একটি একটি করে দিন গড়াচ্ছে। পূর্বের চেয়েও অধিক অস্থির হয়ে ওঠছে সুহাস। প্রতিনিয়ত তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে নামীর সাথে কাটানো এক একটা মুহুর্ত। রাত গভীর হলে যখনি দু’চোখের পাতা এক হয় দুঃস্বপ্নেরা ছিন্নভিন্ন করে দেয় হৃদয়। নির্ঘুম বা দুঃস্বপ্ন দু’টোর একটিকে নিয়েই প্রতিটি রাত পার করছে সে। যেন এক রাতজাগা পাখি৷ যার প্রতিটা দীর্ঘশ্বাস ঘুটঘুটে আঁধার মাখা বদ্ধ ঘরে গুমোট বেঁধে থাকে। এক টুকরো আলোর আশায় উতলা রয় সর্বক্ষণ। যেই আলোর নাম নামী। তার হৃদয় কোণে শিহরণ জাগানো সে এক সুহাসিনী।
সোহান খন্দকার কোনোভাবেই বন্ধুর সাথে যোগাযোগ করতে পারেনি। ফলশ্রুতিতে বাবা, ছেলেকে হতাশা জেঁকে ধরেছে। কিন্তু সেই হতাশা তাদের দিক বিভ্রান্ত করতে পারেনি৷ নিয়ম মেনে সুহাস ফিরে গেছে তার কর্মস্থলে। সোহান খন্দকার আগামী মাসে হজে চলে যাবে। ইতিমধ্যে সুহাস ভিসার জন্য আবেদন করতে চেয়েছিল। বাঁধা দিয়েছে আইয়াজ। কারণ সে আর ফারাহও সুহাসের সঙ্গে অ্যামেরিকা যাওয়ার ইচ্ছে পোষণ করেছে। আইয়াজের পাসপোর্ট করা ছিলই। ফারাহর পাসপোর্ট তৈরি হলেই ওরা তিনজন ভিসার আবেদন করবে৷ আইয়াজের এহেন সিদ্ধান্তের পেছনে অবশ্য বন্ধুত্বের চমৎকার একটি যত্ন লুকিয়ে আছে৷ সৌধ একা সুহাসকে অ্যামেরিকায় পাঠাতে রাজি না৷ আবার সে নিজেও সঙ্গ দিতে পারবে না৷ কারণ, হসপিটালে জয়েন করার পর অনেকদিন ছুটি কাটিয়ে ফেলেছে সে৷ সদ্য বিয়ে করেও ছুটি কাটাল। তাই নিজের ক্যারিয়ারের কথা চিন্তা করে আইয়াজকে সঙ্গ দিতে বলেছে। সৌধর সঙ্গে পরামর্শ করে আইয়াজ, ফারাহ অ্যামেরিকার এই সফরটাকে হানিমুন সফর হিসেবেই বিবেচনা করে নিল। নিশ্চিন্ত হলো সুহাসও৷ কারণ নামী তাকে দেখে কীভাবে রিয়্যাক্ট করবে জানে না সে৷ তাই আইয়াজ, ফারাহ সঙ্গে থাকলে জোর পাবে। নামীর অতিপ্রিয় বান্ধবী ফারাহ। তাই বান্ধবী আর তার বরকে নিশ্চয়ই বাবার বাসা থেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে পারবে না? নিজের কৃতকর্মের জন্য ঘাড় ধাক্কা খাওয়ার কিঞ্চিৎ ভয় পেলই সে।
.
.
আগামী সপ্তাহে সৌদির উদ্দেশ্যে রওয়ানা করবে সোহান খন্দকার। বিয়ের পর সৌধ সেই যে চট্টগ্রাম গেছে একবারও বাড়িতে আসেনি। এরজন্য অবশ্য শ্রদ্ধেয় আম্মা আর স্নেহময়ী স্ত্রীকে কৈফিয়ত দিতে কৃপণতা করেনি৷ শশুর আগামী সপ্তাহে চলে যাবে এ জন্য বেশ কিছুদিন ছুটি কাটাবে সে। মেয়ের জামাই হিসেবে আলাদা কিছু দায়দায়িত্ব আছে না? তাই এর আগে অল্প ছুটি নিয়ে বাড়িতে আসাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেনি। তবে দূরত্ব তার বৈবাহিক জীবন বা স্ত্রীর মনে কোনো বিরূপ প্রভাব ফেলেনি। বরং দূরত্বটুকুই
ওদের সম্পর্কে দারুণ এক মিষ্টতা এনে দিয়েছে। শত ব্যস্ততায়ও নিয়ম মেনে দিনের বেলা বারকয়েক ফোন করেছে সৌধ৷ অপ্রয়োজনীয় কথা বলেনি। খবরাখবর নিয়ে রেখে দিয়েছে। কখনো কখনো প্রয়োজনটাও প্রিয় হয়ে ওঠে ভীষণ। যার উদাহরণ সৌধর থেকে পেল সিমরান। এছাড়া রাতটা ছিল অন্যরকম অনুভূতিপ্রবণ। ন’টার পর থেকে দু’জনের ফোনালাপ শুরু হতো৷ কখনো অতি ব্যস্ততায় ন’টার জায়গায় বারোটা বাজিয়ে কল করত সৌধ৷ অনেক সময় ভিডিয়ো কলে থেকে টুকিটাকি কাজ করত দু’জনই। রাতের খাবারটা প্রায় সময়ই একসাথে খেত। ফোনের স্ক্রিনে মুখোমুখি হয়ে। যেদিন দেরিতে কল করত সেদিন দেরিতেই ফোন ছাড়া হতো। ভিডিয়ো কলে কথা অবশ্য কম বলত ওরা৷ কারণ অডিয়ো কলে সিমরান অনেক বেশি সহজ আর প্রাণ চঞ্চল হয়ে কথা বলতে পারে৷
সারাদিন সে কী করেছে, কোথায় গিয়েছে, আজ কী রান্না শিখল, আব্বা, আম্মা তার রান্না খেয়ে কী প্রশংসা করল, ভার্সিটিতে আজ কোন টপিকে ক্লাস হয়েছে, কাল কোন টপিক পড়াবে, ফাইনাল এক্সাম কবে ইত্যাদি যত কথা সব অনায়াসে উগ্রে দিত মেয়েটা। প্রেমের প্রথম ধাপে নারী, পুরুষের মাঝে যেই উত্তেজনা, আবেগ, ভালোলাগার শিহরণ তৈরি হয় তার সবটুকুরই আভাস পাওয়া যায় এই দম্পতির মাঝে৷ সিমরানের যত গল্প সব মন দিয়ে শুনত সৌধ।
ভিডিয়ো কলে দেখাদেখি ছাড়া ওরা দু’জন কিছুই বলতে পারে না। সিমরান এত বেশি লজ্জা পায় যে সৌধ কী বলবে ভেবে পায় না। পাছে অতি লজ্জায় কল কেটে দেয় যদি? দু একবার এমন হওয়াতে সে ভুল আর করেনি৷ মিষ্টি একটা বন্ধুত্ব আর টক, ঝাল অনুভূতিতে দু’জন সিক্ত হয়েছে সর্বদা৷ একে অপরের সঙ্গে সামনাসামনি তেমন সখ্যতা গড়ে তুলতে না পারলেও ফোনকলে ঠিকই গড়ে তুলল। আলাদা একটা অনুভূতি, অভ্যেসে দু’জন ডুবে রইল দু’জনাতে। প্রথম দিকে সৌধ কম কথা বললেও সিমরানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এক সময় সেও তার প্রত্যাহিক জীবনের টুকিটাকি কথা জানাতে শুরু করে৷ সেদিন এক ঘটনাও শেয়ার করছিল। বলেছিল,
” আজ হসপিটালে এক প্যাশেন্ট এসেছিল। জানিস, উনার কী নিয়ে হার্টে সমস্যা হয়েছে? তার আদুরে কন্যা এক ট্রাক ড্রাইভারের সঙ্গে পালিয়ে বিয়ে করেছে। একজন উকিলের মেয়ের জামাই ট্রাক ড্রাইভার। ইগোতে আঘাত পড়েছে ভীষণ। ব্যস এট্যাক করে বসেছে! ”
ঘটনাটি দুঃখজনক হলেও খিলখিল করে হেসে ওঠে সিমরান৷ হাসিটা বোকা বোকা লাগে। চোখ, মুখ কুঁচকে ধমক দেয় সৌধ। কথার ছলে মুখ ফস্কে বলে ফেলে,
‘ হাসছিস কেন? হাসার জন্য বলিনি। বলেছি বর্তমানে সন্তানদের কী অধঃপতন হয়েছে। সেটা জেনে রাখার জন্য। বাচ্চা, কাচ্চাদের প্রতি কেয়ারলেস থাকা যাবে না বুঝেছিস? তারা কোথায় যায়, কী করে, কার সঙ্গে মেলামেশা করে সব খবর রাখতে হবে। ওই মেয়েটা যে ট্রাক ড্রাইভারের সঙ্গে প্রেম করে পালিয়ে গেল, এটাত আর একদিনে হয়ে যায়নি। প্রেম করতে মিনিমাম কিছুদিন সময় লেগেছে। এরপর পালানো, বিয়ে। এতকিছু ঘটিয়ে ফেলল বাচ্চা একটা মেয়ে৷ পড়ে ক্লাস নাইনে। অথচ পরিবারের লোক টের পেল বিয়ে করে জামাই নিয়ে উপস্থিত হওয়ার পর? শোন সিনু, পড়াশোনা শেষ কর। আরেকটু বুদ্ধিশুদ্ধি বাড়া আই মিন ম্যাচিওর হয়ে নে৷ তারপর আমরা বেবি নিব। দু’জন মিলে পর্যাপ্ত কেয়ার করে সন্তান মানুষ করতে হবে। নাবালক, নাবালিকা অবস্থায় এক চুল অবহেলাও করা যাবে না ওদের। বর্তমান সমাজব্যবস্থার যেমন খুবই করুণ অবস্থা। উঠতি ছেলেমেয়েদের মানসিকতাও করুণ বিপর্যস্ত। ‘
সৌধ এ কথাগুলো খুবই সহজ, সাবলীল ভাবে বলে। সিমরান নিশ্চুপ থেকে মন দিয়ে শুনতে শুনতে হঠাৎ থমকে যাক। চোখের পলক ফেলতে যেমন ভুলে যায় ঠিক তেমনি ভুলে যায় নিঃশ্বাস ছাড়তেও৷ কান দু’টোয় উষ্ণ ধোঁয়া বেরুতে শুরু করে৷ শরীর জুড়ে অদ্ভুত শিহরণে টালমাটাল হয়ে রয়। সে জানত সৌধ ভাই একদিন মন থেকে পূর্ণরূপে তাকে ভালোবাসতে পারবে৷ সেটা এত তাড়াতাড়ি হয়ে যানে কল্পনা করতে পারেনি৷ সবচেয়ে বেশি ভালো লাগল, এটা ভেবে যে মানুষ অবচেতনে যা বলে তা একদম সত্যি বলে। পুরোপুরি মন থেকে বলে। ভেতর থেকে না এলে এভাবে কেউ বলতে পারে না৷ নিমেষে বুকে কম্পন সৃষ্টি হয় মেয়েটার। উথাল-পাতাল তরঙ্গে দুলতে থাকে ছোট্ট হৃদয়টুকু। দীর্ঘসময় নীরব থাকলে
চমকে ওঠে সৌধ৷ হুঁশ ফেরে আচমকা। টের পায় সে কী বলেছে? যেখানে আর পাঁচটা স্বামী, স্ত্রীর মতো সম্পর্কই গড়ে ওঠেনি সেখানে সে ডিরেক্ট বাচ্চা, কাচ্চা নিয়ে কল্পনা করে ফেলেছে। তার বউ কি ধাক্কাটা নিতে পেরেছে? নিশ্চয়ই পেরেছে কিন্তু সামলে ওঠবে কখন? আকস্মিক কেশে ওঠে সৌধ। বিব্রত বোধটুকু আড়াল করে মেকি হেসে বলে,
‘ কী ব্যাপার এমন চুপসে গেলি কেন? এভাবে চুপসে গেলে তো চলবে না। সেদিন কী বলেছিলি মনে আছে? আমাকে তোর লাভলেস মনে হয়। আমি নাকি অপ্রেমিক! কত বড়ো স্পর্ধা নিয়ে এ কথা বলেছিস। ভাবতেই তো আমার দম বেড়িয়ে আসতে চায়! ‘
নড়েচড়ে ওঠে সিমরান৷ লজ্জায় মিলেমিশে একাকার হয়ে চাপা স্বরে প্রশ্ন করে বসে,
‘ বাচ্চা, কাচ্চার পরিকল্পনা করলেই বুঝি কেউ প্রেমিক মহাশয় হয়ে যায়? ‘
চোখ কপালে ওঠে যায় সৌধর। ধীরে ধীরে সিমরান স্বাভাবিক হয়ে ওঠছে তার সাথে। লজ্জা পেলেও মুখের ওপর প্রশ্ন করতে শঙ্কিত হচ্ছে না৷ ভালো লাগল বিষয়টা। মুচকি হেসে অনেক কিছুই বলতে উদ্যত হয়েও আবার থেমে গেল। মনে মনে নিজেকেই উত্তর করল,
‘ আমি তোকে মিথ্যা অনুভূতির জালে ফাঁসাতে চাই না ডিয়ার৷ বাচ্চা, কাচ্চার পরিকল্পনা করলেই প্রেমিক হওয়া যায় না৷ স্ত্রীর শরীরে উন্মত্ত হতে পারা পুরুষকেও প্রেমিক বলা অন্যায়৷ আমি তোকে একজন খাঁটি প্রেমিক রূপে ধরা দিতে চাই। ভালোবাসতে চাই নিজের সবটুকু দিয়ে৷ আমি জানি, ভালোবাসার পরিমাপে তোর ওজন অনেক বেশি। আমি তোর চেয়ে বেশি হতে না পারলেও সমকক্ষ রূপে ধরা দিতে চাই। আই ফিল ইউ এণ্ড আই মিস ইউ, দ্যান আই ওয়ান্ট টু লাভ ইউ ইনশাআল্লাহ। ‘
প্রণয়ের সূচনাতেই প্রিয়তমার সর্বস্ব লুট করে নিতে নেই৷ সবচেয়ে বড়ো লুটপাট তো করেই ফেলেছে। অর্ধাঙ্গিনীর হৃদয়টুকুর মালিকানা পেয়ে গেছে। বাকিটা না হয় রয়েসয়েই হোক। হঠাৎ একদিন খুব যত্ন নিয়ে নিজের হৃদয়টাও নতুলে দেবে সে। বুঝিয়ে দেবে সৌধ চৌধুরী শুধু তার হৃদয় চুরিই করেনি নিজের হৃদয় স্বেচ্ছায় বিলিয়েও দিয়েছে। তবে কে মহান হলো? যে চুরি করে সে নাকি যে স্বেচ্ছায় বিলিয়ে দেয় সে? এই প্রশ্ন সিনুকে একদিন করবেই সে। সেই মুহুর্তটুকু তাদের গভীর মিলনবেলায়ও আসতে পারে! তবে মুহুর্তটা এমন হতে হবে যেন মানুষটা শুধু তাকে অনুভবই করতে পারে৷ মুখ ফুটে উচ্চারণ না করতে পারে একটি শব্দও। প্রিয় খাবার যেমন গিলে খেলে তৃপ্তি আসে না। ঠিক তেমনি প্রিয়জনকে আচমকা বশ করে নেয়া বা আচমকা তার বশ মানাতে অনুভূতির গাঢ়ত্ব বা দৃঢ়ত্ব বজায় থাকে না৷ ভালোবাসতে হয় রয়েসয়ে খুব যতনে সংগোপনে।