গত কয়েকদিন ধরে মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। দিন নেই রাত নেই প্রকৃতি মুখরিত হয়ে আছে শ্রাবণ ধারায়। সুহাস, আইয়াজ গতকাল ঢাকায় ফিরেছে। ছুটি শেষ ওদের। ফারাহ আপাতত নামীর সঙ্গে নামীর বাসাতে থাকছে। একমাসের মধ্যে আইয়াজ তার পরিবারকে মানিয়ে আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে ফারাহকে ঘরে তুলবে। আজ আইয়াজ আর সৌধর নাইট ডিউটি।
বছর পেরোয়নি একটাও৷ তবু যেন বহু বছরের তৃষ্ণা। ঠিক এমন করেই তাকিয়ে আছে সৌধ। যে তাকানোতে বাইরে থেকে প্রকাশ পাচ্ছে তীব্র ক্রোধ, অভিমান। অথচ ভেতরে আকুলতায় ভরা। ব্যাকুলতায় গাঁথা। পুরুষালি দেহের ভিতর থাকা ছোট্ট হৃদযন্ত্রটা ছটফট করছে ভীষণ। ক্রোধান্বিত দৃষ্টি দু’টো নির্মল হতে চাইছে ক্ষণে ক্ষণে।
কোনোমতে শরীরে টি-শার্ট জড়িয়ে নিচে নেমে এলো সৌধ৷ দেখতে পেল সুহাস, আইয়াজ আর প্রাচীর আতঙ্কিত মুখ। সুহাস ঢাকাতে ছিল, গতকাল সকালেই কথা হয়েছে ওর সঙ্গে। তাই আকস্মিক সুহাসের আগমন সন্দেহ তৈরি করল মনে। আইয়াজ আর ফারাহর গত মাসে আনুষ্ঠানিক ভাবে বিয়ের কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে।
সৌধর মা তানজিম চৌধুরী। সিমরানকে খুব ছোটো থেকে বড়ো হতে দেখেছে। সেদিনের সেই এক রত্তি মিষ্টি মেয়ে সিমরান। চোখের পলকে কতবড় হয়ে গেল৷ সচক্ষে দেখল, বাবা, মা, ভাইয়ের কাছে একরোখা, জেদি তকমা পাওয়া মেয়েটি আদর, ভালোবাসা, যত্ন পেলে কেমন মোমের মতো গলে যায়৷ মিলিয়ে যায় হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো।
সেদিন কথোপকথন শেষ করে গভীর ভাবনায় পড়ে তানজিম চৌধুরী। এরপর বেশ তাড়াহুড়ো করে বাড়ি পাঠিয়ে দেয় সিমরানকে৷ কারণ সে সময় সৌধ, সুহাস ছাড়াও ওদের আরো বন্ধু, বান্ধবী বাড়িতে উপস্থিত ছিল। সিমরান চলে যায়। কেউই টের পায় না, জানতে পারে না সেদিন সিমরানের চৌধুরী বাড়িতে আসার খবর৷ এরপর স্বামীর সঙ্গে পরামর্শ করেন তানজিম চৌধুরী।
গভীর রাত। ধরণিতল বৃষ্টিতে ভিজে চুপ চুপ। থেকে থেকে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। সুহাস ঘুমোচ্ছে বেঘোরে। তার এক হাত নামীর কাঁধ আঁকড়ে, এক পা কোমরে তোলা। বউকে ঠিক কোলবালিশের ন্যায় আঁকড়ে ঘুমোচ্ছে সে৷ ক্ষণে ক্ষণে মুখের ভারিক্কি, উত্তপ্ত নিঃশ্বাস এসে ছুঁয়ে দিচ্ছে নামীর ঘাড়ে এবং কানে। সুহাস গভীর ঘুমে থাকলেও নামীর ঘুম গভীরতায় পৌঁছায়নি।
সৌধ ভেবেছিল উদয়িনী আন্টির সাথে দেখা করবে। শেষ পর্যন্ত দেখা করা হলো না৷ আইয়াজের সাথে কথা হয়েছে ভোরবেলা। সে পরামর্শ দিল, উদয়িনী আন্টি নয় শুধু সিমরানের সঙ্গেই একান্তে কথা বলতে। এই বিয়েতে সুহাস রাজি নয়। রাজি নয় উদয়িনী আন্টিও। সুহাসের বিয়ে যেমন সোহান আংকেল নিজের সিদ্ধান্তে দিয়েছে।
অন্ধকার আছে বলেই আলোর মর্ম বোঝা যায়৷ প্রকৃতির নিয়মেই রাত্রির আগমন ঘটে। তাই বলে কি মানবকূল বিচলিত হয়? নাহ, তারা অপেক্ষা করে প্রভাতের। তারা জানে সন্ধ্যায় যে সূর্য অস্ত যায়। সময়ের চাকা ঘুরে সে সূর্য উদিতও হবে। মানুষের জীবনে সুসময়, দুঃসময়, প্রাপ্তি, অপ্রাপ্তি ঠিক সূর্যাস্ত আর সর্যদয়ের মতোন। আজ দুঃখ পেয়েছ?
প্রকৃতির যৌবন মাস চলছে। আকাশ, বাতাস, মাঠ, মাটি সর্বস্তরই নিজের যৌবন দ্বারা সুবাসিত করে রেখেছে শরৎরানি৷ আকর্ষিত মানব চিত্ত। চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে শুভ্র আলোকরশ্মি আর স্নিগ্ধ আবহাওয়া। প্রকৃতির এই রূপকে ভীষণ ভালোবাসে নামী৷ তার সেই ভালোবাসায় মুগ্ধতা ছড়িয়ে দিল সুহাস৷ জানালো, পরশু তারা রাঙামাটি বেড়াতে যাবে। শুধু তারাই নয় আইয়াজ, ফারাহও যাচ্ছে।
মিসেস উদয়িনী ইজ নো মোড়! ডক্টর উদয়িনী আর নেই৷ দু’টো সন্তান আজ মাতৃহারা। সোহান খন্দকার বিপত্নীক হলেন৷ দুনিয়াতে নতুন প্রাণের আগমনে চারপাশ ঝলমলে হয়ে ওঠে৷ আপনজনেরা ছড়িয়ে দেয় উল্লাস। আনন্দে উদ্ভাসিত হয় সকলের মুখ। আর পুরোনো প্রাণ বিদায় নিলে চারপাশ মলিনতায় ছেয়ে যায়। আপনজনেরা হয় শোকাবহে স্তব্ধ। মুখাবয়বে ফুটে ওঠে বিষণ্ণতা।