ত্রিধারে তরঙ্গলীলা | পর্ব – ৫

গাঢ় গোলাপি রঙের ঘাগরার সঙ্গে গাঢ় নীল লেডিস শার্ট পরিহিত নামী। শার্টের দুই হাতা কনুই পর্যন্ত গোটানো। গলায় ঝুলানো গোলাপি রঙের জর্জেট ওড়না। মুখশ্রীতে কোনো প্রসাধনী নেই। ঘন-কালো দিঘল রেশম চুলগুলো পেছন দিকে বেশ উঁচু করে বাঁধা। ছোট্ট কপালটা ছোটো-ছোটো চুলে ঢাকা। মুখে লেগে আছে স্নিগ্ধতা মেশানো মৃদু হাসি। হাতে হলুদ রঙের একটি কফির মগ। সুহাসের অনুমতি পেয়ে ধোঁয়া ওঠা কফির মগ নিয়ে এগিয়ে এলো নামী। বিস্ময়কর ভালো লাগার আবেশে ডুবে গেল সুহাস। নামী কফির মগ এগিয়ে দিতেই সে শ্যামলাটে মুখটায় প্রগাঢ় চাউনি ছুঁড়ে দিল। সন্তর্পণে হাত বাড়িয়ে মগটা নিয়ে গাঢ় স্বরে বলল,
‘ বসো। ‘
নামী লাজুক ভঙ্গিতে মাথা নিচু করে পাশে বসল। কফির মগে কয়েক পল তাকিয়ে থেকে সুহাস প্রশ্ন করল,
‘ তুমি বানিয়েছ? ‘
মৃদুস্বরে জবাব দিল নামী,
‘ হ্যাঁ। ‘
ধূসর রঞ্জিত চোখজোড়ায় মুগ্ধতা ছড়িয়ে পড়ল। ঠোঁটে ঈষৎ হাসি ফুটিয়ে মাথা দুলিয়ে চুমুক দিল কফির মগে। নামী সরাসরি না তাকালেও আড় চোখে তাকিয়ে দেখল চুমুক দেয়ার দৃশ্যটি। অতি যত্নে মগে ঠোঁট ছোঁয়ানো দৃশ্যটি দেখতেই দেহ শিরশির করে ওঠল তার। মনে পড়ে গেল গতরাতে পুরুষালি ঐ গোলাপি ঠোঁটজোড়ার খুব কাছে ছিল সে। কিঞ্চিৎ দূরত্বই ছিল দু’জোড়া ঠোঁটের মিলন ঘটাতে! ধুকপুক করে ওঠল বুক। আড় দৃষ্টিতে তাকালেও খুব নিঁখুত ভাবে তাকিয়ে নামী। গতকাল খেয়াল না করলেও আজ খেয়াল করল, ছেলে হিসেবে সুহাসের ঠোঁটজোড়া বেশিই গোলাপি। অথচ মেয়ে হয়েই তার ঠোঁট অতো গোলাপি নয়। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। ফরসা ত্বকের মানব, মানবিদের ঠোঁট বেশির ভাগ গোলাপিই হয়। শ্যামলা ত্বকের মেয়েদের অমন আকর্ষণীয় ঠোঁট খুব কম হয়। নামী খেয়াল করল, সুহাসের নিচের ঠোঁট উপরের ঠোঁটের তুলনায় মোটা। আর নিচের ঠোঁটের এক কোণায় স্পষ্ট একটি কালো তিল। যা দেখে চোখ দু’টো ধাঁধিয়ে ওঠল। একজন পুরুষও এমন আশ্চর্য সুন্দর হয়? তার ভাবি অযথাই বদনাম করছিল। সুহাস যথেষ্ট সুদর্শন এক যুবক। শুধু তাই নয় সে অন্যান্যদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এই যেমন তার চোখ দু’টো আর পাঁচজন ছেলের মতো নয়। তার চোখ আলাদা। ধূসর বর্ণের ঐ চোখ দু’টোর গভীরতা কিঞ্চিৎ হলেও টের পেয়েছে সে৷ আর সুহাসের নাকটাকে লোকে হয়তো বোঁচা বলবে৷ কিন্তু তার কাছে বোঁচা লাগছে না বরং অদ্ভুত সুন্দর লাগছে। ফরসা, লম্বাটে দেহের হ্যাংলা, পাতলা সুহাসের যখন আরেকটু বয়স হবে। স্বাস্থ্য ভালো হবে৷ দেহে বলিষ্ঠতা আসবে। তখন লম্বাটে মুখে এই নাকটাই গুরুগম্ভীরতা আনবে। এ পর্যন্ত ভেবেই বক্ষঃস্থলে ধুকপুকানির মাত্রা বেড়ে গেল নামীর। সুহাস যেন টের না পায় তাই সে দম আঁটকে ঠাঁই বসে রইল। আচমকা সুহাস বলে ওঠল,
‘ আমার একার জন্যই এনেছ? মানুষ দু’জন অথচ কফি একটা! ‘
সুহাসের মুখে কপট বিস্ময়। নামী অবাক চোখে তাকিয়ে। আমতা আমতা করে বলল,
‘ সমস্যা নেই। আপনিই খান, আপনার জন্য করেছি।’
‘ কফি পছন্দ করো না? ‘
প্রশ্নটি করেই নামীর সর্বাঙ্গে সুক্ষ্ম দৃষ্টি বুলাল সুহাস। বুকের ভেতর অদ্ভুত এক প্রশান্তি ছুঁয়ে যাচ্ছে তার। নামীর বেশভূষা যথেষ্ট মার্জিত। গায়ের রঙ চাপা হলেও মারাত্মক স্মার্ট। বুঝে ফেলল সুহাস। মনে মনে আনন্দিত হলো খুব। একদিক বাদ রেখে বাকি সবদিক দিয়ে মেয়েটা অসাধারণ। সুহাস মনে মনে এসবই ভাবতে থাকল। নামী তার প্রশ্নের জবাবে বলল,
‘ আমি মারাত্মক কফি লাভার। ‘
সুহাস বেশ উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল,
‘ তাই? তাহলে তো একা একা এটা খাওয়া ঠিক হবে না। চলো শেয়ার করে খাই। ইউ নো হোয়াট? উই আর হাজব্যন্ড ওয়াইফ। সো শেয়ার করতেই পারি। ‘
সুহাস কফির মগ এগিয়ে ধরল। নামী হতভম্ব হয়ে তাকাল। ইতস্ততভাবে বলল,
‘ না, না। আপনিই খান আমি খাব না। ‘
ভ্রু কুঁচকে ফেলল সুহাস। বলল,
‘ কী ব্যাপার নামীদামি? দাম দেখাচ্ছ? ‘
‘ ছিঃ ছিঃ কী বলছেন। দাম কেন দেখাব। ‘
আঁতকানো কণ্ঠে বলল নামী৷ সুহাস কপট রাগ দেখিয়ে বলল,
‘ তাহলে সমস্যা কী? ‘
এ কথা বলেই বিস্ময় কণ্ঠে পুনরায় বলল,
‘ অ্যাঁই তুমি কি ভাবছ আমি দাঁত ব্রাশ করিনি? মুখে গন্ধ বেরোচ্ছে? গন্ধ মুখের এঁটো খেতে তাই এত্ত অনীহা। বাব্বাহ তুমি সত্যিই নামীদামি লোক। শোনো নামীদামি, একদম নতুন ঝকঝকে পরিষ্কার ব্রাশ দিয়ে দাঁত ব্রাশ করেছি। বিশ্বাস হচ্ছে না ওয়েট প্রুফ দিচ্ছি। ‘
ত্বরিত নামীর মুখের কাছে মুখ নিয়ে এলো সুহাস। হা করে শ্বাস ছাড়ল নামীর মুখের ওপর৷ পরোক্ষণেই আবার সামনের পাটির দাঁত গুলো বের করেও দেখাল। আকস্মিক কাণ্ডে হকচকিয়ে গেল নামী। আচমকা সুহাসের মুখের উষ্ণ শ্বাস নিজের মুখে পড়তেই চোখ দু’টো খিঁচিয়ে বন্ধ করে নিল। শরীর জুড়ে দিয়ে ওঠল তীব্র ঝংকার। অবচেতন মন কেঁদে ফেলল এই ভেবে,
‘ এই ছেলেটা এত পাগল কেন? ‘
.
.
সৌধের গাড়ি মুক্তাগাছা ছাড়াবে। এমন সময় সৌধের ফোনে কল এলো, সোহান খন্দকারের। সৌধ মিটিমিটি হেসে গাড়ির ব্রেক কষলো। রিসিভ করল সোহান আংকেলের কল। নিধি সহ সকলেই তাদের কথোপকথন শুনল। সেসব শুনে বাকিরা অবাক না হলেও নিধি হলো। বাকিদের চোখে বিস্ময় না ফুটলেও নিধির দুচোখ বিস্ময়ে বড়ো বড়ো হয়ে গেল। সৌধ কথা শেষ করে ফোন পকেটে রাখতেই সহসা নিধি চিল্লিয়ে ওঠল,
‘ এসবের মানে কী সৌধ? ‘
সৌধকে প্রশ্নটি করেই পাশে বসা প্রাচীর দিকে তাকাল। রেগেমেগে বলল,
‘ প্রাচী! এসব কী? আংকেল তো এখন দাওয়াত দিল। আর আংকেল তো জানেও না আমরা যাচ্ছি। ‘
নিধির চিৎকারে সৌধ বিরক্ত হলো। প্রাচীকে ইশারায় বলল, পুরো বিষয়টা বোঝাতে। প্রাচী মাথা নাড়াল, ‘ বোঝাচ্ছি ‘ নিশ্চিন্ত মনে ড্রাইভ শুরু করল সৌধ। প্রাচী বলল,
‘ আসলে রাতে সুহাস জানিয়েছে সকালে আংকেল আমাদের দাওয়াত করবে। আমরা যেন চলে যাই। ‘
‘ দাওয়াত না পাওয়ার আগেই আমরা বেরিয়েছি কেন? ‘
‘ দেখ আংকেল এখন দাওয়াত দিল। আমরা যদি ভোরেই না বের হতাম তাহলে তুই দাওয়াতটা মিস করতি। কারণ এ সময় ময়মনসিংহ গিয়ে তোকে নিয়ে আসতে আসতে বিকাল হয়ে যেত। আমরা তো জানিই আংকেল আমাদের দাওয়াত করবে। তাই আগেভাগে তোকে নিয়ে এলাম। মাঝরাস্তায় দাওয়াতও পেয়ে গেলাম। ‘
সহসা হাত তালি দিয়ে ওঠল নিধি। এরপর চোখ কটমট করে তাকাল সৌধর দিকে। দাঁত চিবিয়ে বলল,
‘ বুদ্ধিটা নিশ্চয়ই ওর। ‘
স্টিয়ারিং ঘোরানোর পাশাপাশি আয়নাতে নিধির রক্তিম মুখটা দেখে নিল সৌধ। আপনমনে হাসল কিঞ্চিৎ। রেগে গেলে নিধিকে কী ভয়ানক সুন্দরই না লাগে!
‘ ঐ শ য় তান হাসছিস তুই। ছিঃ ছিঃ কোন মাত্রার ছ্যাঁচড়া তোরা? দাওয়াত না দিতেই চৌদ্দ গুষ্টি সহ বেরিয়ে পড়ছিস। ‘
বিরক্ত স্বরে আইয়াজ বলল,
‘ আহ, চিল্লাচ্ছিস কেন? আমরা তো জানি দাওয়াত পাবো। আর পেয়েও গেছি। ‘
প্রাচী দাঁত ক্যালিয়ে হাসল। সৌধ বাঁকা হেসে আপনমনে ড্রাইভ করতে লাগল। নিধি হতাশ হয়ে গা এলিয়ে দিল সিটে। উপর দিকে চোখ তুলে সকলকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল,
‘ আল্লাহ তুমি বিচার করো। ‘
প্রাচী বলল,
‘ এমন করছিস কেন। দাওয়াত দেয়ার আগে রওনা দিয়েছি। পৌঁছাব তো দাওয়াত দেয়ার পরই। ‘
‘ আংকেল যদি বলে এত দ্রুত তোমরা এলে কী ভাবে? সবাই একসাথেই বা কী করে? ‘
‘ সৌধ ম্যানেজ করবে সব তুই প্যারা নিস না। ‘
‘ হ্যাঁ দুনিয়ার যত কু’কর্ম সব তো ঐ করে। আর কুবুদ্ধি দিয়ে সব সামলায়। ‘
সৌধ খোঁচা দিয়ে বলল,
‘ অহেতুক চিল্লাতে মাথা না লাগলেও এসব করতে মাথা লাগে মাথা। ‘
এ কথায় ভয়ানক ক্ষেপে গেল নিধি। চিৎকার করে বলল৷
‘ এই তুই গাড়ি থামা। যাব না আমি। ‘
সৌধ পাত্তা দিল না। বরং গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিল তিনগুণ। ‘
.
.
দুপুর সাড়ে বারোটায় সুহাসের বন্ধুরা নামীদের বাড়িতে পৌঁছাল। সুহাস আর সোহান খন্দকারের সঙ্গে আলাপ শেষে নামীকে ডেকে পাঠানো হলো। সুহাসের সঙ্গে এক মগে কফি খেতে বাঁধ্য হয়েছিল নামী। এরপর থেকেই তীব্র লজ্জায় গাল দু’টো রঙিন হয়ে ওঠছে তার৷ প্রথম আলাপে বিরক্ত লাগা মানুষটার প্রতি যে সীমাহীন ভালোলাগা তৈরি হচ্ছে টের পেল সে। এই ভালোলাগা ভালোবাসায় রূপ নিতে আর কতক্ষণ? না জানি দমকা হাওয়ার মতো কখন ছুঁয়ে দেয় এ হৃদয়।
বসার ঘরে বন্ধুদের সঙ্গে সুহাস বসে। সুহাসের এক পাশে সৌধ অন্য পাশে নিধি। প্রাচী, আইয়াজ, আজিজ ওরাও কাছাকাছিই বসে। সকলেই সুহাসের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। কারণ সৌধ যখন সুহাসকে জিজ্ঞেস করল,
‘ কী বন্ধু, বিয়ে করে কেমন ফিলিংস হচ্ছে? ‘
সুহাস সঙ্গে সঙ্গে বলল,
‘ কেমন যেন সবকিছু ভাল্লাগছে দোস্ত। ‘
নিধি ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘ কেমন ভাল্লাগছে সেটা বল? ‘
‘ কবুল বলার পর থেকেই ওকে আমার বউ বউ লাগছে। ‘
‘ আরে গাধার হাড্ডি। ও তো তোর বউই। ‘
‘ আসলে আমি বোঝাতে পারছি না। ‘
সৌধ বলল,
‘ বোঝাতে হবে না। শুধু বল বিয়ে করতে তো রাজি ছিলি না। রাজি না থাকা সত্ত্বেও বিয়ে করে কেমন লাগছে? ‘
‘ ভালো লাগছে দোস্ত। ওকে শুধু আদর করতে মন চাচ্ছে। ও অনেক লক্ষ্ণী। ‘
স্তব্ধ মুখে বসে স্থির চোখে তাকিয়ে বলা সুহাসের এহেন কথা শুনে সকলেই নিচু কণ্ঠে একসুরে বলে ওঠল,
‘ এই ও টা কে দোস্ত? ‘
সুহাস ঘোরের মাঝেই বলে দিল,
‘ তোদের ভাবি। ‘
বন্ধুরা এবার একসঙ্গেই সুর তুলল,
‘ ওওও!!! ভাবি!!! ‘
সৌধ খোঁচাও দিল সুহাসের পেটে। তৎক্ষনাৎ সম্বিৎ ফিরে পেল সুহাস। সকলে মিলে এবার তাকে ক্ষেপাতে উদ্যত হতেই সহসা উপস্থিতি ঘটল নামীর। ট্রে তে ছয়টা সরবত ভর্তি গ্লাস নিয়ে এসে সালাম দিল নামী। ওরা সকলেই বিস্ময় হয়ে তাকাল নামীর দিকে। কালো রঙের সোনালি পাড়ের শাড়ি পরিহিত শ্যামবর্ণা মেয়েটিকে দেখে কেউ অপছন্দ করতে পারল না। বরং সকলেই মুগ্ধ হলো তার গোলগাল মুখশ্রীর মিষ্টি হাসিতে। টি টেবিলের ওপর ট্রে রাখল নামী৷ সৌধরা সালাম ফিরিয়েছে। নিধি ওঠে এসে নামীর কাঁধ জড়িয়ে ধরে বলল,
‘ আমি নিধি, সুহাসের বান্ধবী। ‘
প্রাচী সহ বাকিরাও পরিচয় দিল৷ নামী সৌজন্যতা মিশিয়ে তাকাল, হাসল। নিধি টেনে নিয়ে সুহাসের পাশে বসিয়ে দিল তাকে। প্রাচী ড্যাবড্যাব করে বেশ অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,
‘ সুহাসের মায়াদেবী। ‘
আইয়াজ বলল,
‘ উহুম সুহাসের সুহাসিনী। ‘
নিধি হেসে ফেলল। বলল,
‘ সুহাসের চিরকালের সঙ্গী। ‘
সৌধ নিধির দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য করে বলল,
‘ সেটা আমরা সবাই জানি। উপমা দিতে না পারলে চুপচাপ থাক। ‘
চোখ রাঙাল নিধি। নামী লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে বসে। ওরা সরবত নিল। সুহাস নিজেরটা নিতে গিয়ে নামীর দিকে তাকাল। নিচু কণ্ঠে বলল,
‘ নিজের জন্য আনোনি কেন? ‘
সুহাসের নিচু কণ্ঠ বাকিরা না শুনলেও সৌধ শুনল। মিটিমিটি হাসতে থাকল সে। নামী ইতস্তত করে বলল,
‘ আমি খাব না আপনারাই খান। ‘
সুহাস নড়েচড়ে একই কণ্ঠে বলল,
‘ আমিও খাব না। ‘
‘ কিরে সুহাস এখনি ফিসফাস করিস! ‘
হঠাৎ আজিজের কথা সকলের নজর সুহাস নামীর দিকে পড়ল। নামীর শ্বাসরোধ করে বসে৷ সুহাস মুচকি হেসে সোজা হয়ে বসল। কিছু জবাব দেবে এমন সময় দুম করে কারেন্ট চলে গেল। থেমে গেল অনবরত ঘুরতে থাকা বৈদ্যুতিক পাখা। জৈষ্ঠ্যমাসের গরম। যেন কয়েক সেকেণ্ডেই গা জ্বলে ওঠল। নামী সহসা ওঠে দাঁড়িয়ে বলল,
‘ আমাদের এদিকে এ সময় কারেন্ট খুব ডিস্টার্ব করে। আপনারা বারান্দায় এসে বসুন। প্রাকৃতিক হাওয়া পাবেন। ‘
নামীর মিষ্টি কণ্ঠের সুন্দর সমাধান পেয়ে সকলে গিয়ে বারান্দায় পাতা চেয়ারে বসল। চুপিসারে সৌধ সুহাসকে বলল,
‘ শাড়ি পরেছে। একান্তে কিছু প্রশংসা করিস। ‘
‘ কী প্রশংসা করব? হ’ট লাগছে? ‘
সৌধ বাঁকা হেসে বলল,
‘ এখনি এসব বলবি কেন গাধা। আগে ইমপ্রেস কর৷ একে অপরের প্রতি মুগ্ধতা বাড়া। ‘
সৌধর কথা শুনে নামীর দিকে তাকাল সুহাস৷ নামী নিধির সঙ্গে কথা বলে ওঠে যাচ্ছিল। সৌধ পুনরায় বলল,
‘ চলে যাচ্ছে ডাক দে। একটু দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে প্রশংসা কর। ‘
‘ কেমন টাইপ সেটা বল ফাস্ট। ‘
‘ অ্যাঁই শালা, ওটাও কি আমি বলে দিব? বউ কি আমার? বিয়ে কি আমি করছি। ‘
সুহাস ভ্রু কুঁচকে তাকাল। সৌধ ত্বরিত বলল,
‘ ওকে নিয়ে দূরে দাঁড়াবি। কথাবার্তা বলবি। এরপর
মনোযোগ দিয়ে ওর দিকে তাকাবি। মন দিয়ে আগাগোড়া দেখার পর মন থেকে যা আসবে তাই বলে দিবি। যদি অনুভূতি আসে তবেই বলবি। অনুভূতি না আসলে বলার দরকার নেই। যা ট্রাই কর গিয়ে। ‘
সৌধর পরামর্শ নিয়ে নামীকে ডাকল সুহাস। সবার সামনে ডাকাতে লজ্জা বাড়ল নামীর। তবুও এগিয়ে এলো। ভরদুপুরে বাইরে কড়া রোদ। তাই বিশাল বারান্দার ওপাশে গিয়ে দাঁড়াল সুহাস। কয়েক মুহুর্ত পরই নামী এসে পাশে দাঁড়াল। সৌধর কথানুযায়ী সুহাস মনোযোগ দিয়ে তাকাল নামীর দিকে। অতি সাধারণ ভাবেই দাঁড়িয়ে নামী। শ্যামলা মুখের টানা টানা মায়াবি চোখ দু’টোতে শুধু গাঢ় করে কাজলের প্রলেপ লাগানো। কাজল কালো ঐ আঁখি যুগলেই হারাতে বাধ্য হলো সুহাস। বুঝে ওঠতে পারল না এত অল্প সময়ে তার বক্ষঃস্থলে সুক্ষ্ম টান পড়ে কেন? অরিনের জন্যও তো কখনো এমন অনুভূতি হয়নি।
নামীর মুখে কী আছে এমন? এই চোখ দু’টোতে কী জাদু আছে? এমন লাগছে কেন? কেন হচ্ছে এমন অনুভূতিতে সিক্ত? কোন দৈববলে এত অল্প সময়ে এই গভীর অনুভূতির সৃষ্টি ? নামী তাকিয়ে আছে সুহাসের দিকে। সুহাস কী তাকে জরুরি কিছু বলতে ডাকল? কী ভাবছে এত? কী বলবে? খুব দরকারি কিছু কী? নামীর বুকের ভেতর অজানা ভয়ে কাঁপতে শুরু করল। সরল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল অনিমেষে। যেই দৃষ্টিতে ভয়ানক ভাবে আক্রান্ত হয়ে পড়ল সুহাস৷
আচম্বিতে তার বুকের গহীন বন থেকে বেরিয়ে এলো এক নৈসর্গিক বাক্য,
‘ সুহাসিনী, দ্বিপ্রহরের রৌদ্রোকজ্জ্বল এই ক্ষণে কাজল রঙে আবৃত তোমার মায়াবিষ্ট আঁখি যুগলেই কি হলো আমার মরণ?‘

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।