‘ সুহাসিনী, দ্বিপ্রহরের রৌদ্রোকজ্জ্বল এই ক্ষণে কাজল রঙে আবৃত তোমার মায়াবিষ্ট আঁখি যুগলেই কি হলো আমার মরণ? ‘ __সুহাস
নামীর ব্যক্তিগত ডায়ারিতে স্থান পেল তাকে উদ্দেশ্য করে বলা সুহাসের প্রথম নৈসর্গিক বাক্যটি। একবার, দুবার, বার বার অসংখ্যবার বিড়বিড়িয়ে বাক্যটি আওড়াল নামী। নিজের ঘরে নাজুক মুখে বসে মুচকি মুচকি হাসছে সে। কিয়ৎক্ষণ পূর্বে দুপুরের খাবার পর্বের সমাপ্তি ঘটেছে। সুহাস গেছে তার বন্ধুদের নিয়ে বাড়ির সামনে হাঁটাহাঁটি করতে। এ সুযোগেই সে একরাশ অনুভূতি বুকে চেপে ছুটে এসেছে নিজের ঘরে। ডায়ারিতে লিপিবদ্ধ করে রাখল, শব্দের বুননে তৈরি হওয়া ঐন্দ্রজালিক সে বাক্যটি। যা তার হৃদয় কুহরে আটকে গেছে জন্মান্তরের জন্য।
মিনিট পাঁচেক পরই দরজায় টোকা পড়ল। শুনতে পেল নিধি আপুর ডাক,
‘ নামী আসব? ‘
বিছানার পাশের টেবিলে ডায়ারি রাখল নামী। ধাতস্থ হয়ে ওঠে দাঁড়িয়ে বলল,
‘ জি আপু আসুন। ‘
প্রথমে নিধি ঢুকল। এরপর প্রাচী। নামী ওদের বসতে বললে বিছানায় বসল ওরা। বলল,
‘ তোমাদের এদিকে দুইশ এক গম্বুজ মসজিদ হচ্ছে তো। ঝটপট রেডি হয়ে নাও। আমরা এখন ওখানে যাব। ‘
প্রাচী বলল,
‘ আর কী রেডি হবে? রেডিই তো। ‘
নামী ঈষৎ হেসে বলল,
‘ আমি যাব? ‘
‘ আমরা যাচ্ছি আর তুমি যাবে না! উফ নামী এটা কোনো প্রশ্ন? জলদি তৈরি হও। ‘
নামী বেশ ইতস্তত বোধ করতে লাগল। প্রাচী নিধিকে ইশারায় কিছু বলতেই নিধি আশ্চর্য মুখে বলল,
‘ তুমি এত সংকোচ করছ কেন? কোনো সমস্যা? ‘
নামী ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলল। আমতা আমতা করে বলল,
‘ বাবা আর আংকেলকে বলতে হবে তো। আমি গিয়ে বলে আসি?’
নিধি বিস্মিত হলো। নামী বেরিয়ে যেতে উদ্যত হতেই হাত টেনে ধরল সে৷ বলল,
‘ বাব্বাহ! সত্যিই খুব লক্ষী মন্ত মেয়ে গো তুমি। শোনো দুই আংকেলই অনুমতি দিয়েছেন। তাছাড়া সোহান আংকেল তোমার শশুর হলেও সে অন্যধারার মানুষ। ধীরেধীরে তুমি নিজেই টের পাবে। সে কখনোই তোমাকে পুত্রবধূ হিসেবে ট্রিট করবে না।’
লজ্জা পেল নামী। আর কিছু বলতে পারল না। তৈরি হওয়ার মধ্যে শুধু চুল আঁচড়ে ঠোঁটে ব্রাউন ন্যুড কালার লিপস্টিক লাগাল। এরপর হ্যান্ডপার্স আর ফোন তুলে বলল,
‘ আমি তৈরি আপু। ‘
নিধি সঙ্গে সঙ্গে সৌধকে কল করল। সৌধ রিসিভ করলে বলল,
‘ কী ভাই, হেলথ্ মিনিস্টার, আপনার চল্লিশ মিনিট হাঁটা হয়নি? ‘
আবারো ভাই! সৌধর মাথা দপদপ করে ওঠল। ইচ্ছে করল নিধির ঠোঁটজোড়ায় ইনজেকশন পুশ করে সারাজীবন অবশ করে রাখতে। যেন আজ এই মুহুর্ত পর থেকে ঐ মুখে আর তাকে ভাই শুনতে না হয়। সমবয়সী, বন্ধু হয়েই জীবনটা তেজপাতা হয়ে যাচ্ছে। না পারছে মনের অনুভূতি জানাতে আর না পারছে সহ্য করতে। এর মধ্যে এ ভাই, ও ভাই করে বুকের ভেতর রক্ত ক্ষরণ ঘটিয়ে দিচ্ছে। ক্রোধের বশে
শক্ত কিছু কথা বলতে গিয়েও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে ফেলল সৌধ। চোখ বন্ধ করে দু’বার ঘন নিঃশ্বাস ছেড়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
‘ আরো পনেরো মিনিট। ‘
অমন গম্ভীর কণ্ঠ শুনে নিধি হকচকিয়ে গেল। মনে মনে বলল, এই সৌধটার আজ হয়েছেটা কী? মুখে বলল,
‘ নামী রেডি, আমরা বেরুচ্ছি। তোরা সামনেই আছিস তো? ‘
‘ হুম। ‘
বলেই ফোন কেটে দিল সৌধ। নিধি ভ্রু কুঁচকে প্রাচীকে বলল,
‘ এই প্রাচী, সৌধর কী হয়েছে রে? ‘
প্রাচী অবাক হয়ে বলল,
‘ কী আবার হবে ওর? ‘
‘ জানি না। মনে হচ্ছে মেজাজ দেখিয়ে কথা বলছে। ‘
‘ মনে হচ্ছে কিন্তু সত্যি না৷ ওসব ছাড় তো, চল এবার। ‘
প্রাচী নিধির হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল। ওদের পেছন পেছন চলল নামীও।
.
.
সৌধর গাড়িতে ড্রাইভার সিট সহ মাত্র পাঁচজন যাওয়া যাবে। অথচ মানুষ সাতজন। তাই গাড়ি রেখে অটো করে আট কি.মি দূরে অবস্থিত মসজিদ দেখতে গেল ওরা। ভেতর সিটে সুহাস, নামী পাশাপাশি আর নামীর পাশে প্রাচী। মধ্যসিটে সৌধ আর নিধি। অটোওয়ালার এক পাশে আজিজ। অন্য পাশে আইয়াজ। বেশ গল্প স্বল্প করতে করতেই পৌঁছাল ওরা। মসজিদের সামনে এসেই মাথায় কাপড় তুলল নামী। তাকে দেখে নিধি আর প্রাচীও মাথায় কাপড় তুলল। এরপর সকলে মিলে ভেতরে চলে গেল। মসজিদের ভেতরে গিয়ে বিশ মিনিট সময় কাটিয়েছে ওরা৷ এরপর নিচে নেমে ডান পাশের দোকান গুলো ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল। ফুচকার দোকান দেখেই নিধি চট করে সৌধর হাত চেপে ধরল। উত্তেজিত হয়ে বলল,
‘ দোস্ত ফুচকা খাব। ‘
নিধির ধরে রাখা হাতটার দিকে তাকিয়ে সৌধ শীতল দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। শান্ত কণ্ঠে বলল,
‘ এগুলো ভালো হবে না। অস্বাস্থ্যকর লাগছে। ‘
হাত ছেড়ে মেজাজ খারাপ করা স্বরে নিধি বলল,
‘ ধূর, তুই ভাই একটা নিরামিষ। ‘
সৌধকে কথাটা বলেই সুহাসকে বলল,
‘ এ সুহাস চল তো ফুচকা খাই। ‘
সুহাস নামীর দিকে তাকাল। জিজ্ঞেস করল,
‘ ফুচকা খাবে? ‘
নাজুক মুখে মাথা নাড়াল নামী। প্রাচী নিধির পেটে মৃদু গুঁতো দিয়ে বলল,
‘ দেখেছিস কাণ্ড! কে বলবে একদিন আগেও এরা দু’জন দু’জনের সম্পূর্ণ অপরিচিত ছিল? ‘
মাথা দুলিয়ে হাসল নিধি। এরপর প্রায় দৌড়েই চলে গেল ফুচকার দোকানে। নামীকে নিয়ে সুহাসও এগুলো। গম্ভীর মুখে ধীরপায়ে চলতে থাকা সৌধকে তাড়া দিয়ে সুহাস বলল,
‘ জোরে হাঁট। ‘
সৌধ হাঁটার গতি আরো কমিয়ে দিলে সুহাস পুনরায় ডাকল দু’বার। সৌধ ইশারায় বলল,
‘ এখানেই আছি। তোরা খেয়ে আয়। ‘
পকেটে দু-হাত গুঁজে মৃদু পায়ে ঘুরে ঘুরে দোকান দেখতে লাগল সৌধ। দেখতে পেল, আজিজ আর আইয়াজ তসবিহ, টুপিওয়ালা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে। নিজেদের মধ্যে কিছু একটা আলোচনা করছে ওরা। বাঁকা হেসে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতেই চোখ পড়ল কয়েক হাত দূরে নিল রঙের বোরখা আর সাদা হিজাব পরা দু’টো মেয়ের দিকে। মেয়ে দু’টো তার দিকে ড্যাবড্যাব চোখে তাকিয়ে আছে। পাশাপাশি নিজেদের মধ্যে যেন গুরুত্বপূর্ণ কিছু আলোচনাও করছে। প্রথমে খেয়াল দিলেও পরোক্ষণেই এড়িয়ে অন্যদিকে হাঁটা শুরু করল সে। মিনিট দুয়েক পর শুনতে পেল অল্প বয়সী মেয়েলি ডাক,
‘ ভাইয়া একটু শুনেন. ‘
ভ্রু কুঁচকে থেমে গেল সৌধ। ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখল সেই বাচ্চা মেয়ে দু’টো। বাচ্চা সরল দু’টি মুখ দেখে কুঁচকানো ভ্রুদ্বয় ঠিক হয়ে গেল৷ মৃদু হেসে বলল,
‘ ইয়েস? ‘
মেয়ে দু’টোর মধ্যে ফরসা করে মেয়েটা চঞ্চলিত কণ্ঠে বলল,
‘ আপনার একটা ছবি তুলতে পারি? ‘
সৌধ অবাক হলো। তৎক্ষনাৎ পাশের শ্যামলা মেয়েটা বলল,
‘ আসলে ভাইয়া আপনাকে না ঠিক হিরোদের মতো দেখতে। ‘
ফরসা মেয়েটা ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
‘ না না হিরো নয় আমাদের প্রিয় সিংগার আরমান মল্লিকের মতো দেখতে। প্লিজ ভাইয়া একটা ছবি তুলতে দেন। বান্ধবীদের দেখাব। আমরা সবাই আরমান মল্লিকের ডাই হার্ট ফ্যান। আপনাকে দেখে তো আমরা খুব অবাক হয়ে গিয়েছি। কয়েক মিনিট লেগেছে ঘোর কাটতে। মনে হচ্ছে আপনারা জমজ ভাই। ইস, আপনার ফিটনেসও মারাত্মক। আচ্ছা ভাইয়া আপনি কি হিরোদের মতো জিম করেন? ‘
সৌধ খেয়াল করল মেয়েগুলো তার হাতের ফুলে ফেঁপে থাকা পেশির দিকে তাকাচ্ছে আর কথা গুলো বলছে। ঠিক কী উত্তর দেবে বা কী বলবে বুঝে ওঠতে পারল না সে। হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল শুধু। তাকে আরমান মল্লিকের মতো দেখতে? এ প্রথম এমন কথা শুনল। খুশি হওয়া উচিৎ না বিরক্ত হওয়া উচিৎ মেয়ে দু’টোর প্রতি? প্রচণ্ড বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে গেল যেন। না খুশি হলো না বিরক্ত। অদ্ভুত অনুভূতি হলো তার৷ বাচ্চা মেয়ে দু’টোর অনুরোধে কয়েকটা ছবি তুলতেও দিল। এরপর বিদায় নিতে উদ্যত হলেই ফরসা করে মেয়েটা বলল,
‘ ভাইয়া আপনার ফেসবুক আইডি টা জানতে পারি? ‘
এ পর্যায়ে তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল সৌধ। আর এক মুহুর্ত না দাঁড়িয়ে চলে এলো আজিজ আর আইয়াজের কাছে। দেখল, ওরা দু’জন এক হাজার পুঁতির দুটো তসবিহ কিনে নিজেদের মধ্যে কিছু আলোচনা করছে। সৌধ গিয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘ কী ব্যাপার তসবিহ কার জন্য? ‘
আজিজ দাঁত ক্যালিয়ে হাসল। বলল,
‘ নিউ ম্যারিড কাপলদের জন্য। ‘
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল সৌধ। বলল,
‘ মানে! ‘
আজিজ বলল,
‘ একটু পরই বুঝবি। ‘
নামী ওরা ফুচকা খেয়ে বেরিয়ে আসতেই আজিজ গিয়ে সামনে দাঁড়াল। দু’টো তসবিহ দু’জনের হাতে ধরিয়ে বলল,
‘ হ্যাপি ম্যারিড লাইফ দোস্ত, হ্যাপি ম্যারিড লাইফ ভাবি। ‘
নামী সুহাস সহ প্রত্যেকেই ভীষণ অবাক হলো। এ প্রথম এমন কিছুর সম্মুখীন হলো তারা। আজিজ বলল,
‘ আজ থেকে প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙার পর তসবিহ পড়বে দু’জনে। কী জপবে বলো তো? ‘
এবারে সুহাস টের পেল আজিজের দুষ্টুমি। কিন্তু নামী খুব সিরিয়াস হয়ে তাকিয়ে রইল। আজিজ তার দিকে তাকিয়েই বলল,
‘ প্রতিদিন এক হাজার বার সুহাস, সুহাস, জপ করবে। ‘
এরপর সুহাসের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ আর তুই নামী, নামী। দেখবি তরতর করে মহব্বত বাড়বে। ‘
তীব্র লজ্জায় মাথা নত করে ফেলল নামী। আরক্ত হলো তার কপোলদ্বয়। সুহাস চোখ রাঙিয়ে তসবিহ ফেরত দিতে নিলে নামী বাঁধ সেধে নরম স্বরে বলল,
‘ থাক না। উপহারের জিনিস ফেরত দিতে নেই। ‘
সকলে বিস্ময় চোখে তাকাল। সৌধ বাঁকা হেসে চোখ ফিরিয়ে নিল ওদের থেকে। বুঝল, নামী মেয়েটা অসাধারণ। আংকেলের পছন্দটা মারাত্মক। কিন্তু সুহাসকে নিয়েই চিন্তা হচ্ছে। সুহাস ঠিক থাকবে তো? ঘন ঘন গার্লফ্রেন্ড বদলানো ছেলেটা এক নামীতে আটকাবে তো?
বাকিরা নিজেদের মধ্যে দুষ্টুমি আর সুহাস নামীকে ক্ষেপাতে ব্যস্ত। ঘোরাঘুরি শেষ করে চলে যাবার সময় সকলে আগে আগে হাঁটছিল। আর সুহাস নামী পিছু পিছু। ভীড় ঠেলে বেরুতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছিল ওদের। পরিস্থিতি বুঝে আচমকা সুহাস নামীর হাত ধরল। আগলে নিয়ে বেরিয়ে গেল রাস্তায়। নামী স্তব্ধ মুখে তাকিয়ে সুহাসের পানে। শরীর জুড়ে শিরশির অনুভূতিতে সিক্ত তার। হৃৎ স্পন্দনের গতিও বাড়ছে অস্বাভাবিক ভাবে৷ বন্ধুরা অটোতে বসে দেখল নববিবাহিত বন্ধুর মনোমুগ্ধকর দৃশ্যটি। সকলে এক সুরে বলেও ওঠল,
‘ মাশাআল্লাহ, মাশাআল্লাহ। ‘
গোধূলিলগ্ন। আকাশের অবস্থা সুবিধার না। নামীদের বাড়ি থেকে বিদায় নিল, পাঁচ বন্ধু। নামী জোরাজুরি করছিল, একদিন থেকে যেতে৷ নামীর বাবা, মাও বেশ জোর করল থাকতে। সকলেই বাড়ির বাহানা দিয়ে বিদায় নিল। তবে নামীকে কথা দিয়েছে সে সুহাসদের বাড়িতে যাওয়ার পর অবশ্যই তার সঙ্গে তারা দেখা করবে। তাছাড়া নামী যদি তাদের কলেজেই ভর্তি হতে পারে৷ তাহলে তো হয়েই গেল। এ ব্যাপারটা অবশ্যই সৌধ মাথায় রাখল। গ্রাম থেকে বেরোতে বেরোতে মাগরিবের আজান পড়ে গেছে। বৃষ্টি হচ্ছে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টির শব্দ শুনতে পেল ওরা। ড্রাইভ করতে করতে সৌধ বলল,
‘ সবাই আমার বাড়িতে থেকে যা। ‘
আইয়াজ বলল,
‘ না রে। ক’টাদিন ছুটি পেয়েছি। আজ না ফিরলে আম্মা কষ্ট পাবে। ‘
প্রাচী বলল,
‘ আমি আর নিধি থেকে যাচ্ছি এটাত কনফার্ম। ‘
আজিজ বলল,
‘ মেয়ে দুইডারেই নিয়ে যা। আমাদের নিয়ে এত চিন্তা কী। ‘
হঠাৎ নিধি বলল,
‘ আমি বুঝলাম না, তোর বাসায় ক্যান যেতে হবে? আমাদের বাসায় গেলে সমস্যা টা কী? ‘
বিরক্ত সূচক শব্দ করে সৌধ বলল,
‘ তুই বুঝিস টা কী আমাকে বলবি? বাসাটা কি তোর বাবার? ছুটি শেষ হয়নি, রাত করে হঠাৎ বাসায় যাবি। আর বাড়িওয়ালার অসংখ্য প্রশ্ন, সন্দেহের সম্মুখীন হবি৷ এ খেয়াল আছে? ‘
সহসা দমে গেল নিধি। সত্যিই তো!
মেডিকেল কলেজের পেছনে এক রুমের একটি বাসা ভাড়া করে থাকে নিধি, প্রাচী। অন্যের বাড়িতে ভাড়া থাকতে হলে খুব বেশি স্বাধীনতায় থাকা যায় না। তাদের ছুটি কতদিন বাড়িওয়ালা জানে। তাই এ সময় বাসায় গিয়ে উপস্থিত হলে সত্যিই বিপদ বাড়বে। তাই সৌধর কথাই মেনে নিল। ছুটি শেষ হতে তিন দিন বাকি। সৌধর বাসায় দু’রাত থাকতেই হবে৷ ব্যাগপত্র গুছিয়ে যখন এসেছে। নিজ বাড়িতে দু’দিনের জন্য ফিরে যাওয়া অসম্ভব। তাছাড়া সৌধর বাড়িতে যাওয়া আসা হয়ই। আন্টি, আংকেল, স্মৃতি আপু সবাই খুব বন্ধুত্বপূর্ণ। সৌধের পরিবারটা সবচেয়ে আলাদা৷ সবচেয়ে ভালোবাসা পূর্ণ। যেখানে গেলে হাঁপ ছেড়ে শ্বাস নেয়া যায়। শান্তির আরেক নামই যেন সৌধর বাড়ি, সৌধর পরিবার। দুটো বছরে এইটুকু উপলব্ধি করেছে নিধি। অমন অমায়িক মানুষ, অমায়িক পরিবার আর দুটো দেখেনি সে।
আজিজ আইয়াজকে নামিয়ে দিয়ে নিজের বাড়ির কাছাকাছি চলে এলো সৌধ। গ্যারাজে গাড়ি রেখে নেমে পড়ল তিনজনই৷ গাড়িতে একটি মাত্র ছাতা। প্রাচীর ঠাণ্ডার সমস্যা আছে। তাই নিধি প্রাচীকেই ছাতা দিল বলল,
‘ তুই আর ব্যাগ দুটো যেন না ভেজে। ‘
প্রাচী তার এবং নিধির ব্যাগ নিয়ে ছাতা মাথায় ত্বরিত সৌধদের বাড়ির দিকে হাঁটা ধরল। ইচ্ছে করেই এমনটা করল সে। যেন সৌধ, নিধি বৃষ্টি মুখর রাতটায় একান্ত কিছু সময় কাটাতে পারে। এতে নিধির কী হবে জানে না৷ তবে সারাদিনে সৌধর বিগড়ানো মেজাজ অনেকটাই ঠিক হবে। বৃষ্টিতে ভিজতে বেশ ভালোই লাগে নিধির। বৃষ্টি হয়েছে আর সে ভেজেনি এমন ঘটনা খুব কমই ঘটেছে। এমনও সময় গেছে যখন সে মাঝরাতে ছাদে গিয়ে বৃষ্টি বিলাস করেছে। আজ এমনিতেও গিয়ে গোসল করা লাগবে। গ্রীষ্মের গরমে একদিন গোসল না করে থাকা অসম্ভব! তাই ভিজতে কোনো অসুবিধা হলো না। বেশ উৎসাহ নিয়ে ভিজতে এবং হাঁটতে শুরু করল সে। তার পায়ে পা মিলিয়ে এগিয়ে এলো সৌধও। নিধি প্রফুল্ল চিত্তে বলল,
‘ জোশ লাগছেরে ভাইই। আজকের দিন, রাত সবটাই অসাধারণ। ‘
সহসা বা হাত মাথার পেছনে দিয়ে নিজের চুল নিজেই টেনে ধরল সৌধ। মনে মনে বলল,
‘ কন্ট্রোল সৌধ কন্ট্রোল। ‘
এগুতে এগুতে আরো অনেক বকবক করল নিধি। সেসবে খেয়াল না দিয়ে মনে ক্রোধ চেপে মুখে গম্ভীরতা ফুটিয়ে একসঙ্গে শুধু এগিয়েই চলল সৌধ। আর নিজেকে রাখল কঠিন নিয়ন্ত্রণে। ল্যামপোস্টের আলোয় নিধির পরিহিত গাউন ভিজে একাকার হওয়ার দৃশ্য দেখল সে। গাউন সহ চুরিদারের দু’হাতে চেপে ধরে এগুচ্ছে নিধি। চুলগুলো খোঁপা করায় পৃষ্ঠদেশ স্পষ্ট দৃশ্যমান। সাদা রঙের গাউনটা ভিজে দেহের সঙ্গে লেপ্টে রয়েছে। কালো রঙা অন্তর্বার স্পষ্ট হয়ে ওঠেছে। মুহুর্তেই দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল সৌধ। নিচের দিকে মাথা নুইয়ে এগিয়ে এলো। তৎক্ষনাৎ নিধি ডাকল,
‘ আরেহ ভাই এত স্লো ক্যান তাড়াতাড়ি হাঁট। ‘
সহসা দাঁড়িয়ে পড়ল সৌধ। চোখ দু’টো খিঁচিয়ে নিচু কন্ঠ অথচ চিবানো সুরে বলল,
‘ যদি কোনোদিন সুযোগ পাইরে নিধি, আস্ত গিলেই খাব তোকে! ‘
নিধি প্রায় লাফাতে লাফাতে বাড়ির সামনে চলে এলো। বৈদ্যুতিক ঝকঝকে আলোতে সৌধদের লোহার গেঁট আকড়ে থাকা বৃষ্টি ভেজা কাগুজি ফুলগুলো দেখে খুশিতে গদগদ হয়ে গেল সে। বলল,
‘ এই সৌধ, এগুলো সাইজ করে কাটাস না কেন? ‘
সৌধ উত্তর দিল না। নিঃশব্দে পিছু পিছু গেট পেরিয়ে গেট লাগিয়ে তালাবদ্ধ করে দিল। বাড়ির মেইন দরজাও খোলা৷ নিধি ত্বরিত গতিতে যেতে উদ্যত হলেই সৌধ পিছু ডাকল,
‘ নিধি ওয়েট। ‘
নিধি দাঁড়িয়ে পড়ল। কপাল থেকে থুতনি অবধি পানিগুলো ঝেড়ে কাঁপা কণ্ঠে বলল,
‘ কী হলো? ‘
সৌধ দ্রুত সামনে এসে বলল,
‘ চুলগুলো ছেড়ে দে। ‘
‘ মানে চুল ছাড়ব কেন! ‘
এক মুহুর্ত নিশ্চুপ থেকে সৌধ বলল,
‘ যা বলেছি তাই কর। বাসায় কাজিনরা আছে। যদি বসার ঘরে থাকে সমস্যা হবে। ‘
‘ মানে কী সমস্যা হবে। ‘
‘ তোর সমস্যা হবে। ‘
‘ মানে কী বলছিস তুই বুঝছি না। ‘
সহসা রেগে গেল সৌধ। ধমকে বলল,
‘ তুই বুঝিসটা কী? বৃষ্টিতে ভিজে শরীরে জামা লেপ্টে গেছে। জামার ভেতরকার বাচ্চা জামাটাও দেখা যাচ্ছে। ‘
মুহুর্তেই শক্ত হয়ে গেল নিধি। হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল সৌধর মুখের দিকে। অবিশ্বাস্য ঐ দৃষ্টি দেখে সৌধ মেজাজ ঠাণ্ডা করে শান্ত গলায় বলল,
‘ কুল, বি পজেটিভ নিধি। একদম ভুল বুঝবি না। ‘