লিভিং রুমে মামা, মামি আর নানুমনি বসে ছিল। সদর দরজা পেরিয়ে সেখানে উপস্থিত হলো সৌধ, সুহাস, নামী। সৌধ সবাইকে সালাম দিয়ে যতটুকু সম্ভব কথাবার্তা বলল। এরপর চলে গেল সিমরানের কাছে। সুহাস নিশ্চল দেহে ঠাঁই দাঁড়িয়ে। পাশে বাচ্চা কোলে নামী৷ দৃষ্টি ছলছল, মুখশ্রী বিমর্ষ। তীব্র আলোড়ন হৃদয়ে। নিজেকে প্রাণপনে শক্ত রাখার চেষ্টা করল নামী। আড়দৃষ্টিতে তাকাল সুহাসের পানে। দেশের মাটিতে পা দেওয়ার পর পরই সত্যিটা জানানো হয় সুহাসকে। বেচারা বিশ্বাস করেনি৷ আসলে এই নির্মম সত্যিটুকু বিশ্বাস করার সাহস হয়নি ওর। কিন্তু সত্যিটা তো আর অস্বীকার করা যাবে না। অস্বীকার করা গেলেও তা মিথ্যা হয়ে যাবে না৷ উপস্থিত সবাই নির্বাক। সুহাস তার অবিশ্বাস্য, রক্তিম চোখ দু’টো নানুমনির পবিত্র মুখপানে স্থির রেখে কয়েক পা এগুলো। লম্বাটে, বলিষ্ঠ শরীরটা আচমকা ছেড়ে হাঁটু ভেঙে বসল সামনে। নানুমনি হাত বাড়াল। নাতির মাথায়, মুখে বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
‘ মৃত্যুতে আমাদের কোনো হাত নাই নানাভাই৷ তুমি নিজেকে সামলাও। তোমার এখন অনেক দায়িত্ব। বাবা, মায়ের ফেলে যাওয়া সব দায়িত্ব এবার তোমাকে নিতে হবে৷ ‘
লাল টকটকে ফ্যাকাশে মুখটা স্থবির হয়ে তাকিয়ে। কান্না উপচে আসছে। কিন্তু ছেলেটা কাঁদতে পারছে না৷ মানুষ অল্প শোকে কাতর হয়। অধিক শোকে হয় পাথর৷ সুহাস আজকের পর কাঁদবে না আর। কাঁদতে পারবে না৷ সে এক মূর্তিমান পাথর। যে ভেতর থেকে একেবারে নিঃশেষ হয়ে গেছে। তীব্র কষ্টে কান্নাটা গিলে ফেলে অসহায়, বেদনার্ত কণ্ঠে সুহাস বলল,
‘ আমি এতিম হয়ে গেলাম নানুমনি! যারা আমাকে এ দুনিয়ার আলো দেখাল তারা কেউ নেই। আমি এই সত্যিটা কীভাবে মেনে নিব? আমি আমার বাবাকে শেষবারের মতো দেখতে পারলাম না! একটাবার ছুঁতে পারলাম না। আমার মতো হতভাগা কেন এ পৃথিবীতে জন্মেছিল বলতে পারো? ‘
রক্ত লাল ওই চোখ বেয়ে অশ্রু গড়ায় না। কিন্তু গড়াতে চায়৷ ছেলেটা জোর করে আঁটকায় রক্তাশ্রু। এ পৃথিবীটা এখন তার কাঁদার জন্য না। আজ থেকে গোটা পৃথিবীতে লড়াই করে বাঁচতে হবে তাকে৷ বটগাছের মতো ছায়া দিয়ে যেতে হবে শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত। এই ঘর, তাকে ঘিরে থাকা মানুষ, বাবার রেখে যাওয়া দায়িত্ব। সব যেন তার দুকাঁধে চেপে আছে৷ কী আশ্চর্য! বিনা নোটিশে কীভাবে সে একটা গাছে রূপান্তরিত হলো। তার ছায়াতলে এই ঘর, সংসার আর মানুষ গুলো। শরীর কাঁপছে সুহাসের। মাথা তুলে রাখতে পারছে না৷ বুকের ভেতর যেন একশোমণ বোঝা৷ সে শ্বাস নিতে পারছে না। কষ্ট হচ্ছে তীব্র। অথচ বলতে পারছে না৷ সে আর কখনো বলতে পারবে না তার ব্যথা কোথায়, কিসে?
আলাদা দেশ৷ আলাদা আবহাওয়া। অপরিচিত পরিবেশ আর মানুষ দেখে সুহৃদ কান্না শুরু করল। সবারই ধ্যান ভাঙল তখন৷ চকিতে তাকাল নামীর পানে। ওর কোলে থাকা ফুটফুটে বাচ্চার পানে। আচমকা সুহাসের বড়ো মামি বলে উঠল,
‘ আহারে কী সুন্দর বাচ্চা। এই বংশের প্রদীপকে না দেখেই দুলাভাই বিদায় নিল৷ ‘
ছোটো মামির স্বর অন্যরকম৷ সে ক্রুদ্ধ হয়ে নামীকে দোষারোপ করতে করতে বলল,
‘ এখন এসেছ কেন? সংসারটা একেবারে গিলে খেয়ে তারপর আসলা! সেই যখন আসবাই এত নাটক করে সবার কলিজা ঝাঁজরা করলা কেন? কেমন মেয়ে মানুষ তুমি? নিজের জেদের কারণে একটা পরিবারই ধ্বংস করে দিলা৷ ছেলেটা বাবাকে শেষ দেখা পর্যন্ত দেখতে পারল না। নিষ্পাপ বাচ্চা আদর পেল না দাদার৷ দুলাভাইও তার বংশধর দেখতে পারল না। ‘
সংসার জীবন খুবই জটিল৷ নারীরা তাদের মনের মতো সংসার গড়ে তুলতে পারলেও সংসারে থাকা প্রতিটি মানুষকে মনের মতো গড়ে তুলতে পারে না৷ ছোটো মামির কথাকে গুরুত্ব দিল না নামী৷ তার কাছে ইম্পর্ট্যান্ট সুহাস আর সুহাসের পরিবার। এর বাইরে কাউকে বা কারো কথাকে সে পাত্তা দেয় না৷ আজ এ পরিবারে সুহাস, সিনু আর সুহৃদ ছাড়া কেউ নেই৷ তাই অন্য কেউ কী বলল? কেন আঙুল তুলল এসব নিয়ে ভাবার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। যে মানুষটা একদিন সম্মান দিয়ে ভালোবেসে এ ঘরে তুলেছিল তাকে। আজ সে মানুষটা আর নেই। তীব্র এক যন্ত্রণায় সেও পুড়ছে। আফসোস নামক শব্দটা তাকেও পীড়া দিচ্ছে। কিন্তু ভাগ্যের ওপর, সৃষ্টিকর্তার সিদ্ধান্তের ওপর তাদের মতো নগন্য মানুষের হাত নেই। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল নামী। সুহৃদকে সামলে রাখতে হিমশিম খেলো। বড়ো মামি এগিয়ে এসে কোলে নিতে চাইল ওকে। সুহৃদ তাকে দেখে আরো বেশি কান্না শুরু করল। নামী অসহায় চোখে তাকাল সুহাসের পানে। সুহাসের মন বিধ্বস্ত। জানে সে তবু একটি ভয় বিঁধছে বুকে। আবারো সুহাস তাঁকে ভুল বুঝবে না তো। অভিযোগ করবে না তো? জেনেভায় যে সম্পর্ক নতুন করে সুর খুঁজে পেয়েছে। তা আবার হারিয়ে যাবে না তো? নামীর প্রতি সবাই অসন্তুষ্ট থাকলেও সুহৃদের কান্নাকাটির জন্য অস্থির হয়ে পড়ল৷ কীভাবে বাচ্চাটা থামবে তা নিয়ে হৈচৈ বেঁধে গেল। নানুমনি বলল,
‘ মনে হয় ওর খিদে পাইছে।’
নামী নিজেও বুঝতে পারল সুহৃদের খিদে পেয়েছে। কিন্তু পরিস্থিতি এমনই যে সে এখন কী করবে ভেবে পেল না৷ সুহাস এ মুহুর্তে তাকে কীভাবে গ্রহণ করবে? এ বাড়িতে তার স্থান কী? অধিকারই বা কতটুকু। এই নিয়ে দ্বিধায় ভুগতে শুরু করল। এমতাবস্থায় অকস্মাৎ উঠে দাঁড়াল সুহাস। রক্তিম চোখে তাকাল নামীর পানে। মুখটা গম্ভীর। বুকের ভেতর ছ্যাঁৎ করে উঠে নামীর৷ সুহাস দুর্বল চিত্তে এগিয়ে আসে। মুখোমুখি হয় ওর। সম্পূর্ণ অচেনা এক কণ্ঠস্বরে বলে উঠে,
‘ নিজের ঘরে যাও। ফ্রেশ হয়ে খাইয়ে ঘুম পাড়াও ওকে। ‘
এরপর তাকায় বড়ো মামির দিকে। আপাততঃ ছোটো মামিকে কিছু বলার নেই। তাই বড়ো মামিকেই বলে,
‘ বড়ো মামি আপনি ওদের সাথে থাকুন আপাতত।’
বড়ো মামি সঙ্গে সঙ্গে নামীকে নিয়ে সুহাসের ঘরে পা বাড়ায়। আর সুহাস স্তম্ভিত মুখাবয়ব নিয়ে যায় তার একমাত্র, আদুরে বোনটির কাছে। তার এখন অনেক দায়িত্ব অনেক। সবচেয়ে বড়ো দায়িত্ব হলো হতভাগী বোনটাকে আশ্বস্ত করা সে আছে। তার ভাই আছে। সেই ছোট্ট বেলা থেকে বাবা, মায়ের অনুপস্থিতিতে যেভাবে ছিল আজো ঠিক সেভাবেই আছে। আর সারাজীবন এভাবেই থেকে যাবে।
.
কিছু মুহুর্তে সান্ত্বনা নামক শব্দটি বড্ড বেশি বেমানান লাগে৷ আজ সৌধর কাছেও বেমানান লাগছে এই শব্দটিকে। নিশ্চল, ফিনফিনে শরীরটা বুকে আগলে বসে আছে সে। পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ বুকটিতে মাথা রেখে ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলছে সিমরান। একেকটা নিঃশ্বাস যেন বহুদিন কেউ আঁটকে রেখেছিল। যা আজ মুক্ত পাখির ন্যায় উড়োউড়ি করছে৷ জমিয়ে রাখা কান্না গুলোও আপন নীড় পেয়ে উপচে বেরুচ্ছে। বুকের মাঝখানটায় শার্ট ভিজে চুপেচুপে সৌধর। চোখ বুজে সে স্থির করল নিজেকে। শান্ত করার চেষ্টা করল সিমরানকে। বলল,
‘ যে কষ্টটা তুমি পাচ্ছ। এটা বোঝার ক্ষমতা তোমার মতো ভুক্তভোগীদেরই আছে। আমি সান্ত্বনা দিচ্ছি না সিনু৷ আমি নির্ভরতা দিচ্ছি। তুমি যা হারিয়েছ তা হয়তো ফিরে আসবে না৷ কিন্তু সৃষ্টিকর্তা তোমাকে সবুর দেবে৷ দু-হাত ভরে পূর্ণতা দেবে। একটু সামলে নাও। মূল্যবান কিছু যেমন হারালে সৃষ্টিকর্তা মূল্যবান কিছু উপহারও দেবেন৷ এটাই জগত জীবনের নিয়ম৷’
বিরামহীন অশ্রু ঝড়ল সিনুর চোখ বেয়ে৷ দু-হাতে খামচে ধরল সৌধর শার্ট। বুকের বা পাশে কপাল ঠেকিয়ে কাঁপা স্বরে বলল,
‘ আমি এতিম হয়ে গেলাম সৌধ৷ আমার বাবা, মা কেউ রইল না, কেউ না। ‘
সৌধ চুপসে গেল। বুকের ভেতর যন্ত্রণা হলো তীব্র।
পরমুহূর্তেই আবার নিজেকে সামলে নিয়ে সিমরানের গালদুটোতে আলতো হাতে স্পর্শ করল। অশ্রুসিক্ত, অসহায় দৃষ্টিজোড়ায় কোমল দৃষ্টি রেখে কপাল ঠেকাল কপালে। দু’হাতের বুড়ো আঙুলে অশ্রু মুছে
নরম সুরে বলল,
‘ নিজেকে এভাবে ভেঙে দিও না বউপাখি৷ তোমার সৌধ আছে তো তোমার কাছে। মাথার ওপর ছায়া হয়ে, পাশে ঢাল হয়ে আর হৃদয়ে প্রশান্তি হয়ে আছে।’
চোখ মেলে তাকাল সিমরান। ওর ভেজা পাপড়ি গুলো থেকে অশ্রু মুছে দিল সৌধ৷ এরপর কপালে চুমু এঁটে বলল,
‘ আমার স্ত্রী অসহায় নয়। আমার স্ত্রী দুর্বল হতে পারে না। তাকে সবার সহায় হতে হবে। তাকে সব পরিস্থিতিতে শক্ত থাকতে হবে। সে এতিম নয়৷ তার বাবা, মা, ভাই, ভাবি আর স্বামী সৌধ চৌধুরী আছে৷ সব আছে তার সব৷ ‘
এ পর্যন্ত বলেই কিঞ্চিৎ আকুল স্বরে বলল,
‘ সিনুপাকনি, আমার আব্বা, আম্মা কি তোমার কেউ নয়? ‘
ফুপিয়ে উঠে সিমরান। নিজেকে কিছুতেই বোঝাতে পারছে না সে। সামলাতে পারছে না কোনোভাবে। সৌধ ওকে বুকে আগলে নেয় আবারো। ওরা একে-অপরের মাঝে খুঁজতে থাকে পরম সুখ, শান্তি। সুহাস দরজায় টোকা দেয়। ধীরেসুস্থে ওরা একেঅপরের থেকে সরে যায়। ভেতরে ঢুকে সুহাস। সিমরান এতদিন নিজেকে শান্ত, শীতল রেখেছিল। এতক্ষণ সৌধর সামনেও বীভৎস ভাবে ভেঙে পড়েনি। কিন্তু সুহাসকে দেখে সে নিজের সব খোলস ছেড়ে দিল। গগনবিদারী এক চিৎকার করল ‘ভাইয়া’ ডেকে। সুহাস ছুটে এলো নিমেষে। বোনকে জাপ্টে ধরল বুকে। ভাইয়ের বুকে মুখ গুঁজে হাউমাউ করে কাঁদল সিমরান। সৌধর দেহের আপাদমস্তক কেঁপে উঠল সেই কান্না দেখে। বিস্ময়াপন্ন হলো বিমূঢ় মুখের শক্তরূপী সুহাসকে দেখে। ভাইবোন দু’জনকেই বুকে আগলে ধরল সে। ক্ষীণ স্বরে সুহাসকে বলল,
‘ আই এম সরি দোস্ত। ‘
সৌধ যখন জানতে পারে সোহান আংকেল আর নেই। তখন কারো সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছিল না৷ এরপর তার আব্বা সুজা চৌধুরী নিজেই তার সঙ্গে যোগাযোগ করে। সৌধ চেয়েছিল, সুহাসকে কিছু না জানিয়ে যতদ্রুত সম্ভব ওকে নিয়ে বাংলাদেশে চলে আসবে৷ সোহান আংকেলের জানাজা পড়ে দাফনে অংশ নেবে৷ কিন্তু নামীকে সহ নিয়ে যাওয়া নিয়ে জটিলতার সম্মুখীন হতে হবে। সুহাস নামীকে ছাড়া যাবে কিনা তা নিয়েও সন্দেহ রয়ে যায়৷ এদিকে সুজা চৌধুরী দাফনে দেরি করতে নারাজ৷ সে সৌধকে বলে, মৃত ব্যক্তিকে যত দ্রুত সম্ভব জানাজা পড়িয়ে দাফন করতে হয়৷ হাদিস তুলে ধরেও সৌধকে বোঝায় সুজা চৌধুরী। মা, বাবা দুনিয়াতে নেই। বউয়ের সঙ্গেও সম্পর্কে ফাটল। যারা চলে গেছে তাদের তো আঁকড়ে ধরা যাবে না আর৷ তাই যারা আছে তাদের আঁকড়ে ধরেই বাঁচতে হবে। আব্বার সে কথা মেনেই সুহাসকে ওদেশে কিচ্ছু জানায়নি সৌধ৷ দেশের মাটিতে পা রেখেই সবটা অবগত করেছে। সুহাস এ নিয়ে অবশ্য কাউকে দোষারোপ করল না শুধু নিজের ভাগ্যটুকু ছাড়া৷
.
.
তিনদিন পর:
মন মেজাজ ভালো নেই ফারাহর। সোহান আংকেলকে শেষবার দেখতে পারেনি সে। বিষয়টা নিয়ে ডিপ্রেশনে ভুগছিল৷ কত চেয়েছিল একবার যাবে দেখতে। শাশুড়ি আর স্বামীর আপত্তি থাকায় যেতে পারেনি৷ সবচেয়ে বড়ো বাঁধা শাশুড়িই দিয়েছে। গর্ভবতী নারীদের নাকি মৃতমুখ দেখতে নেই। স্ত্রীর প্রতি, সন্তানের প্রতি আইয়াজ ভীষণ দুর্বল। তাই মায়ের কথায় ভয় পেয়ে সাহস করেনি নিয়ে যাওয়ার। নামী, সুহাস বাংলাদেশে এসেছে। তাদের একমাত্র সন্তান সুহৃদকে নিয়ে। প্রিয় বান্ধবীর ওপর শত অভিমান থাকলেও মনটা ভীষণ ছটফট করছে ফারাহর। একছুটে চলে যেতে ইচ্ছে করছে সুহাসদের বাড়ি। ছোট্টসোনাকে আদর করতে মনে আকুলিবিকুলি করছে। নিজের সেই অনুভূতি গুলো আইয়াজকে বললে সে রাজি হলো না৷ ফারাহ তাই অভিমান করে ঘরে এসে শুয়ে পড়ল। এরপর আর আইয়াজের সাথে কথা বলেনি সে। আইয়াজ কত চেষ্টা করল কথা বলার। বলল না। খাবারদাবারেও অরুচি ধরে গেল ফারাহর৷ খেয়াল করে ডিপ্রেশনে চলে গেল৷ মায়ের কাছে গিয়ে বলল,
‘ আমি ফারাহকে নিয়ে একবার টাঙ্গাইল যেতে চাই মা। কয়েকদিন বেড়িয়ে আসি ওখান থেকে। ‘
মা আশ্চর্য মুখে তাকাল৷ বিরক্তি প্রকাশ করে বলল,
‘ তোর বউ তো দেখি বড্ড ঘাউড়া। এই অবস্থায় না বেড়ালে তার চলবে না? আর তো কয়টা মাস। তারপর তো সে মুক্ত। এটুকু ধৈর্য্য সহ্য হচ্ছে না? বেশ, যা খুশি কর৷ কোনো বিপদ ঘটলে আমাকে বলতে পারবি না, তুমি তো না করো নাই মা। ‘
শাশুড়ির কথা স্পষ্ট শুনতে পেল ফারাহ৷ এমনিতেই মন, মেজাজ ভালো নেই। অমন কথা শুনে মন ঘেঁটে গেল আরো। শান্ত মেজাজি সে সহসা উত্তপ্ত হয়ে উঠে ডাকল আইয়াজকে,
‘ আমি কোথ্থাও যাব না আয়াজ। ‘
এ প্রথম ফারাহর অমন ক্ষোভ মিশ্রিত কণ্ঠ শুনে অবাক হয়ে গেল শাশুড়ি। আইয়াজের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ দেখছিস দেখছিস তোর বউয়ের গলা? ‘
ঘর থেকে ফারাহর কান্নার শব্দ শোনা গেল। আইয়াজ আহত গলায় বলল,
‘ প্লিজ মা চুপ করো। ওর এই অবস্থায় তুমি এভাবে রাগ দেখিয়ে কথা না বলে একটু মোলায়েম সুরেও তো বলতে পারো। আমি জানি তুমি আমাকে ভালোবাসো, আমাদের ভালো চাও৷ তাই আদেশ, নিষেধ করো। আমার রিকোয়েস্ট মা, তুমি সেসব একটু বিনয়ী হয়ে করো। আর আমি ফারাহকে নিয়ে সুহাসদের ওখানে যাবই। ওর দেখভাল, সেফটি সবটা আমার ওপর ছেড়ে দাও। বউ আমার, বাচ্চা হবে আমার। ওদের সম্পূর্ণ দায়ভারও আমার। তুমি শুধু রাগ না করে আমাদের জন্য দোয়া করো। ‘
একশ্বাসে কথাগুলো বলে ঘরে এলো আইয়াজ৷ ফারাহ জেদি স্বরে বলল,
‘ আমি কোথাও যাব না। যাব না মানে যাব না। ‘
আইয়াজ ওর চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল,
‘ রাগ করে না৷ কী কী নিতে হবে বলো গুছিয়ে দিচ্ছি। আমরা কাল বেরুবো। ‘
‘ বললাম না যাব না? ‘
‘ আমি বললাম তো তোমাকে নিয়ে যাব। ‘
ফারাহ চ্যাঁচিয়ে উঠায় আইয়াজ ধমকে উঠল। ফলশ্রুতিতে চুপসে গেল ফারাহ৷ মাথা নত করে অশ্রু বিসর্জন দিল। আইয়াজে ওর থুতনি ছুঁয়ে মুখ উঁচু করে চোখের পানি মুছে দিয়ে কপালে চুমু দিয়ে বলল,
‘ কাঁদে না। অবাধ্যতা করে না। ‘
ফারাহ চোখ তুলল না৷ আইয়াজ ওর সারা মুখে আদুরে স্পর্শ দিয়ে বলল,
‘ কথা শুনো বউ। কাঁদে না৷ বেবিরা কষ্ট পাচ্ছে। উহুম কাঁদে না৷ ‘
বলতে বলতেই হাঁটু মুড়িয়ে বসল। ফারাহর পেট বরাবর কান পেতে বলল,
‘ দেখেছিস তোদের মা কেমন ছিঁচকাদুনে? তোরা কি কাঁদবি শুধু আয় একবার৷ মায়ের কান্না দেখতে দেখতেই নিজেদের কান্না ভুলে যাবি। ‘
চুপ করে ছিল ফারাহ৷ শেষ কথা শুনে হেসে ফেলল কিঞ্চিৎ। তার সব দুঃখ সুখে, সব কান্নাকে হাসিতে পরিণত করার অসম্ভব ক্ষমতার অধিকারী আইয়াজ। নিজেকে শান্ত করল সে। এরপর স্বামী-স্ত্রী উচ্ছ্বসিত মনে নিজেদের ব্যাগপত্র গুছাতে শুরু করল।
.
একটু একটু করে দিন এগিয়ে চলবে। মলিন হবে সকল বিষণ্ন বেদনা৷ তবু দিনশেষে রয়ে যাবে একচ্ছত্র দীর্ঘশ্বাস। সুহৃদকে নিয়ে নিজের ঘরে বসে আছে সিমরান। সুহৃদ নিত্য, নতুন খেলা দিয়ে খেলছে। আর সে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মাঝে মাঝে আদর দিচ্ছে আব্বু, আব্বু ডেকে। নামীর সঙ্গে কথা বলে না সে৷ মন থেকে আগ্রহ পায়নি কথা বলার। তাই বলেনি৷ যদি মন থেকে আগ্রহ পায় কখনো তবেই বলবে। নামী সেধে এসেছিল কয়েকবার। সে এড়িয়ে চলে এসেছে। সুহৃদকে তার কাছে নিয়ে এসেছে সৌধ৷ মানুষটা তাকে ভালো রাখার, খুশি করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। একটুক্ষণের জন্যও একা ছাড়ছে না। মাত্রই বেরুলো। হয়তো তার বাড়িতে যাবে। তাই সুহৃদকে কাছে দিয়ে গেল। সুহৃদের সঙ্গে সময় কাটাতে কাটাতেই এসে যাবে নিশ্চিত। বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে ওর৷ ভাইটাকে নিয়ে দুঃশ্চিন্তা হচ্ছে। হাসিখুশি, চঞ্চল ছেলেটা কেমন নীরব হয়ে গেল। তারা ভাইবোন কি সত্যি কখনো আর স্বাভাবিক হতে পারবে? এই শোক কি কোনোদিন কাটবে তাদের?
খেলতে খেলতে হঠাৎ কান্না শুরু করল সুহৃদ। কান্না শুনে ছুটে এলো নামী৷ সিমরানের কান্না থামাতে পারছিল না৷ তাই নামী হাত পাতলে ওর কাছে দিয়ে নিজে সরে গেল। নামীও আর দেরি করল না। বেরিয়ে এসে ছেলেকে নিয়ে হাঁটতে লাগল বারান্দা দিয়ে৷ নিচ থেকে সুহাস উঠে এলো,
‘ কাঁদছে কেন? ‘
‘ জানি না, ঘুমানোর সময় হয়েছে বলেই হয়তো।’
সুহাস কোলে নিল সুহৃদকে। গম্ভীর গলায় বলল,
‘ বাইরে হেঁটে আসি৷ ঘুমালে নিয়ে আসব। ‘
আর দেরি করল না৷ নিচে নেমে গেল সুহাস৷ নামী হাঁপ নিঃশ্বাস ছেড়ে রুমে চলে গেল। তার মন ঠিক বুঝে উঠছে না সে। সুহাস কি তাকে অপরাধী করে রেখেছে মনে মনে? দিলখোলা ছেলে সুহাস৷ মনের ভিতর গিঁট বেঁধে রাখে না কিছু। মনে যা আসে মুখে বলে দেয় তা৷ চেনা সেই সুহাসের আজ এত পরিবর্তন বুকে হাহাকার তুলছে৷ একঘরে এক বিছানাতে থেকেও যেন বিশাল দূরত্ব তাদের মাঝে। অপ্রয়োজনে একটা কথাও বলে না৷ যতটুকু প্রয়োজন সব সুহৃদকে ঘিরেই। কবে স্বাভাবিক হবে সব, কবে? যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে তা কী দিয়ে পূরণ করবে সে? ঘরে এসে নামী দেখল ওর ফোন বাজছে। স্ক্রিনে সৌধ ভাইয়া নামটি জ্বলজ্বল। রিসিভ করতেই সৌধ বলল,
‘নামী আগামীকাল আইয়াজ, ফারাহ আসবে। আমি নিধিকেও ফোন করে ইনভাইট করে রাখি কী বলো?’
বিষণ্ন মনে এক টুকরো উষ্ণ হাওয়া বয়ে গেল। মৃদু হেসে নামী বলল,
‘ সত্যি! ফারাহ আসবে? হ্যাঁ হ্যাঁ নিধি আপুকেও কল করুন। আপনাদের অনুপস্থিতিতে আপু যেভাবে সবটা সামলেছে, পাশে থেকেছে। একবার মিট করে অন্তত কৃতজ্ঞতা জানানো উচিত। ‘
সৌধ এ ব্যাপারে আর কিছু বলল না। নামীর মতামত টুকু নিয়ে ফোন কেটে দিল। এরপর কিছুক্ষণ ভেবেচিন্তে কল করল নিধির ফোনে। দুপুরের রান্না বসিয়েছে নিধি৷ অর্পণ স্যার অনিরূপকে মুখে মুখে ইংরেজি বর্ণমালা শেখাচ্ছে। দু’বছর পূর্ণ হয়নি অনিরূপের৷ দু’মাস পর হবে। আধো স্বরে এ,বি এই দুটো বর্ণমালা সে বলতে পারে। ছেলেকে পড়ানোর সময়ই ফোনটা বেজে উঠল৷ নিধি ফোনের শব্দ পেয়ে রান্না ঘর থেকেই হাঁক ছাড়ল,
‘ স্যার, ফোনটা রিসিভ করে নিয়ে আসুন। ‘
অচেনা নাম্বার থেকে কল। রিসিভ করে সালাম দিল অর্পণ। একজনের ফোন আরেকজন ধরেছে৷ হোক হাজব্যান্ড। ফোন ধরবে কেন? মেজাজ খিঁচে উঠল সৌধর। পরপরই দমে গেল একটি কথা ভেবে। যদি সিনুর ফোনে কল আসত। সে কী ধরত না? তারা স্বামী-স্ত্রী। লাইফ পার্টনারদের অধিকার সম্পর্কে সে অজ্ঞ নয়৷ নিমেষে শান্ত হয়ে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল। সালাম ফিরিয়ে বলল,
‘ আমি সৌধ চৌধুরী বলছি। ‘
নীরব হয়ে গেল অর্পণ। ব্যস্ত পায়ে রান্নাঘরে ছুটলে সৌধ বলল,
‘ ধন্যবাদ। ‘
নিধিকে ফোন দিতে উদ্যত হয়েও থেমে গেল অর্পণ শিকদার। ধন্যবাদ? এটা কেন বুঝতে পারল না সে। অতীতে যা ঘটেছে সবটাই মিস্টেক৷ এরজন্য আইয়াজ, সুহাস সরি বলেছে তাকে। শুধু সৌধ ছাড়া। সৌধর থেকে অবশ্য সে সরি এসপেক্ট করে না৷ সৌধ ওই ধাঁচের ছেলেই নয়। কিন্তু ধন্যবাদ কেন?
মনের প্রশ্নটি মুখে বলার পূর্বেই সৌধ নিজে থেকেই বলল,
‘ আমার শশুরের মৃত্যুতে পাশে থাকার জন্য। আমার স্ত্রীর অসুস্থতায় সঠিক চিকিৎসা দিয়ে পাশে থাকার জন্য। ‘
‘ ধন্যবাদের কিছু নেই। এটা আমার রেসপনসিবিলিটির মধ্যে ছিল। সিমরান আমার স্ত্রীর প্রিয় বন্ধু সুহাসের বোন, সৌধর বউ। এছাড়াও আমি একজন ডক্টর। ‘
এ পর্যন্ত বলেই নিধির কাছে ফোন দিল অর্পণ। হতভম্ব মুখে নিধি ফোন নিলে সৌধ বলল,
‘ আগামীকাল সুহাসদের বাড়িতে আসার নিমন্ত্রণ রইল। আইয়াজ, ফারাহও আসবে। বন্ধুদের মধ্যে আজিজকেও ফ্রি পেলাম৷ আশা করি তুইও আসবি।’
ক্ষীণ স্বরে সম্মতি দিল নিধি। সৌধ স্মিত হেসে বলল,
‘ রূপকে নিয়ে আসিস৷ সুহৃদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়ে যাবে। ‘
***
ভরসন্ধ্যায় শুয়ে আছে সিমরান। সৌধ এসে পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
‘ অবেলায় শুয়ে থাকতে নেই সিনু। শরীরে রোগ বাসা বাঁধে। দেখি উঠো। সেলিনা আপা কফি আনছেন। একসঙ্গে কফি খাব। ‘
উত্তরে বিস্ময়কর এক কথা বলল সিনু। যা সৌধ কখনো কল্পনাও করতে পারেনি। সে উঠে বসে সৌধর চোখে চোখ রেখে আকুল কণ্ঠে বলল,
‘ আমরা কখনো বেবি নিব না সৌধ প্লিজ। ‘
মাথায় যেন বজ্রপাত ঘটল। আচমকা ওর মুখে তর্জনী চেপে ধরল সৌধ। চোখ রাঙিয়ে শীতল একটি ধমক দিয়ে বলল,
‘ হুঁশশ, আর কক্ষনো যেন এমন কথা বলতে না শুনি। ‘