বিছানায় চিত হয়ে , লম্বা চুল গুলো এক পাশে করে রেখে কোলবালিশে ডান পায়ের হাটু ঠেকিয়ে বুকের ওপর হাত রেখে শুয়ে আছে রুমাইশা। ঘুম নেই ওর চোখে। আর যা হয়েছে আজ রাতে তাতে ওর ঘুম আসলেই বরং আশ্চর্যের ব্যাপার হতো।
গলা টা বসে গেছে, মুখ দিয়ে আওয়াজ বের হতে যেন কলিজা ছিড়ে যাচ্ছে ওর৷ ঢোক গিলতে গেলে ও প্রচণ্ড ব্যাথাতে কুকড়ে উঠছে রুমাইশা। চোখ দিয়ে নোনা পানির নহর বয়ে যাচ্ছে যেন৷ বার বার করে চোখ মুছছে রুমাইশা, কিন্তু পরক্ষনেই আবার চোখ দুইটা পানিতে পরিপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে৷
কিছু সময় পর দরজায় নক পড়লো আবার৷ রুমাইশার গা কাপিয়ে উঠলো নকের শব্দে৷ তড়িঘড়ি করে শোয়া থেকে উঠে বসলো। কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করলো দরজার বাইরের শব্দ৷ কিন্তু বৃষ্টির শব্দের কারণে কিছুই শোনা গেলো না৷ তৎক্ষনাৎ আবার ও কড়া নাড়ার শব্দ হলো।
সাথে কারো আদেশপুর্ণ কণ্ঠস্বর,
— রিমু, দরজা খোল।”
‘এটা তো সাফওয়ান! আবার কেন এসেছে! আবার টর্চার করবে আমাকে!”
বুক ফেটে কান্না আসতে চাইলো রুমাইশার।
বিছানা থেকে উঠে দরজার কাছে গিয়ে দাড়ালো ও। তারপর দরজা না খুলেই এপাশ থেকে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে কাদো কাদো কণ্ঠে বলল,
—আমি কাল সকালেই চলে যাবো ভাইয়া৷ এ-এই বাড়িতে আর কখনো আসবো না৷ আর আমি কাউকে কিছুই বলব না৷ সত্যি বলছি, বিশ্বাস করুন! আমার চেহারাও আপনি আর কখনো দেখবেন না! কসম করে বলছি। দরকার হলে, দরকার হলে আমি কলেজ ও বদলে ফেলবো ভাইয়া। আপনি যা বলবেন তাই করবো!”
বলতে বলতে কিছুটা উচ্চস্বরেই ফুপিয়ে কেদে ফেললো রুমাইশা।
রুমাইশার এমন কান্না একদম বুকে গিয়ে লাগলো সাফওয়ানের, প্রচণ্ড খারাপ লাগলো ওর।
এদিকে বাইরে সাফওয়ানের গলা শুনে ঘুম ভেঙে গেলো শাফিনের৷ তড়িঘড়ি করে বিছানা ছেড়ে উঠে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলো৷
রুমাইশার রুমের দরজার সামনে সাফওয়ান কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে প্রচন্ডরকম অবাক হলো ও৷
কি হচ্ছে কিছুই বুঝে উঠতে না পেরে বিস্মিত হয়ে সাফওয়ান কে জিজ্ঞেস করলো, ‘কি হয়েছে ভাইয়া!তুমি এসময়ে এখানে কেন? রুমি আপুর কিছু হয়েছে! ”
সাফওয়ান শাফিনের প্রশ্নের কোনো জবাব না দিয়ে আবার ও নক করলো দরজায়, নরম গলায় বলল,
—রিমু! দরজা খোল এখনি, ভালো ভাবে বলছি৷ দ্রুত খোল!”
কিন্তু রুমাইশা দরজা খুলল না, ওপাশ থেকে কান্না রত অবস্থাতেই বলল, ‘আপনি চলে যান ভাইয়া। আমি কাল সকালেই এখান থেকে চলে যাবো। কথা দিচ্ছি!”
শাফিন রুমাইশার কথার আগা মাথা কিছু বুঝতে না পেরে সাফওয়ানের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো।
সাফওয়ান বুঝলো এভাবে কাজ হবে না, রুমাইশা কে বলে দরজা খোলানো যাবে না৷ তাই দরজায় নক করা ছেড়ে দিয়ে শাফিনের দিকে ঘুরলো, নিজের ট্রাউজারের পকেটে দুই হাত দিয়ে সোজা হয়ে দাড়ালো।
—আমার কথা মন দিয়ে শোন। আমি এখন রুমাইশার রুমের পেছনের জানালা দিয়ে ওর ঘরে ঢুকবো, তারপর ওকে নিয়ে বের হবো৷ কোথায় যাবো জানিনা, কখন ফিরবো সেটাও জানিনা৷ যখন ফিরবো তখন তোকে কল দিবো৷ আমার ফিরতে ফিরতে যদি সকাল হয়ে যায় তাহলে মা কে ম্যানেজ করার দায়িত্ব তোর৷ বোঝা গেছে?”
ভারী কণ্ঠে বলল সাফওয়ান৷
শাফিন উপর নিচে মাথা নাড়ালো, দ্বিতীয় কোনো প্রশ্ন করলো না। ‘কি হচ্ছে এখানে সেটা পরেও জানা যাবে৷ আগে এদের ভেতরকার মনোমালিন্য দূর হোক!” মনে মনে আওড়ালো শাফিন৷
সাফওয়ান এবার ছাদের দিকে চলে গেলো।
শাফিনের সাথে সাফওয়ানের কি কথা হয়েছে তা জানতে পারলো না রুমাইশা৷ কারো পায়ের শব্দ ছাদের দিকে চলে যেতেই রুমাইশা ভেতর থেকে আওয়াজ দিলো —শাফিন!”
শাফিন বাইরে থেকে বলে উঠলো, হ্যা, আপু বলো।
— সাফওয়ান ভাইয়া চলে গেছে?
— হ্যা, ভাইয়া চলে গেলো এইমাত্র
সাফওয়ান যে জানালা দিয়ে ঢুকবে রুমাইশার রুমে সেটা গোপনেই রাখলো শাফিন৷
হাফ ছেড়ে বাচলো রুমাইশা। শাফিন আর কোনো বাক্যব্যয় না করে নিজের রুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলো।
রুমাইশা দরজার কাছেই ধীরে ধীরে বসে পড়লো, তারপর দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে চোখ দুইটা বন্ধ করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো, সকালেই কারো জানার আগে বাড়ি ছাড়বে ও৷ এমন সময় বাইরে মাটিতে ধুপ করে শব্দ হলো৷
সাফওয়ান এখন নিশ্চয় জঙ্গলের দিকে যাচ্ছে, ভাবলো রুমাইশা। দরজায় মাথা ঠেকিয়ে একটু শান্ত করলো নিজেকে৷
কিন্তু কিছুক্ষন পরেই রুমাইশাকে হতবাক করে দিয়ে সাফওয়ান পেছনের জানালা দিয়ে ঢুকলো রুমাইশার রুমে৷ আর ঠিক সেই জানালা বরাবর দরজার সাথে পিঠ ঠেকিয়ে জানালা মুখি হয়ে বসে আছে রুমাইশা।
সাফওয়ানের হঠাৎ আগমনে স্তম্ভিত রুমাইশা বুঝে উঠতে পারলো না কি করবে! তড়িঘড়ি করে উঠে দাড়ালো ও। মুখ ফুটে কিছু বলতে যাবে তার আগেই তড়িত গতিতে এসে রুমাইশার মুখ হাত দিয়ে চেপে ধরলো সাফওয়ান। রুমাইশা অসহায় এর মতো করে তাকালো সাফওয়ানের দিকে! কিন্তু মুখ ঢাকা থাকার কারণে সাফওয়ানের মুখের কোনো অভিব্যক্তিই দেখতে পেলো না ও।
—কোনো আওয়াজ করবিনা, চুপ চাপ আমার সাথে যাবি, যেখানে নিয়ে যাবো সেখানে।”
আদেশের সুরে বলল সাফওয়ান। তারপর রুমাইশার হাত দুইটা নিজের কাধের ওপর রেখে রুমাইশার বাহুমূলের নিম্নদেশে হাত দিয়ে বাচ্চা দের মতো করে কোলে তুলে নিলো ওকে। রুমাইশার মুখ টা নিজের কাধের ওপর রেখে ওর বুকের সাথে বুক মিশিয়ে দিলো।
বহুবছর পর আজ আবার ও রুমাইশাকে ছোটবেলার মতো করে কোলে নিয়েছে সাফওয়ান, অনুভুতি টাও সেই ছোটবেলারই মতো, শুধু বুকের কাছটাই পরিবর্তন হয়েছে। সাফওয়ানের মনে হলো যেন নরম তুলতুলে তুলার বস্তা কোলে নিয়েছে ও৷
এরপর আদেশের সুরে রুমাইশা কে বলল, ‘শক্ত করে ধরে রাখবি, ছাড়লেই কিন্তু পড়ে যাবি, তখন কিছু হলে কিন্তু তার জন্য আমি দায়ী থাকবো না।”
সাফওয়ানের এহেন কর্মকাণ্ডে হতভম্ব হয়ে গেলো রুমাইশা। জীবনে প্রথমবার কোনো পুরুষের এত কাছে এলো ও। হাত পা অসাড় হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। কিন্তু কোনো রকম প্রশ্ন করার সাহস পেলো না ও। সাফওয়ানের কথা মতো শক্ত করে গলা জড়িয়ে ধরলো সাফওয়ানের, আর পা দুইটা দিয়ে সাফওয়ানের কোমর জড়িয়ে ধরলো ঠিক সেই ছোটবেলার মতো করে।
নিঃশব্দে জানালা দিয়ে বের হয়ে নিচের তলার জানালার ছাদের ওপর পা রাখলো সাফওয়ান৷ তারপর রুমাইশা কে দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে সেখান থেকে লাফ দিলো মাটিতে।
বাড়ির পেছন দিকে থেকে হাটতে হাটতে সামনের দিকে এগোলো সাফওয়ান।
বিস্মিত রুমাইশা সাফওয়ানের কোলের ভেতরে সাফওয়ানের কাধে মাথা রাখা অবস্থাতেই ভাবতে লাগলো, হয়তো ওকে মেরে কোথাও গুম করে দেবে সাফওয়ান, ওর লাশ টাও কেউ খুজে যেন না পায় তাই এই ব্যাবস্থা!
ভয়ে আর উত্তেজনায় হৃৎপিণ্ডের গতি অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে গেলো রুমাইশার, যার কম্পন নিজের বুকেও অনুভব করলো সাফওয়ান৷ কিন্তু কিছুই বলল না রুমাইশা কে৷
বাড়ির সামনে থেকে কিছুটা দূরে যাওয়ার পর রুমাইশাকে কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে কিছুক্ষন তীর্যক চোখে তাকিয়ে থাকলো সাফওয়ান রুমাইশার দিকে। সাফওয়ানের এইভাবে তাকানোর কারণ বোধগম্য হলো না রুমাইশার। কিন্তু পরক্ষনেই বুকের ওপর যে ওর ওড়না নেই সেটা মনে পড়তেই আতকে উঠলো রুমাইশা। অন্তর্বাস হীন পাতলা ওভারসাইজ টি শার্ট টা তে যে ওর শরীরের কিছু ভাজ দৃশ্যমান হয়ে পড়েছে সেটা মনে পড়তেই লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে মন চাইলো ওর। চোখ নামিয়ে নিজের দুইটা হাত বুকের ওপর কোণাকুণি ভাবে রেখে লজ্জা নিবারনের চেষ্টা করলো ও।
—চুপচাপ এইখানে দাড়াবি, কোথাও যাবিনা। আমি এখুনি আসছি। ”
বলে আবার বাড়ির দিকে এগোলো সাফওয়ান। তারপর বাড়ির সীমানা প্রাচীর এর গেইট খুলে ভেতরে ঢুকে গ্যারাজ থেকে গাড়ি বের করে চালিয়ে সোজা বাইরে আসলো। তারপর গাড়ি থেকে নেমে বাসার গেইট বন্ধ করে গাড়িতে বসে এবার আসলো রুমাইশা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে।
রুমাইশার সামনে গাড়ি দাড় করিয়ে ওকে ইশারা করলো গাড়িতে ওঠার জন্য। রুমাইশা বাধ্য মেয়ের মতো গাড়ির পেছনের দরজা খুলে উঠে বসলো। সামনে তাকিয়েই ওর চোখ থেমে গেলো গাড়ির রিয়ারভিউ মিররে, সাফওয়ান মিররের ভেতর দিয়েই তাকিয়ে আছে ওর দিকে।
মিররে চোখ রাখা অবস্থাতেই গম্ভীর চাপা কন্ঠে সাফওয়ান বলে উঠলো, আমাকে কি তোর ড্রাইভার মনে হচ্ছে?
প্রথমে সাফওয়ানের কথার মানে না বুঝলেও পরক্ষণেই বুঝে গেলো রুমাইশা৷ ফোস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো ও৷ তারপর গাড়ির পেছনের সেট থেকে নেমে সাফওয়ানের পাশের সিটে উঠার উদ্দ্যেশ্যে গেলো,
— মেরেই তো ফেলবে, তা এত নাটক করার কি আছে বুঝলাম না৷”
মনে মনে বলল রুমাইশা।
কিন্তু বিপত্তি বাধলো দরজা খোলার সময়। আজকেও দরজা খুলতে গিয়ে পারলো না রুমাইশা। এই দরজাটার যে কি সমস্যা তা মাথাতেই আসলো না ওর৷
সাফওয়ান নিজের দাঁত চেপে চোখ দুইটা বন্ধ করে ফোস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে নিজের ক্রোধ কে সংযত করলো।
তারপর ড্রাইভিং সিট থেকে নেমে গিয়ে রুমাইশার পাশের দরজা খুলে দিয়ে আবার নিজের সিটে গিয়ে বসলো। রুমাইশা উঠে বসলো গাড়িতে, তারপর দরজা আটকে দিলো৷
জনমানব হীন রাস্তায় তুমুল গতিতে গাড়ি হাকালো সাফওয়ান। রুমাইশা সোজা হয়ে বসে সামনে তাকিয়ে রইলো। নড়াচড়াও করলো না৷
উত্তরের জঙ্গলের ভেতর দিয়ে হাইওয়ে চলে গেছে সাতক্ষীরার দিকে। সেদিকেই গাড়ি নিয়ে চলল সাফওয়ান। কিছুক্ষন পরেই কাঙ্ক্ষিত জায়গায় এসে পৌছালো ওরা।
জঙ্গলের শেষ প্রান্ত ঘেঁষে বয়ে গেছে হরিণার বিল, রাস্তা থেকে নেমে সেই বিলের পাশে গাড়ি দাড় করালো সাফওয়ান৷
গাড়ি দাড় করাতেই ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে আশে পাশে চোখ বুলালো রুমাইশা।
ঝুম বৃষ্টির পর বীলের পানি প্রচন্ডরকম শান্ত হয়ে আছে। মেঘ ডাকছে থেকে থেকে, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বৃষ্টি যে আর ও হবে সেটা মেঘের গুরুগুরু শব্দেই বোঝা যাচ্ছে৷
বাইরের অবস্থা দেখা বিদ্যমান রুমাইশার দিকে তাকিয়ে আছে সাফওয়ান৷ গাড়ির ভেতরকার আলোতে রুমাইশার গলার হাতের আঙুলের ছাপ খয়েরী বর্ণ ধারন করে স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে যেন৷
নিজের ড্রাইভিং সিট থেকে সরে গিয়ে রুমাইশার কাছাকাছি চলে এলো সাফওয়ান।
নিজের খুব কাছে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে চকিতে ফিরে তাকালো রুমাইশা। সাফওয়ান কে নিজের এত কাছে দেখে চমকে গাড়ির দরজার দিকে সরে গিয়ে বসলো ও।
ধীর গতিতে চোখের ডার্ক গগলস টা খুলে ফেললো সাফওয়ান। খুলে সোজা রুমাইশার চোখের দিকে তাকালো। সাফওয়ানের জ্বলজ্বলে ধুসর সবুজ চোখ দুটো কে এত কাছ থেকে কখনো দেখবে ভাবতেই পারেনি রুমাইশা। অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো ও সাফওয়ানের চোখ জোড়ায়৷
— অদ্ভুত! খুব অদ্ভুত! সেই সাথে অসাধারণ।
রুমাইশা কে চোখ বড় বড় করে এইভাবে তাকিতে থাকতে দেখে মনে মনে বেশ মজা পেলো সাফওয়ান৷ কিন্তু সেটা প্রকাশ করলো না৷
রুমাইশার আর একটু কাছাকাছি এসে রুমাইশার গলায় বসে যাওয়া আঙুলের ছাপে হাত বুলালো সাফওয়ান৷ তারপর রুমাইশার মুখের কাছে নিজের মুখ এগিয়ে নিয়ে এসে রুমাইশার চোখে চোখ রেখে ধীরে ধীরে অনুতাপের স্বরে বলল,
—সরি রিমু, আমি নিজের হুসে ছিলাম না৷ আমি বুঝতে পারিনি তোকে এতটা কষ্ট দিয়ে ফেলবো। মাথায় কাজ করছিলো না আমার, তাই এরকম করে ফেলেছি।”
সাফওয়ানের এমন কর্মকাণ্ডে রুমাইশা যারপরনাই অবাক হলো৷
কিছুক্ষণ থেমে রুমাইশার হাত টা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে ভারী পুরুষালি কণ্ঠে বলল, ‘আমার মোটেই উচিত হয়নি তোর সাথে এমন টা করা! ক্ষমা করে দে আমাকে! ভুল হয়ে গেছে আমার! আমি এরকম টা করতে চাইনি, তোকে আঘাত দিতে চাইনি কখনো!”
হতবিহ্বল হয়ে গেলো রুমাইশা৷
কথা গুলো বলেই নিজের সিটে গিয়ে বসলো সাফওয়ান৷ প্রায় মিনিট পাঁচেক কেউ আর কোনো কথা বলল না৷ তারপর আচমকাই সাফওয়ান রুমাইশার হাত ধরে এক ঝটকায় টান দিয়ে নিজের কোলের ওপর বসালো৷
হতচকিত রুমাইশা অবাক হয়ে দেখতে লাগলো সাফওয়ানকে! সাফওয়ানের আচরণের এমন পরিবর্তন মানতে পারছে না ও!
একটু আগে যা বলেছে, বলেছে। অনুতপ্ত হয়ে বলেছে! কিন্তু এখন ওকে এই ভাবে কোলের ওপর নেয়ার মানে কি! মনে মনে, সাফওয়ানের উদ্দেশ্য কি সেটা নিয়ে ভাবতেই ব্যাস্ত হয়ে পড়লো রুমাইশা।
সাফওয়ান এবার রুমাইশার চোখে চোখ রেখে নির্লিপ্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
— আমার চেহারা দেখেছিস তুই?”
রুমাইশা ভীত হয়ে ওপর নিচে মাথা নাড়িয়ে হ্যা বোঝালো।
— কবে দেখেছিস? কিভাবে দেখেছিস?” উৎসুক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো সাফওয়ান।
— আপনি যেদিন আইস্ক্রিম খেতে নিচে এসেছিলেন, সেদিন। দরজার ফাকা দিয়ে দেখেছিলাম। আপনার মুখে মাস্ক ছিলো না। আইসক্রিম চেটে খাচ্ছিলেন, তখন।
সাফওয়ানের থেকে চোখ ফিরিয়ে আমতা আমতা করে বলল রুমাইশা।
সাফওয়ান নিঃশব্দে হাসলো।
— নজরদারি তো তাহলে অনেক আগে থেকেই চলছে!”
বলল ও৷
রুমাইশা প্রতিউত্তরে কিছু বললনা।
সাফওয়ানের হাসি মুখ হঠাৎ করেই কঠিন হয়ে গেলো। চোয়াল শক্ত করে বলল, তুই যেহেতু জেনেই গেছিস আমার ব্যাপারে, আর আমাকে দেখেও ফেলেছিস, সেহেতু তোর উচিত আমাকে আবার ভালোভাবে দেখা, আর সমস্ত কনফিউশান দূর করে স্বাভাবিক থাকা। আর আমাকেও একজন স্বাভাবিক মানুষের মতো ট্রিট করা৷
রুমাইশার গলা শুকিয়ে গেলো!
— ভালো ভাবে দেখা!! মানে ওই ভয়ঙ্কর দাঁত আর জিহবা দেখা! ওই সাপের মতো স্কিন দেখা!”
মনে মনে ভেবে আতকে উঠলো ও। মুখ থেকে অস্ফুট শব্দ বেরিয়ে এলো।
— না আমি দেখবো না।” জোর দিয়ে বলল রুমাইশা। সাফওয়ানের কোল ছেড়ে উঠে যেতে চাইলো, কিন্তু সাফওয়ান তা হতে দিলো না। নিজের পেশিবহুল হাত দুইটা দিয়ে রুমাইশা কে জাপটে ধরে বসে রইলো।
বৃষ্টি শুরু হলো বাইরে। রুমাইশা ছাড়া পাওয়ার জন্য হাত পা ছুড়তে লাগলো, কিন্তু তাতে কোনো কাজ হলোনা।
— তোর দেখা লাগবে, আর স্বাভাবিক হওয়া লাগবে৷ প্লাস আমারে চুমু খাওয়া লাগবে, ছোট বেলায় যেমন খেতি।
স্বাভাবিক অথচ গম্ভীর গলায় বলল সাফওয়ান।
সাফওয়ানের কথায় হতভম্ব হয়ে গেলো রুমাইশা। ছাড়া পাওয়ার জন্য এবার দিগুণ জোরে সাফওয়ানের হাত সরানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু ব্যর্থ হলো৷
সাফওয়ান মাদকতাময় দৃষ্টি তে তাকালো রুমাইশার দিকে,
—কোনো লাভ নেই লাফালাফি করে। আমি ছাড়বো না৷ ”
ধীর কণ্ঠে বলল ও৷
তারপর বাম হাত দিয়ে মুখের ওপর থেকে ধীরে ধীরে নিজের মাস্ক সরালো সাফওয়ান।
রুমাইশা সাথে সাথে অন্য দিকে তাকিয়ে চোখ খিচে বন্ধ করে নিলো। বুকের ভেতর দিড়িম দিড়িম শব্দ হচ্ছে ওর। শব্দের তোড়ে পুরো শরীর টাই যেন কেপে উঠছে।
— দেখবো না আমি! একদমই দেখবো না! ” অসহায়ের মতো করে বলল রুমাইশা।
মুখ খুলে নিজের কালো লকলকে লম্বা জিহবা টা বের করে রুমাইশার চোয়াল স্পর্শ করে চেটে দিলো সাফওয়ান। তারপর ডান হাত দিয়ে রুমাইশার চোয়াল চেপে ধরে ওর মুখটা নিজের দিকে ঘুরালো৷
—এখনি তাকা, ভালো ভাবে দেখ আমাকে। নইলে সকাল হওয়ার পর গাড়ি নিয়ে তোকে সহ বাড়িতে ঢুকবো সবার সামনে দিয়ে, আর মাকে বলব, যে তুই সারারাত আমার সাথে ছিলি! তখন কিন্তু সারাজীবন এই চেহারা টা দেখেই কাটিয়ে দিতে হবে!”
নিজের নির্লিপ্ততা বজায় রেখে বলল সাফওয়ান।
সত্যি সত্যি সাফওয়ান এ কাজ করলে অবাক হবে না রুমাইশা, কারণ ওর দ্বারা সবই সম্ভব৷
তাই নিরুপায় হয়ে আর ছটফট না করে ধীরে ধীরে সময় নিয়ে চোখ খুলল রুমাইশা।
সাফওয়ান ওর দিকেই চোখা দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো। রুমাইশা তাকিয়ে দেখতে পেলো সাফওয়ানের কুচকুচে কালো ঠোঁট। গলা, কাধ আর বুকের কিছু অংশে সাপের শরীরের আবরণ, যেগুলো গাড়ির ভেতরের আলোতে চকমক করছে৷ শরীরের সমস্ত লোম খাড়া হয়ে গেলো যেন রুমাইশার। হৃৎপিণ্ডের গতি আর ও দ্রুত হলো ওর৷
পরক্ষণেই সাফওয়ান মুখ খুললে সাফওয়ানের ঝকঝকে বিষদাতের পেছনের কুচকুচে কালো মুখগহ্বর চোখে পড়লো রুমাইশার। গা থরথর করে কাপতে শুরু করলো ওর। আর পরমুহুর্তেই সাফওয়ানের কালো লকলকে জিহিবা টা বেরিয়ে আসতেই প্রবল ভয়ে আর উত্তেজনায় সেখানেই জ্ঞান হারালো রুমাইশা৷
জ্ঞানহীন ঘুমন্ত রুমাইশার মুখের ওপর ঝুকে এক দৃষ্টিতে দেখতে থাকলো সাফওয়ান। ডান হতের আঙুলের ওপরের পাশ টা বুলিয়ে দিলো রুমাইশার নরম চোয়ালে৷
বাইরে মেঘলা আকাশ, আর ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হওয়া সত্বেও বেসুরো গলায় গান ধরলো সাফওয়ান,
“চাঁদনী রাইতে নদীর ওপারে
আকাশ থেইকা নামলো পরী
আমার চোখে চলে ঘোরগাড়ী।
আমি হাবলায় নদীর এপারে
ঘুমের ঘোরে দেখি তারে
ছবির মত ডাকে আমারে।
তারপর চোখ তুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে স্রষ্টার নিকট যেন অভিযোগের সুরে গাইলো —
দেখাও কত রঙিন ছবি
ছবির আশায় হারাইলাম সবই!
দয়াল বানাও কত মায়ারও ছবি
ছবির নেশায় ছাড়লাম সবই……… (ঘোরগাড়ি)