৭৪. সুউচ্চ এক বহুতল ভবনের ইলেভেন্থ ফ্লোরের বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টের ডাইনিং টেবিলে বসে লাঞ্চ করছে এক চল্লিশোর্ধ্ব পুরুষ। তার সাথে আর কেউ নেই, স্ত্রী, পুত্র, সন্তান, কেউই না। দশ ফিট লম্বা ডাইনিং টেবিল টাতে বসে সে একাই লাঞ্চ করছে৷ তার সামনে নানাবিধ পদের খাবার পরিবেশন করে রাখা। কাঁচা পাকা চুল আর দাড়ি দুইটাই তার ঝুটি বাধা। ডান পাশের চোয়ালের ওপর বিঘত খানিক লম্বা কাটা দাগ, যার কারণে লোকটার চেহারা খুবই নিষ্ঠুর দেখাচ্ছে। তার চেহারা আর ব্যাক্তিত্ব, দুইটার ভেতর বিন্দুমাত্র তফাত নেই।
তার লাঞ্চে ব্যাঘাত ঘটিয়ে হঠাৎ তার অ্যাপার্টমেন্টের দরজায় নক পড়লো। লোক টা খাওয়া থামিয়ে দরজায় নক দেওয়া ব্যাক্তি টাকে ভেতরে আসার অনুমতি দিলো। আর তখনি অ্যাপার্টমেন্টের ভেতর হন্তদন্ত হয়ে প্রবেশ করলো দুজন যুবক। ঢুকেই তাদের ভেতর থেকে একজন লাঞ্চরত ব্যাক্তি টার উদ্দ্যেশ্যে ইংরেজিতে বলে উঠলো,
— ম্যাথিউ আপনার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে বস। সে সাফওয়ানের সাথে হাত মিলিয়ে ওকে পালাতে সাহায্য করেছে। আমরা যা ধারণা করেছিলাম তার কিছুই হয়নি। সাফওয়ান পুরোপুরি সুস্থ আছে৷ কেউ ওর কিছুই করতে পারেনি। এ ছাড়া আর ও একটা তথ্য পাওয়া গেছে, যে ম্যাথিউই সেই ব্যাক্তি যে কিনা সাফওয়ান কে এতদিন আমাদের সমস্ত পরিকল্পনার তথ্য পাচার করেছে, আমাদের প্রতিটা মুভমেন্টের খবর সে-ই সাফওয়ান কে দিয়েছে। আর, অন্য এক সূত্রে খবর পেয়েছি, সাফওয়ানের সাথে একটা মেয়ে আছে। মেয়েটা সম্পর্কে ওর ঠিক কি হয় সেটা জানা যায়নি, তবে আমাদের দলের লোকেরা চেষ্টা করছে মেয়েটার পরিচয় উদঘাটন করার।
এখন আমাদের করণীয় কি, বস?
ডাইনিং টেবিলে বসা লোকটা আর খাবার স্পর্শ করলো না। চেয়ার ছেড়ে উঠে বেসিনে গিয়ে হাত ধুয়ে ফেললো। অ্যাপার্টমেন্টের ভেতরে আসা ছেলেদুটো সেভাবেই দাঁড়িয়ে রইলো তাদের বসের আদেশের অপেক্ষায়।
লোকটা বেসিন থেকে সরে তার রুমের কাবার্ডের কাছে গেলো। এরপর কাবার্ড থেকে একটা ফুলদার শার্ট বের করে গায়ে দিতে দিতে বেডসাইড টেবিলের ওপর থেকে নিজের ফোন টা নিয়ে কল করলো কারো কাছে, ওপাশ থেকে কল রিসিভ হতেই লোকটা বলে উঠলো,
— হারবার্ট বলছি, আমার হেলিকপ্টার টা রেডি করো, আমি বের হবো, এখনি।
বলেই ফোন কেটে দিলো। তারপর শার্টের লাস্ট বোতাম টা আটকে বেরিয়ে গেলো অ্যাপার্টমেন্ট থেকে।
.
বর্তমানে ম্যানহোলের আন্ডারগ্রাউন্ড রাস্তা দিয়ে ঝড়ের গতিতে ছুটে চলেছে সাফওয়ান আর রুমাইশা। সাফওয়ান চলেছে সামনে, তার পেছন পেছন রুমাইশা। ম্যান হোলের শেষ অংশ টা গিয়ে থেমেছে নর্থ অ্যান্টার্কটিক সাগরের ওপর, ম্যান হোলের পানি টা সাগরের নীল পানির সাথে মিশে গিয়ে নিজের কলুষিত দেহটাকে পবিত্র করে নেয় সেখানে।
রুমাইশা গতকাল যখন এসেছিলো এখানে, তখন ম্যান হোলেরই অন্য রাস্তা দিয়ে এসেছিলো, যেটা ছিলো শহরেরই ভেতরে। কিন্তু এই রাস্তা টা সম্পুর্ণ শহরের শেষ সীমানায়। ম্যাপে দেখানো রাস্তা দিয়ে ওরা ছুটে চলেছে দুজনেই। জোনাসের সাথে কথা হয়েছে একটু আগেই। ওরা ওদের নির্ধারিত জায়গায় অপেক্ষা করছে।
ম্যাথিউ সাফওয়ান আর রুমাইশা কে গোপন রাস্তা পর্যন্ত সেইফলি পৌছে দিয়ে নিজেই লড়ে যাচ্ছে গার্ড দের সাথে। বন্ধুর জন্য নিজের বসের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে সে। তাই এই গার্ড গুকো একটা ব্যাবস্থা করে দিয়ে খুব শীঘ্রই সেও তার আন্ডারে থাকা ছেলে গুলোকে নিয়ে পালাবে। ওদের গাড়ি গুলো ভার্সিটির বাইরেই দাড় করানো।
ইতোমধ্যে ম্যাথিউ খবর পেয়েছে হারবার্ট তার পার্সোনাল হেলিকপ্টারে ভার্সিটির উদ্দ্যেশ্যে রওনা দিয়েছে। আর তার দৃঢ় বিশ্বাস, হারবার্টের টার্গেট এখন সে নিজেই, কারণ সে-ই সাফওয়ান কে পালাতে সাহায্য করেছে। আর সাফওয়ান কোথায় গিয়েছে সেটাও শুধু সে-ই বলতে পারবে।
৭৫. দুজন গার্ড সহ হেলিকপ্টারের পেছনে বসে আছে হারবার্ট। চোখে তার ভাবুক দৃষ্টি। হেলিকপ্টারের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে সে, আর তার মাথার ভেতরে চলছে স্মৃতির রোমন্থন।
আজ পর্যন্ত তিনি যতগুলো মানুষ কে দিয়ে নিজের খুব গোপন আর অসাধ্য মনে হওয়া কাজ গুলো করিয়েছেন তাদের ভেতরে সাফওয়ান তার সবচেয়ে বিশ্বাসভাজন ব্যাক্তি। সমস্ত পৃথিবীর কোণা কোণা থেকে সেই সমস্ত লোকজন কে মৃত্যুর মুখে পাঠাতে সাফওয়ানের ডাক আসতো, যাদের কে কেউ কোনোভাবেই কাবু করতে পারেনি।
কিন্তু অন্যরা যেটা পারতো না সেটা সাফওয়ান খুব সহজেই করে ফেলতো। রাতের আধারে সে বেরিয়ে পড়তো ভোগে পাঠানোর অর্ডারকৃত ব্যাক্তিটার উদ্দ্যেশ্যে। এবং খুবই দক্ষতার সাথে বিশাল নিরাপত্তা প্রহরী ডিঙিয়ে, এতএত সিকিউরিটি ক্যামেরা পেরিয়ে, এত এত অ্যালার্ট সিস্টেম পেরিয়ে সে ঠিকই সেই ব্যাক্তির একান্ত ব্যাক্তিগত কামরায় পৌছে যেত। এবং সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ব্যাপার এটাই যে, কোনো ধারালো অস্ত্রের সাহায্য ছাড়াই সে নিমিষেই যে কাউকে দুনিয়া ছাড়া করে ফেলতো, হয়তো তার হাত পা ছিড়ে, আর নয়তো তার নিজের ভেনম দিয়ে।
প্রথমবার হারবার্ট যখন সাফওয়ানের সন্ধান পায় তখন সাফওয়ান সিঙ্গাপুর ভার্সিটির বোটানিক্যাল ডিপার্টমেন্টের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। হ্যাংলা পাতলা শরীরে মাথায় ঝাকড়া চুল, চোখের দিকে তাকালে মনে হতো কি নিদারুণ দুঃখ নিয়ে সে এই পৃথিবীর প্রতিটা মুহুর্ত পার করছে। কিন্তু হারবার্ট তখন ও জানতো না যে এই ছেলেটার বিশেষত্ব কি!
সাফওয়ান হারবার্টের হয়ে কাজ করার আগেই বলে দিয়েছিলো, যে, সে যে কাজ করবে এইটা যেন হারবার্ট ছাড়া আর অন্য কেউই না জানে। কিন্তু সেটা ঠিক কি কারণে, তা জানতো না হারবার্ট। তবে হারবার্ট তার কথা রেখেছিলো, কাউকেই সাফওয়ানের ব্যাপারে বলেনি সে। ইভেন সাফওয়ান আজ পর্যন্ত যে গুটি কয়েক মানুষের হয়ে কাজ করেছে সবার কাছেই সাফওয়ানের এই একই শর্ত ছিলো। কিন্তু তার কারণ সবারই অজানা ছিলো।
সাফওয়ান কে দেখে হারবার্টের মায়া হতো অনেক। সারাটা দিনের সারাটা ক্ষন যেন সাফওয়ান দুঃখবহন করে বেড়াতো। মাঝে মাঝেই আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকত, আর কি যেন বিড়বিড় করতো। হয়তো সৃষ্টিকর্তার কাছে জীবনের প্রতি অভিযোগ জানিয়ে জানিয়ে আকাশ ভারি করে ফেলতো সে৷
সাফওয়ান কে দেওয়া প্রথম দুইটা কাজ খুবই দক্ষতার সাথেই করে সে। যদিও হারবার্ট ভেবেছিলো, যে আস্তানায় সাফওয়ানকে সে পাঠাচ্ছে, সেখান থেকে বেচে ফেরা এক রকম অসম্ভব। কিন্তু সেই অসম্ভবের তোয়াক্কা না করে সাফওয়ান সফল হয়েই ফিরে আসে। আর সাফওয়ান কে এমন সুস্থ সবল আর উইদাউট এন্যি স্ক্রাচ দেখে হারবার্ট অবাকতার চরম সীমায় পৌছায়।
কিন্তু এরপর আর ও অবাক হয় যখন পরদিন সকালে সে নিউজে খবর পায়, যাকে যমের দুয়ারে পাঠাতে সে সাফওয়ান কে নিযুক্ত করেছিল সে নাকি সাপে কেটে মারা গেছে, আর এটা নাকি এমন সাপ যার কোনো চিহ্নই নেই! এই প্রথম বার এমন কোনো অজানা সাপের সন্ধান পেয়েছিলো আমেরিকার বিজ্ঞানিরা।
আর এ ঘটনার পরই হারবার্ট আঁচ করতে পারে সাফওয়ানের ভেতরে কিছু তো একটা ঝামেলা আছে। তাই সাফওয়ানের থেকে ধীরে ধীরে ওর ব্যাক্তিগত কথা গুলো বের করার চেষ্টা করে হারবার্ট।
কিন্তু নিজের পরিবার পরিজনের কথা জিজ্ঞেস করলে কখনোই বলতো না সাফওয়ান। উলটো ওর মুখ টা চুপসে যেত, মুখের ওপর এসে ভর করতো এক রাশ হতাশা আর কষ্ট, তাই সাফওয়ানের ফ্যামিলি নিয়ে আর বেশি প্রশ্ন করতো না হারবার্ট। আর সাফওয়ানের এমন করুণ চাহনি হারবার্টের বুকে গিয়ে লাগতো। তারপর ধীরে ধীরে সাফওয়ানকে খুবই স্নেহের চোখে দেখা শুরু করে সে। কিন্তু সাফওয়ানের প্রতি তার সে স্নেহ বেশিদিন টেকেনি।
সাফওয়ান ততদিনে আবার সিঙ্গাপুরে ফিরে আসে, নিজের পড়াশোনার পাশাপাশি রেপটাইল নিয়ে হিউজ চর্চা শুরু করে সে। পাশাপাশি নিজের দাদুর পুরোনো বন্ধুদের খুজে বের করে তাদের থেকে যত ইনফর্মেশন সম্ভব নিয়ে সে নিজের ভেনমের এন্টিভেনম তৈরি করার জন্য কেমিস্ট্রি এর ওপর ব্যাপক পড়াশোনা শুরু করে৷ আর সেই সুবাদেই তৈরি হয়ে যায় তার সুনির্দিষ্ট কিছু কেমিস্ট বন্ধু সার্কেল, যাদের সাথে পরবর্তীতে সে এন্টিভেনমের পাশাপাশি মেডিসিন এন্ড ড্রাগস তৈরিতেও লেগে পড়ে। আর আস্তে আস্তে হয়ে পড়ে ফার্মাসিউটিক্যাল সায়েন্টিস্ট।
হারবার্ট সহ অন্যান্য দের দেওয়া একের পর এক কাজ, তার পাশাপাশি পড়াশোনা আর ড্রাগস তৈরি, এই সবকিছুই একসাথে চালাতে থাকে সাফওয়ান৷ আস্তে আস্তে একজন প্রফেশনাল হিটম্যান হিসেবে আন্ডারগ্রাউন্ডে এক হিউজ জনপ্রিয়তা অর্জন করে সে আর তার পাশাপাশি মেডিসিনের এক বিশাল বিজনেস শুরু হয় তাদের সেই ছোট্ট সার্কেল টার। আস্তে আস্তে সিঙ্গাপুরেই নিজের এক বিশাল সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলে সাফওয়ান। কিন্তু এর কিছুদিন পরেই বাধে আসল ঝামেলা৷
হারবার্টের দেওয়া একটা টাস্ক কমপ্লিট করতে সাফওয়ান ব্রিটেনের এক সিনেটর কে খুন করে নিজের ভেনমের সাহায্যে। সেই সিনেটর ছিলেন হারবার্টেরই একজন খুবই কাছের বন্ধু, যাকে নিজের স্বার্থের কারণে নিজের রাস্তা থেকে সরিয়ে দেয় হারবার্ট।
আর এরপর সেই লাশ যখন পোস্টমর্টেমের জন্য নিয়ে যাওয়া হয় তখন লাশের শরীর থেকে পাওয়া ভেনম কে এইবার বিশেষ ভাবে এক্সামিন করা হয়। পোস্টমর্টেম যিনি করেন তিনিও ছিলেন হারবার্টেরই একজন কাছের বন্ধু। আর সে-ই হারবার্ট কে এই ভেনমের ব্যাপারে ডিটেইলস বলে, যার সারমর্ম ছিলো এই যে, এই ভেনম এতটাই পয়জোনাস, যে এর একটা সিঙ্গেল ফোটা দশ মিনিটের ভেতরেই একজন পূর্ন বয়স্ক ব্যাক্তি কে মেরে ফেলতে সক্ষম।
আর এর যেহেতু কোনো এন্টিভেনম নেই, তাই যার শরীরে ভেনম টা পুশ করা হবে তার মৃত্যু অনিবার্য।
আর এরপরই কৌতুহল বসত বিশ্ববাজারে এই ভেনমের একটা স্যাম্পল পেশ করে হারবার্ট, আর সেটা পেশ করার পরই এর মূল্য যেটা উঠে সেটা দেখে চমকে যায় হারবার্ট। সে যা ধারণা করেছিলো তার থেকেও অনেক অনেক বেশি দামী ছিলো সাফওয়ানের ভেনম টা। আর এ ঘটনার পরই শুরু হয় হারবার্টের লোভ৷
সাফওয়ান ওর তৈরি করা রেপটাইল ল্যাবে আশেপাশের সমস্ত রেপটাইল গুলো কে গায়ে জড়িয়ে বসে থাকতো, সেটা ওর কাছে ছিলো এক অন্য ধরনের শান্তি। কিন্তু কাজের চাপে সাফওয়ান যখন আমেরিকাতে ছিলো বেশ কিছুদিন তখন তার এই শান্তিতে ব্যাঘাত ঘটতে শুরু করে, যার কারণে হঠাৎই একদিন অসুস্থ হয়ে পড়ে সাফওয়ান। জংলির মতো আচরণ শুরু করে দেয় ও।
আর এই খবর পাওয়া মাত্রই হারবার্ট ওকে নিয়ে যায় ওর সেই পোস্টমর্টেম কারী বন্ধুটির কাছে। তিনি সাফওয়ানের সম্পুর্ন দেহ টা চেইকআপ করেন, আর সন্ধান পান সৃষ্টিজগতের এক অবিশ্বাস্য সৃষ্টির৷
সাফওয়ানের ভেনম গ্রন্থি আর ভেনম থলিটা চেইক করে দেখেন তিনি। আর এরপর যখন তিনি হারবার্ট কে ইনফর্ম করেন যে সাফওয়ান তার ভেনম থলিতে দুশো পঞ্চাশ গ্রাম ভেনম ধারন করে আছে তখন হারবার্টের চোখ দুইটা টাকার লোভে চকচক করে উঠে।
কিন্তু সাফওয়ান এর এ ভেনম সব একবারে নিতে গেলে সাফওয়ান বাচবে না, কারণ ওর ভেনম গ্রন্থি আর ভেনম থলি ওর হৃৎপিণ্ড সহ কিডনির সাথে এমন ভাবে জড়িত, যে ভেনম থলি টা পুরোপুরি নিতে গেলে সাফওয়ানের মৃত্যু অবধারিত। তাই হারবার্ট সিদ্ধান্ত নেয় আর ও কিছুদিন পর সাফওয়ানের কাছে সে প্রস্তাব দিবে অল্প অল্প করে তার ভেনম যেন সে হারবার্টের কাছে বিক্রি করে, এতে সাফওয়ান ও সুস্থ থাকবে, আর হারবার্ট ও লাভবান হবে।
কিন্তু হারবার্টের এ সমস্ত পরিকল্পনা ভেস্তে যায়, যখন সাফওয়ান নিজের এ প্রফেশন থেকে অব্যাহতি দিয়ে নিজের মাতৃভূমি তে ফেরত আসার চিন্তা ভাবনা করে। সাফওয়ানের এ সিদ্ধান্তে তখনই বাধ সাধে হারবার্ট। তার একটাই কথা সাফওয়ান কিছুতেই এই কাজ ছাড়তে পারে না। কারণ তার মতো দক্ষ হাতে কেউই এই কাজ গুলো করতে পারবে না, কেউ করতে গেলে নির্ঘাত মারা পড়বে। কিন্তু সাফওয়ান হারবার্টের কথা কানেই নেয় না। নিজের এ প্রফেশন থেকে বের হয়ে দেশে আসার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে থাকে। আর দেশ থেকে একবার ঘুরে আবার সিঙ্গাপুরে ফিরে গিয়ে ভার্সিটি তে টিচিং প্রফেশনে ঢোকার সিদ্ধান্ত নেয়।
সাফওয়ানের এমন অনড় সিদ্ধান্তে চিন্তায় পড়ে যায় হারবার্ট৷ কিন্তু, তারপরও সে সাফওয়ান কে প্রস্তাব দেয় ভেনম বিজনেসের ব্যাপারে। কিন্তু সাফওয়ান এবার হারবার্ট কে সরাসরি না করে দেয়। আর দ্বিতীয় বার যেন হারবার্ট এ ধরনের কথা বলার স্পর্ধা না দেখায় সে বিষয়েও হারবার্ট কে সতর্ক করে দেয় সাফওয়ান। আর তাতেই রেগে যায় হারবার্ট।
সাফওয়ানের সিঙ্গাপুরের ভার্সিটির টিচার হওয়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নের রাস্তায় বিশাল এক বাধার সৃষ্টি করে। আর এরপর ধীরে ধীরে লোক লাগিয়ে আর ষড়যন্ত্র করে সাফওয়ান আর ওর ফেলো পার্টনারদের তৈরিকৃত ফার্মাসিউটিক্যাল ল্যাব টাও বন্ধ করে দেয়। কিন্তু তাতেও দমে না গিয়ে সাফওয়ান যখন পুরোদমে দেশে আসার প্রস্তুতি নিতে শুরু করে তখনি হারবার্ট তার ছেলেদের উদ্দ্যেশ্যে বলে যে সাফওয়ান কে আর তোষামোদ করার কোনো প্রয়োজন নেই। এখন ওর জীবনের কোনো মূল্য নেই হারবার্টের কাছে। তাই সাফওয়ান কে পৃথিবীর যে প্রান্তে পাওয়া যায় সেখান থেকেই উঠিয়ে নিয়ে এসে ওর ভেনমের থলি টা কেটে ফেলার আদেশ দেয় ও। আর এরপর থেকেই শুরু হয় সাফওয়ান কে খোজার অভিজান।
৭৬.
আন্ডারগ্রাউন্ড টানেলের ভেতর দিয়ে ছুটে চলেছে ওরা দুজন। ষাট কিলো রাস্তার অর্ধেকের কিছুটা বেশি পার করে ফেলেছে। ম্যাপে দেখানো রাস্তা অনুযায়ীই ওরা চলেছে। ম্যাপ টা সাফওয়ান ভাজ করে ওর প্যান্টের পকেটে পুরে রেখেছে। যখনি কনফিউশানে পড়ছে ম্যাপ টা বের করে দেখে নিচ্ছে। আর সেই সাথে একটু জিড়িয়েও নিচ্ছে ওরা।
রুমাইশার পানি তৃষ্ণা পেয়েছে, কিন্তু ওদের সাথে কোনো পানি নেই। গলা বুক শুকিয়ে গেছে ওর, কিন্তু কিছুই করার নেই। মাঝে মাঝেই দাঁড়িয়ে দম নিচ্ছে ও। সাফওয়ানের কষ্ট হচ্ছে ওকে এইভাবে দেখে। ও কয়েক বার বলেছে রুমাইশা কে, ওর কোলে উঠে বসতে, তাহলে রুমাইশার কষ্ট টা একটু কম হবে, কিন্তু রুমাইশা শোনেনি।
সাফওয়ানকে ও মোটেই কষ্ট দিতে চাচ্ছে না, ছুটে দুজনেই ক্লান্ত হয়ে গেছে, কিন্তু এখন রুমাইশা নিজের কষ্ট কে প্রাধান্য দিয়ে সাফওয়ানের ওপর নিজের ভর ছেড়ে দিলে সেটার মতো অমানবিকতা আর কিছুই হবে না।
ইতোমধ্যে জোনাস আর রবার্ট কয়েকবার যোগাযোগ করেছে ওদের সাথে। কারণ এত দেরি হওয়ার কথা না ওদের, তারপর ও দেরি হচ্ছে কেন সেটাই ওরা বুঝতে পারছে না।
রবার্টের ফ্যালকন এইট এক্স টা সমুদ্রের পাড়েই আছে। রানওয়ের জন্য সেটাকে সমুদ্রের পাড়ে নিয়ে গেছে ওরা। সাফওয়ান আর রুমাইশা যেখানে এসে থামবে সেখান থেকে আর ও দু কিলো দূরে অবস্থান করছে জোনাস আর রবার্ট। দুজনেই ওরা চিন্তিত নিজের বন্ধু আর বন্ধু-পত্নীর এমন অবস্থায়।
.
আর ও দশ কিলো এগোনোর পর রুমাইশা হঠাৎ করেই দাঁড়িয়ে গেলো। রুমাইশা কে ছাড়িয়ে বেশ খানিক টা পার হয়ে গেলো সাফওয়ান৷ কিন্তু রিমুর অনুপস্থিতি টের পেতেই দাঁড়িয়ে গেলো ও নিজেও। পেছন ফিরে দেখলো রুমাইশা টানেলের দেয়াল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। দম ফেলছে ও ঘন ঘন। এত সময় ধরে এক নাগাড়ে ছোটার ফলে ওর চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে।
সাফওয়ান দ্রুত গতিতে এগিয়ে আসলো ওর দিকে এসেই নিজের দুহাতে রুমাইশার মুখখানা ধরে বলল,
— ঠিক আছিস তুই? কি হচ্ছে বল আমাকে! শরীর খারাপ লাগছে? বসবি কিছুক্ষণ?
রুমাইশা প্রতিউত্তরে কিছুই বলল না, ফ্যালফ্যাল করে অসহায়ের মতো খানিকক্ষন তাকিয়ে রইলো শুধু সাফওয়ানের চোখের দিকে। কিন্তু এরপর হঠাৎ করেই গা গুলিয়ে উঠলো ওর। ধপ করে মাটিতে বসে পড়ে হড়হড় করে বমি করে দিলো ও।
আঁতকে উঠলো সাফওয়ান। তড়িঘড়ি করে নেতিয়ে পড়া রুমাইশা কে বমি করা জায়গা টা থেকে সরিয়ে এনে আলতো করে নিজের বুকের ওপর টেনে নিলো ও। তারপর রুমাইশার চুলের ওপর দিয়ে ওর মাথায় একটা চুমু বসিয়ে দিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলো,
— কি হচ্ছে, বল আমাকে! কোথায় কষ্ট হচ্ছে পাখি আমার! না বললে আমি বুঝবো কিভাবে! কথা বল!
রুমাইশা এবার ও কিছু বলল না। নিজের নেতিয়ে পড়া শরীর টার সম্পুর্ন ভার সাফওয়ানের ওপর ছেড়ে দিলো ও। তারপর সাফওয়ানের বুকের সাথে নিজের কপাল আর নাক ঠেকিয়ে রেখে অনেক কষ্টে নিজের গলা দিয়ে মৃদু আওয়াজ বের করে ও বলে উঠলো,
— আপনি বাবা হতে চলেছেন সাফওয়ান, গত তিনমাস ধরে আপনার ছোট্ট অস্তিত্ব টা আমার গর্ভে একটু একটু করে বেড়ে উঠছে! আমি আর পারছিনা ছুটতে!
সাফওয়ান যেন জমে গেলো নিজের জায়গায়, নিজের কান কে ও যেন বিশ্বাস করতে পারলো না। আর এখন, এই মুহুর্তেই ভীষণ কান্না পেলো ওর।
ওর বুকের ভেতর কষ্ট হতে লাগলো প্রচুর, মনে হচ্ছে কলিজাটা কেউ ছিড়ে নিয়ে যাচ্ছে। ওর তিনমাসের গর্ভবতী স্ত্রীর ওপর দিয়ে এইমুহূর্তে যে হিউজ প্রেশার টা যাচ্ছে তার জন্য সম্পুর্নভাবে দায়ী ও নিজে। আজ যদি কোনোভাবে ওর রিমু আর ওর অনাগত সন্তানের কিচ্ছুটি হয়, তাহলে ও নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না, কোনোদিন ও না।
দাঁতে দাঁত চেপে রইলো সাফওয়ান। বুকের ভেতর টা ওর দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। কোনো কিছু না ভেবেই ও নিজের পোশাকের ওপরের অংশ খুলে ফেললো, আর তারপর কোলে তুলে নিলো রিমুকে। এরপর রিমুর হাত দুইটা নিজের ঘাড়ের পেছনে দিয়ে, গায়ের খুলে ফেলানো পোশাক টা দিয়ে রিমুর হাত দুইটা বেধে দিলো শক্ত করে, যেন রিমু শক্তি হারালেও ওকে আকড়ে ধরতে পারে।
এরপর রিমুর ব্যাকপ্যাক হাতড়ে আর একটা টি শার্ট পেলো সাফওয়ান, সেটা দিয়ে রিমুর পা দুইটা নিজের কোমরের পেছন দিকে এক সাথে নয়ে বেধে দিলো শক্ত করে। আর এরপর আর একটা ট্রাউজার বের করে নিয়ে রুমাইশার কোমরের সাথে নিজের কোমর টা বেধে নিলো। তারপর ওর কাধের ওপর মাথা রাখা রুমাইশার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,
— শক্ত করে ধরে রাখ আমাকে, জীবন চলে গেলেও আমাকে ছাড়বি না। আর আমার প্রাণ থাকতে আমি তোদেরকে ছাড়বো না।
আর এরপর রুমাইশা কে কোলে নিয়েই সাফওয়ান নিজের সর্বোচ্চ গতিতে ছুটে চলল ওর গন্তব্যের দিকে।