ফ্লোরেনসিয়া – ৪৮

খারকিভ, ওয়াভেল কোট।

নিবিড় শ্বেত মার্বেল পাথরের মেঝেতে বসে সোফার সাথে পিঠ ঠেকিয়ে রেখেছে সিয়া। একটুকরো খাবারও মুখে তুলেনি ও। চব্বিশ ঘন্টারও বেশি সময় চলে গেছে। ঘড়িতে চারটে বাজে। গতকাল সকালে একাডেমিতে যাওয়ার আগে একটুখানি খাবার খেয়েছিলো ও। ক্রমশ শরীর দুর্বল হয়ে আসছে। আর কতক্ষণ না খেয়ে থাকা যায় একটা মানুষের পক্ষে? পেট মোচড়াচ্ছে। গুড়গুড় আওয়াজ করছে। কামরার ডানদিকে ওয়াশরুম। মুখে আর মাথায় পানি দিলে ভালো লাগবে হয়তো। কিন্তু জেদ ধরে বসে আছে। রাগ হচ্ছে। খুব বেশিই রাগ হচ্ছে ওর। ওষ্ঠদ্বয়ের সাথে ফর্সা গাল দু’টো আর নাকের অগ্রভাগ লাল হয়ে উঠে। রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে মেঝের দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে।

ঘটনাটা অপ্রত্যাশিত। এদুয়ার্দো দায়ী নয়। হঠাৎ করে পড়ে গিয়েই দুর্ঘটনাটা ঘটে গেছে। কিন্তু সেকথা সিয়াকে কে বোঝাবে? ও রাগে ফুঁসছে। মনে মনে গালি দিয়ে এদুয়ার্দোর ভ্যাম্পায়ার গোষ্ঠী উদ্ধার করছে। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে ইতোমধ্যে কয়েকবার ঠোঁট ঘষামাজা করা শেষ। এদুয়ার্দো সরু দৃষ্টিতে কপাল কুঁচকে ক্ষণকাল তাকিয়ে রইলো। ভীষন বিরক্তবোধ করলো। বারবার ঠোঁট মুছে ও কি প্রমাণ করতে চাইছে? ওর ঠোঁটজোড়ায় কি নোংরা কিছু লেগে গেছে? এতোবড় অপমান! বরদাস্ত করবে না এদুয়ার্দো। সে শক্ত গলায় বলে,,,

– এভাবে ঠোঁট মুছে কি বুঝাতে চাইছো? অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা কি স্বইচ্ছায় ঘটানোর ইঙ্গিত দিচ্ছো?

সিয়া রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকায়। এদুয়ার্দো পাত্তা দেয় না। কঠিন কন্ঠে বলে,,,

– আমি বিন্দুমাত্র আগ্রহী নই।

– অ’সভ্য। নি’র্লজ্জ র’ক্তপিপাসু। দুর হও আমার সামনে থেকে।

এদুয়ার্দোর চোয়াল শক্ত হয়ে উঠে। সিয়ার সাহস বেড়ে গেছে।

– ইচ্ছে করে কিছু করিনি। এই বিব্রতকর পরিস্থিতির জন্য তুমি দায়ী। পারবে না জেনেও কেনো লড়তে এসেছিলে? বাচ্চা মেয়ে। বোকার হদ্দ। ঘটে বুদ্ধি নেই একটুও?

সিয়া কিছু বলতে চেয়েও থেমে যায়। এদুয়ার্দোর সাথে কথা বলতেও ওর অস্বস্তি হয়। নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করে। ও কি নিজের লক্ষ্য থেকে সরে যাচ্ছে? দুর্বল হয়ে পড়ছে অন্য সবার মতো? ভুলে যাচ্ছে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিটাই ওর মায়ের হ’ত্যাকারী? সিয়া মনে মনে ভাবে।

এদুয়ার্দো শান্ত চোখে দেখে। সিয়ার মন পড়ে। তার শক্ত কঠিন মুখখানা স্বাভাবিক হয়ে আসে। সিয়াকে কোনো কৈফিয়ত দিবে না সে। ওর কাছে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার কোনো প্রয়োজন মনে করে না। কি যায় আসে কেউ তার সম্পর্কে ভুল ধারণা পোষণ করলে?

– ঈশ্বর কবে আমার দিকে মুখ তুলে চাইবেন? আমি একটা শক্তিহীন দুর্বল মেয়ে। যদি তিনি সহায় না হন, আমি কিভাবে যুদ্ধে জয়ী হবো? কিভাবে ধ্বং’স করবো ওদের?___সিয়া মনে মনে ভাবে।

এদুয়ার্দো নিশ্চুপ নির্বাক। মুখখানা অদ্ভুত রকম ভারী। ডিয়েটসের পরিবার ধ্বংসের জন্য এদুয়ার্দোর পরিবার দায়ী। সেকথা অস্বীকার করার কি কোনো উপায় আছে?

সিয়ার মুখখানাও হঠাৎ থমথমে হয়ে উঠে। চাহনি নিষ্প্রাণ। এই বাচ্চামো ওর দ্বারা শোভা পায় না। মায়ের কথা ভীষণ মনে পড়ে। দু’চোখের পাতা বুজে নেয়। মনে পড়ে যায় ইনায়ার কথা। কান্না আসে না। চোখ থেকে একফোঁটা অশ্রুকণা গড়ায় না। বুকের অভ্যন্তরে ধিকিধিকি আগুন জ্বলতে শুরু করে। আর যাই হোক, ও নিজের প্রতিশোধের কথা ভুলে যেতে পারেনা। ওর জীবনের সবচেয়ে বড় শত্রু এদুয়ার্দো। যাকে ধ্বংস করার প্রতিজ্ঞা করেছে ও। শনিবার আর রবিবার সপ্তাহে দু’দিন ইনায়া, আর্নি আর ক্রিস্তিয়ানের সাথে ইম্যুভিলের চার্চে যেত। ঈশ্বরের কাছে ওর একটাই প্রার্থনা ছিলো। সবগুলো র’ক্তপিপাসুদের বিনাশ করবে ও। কিছুক্ষণ আগে ঘটা ঘটনাটার কথা ভুলে যায় সিয়া। নিষ্প্রভ কন্ঠে অনুচ্চস্বরে বলে,,,

– যদি আমার ঈশ্বর চান, একদিন তুমিও বুঝবে মা হারানোর যন্ত্রণা কতটা অসহনীয়। তোমার চোখের সামনে একে একে ধ্বংস হবে তোমার প্রিয়জনগুলো।

এদুয়ার্দোর চেহারা আরও গম্ভীর হয়ে উঠে। একপলক সিয়ার দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে, পরমুহূর্তেই চোখ সরিয়ে নেয়। ত্বরিত দাঁড়িয়ে পড়ে সে। থমথমে পায়ে হেঁটে দরজা খুলে কামরার বাইরে বেরিয়ে যায়।

________

ইম্যুভিল, ফ্রাঙ্কলিনের বাড়ি।

এ বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষ দিকবিদিক জ্ঞানশুন্য বোধ করে। তাদের সন্দেহটাকে ভয়াবহ আতঙ্কে বদলে দিয়ে ইনায়াও নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে। মাদাম ল্যারির মুখশ্রী ফ্যাকাশে। বারবার বারণ করা সত্ত্বেও মেয়েটা একাডেমিতে গিয়েছিলো। কথা ছিলো ক্লাস করবে না ও, শুধু ইজাবেলের সাথে দেখা করে বাড়িতে ফিরে আসবে।

– ইনায়ার গলায় ক্রুশ লকেট ছিলো। তবুও জা’নোয়ারটা ওকে স্পর্শ করার দুঃসাহস কি করে পেলো?____ক্রিস্তিয়ান আর আর্নিকে জিজ্ঞেস করেন স্ট্রিকল্যান্ড কুরী।

– ও যদি স্বইচ্ছায় চলে যায়। তাহলে ওকে তুলে নিয়ে যাওয়ার জন্য দুঃসাহসের কি প্রয়োজন বাবা?___ ক্রিস্তিয়ান অকপটে বলে। তীব্র ভয়ে আর্নি কাঁপতে শুরু করে।

– স্বইচ্ছায় চলে গেছে মানে?___ বিস্মিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করেন ফ্রাঙ্কলিন।

– হ্যাঁ। আত্মরক্ষার কোনো চেষ্টা করেনি ইনায়া। আমি জানিনা ওর মাথায় কি চলছিলো। ঐ শ’য়তানগুলোর সাথে কেনো চলে গেল?

– দুশ্চিন্তায় আমার মাথা ফেটে যাচ্ছে। সম্পূর্ণ ঘটনা খুলে বলো। ___রাগমিশ্রিত কন্ঠে কথাটা বলেন স্ট্রিকল্যান্ড কুরী।

আজ ইজাবেল একাডেমিতে আসেনি। ব্রেক টাইম পর্যন্ত ক্লাস করে ইনায়া। গতকালই প্রতিযোগিতা শেষ। আজ থেকে নির্দিষ্ট সময়ে ক্লাস শুরু হওয়ার কথা ছিলো। মূলত ক্লাস শুরু হওয়ার পর আর বাইরে বের হয়ে আসতে পারেনি ও। আর্নিও নিজের ক্লাসে গিয়ে প্রশিক্ষণে অংশগ্রহন করেছিলো। বিরতির পর আর্নি আর ইনায়া ভবনের বাইরে বেরিয়ে আসে। ক্রিস্তিয়ান তখনো মাঠে দাড়িয়ে ছিলো। ইনায়া ভীষণ চিন্তিত। অন্যমনস্ক হয়ে কি যেন ভাবছিলো। তন্মধ্যে আর্নি ওকে জিজ্ঞেস করে,,,,

– কি ভাবছো? ইজাবেল একাডেমিতে আসেনি। এবার কি হবে?

– জানিনা। চিঠিতে দু’দিনের মধ্যে অ্যাভোগ্রেডোর হাতে জিনিসগুলো তুলে দেওয়ার কথা বলেছিলো। বুঝতে পারছি না, এই মুহূর্তে আমার কি করা উচিত। শুধু জানি, যেভাবেই হোক সিয়াকে ফেরত চাই। আমি ওর কোনো ক্ষতি হতে দিবো না।___ইনায়া ম্লান কন্ঠে বলে।

– মাথা ঠান্ডা রেখে ভাবতে হবে ইনায়া। কোনো হঠকারী সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না।___শান্ত গলায় কথাটা বলে উঠে ক্রিস্তিয়ান।

হাঁটতে হাঁটতে তিনজনে একাডেমির প্রধান ফটকের সামনে গিয়ে দাড়ায়। ক্রিস্তিয়ান একটা ক্যারিজ ডেকে নেয়। ওরা তিনজনে ক্যারিজে চড়ে বসে। আর্নি আর ইনায়া ভিতরে। ক্রিস্তিয়ান বসে কোচওয়ানের পাশে। জোড়া অশ্বের পিঠে চাবুক পড়তেই দ্রুত গতিতে চলতে শুরু করে ক্যারিজ। তিনজনেই ভীষণ দুশ্চিন্তায় ছিলো। শহর ছাড়িয়ে কখন মাঝপথে চলে আসে, জানা নেই কারো। ছোট খাটো একটা বন। অসংখ্য বার্চ বৃক্ষ। আচমকাই দাড়িয়ে পড়ে ঘোড়া দু’টো। সম্বিত ফিরে পায় ওরা। ইনায়া জোর গলায় জিজ্ঞেস করে,,,,

– ক্রিস্তিয়ান! কি হলো? ক্যারিজ থেমে গেল কেনো?

– দাড়াও দেখছি।

চারদিকে অদ্ভুত নিস্তব্ধতা বিরাজ করছিলো। ক্রিস্তিয়ান নেমে দাড়ায়। ক্যারিজের চাকাগুলো ঠিক আছে কিনা দেখে নেয়। সবগুলো চাকা ঠিক ছিলো। কোচওয়ান অনবরত চাবুক আঘাত করে। আর্ত কন্ঠের তীব্র অশ্বারব শোনা যায়। অথচ একপাও সামনে এগোয় না ঘোড়াগুলো। ফিটন থেকে নেমে দাড়ায় ইনায়া আর আর্নি। চারজনেই অজানা আতংকে জড়োসড়ো হয়ে রয়।

ক্ষণকাল সময় গড়ায়। সহসা কতগুলো বাদুড় উড়ে আসে। ঝাঁকে ঝাঁকে, অসংখ্য। অন্তর আত্মা শুকিয়ে যায় ওদের। অদ্ভুত শব্দ করে বাদুড়গুলো সবাইকে আক্রমণ করে বসে। বাদ যায় না ঘোড়া দু’টোও। ইনায়া অবাক হয়। বুঝে নেয় শয়তানগুলো এসে গেছে। কিন্তু এখানে কেনো? কথা ছিলো বরফ ঢাকা বিস্তর প্রান্তরে অপেক্ষা করবে। ইনায়াকে আরও বেশ খানিকটা চমকে দিয়ে অকস্মাৎ ওদের চারদিকে একটা কালো ধোঁয়ার কুন্ডলী ঘুরতে শুরু করে। একটা নয়। কয়েকটা। ইতোমধ্যে কোচওয়ান আর ঘোড়া দু’টো রক্তাক্ত হয়ে গেছে। আর্নি চিৎকার করতে শুরু করে। ক্রিস্তিয়ান আর্নিকে বুকের কাছে আগলে নেয়। দু’হাতে বাদুড়গুলোর করা আক্রমণ প্রতিহত করে। কিন্তু পেরে উঠে না সে। ইনায়া ক্রুদ্ধ কন্ঠে বলে,,,,

– সাহস থাকলে সামনে এসো।

পাঁচ পাঁচটা ধোয়ার কুন্ডলী মানুষের অবয়ব ধারন করে। ইনায়া সর্তক দৃষ্টিতে তাকায়। চোখের সামনে পাঁচজন পুরুষ দাঁড়িয়ে আছে। সামনের পুরুষটাকে দেখে ওর অক্ষিকোণে রক্ত জমাট বেঁধে যায়। ক্রোধের আধিক্যে থরথরিয়ে শরীর কাঁপতে শুরু করে। লাল টুকটুকে দু’ঠোঁটের কোণে ক্রুর হাসি ঝুলিয়ে আব্রাহাম দাঁড়িয়ে আছে।

– তুমি?____বিস্মিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে ইনায়া।

– হ্যাঁ। আব্রাহাম স্যাভেরিন।____ফ্লভেয়ার দৃঢ় গলায় বলে।

– জা’নোয়ার। নিজের কুৎসিত রাক্ষুসে বাদুড়গুলোকে থামাও।

– এতো তাড়া কিসের?

ইনায়া চোখের পলকে ছুটে গিয়ে দু’হাতে ফ্লভেয়ারের শার্টের কলার খামচে ধরে। যেন মাত্রারিক্ত ক্রোধ ওকে বুদ্ধিহীন করে তুলে। আক্রোশপ্রসূত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,,,,

– সিয়া কোথায়?

– সিয়া? মানে ফ্লোরেনসিয়া?

– হ্যাঁ। ওকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছে তোমার ভাই?

– ভাই? মানে এদুয়ার্দো?

– আমি তোমাকে মে’রে ফেলবো। আমার বোন কোথায়?

ফ্লভেয়ার ঠোঁট ছড়িয়ে হাসে। মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সে। মেয়েটা ভীষণ সুন্দর দেখতে। এজন্যই বুঝি তার ভাই আব্রাহাম ইনায়ার জন্য উন্মাদ হয়ে গেছে।

– শুনেছি, ক্রিসক্রিংগলের ছোট মেয়েটা নাকি আরও বেশি সুন্দরী। ওকেও তুলে নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মেয়েটা এসব কি বলছে? ওর বোনকে এদুয়ার্দো কোথাও লুকিয়ে রেখেছে?____ফ্লভেয়ার মনে মনে ভাবে। ইনায়ার নাম ধরে সহাস্যে ডাকে,,,,

– ইনায়া ইবতিসাম।

– ওদের থামাও। আর্নি আর ক্রিস্তিয়ানের থেকে ওগুলোকে দুরে সরাও।____ইনায়া ক্রোধিত কন্ঠে বলে।

– তুমি আমার সাথে এসো। বাদুড়গুলো ওদের এমনিতেই ছেড়ে দিবে।

ফ্লভেয়ারের কলার ছেড়ে দিয়ে সরে দাড়ায় ইনায়া। ছেলেটার কন্ঠস্বর আলাদা। এমন কেনো শোনা যায়? মনে হয়, আব্রাহাম নয়। ওর সাথে অন্য কেউ কথা বলছে।

– আমি তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছি।___ফ্লভেয়ার উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলে। ওদিকে অসংখ্য রক্তচোষা বাদুড়গুলো নিজেদের তীক্ষ্ণ ধারালো নখের আঘাতে আর্নি আর ক্রিস্তিয়ানকে ক্ষতবিক্ষত করে। আর্নি করুন স্বরে চিৎকার দিয়ে কাঁদে। ক্রিস্তিয়ান দৃঢ় গলায় বলে,,,,

– তুমি কোথাও যাবে না ইনায়া। মা’রো ওদের। নিজেকে রক্ষা করো।

– আমার কথা মেনে নাও। চলো আমার সাথে। তোমাকে সিয়ার কাছে পৌঁছে দিবো। কথা না শুনলে তোমার সাথে ওরাও ম’রবে। তুমি কি তাই চাও?___ফ্লভেয়ার উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলে।

সিয়ার কাছে যাবে। এই মুহূর্তে ইনায়ার জন্য এর থেকে বেশি আনন্দের আর কি হতে পারে? সাথে আর্নি আর ক্রিস্তিয়ানের সুরক্ষার প্রশ্ন। ওরা নিরাপদে বাড়িতে ফিরে যাক। ইনায়া সিদ্ধান্ত নেয়। কঠিন কন্ঠে বলে,,,

– আমি যাবো তোমার সাথে।

– বুদ্ধিমতী মেয়ে।____ফ্লভেয়ার সহাস্যে বলে। তার পেছনে চারজন ভ্যাম্পায়ার সেনা দাঁড়িয়ে। এরা পিদর্কার বিশ্বস্ত সেবক। ফ্লভেয়ার ইশারা করতেই বাদুড়গুলো জঙ্গলের দিকে উড়ে যায়।

– তুমি ভুল সিদ্ধান্ত নিচ্ছো। এই শ’য়তানগুলোকে বিশ্বাস করো না। ____ক্রিস্তিয়ান অনুরোধ করে। তার কন্ঠস্বরে অসহায়ত্ব প্রকাশ পায়। ভীত-সন্ত্রস্ত আর্নিকে দু’হাতে আগলে ধরে আছে সে।

– জানিনা ভাগ্যে কি আছে। যদি ঈশ্বর চান আবার দেখা হবে। যদি বাবা ফিরে আসেন। তাকে সামলে নিও ক্রিস্তিয়ান। ভালো থেকো। আশা করি নিরাপদে বাড়ি ফিরে যাবে।___ইনায়া ম্লান কন্ঠে বলে।

ক্রিস্তিয়ান ব্যথিত হয়। ভীষণ ভয় পায়। বক্ষস্থলে থাকা হৃদপিণ্ডটা দুমড়ে মুচড়ে যায়। কাতর কন্ঠে বলে,,,

– এরকম করো না। ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখো। সিয়াকে উদ্ধার করার কোনো না কোনো উপায় খুঁজে নিবো।

ফ্লভেয়ার বিরক্ত হয়। এইসব মেলোড্রামা দেখার সময় নেই। সে অকপটে জিজ্ঞেস করে,,,

– হেঁটে যাবে? নাকি তোমাকে কোলে তুলে নিবো?

– দুরে থাকো। হেঁটে যাবো। তবুও আমাকে স্পর্শ করার দুঃসাহস দেখাবে না।

ওকে প্রথমে প্রাসকোভিয়া জঙ্গলের সেই জরাজীর্ন কুটিরে নিয়ে যাওয়া যাক। এরপর কি করতে হবে সেই সিদ্ধান্ত মা নিবে। ভাবতেই ক্রুর হাসে ফ্লভেয়ার। ইনায়াকে উদ্দেশ্য করে বলে,,,,

– কিছুটা পথ এই ক্যারিজে করে যেতে পারো। বাকিটা পায়ে হেঁটে।

– বাকি রাস্তা টুকু হেঁটে বাড়ি ফিরে যাও ক্রিস্তিয়ান। জানি কষ্ট হবে। কিন্তু এছাড়া আর কোনো উপায় নেই। আর্নিসহ বাড়ির সবার খেয়াল রেখো। যদি ঈশ্বর সহায় হন, আবার দেখা হবে।

নিজের কথা শেষ করে ইনায়া ক্যারিজের ভিতরে গিয়ে বসে। কোচওয়ান রিতীমত কাঁপতে শুরু করে। পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পায়নি সে। ফ্লভেয়ার দিক নির্দেশনা দেয়। পিঠে চাবুক পড়তেই আহত ঘোড়া দু’টো পুনরায় চলতে শুরু করে। চারটে রক্তপিপাসু ধোঁয়ার কুন্ডলী হলে বাতাসে মিলিশে যায়। ক্রিস্তিয়ান নির্বাক চোখে দেখে।

– ইনায়াকে আমি বুদ্ধিমতী মেয়ে ভেবেছিলাম।___ হতাশ কন্ঠে বলে উঠেন মাদাম ল্যারি।

– এখন কি করবো? কোথায় খুঁজবো? রাত হয়ে এলো। আমার ভীষণ ভয় করছে বাবা। ওদের কোনো ক্ষতি করবে নাতো র’ক্তচোষা পি’শাচগুলো?

ক্রিস্তিয়ান প্রশ্ন করে। ওর প্রশ্নের উত্তর জানা নেই কারো। ফ্রাঙ্কলিন পায়ের নিচে অথৈয় শূন্যতা অনুভব করেন। স্ট্রিকল্যান্ড হিতাহিতজ্ঞানশূন্য। প্রত্যেকের মনে একাধিক প্রশ্ন। ক্রিসক্রিংগল ফিরে এলে তাকে কি জবাব দিবে? সিয়া ইনায়ার ভাগ্যে কি আছে? ওরা কি আদৌও বাড়িতে ফিরে আসবে কোনোদিনও?

_______

প্রাসকোভিয়া।

গহীন জঙ্গলে রাতের অন্ধকারে ছুটে যাচ্ছিলো কতগুলো ঘোড়া। একহাতে জ্বলন্ত মশাল অন্য হাতে ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরে প্রথম সারিতে ছিলেন মার্টিন লরেন্স, ক্রিসক্রিংগল আর মার্কস। পেছনে আরও বেশ কয়েকজন। ঘোড়া ছুটিয়ে জঙ্গলের সেই সরু খালটার কাছে পৌঁছে যায় তারা। দু’জন বাবার মনের কোণে কতশত উদ্বিগ্নতা। অধৈর্য হয়ে উঠে আত্মা। মেয়েদের দেখার প্রবল আকাঙ্ক্ষা। এইতো আর কিছুক্ষণ। তারপর দু’জন বাবা দেখা পাবে তাদের মেয়েদের।

সরু খালটার কাছে ঘোড়া থামিয়ে নেমে দাড়ায় সবাই। মার্টিন লরেন্স থমথমে ভরাট কন্ঠে বলেন,,,

– মার্কস। নৌকা প্রস্তুত?

– জ্বি মহামান্য মাস্টার।

মার্কস মশাল হাতে এগিয়ে যায়। খালের কিনারায় বেঁধে রাখা নৌকো ঠিক ঠাক আছে কিনা দেখে নেয়। ফিরে এসে মার্টিনকে জানায়। ক্রিসক্রিংগল আর মার্কসকে সাথে নিয়ে দ্রুত পায়ে হেঁটে মার্টিন নৌকায় চড়ে বসেন। তিনজনই ইম্যুভিলে যাবেন। বাকিরা ঘোড়া সমেত কেইভ অব জুপিটারে ফিরে যায়। কয়েক মিনিটের ব্যবধানে খাল পেরিয়ে নৌকা কিনারায় ভিড়ায় মার্কস। তিনজনেই লাফ দিয়ে স্থলভাগে নেমে দাড়ায়। দ্রুত পায়ে হাঁটতে শুরু করে আবার।

__________

খারকিভ, ওয়াভেল কোট।

এদুয়ার্দোর নির্দেশে স্যান্ড্রিকে লোহার কফিনে বন্দি করে রেখেছে অ্যাভোগ্রেডো। লোহার সংস্পর্শে স্যান্ড্রির শরীরের চামড়া পুড়ে যাচ্ছিলো। মাংসগুলোও বুঝি ক্ষয়ে পড়বে। মুখ বেঁধে রাখায় চিৎকার করতে পারছে না। কেবলই অসহনীয় যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিলো আর অস্পষ্ট স্বরে গোঙ্গাচ্ছিলো সে। তবুও মুখ খুলছে না। যেন মরণপণ করেছে। মা’রা যাবে তবুও সত্যি বলবে না। কিন্তু কতক্ষণ? এভাবে পাওয়া যন্ত্রণার থেকে একেবারে ম’রে যাওয়া ভালো ছিলো। এদুয়ার্দো ঠিক এরকমটাই চেয়েছিলো। সব সত্যি যখন বলবেই না। তাই স্যান্ড্রিকে তিলে তিলে মা’রার নির্দেশ দিয়েছে সে।

দুর্গের সবচেয়ে উঁচু টাওয়ারের ছাদে বসে জোসেফাইনের সাথে কথা বলছিলো এদুয়ার্দো। রাশভারী কন্ঠে তার প্রথম প্রশ্ন,,,,

– ফ্লোরেনসিয়া আপনার সম্পর্কে কিভাবে জানে? ওর সাথে আপনার পরিচয় কিভাবে হয়েছিলো?

– ফ্লোরেনসিয়া কে?_____জোসেফাইন বিস্মিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে। অথচ সে সিয়াকে চিনে।

– ডিয়েটসের নাতনি। ক্রিসক্রিংগলের ছোট মেয়ে।___এদুয়ার্দো শান্ত গলায় বলে।

জোসেফাইনের গলা শুকিয়ে আসে। তার মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বেরোয় না। ওভারলর্ড কি কাস্ত্রোরুজ থর্পের ঘটনাটা জেনে গেছে? কিন্তু কিভাবে?

– জোসেফাইন!___এদুয়ার্দো উচ্চস্বরে ডাকে।

জোসেফাইন সম্বিত ফিরে পায়। মৃদু কম্পিত কন্ঠে বলে,,,,

– ডিয়েটস ব্যতীত আমি কাউকে চিনি না। ক্রিসক্রিংগলের মেয়ের সাথে আমার কখনো দেখা হয়নি।

– আচ্ছা। ঠিক আছে। আপনি বসুন। আমি ওকে নিয়ে আসছি। অ্যাভোগ্রেডো, জনাব জোসেফাইনের খেয়াল রেখো।

ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকান জোসেফাইন। মনে মনে ভাবেন,,

– ওভারর্লড কাকে নিয়ে আসবেন? সিয়াকে নয়তো!

বুকের কাছে ডানহাত মুষ্টিবদ্ধ রেখে মাথা ঝোঁকায় অ্যাভোগ্রেডো। দৃঢ় কন্ঠে বলে,,,

– জ্বি মহামান্য মহারাজ।

এদুয়ার্দো দ্রুতপায়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে যায়। জোসেফাইন ভীত দৃষ্টিতে তার চলে যাওয়া দেখে।


বেসমেন্টে থাকা এদুয়ার্দোর কামরায় সোফার উপর নিশ্চুপ বসে ছিলো সিয়া। ভাবছিলো। কাস্ত্রোরুজ থেকে ইম্যুভিলে আসার সময় পথিমধ্যে আহত অবস্থায় কিছুক্ষণের জন্য ঘুমিয়ে পড়েছিলো ও। প্রাসকোভিয়া জঙ্গলে পৌঁছাতেই ওর স্বপ্নে দেখা দিয়েছিলো একটা মেয়ে। যার মাথার উপর গাছের ডালে ঝুলে ছিলো বিশালাকৃতির সবুজ অ্যানাকোন্ডা।স্বর্গীয় দেবীদের মতো অলৌকিক সৌন্দর্যের অধিকারী গাঢ় বাদামী নেত্রের চোখ ঝলসে যাওয়ার মতো একজন সুন্দরী যুবতী। যার বাদমী রঙের অস্বাভাবিক লম্বা চুলগুলো মাটিতে লুটিয়ে ছিলো। এই মেয়েটাই পরবর্তীতে সিয়ার সামনে স্ব শরীরে দেখা করতো। যেদিন সিয়ার সাথে মেয়েটার শেষ দেখা হয়েছিলো, সেদিন মেয়েটার সাথে অ্যানাকোন্ডা ছিলো না। মেয়েটা যাওয়ার আগে সিয়াকে বলে গিয়েছিলো,,,

– আমি দেবী আর্টেমিসের অংশ। তোমার ঐশ্বরিক সত্তা। আমি তোমাকে একটা কথাই বলবো। প্রথমে নিজের সম্পর্কে জানো। জানার চেষ্টা করো। সত্যিগুলো খুঁজে বের করো। উদঘাটন করো সব রহস্য। অনেক কিছু জানতে হবে তোমার। তারপর আমি তোমাকে সাহায্য করবো।

সেদিনের পর মেয়েটি আর আসেনি। সিয়ার আরও একজন মেয়ের সাথে পরিচয় হয়। তাকে কখনো দেখতে পায়নি ও। সে অদৃশ্য, আত্মা। পাহাড়ের চূড়ায় এদুয়ার্দোর সাথে যেদিন সিয়ার প্রথম লড়াই হয়েছিলো, ঠিক তার পরের দিন সকালে। অদৃশ্য মেয়েটাই থ্যাসোকে উপহার দিয়েছিলো।

থ্যাসোর কথা মনে পড়তেই সিয়া ম্লান হাসে। পাশ থেকে সেই অদৃশ্য মেয়েটার কন্ঠস্বর ভেসে আসে,,,

– ফ্লোরেনসিয়া।

– আপনি এসেছেন?___ সিয়ার নিষ্প্রাণ কন্ঠে জিজ্ঞেস করে তাকে।

– হ্যাঁ। একটা কথা জানানোর ছিলো। আশা করি তুমি মাথা ঠান্ডা রাখবে।

– বলুন।

সিয়া শান্ত হয়ে বসে । মেয়েটা ইতস্তত করে। ব্যথাতুর করুন কন্ঠে বলে,,,

– ইনায়াকে নিয়ে গেছে ওরা।

– কারা?____সিয়ার আতঙ্কিত কন্ঠ। মুহূর্তেই অস্থির হয়ে উঠে ও।

– ঐ র’ক্তচোষা পি’শাচগুলো।

– কোথায় নিয়ে গেছে ওকে? আপনি কিভাবে জানেন?

– কোথায় নিয়ে গেছে জানিনা। ফ্রাঙ্কলিনের বাড়িতে গিয়েছিলাম। তখন ক্রিস্তিয়ানের থেকে শুনেছি আব্রাহাম নিয়ে গেছে ওকে।

খট করে দরজায় শব্দ হয়। কেউ কামরায় প্রবেশ করে। সিয়ার বাদামী মনির চোখজোড়া থেকে যেন আগুনের ফুলিঙ্গ ঝড়ে পড়ে। ক্রোধের আধিক্যে মৃদুমন্দ কাঁপছে ও। এদুয়ার্দোকে দেখে নিমিষেই হিংস্রাত্মক হয়ে উঠে। ত্বরিত দাঁড়িয়ে পড়ে। আক্রমনাত্মক হয়ে ছুটে যায় এদুয়ার্দোর দিকে। ক্রোধিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,,,,,

– ইনায়াকে কোথায় নিয়ে গেছে আব্রাহাম? কি করতে চায় ওর সাথে?

এদুয়ার্দো বিস্ময়াভূত হয়। ফ্লোরেনসিয়া এসব কি বলছে? কামরাবন্দী থেকে কি পাগল হয়ে গেছে ও?

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।