অন্ধকার আরও খানিকটা গাঢ় হয়ে আসে। ইনায়া যেন নিজের মৃ’তুকে খুব কাছ থেকে দেখে। আ’ক্র’মনের শুরুতেই হাতে থাকা লন্ঠন’টা ছিটকে পড়েছে দূরে। পড়ে যাওয়া লন্ঠনের আবছা আলোয় র’ক্তচোষা ভ’য়ংকর বাদুড়গুলোকে প্রতিরোধ করার আপ্রাণ চেষ্টা করে। কিন্তু এভাবে কতক্ষণ? আর বুঝি নিস্তার নেই?

হঠাৎই একটা কালো ধোঁয়ার কুন্ডলী বাতাসের বেগে ইনায়ার চারপাশে ঘুরতে শুরু করে। বাদুড়গুলো ওকে ছেড়ে দিয়ে দল বেঁধে উড়ে যায় আকাশের দিকে। আবছা আলোয় ঝাঁক বেঁধে উড়ে যাওয়া বাদুড়গুলোকে আরও ভয়ংকর লাগে দেখতে। যেন একঝাঁক মৌমাছি। বরং মৌমাছির থেকেও ভয়াবহ হিংস্র। ওদের নখের আঁচড় আর ধারালো দাঁতের আঘাত কতটা বীভৎস! কামড়ে ধরে র’ক্ত শুষে নেয় শয়তানগুলো। ওরা যেন ইনায়াকে কালো ধোঁয়ার কুন্ডলী’টার হাতে সমর্পণ করে গেলো।

চারপাশে গোল গোল ঘুরে কুন্ডলী’টা একটা ছেলের অবয়বে ইনায়ার সামনে এসে দাড়াল। নিমিষেই ইনায়ার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে উঠল। দ্রুত বেগে দু’কদম পিছিয়ে যায় ও। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কালো কাপড়ে মুখ ঢেকে রাখা ছেলে’টাকে দেখে একটা অদ্ভুত বিস্ময়ে ইনায়ার গা শিউরে ওঠল। বুকের মাঝে নাম না জানা ভয়াল আতংক ছড়িয়ে পড়ল। ছেলেটার দু’চোখের মনি দু’টো যেন দু’টুকরো জ্বলন্ত অঙ্গার। চুলগুলো সোনালী বর্ন। আদি-অন্ত কালো কাপড়ে আচ্ছাদিত হলেও হাত দু’টো খোলা ছিলো। যা অস্বাভাবিক ফর্সা। ধবধবে সাদা নাকি পাণ্ডুবর্ণ? ইনায়া বুঝতে পারল না।

ইনায়া স্থির দাঁড়িয়ে রইল। এই মূহূর্তে ওর বাবার দেওয়া শিক্ষা যেন ওর মনের জোর আরো অনেকটা বাড়িয়ে দিলো। মৃ’ত্যু ভয়কে উপেক্ষা করে শত্রুর সাথে লড়তে চাইল। ছেলেটা ওর চারপাশে চক্রাকারে ঘুরতে শুরু করল। পুনরায় ওর সামনে এসে দাড়াল। ইনায়া নির্বাক চোখে দেখল।

– মাঝরাতে এই পাহাড়ের চূড়ায় এতো সুন্দর একটা শিকার খুঁজে পাবো একদম’ই ভাবিনি। ___ছেলেটা তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল।

– কে তুমি?____ ইনায়া বিস্মিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল।

– যদি বলি তোমার মৃ’ত্যু।

ছেলেটা ভ্রু নাচায়। একহাতে ইনায়ার কোমর আঁকড়ে ধরে নিজের কাছে টেনে নেয়। ইনায়া তাকে দু’হাতে ঠেলে দুরে সরিয়ে দেয়। দু’কদম পিছিয়ে গিয়ে ক্রুদ্ধ কন্ঠে বলল,

– দুরে থাকো। দ্বিতীয়বার আমাকে স্পর্শ করার দুঃসাহস দেখাবে না।

ছেলেটা শব্দ করে হাসে। ফের ইনায়ার চারপাশে চক্রাকারে ঘুরে। মাটিতে পড়ে থাকা লন্ঠনের আলো নিভু নিভু হয়ে আসে। চারপাশে বিরাজ করে অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। ইনায়ার সারা শরীরে অসহনীয় ব্যথা। রক্তচোষা বাদুড়গুলো ওকে আঁচড়ে কামড়ে ক্ষত-বিক্ষত করে দিয়েছে। ঘুরতে ঘুরতে ছেলেটা ওর পেছনে গিয়ে দাড়ায়। একপা দু’পা করে এগিয়ে যায়। ইনায়া পেছন ফিরে দেখে। রাগমিশ্রিত কন্ঠে বলে,

– থেমে যাও। আমার কাছে আসবে না। পরিণাম ভালো হবেনা।

মুখে বড় বড় কথা বললেও ভেতর থেকে ইনায়া বেশ ভীত হয়ে পড়ে। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা প্রতিদ্বন্দী ভীষন সাংঘাতিক বুঝতে পারে ও। গলা শুকিয়ে যায় মরুভূমির মতো। তবুও মনোবল ধরে রাখার চেষ্টা করল। মনে মনে বলে,

– সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটা কোনো সাধারণ মানুষ নয়।

– তোমার ধারনা সঠিক। আমি কোনো সাধারণ মানুষ নই।___ছেলেটা সহাস্যে প্রত্যুত্তর দেয়।

ইনায়া চমকায়। পুনরায় মনে মনে বলে,

– ছেলেটার কি মাইন্ড রিডিং ক্ষমতা আছে?

– তুমি এবারও সঠিক।

– দাদু বলেছিলেন ভ্যাম্পায়ারদের মাইন্ড রিডিং পাওয়ার থাকে।

অকস্মাৎ ছেলেটা শব্দ করে হাসে। যেন এবারও ইনায়ার মনের কথাটা পড়ে নিয়েছে সে।

– অর্থাৎ তুমি রক্তচোষা পিশাচ! আমাকে আক্রমণ করা বাদুড়গুলো তোমার অনুগত ছিলো?

– হ্যাঁ।___ ছেলেরা দৃঢ় কন্ঠে বলল।

ইনায়া বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকায়। আজ পর্যন্ত যে র’ক্তচোষা ভ্যাম্পায়াদের কথা শুনে এসেছে, তাদেরই একজনকে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে ও। কিন্তু এই নির্জন নিস্তব্ধ জায়গায় একজন রক্তচোষা পিশাচের শিকার হওয়া থেকে কে বাঁচাবে ওকে? ক্ষনিকের জন্য বুকের মাঝখানে মৃ’ত্যুর হিমেল স্পর্শ অনুভব করল। তবে কি ওর মৃ’ত্যু নিশ্চিত হয়ে গেলো?

– এতো সহজে হার মেনে নেওয়ার মেয়ে নই আমি। ____ইনায়া মনে মনে ভাবল।

– আক্রমনাত্মক শিকার আমার বেশ পছন্দ।

যতবার ও মনে মনে কিছু ভাবে। ছেলেটা ততবার স্পষ্ট জবাব দেয় ওকে। ইনায়া চায় ছেলেটা যেন বুঝতে না পারে ও ভয় পাচ্ছে। ভয় মানুষের সবচেয়ে বড় দূর্বলতা। শত্রুকে নিজের দূর্বলতা সম্পর্কে জানতে দিতে নেই। এমন অনেক কিছু ভেবে ও পিছিয়ে যেতে থাকে। চোখের পলকে ছেলেটা ওর সামনে গিয়ে দাড়ায়। ইনায়া নিজের বাবার শেখানো রণ কৌশল প্রয়োগে ছেলেটাকে প্রতিহত করতে চায়। হাত দু’টো মুষ্টিবদ্ধ করে পা দিয়ে বুক বরাবর আঘাত করে ও। কিন্তু হঠাৎ করেই যেন ছেলেটা হাওয়াই মিলিয়ে যায়। ইনায়ার শ্রবণেন্দ্রিয় সজাগ হয়ে উঠে। ছেলেটা ওর পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। ইনায়া পেছনে আঘাত করতে গিয়ে সামনে আঘাত করে বসে। অব্যর্থ লক্ষ্য। ওর অভিজ্ঞতা জানান দিয়েছিলো পেছনে আঘাত করতে চাইলে ছেলেটা সামনে এসে দাড়াবে। হলোও তাই। মুষ্টিবদ্ধ এক হাতের শক্তপোক্ত আঘাত ছেলেটার থুতনিতে গিয়ে লাগে।

কয়েক হাত দুরে ছিটকে পড়তে গিয়েও ছেলেটা নিজেকে সামলে নিয়ে সোজা হয়ে দাড়ায়। চোখগুলো অস্বাভাবিক রকম লাল টকটকে হয়ে যায়। ভয়াবহ হিংস্র চোখের দৃষ্টিতে সে ইনায়ার দিকে তাকায়। বজ্রাহত কন্ঠে বলে,

– অনেক হয়েছে। তোমার এতো বড় দুঃসাহস! তুমি আমাকে আঘাত করো? এর চরম মূল্য চুকাতে হবে।

মূহূর্তেই সে ইনায়ার সামনে গিয়ে দাড়ায়। ওকে আঘাত করার কোনো সুযোগ না দিয়ে হাত দু’টো শক্ত করে ধরে। ইনায়া নিজেকে ছাড়ানোর জন্য ছটফট করতে শুরু করে। ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে ওর কাঁটা দিয়ে বেঁধে রাখা লালচে-সোনালি চুলগুলো খুলে গিয়ে পিঠময় ছড়িয়ে পড়ে। যা একে বেঁকে হাঁটু ছাড়িয়ে যায়।

ছেলেটা থমকায়। নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সুদীর্ঘ লালচে সোনালী চুলগুলোর দিকে। ইনায়ার চুল থেকে ভেসে আসা অদ্ভুত এক বিমুগ্ধ করা সুবাসে ছেলেটার চোখ বুজে আসে। গভীর এক নিঃশ্বাস টেনে নেয়। যেন সে বিমোহিত হয়। ইনায়া সুযোগ পায়। নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ছেলেটাকে পুনরায় সজোরে আঘাত করে। ছেলেটা চোখ মুখ কুঁচকে ফেলে। মনে মনে বলে,

– শেইম অন ইউ আব্রাহাম। সামান্য একটা মেয়ের কাছে নাস্তানাবুদ হচ্ছো?

আব্রাহাম চাইলেই এই মেয়েটাকে সম্মোহিত করতে পারে। কিন্তু মেয়েটার তেজস্বী রুপ দেখতে তার ভীষণ ভালো লাগে। সে আরও দেখতে চায়, মেয়েটা ভেতর থেকে বেশ ভীত হয়েও উপরে যে সাহসিকতা দেখাচ্ছে তা কতক্ষণ সময় ধরে টিকে।

– উইজার্ড ডিয়েটস। তোমার দাদু তাইনা? ____ জিজ্ঞেস করে আব্রাহাম। ইনায়া কোনো উত্তর দেয়না। ওর থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে আব্রাহাম পুনরায় কথা বলে,

– এসেছিলাম তোমার দাদুকে সাথে নিয়ে যেতে। কিন্তু আমার মত বদলে গেছে। তোমার দাদুর জায়গায় যদি তোমাকে তুলে নিয়ে যাই, তাহলে কেমন হবে?

ভয়ংকর ক্রোধের আগুনে জ্বলে উঠে ইনায়া। ক্ষিপ্র পায়ে হেঁটে গিয়ে দু’হাতে আব্রাহামের কলার চেপে ধরে। আক্রোশপ্রসূত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,

– কি করেছিস আমার দাদুর সাথে? বল। কি করেছিস?

কলার চেপে ধরায় আব্রাহাম রেগে যায়। তার সমস্ত শিরা-উপশিরায় খু’নের নেশা চেপে বসে।

– অনেক হয়েছে এই মেয়েকে সহ্য করা। একটা তুচ্ছ, নগন্য মেয়ে কিনা আমার কলার চেপে ধরে?

আব্রাহাম ভাবে। ইনায়াকে ছিটকে ফেলে দেয় দূরে। মাটিতে আছড়ে পড়ে মাথায় বেশ জোরালো আঘাত পায় ইনায়া। উঠে দাড়ানোর চেষ্টা করে। হঠাৎ করেই যেন মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ে ও। আব্রাহাম নিমেষেই ওর সামনে এসে বসে। শক্তহাতে গাল চেপে ধরে। ইনায়াও আঘাত করতে চায়। কিন্তু পেরে উঠে না। সৃষ্টিকর্তা যেন সমস্ত শক্তি ঢেলে দিয়েছে সামনে বসে থাকা শয়তানটার মাঝে। শক্ত করে গাল চেপে ধরায় ব্যথা পায় ইনায়া। ওর চোখ থেকে একফোঁটা অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়ে।

আব্রাহাম ওর গাল ছেড়ে দিয়ে দু’হাতে শক্ত করে ওর দু’কাধ চেপে ধরে। ইনায়া ব্যথা পায়। রেগে যায় আরও। টান দিয়ে আব্রাহামের মুখ থেকে কাপড় সরিয়ে নেয়। কিন্তু সম্পূর্ণ চেহারা দেখতে পায়না। তার আগেই আব্রাহাম ওর ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে দেয়। তার দু’ঠোটের ফাঁক গলিয়ে ক্ষুরের ফলার মতো তীক্ষ্ণ দু’টো শ্বদন্ত বেরিয়ে আসে। ইনায়ার ঘাড়ে সজোরে কামড়ে ধরে। সূঁচালো দু’টো দাঁত চামড়া ভেদ করে রক্ত নালিতে গিয়ে পৌঁছায়।

অসহ্য যন্ত্রণায় কুকিয়ে উঠে ইনায়া। শরীর অবশ হয়ে আসে। পিশাচ’টা ওর শরীরের রক্ত চুষে নিতে থাকে। ক্রমে ক্রমে ইনায়ার চোখ বুজে আসে। হয়তো ও ম’রে যাচ্ছে। মৃ’তু নিশ্চিত জেনে উচ্চস্বরে চিৎকার দিয়ে উঠে। নিজের দাদুকে শেষবারের মতো ডাকে,

– দাদু!

কয়েক মিনিটের ব্যবধানে দু’জনের শরীরে পানির ছিটে এসে লাগে। ভেসে আসে মন্ত্রধ্বনি। পানির ছিঁটে লাগতেই আব্রাহামের শরীর যেন জ্বলে পুড়ে যায়। ইনায়াকে ছেড়ে দিয়ে সে ছিটকে দূরে সরে যায়। বেশ খানিকটা দূরে গিয়ে মাটিতে আছড়ে পড়ে।

– ধুর হ শয়তান! তোর মতো পিশাচের আমার গ্রামের ত্রিসীমানায় প্রবেশ করার দুঃসাহস কি করে হয়?

ক্ষীণ অথচ ক্রোধিত কন্ঠে কথাটা বলেন উইজার্ড ডিয়েটস। দৌড়ে গিয়ে ইনায়ার মাথাটা বুকে আগলে নিলেন। লন্ঠনের মৃদু আলোয় আব্রাহামের চেহারাটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিলো না। শুধুমাত্র একটা অস্পষ্ট ছায়া মূর্তি নজরে আসে। আব্রাহামের শরীর জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে। ভয়াবহ পীড়ন হচ্ছে। নিশ্চয়ই পানিটা মন্ত্রপুত পবিত্র পানি ছিলো।

আব্রাহামের আক্রোশ বেড়ে যায়। সামান্য এক বৃদ্ধ লোকের কাছে হার মানবে না সে। মনে মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করে মানুষ দু’টোর রক্ত শুষে মে’রে ফেলবে। দ্রুত পায়ে ডিয়েটসের দিকে এগিয়ে যায় সে। তাকে এগিয়ে আসতে দেখে ডিয়েটস মন্ত্র পাঠ করতে শুরু করে। আব্রাহাম দু’কদম বাড়াতেই ফের ছিটকে পড়ে দূরে। মন্ত্র পাঠ করে অদৃশ্য একটা ব্যারিয়ার তৈরি করেছেন ডিয়েটস। যার সীমানা অতিক্রম করার সাধ্য নেই কোনো পিশাচের। ইনায়া আধবোজা চোখে ওর দাদুর দিকে তাকায়। ক্ষীন স্বরে বলে,

– এখানে আসতে এতো দেরি করলেন কেনো দাদু? আর একটু দেরি হলে পিশাচটা আমাকে মে’রে ফেলতো। আমি আপনাকে কতবার ডেকেছি। আপনি একবারও সাড়া দেননি। অতঃপর ভেবেছি পিশাচটা হয়তো আপনার কোনো ক্ষতি করে দিয়েছে।

– আমার ক্ষতি করার ক্ষমতা ওর নেই। আমি মন্ত্র পাঠ করছিলাম। সিয়া উল্টো পাল্টা স্পেল পড়ে কাস্ত্রোরুজ থর্পের সুরক্ষা ব্যারিয়ার ভেঙ্গে ফেলেছিলো। যা বোঝার পর আমি এই পাহাড়ে চলে আসি। দীর্ঘ সময় ধরে মন্ত্র পাঠ করার জন্য নিরিবিলি একটা জায়গার প্রয়োজন ছিলো। দুশ্চিন্তায় ছিলাম। তুমি আমাকে ডেকেছো আমি শুনতে পাইনি। কিন্তু তোমার শেষ চিৎকারটা আমি শুনতে পেয়েছি।

– আপনি এখানে কেনো এসেছেন? ___অকপটে জানতে চায় ইনায়া।

– পুনরায় সুরক্ষা ব্যারিয়ার তৈরি করতে। কিন্তু আমি জানতাম না তার আগেই এই গ্রামে পিশাচের আগমন ঘটবে।

– আপনি কি করে জানলেন সুরক্ষা ব্যারিয়ার নষ্ট হয়ে গেছে?

– আমার কাছে একটি অলৌকিক শক্তি সম্পন্ন পাথর আছে। সুরক্ষা ব্যারিয়ার নষ্ট হয়ে গেলে সেই পাথর’টা আলো ছড়াতে থাকে।

দাদু নাতনির কথার মাঝখানেই হঠাৎ ধূলো উড়তে শুরু করে। ক্রমে ক্রমে বাতাসের বেগ বাড়ে। অস্বাভাবিক ধূলিঝড়ের প্রভাবে তাকিয়ে থাকা মুশকিল হয়ে দাড়ায়। আব্রাহামের আক্রোশ বাড়ে। সে বজ্রধ্বনি তুলে বলে,

– তোমাকে সাথে নিয়ে যেতে আমি আবারও ফিরে আসবো ডিয়েটস। যেভাবেই হোক, আমি আমার মায়ের চাওয়া পূরণ করবো।

ধোঁয়ার কুন্ডলী হয়ে আব্রাহাম কাস্ত্রোরুজ থর্পের সীমানা পেরিয়ে যায়। ধীরে ধীরে ধূলিঝড় থেমে যায়। ডিয়েটস সতর্ক দৃষ্টিতে আশেপাশে তাকালেন। কিন্তু কাউকে দেখতে পেলেন না। ইনায়াকে রাগমিশ্রিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করেন,

– মাঝরাতে এই পাহাড়ের চূড়ায় তুমি কেনো এসেছিলে? কোনোভাবে আমাকে অনুসরণ করে এখানে চলে আসোনি তো!

ইনায়া অপরাধবোধে ভুগল। ডিয়েটসকে অনুসরণ করা ঠিক হয়নি বুঝতে পারল ও। মুখ কাচুমাচু করে মিনমিনে স্বরে বলল,

– আসলে মাঝরাতে আপনি কোথায় যাচ্ছিলেন, সেটা জানার কৌতুহল থেকেই আপনাকে অনুসরণ করেছিলাম। তারপর আপনার পেছন পেছন এই পাহাড়ের চূড়ায় এসে পৌঁছাই। কিন্তু আপনাকে খুঁজে পাইনি। যখন ফিরে যেতে চাইলাম, ঠিক তখনই আমাকে কিছু ভয়ংকর বাদুড় আক্রমণ করে বসল।

– তারপর একটা ভ্যাম্পায়ারের মুখোমুখি হলে। তাইতো?

ডিয়েটসের প্রশ্নের উত্তর দিতে ইনায়া উপর নিচ মাথা ঝাঁকাল।

– মেয়েদের এতো কৌতুহল থাকা ভালো নয় ইনায়া। পদে পদে বিপদে পড়তে হয়। তাছাড়া তুমি এখনো অনেকটা দূর্বল। ওদের শক্তি বা ক্ষমতা সম্পর্কে তোমার বিন্দুমাত্র ধারনা নেই। পিশাচ’টা যদি চাইতো, মুহূর্তেই তোমার রক্ত শুষে তোমাকে মে’রে ফেলতে পারতো। নেহাত তোমার ভাগ্য ভালো ছিলো। তাই আজ মৃ’ত্যুর হাত থেকে বেঁচে গেলে। আশা করি, দ্বিতীয়বার কখনো এরকম বোকামো করবে না।

ইনায়ার শরীর বেশ দূর্বল হয়ে এলো। শয়তানটা ওর দেহ থেকে অনেকটা রক্ত চুষে নিয়েছিলো। ভীষণ ঘুম পাচ্ছে ওর। বুজে আসা চোখে ও ডিয়েটসের কথায় সম্মতি সূচক মাথা নাড়াল।

– অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে। এখন চলো। বাড়িতে ফেরা যাক।

ডিয়েটসের হাত ধরে ইনায়া ধীরে ধীরে উঠে দাড়াল। অগোছালো পায়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে হাঁটতে শুরু করল।

________★★_________

দরজায় করাঘাতের শব্দে সিয়ার ঘুম ভেঙ্গে গেল। লম্বা একটা হাই তুলে শোয়া থেকে উঠে বসল। ওর পরনে ভিক্টোরিয়ান নাইট গাউন। ভোর হয়ে গেছে। আধ খোলা কাঁচের গোল জানালা দিয়ে কামরায় ভোরের আলো প্রবেশ করছে। সিয়া দেয়াল ঘড়িটার দিকে তাকাল। মনে মনে ভাবল,

– কি ব্যাপার? আজ এতো বেলা হয়ে গেলো, অথচ অনুশীলনের জন্য বাবা ডেকে তুললেন না কেনো? আজকের আগে এরকম কখনো হয়নি।

সিয়া তড়িঘড়ি করে বিছানা থেকে নেমে দাড়াল। দ্রুতপায়ে হেঁটে গিয়ে দরজা খুলে দিল। দরজার পাশে উরসুলা ভনডারলেন দাঁড়িয়ে ছিলেন। তার মুখখানা কেমন শুকনো দেখাচ্ছিলো।

– দাদিন! কি হয়েছে? আপনার মুখখানা এমন শুকনো দেখাচ্ছে যে! বাবা কোথায়? উনি আজ আমাকে অনুশীলনের জন্য ডেকে তুললেন না কেনো?

উরসুলা ভনডারলেন সিয়ার একটা প্রশ্নেরও উত্তর দিলেন না। নিঃশব্দে পা ফেলে করিডোর দিয়ে হাঁটতে শুরু করেন। সিয়া উরসুলার পিছু নিল। তাকে নানা রকম প্রশ্ন করল। ধীরপায়ে হেঁটে সিড়ি বেয়ে নিচের তলায় নেমে গেলো। উঠানে একটা কাঠের চেয়ার পেতে বসে আছে ইনায়া। তার পাশেই বসে আছেন ডিয়েটস। ইলহামা অ্যালিয়েভ ইনায়ার দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে ছিলেন। তার চোখ জোড়া অশ্রুসিক্ত। মায়ের মুখের দিকে তাকাতেই সিয়ার বুকটা ধক করে উঠল। কি হয়েছে ওর মায়ের? এরকম কেনো দেখতে লাগছে তাকে?

সিয়া দৌড়ে যায় তার মায়ের কাছে। বাকিরা নির্বাক চোখে দেখে। সিয়া ইলহামা অ্যালিয়েভের একহাত নিজের দু’হাতের মাঝখানে নিয়ে জিজ্ঞেস করে,

– কি হয়ছে মা? আপনি কাঁদছেন কেনো?

ইলহামা অ্যালিয়েভ নিশ্চুপ, নির্বাক। কোনো কথা বললেন না। প্রস্তর মূর্তির ন্যায় স্থির দাড়িয়ে রইলেন। মূহূর্তেই ব্যাকুল হয়ে উঠে সিয়া। অকপটে জানতে চাইল,

– বাবা কোথায়?

ইলহামা যেন এই প্রশ্নটার’ই অপেক্ষায় ছিলেন। প্রশ্ন করা মাত্রই গর্জে উঠলেন। সিয়ার হাত দু’টো এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে ক্রুদ্ধ কন্ঠে বললেন,

-বাড়ি থেকে চলে গেছেন তোমার বাবা। আর কখনো ফিরে আসবেন না। তুমি চলো তোমার নিজের মর্জি মতো। কেউ আর তোমাকে অনুশীলনের জন্য তাগিদ দিবে না। চুল কেটে ফেলার জন্য শাস্তি দিবে না।

সিয়া ভীষনভাবে চমকায়। ওর চোখ দু’টো ছলছল করে করে উঠে। করুন স্বরে জিজ্ঞেস করে,

– বাবা কি আমার উপর রাগ করে সত্যি’ই বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন মা?

ইলহামা অ্যালিয়েভ প্রত্যুত্তর দেন না। তার গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। সিয়া ইনায়ার দিকে তাকায়। ওর হাতে অসংখ্য আঁচড়ের দাগ এবং ঘাড়ে ছোট ছোট দু’টো স্পষ্ট ক্ষত চিহ্ন দেখতে পায়। অস্থির হয়ে উঠে। ব্যাকুল কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,

– কি হয়েছে তোমার? শরীরে এই দাগগুলো কিসের?

ইনায়া রয়ে সয়ে গতকাল মাঝরাতে ঘটা লোমহর্ষক ঘটনাটার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিস্তারিত বলে। সিয়া ভীত-সন্ত্রস্ত চোখে তাকায়। যেন ওর শিরদাঁড়া বেয়ে অসম্ভব ভয়ের শীতল স্রোত গড়িয়ে যায়। শরীরের প্রতিটা লোমকূপ কেঁপে কেঁপে উঠে। তন্মধ্যে উইজার্ড ডিয়েটস গম্ভীর কন্ঠে বলেন,

– তোমার পাঠ করা ওল্টা পাল্টা স্পেলের জন্য সুরক্ষা ব্যারিয়ার ভেঙ্গে গিয়েছিলো। ভাবতে পারছো? আমি যদি টের না পেতাম তাহলে গ্রামের মানুষগুলোর কত বড় ক্ষতি হয়ে যেত! তোমার জন্যই ঐ রক্তচোষা পিশাচ’টা গ্রামের মধ্যে প্রবেশ করতে পেরেছিলো। কাল ইনায়ার মৃ’ত্যুও হতে পারতো। আমরা সবাই বিপদে পড়তাম। তুমি এখন অনেক বড় হয়ে গেছো। আর কিভাবে বললে তুমি বুঝবে বলোতো?

সিয়ার কাছে সবকিছুই কেমন অবিশ্বাস্য মনে হয়। বই-পুস্তক এবং দাদু-দাদিনের কাছে রক্তচোষা পিশাচ সম্পর্কে আজ পর্যন্ত যা কিছু জেনে এসেছে, তারমানে সবটাই সত্যি ছিলো? বিশ্বাস হয়েও হয় না যেন।

– কিন্তু ইনায়া বা দাদু এমন পরিস্থিতিতে মিথ্যা কথাই বা বলতে যাবে কেনো? বিশেষ করে ইনায়ার ক্ষতচিহ্নগুলো?

সিয়ার মাথা যন্ত্রণা শুরু হলো। ওর বাবা রাগ করে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন। মানতে পারল না ও। অবিশ্বাস্য কন্ঠে বলল,

– বাবা বাড়ি ছেড়ে চলে যাননি। নিশ্চয়ই পাহাড়ে গেছেন। আমি গিয়ে তাকে খুঁজে নিয়ে আসবো।

এতটুকু বলে বাড়ি থেকে দৌড়ে বেরিয়ে যায় ও। বাকিরা কেবল নিরব দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে ওর চলে যাওয়া দেখল।

_________★★_________

কিয়েভ, স্যাভেরিন ক্যাসল।

ড্রয়িং রুমে বসে ছিলো স্যাভেরিন পরিবারের সদস্যগুলো। ভোর বেলার দিকে কাস্ত্রোরুজ থেকে বেশ নাস্তানাবুদ হয়ে দুর্গে ফিরে এসেছে ভ্যাম্পায়ারদের রুলার আব্রাহাম স্যাভেরিন। খরবটা এখন পর্যন্ত ওভারলর্ড এদুয়ার্দো স্যাভেরিনের কান পর্যন্ত পৌঁছায়নি হয়তো।

ড্রয়িং রুমে পিনপতন নিরবতা বিরাজ করছিল। যা ঝড় আসার পূর্ব লক্ষণ। শুকনো মুখে বসে আছে ইজাবেল। ভাই আব্রাহামের জন্য বেশ দুশ্চিন্তা হচ্ছে তার। সোফার উপর সটান হয়ে শুয়ে আছে আব্রাহাম। হ্যারিয়েট সোফার উপর দু’পা তুলে আয়েশ করে বসল। একটু পরই এখানে জবরদস্ত ফাইট হবে তার দু’ভাইয়ের মধ্যে। যা দেখার জন্য একেবারে মুখিয়ে রইল।

পিদর্কা স্যাভেরিন ব্যস্ত ভঙ্গিতে পায়চারি করেন। বসে থাকতে থাকতে হাঁপিয়ে উঠে ভিক্টোরিয়া আর ক্যারলোয়েন। দু’জনেই ওভারলর্ডের এখানে আসার অপেক্ষায় অধীর আগ্রহে প্রহর গুনছিলো।

পরিবারের প্রত্যেকের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ঝড়ের বেগে ড্রয়িং রুমে প্রবেশ করে ওভারলর্ড এদুয়ার্দো স্যাভেরিন। প্রথমেই সে আব্রাহামের সামনে গিয়ে দাড়াল। দু’হাতে আব্রাহামের গলা চেপে ধরে মাটিতে আছড়ে ফেলল। গর্জন তুলে বলল,

– তোকে দিয়ে আজ পর্যন্ত কোন কাজটা ঠিকমতো হয়েছে? বল। বল আমাকে।

এদুয়ার্দো যখন ভয়ানক রেগে যায়। তখন ছোট ভাইকে তুই তুকারি করে বলে,

– স্লোভাকিয়ার দায়িত্ব দিয়েছিলাম তোকে। সেখানে থাকা সবগুলো ভ্যাম্পায়ার’দের শাসক বানিয়েছিলাম তোকে। এই রুলার সম্বোধন’টা তুই কিভাবে পেয়েছিস? স্লোভাকিয়ার ভ্যাম্পায়ারগুলো সব তোর অধীনস্থ বলেই তোকে সবাই রুলার বলে সম্বোধন করে। কিন্তু তুই কি করলি? ওডেসায় নিজের দুর্গে ফিরে এলি। রোমানিয়া, মলদোভা, পোল্যান্ড রাষ্ট্রের সবগুলো ভ্যাম্পায়ার শাসক আমার অধীনে চলে। আমি__ওভারলর্ড ক্লীভল্যান্ড এদুয়ার্দো স্যাভেরিন সমস্ত ভ্যাম্পায়ারদের কাউন্ট। তোকে স্লোভাকিয়ার রুলার পদ থেকে বরখাস্ত করছি। যে কিনা সামান্য একটা বৃদ্ধ লোকের কাছে পরাজিত হয়ে ফিরে আসে তার রুলার হওয়ার কোনো যোগ্যতা নেই।

– আমি হতে চাইনা কোনো রুলার। কারণ শাসকরা কখনো স্বাধীনভাবে জীবন যাপন করতে পারেনা। দায়িত্বের বেড়াজাল তাদের আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নেয়। আমি আমার মতো থাকতে চাই। আর রইলো আপনার বৃদ্ধ উইজার্ড ডিয়েটস। তাকেও আপনি গিয়ে নিয়ে আসুন। আমিও দেখতে চাই আপনার কত ক্ষমতা, কত শক্তি। ____আব্রাহাম তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বলে।

এদুয়ার্দো ফের তাকে মাটিতে আছড়ে ফেলে। পা চেপে ধরে বুকে। ক্রুদ্ধ কন্ঠে বলে,

– আমিই যাবো উইজার্ডকে আমার মায়ের সামনে হাজির করতে। ক্লীভল্যান্ড এদুয়ার্দো স্যাভেরিন তোর মতো অপদার্থ সন্তান নয়।

– ওকে ছেড়ে দাও। অনেক হয়েছে নিজেদের মধ্যে ঝুট ঝামেলা। উইজার্ড ডিয়েটস’কে তুলে আনা এতোটাও সহজ ব্যাপার নয়। এজন্যই আমি তোমাকে বলেছিলাম কাস্ত্রোরুজ থর্পে যেতে। কিন্তু তুমি আমার সম্পূর্ণ কথা না শুনে আব্রাহামকে পাঠিয়ে দিলে।

কথাগুলো বললেন পিদর্কা স্যাভেরিন। আব্রাহামকে ছেড়ে দেয় এদুয়ার্দো। দু’হাতে মাথা চেপে ধরে সোফার উপর বসে পড়ে সে।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।