ফ্লোরেনসিয়া – ১৪

কাস্ত্রোরুজ থর্প।

গুহার দরজার সামনে বুক টানটান করে সগর্বে দাঁড়িয়ে ছিলো এদুয়ার্দো। ভেতর থেকে ভেসে আসছিলো ভয়ার্ত সিয়ার অসহায় আত্মচিৎকার। তবুও এদুয়ার্দোর মনে বিন্দুমাত্র করুণা হলো না। বরং বক্ষস্থলে পৈশাচিক আনন্দ পাচ্ছিল যেন। ক্ষণকাল সময় গড়াল। সিয়ার আর্তনাদ থেমে গেলো। এদুয়ার্দোর এমারেল্ড সবুজ চোখজোড়া থেকে অপার্থিব দ্যুতি ছড়াল। সে রাগমিশ্রিত কন্ঠে বলল,

– মেয়েটা চরম বে’য়া’দব।

ওভারলর্ড এদুয়ার্দো স্যাভেরিন শুধুমাত্র তার মায়ের কথা শুনে চলে। তার একমাত্র দূর্বলতা ছোট বোন ইজাবেল। পাথরের থেকেও শক্ত হৃদয়ের এই র’ক্তচোষা পি’শাচের জীবনে আদৌও মায়া-দয়া বলে কিছু আছে কিনা কে জানে! থাকলে কি আর সিয়াকে এভাবে কষ্ট দিতে পারতো?

গভীর রাত। সন্ধ্যা লগ্নে গগনে উঠেছিলো রুপোলী চাঁদ। যেন কোন এক পাহাড়ের পেছনে লুকিয়ে ছিলো ওটা। এদুয়ার্দো গুহার দরজার সম্মুখে দাঁড়িয়ে দূরের পাহাড়গুলোর দিকে স্থির নেত্রে তাকিয়ে রইল। চাঁদটা লুকিয়ে গেছে মেঘের আড়ালে। ক্ষণে ক্ষণে বাতাসের বেগ বাড়ল। বড় বড় গাছের ডালপালাগুলো আন্দোলিত হলো। দমকা হাওয়ার দাপটে এদুয়ার্দোর পরনে থাকা ট্রেঞ্চকোট’টা উড়তে শুরু করল। গুহার দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল খড়কুটো আর ধূলোবালি। প্রবল বাতাসে দাঁড়িয়ে থাকা মুশকিল হয়ে দাড়াল। হয়তো ধূলিঝড় হবে। এদুয়ার্দো গুহার ভিতরে প্রবেশ করল। দেয়াল ঘেঁষে মেঝেতে সিয়াকে কাত হয়ে পড়ে থাকতে দেখল। মেয়েটার হাঁটু পর্যন্ত লম্বা সাদা ফ্রকটায় ছোপ ছোপ রক্তের দাগ লেগে আছে। উজ্জ্বল বাদামী রঙা চুলগুলো এলোমেলো হয়ে মুখ ঢেকে গেছে। পুতুলের মতো দেখতে বাচ্চা একটা মেয়ে। যার নিষ্পাপ মুখখানার দিকে তাকালে যেকোন মানুষের হৃদয় বিগলিত হবে। কিন্তু এদুয়ার্দো মানুষ নয়। কঠিন হৃদয়ের একজন ভয়ংকর র’ক্তচোষা পি’শাচ।

মাতাল করা রক্তের তীব্র সুবাসে এদুয়ার্দো নিমেষেই হিংস্র হয়ে উঠল। দুর্দমনীয় রক্তের নেশা তাকে চুম্বকের মতো সিয়ার কাছে টেনে নিয়ে গেল। চোখের পলকে সে সিয়ার পাশে গিয়ে বসল। শক্ত হাতে ওর ঘাড় চেপে ধরল। সিয়া মৃদু আর্তনাদ করে উঠে মিষ্টি প্রাণোচ্ছল ভঙ্গিতে হাসল। চাঞ্চল্য ঠোঁটে অপূর্ব কন্ঠে বলল,

– আহ! লাগছে। ইনায়া ছেড়ে দাও আমাকে।

এদুয়ার্দো থমকাল। হঠাৎই যেন তার রক্তের নেশা উবে যায়। একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে দেখল। মেয়েটা হাসছে। ঘুমের ঘোরে বোধহয় স্বপ্ন দেখছে। এদুয়ার্দোর হিংস্র চেহারা ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে এলো। সে হাতের এক আঙ্গুলের দ্বারা সিয়ার মুখের চুল সরিয়ে দিল। সিয়া তখনো মিটমিটিয়ে হাসছিল। ভীষন সুন্দর লাগছিল দেখতে। ওর হাস্যোজ্জ্বল মুখখানা থেকে এক টুকরো চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়ে যেন সম্পূর্ণ গুহাটা আলোকিত হয়ে উঠল। নিজের অজান্তেই এদুয়ার্দো কিঞ্চিৎ ঠোঁট ছড়িয়ে প্রশংসনীয় হাসল।

বাইরে ধুলিঝড় বইছিল। গুহার মাঝখানে থাকা মশালগুলো কাঁপতে শুরু করল। কতক্ষণ সময় গড়াল কে জানে। সহসা এদুয়ার্দোর চেহারা পুনরায় হিংস্র হয় উঠল। সে হাত ছেড়ে দিল। সিয়ার মাথাটা সশব্দে মেঝেতে বাড়ি খেল। সিয়া করুন কন্ঠে চিৎকার দিয়ে উঠে ডাকল,

– মা!

মাথায় আঘাত পেয়ে সিয়ার ঘুম ভেঙ্গে গেল। ও চোখ পিট পিট করে তাকাল। কিন্তু চোখের সামনে সবকিছু ঝাপসা দেখতে পেল। সারা শরীরে প্রচন্ড ব্যথা অনুভব করল। এদুয়ার্দো ওর থেকে বেশ খানিকটা দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সিয়ার হাত দু’টো তখনো পিঠ পেছনে শক্ত রশ্মি দিয়ে বাঁধা ছিল। পা দু’টোও বাঁধা। বেঁধে রাখা হাত-পায়ে খুব কষ্টে উঠে বসার চেষ্টা করল। বার কয়েক চেষ্টা করার পর উঠে বসতে সক্ষম হল। দৃষ্টি ঘুরিয়ে আশ পাশটা দেখল। এদুয়ার্দোর দিকে চোখ পড়তেই অসামান্য বিতৃষ্ণায় মুখ ফিরিয়ে নিল ও। কিছু আক্রোশপ্রসূত গালাগালি গলা পর্যন্ত এসে আঁটকে গেলো। একরাশ ঘৃনা নিয়ে উচ্চস্বরে বলল,

– র’ক্তচো’ষা জা’নো’য়ার।

জা’নো’য়ার শব্দটাকে ভীষণ অপছন্দ করে এদুয়ার্দো। তার মন চাইল এখনই সিয়ার ধর থেকে মাথাটা আলাদা করে দিতে। সারাজীবনের মতো মেয়েটার কন্ঠস্বর রোধ করে দিতে। কিন্তু কোন এক অদৃশ্য বাঁধা তাকে আঁটকে দিল। হয়তো ডিয়েটস’কে এখান থেকে স্যাভেরিন ক্যাসলে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনের তাগিদে। নতুবা অন্য কোনো কারণে সে সিয়াকে বাঁচিয়ে রাখল।

ততক্ষণে বাইরে প্রবাহিত শ্বাসরোধ করা ধুলিঝড় থেমে গেলো। এদুয়ার্দো একটা বড় আকারের মশাল হাতে নিল। এগিয়ে গেল গুহার দরজার দিকে। সিয়া সরু দৃষ্টিতে তার চলে যাওয়া দেখল। পুনরায় দু’হাতের বাঁধন খুলে ফেলার আপ্রাণ চেষ্টা করল ও। বিরবিরিয়ে বলল,

– একবার শুধু হাতের বাঁধন মুক্ত হই। শ’য়’তানটার গলা চেপে ধরবো। ওকে আমি শ্বাসরোধ করে মা’রবো।

– নির্বোধ।____ বিদ্রুপের স্বরে বলে উঠল এদুয়ার্দো।

চোখের সামনে পুনরায় এদুয়ার্দোকে দেখে ফুঁসে ওঠল সিয়া। আক্রমনাত্মক হয়ে তেড়ে গেলো তাকে মা’রার জন্য। কিন্তু পা বেঁধে রাখায় দাঁড়াতে পারল না। ভারী ভারী পা ফেলে এদুয়ার্দো ওর কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়াল। অকস্মাৎ কোলে তুলে নিল। সিয়া ছটফটিয়ে উঠল। কর্কশ ভাষায় গালিগালাজ জুড়ে দিলো।

এদুয়ার্দো ঝড়ের বেগে গুহার দরজায় গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। ক্রুদ্ধ কন্ঠে শাসানোর স্বরে বলল,

– আর একটা শব্দ করলে এখান থেকে নিচে ফেলে দিবো।

– ফেলে দে। চোখের সামনে তোর মতো একটা অপকৃষ্ট জন্তুকে দেখার চেয়ে ম’রে যাওয়া ঢের ভালো। নতুবা আমার হাতের বাঁধন খুলে দে। আমিই তোকে ফেলে দেই এই গুহার মুখ থেকে।

– অ’স’ভ্য মেয়ে।

– আমার দাদু যদি একবার জানতে পারে তাহলে তোর কি অবস্থা হবে, সেটা কল্পনা করেই আমার ভীষণ আনন্দ হচ্ছে।

এদুয়ার্দোর ধৈর্যচ্যুতি ঘটল। সিয়াকে গুহার মুখ থেকে নিচে ফেলে দিল। সিয়া বীভৎস চিৎকার দিয়ে উঠল। হাত পা বাঁধা অবস্থায় ক্রমশ নিচে পড়ে যাচ্ছিলো। ওর গলা শুকিয়ে গেল। মৃ’ত্যু নিশ্চিত জেনে চোখ মুখ কুঁচকে বন্ধ করে নিল। আচম্বিতে ডানা ঝাপ্টানোর শব্দ শুনতে পেল। সিয়া চোখ মেলে তাকালো। দৃষ্টির সম্মুখে দু’টো জ্বলজ্বলে সবুজ চোখের মনি দেখতে পেল। সটান হয়ে খাদের অভিমুখে পড়তে থাকা সিয়ার সাথে সাথে এদুয়ার্দোও খাদে পড়ে যাচ্ছে। যেন দু’জনের মাঝখানে বেশ দুরত্ব বজায় রেখে একজন আরেকজনের উপর শুয়ে আছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই এদুয়ার্দো সিয়াকে দু’হাতে আঁকড়ে নিলো। বাহুবন্ধনীতে আবদ্ধ করে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। কালো কুচকুচে দু’টো প্রশস্ত ডানা মেলে শূন্যে ভেসে রইল। অকপটে সিয়াকে জিজ্ঞেস করল,

– এখনো কি ম’রে যাওয়ার ইচ্ছেটা আছে?

সিয়া কোনো কথা বলল না। ভয়াবহ রাগে ওর গা জ্বলে যাচ্ছিল। এদুয়ার্দোর দিকে তাকিয়ে থেকে মনে মনে ভাবল,

– এই র’ক্তচোষা শ’য়’তানটা কি চায় আমার কাছ থেকে? মে’রেও ফেলছে না, ছেড়েও দিচ্ছে না। তাহলে আমাকে নিয়ে ওর কি উদ্দেশ্য?

সিয়া বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারল না। যেন ওর চোখ দু’টো ঝলসে যেতে চাইল। ও নিজের দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। বিরবির করে অনুচ্চ স্বরে বলল,

– ঈশ্বর এই রক্তচোষা পি’শাচের মুখশ্রীতে এতো মায়া কেনো ঢেলে দিয়েছেন কে জানে! এজন্যই আর্নি এই শয়তানটার মায়ায় জড়িয়েছিল। কিন্তু আমি এর মায়ায় পড়ে যাওয়ার মতো মেয়ে নই। আর্নির মতো বোকা নই আমি। সুযোগ পেলে প্রাণ নিয়ে নিবো।

– এবার যদি ছেড়ে দেই, অকালে প্রাণ হারাবে। কেউ বাঁচাতে আসবে না। সুতরাং নিজের মুখ বন্ধ রাখো।

সিয়া পরপর দু’বার শুকনো ঢোক গিলে নিশ্চুপ হয়ে গেলো। এদুয়ার্দো চোখের পলকে ওকে নিয়ে বনিফেসিও পাহাড়ের চূড়ায় উঠে এলো। দূর থেকে দু’টো মশালের আলো দেখতে পেলো। সিয়াকে বিস্তর প্রান্তরে নিয়ে একপ্রকার ছুঁড়ে ফেলে দিল। সিয়া ভীষণ অপমানবোধ করল। এদুয়ার্দো পাহাড়ের কিনারায় গিয়ে দাড়াল।

_______★★______

বনিফেসিও পাহাড়।

এই পাহাড়ের চূড়া এমন একটা জায়গা, যেখানে কোনোদিনও কোনো গাছ অথবা লতাগুল্ম জন্মাতে দেখা যায়নি। বছরের দু’মাস এই জায়গার পাহাড়ি মাটি পাথরের মতো শক্ত আর মরুভূমির বালির ন্যায় উত্তপ্ত হয়ে থাকে। কিন্তু সাম্প্রতিক ঝড় বৃষ্টির ফলে মাটি ভিজে পিচ্ছিল হয়ে আছে। সিয়ার পোশাক আর শরীরে কাদার ছড়াছড়ি। দীর্ঘ সময় ধরে বেঁধে রাখার ফলে ওর হাত পা প্রচন্ড ব্যথা হয়ে গেছে। অসহ্য লাগছে সবকিছু। সবথেকে বেশি অসহ্য লাগছে সামনে দাড়িয়ে থাকা পি’শাচ’টাকে।

প্রায় ভোর হতে চলেছে। দূর থেকে ভেসে আসছে গীর্জার ঘন্টাধ্বনি। দু’টো মশাল হাতে বনিফেসিও পাহাড়ের নিচে এসে দাঁড়ালেন ক্রিসক্রিংগল আর ডিয়েটস। চারদিকে আবছা আলো আবছা অন্ধকার ছিল। মশাল সাথে করে নিয়ে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন মনে করলেন না বিধায় সেগুলো সিঁড়ির কাছে রেখে গেলেন। ইতোমধ্যে ডিয়েটসের আত্মা কাঁপতে শুরু করল। কোনো র’ক্তচো’ষা পি’শাচের ভয়ে নয়, নিজের নাতনির কথা ভেবে। ঈশ্বর জানেন সিয়া কেমন অবস্থায় আছে।

ক্রিসক্রিংগলের মুখাবয়ব প্রস্তর মূর্তির ন্যায় শক্ত দেখাচ্ছিল। অথচ তার শান্ত চেহারার পেছনে ভয়াবহ আতংক বিরাজ করছিল। তিনি ভাবলেন। ভীষন মনোযোগ দিয়ে ভাবলেন, কিভাবে মেয়ে আর বাবা দু’জনকেই নিরাপদে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন। ভাবতে ভাবতে তিনি দিশেহারা হয়ে পড়লেন। বৃদ্ধ বাবাকে নিয়ে দ্রুতপায়ে পাহাড়ের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে শুরু করলেন। তার পিঠ পেছনে ঝুলে আছে ধনুর্বিদ্যার ব্র্যাকার। কতগুলো তীর আর দু’টো ঝকঝকে ধারালো তলোয়ার। তীরের অগ্রভাগ গুলো লোহার তৈরী। তিনি পূর্ব প্রস্তুতি নিয়ে এসেছেন। কে জানে তাদের জন্য কি ভয়াবহ বিপদ অপেক্ষা করছে।

একটা আলো ঝলমলে ভোর। কর্ণকুহরে ভেসে আসে পাখিদের মিষ্টি মধুর গান। হাঁটতে হাঁটতে অবশেষে পাহাড়ের চূড়ায় উঠে এলেন দু’জন। ডিয়েটস ঘনঘন নিঃশ্বাস নিতে শুরু করলেন। পিচ্ছিল মাটিতে হাঁটতে তার বেশ বেগ পেতে হচ্ছিলো। তিনি সাবধানী পা ফেলে এগিয়ে গেলেন। ক্রিসক্রিংগল ধনুকে তীর রেখে সতর্ক দৃষ্টিতে আশে পাশে নজর বুলালেন। কিন্তু কাউকে দেখতে পেলেন না। গলা শুকিয়ে গেল তার। অজানা আশংকায় বুক ধরফড়িয়ে উঠল। শঙ্কিত কন্ঠে বললেন,

– বাবা। এখানে তো কেউ নেই। তাহলে আমার মেয়ে কোথায়?

ডিয়েটস দৃঢ় চিত্তে অপেক্ষা করলেন। আত্মবিশ্বাসের সাথে বললেন,

– ওরা এখানেই আছে। কাছে কোথাও। আমি একজন ক্ষমতাধর পি’শাচের অস্তিত্ব অনুভব করছি।

বলতে না বলতেই দু’জনের পেছন থেকে একটা ভয়ংকর কন্ঠস্বর ভেসে আসে,

– উইজার্ড ডিয়েটস!

ডিয়েটস পেছন ফিরে তাকালেন। শূন্য হাতে দাঁড়িয়ে থাকা একজন সুদর্শন পুরুষকে দেখতে পেলেন। যার এমারেল্ড সবুজ চোখজোড়া দৃষ্টিগোচর হতেই ভয়াবহ চমকে গেলেন। ক্রিসক্রিংগল এদুয়ার্দোর দিকে তীরের নিশানা ঠিক করে নিলেন। ডিয়েটস তাকে বাঁধা দিয়ে বললেন,

– থামো। ভুল করেও তীর ছুঁড়বে না।

ক্রিসক্রিংগল বিস্মিত হলেন। তীর-ধনুক নামিয়ে নিলেন। সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে তার বাবার দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে রইলেন। ডিয়েটস কৌতুহলী কন্ঠে জানতে চাইলেন,

– কে তুমি? নাম কি তোমার?

– সমগ্র ভ্যাম্পায়ার জাতির ওভারলর্ড। ক্লিভল্যান্ড এদুয়ার্দো স্যাভেরিন।

এদুয়ার্দোর কন্ঠে প্রচন্ড ক্রোধ আর আত্ম অহমিকা প্রকাশ পায়। ডিয়েটস পুনরায় চমকান। বিস্ময়ে তার বোধশক্তি লোপ পায়। তিনি অবিশ্বাস্য কন্ঠে জিজ্ঞেস করেন,

– তুমি কি সেই এদুয়ার্দো, যাকে আমি খুব ছোট বেলায় দেখেছিলাম?

ডিয়েটের কথা কিছুই বুঝল না এদুয়ার্দো। অথচ ক্রোধিত কন্ঠে বলল,

– আমি সেই এদুয়ার্দো। যার বাবা ডেভিড যোসেফ স্যাভেরিন’কে তুমি নিজ হাতে হ’ত্যা করেছিলে। আমি এখানে এসেছি আমার মায়ের আদেশে। তোমাকে তুলে নিয়ে যাবো স্যাভেরিন ক্যাসলে আমার মা পিদর্কা স্যাভেরিনের কাছে।

কথাগুলো শুনে ডিয়েটসের পাশাপাশি এবার ক্রিসক্রিংগলও চমকালেন। তিনি মনে মনে ভাবলেন,

– ছেলেটা নিজেই নিজের সম্পর্কে কিছু জানে না। কিন্তু ওকে এসব ভুল বুঝিয়েছে কে? পিদর্কা স্যাভেরিনই বা বাবাকে ওর সাথে নিয়ে যেতে বলবেন কি করে?

– তোমার মা পিদর্কা স্যাভোরিন। কিন্তু যোসেফ স্যাভেরিন তোমার বাবা হয় কি করে?_____ডিয়েটস অকপটে জিজ্ঞেস করেন।

এদুয়ার্দোর ভ্রু কুঞ্চিত হলো। সে থমথমে পায়ে হেঁটে গিয়ে ডিয়েটসের সামনে দাঁড়াল। শান্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

– নাতনির শোকে মাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি?

এদুয়ার্দো উচ্চশব্দে হাসল। ডিয়েটস সম্বিত ফিরে পেল। এতক্ষণ সিয়ার কথা যেন বেমালুন ভুলে গিয়েছিলেন। শঙ্কিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,

– সিয়া কোথায়?

– ও আছে। তুমি আমার সাথে ক্যাসলে যেতে রাজি হলেই ও অক্ষত অবস্থায় বাড়ি ফিরে যাবে।

– সিয়া কোথায়?_______ক্রুদ্ধ কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন ক্রিসক্রিংগল।

এদুয়ার্দো ক্রিসক্রিংগলকে পাত্তা দিলো না। ট্রেঞ্চকোটের পকেট থেকে একটা ছোট আকারের শিশি বের করে আনল। ডিয়েটসের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

– এটা পান করো।

– সিয়া কোথায়?_____ডিয়েটসের রাগান্বিত কন্ঠস্বর।

– প্রথমে ওর দেহের সমস্ত রক্ত শুষে খেয়েছি। তারপর পাহাড় থেকে নিচে ফেলে দিয়েছি।

ডিয়েটসের চারদিকে গোলগোল ঘুরে কথাটা বলল এদুয়ার্দো। ডিয়েটস প্রচন্ড রেগে গেলেন। উচ্চস্বরে মন্ত্র পাঠ করতে শুরু করলেন। ক্রিসক্রিংগল নিজের একহাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিলেন। এদুয়ার্দোর বুক বরাবর সজোরে আঘাত করলেন। এদুয়ার্দো ছিটকে অনেকটা দূরে গিয়ে পড়ল। যেন তার সম্পূর্ণ শরীরে আগুন ধরে গেল।

শিশিটা ডিয়েটসের পায়ের কাছে গড়াগড়ি খেল। এদুয়ার্দো উঠে দাঁড়াল। দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই পুনরায় অদৃশ্য কিছুর সাথে ধাক্কা খেয়ে পাহাড় থেকে নিচে পড়ে গেল। সাথে সাথে নিজেকে সামলে নিল। হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে দু’হাতে কান চেপে ধরল। বজ্রধ্বনি তুলে বলল,

– তোমার এই মন্ত্র পাঠ বন্ধ করো। এই ব্যারিয়ার ভেঙ্গে দাও। নতুবা নিজের নাতনির মৃ’তদেহটাও খুঁজে পাবে না।

ডিয়েটস সেদিকে কর্নপাত করলেন না। চোখ বন্ধ করে আরো জোরে জোরে মন্ত্র পাঠ করতে শুরু করলেন। ক্রিসক্রিংগল ধনুকে তীর বসিয়ে অনবরত তীর ছুঁড়তে লাগলেন। পবিত্র মন্ত্রের শক্তি আর লোহার তীরের প্রভাবে এদুয়ার্দো টিকে থাকতে পারল না। আচমকা অদৃশ্য হয়ে গেল। ক্রিসক্রিংগল চারদিকে সতর্ক দৃষ্টিতে তাকালেন। কিন্তু এদুয়ার্দো’কে কোথাও দেখতে পেলেন না।

– বাবা! সিয়ার সত্যিই কিছু হয়ে যায়নি তো?___কম্পিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন ক্রিসক্রিংগল।

– সিয়া এতো সহজে ম’রে যেতে পারে না।___আত্মবিশ্বাসের সাথে কথাটা বলে উঠলেন ডিয়েটস।

কয়েক মিনিটের ব্যবধানে সিয়াকে সাথে নিয়ে এদুয়ার্দো পুনরায় বনিফেসিও পাহাড়ের চূড়ায় উঠে এলো। অদৃশ্য ব্যারিয়ার থেকে দূরে অনেকটা উঁচুতে হাওয়াই ভাসতে শুরু করল। নিজের বাবা আর দাদুকে দেখে সিয়ার চোখ দু’টো থেকে আনন্দের অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। এদুয়ার্দোর কবল থেকে নিজেকে ছাড়াতে মোচড়ামুচড়ি শুরু করল। উচ্ছ্বসিত কন্ঠে চিৎকার দিয়ে ডাকল,

– বাবা!

– দাদু!

ক্রিসক্রিংগল চিৎকার দিয়ে উঠে বললেন,

– সিয়া, নড়ো না। পড়ে যাবে।

বাবার কথা শুনে সিয়া কেমন শান্ত হয়ে গেল। ক্রিসক্রিংগল এদুয়ার্দোকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

– জা’নো’য়ার। আমার মেয়ের যেন বিন্দুমাত্র ক্ষতি না হয়।

ক্রিসক্রিংগলের মুখে জা’নো’য়ার শব্দটা শুনে এদুয়ার্দো ক্রুদ্ধ হলো। তার ভিতরে ভয়াল হিংস্র পি’শাচ সত্তা জেগে উঠল। চোখ দু’টো রক্তলাল বর্ণ ধারণ করল। সিয়ার ঘাড়ের কাছে নিজের ক্ষুরের ন্যায় ধারালো শ্বদন্ত বসিয়ে দিল। কামড়ে ধরে রক্ত চুষে নিলো। সিয়া করুন কন্ঠে তীব্র আর্তনাদ করতে শুরু করলো।

– থামো। তুমি যা বলবে আমি তাই শুনবো।____উচ্চস্বরে অসহায় কন্ঠে কথাটা বললেন ডিয়েটস।

এদুয়ার্দো রক্ত পান করা থামিয়ে দিল। সিয়ার ঘুম পেল। ভীষণ ঘুম পেল। ও গভীর নিদ্রায় তলিয়ে গেল। ডিয়েটসকে উদ্দেশ্য করে এদুয়ার্দো বলল,

– তোমার এই ব্যারিয়ার ভেঙ্গে দিয়ে শিশির তরলটুকু পান করো।

ডিয়েটস পায়ের কাছ থেকে শিশিটা তুলে নিলেন। ক্রিসক্রিংগল তাকে বাঁধা দিলেন। অনুরোধের স্বরে বললেন,

– দয়া করে আপনি এটা পান করবেন না বাবা।

ডিয়েটস সময় নিলেন। ক্রিসক্রিংগল’কে কিছু কথা বললেন। অতঃপর শিশির তরলটুকু পান করে এদুয়ার্দোকে বললেন,

– এই ব্যারিয়ার’টা শুধুমাত্র মায়া। তোমার প্রশস্ত ডানা দিয়ে তিনবার আঘাত করো। ব্যারিয়ারটা ভেঙ্গে যাবে।

কথাটুকু বলতে না বলতেই ডিয়েটস শরীর ছেড়ে দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। ক্রিসক্রিংগল ভীতস্বরে ডাকলেন,

– বাবা!

ডিয়েটস প্রত্যুত্তর দিলেন না। ক্রিসক্রিংগল দিশেহারা হয়ে পড়লেন। একদিকে মেয়ে অন্যদিকে বৃদ্ধ বাবা। তিনি কাকে বাঁচাবেন?

ঘুমন্ত সিয়াকে সাথে নিয়ে এদুয়ার্দো তার প্রশস্ত ডানা দিয়ে তিনবার আঘাত করল অদৃশ্য ব্যারিয়ারে। ব্যারিয়ারটা ভেঙ্গে গেল। এদুয়ার্দো সিয়াকে নিয়ে মাটিতে নেমে এলো। ডিয়েটসের থেকে অনেকটা দূরে ওকে শুইয়ে দিলো। ক্রিসক্রিংগল মেয়ের কাছে ছুটে গেলেন। এই সুযোগে এদুয়ার্দো ডিয়েটসের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। শক্ত দু’হাতে তুলে নিলো অচেতন ডিয়েটসকে। অতঃপর বাতাসে অদৃশ্য হয়ে গেল সে। ক্রিসক্রিংগল সিয়াকে জাপ্টে ধরে কাঁদলেন। পিছন ফিরে দেখলেন। কিন্তু রক্তচোষা পিশাচটা নেই, সাথে নেই তার বাবা ডিয়েটস।

ক্রিসক্রিংগল আকুল হয়ে একজন অসামর্থ্য পুত্রের ন্যায় চিৎকার দিয়ে কাঁদলেন। সিয়ার নিঃশ্বাস পড়ছে। মেয়েটা বেঁচে আছে। কিন্তু হারিয়ে গেছে তার বাবা। কে জানে কি আছে বৃদ্ধ জাদুকর উইজার্ড ডিয়েটসের ভাগ্যে। পুনরায় কি দেখা হবে কোনোদিনও নিজের পরিবারের সাথে?

_______★★_______

ধীরে ধীরে পূর্ব আকাশে সূর্য উদিত হয়। জানালার ফাঁক গলিয়ে মিষ্টি রোদের আলো অবাধে কামরায় প্রবেশ করে। বিছানায় শুয়ে ছিলো ইনায়া। ওর মাথার কাছে বসে থেকে গুনগুনিয়ে কেঁদে যাচ্ছেন ইলহামা অ্যালিয়েভ। কাঁদতে কাঁদতে চোখের জল শুকিয়ে গেছে প্রৌঢ়ার। বৃদ্ধা উরসুলা ভনডারলেন বারান্দায় বসে অস্থির চিত্তে অপেক্ষা করছেন স্বামী, সন্তান আর নাতনির ফিরে আসার। তার অসহায় চোখ দু’টো চাতকের ন্যায় এদিক সেদিক দেখে। অথচ বারবার নিরাশ হয়। তিনি পুনরায় প্রবল আকাঙ্ক্ষায় অপেক্ষা করতে থাকেন। এই বুঝি সবাই ফিরে এলো এবার।

মোলায়েম রোদের আলো মুখকান্তিতে বিকীর্ণ হতেই চোখ মেলে তাকাল ইনায়া। ক্ষীণ দৃষ্টিতে আশে পাশে নজর বুলাল। কোথায় আছে বুঝে নিতে কিছুটা সময় লাগল। নিজের কামরায় বিছানার উপর শুয়ে আছে বুঝতে পেরে উঠে বসার চেষ্টা করল। কিন্তু ঘাড়ের কাছে প্রচন্ড ব্যথা অনুভব হলো। ইনায়া মৃদু আর্তনাদ করে উঠল। ইলহামা অ্যালিয়েভ ব্যতিব্যস্ত স্বরে ডাকলেন,

– ইনায়া।

মায়ের কন্ঠস্বর শুনে মাথার কাছে দৃষ্টি দিতেই কান্নারত ইলহামাকে দেখতে পেল। ইনায়া চমকাল। উদ্বিগ্ন কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

– কি হয়ছে মা? আপনি এভাবে কাঁদছেন কেনো? আমি এখানে কি করে এলাম? সিয়া কোথায়? সন্ধ্যা থেকে সকাল কিভাবে হলো?

ইনায়া একের পর এক প্রশ্ন করতে লাগল। ইলহামা শব্দ করে কাঁদতে শুরু করলেন। কান্নারত কন্ঠে থেমে থেমে বললেন,

– সিয়া নেই। কোনো এক র’ক্তচোষা পি’শাচ ধরে নিয়ে গেছে সিয়াকে। তোমার বাবা আর দাদু বনিফেসিও পাহাড়ে খুঁজতে গেছে ওকে। তারা এখনো বাড়ি ফিরে আসেনি। তোমাকে রাতের অন্ধকারে আর্নির বাবা-মা রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে এসেছিলেন। এখন একমাত্র তুমিই বলতে পারবে প্রকৃতপক্ষে তোমার সাথে কি ঘটেছিলো।

ইনায়া বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। সবকিছুই কেমন অবিশ্বাস্য মনে হলো। মনে করার চেষ্টা করল, ওর সাথে এমন কি ঘটেছিলো। মস্তিষ্কে জোর খাটাতেই ধীরে ধীরে সবকিছুই মনে পড়ে গেলো ওর। ইনায়া বলতে শুরু করল,

– আমি আর্নিদের বাড়ির দিকে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ মনে হল আমার পাশ দিয়ে বাতাসের বেগে কেউ ছুটে গেল। গলায় হাত দিয়ে দেখি ক্রুশ লকেটের হারটা নেই। ওটা গোসল করার সময় খুলে রেখেছিলাম। ভুলবশত হারটা পুনরায় গলায় পরা হয়নি। কিন্তু কিছু একটা অশুভ হতে পারে বুঝতে পেরে, আমি ভয় পেয়ে দৌড়াতে শুরু করি। তারপর কারো সাথে ধাক্কা খেয়ে রাস্তায় উল্টে পড়ি। দ্রুত উঠে দাঁড়াই। সামনের দিকে তাকাতেই আমি থমকে যাই। দৃষ্টির সম্মুখে দাঁড়ানো ছিলো সুঠাম দেহের একজন সুদর্শন যুবক। মাথভর্তি সোনালী চুল আর হালকা নীলাভ চোখ। লাল টুকটুকে ঠোঁটে লেগে ছিলো নিদারুণ হাসি। সে ঈষৎ ঘাড় কাত করে নিষ্পলক চোখে আমার দিকেই তাকিয়ে ছিলো।

এতটুকু বলে ইনায়া থামল। একনাগাড়ে কথা বলায় ঘাড়ে তীব্র ব্যথা অনুভব করল। আহ সূচক শব্দ করে ঘাড় চেপে ধরল।

– তারপর?_____কৌতুহলী কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন ইলহামা অ্যালিয়েভ।

– তারপর আমার আর কিছুই মনে নেই মা। কিন্তু আমার ঘাড়ের এই ক্ষতটা পুনরায় তাজা কি করে হলো?

– তুমি যাকে চোখের সামনে দেখেছিলে, নিঃসন্দেহে বলা যায় সে কোনো মানুষ ছিলো না। র’ক্তচোষা পি’শাচ ছিলো। শ’য়তান’টা তোমাকে সম্মোহিত করে তোমার শরীর থেকে রক্ত পান করেছিলো। এবার বুঝতে পারছো কেনো তোমার এই ক্ষতটা পুনরায় তাজা হলো?

– তাহলে পি’শাচটা আমাকে একেবারে মে’রে ফেললো না কেনো?____ইনায়ার বিস্মিত কন্ঠস্বর।

ইলহামা অ্যালিয়েভ দৃঢ় কন্ঠে বললেন,

– হয়তো তোমাকে মে’রে ফেলার আগেই আর্নির মা-বাবা চলে এসেছিলো। ঈশ্বর তোমার সহায় ছিলো। তাই প্রাণে বেঁচে গেছো। প্রার্থনা করো, আমার সিয়াও যেনো ওর দাদু আর বাবার সাথে সুস্থ অবস্থায় বাড়িতে ফিরে আসে।

ইনায়ার দুশ্চিন্তায় মাথা যন্ত্রণা শুরু হয়। দুরুদুরু করে বুক কাঁপতে শুরু করে। বনিফেসিও পাহাড়ে ওর ছোট বোন একটা র’ক্তচোষা পি’শাচের হাতে বন্দি। তাহলে ও এভাবে বাড়িতে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকবে কি করে?

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।