হসপিটালে সিমরানকে রাখা হলো তিনদিন। চব্বিশ ঘন্টা অক্সিজেন চলে। এরপর স্যালাইন দিয়ে রাখা হয়। কারো সাথে কথা বলে না সে। নিশ্চুপ তাকিয়ে থাকে। মাঝেমাঝে দৃষ্টিজোড়া চঞ্চল হয়ে উঠে। চারপাশে তাকিয়ে কী যেন খুঁজে। পরোক্ষণেই উতলা মন হতাশ হয়। মুখশ্রী স্থবির হয়ে যায়। তানজিম চৌধুরী আর নিধি সর্বক্ষণ পাশে আছে ওর। যখন নিধি সময় দিচ্ছে তখন তানজিম চৌধুরী বাড়ি চলে যায়। আবার তানজিম চৌধুরী উপস্থিত থাকেন তখন নিধি যায় তার বাসায়। দু’জনেরই সংসার আছে। বাসায় ছোটো বাচ্চা নিধির। সবমিলিয়ে যেভাবে সুবিধা হয় সেভাবেই সব সামলাচ্ছে সকলে মিলে।
সিমরানের মামা, মামিরাও এসে ঘন্টা দু’য়েক সময় দিয়ে গেছে।
সিমরান কথা বলল চতুর্থ দিন। তবু মাত্র সাত শব্দের বাক্য,
‘ নিধি আপু, আমি আমার বাড়ি যেতে চাই।’
ওর মানসিক যা অবস্থা তাতে বিরোধীতা করার প্রশ্নই উঠে না। তাই অর্পণের সঙ্গে কথা বলে ওকে বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়। এতদিন সৌধ আইয়াজ আর নিধির থেকেই ঘনঘন সিনুর আপডেট নিচ্ছিল। আজ আইয়াজও চলে গেল। এমনিতেই ফারাহ আসতে পারেনি। তার ওপর কয়েকদিন কাছে নেই আইয়াজ। সোহান আংকেলের আকস্মিক মৃত্যুর খবর। তাকে শেষবার দেখতে না পারা। সবমিলিয়ে মন খারাপ, দুঃশ্চিন্তা থেকে ফারাহও অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তাই আইয়াজ আর এখানে থাকতে পারল না। ও চলে যাওয়াতে সিমরানের খোঁজ নিতে নিধির কাছেই ফোনকল করতে শুরু করে সৌধ। প্রতিদিন আম্মাকে যদি দু’বার ফোন করে নিধিকে করে দশ থেকে এগারোবার। আম্মাকে যতটা না বোঝানো যায় বন্ধুকে তারচেয়েও অনেক বেশি বোঝানো যায়। তাই তো সৌধ তার অপারগতা, আকুলতা, ভয় সবটা বোঝাতে পারল নিধিকে। আর নিধিও বুঝতে পারল। একদম স্পষ্টভাবেই বুঝতে পারল, সৌধ সিনুকে পাগলের মতো ভালোবাসে। সিনুর প্রতি সৌধর অনুভূতির গভীরতা আজ ভয়ংকর। একটি পবিত্র সম্পর্কের বন্ধন, ভালোবাসা বুঝি এমনই হয়?
যে ভালোবাসা দেখে বিস্ময় জাগে। মুগ্ধতা এসে ভর করে। একরাশ স্বস্তিদায়ক নিঃশ্বাসও ফেলা যায়। আজ নিজেকে নির্ভার লাগছে নিধির৷ বহুদিনের তৃষ্ণা নিবারণ হলে যে প্রশান্তি অনুভূত হয়৷ সেই প্রশান্তি অনুভব করছে। আবেগ, অনুভূতির দাবানলে হওয়া অনুভূতিদের প্রশ্রয় না দেওয়া নিয়ে আজ আর কোনো আফসোস নেই৷ দিনশেষে সৌধর প্রতি সে কৃতজ্ঞ। ভীষণ রকম কৃতজ্ঞ। ছেলেটা তার জন্য অনেক করেছে অনেক। বিনিময়ে পেয়েছে পাহাড়সম দুঃখ, কষ্ট৷ আজ যখন সিনুকে পেয়ে সে কষ্ট, যন্ত্রণা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। তাই সৌধকে সুখী করা, সৌধর ভালোবাসার প্রিয় মানুষটার এই করুণ সময়ে সে পাশে না থেকে দূরে সরে যেতে পারেনি। অন্তত বন্ধুর টানে, বন্ধুর প্রিয়জনকে আগলে রাখার দায়িত্বটা নিজে নিজেই নিয়েছে। বন্ধুত্বের ঋণ কখনো শোধ করা যায় না। নিধিও পারবে না সৌধর ঋণ শোধ করতে৷ কিন্তু জীবনে কোনো পরিস্থিতিতে কেউ তাকে অকৃতজ্ঞ বলে আঙুল তুলতে পারবে না।
সিমরান নিজের জগত, ধ্যানে এতটাই বিভোর যে তার আশপাশে কী হয়ে যাচ্ছে কিচ্ছুটি খেয়াল করে না। ওকে স্বাভাবিক করতে নিধি বারবার কথা বলার চেষ্টা করে। সিমরান নিজের মতোই চুপটি মেরে বসে থাকে। না কাঁদে আর না হাসে৷ তার কিছু ভালো লাগে না৷ কাউকে ভালো লাগে না। এই পৃথিবী, আশপাশে থাকা প্রতিটি মুখ তার কাছে অচেনা আর অজানা।
.
.
সৌধর মুখে সোহান আংকেলের মৃত্যুর খবর শুনে বিশ্বাস করল না নামী৷ আজ তার হসপিটালে ডিউটি ছিল৷ সুহৃদকে সুহাসের কাছে রেখে সে এসেছে হসপিটালে। সৌধ ঠিক এই সুযোগটাকেই কাজে লাগিয়েছে। সৌধর ফ্যাকাশে মুখে, বিমর্ষ কণ্ঠে বলা কথাটি শুনে নামী রাগান্বিত হয়ে বলল,
‘ ছিঃ ছিঃ! এটা আপনাদের প্ল্যান তাই না? নিশ্চয়ই এটা সুহাসের বুদ্ধি? ও কোনোদিন বড়ো হবে না, কোনোদিন ম্যাচিওর হবে না৷ বাবাকে নিয়ে কেউ এমন বলে ছিঃ। আমি ওকে এক্ষুনি ফোন করছি। ছেলের বাবা হয়ে গেল এখনো আক্কেল জ্ঞান হলো না! ‘
ফোন করতে উদ্যত হয়ে আচমকা থেমে গেল নামী৷ হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেল একটি বিষয় স্মরণ হয়ে। সুহাস যতই পাগল থাকুক। তাই বলে বাবা সম্পর্কে এমন একটি কথা বলবে? আর সৌধ ভাইয়া! সে তো এসব এলাউ করার মানুষ নয়। সৌধর পানে সুক্ষ্ম দৃষ্টি নিক্ষেপ করল নামী। আর যা বুঝল তাতে সর্বাঙ্গ শিউরে উঠল। থমথমে মুখে, অবিশ্বাস্য কণ্ঠে বলল,
‘ আপনি মিথ্যে বলছেন ভাইয়া! ‘
‘ আমার রুচিবোধ এতটা নির্বোধ নয়। আর না মস্তিষ্ক বিকৃত। আমি আমার বন্ধু এবং বউয়ের বাবা সম্পর্কে মিথ্যা বলব? অপ্রয়োজনে, খুব বিপদে না পড়লে আমি মিথ্যা বলি না নামী। এই মুহুর্তে আমি কী সিচুয়েশনে আছি তুমি জানো না৷ সিনুর পাশে আমাকে প্রয়োজন, সুহাসকে প্রয়োজন। আর সুহাস যখন জানতে পারবে আংকেল নেই। তখন ওর পাশে তোমাকে প্রয়োজন। আমি কিছু ভাবতে পারছি না নামী৷ আমাকে বাংলাদেশে ফিরতে হবে। সুহাসকে কীভাবে কনভিন্স করব বুঝতে পারছি না। ‘
হৃৎস্পন্দন থেমে গেল নামীর। বিশ্বাস করতে বাধ্য হলো সৌধকে৷ পৃথিবী কখনো নিষ্ঠুর হয় না৷ নিষ্ঠুর হয় পৃথিবীর মানুষ। আর মানুষের ভাগ্য৷ সুন্দরতম এই পৃথিবীতে খুব কম মানুষই পরিপূর্ণ সুখী জীবনযাপন করতে পারে। আজ ভাগ্য ছাড়া কাউকে দোষারোপ করতে পারছে না নামী। নিরুপায় হয়ে ঠাঁই বসে আছে সৌধর মুখোমুখি। চোখ দুটো ক্রমশ লাল হয়ে উঠছে। দেহে কাঁপুনি ধরেছে খুব। অবচেতন মনটা খুব করে চাইছে সুহাসকে। এত দিশেহারা, এত মরিয়া এ জীবনে আর কখনো লাগেনি। তীব্র অপরাধ বোধ হচ্ছে একটি বিষয় ভেবেই, ‘ সুহৃদ তার নানা, নানির ভালোবাসা পায়নি
দাদা, দাদির ভালোবাসাও পেল না। সোহান আংকেল তার বংশধরকে সশরীরে দেখার সুযোগ পেল না৷ একটিবার ছুঁয়ে আদর করতে বুকে টেনে নিতে পারল না৷ ‘ আর ভাবতে পারল না কিছু। দু-হাতে মুখ ঢেকে হুহু করে কেঁদে উঠল।
নামীর ফেরার কথা দুপুরের পর৷ কিন্তু দুপুরের মধ্যেই সে ফিরে এলো৷ সুহৃদকে ঘুম পাড়িয়ে একটি রোমান্টিক উপন্যাস পড়ছিল সুহাস। হঠাৎ নামী এসে ভেজা গলায় ডাকল,
‘ সুহাস? ‘
চকিতে তাকাল সুহাস। অবাক কণ্ঠে বলল,
‘ এত তাড়াতাড়ি! ‘
কথাটা বলেই বই ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। নামীর কাছাকাছি এসে ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করল,
‘ মুখটা এমন লাগছে কেন? এনিথিং রং? ‘
অকস্মাৎ ডুকরে উঠল নামী। অনেকক্ষণ ধরে আঁটকে রাখা কান্নাটা উপচে পড়ল। প্রচণ্ড শক্ত করে জড়িয়ে ধরল সুহাসকে। কিয়ৎক্ষণ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সুহাস। ধীরেধীরে হাত উঠিয়ে বুকের ভেতর আগলে নিল নামীকে। মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করল,
‘ কী হয়েছে নামী? ‘
হতবিহ্বল সুহাস৷ মস্তিষ্ক পুরোপুরি ফাঁকা লাগছে৷ শক্ত খোলসে আবৃত মেয়েটার কী হলো হঠাৎ? এভাবে ভেঙে, মুচড়ে ধরা দেওয়ার মতো মানুষ তো এ মেয়ে নয়। স্তম্ভিত সুহাস নামীকে জড়িয়ে ধরে অনেকটা সময় কাটিয়ে দিল। নামীও কাঁদতে কাঁদতে বুক ভিজিয়ে ফেলল সুহাসের। এক পর্যায়ে নাক টানতে টানতে মাথা তুলে হাত বাড়িয়ে সুহাসের চোয়ালদ্বয়ে স্পর্শ করল। বলল,
‘ বাংলাদেশে ফিরতে হবে সুহাস।’
চমকে উঠল সুহাস। কপট রাগ দেখিয়ে নামীর হাত সরিয়ে দিয়ে বলল,
‘ ওওহ! এমনি কথায় কাজ হচ্ছিল না। তাই ইমোশনালি ব্ল্যাকমেইল করে ফিরে যেতে বলছ? বলেছি না, তোমাকে আর সুহৃদকে না নিয়ে ফিরব না। ‘
চোখ গলে দু’ফোঁটা অশ্রু ঝড়ে পড়ল নামীর। এগিয়ে এসে ফের সুহাসের গাল দু’টো আলতো হাতে ছুঁয়ে বলল,
‘ আমাদের যতদ্রুত সম্ভব নিয়ে চলো সুহাস। ‘
নামীর চোখ দুটো দেখে বুক ধক করে উঠল সুহাসের। বিচলিত হয়ে পড়ল ভীষণ। দু-হাত বাড়িয়ে নামীর গালদুটো চেপে ধরে শুধাল,
‘ কী হয়েছে নামী? ‘
‘ কোনো প্রশ্ন নয় সুহাস। আমাকে তুমি বাংলাদেশে নিয়ে চলো। আমি সুহৃদকে নিয়ে ওর পরিবারে, ওর বাড়িতে ফিরতে চাই। ‘
কাঁদতে কাঁদতে গা কাঁপছিল নামীর৷ সুহাস ওর চোখের জল মুছে দিয়ে কপালে চুমু খেয়ে বলল,
‘ তোমার বাড়ি তুমি ফিরবে। এত কেঁদে বলার কী আছে? বরফ গলেছে এতেই আমি খুশি এত পানি ঝড়াতে হবে না। ‘
কথাটা বলেই ফের চুমু খেল কপালে৷ এরপর তাকাল অশ্রুসিক্ত চোখ দু’টোতে। নাকে নাক ঘঁষল। ভেজা গালে গভীর চুম্বন এঁটে ঠোঁটে আলতোভাবে একবার ঠোঁট মিলিয়ে বলল,
‘ ঝুটঝামেলা শেষ। ভাব, ভাব, ভাব। আমরা মিলে গেছি ওকে? ‘
সুহাসের বাচ্চাসুলভ আচরণ দেখে কান্নার মাঝেও ঈষৎ হাসল নামী। চোখ বেয়ে ঝরল নোনাপানির ধারা। সুহাস সে নোনাপানি মুছে দিতে দিতে বলল,
‘ আহ হা৷ আর কেঁদো না নামী। এবার একটু হাসো। আরো একটু বুকে আসো। ‘
কথাটা বলতে বলতেই গভীর আলিঙ্গন করল ওরা। সুহৃদের ঘুম ভেঙেছে কিছুক্ষণ। নড়েচড়ে উঠে বসে চোখ কচলে বাবা, মায়ের দিকে তাকিয়েছে। দু’জনকে এক সঙ্গে আলিঙ্গনরত অবস্থায় দেখে ওর বাচ্চা মন এত্ত আনন্দ পেল যে খিলখিল করে হেসে উঠল। আচমকা বাচ্চার হাসিতে চমকে উঠল ওরা। বিস্মিত হয়ে একসঙ্গে তাকাল ছেলের পানে। পৃথিবীতে এরচেয়ে সুন্দর দৃশ্য কি ওরা আর দেখেছে? আছে কি এরচেয়েও অধিক সুন্দর দৃশ্য? এ যেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম সুন্দর দৃশ্য। অশ্রুসিক্ত নামী ছেলের থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে সুহাসের পানে তাকাল। মৃদুস্বরে বলল,
‘ আমাদের বাবা। ‘
বুকের ভেতর শীতল শিহরণ বয়ে গেলে সুহাসের। একহাতে নামীর কাঁধ জড়িয়ে অপর হাতে সুহৃদকে উড়ন্ত চুমু ছুঁড়ে বলল,
‘ ইয়েস আওয়ার লিটল ফাদার, নুহাস খন্দকার সুহৃদ। ‘
.
.
কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরের সকাল। সিমরানের ঘুম ভাঙলেও বিছানা ছাড়েনি৷ সে শুয়ে আছে তার বাবা মায়ের ঘরে৷ গায়ে ব্লাঙ্কেট জড়ানো ছিল। হঠাৎ অস্থিরতা অনুভব করল খুব৷ হাসফাস চিত্তে ব্লাঙ্কেট সরিয়ে একধ্যানে তাকিয়ে রইল দেয়ালে টাঙানো ফ্যামিলি ফটোর দিকে। খোলা দরজা পেরিয়ে সৌধ ঘরে ঢুকল ঠিক সেই মুহুর্তেই। ধুকপুক ধুকপুক বুকটা নিয়ে ধীরপায়ে কয়েক পা এগুতেই স্থবির হয়ে গেল তার অর্ধাঙ্গিনীকে দেখে। মনে পড়ে গেল পনেরো,বিশদিন আগের দেখা সেই স্বপ্নটিকে৷ স্বপ্নে দেখা সেই রুগ্ন দেহের বিবর্ণ মুখের সিমরানকে। প্রিয় মানুষকে নিয়ে দেখা স্বপ্ন এভাবেও সত্যি হয়? সৌধ বিড়বিড় করল,
‘আমার স্বপ্ন, এ দৃশ্য মিথ্যে হয়ে যাক।’
নিমেষে চোখ বুজল। তৎক্ষনাৎই আবার খুলল। এগিয়ে গিয়ে বসল তার বউপাখিটার পাশে। হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করল মাথায়৷ পরিচিত, কাঙ্ক্ষিত ভরসা ভরা সে স্পর্শটি পেয়ে সন্তর্পণে চোখ দু’টি বুজে নিল সিমরান। কার্ণিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল কয়েক ফোঁটা উষ্ণ জল।