জীবন দিয়ে ভালোবাসা প্রমাণ করা যায়??তাহলে শাজাহান কেন তাজমহল বানিয়ছিলো?? সেও তো পারতো তার প্রিয়তমার জন্য জীবন দিয়ে দিতে। সবার ভালোবাসা প্রকাশের ধরন এক হয় না। ভালোবাসা প্রমাণ করার জন্য কেউ জীবন দেয় আর কেউ হাতে হাত রেখে সারাজীবন একসাথে চলার অঙ্গীকার করে। ভালোবাসা সম্পর্কে সবার চিন্তাধারা ভিন্ন হলেও ভালোবাসার কোন পরিবর্তন হয় না। পরিবর্তন হয় সময় এবং পরিস্থিতি। সময়ের বেড়াজালে আটকে যায় সব। পাল্টে যায় ভাগ্য লিখন।
গামছা আর শাড়ি হাতে নিয়ে ধৈর্যহীন চোখে শায়ের কে দেখছে পরী। সবসময় অদ্ভুত লাগে শায়ের কে। যখন শায়ের কথা বলে তখন ওর চোখ থেকে চোখ ফেরানো দায়। পরী আটকে যায় সুরমা পরিহিত ওই চোখে। পরী বলে ওঠে,’আপনার পরীজান কে ভালোবাসতে হলে আপনাকে বেঁচে থাকতে হবে মালি সাহেব। আপনার ভালোবাসা ছাড়া পরীজান আর কিছু চায় না।’
-‘সম্রাট শাজাহান তার স্ত্রীর জন্য তাজমহল বানিয়েছে। জানেন কি??’
পরী মাথা নেড়ে বলে,’হুমম।’
-‘ভারতের সম্রাট শাজাহান। তার স্ত্রীর নাম মমতাজ। স্ত্রীকে তিনি এতোটাই ভালোবাসতেন যে তার জন্য বিশাল বড় তাজমহল বানিয়েছেন। ইতিহাস সেরা সে মহল। তিনি তার ভালোবাসা প্রমাণ করার জন্য তাজমহল বানিয়েছেন।’
-‘আপনি কীভাবে প্রমাণ করবেন?’
শায়ের মৃদু হেসে জবাব দিলো,’শাজাহানের মতো তাজমহল বানাতে পারবো না বলে কি আমার ভালোবাসা মিথ্যা পরীজান?’
-‘এখন সারা বিশ্ব দেখলেও মমতাজ কিন্ত তাজমহল দেখেনি। আমি চাই না আমার অনুপস্থিতিতে আপনি আপনার ভালোবাসা প্রমাণ দিন। কারণ আপনার চোখে আমি প্রতিদিন প্রমাণ পাই। শুধু এটুকুই আমার পাওয়া। তাজমহলেই কি শুধু ভালোবাসা হয়? কুঁড়ে ঘরে হয়না বুঝি??
শায়ের উত্তর না দিয়ে হাসলো। পরী আর সময় ব্যায় করে না। শায়ের কে তার জন্য অপেক্ষা করতে বলে সে গোসলে চলে যায়।
রুপালি তার ছেলেকে কোলে নিয়ে বসে আছে। পরী তখন রুপালির ঘরে গেলো। মনমরা হয়ে বসে আছে রুপালি। পরীকে দেখে সে হাল্কা হাসার চেষ্টা করে। পরী হাত বাড়িয়ে দিলো ছোট্ট পিকুলের দিকে। পিকুল এখন বসতে পারে। পরীকে দেখে সে এক পলক মায়ের দিকে তাকিয়ে আবার পরীর দিকে তাকায়। পরী অবিকল তার মায়ের মতো সুন্দর। মায়ের থেকে একটু বেশি বলা চলে। তবে পরীর হাসিটা যেন রুপালির মতোই। পিকুল ঝাঁপিয়ে পড়ে পরীর কোলে। পরীর বুকের সাথে মিশে থাকে সে। রুপালি বলে,’দেখ,জন্মের পর তো তোকে পায়নি বলতে গেলে। কি সুন্দর খালামনিকে চিনে নিয়েছে।’
-‘কেন চিনবে না? আমাদের রক্ত না? আমার কাছে আসবে না তো কার কাছে যাবে?’
-‘তাই তো দেখছি।’
-‘দাদিকে কি ভুল বুঝেছো আপা? কোন ভুলের মাফ চাইছিলে তুমি?’
হঠাত করেই রুপালি চুপ করে গেলো। এদিক ওদিক পলক ফেলে চোখ আড়ালে ব্যস্ত হলো সে। পরী আবারো জিজ্ঞেস করতেই সে বলে,’অনেক কটু কথা শুনিয়েছি তাকে। বুড়ো মানুষ, আমার ঠিক হয়নি দাদির সাথে খারাপ আচরণ করা। তাই মাফ চাইলাম।’
পরী পিকুলের গালে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,’সেজন্য এভাবে বলার মানুষ তুমি নও আপা। আমি জানি তুমি দাদিকে কতটা অপছন্দ করতে। কিন্ত সে কি এমন মহান কাজ করলো যে তার কাছে এভাবের মাফ চাইবে? তোমার চোখ বলছে তুমি মিথ্যা বলছো।’
রুপালি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,’সত্যিই আমি দাদিকে চিনতে অনেক দেরি করে ফেলেছি। মানুষের বাইরের সত্ত্বা দেখা গেলেও ভেতরের সত্ত্বা বোঝা কঠিন। তুইও বুঝবি পরী। সময় এলেই বুঝবি।’
-‘সময়ের অপেক্ষা করতে পারবো না। তুমিই বলো।’
-‘কিছু কিছু প্রশ্নের উত্তর সময়ের থেকে নিতে হয়। তাহলে সেই উত্তর থেকে অনেক কিছু জানা যায়। এখন বল একটা প্রশ্নের উত্তর নিবি নাকি অনেক প্রশ্নের?’
জবাব না দিয়ে রুপালির দিকে তাকিয়ে রইল পরী। এই মুহূর্তে বোনের ভাবমূর্তি বুঝতে অক্ষম সে। সবকিছু ধোয়াশা মনে হচ্ছে। পরীর মনে হচ্ছে ওর সামনে যা কিছু আছে তা শুধুমাত্রই আবছা,মেঘে ঢাকা সবকিছু। মেঘ কেটে গেলে সবকিছু স্পষ্ট হয়ে যাবে। তিনদিন পর মিলাদের আয়োজন করা হয়। হুজুর ডেকে এনে ঘরেই সবকিছু সম্পন্ন করা হয়। এই তিনদিন পরী আর শায়ের জমিদার বাড়িতে থাকলেও এখন তাদের চলে যেতে হবে। পরী কেন যেন থাকতে ইচ্ছা করলেও থাকা হয়ে ওঠে না। শায়ের তাকে ফেলে যেতে নারাজ। তাই স্বামীকে ফেলে তার থাকা হয়ে ওঠে না। যাওয়ার আগে আবেরজানের কবর দর্শনে গেলো সে। ইতিমধ্যে বাঁশের বেড়া দেওয়া হয়ে গেছে। একদিন মাটির নিচে সবাইকে যেতে হবে। আগে কিংবা পরে,যেতে হবেই। তবে ঈমানের সাথে যাওয়াই শ্রেয়। পরী জানে না কি এমন ভালো কাজ আবেরজান করেছে যার জন্য রুপালি আজ এতো আফসোস করছে তার জন্য। বোনের কথামতো সে সময়ের থেকে সব জবাব নেবে বলে মন স্থির করেছে।
শায়ের পরীর পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলে,’আমাদের যেতে হবে পরীজান চলুন।’
পরী শায়েরের দিকে এক পলক তাকিয়ে আবার কবরের দিকে তাকালো বলল,’কবরস্থানের দিকে তাকালে মনে হয় পৃথিবীর সব আয়োজন বৃথা। সব শত্রুতা,বিরোধীতা,হিংস্রতা এমনকি ভালোবাসাও এখানে স্থির। তাহলে কেন এতো দ্বন্দ্ব মানুষের মাঝে?কেন সবাই কবরে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয় না?’
-‘সবার মস্তিষ্ক একই রকম দেখতে হলেও চিন্তাধারা এক নয় পরীজান। সবাই যদি আপনার মতো ভাবতো তহলে সবাই ভালোবাসাতে পূর্ণ থাকতো। ঠিক আপনার মতো।’
অতঃপর পরীর হাত ধরে নিয়ে গেলো শায়ের। যাওয়ার আগে বাড়িটাকে ভালোভাবে দেখে নিলো পরী। এই কি সেই বাড়ি যে বাড়িতে পরী ছিলো? সবকিছুই স্বাভাবিক থাকলেও পরীর কাছে সবকিছু অস্বাভাবিক লাগছে। পরীকে অন্যমনস্ক দেখে শায়ের জিজ্ঞেস করে,’আপনি কি কোন কিছু নিয়ে চিন্তিত?’
পরী জবাব দিলো,’আমার কেন জানি মনে হচ্ছে এই জমিদার বাড়িতে কিছু একটা হচ্ছে। যা আমার অজানা। কিন্ত আম্মা,আপা,কুসুম,শেফালি,দাদি এবং জুম্মান জানে। কি এমন হয়েছে সবার??’
-‘হয়তো আপনার দাদির মৃত্যুতে সবাই কষ্ট পেয়েছে তাই এরকম লাগছে সবাইকে।’
-‘নাহ!!আমি কুসুম কে দেখেছি,রান্নাঘরে ওর সাথে খাবার বাড়ার সময় ওর হাত অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপছিল। এমনকি পুরো শরীর ও। সামান্য বিষয় নিয়ে বেশি ভয় পাচ্ছিল। ওর ঘাড়ে একটা ক্ষত ছিলো। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম। ও বলেছিল পড়ে গিয়েছিল। আমি নিশ্চিত কেউ ওকে আঘাত করেছে। আর জুম্মান কে তো এই তিনদিনে দেখলামই না। যে ছেলেটা আমার এতো পাগল সেই ছেলেটার মুখ আমি তিনদিনে দেখলামই না। কিছু তো একটা হয়েছে। আম্মা,আপা,বাকি সবাই আড়াল করছে আমার থেকে।’
-‘আপনার যদি সেরকম কোন সন্দেহ হয়ে থাকে তাহলে আপনি থাকতে পারেন। আমি বাধা দেবো না।’
পরী নিশ্চুপ রইলো। শায়ের কে একা ছাড়তে ওর মন সায় দিচ্ছে না। কেননা মানুষ টা তাকে ছাড়া থাকতে পারবে না। পরী যে তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। তাছাড়া পরী নিজেও থাকতে পারবে না।
যে মানুষটির ঘুমন্ত চেহারা দেখে ঘুম ভাঙে,যার স্পর্শ না পেলে সারা রাত্রি বিনা নিদ্রায় পার হয় তাকে ছাড়া থাকার কোন প্রশ্ন আসে না। তাই সব অজানা রহস্য নূরনগরে ফেলে যাচ্ছে শ্বশুরবাড়ি।
পরী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,’ওবাড়ি থেকে চলে আসার পর সবকিছু বদলে গেছে। আপাকে রেখে আসার পর থেকে ভয়ে আছি আমি। না জানি কোন হিংস্র পশু থাবা মারে। আপা যে বড়ই দূর্বল প্রকৃতির। আঘাত সে সহ্য করতে পারে না।’
শায়ের পরীর হাত চেপে ধরে বলল,’আপনি চিন্তা করবেন না পরীজান। অন্দরের সব নারীরা সুরক্ষিত। তাদের কেউ ক্ষতি করতে পারবে না।’
-‘যেখানে ঘরের মানুষ থাবা মারে সেখানে বাইরের লোক কিছু না।’
-‘আমাকে বলবেন কি হয়েছে? আমার মনে হচ্ছে আপনি সব কথা বলছেন না। আপনিও কিছু লুকিয়ে যাচ্ছেন।’
পরী আর কথা বলল না। গাড়িতে হেলান দিয়ে বসে রইল। কি বলবে সে শায়ের কে? আখির ওর নিজের কাকা। এই লোকটা যে ওদের তিন বোনের দিকে হাত বাড়িয়ে ছিলো। শায়ের তা জানলে কি করবে? হয়তো কিছু করতে পারবে না। আখির কে দেখতে শান্তশিষ্ট মনে হলেও সে একজন ভয়ানক মানুষ। নাহলে ভাতিজিদের দিকে কে এমন কুৎসিত নজর দেয়!! অতীত টানতে চায় না পরী। আর না শায়ের কে বলতে চায়।
সূর্য যখন দিগন্ত থেকে বিদায় নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে তখনই নবীনগর পৌঁছালো ওরা। ঘরে ফিরতেই চম্পা এসে হাজির হলো। পরী মুচকি হেসে চম্পাকে ঘরে আসতে বলে। পরীর সাথে চম্পার এখন ভাব হয়েছে। চম্পা নিজেই এসেছে। পরী তাতে বেশ খুশি,সে চায় না সম্পর্কে মনোমালিন্য থাকুক। সবাই একসাথে হাসিখুশি থাকাটাই জীবনের বড় পাওয়া। তাই পরী সহজেই এবাড়ির সবার সাথে মিশছে। চম্পা আর চামেলি প্রতিদিন আসে পরীর সাথে গল্প করার জন্য। রাতে শায়ের এখন একটু দেরি করে ফেরে সেজন্য ওরাও থাকে। কখনো আম,জাম্বুরা,তেঁতুল মেখে তিনজনে কাড়াকাড়ি করে। কখনও ঘরে বসে নায়ক নায়িকার কাহিনী বলে। টেলিভিশন না দেখলেও চম্পা আর চামেলির মুখে অনেক সিনেমার কাহিনী শোনা হয়ে গেছে পরীর। ওদের সাথে সময় কাটাতে বেশ ভালোই লাগে পরীর।
আজকেও চম্পা এসেছে পরীর সাথে গল্পগুজব করতে। সে জলপাইয়ের আচার এনেছে পরীর জন্য। পরী হাসি মুখে তা গ্রহণ করে। আচার খেয়ে বেশ প্রশংসা করলো। এর আগেও হেরোনার দেওয়া অনেক কিছুই খেয়েছে সে। তার রান্নার হাত খুব ভালো।
চম্পা পরীর থেকে বিদায় নিয়ে নিজ ঘরে ফিরে গেলো। ঘরে ঢুকতেই হেরোনার মুখোমুখি হলো সে। কঠিন দৃষ্টিতে মেয়েকে কিছুক্ষণ দেখে হেসে ফেলল হেরোনা। চম্পাও হাসলো বলল,’সব কিছু ঠিকঠাক হইবে তো মা?’
-‘আমার কথা হুনলে সব ভালা হইবো তোর। বাটিডা দে।’
মেয়ের হাত থেকে আচারের খালি বাটিটা নিয়ে হেরোনা চলে গেল। চম্পা নির্বাক চোখে শায়েরের ঘরের দিকে তাকালো। এই ঘরটাতে সে থাকতে চায়। শায়েরের বধূ হতে চায় তার আকুল মন। তাইতো মায়ের সাথে এক নোংরা খেলায় মেতেছে সে। এতে যে হেরোনার লোভ ও আছে তা জানে চম্পা। তবুও ভালোবাসার মানুষ কে পাওয়ার তীব্র আকাঙ্খা এই কাজ করতে বাধ্য করছে চম্পাকে। ওর মতে প্রিয় মানুষ কে পাওয়ার জন্য যা কিছুই করুক না কেন তা পাপ না।