
স্তব্ধ হয়ে গেলেন সোহান সাহেব। এক মুহুর্ত নিশ্চুপ থেকে ভাবলেন, তার ছেলেমেয়েরা বড়ো হয়েছে। তাছাড়া স্ত্রীর স্বভাব তিনি জানেন। পেশায় ডাক্তার হওয়াতে সাধারণদের কাছে যা লজ্জাজনক। তার কাছে তা খুবই স্বাভাবিক একটি ব্যাপার। তাই সুহাসের এহেন মন্তব্যে বিচলিত হলেন না। বরং প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন,
‘ মানসিক ভাবে তৈরি হও৷ আজ রাতেই তোমার বিয়ে। ‘
কথাটা বলেই সুহাসের হাত থেকে মোবাইল ফোন কেড়ে নিলেন তিনি। সুহাস পরিস্থিতি বুঝে হাসফাস শুরু করল৷ কোনটা ঠিক কোনটা বেঠিক তালগোল পাকিয়ে গেল তার৷ শেষে বাবাকে বলল,
‘ আমি মেয়েটার সঙ্গে কথা বলতে চাই। ‘
‘ নো প্রবলেম মাই সন। তবে মনে রেখো নামীর সঙ্গে আজ তোমার বিয়ে না হলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তোমার মাকে আমি ডিভোর্স দিব। পঁচিশ বছর আগে যা করতে পারিনি। আজ তাই করব। বিকজ, আজ আমার জীবনে কোনো পিছুটান নেই। ‘
***
লম্বা ফিনফিনে দেহশ্রীতে সুক্ষ্ম দৃষ্টি বুলাল সুহাস৷ নামী তীব্র অস্বস্তি নিয়ে রুমের একপাশে দাঁড়িয়ে। বিছানায় দু-হাত ভর করে বসা সুদর্শন পুরুষটির গাঢ় চাহনির কবলে পড়ে হৃৎস্পন্দন অস্বাভাবিক হয়ে গেছে তার। সুহাস খেয়াল করল, মেয়েটি ঘনঘন শ্বাস ফেলছে। আচমকা তার দৃষ্টি নামল তার বুকের মধ্যস্থে। অধর কোণে ফুটল দুর্বোধ্য হাসি। গায়ের রঙ চাপা হলেও মেয়েটির দেহশ্রী নিখুঁত। এতক্ষণ তার মধ্যে বিয়ের প্রতি অনিহা কাজ করলেও নামীকে আপাদমস্তক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার পর অনিহা কেটে গেল। যতই তার গার্লফ্রেন্ড সুন্দরী হোক না কেন দৈহিক গঠন এই মেয়েটির মতো নজরকাড়া নয়। বিষয়টা মাথায় আসতেই সুহাস ভাবল, বিয়ে করতেই হবে৷ না করে উপায়ও নেই৷ বর্তমানে গায়ের রঙ চাপা কোনো সমস্যাই না৷ এটা ম্যানেজ করে নেবে। শুধু অরিনকে ম্যানেজ করাই কঠিন হবে। সাত মাসের রিলেশনে কত ঘনিষ্ঠ মুহুর্ত কাটিয়েছে দু’জন। সে ভুলতে পারলেও অরিনের বেশ কষ্ট হবে। ঢোক গিলল সুহাস৷ খেয়াল করল নামী একটু পর পর তাকাচ্ছে তার দিকে। তাই মুচকি হেসে বলল,
‘ কী নামীদামি আমাকে পছন্দ হয়েছে তো? ‘
নামী লজ্জায় মাথা নত করে ফেলল। এতে সুহাস মজা পেল খুব৷ দুই পা দুলাতে দুলাতে রসাল সুরে বলল,
‘ ওখানে দাঁড়িয়ে কেন? পাশে এসে বসো। ‘
নামী এক চুলও নড়ল না। তীব্র অস্বস্তি নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। সুহাস টের পেল মেয়েটা লজ্জা পাচ্ছে। মনে মনে ভেঙচি কাটল তাই৷ এরপর ইচ্ছে করে দিল এক ধমক,
‘ অ্যাঁই নামীদামি, এত দাম দেখাচ্ছ কেন? এদিকে এসো, বসো পাশে। নইলে কিন্তু বিয়ে করব না। ‘
চমকে তাকাল নামী। কিঞ্চিৎ ভীত হয়ে ঢোক গিলল। মৃদু পায়ে এগিয়ে এসে বসল পাশে। সুহাস অবাক হয়ে তাকাল। ড্যাবড্যাবিয়ে নামীর ভাবগতিক বোঝার চেষ্টা করল। বলল,
‘ বাব্বাহ বিয়ের প্রতি এত ইন্টারেস্ট? তো নামীদামি ঝেড়ে কাশো তো। ‘
অবুঝ চোখে তাকাল নামী। সুহাস অবাক হওয়ার ভাণ করে বলল,
‘ ওলে অবুঝলে। ‘
এ কথা বলেই ভ্রু নাচাল। মুখ নিচু করে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল,
‘ বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে ক’বার ডেটে গেছ বেবি? ‘
চমকে ওঠল নামী। তড়াক করে ওঠে দাঁড়াল সে। রাগে ফোঁস ফোঁস করে সুহাসের দিকে তাকাল একবার। তারপর রুম ত্যাগ করতে উদ্যত হলো। টের পেয়ে হাত চেপে ধরল সুহাস৷ লাফিয়ে ওঠে বলল,
‘ অ্যাঁই নামীদামি, একদম রুম থেকে বেরোবে না। ‘
নামী মুখ ফিরিয়ে কঠিন দৃষ্টিতে তাকাল। হাত ছাড়ানোর বৃথা চেষ্টাও করল। সুহাস বলল,
‘ ও মা গো! এত দেখি সাপের মতো ফোঁস ফোঁস করে। এই তুমি নাগিন টাগিন নও তো? ভেজা বেজি থেকে অগ্নিঝড়া সাপ! কী সাংঘাতিক!’
‘ হাত ছাড়ুন। ‘
শক্ত কণ্ঠের মেয়েলি বাক্যে চমকাল সুহাস৷ বিড়বিড়িয়ে বলল,
‘ তার মানে বোবা নয়। ‘
নামী অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে। সুহাস হাত ছেড়ে বলল,
‘ ওকে ফাইন ছাড়লাম। কিন্তু রুম থেকে যেও না। আজ রাতে তোমার আমার বিয়ে৷ জরুরি কথা আছে বসো পাশে। ‘
এ দফায় কিঞ্চিৎ শান্ত হলো নামী। কিন্তু বসল না৷ সুহাস আর বসতেও বলল না। নিজে বসে প্রশ্ন করল,
‘ বয়ফ্রেন্ড আছে? ‘
কাঠকাঠ গলায় নামী জবাব দিল,
‘ না। ‘
‘ থাকবে কী করে? ছেলেদের রুচি এখনো এত নিচে নামেনি। আর যাইহোক, সাক্ষাৎ নাগিনীর ধারেকাছে কেউ আসতে চাইবে না। ‘
তীব্র মেজাজ খারাপ হয়ে গেল নামীর। আর এক মুহুর্ত এই ছেলের সামনে দাঁড়ালে নিশ্চিত ঠাটিয়ে থাপ্পড় বসাবে। দু বছরের সিনিয়র বলে এমন কাণ্ড সে ঘটাতে চাইল না। এরচেয়ে ভালো এখান থেকে বিদায় হওয়া। উচ্চ পদধ্বনিতে রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেল সে। সুহাস হকচকিয়ে গেল। ক্ষীণ স্বরে বলে ওঠল,
‘ ফায়ার স্ন্যাক! ‘
পরোক্ষণেই লাফিয়ে ওঠল৷ বড়ো বড়ো নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
‘ অসম্ভব! জলজ্যান্ত সাপকে বিয়ে করা অসম্ভব। ছিঃ বাবা, তোমার রুচি দেখে বমি পেয়ে গেল! আমার অপরূপা মাকে তুমি চয়েজ করো না। অথচ এই ফায়ার স্ন্যাক তোমারি চয়েজ ছিঃ!’

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।