জানালার সামনের পর্দাটা সড়িয়ে দিতেই জানালার কাঁচ ভেদ করে বাহিরের তীর্যক রশ্মি হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকছে।প্রবল উত্তাপের প্রখরতায় চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে নেয় মেহেনূর।ঝটপট হাতের পিঠ ঠেকায় চোখের উপর।চোখ বন্ধ রেখেই আহ্লাদী গলায় বললো,
– ভাবী প্লীজ আরেকটু ঘুমাতে দাও না।
মেহেনূরের বিছানাটা একদম জানালার কিনার ঘেঁষে।ফলে সূর্যের আলো খুব তীক্ষ্ণভাবে ওর চোখে মুখে এসে পড়ছে।কাল রাতে অনেক দেরি করে ঘুমিয়েছে মেহেনূর।টানা পাঁচ দিন পরে ভাই ভাবীকে কাছে পেয়ে গল্পগুজব করতে করতে কখন যে তিনটা বেজে গেছে টেরই পায় নি।তারপর আবার ঘুমোতে যাওয়ার আগে তনিমার সাথেও প্রায় একঘন্টা কথা বলেছে।তনিমার মুখ থেকে সব শুনে মেহেনূর খুব খুশি হয়েছে।এই মেয়ে অপরের সুখ থেকে কি আনন্দ পায় কে জানে!অথচ নিজের জীবনটা যে কত উত্থান-পতনের মধ্যে দিয়ে পার করছে সেই দিকে ওর বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই।সব সময় অন্যদের জন্য চিন্তা করে বেড়ায়।বিডিতে আসার পর থেকে তো বিয়ের ঘটক-ই হয়ে গেছে!রোশনি এবার সবকয়টা পর্দাই সড়িয়ে দিয়েছে।সাথে জানালার গ্লাস গুলোও খুলে দিয়েছে। মেহেনূরের দিকে এগিয়ে এসে শক্ত গলায় বললো,
– অনেক ঘুমিয়েছো আর না।এবার কিন্তু মা খুব বকবেন।কয়টা বাজে সে খেয়াল কি আদৌ আছে তোমার?
– কয়টা বাজে?
– প্রায় সাড়ে বারোটা।
– কি সাড়ে বারোটা?
মেহেনূরের চক্ষু চড়াকগাছ।এক লাফে বিছানা থেকে উঠে বসলো।চোখ কচলিয়ে দেয়াল ঘড়িটায় তাকালো।বারোটা সাতাশ বাজে।আজকে দুপুর দুটোয় গাঙিনীপাড়ে শেষ বারের মতো তনিমা-শান্ত, দিহাদ-কলি আর অয়নের সাথে দেখা করতে যাবে ও।কারণ আজই মেহেনূর কানাডায় ফিরে যাচ্ছে।ইউনিভার্সিটি থেকে যে ক’দিনের ছুটি ছিল সেটার মেয়াদ শেষ হয়েছে আরো দুদিন আগেই।রাওনাফ আর রোশনি কক্সবাজার ছিল বিধায় তিনটা দিন এক্সট্রা থাকতে হলো ওকে।মেহেনূর চটজলদি বিছানা থেকে নেমে ওয়াশরুমে চলে যায়।
_____________________
চারদিকে শরতের শুভ্র কাশফুল, সাথে শরীর-মন জুড়িয়ে দেওয়া বাতাস। শরৎকাল মানেই নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা, সাথে শ্বেত শুভ্র কাশফুলের চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য। ভাদ্র ও আশ্বিন জুড়ে এই দুইয়ের আভায় হৃদয়ে দোলা দেয় প্রকৃতিপ্রেমীদের। শুভ্র কাশফুলে ছেয়ে যাওয়া কাশবন গুলোতে মন জুড়াতে প্রিয়জনকে নিয়ে প্রতিদিন ভিড় করছেন শত শত মানুষ।কাশবনে ঘুরতে এসে আনন্দঘন মুহূর্তগুলো করছেন ক্যামেরাবন্দী।একঘেয়েমি নাগরিক জীবনে শরৎতের এই শুভ্র কাশফুল প্রশান্তি বয়ে এনেছে প্রকৃতিপ্রেমীদের মনে-প্রাণে।মেহেনূরও মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে গাঙিনীর তটে।দেখছে প্রকৃতির লীলা-লাস্যময় সৌন্দর্য্য।
– আর ক’টা দিন থেকে গেলে হতো না?এই মাসের ষোল তারিখেই আমাদের বিয়ের ডেইট ফিক্সড করা হয়েছে।মেহেনূর প্লীজ আরেকটু থেকে যাও না।
তনিমা অনুনয় করে বললো কথাটাগুলো।কিন্তু মেহেনূরের আর একটা দিনও এখানে থাকা পসিবল না।ওর এক্সাম চলে এসেছে।তাছাড়া বিডিতে আসার আগে থেকেই কানাডায় অনেকগুলো প্রজেক্টে সাইন করেছিল।ঠিক সময়ে ওখানে উপস্থিত না হতে পারলে ব্যাপারটা খুব বিশ্রী হয়ে যাবে।তনিমার প্রশ্ন মেহেনূর মৃদু হেসে বললো,
– সেটা হয় না তনিমা আপু।এবার আমাকে যেতেই হবে।অনেকদিন তো হলো আর কত?আমি চলে যাচ্ছি বলে কি হয়েছে,ভাইয়া ভাবী তো এখানেই আছে।তোমাদের বিয়েতে তাঁরা তো থাকবেই।তবে হ্যাঁ,সবাই একসাথে থাকলে অবশ্য ভালো লাগতো।
– রাওনাফ আর কানাডায় যাবে না?
উৎকন্ঠিত স্বর জিজ্ঞাস করলো অয়ন।মেহেনূর স্মিত হেসে বললো,
– যাবে।তবে সামনের মাসে।তাঁদের আরো কিছুদিনের ছুটি আছে।আনফর্চুনেটলি আমি তো আর থাকতে পারছি না।তাই সেই জায়গা থেকে একটু খারাপ লাগছে।তবে অয়ন ভাইয়া আমার আফসোস রয়ে গেলো?
– কি?
– শুধু আপনার বিয়েটাই দেখতে পারলাম না!
মেহেনূরের কথা শুনে সবাই হেসে উঠলো।দিহাদ গলার স্বর উঁচু করে বললো,
– শুধু অয়ন কেন অর্কের বিয়েও তো বাকি এখনো।
– উনার ব্যাপার স্যাপার আবার আলাদা!উনি কি আর যে-সে মেয়ে বিয়ে করবেন নাকি?উনার ভাষ্যমতে, মেয়ে হতে হলে কিরণ চৌধুরীর মতো হও।কথা বলতে হলে,কিরণ চৌধুরীর মতো করে বলো।ওর মতো গুণবতী হও, ওর মতো খাও, ঘুমাও,হাঁটো ব্লা ব্লা ব্লা…!কেন?ওই কিরণ চৌধুরী কি মানুষ না।ও কি কোনো ফেরেস্তা!আরে আগে তো ও একজন মানুষ,একটা সাধারণ মেয়ে।তারপর না সে একজন সিঙ্গার,রকস্টার।এই মেয়ে শখের বশে দু একটা গান রেকর্ড করে সোস্যাল মিডিয়ায় আপলোড করে।সেগুলো মানুষ স্বাদরে গ্রহণ করে।এত মানুষের ভালোবাসা পেয়ে অনুপ্রাণিত হয়ে গানের জগতে নিয়মিত হয়।গত এক বছর ধরে লাইভ স্টেজ শো কনসার্ট করে।এখন দেশের গন্ডি পেড়িয়ে বিভিন্ন দেশে ওর নাম ডাক হয়েছে বলেই কি সব মেয়েকে ওই মেয়ের সাথে তুলনা করতে হবে।হ্যাঁ আমি মানছি, কিরণ চৌধুরী হয়তো আসলেই খুব ট্যালেন্টেড। তাই বলে সব মেয়েকে কেন কিরণের মতোই হতে হবে?প্রত্যেকের ভেতরেই কোনো না কোনো ইউনিক সুপ্ত প্রতিভা থাকে।আমরা যদি তাঁদের কোণঠাসা করে রাখি তাহলে কি তাদের প্রতিভাগুলো বিকশিত হবে?নিজেদের প্রুভ করার জন্য আমাদের তো ওদেরকে সুযোগ দিতে হবে।আমাদের তো উচিৎ যে যেমন তাঁকে সেই ভাবেই গ্রহণ করা।এমনটা তো হতেই পারে ওই মেয়ে গুলোর মধ্যেও হাজারটা কিরণ চৌধুরী লুকিয়ে আছে।সেই সব প্রতিভা উন্মোচনের জন্য হয়তো শুধু একটু সময় দরকার,উপযুক্ত পরিবেশ দরকার আর দরকার একটু উৎসাহ।পৃথিবীর কোনো মানুষই একজন আরেকজনের মতো হতে চাইলেও হতে পারে না।আমি মনে করি কারোর সাথেই কাউকে তুলনা করে উচিত না।পৃথিবীর সব মানুষের একটা নিজস্ব এবং আলাদা সত্তা রয়েছে।সবাই নিজ নিজ জায়গাতেই সুন্দর,ভিন্ন।
মেহেনূরের কথার সাথে তাল মিলিয়ে গাঙিনীর ঢেউ গুলোও যেন ছন্দ মিলাতে ব্যস্ত।মেহেনূরের প্রত্যেকটা কথাই সত্য,বাস্তব।সবাই চুপ হয়ে মেহেনূরের কথা শুনছে।মেহেনূর যে তিক্ততায় কথাগুলো বলছে সেটা সবার কাছেই স্পষ্ট। তবে ঠিক কি কারণে মেহেনূর উক্ত কথা গুলো বললো সেটাই কারোর বোধগম্য হচ্ছে না।কিন্তু এখানে যে অর্কের ভূমিকা আছে সেটা কিছুটা হলেও সবাই-ই আঁচ করতে পারছে।কারণ অর্কের প্রসঙ্গ আসতেই মেহেনূর কিরণের উপর খেপেছে।সবাইকে নীরব থাকতে দেখে মেহেনূর ফিচেল হেসে বললো,
– সবাই চুপ করে আছো কেন?কি ভাবছো আমি হঠাৎ এইসব কথা কেন বলছি?আরে ছাড়ো তো আমার কথা।আমি তো এমনই!এলোমেলো কথা বলি!তবে আমি কিন্তু কাউকে মিন করে কথাগুলো বলি নি।ভুলেও এই ভুলটা কেউ বুঝবে না,ঠিক আছে।আসলে ইদানীং দেখছি ছোট ছোট বিষয়গুলোর মধ্যেও কিরণ চৌধুরীকে টেনে আনা হচ্ছে,ভালো তেও মন্দ তেও।জীম কিরণ চৌধুরীর বিশাল বড় একজন ফ্যান।কালকে রাতে আমার খালুজান জীমকে পড়াচ্ছিল।তখন শুনলাম খালুজান বলছেন,কিরণ চৌধুরীর মতো হতে হলে এত খেলাধূলা করা যাবে না,বেশি বেশি করে পড়তে হবে।যদিও এটাকে পজিটিভ ভাবেই নেওয়া যায়।কিন্তু পরশু দিন বাবা বলছিলেন,আজ ওই কিরণ চৌধুরীর জন্য আমার মেয়েটা কষ্ট পেলো!আমার মেয়ের বি……
মেহেনূর কথায় কথায় মুখ ফসকে শেষের কথাটা বলে ফেলেছে।পরমুহূর্তেই ওর খেয়াল হলো ও কি বলতে কি বলে ফেলছে এইসব!অর্কের সাথে ওর বিয়ের কথা হয়েছিল এ কথা কাউকে জানায় নি মেহেনূর।ইনফ্যাক্ট রাওনাফকে না।রাওনাফ জানতে পারলে যদি আবার অর্ককে ভুল বুঝে!সেই ভয়ে মেহেনূর রাওনাফকে কিছু বলে নি।রোশনিকে অবশ্য রেনুফা বেগম আগেই বলে দিয়েছিলেন।যখন বিয়ের কথা হচ্ছিলো।
সবাই মেহেনূরের দিকে ভ্রুকুটি করে তাকিয়ে আছে।মেহেনূরের বলা শেষের কথাটি মানে কি?কিরণ চৌধুরীর জন্য ও কষ্ট পেয়েছে মানে?বাকি কথা বলতে গিয়ে থেমে গেলো কেন?তবে কি অর্কের সাথে মেহেনূরের বিয়ের কথা হচ্ছিলো?নয়তো অর্কের প্রসঙ্গ আসতেই মেহেনূরের সুর পাল্টে কথা বলবে কেন?সবার মনে এই প্রশ্নগুলো ঘূর্ণিপাক খাচ্ছে।মেহেনূর প্রসঙ্গ পরিবর্তন করতে ফিচেল হেসে বললো,
– যাইহোক,বাদ দাও এইসব কথা।দিহাদ ভাইয়া আর কলি আপু তোমরা তনিমা আপুর বিয়ের পর সবাই মিলে হানিমুনে যাওয়ার জন্য কিন্তু কানাডাতেই প্রথম আসবে কেমন।তোমাদের পুরো কানাডাটা আমি ঘুরিয়ে দেখাবো।ওইখান থেকে পরে সুইজারল্যান্ড আর মালদ্বীপ হয়ে অন্য কোথাও যাবে, ঠিক আছে।বাকি কথা কানাডায় গিয়ে হবে।এখন আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।বাসায় গিয়ে লাগেজ গোছাতে হবে।আসছি আমি,তোমরা সবাই ভালো থেকে।তোমাদের সাথে কাটানো সময়টা খুব বেশি মনে পড়বে আমার।তোমরা সবাই কত ভালো।দোয়া করি, তোমাদের এই বন্ধুত্ব অটুট থাকুক সারাজীবন।আমি কিন্তু রোজ তোমাদের ভিডিও কল করবো।তোমাদের কিন্তু খুব বিরক্ত করবো!গাইস,আমি তোমাদের সবাইকে সত্যি-ই খুব মিস করবো।
– আমরাও তোমাকে খুব মিস করবো।
সবাই সমস্বরে বললো।মেহেনূর যে কিছু একটা আড়াল করতে চাইছে বা ওঁদের অগোচরে কিছু একটা ঘটেছে সেটা মোটামুটি সবাই আন্দাজ করতে পেরেছে।তবে মেহেনূরকে কেউ কিছু জিজ্ঞাস করে নি।কারণ মেহেনূরই ব্যাপারটা এড়িয়ে যাওয়া জন্য ওই প্রসঙ্গটা বাদ দিয়েছে।মেহেনূর এগিয়ে গিয়ে কলি আর তনিমাকে আলিঙ্গন করলো।তারপর হাসি মুখে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ওখান থেকে চলে আসে।শুধু সবার মাঝে রেখে যায় একরাশ মন খারাপের সাথে শূন্যতার ঘেরা এক বিদঘুটে অনুভূতি!
________________________
মেহেনূর, রোশান, সুফিয়া বেগম আর রশিদ সাহেব ফিরতি পথে।ন’টার সময় ওদের ফ্লাইট বিমানবন্দর ছেড়েছে।রেনুফা বেগম মেহেনূরের রুমে এসে চুপচাপ বসে আসেন।হয়তো নীরবে চোখের অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছেন।রুমের লাইট অফ।তবে দরজা পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি নিজের প্রিয়তমার গতিবিধি লক্ষ্য করছেন সূক্ষ্মভাবে।তিনিও কেঁদেছেন,তখনও আর একটু আগেও।তবে সবার অগোচরে।মেহরাব সাহেব ধীর পায়ে এগিয়ে গেলেন সম্মুখে।স্ত্রীর পাশ ঘেঁষে বসতেই রেনুফা বেগম স্বামীকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে উঠেন।মেহেনূর কানাডার চলে যাওয়ার পর রেনুফা বেগম ঠিক এইভাবে কাঁদেন,প্রতিবার।রেনুফা বেগমের মাথায় হাত বুলিয়ে উনাকে শান্ত করার চেষ্টা করছেন মেহরাব সাহেব।সেকেন্ড পাঁচেক পর শীতল কন্ঠে বললেন,
– মেহেনূর যাওয়ার সময় কি বলে গিয়েছিল মনে আছে তো?এইবার যদি এত কাঁন্নাকাটি করো তাহলে মেহেনূর কিন্তু বলে গেছে ও আর আসবেই না!
– আমার মেয়েটা অনেক কষ্ট পেয়েছে না গো?
রেনুফা বেগমের করুণ স্বরে বলা কথাটা কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই মেহরাব সাহেবের কলিজাটায় মোচড় দিয়ে উঠে।শুধুমাত্র উনার কথাতেই মেহেনূর এই বিয়েতে রাজি হয়েছিল।শুধু মাত্র ওর বাবা খুশি হবে বলে।শুধু উনি ওর বিয়ে দিতে চেয়েছেন বলে।নিজের মেয়েকে খুব ভালো করেই চিনেন তিনি।নিজের বাবা মা ভাই একদিকে আর বাকি সবকিছু অন্য দিকে।মেয়ের বুক ফাটবে তাও কোনো দিন মুখ খুলবে না।মেহরাব সাহেব চোয়াল শক্ত করে কড়াগলায় বললো,
– আমরা কি ওদের কাছে সেধে মেয়ের বিয়ে দিতে গিয়েছিলাম?ওরাই তো জোর করলো।আমি তো ওই বড়লোকদের বাড়িতে আমার মেয়ের বিয়ে দিতে চাই নি।একটা মেয়েকে এমন ভাবে প্রত্যাখ্যান করলো যে, ওকে কোনো মানুষই মনে করলো না!আমার মেয়েকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করলো ওই ছেলে!ওইদিন যদি আমরা ওই ছেলের বলা কথাগুলো না শুনতাম?মেহেনূর তো এইগুলো আমাদেরকে কোনোদিনও বলতো না।
– একটা মানুষের মন কতটা সরল আর পবিত্র হলে সবকিছু হাসি মুখে সহ্য করে নেয়?অবশ্য তার দৃষ্টান্ত প্রমাণ আমার মেহেনূর।তাই না?ফুলের মতো পবিত্র, নদীর জলের মতো স্বচ্ছ।তবে এত সরলতার মধ্যেও আমার মেয়ের মনটা কিন্তু বড় কঠিন পাথরে গড়া।চাইলেই ওর মন পড়া যায় না!তুমি কখনো লক্ষ্য করেছো?আমার মেহেনূর মুখের ওই মিষ্টি হাসির আড়ালে হাজারো কষ্ট অনায়াসেই লুকিয়ে ফেলতে পারে।
– আমার মেয়ে যেদিন ওই কিরণ চৌধুরীর চেয়েও বড় গায়িকা হবে সেইদিন ওই অর্ককে আমি উচিত শিক্ষা দেবো।আমার মেয়ের অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য যখন উদগ্রীব হয়ে ছুটে আসবে তখন আমার মেয়ের ধারে কাছেও ঘেঁষতে দেবো না!তুমি দেখে নিও!
– এইভাবে কেন বলছো?ভালোবাসা কি পাপ?মানুষ ভালোবাসলে এমনই করে!যখন সে প্রেমে পড়ে তখন মানুষটাকে নিয়ে ভাবতে গিয়ে,মানুষটাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে গিয়ে ভালবাসাটা আকাশ ছুঁয়ে ফেলে।পরিণতিতে সে মানুষটা তার শিরা উপশিরায় বিরাজ করতে শুরু করে। তখন তার ভালোবাসার মানুষটার ভুল-ত্রুটি গুলোকেও ভালো লাগে।মনে হয়,এই দুনিয়ায় সবকিছুই মরিচীকা,মিথ্যে শুধু তার ভালোবাসার মানুষটাই সত্য!
– তুমি কি ওই ছেলের পক্ষ নিচ্ছো রেনু?
– না,ভালোবাসার পক্ষ নিচ্ছি!
– রেনু!
– এটাই তো ভালোবাসা।এইটাই তো ভালোবাসার নীতি।কেন তুমিও তো একদিন ভালোবেসেছিলে!তুমিও তো ভালোবাসার মানুষটির হাত ধরবে বলে বিয়ের আসর ছেড়ে চলে এসেছে!তবে অর্কের ক্ষেত্রে কেন এটা মেনে নিতে পারছো না?তোমার মেয়েকে দেখছো না,কত সুন্দর করে সবকিছু মানিয়ে নিয়েছে।তুমি একটু ওর মতো করে ভেবো,দেখবে তুমিও মানিয়ে নিয়েছো।
– তাহলে তুমি কেন কাঁদছিলে?
– আমি তো বরাবরই কাঁদি!মায়ের মন তো,মনের মধ্যে অনেক কথায় উঠে!সব কথায় ধরতে হয় না।
___________________
আমেনা বেগম ওইদিন রাতেই চলে গিয়েছিলেন।অর্ক যখন বলে,ও এই বিয়ে করবে না তখন আয়েশা বেগম আর আকাশ সাহেব অর্ককে বলেছিলেন, মেহেনূর খুব ভালো মেয়ে।উনারা মেহেনূরকেই তাঁদের ছেলের বউ হিসেবে দেখতে চান।কিন্তু অর্ক ওর কথাতেই অনড় ছিল।তবে আমেনা বেগম অর্ককে কিছুই বলেন নি।হয়তো একটু কষ্ট পেয়েছেন কিন্তু বাস্তবতাও মানতে হবে।বাড়ির বড়দের পছন্দ মতো যে কাউকে বিয়ে করে নিবে?আজকালের ছেলে-মেয়েরা কি আর এখনো সেই যুগে পড়ে আছে?আছে তো!কেন মেহেনূর!তবে আমেনা বেগম অভিমানের পাহাড় নিয়ে অর্কদের বাসা থেকে চলে গেছেন।কাউকে বুঝতে দেন নি।অর্ককে তো না-ই।বরং এমন আচারণ ছিল যে, এটা খুব নরমাল একটা বিষয়।কিন্তু ভিতরে ভিতরে ঠিকই কষ্ট পেয়েছেন।
মেরেনূর চলে যাওয়ার আগে অর্কদের বাসায় এসেছিল বিদায় নিতে।কিন্তু আয়েশা বেগম বা আকাশ সাহেব কারোর সাথেই ওর দেখা হয় নি।শেষে মেহেনূর উনাদের সাথে দেখা না করেই চলে যায়।আসলে উনারাই মেহেনূরের সামনে আসতে চান নি।মেহেনূরের সামনে কোন মুখে যাবেন তারা?নিজেরা যেচে বিয়ের কথা বলছিলেন।মেহরাব সাহেব যখন মেয়ের বিয়ে দিবেন না বলে বেঁকে বসেছিলেন তখন তাকে অনেক কষ্টে রাজি করানো হয়েছিল।আর যখন উনি রাজি হলেন তখন কিনা তাঁদের ছেলে বিয়ে ভেঙে দিলো।অবশ্য ভুলটা তাঁদেরই।তাঁরা যদি আরেকটু সর্তক হতেন তাহলে আজকে হয়তো এমন পরিস্থিতি তৈরি হতো না।
আয়েশা বেগম আর আকাশ সাহেব নিজেদের বোকামির জন্য লজ্জিত।লজ্জিত তাঁদের ছেলের ব্যবহারে।একটা ভিনদেশের মেয়ের জন্য মেহেনূরের মতো মেয়েকে প্রত্যাখ্যান করলো?অর্ক যেমন ওই মেয়ের জন্য দেওয়ানা হয়ে আছে ওর মতো এমন আরো হাজারটা ছেলে আছে যারা কিরণ চৌধুরীকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে।তাই বলে সবার মনের খবর কি কিরণ চৌধুরীর পক্ষে রাখা সম্ভব?তাও অর্কের এই ব্যবহারটা মানা যেত যদি কিরণ চৌধুরীও ওকে পছন্দ করতো, ভালোবাসতো।কিন্তু তেমন কিছুই তো নেই ওদের মধ্যে।তাহলে অর্ক কিসের ভিত্তিতে এমব ব্যবহার করছে?এটা নিছকই অর্কের বোকামি মূর্খামি ছাড়া আর কিছুই না।
আয়েশা বেগম আর আকাশ সাহেব অর্কের সাথে একদম কথা বলা বন্ধ না করলেও প্রয়োজন ছাড়া বাড়তি একটা কথাও কেউ বলেন না।এইমুহূর্তে তিনজন একসাথে ডিনার করছেন ঠিকই কিন্তু কেউই কারো সাথে কথা বলছে না।অর্ক মাঝে মধ্যে প্রশ্ন করলেও হ্যাঁ না তে জবাব দিচ্ছেন দুজনেই। নিজের মতো চুপচাপ খেয়ে উঠে যান আকাশ সাহেব আর অর্ক।আয়েশা বেগমও নিজের খাওয়া শেষ করে টেবিল গুছাচ্ছেন।বাড়িতে কাজের মানুষ থাকলেও নিজের কাজগুলো তিনি নিজে করতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।
– আন্টি অর্ক কোথায়?
আয়েশা বেগম মাথা তুলে সামনে তাকালেন।এত রাতে দিহাদ, কলি, তনিমা আর অয়নকে দেখে উনার কপাল কুঁচকে আসে।পরমুহূর্তেই কুঁচকানো কপাল প্রসারিত করে মৃদুস্বরে বললো,
– হয়তো ওর ঘরেই আছে।
আয়েশা বেগমের জবাবটা ঠিক স্বাভাবিক মনে হলো না কারোর কাছেই।সবাই নিশ্চিত কিছু একটা হয়েছে সেটা শুধু ওরাই জানে না।সবাই সেকেন্ড দুয়েক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আয়েশা বেগমের দিকে তাকিয়ে থেকে পা বাড়ালো অর্কের রুমের দিকে।
চলবে…