বাচ্চাটি গোল গোল চোখে তাকিয়ে ছিল৷ দীর্ঘসময় তাকিয়ে থাকার পর তুলতুলে নরম দেহটি যেন ছটফটিয়ে ওঠল৷ সুহাস খেয়াল করছিল মিষ্টি মুখের মায়াবি বাচ্চাটি তাকে দেখছে। হঠাৎ শুনতে পেল আধো আধো কণ্ঠে বাচ্চাটি তাকে ডাকল, ‘ পাপাহ, পাপপাহ! ‘ সুহাস চমকাল। শিরশিরে অনুভূতি হলো দেহ জুড়ে৷ স্নায়ুতে চঞ্চলতা বাড়ল।
প্রচণ্ড সুশীল প্রকৃতির মেয়ে নামী। আর পাঁচটা মেয়ে রূপ, সৌন্দর্যের দিক দিয়ে তাকে পেছনে ফেলতে পারলেও গুণের দিকে পারবে না। এই মেয়েটি দারুণ মেধাবিনী। শুধু পুঁথিগত বিদ্যাতেই সে সীমাবদ্ধ নেই। বিজ্ঞানের ছাত্রী হলেও সাহিত্যের প্রতি রয়েছে নিবিড় ঝোঁক। পড়াশোনার ফাঁকে ঠিক সমরেশ, রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল, শরৎচন্দ্র ইত্যাদি বহু লেখকের বই পড়ে নেয়।
বন্ধুদ্বয়ের সাথে কথোপকথনের সমাপ্তি ঘটেছে অনেকক্ষণ। নামীদের বাড়ির দোতলার বারান্দায় চনমনে চিত্তে বসে আছে সুহাস। ফোনের স্ক্রিনে মায়ের নাম্বার জ্বলজ্বল করছে। সে অশান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে। দু’বার কল করল মাকে। দু’বারই ফোন বন্ধ শোনাল। এরপর কিয়ৎকাল ভেবে কল করল ছোটো বোন সিমরানকে। তার ফোনও বন্ধ বলছে।
ঘড়ির কাটা সকাল সাতটা পনেরো ছুঁয়েছে৷ এরই মধ্যে ময়মনসিংহের ফুলবাড়ীয়া এসে পৌঁছাল সৌধরা। সৌধ ড্রাইভ করার ফাঁকে ফ্রন্ট মিররে দেখে নিল, বান্ধবী প্রাচী ঘুমাচ্ছে। পাশে বসে বই পড়ছে চৌকশ স্টুডেন্ট আইয়াজ। সৌধর মেজাজ খুব খারাপ হয়ে গেল। আইয়াজের উদ্দেশ্যে বিড়বিড়িয়ে বলল, ‘ এই শালা মনে হয় টয়লেটে বসে বসেও পড়ে!‘
গাঢ় গোলাপি রঙের ঘাগরার সঙ্গে গাঢ় নীল লেডিস শার্ট পরিহিত নামী। শার্টের দুই হাতা কনুই পর্যন্ত গোটানো। গলায় ঝুলানো গোলাপি রঙের জর্জেট ওড়না। মুখশ্রীতে কোনো প্রসাধনী নেই। ঘন-কালো দিঘল রেশম চুলগুলো পেছন দিকে বেশ উঁচু করে বাঁধা। ছোট্ট কপালটা ছোটো-ছোটো চুলে ঢাকা। মুখে লেগে আছে স্নিগ্ধতা মেশানো মৃদু হাসি।
সুহাসিনী, দ্বিপ্রহরের রৌদ্রোকজ্জ্বল এই ক্ষণে কাজল রঙে আবৃত তোমার মায়াবিষ্ট আঁখি যুগলেই কি হলো আমার মরণ? ‘ __সুহাস নামীর ব্যক্তিগত ডায়ারিতে স্থান পেল তাকে উদ্দেশ্য করে বলা সুহাসের প্রথম নৈসর্গিক বাক্যটি। একবার, দুবার, বার বার অসংখ্যবার বিড়বিড়িয়ে বাক্যটি আওড়াল নামী। নিজের ঘরে নাজুক মুখে বসে মুচকি মুচকি হাসছে সে।
ভোরবেলা উদয়িনীর কল পেলেন সোহান খন্দকার। সিমরানের জ্বর হয়েছে। আরো একদিন কক্সবাজারে কাটানোর কথা থাকলেও মেয়ের ভয়াবহ জ্বর হওয়াতে ফিরে আসছে উদয়িনী৷ ভোর ছ’টায় রওনা দিয়েছে তারা। এখন বাজে ছ’টা পয়তাল্লিশ। স্ত্রীর ফোনকল পেয়ে সোহান খন্দকার ঘামতে শুরু করলেন। মেয়ের জ্বর নিয়ে সে দুশ্চিন্তা করছেন না। স্ত্রী এমবিবিএস ডক্টর।
প্রায় এক ঘন্টা হতে চলল। মা, মেয়ে আর ছেলে দ্বার রুদ্ধ করেছে। সোহান খন্দকার একবার উপরে ওঠছেন। আরেকবার নিচে নামছেন৷ বসার ঘরে সোফার এক কোণে মাথা নিচু করে বসে নামী। তার পাশেই নিধি বসে৷ ক্ষণে ক্ষণে নামী যে ঘেমে ওঠছে টের পেল নিধি৷
বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটেনি। উদয়িনী পুরোপুরি তার স্বামীর প্রাক্তনের মেয়েকে ছেলের জীবন থেকে সরাতে পারেনি৷ কিন্তু ছেলেমেয়ে দু’টোর মাঝে তুলে দিয়েছে শক্তপোক্ত দেয়াল। যে দেয়ালের নাম ঘৃণা। সুহাস নামীকে ঘৃণা করে তার মায়ের জন্য। যে মেয়ের মা তার মায়ের জীবনের সব সুখ কেড়ে নিয়েছে সেই মায়ের মেয়েকে সে কেন সুখ দেবে?
ক্লাস শেষ হলো বিকেল পাঁচটায়। সৌধর হাবভাব ভালো ঠেকেনি নিধির৷ একদম স্যারের পিছু পিছু বেরিয়েছে সে৷ কিন্তু বিপদ ঘটল অর্পণ স্যারকে দেখে। আটাশ বছর বয়সী যুবক অর্পণ। তাকে এই মেডিকেল কলেজের হার্টথ্রবও বলা হয়। যার প্রতি অন্যান্যদের মতো নিধিও দারুণ মোহিত। বর্তমানে স্টুডেন্ট’সদের মধ্যেও একজন হার্টথ্রব রয়েছে। যার নাম সৌধ চৌধুরী।