আমি পদ্মজা | পর্ব – ৮৩

এখন যে দুপুর তা বুঝার সাধ্যি নেই! ঘন কুয়াশার চাদর মুড়ি দিয়ে পৃথিবী ঘুমিয়ে আছে। সকাল থেকে সূর্যের দেখা নেই। কুয়াশা তার গভীর মায়াজালে সূর্যকে লুকিয়ে রেখেছে। পূর্ণা আলগ ঘরের বারান্দায় বসে কাঁদছে। তার পাশে বসে আছে প্রান্ত। প্রান্ত পূর্ণাকে নিয়ে যেতে এসেছে। কিন্তু পূর্ণার কোনো হুঁশ নেই। সে কেঁদেই চলেছে। মগা আলগ ঘরে ঘুমাচ্ছে। নাক দিয়ে বের হচ্ছে বিদঘুটে শব্দ। সেই শব্দে প্রান্ত বিরক্ত! সে দুই আঙুল কানে ঢুকিয়ে চুপচাপ বসে রইলো। পূর্ণা হাঁটুর উপর থুতুনি রেখে সুপারি গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখ বেয়ে টুপটুপ বৃষ্টি বর্ষণ হচ্ছে। বুকের জ্বালাপোড়া সহ্য করতে পারছে না। মৃদুলের শেষ কথাগুলো তার শরীরের প্রতিটি পশমকে পুড়িয়ে দিয়েছে। এ ব্যথা সে কোথায় লুকোবে? মনের মণিকোঠায় যত্নে রাখা ভালোবাসার মুখের তিক্ত কথা কি সহ্য করা যায়! পূর্ণা নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে। বুকের ভেতর তুফান বয়ে যাচ্ছে। লণ্ডভণ্ড করে দিচ্ছে ফুসফুস, কিডনি,মস্তিষ্ক,সর্বাঙ্গ! পূর্ণার হেঁচকি ওঠে। প্রান্ত চেয়ার ছেড়ে পূর্ণার সামনে এসে দাঁড়ালো। উৎকণ্ঠিত হয়ে বললো,’আপা!’
পূর্ণা তার ডাগরডাগর চোখদুটো মেলে প্রান্তর দিকে তাকায়। চোখের দৃষ্টিতে দুঃখের মহাসাগর। পূর্ণা প্রান্তকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো,’ভাই,আল্লাহ আমাদের থেকেই কেন সবকিছু ছিনিয়ে নেন?’
প্রান্ত পূর্ণার কথার মানে বুঝলো না। কিন্তু পূর্ণার কান্না তার হৃদয় ছুঁয়ে যায়। সে পূর্ণার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,’ আল্লাহ সব ঠিক করে দিবেন আপা। বড় আপা বলে,যা হয় সব ভালোর জন্য হয়।’
পূর্ণার কান্নার দমকে কিশোর প্রান্ত কেঁপে-কেঁপে উঠে। আলগ ঘরের ডান পাশে রিদওয়ান দাঁড়িয়ে আছে। মৃদুল অন্দরমহলে আছে ভেবে সে পাতালঘর থেকে সোজা আলগ ঘরে এসেছে। কিন্তু এসে দেখে,এখানে পূর্ণা হাউমাউ করে কাঁদছে! ব্যাপারটা কী? রিদওয়ান আলগ ঘরে আর গেল না। কলপাড়ে রিনুকে দেখা যায়। রিদওয়ান চারপাশ দেখতে দেখতে কলপাড়ে আসে। রিনু রিদওয়ানকে দেখে ভয়ে জমে যায়। রিদওয়ান নানা অজুহাতে রিনুর গায়ে হাত দেয়। রিনুর ভালো লাগে না। ভয়ে কিছু বলতেও পারে না। সে এতিম! ছোট থেকে এই বাড়িতে বড় হয়েছে। যাওয়ার জায়গা নেই। রিদওয়ান রিনুকে প্রশ্ন করলো,’ পূর্ণা কাঁদতেছে দেখলাম। কিছু জানিস?’
রিনু কাচুমাচু হয়ে সকালের ঘটনা খুলে বললো। সব শুনে রিদওয়ান খুব খুশি হয়। গুনগুনিয়ে গান গেয়ে অন্দরমহলের দিকে যায়। আমিনা আলোকে নিয়ে অন্দরমহলের সামনে খেলছেন। রিদওয়ান আলোর দিকে হাত বাড়িয়ে ডাকলো,’মামা,এদিকে আসো।’
রিদওয়ান আলোকে কোলে নেয়। আমিনা ভারী করুণ ভাবে বললো,’ আমার রানিরে কি পাওন যাইতো না?’
রিদওয়ান চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো,’খোঁজা হচ্ছে। পেয়ে যাবো।’
আলোকে আমিনার কোলে দিয়ে রিদওয়ান সদর ঘরে প্রবেশ করে। রান্নাঘর থেকে পদ্মজার কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে। রিদওয়ান সেদিকে যায়। পদ্মজা রিদওয়ানকে দেখে চোখ ফিরিয়ে নিল। কাজে মন দিল। রিদওয়ান পদ্মজার উপর চোখ রেখে কপাল কুঁচকায়! এই মেয়ে এতো চুপচাপ আর স্বাভাবিক কেন? সব মেনে নিল নাকি? রিদওয়ান মনের প্রশ্ন মনে রেখেই জায়গা ত্যাগ করে। যাওয়ার পূর্বে লতিফাকে বলে গেল,’লুতু,খাবার নিয়ে আয়।’
রিদওয়ান চোখের আড়াল হতেই লতিফা ভেংচি কাটে। মাংস রান্না হচ্ছে। মাংস রান্না হতে দেখলেই পদ্মজার ফরিনার কথা মনে পড়ে। ফরিনার হাতের মাংসের ঝোলের স্বাদ ছিল অন্যরকম। অন্দরমহলের বাম পাশে ফরিনার কবর! আজ তিনদিন তিনি পৃথিবীর মায়া ছেড়েছেন। পদ্মজার বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। মাথার উপর ভারী বোঝা! বোঝা টানতে কষ্ট হচ্ছে। নিঃশ্বাসে-নিঃশ্বাসে সে আল্লাহর নাম স্বরণ করছে। প্রার্থনা করছে, এই বোঝার ঘানি যেন সে টানতে পারে। সেই ক্ষমতা আর ধৈর্য্য যেন হয়! লতিফা পদ্মজাকে চাপাস্বরে ডাকলো,’পদ্ম?’
পদ্মজা তাকালো। লতিফা বললো,’তুমি আমারে না কইছিলা বড় কাকা আর ছোট কাকার সব খবর দিতে।’
পদ্মজা দরজার বাইরে একবার তাকালো। তারপর লতিফার দিকে ঝুঁকে বললো,’কী খবর এনেছো?’
‘শনিবার রাইতে ভোজ আসর বসাইবো।’
‘কীসের?’
লতিফা কথা বলতে ভয় পাচ্ছে। তার দৃষ্টি অস্থির। সে ফিসফিসিয়ে বললো,’মাইয়া পাচার করার কয়কদিনের মাঝে সবাই এক লগে বইয়া খাওয়া-দাওয়া করে। পরের কাম নিয়া কথাবার্তা কয়।’
‘এটাও কী নিয়ম?
‘হ।’
‘কত্ত খারাপ এরা! এতো মেয়ের জীবন নষ্ট করতে পেরেছে সেই খুশিতে আনন্দ-ফূর্তি করে! কয়জন থাকবে জানো?’
লতিফা বললো,’পাঁচ জনে।’
পদ্মজা আর কথা বাড়ালো না। অন্যমনস্ক হয়ে উচ্চারণ করলো,’শনিবার রাতে!’
লতিফা কপাল ইষৎ কুঁচকিয়ে বললো,’কিতা করবা ভাবছো?’
পদ্মজা তেজপাতা হাতে নিয়ে বললো,’জানি না বুবু।’
পদ্মজা কথা বাড়াতে চাইছে না বুঝতে পেরে লতিফা আর কথা বললো না। সে রিদওয়ানের জন্য খাবার প্রস্তুত করে।।পদ্মজা বললো,’ জানো,তোমার ভাই আমার আগে দুটো বিয়ে করেছে!’
লতিফার হাত থেকে থালা পড়ে যায়। ঝনঝন শব্দ হয়। ভাত,ঝোল মেঝেতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে।

মৃদুল পুকুরপাড়ে বসে আছে। তার চোখ দুটি লাল। আজ ট্রেন নেই। আগামীকাল ভোরে ট্রেন আসবে। জুলেখার ফুফাতো বোনের শ্বশুর বাড়ি অলন্দপুরে। আটপাড়ার পাশের গ্রাম নয়াপাড়ায়! জুলেখা সোজা তার বোনের বাড়িতে চলে এসেছে। এখানে আসার পর থেকে বাড়ির পাশে পুকুরপাড়ে বসে আছে মৃদুল। তার জিভ ভারী হয়ে আছে। অকপট বলে দেওয়া কথাটা তাকে খুঁড়ে, খুঁড়ে খাচ্ছে। পূর্ণার কান্নামাখা চোখ দুটি বার বার ভেসে উঠছে চোখের সামনে। বুকে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। দুশ্চিন্তায় দপদপ করছে মাথার রগ। কান্নারা গলায় এসে আটকে আছে। রাগের বশে সে জীবনে অনেক ভুল করেছে। কিন্তু এইবারের ভুলটা আত্মার উপর আঘাত হানছে। নিজের কথা দ্বারা নিজেই কষ্ট পাচ্ছে। জুলেখা বানু মৃদুলকে খুঁজে পুকুরপাড়ে আসেন। তিনি মৃদুলের উপর বেজায় খুশি! মৃদুলকে বললেন,’আব্বা,খাইতে আসো।’
মৃদুল দূর্বল গলায় বললো,’পরে খামু। যান আপনি।’
জুলেখা মৃদুলের পাশে বসলেন। মৃদুলের পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,’তোমার লাইগগা আসমানের পরী আনাম। মন খারাপ কইরো না।’
‘লাগব না আমার আসমানের পরী।’
মৃদুলের কণ্ঠস্বর কঠিন হওয়াতে জুলেখা বানুর হাসি মিলিয়ে যায়। তিনি বললেন,’দেহো আব্বা,তুমি চাইছো আর পাও নাই এমন কিছু আছে? ওই ছেড়ি কালা। ছেড়ির বইনেরও চরিত্র ভালা না…’
‘চুপ করেন আম্মা। আল্লাহর দোহাই লাগে,চুপ করেন। আপনি কারে কি কইতাছেন? পদ্মজা ভাবির নখের যোগ্যেরও কোনো নারী নাই। আর আপনি তারে চরিত্রের অপবাদ দিতাছেন।’
মৃদুল চিৎকার করে কথাগুলো বললো। মৃদুলের চিৎকার শুনে জুলেখার বোনের শ্বাশুড়ি পুকুরপাড়ে উঁকি দেন। সেদিকে তাকিয়ে জুলেখার লজ্জা হয়। মাথা হেট হয়ে যায়। তিনি রাগে চাপাস্বরে বললেন,’আমি কইতাছি না গেরামের মানুষ কইছে? ওই ছেড়ির শ্বশুরেও কইছে। এরা মিছা কইছে?’
‘হ কইছে। আমি লিখন ভাইরেও চিনি,পদ্মজা ভাবিরেও চিনি। এই দেশের নামীদামী একজন অভিনেতা কেন অন্য বাড়ির বউয়ের সাথে লুকিয়ে সম্পর্ক রাখব আম্মা? তার কী সুন্দর মাইয়ার অভাব? পদ্মজা ভাবিরে লিখন ভাই পছন্দ করে ঠিক। কিন্তু পদ্মজা ভাবির সাথে আমির ভাইয়ের বিয়া হইবার আগে থাইকা। পদ্মজা ভাবি এমনই পবিত্র একজন মানুষ যে,লিখন ভাই এত্ত ভালোবাসে জাইননাও কোনোদিন লিখন ভাইয়ের দিকে ফেইরা তাকাইছে না। জামাইরে ভালোবাসছে। পদ্মজা ভাবি,দিনরাত এবাদত করে। ভাই-বোনের দায়িত্ব নিছে। এমন মানুষ খুঁইজা পাইবেন? পূর্ণার কাছে ওর বইনে ওর মা। তুমি ওর মারে খারাপ কথা কইছো। এজন্যে ও তোমার সাথে খারাপ করছে। আর পূর্ণা তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করছে তাই আমিও…’
মৃদুল আর কথা বলতে পারলো না। চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ে। দাঁতে ঠোঁট কামড়ে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। জুলেখা পিছনে ফিরে তাকান। বোনের শ্বাশুড়ি তাকিয়ে রয়েছে! জুলেখার মুখটা অপমানে থমথমে হয়ে যায়। গটগট শব্দ তুলে জায়গা ছাড়লেন। মৃদুল জুলেখার যাওয়ার পানে তাকালো। সে তার মায়ের স্বভাব জানে। এখন খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিবে। উনিশবিশ হলেই নিজের ক্ষতি করে বসেন। এজন্য গফুর মিয়াও কিছু বলেন না,আর না মৃদুল কিছু বলতে পারে! মৃদুল মাথা নত করে কান্নায় ডুবে যায়। শেষ কবে সে কেঁদেছে জানে না!

পূর্ণা পদ্মজাকে না বলে বাড়িতে চলে গেছে। পদ্মজা এক হাতে কপাল ঠেকিয়ে চোখ বুজে বসে আছে। মস্তিষ্কে ঘুরাঘুরি করছে আমিরের কু-কীর্তি! তার দুটো বিয়ে,নারী আসক্তি,সমাজের চোখে কলঙ্কিত হওয়া আর ফরিনার মৃত্যু! কানে বাজছে ‘নষ্টা’ শব্দটি। কতো ঘৃণা নিয়ে জুলেখা বানু এই শব্দটি উচ্চারণ করেছিলেন! তারপর মৃদুলের বলা কথাগুলো শুনে পূর্ণার অবাক চাহনি! পূর্ণার রক্তাক্ত হৃদয়ের যন্ত্রণা পদ্মজা টের পাচ্ছে! বুকটা ভারি হয়ে আছে। কান্না মন হালকা করে। কিন্তু কান্না আসছে না। আর কত কাঁদা যায়? পদ্মজা নিজেকে বুঝায়, আরো ধৈর্য্যশীল হতে হবে! এক হাতের দুই আঙুলে কপালের দুই পাশ চেপে ধরে।
আমির সদর ঘরে প্রবেশ করে থমকে যায়। তার হাতে কাপড়ের একখানা খালি ব্যাগ। পদ্মজা পা দেখেই চিনে ফেলে,মানুষটা কে! সে মুখ তুলে তাকালো না। সেকেন্ড কয়েক আমির থম মেরে দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর পদ্মজার পাশ কেটে দ্বিতীয় তলায় উঠে গেল। পদ্মজা অনুভব করে,তার অনুভূতিরা পাল্টে যাচ্ছে। চঞ্চল হয়ে উঠছে! আমির ঘরে প্রবেশ করেই দ্রুত আলমারি খুললো। একবার দরজার দিকে তাকালো। তারপর কাগজে মুড়ানো একটা বস্তু দ্রুত ব্যাগে ঢুকিয়ে নিল। যখন আলমারি লাগাতে যাবে একটা খাম মেঝেতে পড়ে। খামের উপরের লেখাটা আমিরের চেনা-চেনা মনে হয়। তাই সে পদ্মজার অনুমতি ছাড়াই খামের ভেতর থেকেচিঠি বের করলো। চিঠির লেখাগুলো দেখে শতভাগ নিশ্চিত হয়ে যায়, এটা আলমগীরের চিঠি!
আমিরের ভ্রু দুটি বেঁকে গেল। সে উৎকণ্ঠা নিয়ে প্রতিটি লাইন পড়লো। প্রতিটি শব্দ তার মগজে আঘাত হানে! আতঙ্কে গায়ের পশম দাঁড়িয়ে যায়। নিজের অজান্তে এক কদম পিছিয়ে আসে। আলমগীরের খামের ভেতরের পৃষ্ঠায় কিছু লেখার অভ্যেস রয়েছে। আমির খাম ছিঁড়লো। তার ধারণা ঠিক! সাদা খামের ভেতরের পৃষ্ঠায় আলমগীরের বর্তমান ঠিকানা ও পাতালঘরের সঠিক অবস্থানের কথা লেখা আছে! আমির আলমগীরের ঠিকানাটা মুখস্থ করার চেষ্টা করলো। কিন্তু মুখস্থ হচ্ছে না। ভেতরটা কাঁপছে। পদ্মজা দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। আমির পদ্মজার উপস্থিতি টের পেয়ে হাতের খাম ও চিঠিগুলো বিছানার উপর রেখে কাপড়ের ব্যাগটা হাতে তুলে নিল। তারপর পদ্মজার দিকে তাকালো। তার চাহনি যেন মৃত! পদ্মজা কয়েক পা এগিয়ে এলো। আমির অপলক চোখে তাকিয়ে আছে। পদ্মজা রয়ে সয়ে প্রশ্ন করলো,’ আর কিছু জানার আছে?’
আমির নির্বিকার! তার মুখে রা নেই। পদ্মজা বিছানা থেকে একটা চিরকুট হাতে নিল। বললো,’আপনার দুই বউয়ের নাম কী ছিল?’
আমির বললো,’শারমিন,মেহুল।’
পদ্মজার ঠোঁট দুটো কেঁপে উঠে। আমির পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে। চোখের পলকও পড়ছে না। পদ্মজা ঢোক গিলে বললো,’আমরা যে ঘরে একসঙ্গে থেকেছি,তারাও কি সেই ঘরে আপনার সঙ্গে থেকেছে?’
‘না,অন্য বাড়িতে।’
‘তাহলে সব সত্য?’
‘মিথ্যা বলে যদি তোমাকে আরো একবার পাওয়া যেত আমি মিথ্যা বলতাম।’ আমিরের সরল গলা। পদ্মজার নাকের পাটা ফুলে যায়। আমিরের সাথে কথা বললে তার এতো কান্না পায় কেন! আমির বললো,’আসি।’
পদ্মজা শ্বাসরুদ্ধকর কণ্ঠে বললো,’কেন?’
আমির থামলো। পদ্মজা কান্না করে দিল। সে কিছুতেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। আমির বললো,’আমাকে কান্না দেখাতে দাঁড় করালে?’
পদ্মজা জল ভরা আগুন চোখে আমিরের দিকে তাকায়। কিড়মিড় করে বললো,’ নরপশু আপনি! এতগুলি মেয়ের ভালোবাসা নিয়ে খেলেছেন।’
আমির নির্বাক। তার চুপ করে থাকাটা পদ্মজাকে আরো জ্বালা দেয়। তার অবচেতন মন চায় একবার আমির বলুক, সব মিথ্যে। কিন্তু আমির বলে না। কারণ,সব সত্য! সব সত্য! পদ্মজা অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে চিৎকার করে বললো,’ কথা বলার মুখ নেই? এতো লজ্জা হা? আসলেই লজ্জা আছে?’
পদ্মজা তাচ্ছিল্যের হাসি দিল। আমির চোখের দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। বুকের ভেতর আগুন ছুটে বেড়াচ্ছে। যেদিকে যাচ্ছে সেদিকটা পুড়িয়ে ছাই করে দিচ্ছে। পদ্মজা এলোমেলো হয়ে গেছে। আমির বের হওয়ার জন্য উদ্যত হতেই পদ্মজা বললো,’আমাকে তালাক দিন। আমি আপনার বউয়ের পরিচয়ে আর থাকতে চাই না।’
পদ্মজার কথা শোনামাত্র আমিরের বুকটা কেঁপে উঠলো। কোথেকে যেনো একটা উত্তাল ঢেউ এসে মনের সমস্ত কিনার ওলট-পালট করে দিল। আমির কথা বলতে গিয়ে দেখলো কথা আসছে না। পদ্মজা আরো একবার চেঁচিয়ে বললো,’আমার তালাক চাই। আপনার বউ হওয়া কলঙ্কের।’
আমির অনেক কষ্টে কয়টা শব্দ উচ্চারণ করলো,’থাক না এক-দুটো কলঙ্ক।’
পদ্মজা সেকেন্ড তিনেক ছলছল চোখে তাকিয়ে রইলো। তারপর মুহূর্তে ভুলে যায় পৃথিবী। ভুলে যায় পাপ-পুণ্য। ঝড়ের গতিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে আমিরের বুকে। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। ছেড়ে দিলে যদি হারিয়ে যায়! আমিরের বুকের সোয়েটার কামড়ে ধরে কাঁদতে থাকে। কাঁদতে কাঁদতে বললো,’ চলুন না, দূরে পালিয়ে যাই। আমি আর সহ্য করতে পারছি না।’
পদ্মজা জড়িয়ে ধরতেই আমিরের শরীরের রক্ত চলাচল থেমে যায়। অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে। চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ে। সেই জল ফুটন্ত পানির মতো গরম। এ যেন দগ্ধ হওয়া হৃদয়ের আঁচ!

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।