আইয়াজ, ফারাহর বাচ্চা দুটো খুবই শান্ত প্রকৃতির হয়েছে। ভাগ্যিস ওরা শান্ত। নয়তো জমজ দুটো সামলাতে হিমশিম খেতো ফারাহ। বিছানায় দুই ভাইকে বসিয়ে তৈরি হচ্ছে আইয়াজ, ফারাহ। বাচ্চারা খেলনা দিয়ে খেলায় মগ্ন। শাড়ি পরায় ব্যস্ত ফারাহ। ওর শাড়ি পারপেল এবং গোল্ডেন কালারের কম্বিনেশন। সুস্বাস্থের অধিকারী সে। ধবধবে ফর্সা শরীরে কী সুন্দর যে মানিয়েছে শাড়িটা! আইয়াজ শুধু তাকিয়েই আছে। লাস্ট কবে ফারাহকে এভাবে দেখেছিল? আপাতত মাথা ঝিম ধরে আছে। তাই মনে করতে পারল না। চশমার আড়ালে থাকা চোখ দুটো শুধু নির্নিমেষে তাকিয়ে রইল। আইয়াজের পরনে ফরমাল শার্ট, প্যান্ট। সাদা শার্টের ওপর গোল্ডেন কালার ওয়েস্ট কটি। তিন বন্ধু প্ল্যান করেই এই ড্রেসআপে তৈরি হয়েছে। এরপর তিন জোড়া কাপল যখন এক হবে। সৃষ্টি হবে এক দারুণ আমেজ।
‘ এই আয়াজ কুঁচি টা ধরে দাও না। ‘
ফারাহর ডাকে সংবিৎ ফিরল আইয়াজের। নাকের ডগায় আসা চশমাটা উপরের দিকে ঠেলে এগিয়ে এলো। সহসা স্মার্ট, শ্যামাঙ্গ পুরুষটির পানে চোখ পড়তেই মনে মনে তিনবার মাশা-আল্লাহ পড়ল ফারাহ। আইয়াজ সাবলীল ভাবে হাঁটু ভাঁজ করে বসল ওর সম্মুখে। ফারাহ মুগ্ধতা ভরে হাসল কিঞ্চিৎ। এরপর সে কুঁচি করল আইয়াজ নিচ থেকে পরিপাটি করে ধরে রইল। সম্পূর্ণ কুঁচি ঠিকঠাক হওয়ার পর উঠে দাঁড়াল আইয়াজ। প্রেয়সীর মুখোমুখি হয়ে বিমুগ্ধ কণ্ঠে বলল,
‘ পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী নারীটিই আমার বউ। ‘
‘ নিজের বউকে সবার কাছেই সুন্দরী লাগে। ‘
‘ কে বলল? অনেক পুরুষের চোখে ঘরের বউয়ের চেয়ে পরের বউ বেশি সুন্দরী লাগে। ‘
‘ তাই বুঝি, এক্সপেরিয়েন্স আছে নাকি সিনিয়র সাহেব? ‘
বহুদিন পর ফারাহর মুখে সিনিয়র সাহেব শুনল আইয়াজ। দারুণ লাগল শুনতে। সেই প্রেমের শুরুতে কী মিষ্টি করেই না ডাকত, সিনিয়র সাহেব শুনছেন? কিন্তু আজ কি খোঁচা মিশে ছিল? নিমেষে জিভ কামড়াল আইয়াজ। মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,
‘ আস্তাগফিরুল্লাহ! কী বলো হুম এসব বাজে কথা। ‘
বলেই দু’হাতে ফারাহর দু কাঁধ স্পর্শ করল সে। মুখ নিচু করে প্রিয় মুখটির ছোট্ট কপালে গভীর চুম্বন এঁটে বলল,
‘ আমার প্রথম, একমাত্র এবং শেষ মুগ্ধতা তুমি প্রিয়তমা সহধর্মিণী। ‘
আবেগাপ্লুত হয়ে হেসে ফেলল ফারাহ৷ দুহাতে আলতো করে জড়িয়ে ধরল প্রিয়তম পুরুষকে। এই ভদ্রলোক তার জীবনে ঠিক কতখানি? তা বলে কয়ে বোঝানো সম্ভব হবে না। এই ভদ্রলোকের স্ত্রী হতে পেরে সে গর্বিত ভীষণ। পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী বউদের মধ্যে অন্যতম সে৷
.
.
চৌধুরী বাড়ির ড্রয়িংরুমটা সুন্দর করে ডেকোরেশন করা হয়েছে। খুব অল্প সময়ে দারুণ আয়োজন। সিমরান নিজেকে যত্ন নিয়ে সাজাতে মশগুল ছিল বলে এসবে নজর দিতে পারেনি৷ নিজেকে পুরোপুরি তৈরি করে নিয়ে দেখল সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে। টনক নড়ল মুহুর্তেই। সন্ধ্যা হয়ে গেল অথচ সৌধ এসে পৌঁছাল না তার কাছে? বুকের ভেতরটায় ছটফট শুরু হলো এবার৷ ঢোক গিলে নীরস গলাটা ভিজিয়ে নিয়ে ফোন করল সৌধকে। রিং হলো কিন্তু রিসিভ করল না। এমন করছে কেন মানুষটা? সে যে আর নিতে পারছে না এসব৷ মন যেন কেমন কেমন করে উঠল৷ সন্দেহের একটা বীজ দাঁনা বেঁধে রইল অন্তরে। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে নিচে নামতে নামতে খেয়াল করল ড্রয়িং রুমটা অন্যরকম সুন্দর লাগছে। ভালোভাবে নজর বুলাতেই মনটা চনমনে হয়ে গেল। এত সুন্দর আয়োজন কে করল? তার শশুর, শাশুড়ি নাকি সৌধ? হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেল। তাহানীকে ডাকল হাঁক ছেড়ে। ব্রাইডাল লুকে সেজে ল্যাহেঙ্গার দুপাশে ধরে প্রিন্সেসের মতো এগিয়ে এলো তাহানী৷ মাথা দুলিয়ে বলল,
‘ সারপ্রাইজ ভাবিপা। ‘
উত্তেজনায় বুক কেঁপে কেঁপে উঠল সিমরানের। তানজিম চৌধুরী এসে বললেন,
‘ সৌধ পৌঁছে যাবে কিছুক্ষণের মধ্যেই। তাই জানালো, তুমি যেন হালকা কিছু খেয়ে নাও। চলো তাহানী আর তোমার জন্য খাবার বেড়েছি। ‘
ভ্রু কুঁচকে ফেলল সিমরান। কিছু খাবে মানে? সৌধ বলেছিল, তাকে নিয়ে বাইরে ডিনার করবে। তাহলে এখন কেন কিছু খেয়ে নেবে? সবকিছু ওরই এমন উলোটপালোট লাগছে? নাকি সৌধ সহ সবাই উলোটপালোট আচরণ করছে ওর সঙ্গে? সবাইকে অদ্ভুত আর অচেনা লাগছে কেন? তীব্র অস্বস্তি নিয়ে
হালকা কিছু খেয়ে নিল সে। এরপর অপেক্ষা করতে লাগল স্বামীর জন্য। অপেক্ষার পালা বাড়তে লাগল। ঘনিয়ে এলো রাত। অথচ সৌধ এসে পৌঁছাল না। বাড়ির সবাই ডিনার করে যে যার ঘরে চলে গেল। সিমরানকে অসংখ্যবার বললেও সে আর কিছু মুখে তুলল না। সারাক্ষণ ছটফট ছটফট করে কাটাতে লাগল। সৌধর ফোন বরাবরের মতোই বন্ধ।
রাত এগারোটা। নিজের ঘরে স্তব্ধ মুখে বসে আছে সিমরান। তাহানী পাশে ভীত মুখে বসে। পরিস্থিতি বুঝে উঠতে পারছে না ছোট্ট ওই মেয়েটিও। ছোটো ভাইয়া এতসব আয়োজন করেও কেন আসছে না? ভাবিপার যে খুব কষ্ট হচ্ছে। আচমকা ফোন বেজে উঠল সিমরানের। স্ক্রিনে সৌধর নাম্বার দেখতেই ঝড়ের গতিতে রিসিভ করল। ওপাশে সৌধর ধীরস্থির কণ্ঠ,
‘ সিনুপাকনি আমি বোধহয় আজ পৌঁছাতে পারব না…’
‘ ওহ! ইট’স ওকে। ‘
বলেই সৌধকে আর কিছু বলার সুযোগ দিল না।
নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে কল কেটে ফোন বন্ধ করে রাখল।
এরপর শান্ত দৃষ্টিতে তাকাল তাহানীর পানে। অনুরোধ করে বলল,
‘ আমি একটু একা থাকতে চাই তাহানী, সম্পূর্ণ একা। তুমি নিজের ঘরে যাবে প্লিজ? তোমার ভাইয়া আসবে না আজ। ঘুমিয়ে পড়ো গিয়ে। ‘
ভাবিপার থমথমে মুখ, রক্তবর্ণ চোখ দেখে ভয়ে শিউরে উঠল তাহানী। মাথা কাৎ করে সায় দিয়ে ধীরপায়ে বেড়িয়ে গেল সে। ও বেড়িয়ে যেতেই উঠে দাঁড়াল সিমরান। তীব্র অভিমান আর সাংঘাতিক ক্রোধ ওর শরীরটা অবশ করে দিচ্ছিল। নিজেকে কোনোরকমে সামলে নিয়ে দরজা আঁটকে দিল। এরপরই শুরু করল পরিচিত এক তাণ্ডবলীলা। তার আর সৌধর গোছাল, পরিপাটি সুন্দর ঘরটায় কতক্ষণ ধ্বংসলীলা চলল। বিছানার চাদর টেনেহিঁচড়ে ফেলে দিল নিচে। ড্রেসিং টেবিলের সামনে থাকা সাজগোজের জিনিস ফেলে ভেঙেচুরে একাকার। আয়নাটা পর্যন্ত অক্ষত রাখল না। বিধ্বংসী সে পরিবেশ সৃষ্টি করে নিজেই আবার ভয় পেয়ে গেল৷ ছোট্টবেলা থেকেই অতিরিক্ত রাগে মাথা ঠিক থাকে না তার। এ স্বভাবটা পেয়েছে মায়ের থেকে। তবে সৌধর সান্নিধ্য পেলে এ পৃথিবীর সবচেয়ে নমনীয় নারীটিই যেন সে হয়ে যায়। সবাই জানে সেদিনের সিমরান থেকে আজকের সিমরানের পরিবর্তনটুকু সম্ভব হয়েছে একমাত্র সৌধর জন্যই। একজন ব্যক্তিত্ববান, সুপুরুষকে ভালোবেসে মেয়েটা কী নিখুঁতভাবে নিজেকে পরিবর্তন করেছে। সেই পরিবর্তনের খোলস যে কোনো মুহুর্তে উঠে যেতে পারে কেবল সৌধর অনুপস্থিতি, অবহেলা আর উপেক্ষাতে। এ খবর কি কেউ জানে? জানে না। তাই বলে শরীরের এমন অবস্থায় সিমরান এসব করবে? সে তো এখন আর একা নেই! একটুও হুঁশ ছিল না একটুও না৷ আকস্মিক আহত সুরে সে বলল,
‘ ওহ আল্লাহ সাহায্য করো আমাকে ‘
সর্বাঙ্গ থরথর করে কেঁপে উঠল মেয়েটার৷ ভয়ে, ব্যর্থ চিত্তে দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। কেউ ভালোবাসে না তাকে কেউ না৷ কেউ নেই তার কেউ নেই। এ পৃথিবীতে সে সম্পূর্ণ একা। এমন অনুভূতিতেই আচ্ছন্ন হয়ে রইল মন, মস্তিষ্ক সবটা জুড়ে৷
.
বারোটা বাজতে আর মাত্র পাঁচ মিনিট৷ বাচ্চারা কেউ জেগে নেই। নামী আর ফারাহ আগে প্রবেশ করল চৌধুরী বাড়িতে। বাচ্চাদের জন্য গুছিয়ে রাখা ঘরটায় গিয়ে শুইয়ে দিল ওদের। এরপর বেরিয়ে এসে তাহানীকে জিজ্ঞেস করল,
‘ সিনু কোথায়? ‘
মুখ ভাড় করে তাহানী জবাব দিতেই নামীর চোখ কপালে। তাহানীকে বের করে দিয়ে রুমে দরজা আঁটকেছে সিনু! মেয়েটার যা সাংঘাতিক রাগ, অভিমান। কান্নাকাটি করছে নিশ্চয়ই। ভাঙচুর এ বাড়ি করার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তাই অতো বেশি টেনশন নিল না। ফারাহকে ভেতরে থাকতে বলে সে বেরিয়ে গেল সৌধদের কাছে। বিবাহবার্ষিকী উপলক্ষে অনেক আগে থেকেই পরিকল্পনা করে রেখেছিল সৌধ। সিমরানকে ঘুণাক্ষরেও কিছু টের পেতে দেয়নি। ও শুধু জানে বিবাহবার্ষিকী উপলক্ষে সৌধ আসবে। বাড়িতে ছোটোখাটো একটি আয়োজন হবে। সে জানে না তার বর দুদিন আগেই এসেছে। উঠেছে তার ভাইয়ার বাড়িতে। এরপর ভাইয়া, ভাবি সহ বন্ধু, বন্ধুর বউ নিয়ে জমকালো আয়োজনের পরিকল্পনা করেছে। শেষ সময়ে বউকে নিরাশ করে আচমকা সারপ্রাইজ দেবার তীক্ষ্ণ পরিকল্পনা। সে অনুযায়ী সবটাই সুন্দর মতোন শুরু করল ওরা।
ড্রয়িং রুমটা এখন কয়েকরকম আলোয় ঝলমল করছে। বাড়ির কাজের লোকেরা মিলে কেক, কোমল পানীয় সাজিয়ে দিয়ে গেল। ঝুমায়না ভাবি আগে থেকেই জানত ছোটোখাটো অনুষ্ঠান হবে। তাই সেও সেজেগুজে উপস্থিত। তাহানী লাইটিং বেলুনের সঙ্গে সেলফি নিচ্ছে। সুহাস গাড়ি থেকে গিটার নিয়ে এলো। আইয়াজ, ফারাহর ফটোশুট করে দিচ্ছে সৌধর কাজিন ব্রাদার। সৌধ মাইক্রোফোনটা লাগিয়ে একটু কথা বলল,
‘ ঠিকঠাক শোনা যাচ্ছে? ‘
নামী ত্বরিত তর্জনী ঠোঁটে চেপে ফিসফিস করে বলল,
‘ জি ভাইয়া, জি ভাইয়া শোনা যাচ্ছে। সব ওকে। ‘
স্মিত হাসল সৌধ। সবাই নিজেদের মতো করে দাঁড়াল আশপাশে। সৌধ গিটার নিয়ে একদম সবার মাঝখানে রাখা ডিজাইনার আসনে বসল। ওরা দারুণ আমেজ নিয়ে উৎসাহ দিল মধ্যমণিকে। দেয়াল ঘড়িতে এক পলক তাকিয়ে কাজিন ব্রাদার ছামির দিকে তাকাল সৌধ। চোখে ইশারায় বোঝাল,
‘ ফটোশুট যেন সুন্দর হয়। ‘
এরপর আরেক কাজিন এনামুলকে মুখ ফুটেই বলল,
‘ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ঠিকঠাক ভিডিয়ো চাই। না পেলেই শব্দহীন মাইর। ‘
অতঃপর সন্তর্পণে চোখ বুজল সুপুরুষটি। গিটারের তালে তালে তুলল সুর গেয়ে উঠল গান,
” আ আ আ
লাবো কো লাবো পে সাজাও
কেয়া হো তুম মুঝে আব বাতাও
লাবো কো লাবো পে সাজাও
কেয়া হো তুম মুঝে আব বাতাও
তোড় দো খুদ কো তুম
বাহো মে মেরী
বাহো মে মেরী
বাহো মে মেরী বাহো মে…”
হাঁটুতে মুখ গুঁজে কাঁদছিল সিমরান। আকস্মিক চিরচেনা সুর শুনে চকিতে মাথা তুলল। শরীরে বিদ্যুৎ ঝটকা লাগল যেন। উলোটপালোট অনুভূতিতে সিক্ত হয়ে উঠে দাঁড়াল সটান। সৌধ এসেছে! ত্বরিত দরজা খুলে প্রায় ছুটে বের হতেই এবার স্পষ্ট শুনল, বুঝতে পারল অনেক কিছুই। সব তাহলে পরিকল্পিত? ওর জন্য সারপ্রাইজ প্ল্যান ছিল! নিজের বোকামিতে লজ্জিত হলো ভীষণ। ছিঃ ছিঃ। কিন্তু তারই বা দোষ কতটুকু? সে কী সিচুয়েশনে আছে মানুষটা যদি জানত। তাহলে কি এতটা প্রেশার দিতে পারত? নিমেষে পায়ের গতি বাড়াল সে। সিঁড়িতে পা ফেলতেই শিউরে উঠল। হায় হায় এ কী পাগলামি করছে? এমন উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটা যাবে না এখন। অতি সাবধানে চলতে হবে। সিঁড়ি বেয়ে নামতে হবে। কোনো তাড়া নেই। ধীরেসুস্থে নামবে সে। আর বোকামি নয় একটুও বোকামি নয়৷
বিধ্বস্ত মুখ। লাল টকটকে চোখ। কান্নাকাটি করে নাকের ডগা পর্যন্ত লাল করে রেখেছে। দুই গালে এখনো অশ্রুজলের দাগ স্পষ্ট। কোমর সমাল লম্বা, খোলা এলোমেলো চুল। মেরুন কালারের বেনারসি পরিহিত রমণী অতি সাবধানে নিচে নামছে। দৃষ্টি তার বিস্মিত, পলকহীন। স্থির কেবল তার গায়ক সাহেবের পানে। আপাদমস্তক সৌধকে দেখল সিমরান। কালো প্যান্ট, সাদা শার্ট পরনে মানুষটার। শার্টের ওপর তার শাড়ির রঙে মিলে যায় এমন রঙা ওয়েস্ট কটি। চোখ দু’টো বন্ধ। কপালে ছড়িয়ে আছে কয়েক ছোটা এলোমেলো ছোটো ছোটো চুল। ফর্সা ভারিক্কি দুগাল ভর্তি ঘন কালো খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে কী যে অমায়িক সুন্দর লাগছে! পুরুষালি পুরো ঠোঁটজোড়া নিগুঢ় আকর্ষণ ধরে গেয়ে চলেছে। সিমরানের উপস্থিতি টের পেয়ে আচমকা চোখ খুলল সৌধ। অর্ধাঙ্গিনীকে দর্শন করেই চট করে উঠে দাঁড়াল। সিঁড়ির ধাপগুলো শেষ সিমরানের। এবার সরাসরি এসে দাঁড়াল সৌধর সামনে। আশপাশে কে আছে, কী আছে কিচ্ছুটি দেখল না। একদিকে চাপা অভিমান অন্যদিকে তীব্র আকর্ষণ আর আনন্দানুভূতিতে আচ্ছন্ন হয়ে রইল। সৌধ থেমে রইল না। থেমে রইল না ওর ঠোঁটজোড়া আর মাতাল করা কণ্ঠস্বর,
” আ আ
তেরেহি এহসাসো মে
ভীগে লম্হাটো মে
মুঝকো ডূবা তিশ্নগী সী হে
তেরী আদাও সে দিলকাশ খতাও সে
ইন লাম্হো মে জ়িন্দেগী সী হে
হায়া কো জ়ারা ভূল জা
মেরে হী তেরহা পেশ আ
খো ভী দো খুদ কো তুম
রাতো মে মেরী
রাতো মে মেরি রাতো মে মেরী
রাতো মে… ”
হাত বাড়াল সৌধ। অবচেতনেই নিজের হাতটা তুলে দিল সিমরান। প্রিয়তম পুরুষটার এ কী সম্মোহনী শক্তি? অবাক না হয়ে পারল না সে। সকলের সামনেই ওর হাতের পিঠে গাঢ় করে চুমু খেল সৌধ। ত্বরিত কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,
‘ হ্যাপি সেকেন্ড ম্যারেজ এনিভার্সারি ডিয়ার। আমার হওয়ার আজ দুবছর তোমার। ভালোবাসি বউপাখি।’
আবেশে চোখ গলে অশ্রু ঝড়ে পড়ল সিমরানের। সৌধ ওকে টেনে নিয়ে এবার সকলের সামনে দাঁড় করালো। সবাই মিলে উইশ করল ওকে। আনন্দে দিশেহারা হয়ে গেল মেয়েটা। তাহানী চিৎকার করে বলল,
‘ ছোটো ভাইয়া গান শেষ করো। ‘
সচকিত হলো সৌধ। ফের বউয়ের চোখে চোখ রেখে গাইল,
”
আ আ
লাবো কো লাবো পে সাজাও
কেয়া হো তুম মুঝে আব বাতাও
লাবো কো লাবো পে সাজাও
কেয়া হো তুম মুঝে আব বাতাও
তেরে জ়্জবাতো মে
মেহকী সী সাঁসো মে
এ জো মেহেক সৈংডলী সী হে
দিল কী পনাহোং মে
বিখরী সী আহোং মে
সোনে কী খোয়াইশ জাগী সী হে
চেহরে সে চেহরা ছুপাও
সিনে কী ধাড়কান সুনাও
দেখলো খুদ কো তুম
আঁখো মে মেরী
আঁখো মে মেরী
আঁখো মে মেরী
আঁখো মে
আ আ
লাবো কো লাবো পে সাজাও
কেয়া হো তুম মুঝে আব বাতাও. ”
.
.
এতবড়ো সারপ্রাইজের জন্য প্রস্তুত ছিল না সিমরান।
তাই সৌধকেও সবচেয়ে বড়ো সারপ্রাইজ উহুম সেরা সারপ্রাইজটা দিল। কেক কাটার পূর্বমুহূর্ত। হঠাৎ সৌধর খুব কাছাকাছি এলো সে। কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
‘ কেউ একজন আসছে ডক্টর, আমরা দুই থেকে তিন হতে যাচ্ছি…! ”
আশ্চর্য মুখে তাকিয়ে রইল সৌধ। এভাবেও কেউ বাবা হওয়ার সংবাদ দেয়? স্তম্ভিত মুখাবয়বে আপাদমস্তক দেখল সিমরানকে। এরপর সচেতন দৃষ্টিতে আশপাশে সকলের পানে তাকাল। সুহাস ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে ওর পানে। বোঝার চেষ্টা করছে হঠাৎ বন্ধু থমকে গেছে কেন? সিনু কী বলছে ওকে? সুহাসের ছোটো ছোটো চোখ দেখে সৌধ ফের সিমরানের পানে তাকাল। কোনোকিছু না ভেবে প্রচণ্ড শক্ত করে জড়িয়ে ধরল সিনুকে। আবেগে ঘনীভূত হয়ে হুহু করে কেঁদে ফেলল সিমরান। সৌধর চোখ দুটোও পানি চিকচিক করছে। অধর কামড়ে হাসছে সে। প্রাপ্তির হাসি। উপস্থিত সবাই নির্বাক। হতভম্ব সুহাস এগিয়ে এলো। থমথমে কণ্ঠে শুধাল,
‘ কী হয়েছে! ‘
নিমেষে সৌধ ছেড়ে দিল সিমরানকে। নিজেকে যথাসম্ভব সামলে নিল সিমরান। সৌধ সুহাসের দিকে এগিয়ে গিয়ে ওকেও জড়িয়ে ধরল। পিঠে চাপড় দিয়ে বলল,
‘ মামা হচ্ছিস দোস্ত, মামা। ‘
মুহুর্তেই ঝড়ের বেগে ছুটে এলো আইয়াজ। পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল সৌধকে। বলল,
‘কংগ্রাচুলেশনস দোস্ত! ‘
সামনে থেকে জড়িয়ে ধরল সুহাস,
‘ কংগ্রাচুলেশনস সৌধ, বাবা হচ্ছিস। ‘
এদিকে নামী, ফারাহও আনন্দিত চিত্তে সিমরানকে অভিনন্দন জানালো। নামীর বুকে মাথা রেখে লজ্জা লুকালো সিমরান। কী একটা শান্ত, শীতল সুখে টগবগ করতে থাকল ওদের প্রত্যেকের হৃদয় আহা!
আইয়াজ, ফারাহর চোখাচোখি হলো তখন। তৃপ্তির হাসি বিনিময় হলো ওদের৷ পুরোনো স্মৃতি, বর্তমান আর ভবিষ্যত সব মিলিয়ে আজ ওরা একাকার।
সুহাস এগিয়ে এলো বোনের কাছে। সিমরান ভাবিকে ছেড়ে এবার ভাইয়ের বুকে মুখ লুকাল। সুহাস ওর মাথায় হাত বুলিয়ে নামীকে বলল,
‘ আমার ছোট্ট পরীটাও মা হবে নামী। ‘
চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে উঠল সুহাসের। আচমকা বাবা, মায়ের মুখটা ভেসে উঠল চোখের পাতায়৷ কেঁপে উঠল বুক। ঠোঁট চেপে কান্না আটকালো সে। নামী ওর অনুভূতি বুঝতে পেরে পাশে এসে দাঁড়াল। কাঁধে হাত রেখে বলল,
‘ বাবা, মা নেই তো কী হয়েছে সুহাস? তাদের দোয়া, ভালোবাসা সবসময় আমাদের ওপর আছে। ‘
সিমরান মাথা তুলল তখন। ভাইয়ের পানে তাকিয়ে সান্ত্বনা দিল,
‘ তুমি, ভাবিপু, সৌধ তোমরা সবাই আছো তো। আমার একটুও কষ্ট হচ্ছে ভাইয়া। আমি তোমাদের মাঝেই বাবা, মাকে খুঁজে পাই। ‘
কান্না গিলে ভাইকে সান্ত্বনা দিল সিমরান। ও সান্ত্বনা দিলেও ওর ভেতরের দুঃখটা টের পেল সৌধ। কাছে এসে পাশে দাঁড়াল। হাত বাড়িয়ে বুকে আগলে ধরল বউকে। অশ্রুসিক্ত দৃষ্টিতে সিনু তাকাল সৌধর পানে। এই মানুষটা তাকে ভালোবাসে জানত৷ কিন্তু সেই ভালোবাসার গভীরতা এতটুকু। বিশেষত্ব এত অসাধারণ ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি। এই মানুষটা জুড়ে এত অসাধারণত্ব কেন? আপাদমস্তক বিশেষত্ব নিয়েই যেন জন্মেছে মানুষটা। যার সঙ্গিনী হয়ে নিজেকে চরম সৌভাগ্যবতী মনে হয়।
পরিশিষ্টঃ
মানুষের জীবন একটাই৷ এই এক জীবনে গল্প তৈরি হয় অজস্র। সে গল্প গুলোর সমাপ্তিও ঘটে। তৈরি হয় নতুন গল্প। এত গল্পের ভীড়ে আবার কিছু গল্প থাকে আমাদের অজানা। কিছু থাকে যার আংশিক মাত্র জানতে পারি। বাকিটা জানতে হৃদয় তৃষ্ণার্ত হয়ে রয়। পরিপূর্ণতা, অপ্রাপ্তি, তৃষ্ণা বা জানা গল্প, অজানা গল্প, আংশিক জানা গল্পের বাকিটা জানার তৃষ্ণা। এসব জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। যে অংশ জুড়ে থাকে অদৃশ্য এক ঢেউয়ের খেলা। মানব জীবনের এক আশ্চর্য তরঙ্গলীলা। ত্রিধারে তরঙ্গলীলা এমনই এক বিস্ময়কর নাম, গল্প, উপন্যাস।
___________________সমাপ্ত______________________
® জান্নাতুল নাঈমা
প্রিয় পাঠক, মাসের পর মাস দীর্ঘ এই উপন্যাসটির সাথে যারা ছিলেন। আমার পাশে থেকে অনেক অনেক সাপোর্ট, ভালোবাসা যারা দিয়েছেন। তাদের প্রত্যেককেই অন্তরের অন্তস্তল থেকে কৃতজ্ঞতা, ভালোবাসা। এই পৃথিবীতে কোনোকিছু যেমন নিখুঁত নয়। আমিও নিখুঁত নই। তেমনি আমার লেখাগুলোও নিখুঁত নয়। অসংখ্য ভুলত্রুটি মিলিয়ে অবশেষে উপন্যাসটির সমাপ্তি টেনেছি। একদিন না একদিন সমাপ্তি তো টানতেই হতো। আজ ত্রিধারে তরঙ্গলীলার সমাপ্তি দিলাম। কিন্তু জানি আমার মতোই আপনাদের হৃদয়েও এটি গেঁথে থাকবে। এটা যদি সত্যি হয় তাহলেই আমি সার্থক। আপনারা যারা পূর্ণাঙ্গ উপন্যাসটি পড়লেন অবশ্যই অবশ্যই পেজে রিভিউ দেবেন। আপনাদের গল্পপ্রেমী বন্ধুদের শেয়ার করবেন উপন্যাসটি। সর্বোপরি ভালোবাসা রইল সবাইকে। ফিরে আসব আবার নতুন গল্প নিয়ে।