১৬ পৃষ্ঠায় | পর্ব – ৮

বিন্দু পরিমাণ কিরণ আকাশ ভেদ করে পড়ে আবার পুণরায় ফেরত যাচ্ছে। বষর্ণের খেলা তখনও চলছে। হঠাৎ হঠাৎ মেঘ গর্জন করাতে বার বার কেঁপে উঠছে নিনি। এক রাশ অভিমান তার চোখে মুখে। ল্যাগেজ নিয়ে পার্কের এক কোণায় সিটে বসে আছে সে। দুই দিন হতে চলছে এক বিন্দু পরিমাণ ও নড়েনি সেখান থেকে। এনোন এমন কেন করল ভেবে পাচ্ছে না সে। না বুঝে না জেনেশুনে বের করে দিল ঘর থেকে। হু হু করে কেঁদে ওঠে সে। আশেপাশে মানুষ তাকে দেখে দেখে চলে যাচ্ছে। অনেকে আবার পাগল বলেও উপহাস করছে…।
_____________________
মোবাইলে ‘Sinan’ লেখাটি আসতেই রিসিভ করল এনোন। কথা হলো তাদের মধ্যে। কথার এক পর্যায়ে সিনান প্রশ্ন করল,, ভাবী কই? ওকে একটু দাও তো ওর মোবাইলে কল ঢুকছে না কেন?”
এনোনের তখন মনে পড়লো নিনির কথা দুই দিন যাবত অফিসের প্রশারে তার কথা একদমই মাথায় ছিল না তার। সে বিরক্ত সূচক শব্দ বের করে কল কেটে দেয়। আর ওদিকে সিনান হ্যালো হ্যালো করতে লাগল সে বুঝতে পারলো না এনোনের এমন ব্যবহার।
আকাশ রঙের শার্ট পরে বেরিয়ে গেল সে। এই বৃষ্টিতে ড্রাইভ করে আশেপাশে চোখ বুলাতে লাগল এনোন। কোথাও নিনি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। টেনশন ঘিরে ধরলো তাকে। কোথাও গিয়ে সুইসাইড করে ফেলল নাকি? এসব বাজে চিন্তা মাথায় আসতেই আতকে উঠল সে। সে ড্রাইভ করতে লাগল স্পিডে। দমকা হাওয়া বইছে খুব সবকিছুই অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। হঠাৎ ই তার চোখ যায় বেঞ্চে বসে থাকা এক মেয়ের দিকে। ভালোভাবে লক্ষ্য করল সে, সেই পরনে আকাশী রঙের নীল শাড়ি দেখে সে বুঝতে পারলো সেই মেয়েটি ই নিনি। সে গাড়ি থেকে নামিয়ে তার পিছনে গিয়ে দাঁড়ালো দেখলো নিনি হাঁটুতে মুখ গুজে হু হু কাঁদছে আর বিড়বিড় করে কি যেন বলছে পাশেই ল্যাগেজ রাখা। এনোন বৃষ্টি ভিজে গেছে পরনে শার্ট টি বলিষ্ঠ দেহের সাথে ভালোভাবে লেপ্টে গেছে। নিনি ও ভিজে একাকার হয়ে গুটিয়ে আছে। এনোন গম্ভীর গলায় বলে,, এখানে আর বসে না থেকে গাড়িতে বসো।” পুরুষালী কন্ঠ পেয়ে প্রথমে চমকালেও এনোন বুঝে আগের মতই রইল নিনি। একই কথা আবারো বলল এনোন শুনেও না শোনার ভান ধরে থাকল নিনি। এনোন সামনে এসে একহাতে ল্যাগেজ নিয়ে আরেকহাতে নিনির হাত ধরতেই ছট করে হাত ছাড়িয়ে নেয় নিনি। এনোন দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়লো সে গিয়ে গাড়িতে ল্যাগেজ রেখে পুনরায় আসল তার সামনে এসে বলল,, তোমাকে লাস্ট বার বলছি গাড়িতে গিয়ে বসো।” নিনি পাত্তা দিল না আগের মতই হাঁটুতে মুখ গুজে রইল। এনোন কয়েক সেকেন্ড দাঁড়ালো যখন দেখল নিনির কোন উন্নতি নেয় আর উপায়ন্ত না পেয়ে তাকে সেই অবস্থায় কোলে তুলে নিল। নিনি ভয় পেয়ে মৃদু চিৎকার দিয়ে উঠে ফ্যাল ফ্যাল চোখে তাকিয়ে ঠোঁট চেপে অভিমানী স্বরে কাঁধ ধাক্কাতে ধাক্কাতে বলল,, নামান নিচে, আমি যাব না আপনার সাথে, যাব না সেই ঘরে নামান বলছি।” এনোন এক পলক তাকালো তারপর তাকে নিয়ে সোজা নিয়ে বসায় নিনি নামতে গেলে এনোন গাড়ির দরজা বন্ধ করে দেয়। সে নিজেও গাড়িতে বসে নিনির দিকে আড়চোখে তাকায় দেখে সীট বেল্ট বাঁধেনি সে আবারো। এনোন বলে,, সীট বেল্ট লাগাও।” নিনি দরজার প্যান্ডেল টি উঠা নামা করতে করতে বলে,, লাগাব না আপনার সাথেও যাব না, এই ফালতু দরজা টা খুলছে না কেন? উফফ্!” শত চেষ্টা চালাতে চালাতে বলল সে। এনোন জানতো সে এসব করবেই তাই সে বসার সাথেই সাথেই দরজা লক করে দিয়েছিল। এনোন তার অবস্থা দেখে মনে মনে ভাবে,, মেয়েটা আমার গাড়ি ভেঙেই ফেলবে।” সে নিনির হাত ধরে এক হেঁচকা টান দেয় নিনি এনোনের দিকে ঝুঁকে পড়ে তাকে এতটা কাছে দেখে চোখ দুটো বড় বড় করে ফেলে সে হচকচিয়ে যায় পুরো। চোখ নামিয়ে হাত ছাড়াতে ছাড়াতে বলল,, হাত ছাড়ুন প্লিজ।” এনোন হাত ছেড়ে বলে,, ধস্তাধস্তি করবা না আমার গাড়িতে, এসব পছন্দ না আমার, Rubbish!” নিনির রাগ উঠলেও কিছু বলল না এনোন তার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে দেখে সে এখনো সীট বেল্ট বাধেনি সে চরম বিরক্ত হয়ে হাত বাড়াতেই সে দূরে সরে বলে,, এ..এসব কি ক..করছেন আপনি?” এনোন তার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকায় তার পর সীট বেল্ট টেনে লাগিয়ে দেয় নিনি বোকা বনে গেলো নিজের কাজেই নিজেই লজ্জা পাচ্ছে সে এখন। মাথা নুয়ে রাখল সে।
ঘরের সামনে গাড়ি থামায় এনোন নিনি তার দিকে মাথা উঁচিয়ে তাকায় এনোন তাকে নির্লিপ্ত ইশারা করে গাড়ি হতে বের হতে বলে। নিনি গাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। এনোন ঘরের ভেতরে ঢুকলো নিনিও ঢুকলো। এনোন নিজের রুমে যেতেই নিনিও নিজের রুমে যায় চোখ এসির দিকে পড়তেই গা জ্বলে উঠে তার। গরম কন্ঠে এসিকে বলে,, তোর জন্য হয়েছে সব, বেদ্দপ!” বলে সে গজগজ করে বাথরুমে চলে যায়। বাথরুম থেকে বের হতেই দেখে এনোন দাঁড়িয়ে আছে আর ওর দিকেই তাকিয়ে আছে নিনি দু তিনবার পলক ফেলে। এনোন হাতে থাকা গ্লাস টি তার দিকে বাড়িয়ে দিল বলল,, খেয়ে নাও।” নিনি নিল গ্লাসের দিকে এমন ভাবে তাকাচ্ছে যা দেখে এনোন নির্লিপ্ত কন্ঠে বলে,, বিষ দেয়নি তোমাকে সো খাও!” নিনি চমকে উঠে তার কথায়। সে বুঝলো কেমনে যে নিনি এতক্ষণ এটায় চিন্তা করছিল।
নিনি বলে,, আমি এসব খায়না।” এনোন তার কথায় বিরক্ত হয়ে বলে,, এখন খাও, আমাকে বিরক্ত করবা না আমি আর কিছু শুনতে চাই না, খেতে বলছি।”
নিনি ভ্রুদ্বয় কুঁচকে ফেলল। খেতে না চাইলেও জোর করে খাওয়ায় দম নিবে সে। সে নাক মুখ কুঁচকে গ্লাসে থাকা কি যেন খেয়ে শেষ করলো। ঠোঁট মুছে চোখ মুখ কুঁচকে বলল,, উহম্ একদমই মজা নাই ইছছ্।” এনোন তার হাত থেকে গ্লাস টেনে নিয়ে বলে,, বেশি কথা বলবা না।” বলেই সে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।
________________________
পর্দা ভেদ করে মিষ্টি রোদ মুখে পড়তেই নড়েচড়ে ঘুম ভাঙল নিনির। উঠে কিছুক্ষণ ভূতের মতো বসে থাকল তারপর ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমে আসলো। দেখলো এনোন নাস্তা রেডি করে রেখেছে নিনি বিরক্ত হয়ে বিড়বিড় করে বলে,, এসব করার দরকার কি? আমি কি আঁতুড় যে নাস্তা বানাতে পারবো না?” বলে সে বসে নাস্তা খাওয়া শেষ করল। নিনি রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসতেই এনোন এসে বলে,, রেডি হোও।” নিনি অবাক হয়ে বলে,, কেন?”
এনোন পকেটে হাত ঢুকিয়ে বলে,, তুমি এখন থেকে আমার সাথে অফিস যাবা।” নিনি না বুঝে বলল,, মানে? মানে কেন?” এনোন নির্লিপ্ত কন্ঠে বলে,, তোমার তো কোন বিশ্বাস নাই কাউকে ঘরে ঢুকিয়ে ডাকাতি করাই দিবা, এ রিস্ক আমি নিতে চাচ্ছি না সো গেট রেডি!” বলে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ায়। নিনি ঠায় দাঁড়িয়ে রইল তাকে যে অপমান করল তা বেশ ভালো বুঝতে পারলো নিনি। রাগে গা জ্বলজ্বল করে উঠলো তার মেজাজ খিঁচড়ে ধরলো। সে জোরে জোরে হেঁটে নিজের রুমে চলে যায়।
দুজনেই রেডি হয়ে গাড়িতে গিয়ে বসে এনোন একপলক তাকালো নিনির দিকে। তার পর চোখ সরিয়ে গাড়ি র্স্টাট দিল। নিনি কাঁচের গ্লাসের মাধ্যমে বাহিরে দেখতে লাগল। এনোন ফাঁকে ফাঁকে তার দিকে বার বার তাকাচ্ছে এবার নিনি সীট বেল্ট লাগালো। কিছুক্ষণ এর মধ্যেই অফিস পৌঁছালো ওরা। এনোন নির্দিষ্ট স্থানে একপাশে গাড়ি পার্ক করলো। নিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল চারপাশে। এনোন হালকা শব্দ করে তাকে বের হওয়ার জন্য জানালো।
এত বড় অফিসে ঢুকে নিনি হা হয়ে গেল। এত বড় অফিসের মালিক এনোন! বাহ্! খুব সুন্দর অফিস। এসব মনে মনে বলল নিনি। এনোন ওর দিকে তাকাতেই দেখে নিনি ঠোঁট জোড়া ফাঁক করে হা করে অফিস দেখছে এনোন তার কানের কাছে এসে আস্তে করে বলে,, মুখ বন্ধ করো ইডিয়েট!” সাথে সাথে মুখ বন্ধ করল নিনি। এনোন তুচ্ছ ভাবে তাকায় তারপর নিজের কেবিনের দিকে পা বাড়ায়। কেবিনে ঢুকতেই নিনি আরো বেশি অবাক হয় কারণ কেবিনটি বেশ পরিস্কার ও সুন্দর করে সাজানো। এনোন ব্লেজার খুলে সোফায় রেখে নিজের চেয়ারে বসে ল্যাপটপ খুলল। নিনি হেঁটে হেঁটে পুরো রুমে ঘুরছে ও ভালোভাবে দেখছে এনোন কিছুক্ষণ পর পর আড়চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। হঠাৎ ই এনোনের কল আসাতে সে ব্লেজার নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। নিনি ফিরে তাকায় তারপর আবার নিজের কাজে মনোযোগ দেয়।
পাক্কা দুই ঘন্টার মিটিং শেষ করেই দম নিয়ে কেবিনে ঢুকে এনোন। ঢুকার সাথে সাথেই সে চরম মাত্রায় অবাক হয়ে যায়। নিনি তার চেয়ারে পায়ের উপর পা তুলে বসে নড়েচড়ে ওপাশে ঢং করছে। কানের কাছে চুল গুলো আঙুলে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে নায়িকাদের মতো নাটক করছে আর স্টাইল ভাবে আপনাআপনি কথা বলছে। এনোনের মেজাজ ক্ষিপ্ত হয়ে যায় তার অনুপস্থিতিতে সে এসব করছে!
এনোন কাছে এসে তার চেয়ার নিজের দিকে ঘুরিয়ে রাগান্বিত স্বরে বলে,, How dare you… তুমি আমার চেয়ারে বসলা কোন সাহসে?”
নিনি তার কথা গায়ে মাখলো না টেবিলে কনুই ভাঁজ করে ঠোঁটের কোণায় আঙুল রেখে পাত্তা না দিয়ে বলল,, আমার অনেক সাহস আছে আপনি আমার সাহস দেখলেন কই?” এনোনের কপাল কুঁচকে আসে। নিনি এসব বলে উঠে এনোনের অনেকটা কাছে এসে দাঁড়ায় বলে,, আমার সাথে উচ্চস্বরে কথা বলবেন না একদমও, নাহলে আমি কি জিনিস সেটা ভালোভাবেই বুঝিয়ে দিব আপনাকে।” এনোন ও কিছুটা উচ্চস্বরে বলে,, তুমি…।” পুরো কথা শেষ হওয়ার আগেই নিনি আবারো বলল,, Keep your voice down Mr. Enon. বলে সে তুচ্ছ ভাবে তার দিকে আগাগোড়া তাকিয়ে পাশ কেটে চলে যায়। এনোন ভেবাছেকা খেয়ে গেল।
এর আবার কি হলো নতুন করে?

চলবে…

[ আমি মোটামুটি ভালোই আছি। এতদিনের জন্য আজকে বড় পর্ব দিলাম। এ পর্বে আপনাদের মতামত জানতে চাই। ]

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।