জেনেভাতে সকাল দশটা। হসপিটাল থেকে সুহৃদকে নিয়ে বাসায় ফিরল নামী৷ সঙ্গে অ্যালেন। সুহাস ফিরে গেছে হোটেলে। লম্বা একটি শাওয়ার নিয়ে চটজলদি ছেলের কাছে ফিরবে। এদিকে সৌধর মন বিচলিত হয়ে আছে খুব৷ পরশু রাতে দুঃস্বপ্ন দেখেছিল সে৷ সিমরানকে নিয়ে। তীব্র জ্বরে বিছানায় শুয়ে কাতরাচ্ছে সিমরান। সুশ্রী মুখটা বিবর্ণা।
মুরুব্বিরা বলেন, স্বামী-স্ত্রীর মাঝে খুব বেশি মিল, মহব্বত থাকলে তাদের মধ্যে একজন যদি আল্লাহর ডাকে পরপারে চলে যায়। তাহলে অপরজনের স্থায়িত্বও এই পৃথিবীতে খুব বেশি দীর্ঘ হয় না। এমনটা তারা বলেন, তাদের অভিজ্ঞতা থেকে। উদয়িনী চলে গেছে আজ দেড় বছর। আজ আকস্মিকভাবে সোহান খন্দকারও পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করল।
সুজা চৌধুরী অফিস ঘরে। আকস্মিক খবরটা শুনে অত্যন্ত ব্যথিত হলেন। ছোটো ভাইকে আগে পাঠিয়ে নিজেকে তৈরি করলেন ঝটপট৷ এরপর বডিগার্ড নিয়ে গাড়িতে চড়ে ফোন করলেন স্ত্রীকে। আদেশ দিলেন, ‘ ড্রাইভার রেডি। ছোটো বউমাকে নিয়ে চটজলদি বেরিয়ে পড়ো। ‘ তানজিম চৌধুরী বোরখা পড়ে অপেক্ষা করছিলেন।
হসপিটালে সিমরানকে রাখা হলো তিনদিন। চব্বিশ ঘন্টা অক্সিজেন চলে। এরপর স্যালাইন দিয়ে রাখা হয়। কারো সাথে কথা বলে না সে। নিশ্চুপ তাকিয়ে থাকে। মাঝেমাঝে দৃষ্টিজোড়া চঞ্চল হয়ে উঠে। চারপাশে তাকিয়ে কী যেন খুঁজে। পরোক্ষণেই উতলা মন হতাশ হয়। মুখশ্রী স্থবির হয়ে যায়। তানজিম চৌধুরী আর নিধি সর্বক্ষণ পাশে আছে ওর।
লিভিং রুমে মামা, মামি আর নানুমনি বসে ছিল। সদর দরজা পেরিয়ে সেখানে উপস্থিত হলো সৌধ, সুহাস, নামী। সৌধ সবাইকে সালাম দিয়ে যতটুকু সম্ভব কথাবার্তা বলল। এরপর চলে গেল সিমরানের কাছে। সুহাস নিশ্চল দেহে ঠাঁই দাঁড়িয়ে। পাশে বাচ্চা কোলে নামী৷ দৃষ্টি ছলছল, মুখশ্রী বিমর্ষ। তীব্র আলোড়ন হৃদয়ে। নিজেকে প্রাণপনে শক্ত রাখার চেষ্টা করল নামী।
বাবা, মা হারিয়ে যে তীব্র ধাক্কা খেয়েছে। সে ধাক্কা সহ্য করতে পারছে না সিমরান। তাই এমন একটি সিদ্ধান্ত। অবুঝ আর অতি-আবেগি সিদ্ধান্ত। এ পৃথিবীতে তাকে বাবা, মা’ই নিয়ে এসেছে। অথচ তাদের দু’জনের কেউই আজ বেঁচে নেই। তাদের ভাই, বোনকে ছেড়ে চলে গেছে চিরতরে। আর কখনো ফিরে আসবে না।
মানুষের চারপাশ ঘিরে একটি বৃত্ত থাকে। যা কখনো জটিল। কখনো আবার খুব সহজ আর সুন্দর। ছোট্ট একটি জীবন। যার উত্থানপতন ঘটে বিস্তর। এসব মেনে নিয়েই জীবনের পথে অগ্রসর হতে হয়৷ জীবনের নিয়ম এটাই৷ দুপুরের আগমুহূর্তে আইয়াজ, ফারাহ এসে পৌঁছাল। ছ’মাসের উঁচু পেট নিয়ে ফারাহকে ভেতরে প্রবেশ করতে দেখে প্রায় ছুটে এলো নামী৷
ঠিক যেন সন্ধ্যাদ্বীপ জ্বলছে৷ পাশাপাশি বসে আছে সৌধ, নিধি৷ নিধির গায়ে কাশ্মীরি শাল জড়ানো। হাত দু’টো হিম ধরে যাচ্ছিল বলে আগুনের তাপ নিল। সৌধর পরনে জিন্স প্যান্ট আর চকোলেট কালার ফুল স্লিভ টি-শার্ট। দৃষ্টি নত। ওরা কেউ একে অপরের দিকে তাকিয়ে নেই। নিধির দৃষ্টি সম্মুখে পুড়তে থাকা কাঠগুলোতে। সৌধর দৃষ্টি নত।
রাত গভীর হচ্ছে। একে-অপরকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে ঘুমাচ্ছে ওরা৷ গভীর রাত। সুখসুখ তন্দ্রায় যেন বিমোহিত একাত্মায় দুই শরীর৷ শ্রান্তিহর সৌধর বুকে মুখ লুকিয়ে সিমরান৷ ধীরেধীরে খিদের ভাব হয়। পেটটা চুঁইচুঁই করে৷ ঘুম ছুটে যায় আকস্মিক। সুঠামদেহী পুরুষটি তার বলিষ্ঠ একজোড়া হাত দিয়ে বউকে গভীর বন্ধনে আবদ্ধ করে রেখেছে। ঘুমাচ্ছে বেঘোরে।
ভয়ে বুক ঢিপঢিপ করছে নামীর। নিজেকে চোর চোর লাগছে। চোরেরা কীভাবে চুরি করে? ঠিক কতখানি সাহস, কত বড়ো বুকের পাটা থাকলে চোরেরা চুরি করতে পারে? ভেবেই শরীর ঘেমে উঠল। চুরি করে সামান্য বরের পিছু নিয়েছে। এতেই তার অবস্থা যাচ্ছেতাই। হঠাৎ ভ্রু কুঁচকে গেল। সুহাস তো বাবা, মায়ের ঘরে যাচ্ছে!