ত্রিধারে তরঙ্গলীলা | পর্ব – ৩৮

আজ সকালে সূর্যের দেখা মেলেনি। থেকে থেকে টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে৷ প্রকৃতি অবসাদগ্রস্ত। সেই অবসাদ গ্রাস করে নিয়েছে সিমরানকেও। দু’পায়ে এখনো ব্যান্ডেজ মেয়েটার। কান্নাকাটি করে ফর্সা মুখ লালচে বর্ণে পরিণত হয়েছে। চোখ দু’টোও ফুলে আছে ভীষণ। সময় সাতটা বেজে পঁয়ত্রিশ মিনিট৷ মেয়ের ঘুম ভেঙেছে, উদয়িনী টের পেয়েছে ব্লুটুথ স্পিকারে গান শুনে। বাইরে থেকে অল্পস্বল্প শোনা যাচ্ছে সিমরানের ঘরে গান বাজছে। হিন্দি গান। যে গানে মিশে আছে বিরহ বেদনা। যে অনলে নিজে দগ্ধ হচ্ছে সে অনলে মেয়েকে দগ্ধীভূত হতে দেখতে চায় না বলেই বিয়ের তোরজোর শুরু করেছিল উদয়িনী। তবু যেন শেষ রক্ষা হলো না৷ ভালো করতে গিয়ে মন্দতে পরিণত হলো সব৷ বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে উদয়িনীর। মেয়ের জন্য নিজ হাতে সকালের নাস্তা তৈরি করতে নিচে নামে। এমন সময় আবির্ভাব ঘটে সৌধ চৌধুরীর। যা রীতিমতো বিস্মিত করে তুলে তাকে। সৌধ স্বভাবসুলভ সালাম দিয়ে মৃদু হাসল। উদয়িনী নিজের বিস্ময় কাটিয়ে প্রশ্ন করল,
‘ তোমরা তো কক্সবাজার ছিলে! সাতসকালে কী করে এলে? ‘
‘ আমি গতকাল রাতেই ফিরেছি আন্টি৷ এদিকের খবর শুনে সুহাস টেনশন করছিল খুব। তাই বললাম আমি গিয়ে অবস্থা দেখি। সমস্যার সমাধান দেয়ার চেষ্টা করি৷ তোরা আস্তে ধীরেই আয়। ‘
সন্তুষ্ট হলো না উদয়িনী। যেখানে সুহাসের আসার কথা সেখানে শুধু সৌধ আসাতে মন কিছুটা অসন্তুষ্ট হলো। মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল তার ছেলের বউ প্রীতি এতটাই যে যে আদরের বোনের অসুস্থতার কথা জেনেও আসল না৷ দায় এড়াতে বন্ধুকে পাঠিয়ে দিল। অন্য সময় হলে সৌধর উপস্থিতি তাকে খুশি করত কিন্তু আজ করল না। কারণ মনে মনে সৌধকে নিয়ে যে স্বপ্ন সে দেখত তা আর এখন দেখে না। তবু পারিবারিক বন্ধুত্ব, ছেলের বন্ধু হিসেবে সৌজন্যতা দেখাল। সৌধকে বসতে দিয়ে নিজেও পাশে বসল। বাড়ির পরিস্থিতি জানালো, মা হয়ে সে মেয়ের মন পড়তে পারছে না৷ মেয়েটাও তাকে বন্ধু ভেবে নিজের যন্ত্রণা ভাগাভাগি করতে চাইছে না৷ বাবার সাথে যেটুকু সখ্যতা ছিল সেটুকুও এখন আর নেই। শুধুমাত্র না জানিয়ে তার জন্য পাত্রপক্ষ নিয়ে আসার ভুলে। সৌধ সমস্ত কথা শুনল৷ এরপর বুঝেশুনে প্রশ্ন করল,
‘ আমি একটা জিনিস বুঝতে পারছি না আন্টি। সিনু সবেমাত্র অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছে। অন্তত পক্ষে অনার্স কমপ্লিট করার পর তোমরা বিয়ের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারতে। এত দ্রুত এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়েছ যে শুধু সিনু নয়, আমরা সবাই স্তব্ধ! ‘
এত দ্রুত সিমরানের বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়ার পিছনে দু’টো কারণ রয়েছে। তন্মধ্যে একটি হলো, উদয়িনীর চতুর বুদ্ধিমত্তা বলে, খুব শিঘ্রই চৌধুরী বাড়ি থেকে সিমরানের জন্য বিয়ের প্রস্তাব আসবে৷ কারণ সৌধর মা তানজিম চৌধুরী সিমরানকে খুবই পছন্দ করে। এছাড়া খবর পেয়েছে সুজা চৌধুরী ভাবছেন ছোটো ছেলের বিয়ের ব্যাপারে৷ ব্যস্ততা কাটিয়ে পারিবারিক ভাবে বসবেনও তারা৷ এই পারিবারিক আলোচনায় সোহান খন্দকারও থাকবেন৷ সোহান কেমন মানুষ জানে উদয়িনী। তাই সেই অঘটন ঘটার আগেই স্বামীকে নিজের কিছু দুর্বলতা দিয়ে ঘায়েল করেছে। রাজি করিয়েছে সিমরানের জন্য ভালো পাত্র দেখতে৷ সব ঠিকঠাক চলছিল। মাঝে বেঁকে গেল সিমরান। কারো সঙ্গে সম্পর্ক আছে কিনা বুঝতে পারছে না৷ এখন পর্যন্ত কিছু বলেনি সিমরান। শতবার প্রশ্ন করা শেষ। অথচ মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে মেয়েটা৷ না প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে আর বা ভালো, মন্দ কিছু বলছে। সে যেন নির্বাক বনে গিয়েছে। আর এর জন্য দায়ী তারা বাবা, মা দু’জন। সবচেয়ে বেশি দায়ী সে নিজে। দীর্ঘশ্বাস ফেলল উদয়িনী। সৌধর কথার বিপরীতে বলল,
‘ তুমি তো জানো বাবা তোমার আংকেলের সাথে আমার সম্পর্ক ভালো না৷ আত্মীয়, পাড়াপ্রতিবেশি সবার মাঝে আমাদের নিয়ে চর্চা হয়৷ ইদানীং তোমার আংকেলের সাথে সম্পর্কটির একটুআধটু উন্নতি হয়েছে। তাই ভেবেছিলাম ছেলেটা তো নিজেরটা বুঝে নিতে শিখেছে। মেয়েটা এখন যুবতী। খুব সরল মনের৷ আমরা দু’জন তো ওকে সময় দিতে পারি না৷ সারাক্ষণ একা একা থাকে। যদি বিয়ে দিয়ে একটা সঙ্গী জুটিয়ে দিই মন্দ হবে না৷ সিনু কেমন জানোই তো। ওর জন্য ভালো হবে। সবদিক দিয়ে ও স্যাটিসফাইড হবে এমন পাত্রই দেখছিলাম। ‘
সৌধ সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে। উদয়িনীর কথা শুনতে শুনতে হঠাৎ কপালে ভাঁজ পড়ল। নাকের এক পাশে তর্জনী দিয়ে চুলকে নিল আয়েশি ভঙ্গিতে। উদয়িনী আন্টির কথাতে গড়মিল স্পষ্ট। সে যে গড়মিল পেয়েছে বুঝতে দিল না। সহজ স্বাভাবিক ভাবে বলল,
‘ সিনুর সঙ্গে আলোচনা করা উচিত ছিল আন্টি। বিয়ে জীবনের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। হুট করে বিয়ের বিষয়টা সামনে আসাতে ওর মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। ‘
‘ বুঝতে পারছি। কিন্তু ওর রিয়াকশন ওভার ছিল। এতটাও কাম্য ছিল না। আমরা বিয়ে দিয়ে দিইনি। জাস্ট দেখতে এসেছে মাত্র। ‘
ভ্রু কুঁচকে গেল সৌধর। ভাবুক কণ্ঠে বলল,
‘ তোমার কী মনে হচ্ছে ও কারো সঙ্গে সম্পর্কে আছে, কমিটেড? ‘
‘ সন্দেহ হচ্ছে, ভুলও হতে পারে। আসলে বাবা এ সময় সুহাসকে খুব বেশি প্রয়োজন ছিল। সিনু আমার আর তোমার আংকেলের থেকেও সুহাসকে বেশি ভরসা করে। কিন্তু সুহাসের বোধহয় আমাদের জন্য সময় হবে না। ‘
শেষ বাক্যে ছেলের প্রতি কিছু অভিমান মিশে ছিল৷ সৌধ লক্ষ করল, ইদানীং উদয়িনী আন্টির অভিমান বেড়েছে। মানুষ যখন ধীরেধীরে বড়ো হয় তখন অভিমানও বাড়তে থাকে। এরপর নির্দিষ্ট সময় তা স্থির রয়। আবার যখন বয়স বাড়ে, বৃদ্ধ হতে শুরু করে তখন অভিমানেরাও বৃদ্ধ হয়। উদয়িনী আন্টির অভিমান কি সেসবেরই ইঙ্গিত? কত আর বয়স হয়েছে তার? এ বয়সী নারীরা তো বৃদ্ধা তকমা পায় না। মনের ভাবনা মনেই রইল। মুখ ফুটে কিছু বলল না সৌধ। কিয়ৎক্ষণ নীরব থাকার পর হঠাৎ বলল,
‘ আমি কি সিনুর সঙ্গে কথা বলব একবার? ‘
চিন্তান্বিত মুখে উদয়িনী বলল,
‘ বলবে? দেখো গিয়ে। যতটুকু জানি তোমাকে খুব মানে ও। আমাদের তো কিছু বলে না। যদি তোমাকে বলে। ‘
উদয়িনীর কণ্ঠে কিঞ্চিৎ আশার আলো দেখার মতো ভরসা মিশে ছিল৷ সৌধ দু’কাঁধ মৃদু নাড়িয়ে ত্বরিত ওঠে দাঁড়াল। ঘড়িতে সময় দেখে নিয়ে পা বাড়াল উপরের দিকে। বলে গেল,
‘ অকে, আই সি। ‘
উদয়িনী ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল। ত্বরান্বিত হয়ে সকালের নাস্তা তৈরি করতে লাগল৷ পাশাপাশি আফসোস হলো, সৌধ কেন নিধির প্রতি আসক্ত হলো? ছেলেটা যদি নিধির প্রতি দুর্বল না থাকত। তাহলে আজ এসব কিছুই ঘটত না৷ সে কখনোই সিমরানের জন্য অন্যত্র পাত্র দেখত না। এমন সময় হঠাৎ মন বলল, সিমরান যদি কারো সাথে সম্পর্কে থেকে থাকে। তাহলে পারিবারিক ভাবে সৌধর সঙ্গে বিয়ের ব্যাপারে আগাতে গেলেও তো একই পরিস্থিতির মুখোমুখি হতো!
.
.
জানালার থাই গ্লাসে ভীড় জমিয়েছে অগণিত বৃষ্টিফোঁটা। সেদিকে স্থির নয়নে তাকিয়ে আছে সিমরান। স্পিকারে তখন গান বাজছে,
” এ হামনাভা, মুঝে আপনা বানা লে…
ছুখি পারি দিল কি ইছ জামি-কো ভিগা দে ।
হুমম… হু এ্যাকেলা, জারা হাথ বারহা দে…”
গানের লিরিক এ পর্যন্ত যেতেই দরজায় টোকা পড়ল। ভেসে এলো পুরুষালি মোটা, সুস্পষ্ট কণ্ঠস্বর,
‘ ক্যান আই কাম সিনু? ‘
থমকানো দৃষ্টি দুটো এক নিমিষে বারকয়েক পলক ফেলল। বিরস বদনে ভর করল বিস্ময়। পীড়িত চিত্তে চঞ্চল হলো। নিঃশ্বাস, প্রশ্বাসে বাড়ল অস্থিরতা। ম্রিয়মাণ বুকটায় অশান্তির ঢেউ ওঠল। ধুকপুক শব্দে মুখরিত হলো বক্ষগহ্বর। কার কণ্ঠ পেল? দরজার বাইরে কে দাঁড়িয়ে? অস্থির হয়ে গান বন্ধ করে দিল। বদ্ধ উন্মাদের মতো এপাশ, ওপাশ তাকিয়ে ওড়না গলায় ঝুলালো। সৌধ ফের দরজায় টোকা দিল৷ সিমরান কান সজাগ করে শুনল সেই টোকা। সৌধ ফের বলল,
‘ কীরে আসব? ‘
আচমকা দৃষ্টিজোড়া টলমল হয়ে ওঠল৷ বুকের ভেতর থেকে উপচে এলো কান্না। কোনোক্রমে নিজেকে সামলে শ্বাস রোধ করে ঠাঁই বসে রইল। প্রচণ্ড কষ্ট হলো কণ্ঠস্বর বের করতে। তবু উচ্চারণ করল,
‘ এসো। ‘
এসো বলেও শান্ত থাকতে পারল না। অস্থির, উন্মুখ হয়ে তাকিয়ে রইল দরজার পানে। মুহুর্তেই দেখা মিলল, কালো রঙের টিশার্ট আর ধূসর রঙা প্যান্ট পরিহিত তাগড়া যুবকটির। যে ধীরেসুস্থে এগিয়ে এলো। আশপাশে তাকিয়ে পড়ার টেবিলের সামনে থাকা কাঠের চেয়ার টেনে বসল তার পাশে। সিমরান আবেগে বিগলিত হলো। আন্দোলিত হলো তার ছোট্ট হৃদয়। বাঁধভাঙা কান্নায় ভেঙে পড়তে চাইল মন৷ অবাধ্য ইচ্ছেরা বুকে তরঙ্গ বইয়ে দিল, একটিবার, শুধু একটিবার সৌধভাইকে জড়িয়ে ধরার জন্য। ঐ হৃষ্টপুষ্ট পুরুষালি বুকটায় ঝাঁপিয়ে পড়ার তৃষ্ণা জাগল খুব৷ হাউমাউ করে কান্না করতে ইচ্ছে করল। অভিযোগ জানাতে ব্যাকুল হলো মন।
‘ সৌধ ভাই জানো আব্বু, আম্মু আমার জন্য পাত্র দেখছে। আমাকে কয়েকজন অপরিচিত লোক এসে দেখে গেছে৷ আমি তো তোমাকে ভালোবাসি সৌধভাই। আমি তো তোমার বউ হতে চাই। ওরা কেন এমন করল কেন ওরা মন বিষিয়ে দিল আমার৷ আমি তোমাকে ছাড়া আর কাউকেই আমার ভাগিদার হতে দিব না৷ তুমি ছাড়া আর কাউকেই এই হৃদয়ে স্থান দিতে পারব না। ‘
ইশ অতিআবেগ মিশ্রিত, ছেলেমানুষি বাক্যগুলো মনে মনেই রয়ে গেল৷ তা আর বলার সাহস করে ওঠল না৷ আর না ওই বুকে মুখ গুঁজে নিজের কষ্টগুলো কমাতে পারল। কেবল অসহায়িনীর ন্যায় মুখ করে বসে রইল চুপচাপ। কী বিষাদগ্রস্ত ওই মুখ। ছোট্ট, সুন্দর মুখখানিতে কী গভীর মলিনতা! দু-চোখে এহেন দৃশ্য দেখে বড্ড খারাপ লাগল সৌধর৷ মনে মনে বলল ‘ সিনুর অবস্থা তো খুব খারাপ। আমাদের সন্দেহটাই ঠিক নাকি! ‘ মনে মনে এসব বলেকয়ে প্রকাশ্যে আচমকা বলে ফেলল,
‘ কীরে পিচ্চি সত্যি করে বল তো কার জন্য এই বিধ্বস্ততা? ‘
সহসা সচেতন হয়ে গেল সিমরান৷ বারকয়েক ঢোক গিলে স্বাভাবিক হয়ে নিয়ে বলল,
‘ মিথ্যা করে বলছি কারো জন্য না। ‘
‘ আমি মিথ্যা সহ্য করতে পারি না। ‘
‘ তুমি সত্যিটাও সহ্য করতে পারবে না। ‘
‘ পাকনি হয়ে গেছিস! পুতুলের মতো সুন্দর গালটায় আমার পাথুরে হাতের পাঁচ আঙুল বসার আগে সত্যি বল পাকনি। ‘
ম্লান হাসল সিমরান। বলল,
‘ তোমরা চলে এসেছ? ‘
‘ আমরা না আমি একা। ‘
‘ কেন? ‘
‘ তোর জন্য। ‘
বুকে গহিনে তীক্ষ্ণ ব্যথা লাগল বুঝি। হতভম্ব মুখে সরাসরি তাকাল সিমরান। সৌধ স্বাভাবিক ভণিতায় বলল,
‘ আমি না এলে তোর পাগলা ভাই বউ, হানিমুন সব কক্সবাজার সমুদ্রে ভাসিয়ে দিয়ে চলে আসছিল। ওদিক যেন না ভাসে তাই আমি চলে এলাম এদিক সামলাতে। এদিক ঠিক থাকলেই ওদিক রক্ষা। ‘
কথা শেষ করে মৃদু হাসল সৌধ। সিমরান অপলকে তাকিয়ে দেখল, একটা ছেলের কথার ভঙ্গিমা কত সুন্দর হতে পারে। কী সুন্দর তার দিকে না তাকিয়ে দৃঢ় দৃষ্টিজোড়া নাড়িয়ে, পেশিবহুল হাত এপেশওপেশ করে, ঠোঁটদ্বয়ে অমায়িক মৃদু হাসি বজায় রেখে কথা বলছে। পৃথিবীর সবচেয়ে সুদর্শন পুরুষটি যেন এই মানুষটা। যার সর্বত্রেই চোখ ধাধানো সৌন্দর্য বিরাজ করে৷ এছাড়া সব পরিস্থিতি সামলানোরও ঐশ্বরিক ক্ষমতা আছে এই মানুষটার৷ ভাবতেই নিমেষে চমকে গেল। সত্যি কী তাই? সবার জীবনের কঠিন পরিস্থিতি সহজ, স্বাভাবিক করতে পারলেও মানুষটা কি পারে নিজের জীবনে আসা কঠিন পরিস্থিতি সামলাতে? সেদিনের সেই দৃশ্য, সেই পরিস্থিতি এখনো ভুলতে পারেনি সিমরান। বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরুলো তার। শুনতে পেল পুনরায় সৌধর করা প্রশ্নবিদ্ধ বাক্যটি,
‘ সমস্যা কী বলত? প্রকাশ্যে তো বয়ফ্রেন্ড নেই, গোপনে আছে? ‘
অকপটে সিমরান জবাব দিল,
‘ না নেই। ‘
‘ তাহলে এখন বিয়ে করতে চাইছিস না? ‘
শ্বাসরোধ করে উত্তর দিল,
‘ না চাইছি না। ‘
‘ ওকে ফাইন করবি না৷ তাই বলে হাত, পা কে টে, ঘরকুনো, গুমরামুখো হয়ে বসে থাকতে হবে? আর কী গান শুনছিলি এসব গান শোনার বয়স এখন? ‘
সিমরানের বিষণ্নতা কেটে গেল অনেক। চোখজুড়ে ভর করল একরাশ মুগ্ধতা। সকাল সকাল স্বপ্ন দেখছে না তো? অপ্রত্যাশিতভাবে সৌধকে পেয়ে হৃদয় জুড়ে শিহরণ জেগে ওঠল। পলকহীন তাকিয়েই রইল মানুষটার দিকে। মুগ্ধতার রেশ কণ্ঠে মিশিয়েই বলল,
‘ তুমি কেমন আছো সৌধভাই? ‘
সহসা এহেন প্রশ্নে সৌধ একটু থমকাল। নতমস্তকে ঠোঁট কামড়ে একটুখানি ভাবার চেষ্টা করল, সে কেমন আছে? তৎক্ষনাৎ আচম্বিতে একটি মুখ ভেসে ওঠল দু-চোখের পাতায়। নাক জুড়ে চেনা শরীরী ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ল সেই রমণীর। বুক আর মস্তিষ্ক জুড়ে কিলবিলিয়ে ওঠল একটি নাম, নিধি! কী আশ্চর্য! সে ভালো আছে কিনা ভাবতে গেলেও বেইমান নিধির মুখ ভেসে ওঠে। ওই মুখ, ওর ঘ্রাণ, ওই নাম সবই তীক্ষ্ণ ভাবে মনে করিয়ে দেয় সে ভালো নেই৷ কেন ভালো নেই? নিধি নামক প্রতারকের জন্য হাহ…।
সিমরান আকুল চোখে তাকিয়ে৷ সৌধ প্রসঙ্গ এড়িয়ে বলল,
‘ শোন বিয়ে করবি না ইট’স ওকে। নো প্রবলেম, তোর বিয়ে হবে না৷ কেন হবে না, কীভাবে হবে না এসব আমার ওপর ছেড়ে দে৷ কিন্তু শর্ত আছে যা তোকে পালন করতে হবে। ‘
‘ কী শর্ত? ‘
সিমরানের কণ্ঠে বিস্ময়। সৌধ বাঁকা হাসল। যে হাসিতে ফের ফাঁসল সিমরান। তরুণিমাকে নিজের বাঁকা হাসিতে পুরোদস্তুর ফাঁসিয়ে তরুণ বলল,
‘ মন খারাপ করে থাকা যাবে না। সব সময় হাসি, খুশি থাকতে হবে৷ নিজের যত্ন নিতে হবে। খাওয়াদাওয়া ঠিকঠাক করতে হবে। মন দিয়ে পড়তে হবে। আর যে কোনো সমস্যায় পড়লে তৎক্ষনাৎ আমাকে বা সুহাসকে জানাতে হবে। আর হ্যাঁ আন্টি, আংকেল না বুঝে ভুল করে ফেলেছে এটা নিয়ে সমস্ত রাগ, অভিমান ভুলে যেতে হবে৷ ক্লিয়ার? ‘
সৌধর কথার সমাপ্তি ঘটতেই সিমরান বাধ্য মেয়ের মতো মাথা কাত করল। সৌধ মাথা দুলিয়ে হেসে বলল,
‘ তুই আসলেই গুড গার্ল। সুহাস, আন্টি শুধু শুধু তোকে নিয়ে টেনশন করে। পায়ের অবস্থা কেমন হাঁটতে পারিস? ‘
প্রথম বাক্যদ্বয়ে ঠোঁট ফুলাচ্ছিল সিমরান। মা আর ভাই তার ইমেজ কতখানি নষ্ট করতে পারে জানে সে। কিন্তু শেষ বাক্যে সিরিয়াস হলো। বলল,
‘ ট্রাই করিনি। ‘
‘ আজ থেকে করবি। ওঠছি আমি, সাবধানে থাকিস।’
সৌধ ওঠতে উদ্যত হলে সিমরান ত্বরিত ডাকল,
‘ সৌধভাই? ‘
‘ হু? ‘
‘ আর একটু বসবে? ‘
ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে করা আবেদনটি ফেলল না সৌধ। মনে শান্তি নেই, স্বস্তি নেই৷ নিজের জীবনে চলা সমস্যা গুলোর সমাধান তার কাছে নেই। কিন্তু অন্যের জীবনের সমস্যা গুলো কী অনায়াসেই সমাধান করতে পারে৷ এই যেমন সিমরানকে দেখে তার স্বাভাবিক লাগছে না। মেয়েটি ভয়াবহ বিষণ্নতায় ভুগছে। বর্তমানে ডিপ্রেশন শব্দটির ভয়াবহতা সম্পর্কে কারোরি অজানা নয়। আর সিমরান যে ধরনের মেয়ে। এই মেয়ে তীব্র বিষণ্ণতায় যা কিছু ঘটিয়ে ফেলতে পারে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বসল সৌধ। বলল,
‘ তোর যদি এখানে ভালো না লাগে আমাদের বাড়ি চলে যা। ওখানে আম্মা, তাহানীর সঙ্গে সময় কাটাবি ভালো লাগবে। ‘
‘ তোমার ছুটি কতদিন? ‘
‘ ছুটি আরো কয়েকটা দিন আছে। বাট আমি আগামীকালই চলে যাব। ‘
মুখটা কাচুমাচু হয়ে গেল সিমরানের। সৌধ খেয়াল করে বলল,
‘ আর কিছু বলবি? ‘
চট করে তাকাল সিমরান। অসহায় মুখ করে আবদার করল,
‘ একটা গান শুনাবে প্লিইজজ?‘

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।