ইকবাল দুঃসহ ভঙিতে ছটফট করছে। প্লেটে হাত চলেনা,গলা দিয়ে খাবার নামেনা। তার বেসামাল,বেগতিক অবস্থা। অথচ,বাকী সবাই হৈহৈ করে খাচ্ছে। আলাপ-আলোচনায় জমে গিয়েছে পার্টি অফিস। ছয়টা লম্বা টেবিল পেতে দুই দিকে চেয়ার বসানো। এক এক টেবিলে দশ জন করে বসেছে। ধূসর,ইকবাল,খলিল সবাই একই টেবিলে। ইকবালের অস্থির অবস্থা আড়চোখে, তীক্ষ্ণ ভাবে দেখছে ধূসর। শেষে জিজ্ঞেস করল,
‘ খাচ্ছিস না কেন?’
ইকবাল নড়ে উঠল একটু,
‘ হু? কই খাচ্ছিতো।’
সোহেল বলল,
‘ খাবারটা মজা না? একদম অনেকগুলো দোকান বেছে বেছে বিরিয়ানীটা আনালাম।’
খলিল বললেন,
‘ হ্যাঁ, আমারতো ভালোই লাগছে। তেল চিপচিপে কম। ‘
ইকবাল একটু হাসল। তবে কিছু বলল না। কথা বলতে ভালো লাগছে না তার। গলার মধ্যে কী যেন ঘুরছে। প্রাণটা কা*তরাচ্ছে কৈ মাছের মতোন। তার চিন্তার মধ্যে খলিলের ধ্বনি শোনা গেল,
‘ নির্বাচনের দিন তোমরা সবাই একটু এলার্ট থেকো ইকবাল। বিরোধীদল কিন্তু হাত গুঁটিয়ে বসে থাকবে না। মনে নেই, গতবার কী কেলে*ঙ্কারি হয়েছিল?’
‘ জি।’
‘ মুখে জি বললে হবেনা। তুমি গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়ানোটা কমাও এখন৷ আমার পর এখানে নেতা তুমি,পার্টি অফিসের দায়িত্ব তোমার। অথচ সব দ্বায়ভার ধূসরের কাঁধে দিয়ে নেঁচে-কুদে বেড়াচ্ছ৷ রাজনীতিতে দায়িজ্ঞান হচ্ছে আসল। এত ইরেসপন্সেবল হলে হয়না। ‘

একেতো মন ভালো নেই। তার ওপর খলিলের কথা গুলোয় ইকবালের মুখের অবস্থা করূন হলো। বিষাদে ঢেকে গেল অন্তঃস্থল । ঠোঁটের চারপাশের হাসি টুকু বিলীন। দলের এত ছোট ছোট সদস্যদের সম্মুখে এভাবে না বললেই কী হতোনা?
সে মুখের ওপর যথাযথ জবাব দিতে গিয়েও পিছিয়ে যায়। আগামীতে খলিল মেয়র নির্বাচিত হবেন। দলের সিনিয়র সদস্য সে। তাকে অপমান করে কিছু বলা ঠিক হবেনা। যদি সেও একই কাজ করে,দুজনের তফাৎ রইল কই?
অথচ এই ভদ্রতার ধার, ধারল না ধূসর। সে মুখের ওপর বলে বসল,
‘ পার্টি অফিস তো চলছে খলিল ভাই। কোনও রকম অসুবিধে হচ্ছেনা। আপনার দল ঠিক থাকলেই হলো,সেটা আমি চালাই বা ইকবাল। ‘

খলিল হাসার চেষ্টা করে বললেন,
‘ তোমার বেশি প্রেশার পরছে বলেই বললাম ধূসর। যার যা দায়িত্ব…. ‘
‘ আমার প্রেশার পরছে আমি বলিনি। আপনিই অহেতুক বাড়িয়ে ভাবছেন। ইকবাল দরকারের সময়ে থাকলেই হচ্ছে। এছাড়া ও গায়ে বাতাস লাগাক বা না লাগাক আমাদের কারোরই দেখার বিষয় নয়। ‘

শীতল যুক্তি আর অপ*মানের তোড়ে খলিলের মুখমন্ডল থমথমে হয়ে আসে। তবু তর্কে গেল না। চোখ নামিয়ে একমনে হাত চালালেন ভাতের থালায়।
ধূসর আর ইকবালের মাখো-মাখো সম্পর্ক একদম পছন্দ না তার। সে ভবিষ্যৎ মেয়র,দুজন হবে তার পা চাঁটা কর্মী। অথচ এই ছেলে তাকে গায়ে লাগায়না। আর ওর স্পর্ধা দেখে ইকবালটাও একইরকম হচ্ছে। তার রে*গেমেগে উঠে যেতে মন চায়৷ পরক্ষনে রাজনৈতিক কৌশলে নিজেকে শান্ত করে।

ইকবাল আপ্লুত চোখে বন্ধুর দিক চেয়ে থাকল। সেই চোখ জ্ব*লে উঠল পরপর৷ কোটর ছড়িয়ে পল্লব ছুঁলো। বদনের ঘাম মোছার ভাণ করে মাথা নীচু করে শার্টের হাতা দিয়ে মুছে নিলো জল। অপ*রাধবোধে হৃদয়পট ছেঁয়ে যাচ্ছে। এই বন্ধুর সাথে দুই বছর ধরে দূর্ভাবনীয় বেঈ*মানী করছে সে, ভাবতেই নিজেকে নীচ আর হেয় লাগছে ভীষণ৷

তাদের উৎসব শেষ হতে বিলম্ব হয়। দুপুর থেকে বিকেল,সন্ধ্যা গড়ায়। খাওয়া দাওয়ার পাঠ চুকিয়ে দীর্ঘ আলোচনায় মগ্ন হলো সবাই। ইকবালের এক মুহুর্ত মন টিকছে না এখানে। তার অবস্থা গলাকা*টা মুরগীর ন্যায়।
একটাবার যদি পুষ্পর সাথে দেখা করার সুযোগ পেত। ফোন করবে একবার?
ভাবনা মতো সে উঠে দাঁড়াল। সবার চোখ তার দিকে ঘুরলে জবাব দিলো ‘ ওয়াশরুমে যাচ্ছি।’

ওয়াশরুমের সামনে এসেই তড়িঘড়ি করে ডায়াল করল পুষ্পর নম্বর। রিং হয়ে হয়ে বেজে গেল,ধরল না কেউ। ইকবালের অস্থিরতা তরতর করে ডগার ন্যায় বেড়ে যায়। বাম হাতে চুল খাম-চে খাম-চে টানল। পুষ্প ফোন ধরছে না কেন? সে কী আর তাকে চাইছেনা?

***
সাদিফ বাইক চালিয়ে সোজা এসে অফিসের সামনে নামল। স্ট্যান্ডে দাঁড় করিয়ে নিজেও দাঁড়াল। হেলমেট খুলে হ্যান্ডেলে ঝুলিয়ে আড়া-আড়িভাবে কাঁধে ফেলা কালো ব্যাগ ঠিকঠাক করে হেঁটে গেল ভেতরে। ভিউ মিরর দেখে, প্রতিদিন চুল সেট আপ করার বিষয়টা আজ আর মাথাতে এলোনা। সেখানে ভর্তি বেদনা,আর যাতনা তাকে ভুলিয়ে দিলো নিজের যত্ন। প্রতিটি কদমে তার দীর্ঘশ্বাস ভারী হয়। প্রতিটি পল্লব ফেলার সময় মনে পড়ে পিউকে। চোখে ভাসে তার মায়াময়,স্নিগ্ধ আঁদল। কেন যে অতটুকু মেয়ের প্রতি মন হারাতে গেল? নাহলে এই মানসিক টানাপো*ড়েনে পরতে হতোনা। এইভাবে দ্বিধাদন্দের চাপে নিঃ*শেষ হতে হতোনা।
তার মানসিক বিধ্ব*স্ততা হাজারে গড়িয়েছে গতকাল থেকে। পুষ্পর সম্পর্কে সব জেনে-শুনেও ওকে বিয়ে করতে হবে ভাবলেই হৃদয়সিন্ধুতে তমসা নামে। একটাবার যদি কিছু করতে পারত? বিয়েটা যদি আটকানো যেত!
সে থমকে দাঁড়ায় হঠাৎ। মনকে শ*ক্ত করে ভাবে,বাড়ি ফিরে মায়ের কাছে সবটা খুলে বলবে। জানাবে সে পুষ্পকে নয়,পিউকে চায়। উল্টোদিকের পুষ্পও তাকে চাইছেনা। তার মনে ইকবাল। পরক্ষনে দুদিকে মাথা নাড়ল। কথাগুলো বলার সময় মায়ের ব্য*থিত মুখ মনে করে পিছিয়ে গেল। না, এ জগতে তার দ্বারা মানুষকে উপেক্ষা করা কঠিন,দূর্বার।

‘ আরে আপনি এখানে?’
হঠাৎ মেয়েলী স্বরে সম্বিৎ পেলো সাদিফ। চকিতে ঘুরে তাকাল। সম্মুখের পরিচিত তবে অনাকাঙ্ক্ষিত মুখটি দেখে বিস্ময়ে চেয়ে রইল কিয়ৎক্ষণ। এই মেয়ে এখানে কেন?
মারিয়া এগিয়ে এসে সামনে দাঁড়ায়। তার হাতে জল ভর্তি প্লাস্টিকের বোতল। বলল
‘ আপনি এই অফিসে কেন?
প্রশ্নটা করেই তার চোখ গেল সাদিফের বেশভূষায়। ফরমাল গেট-আপ দেখে ঠোঁট কামড়ে, অনুমান করে বলল,
‘ আপনিও কি এখানে কাজ করেন?’
সাদিফ অতি দ্রুত বিস্ময়ের হাবভাব সামলে ওঠে। চোখের চশমা ঠেলে গলা খাকাড়ি দেয়। গম্ভীর কণ্ঠে শুধায়,
‘ আপনি কে? ‘
মারিয়া আকাশ থেকে পরল।
‘ আপনি আমাকে চিনতে পারছেন না? ‘
তার চোখ ছোট হয়ে এলো,
‘ চেনার মতো কোনও কারণ আছে? আপনাকে কখনও দেখেছি বলে মনে পড়ছেনা।’
মারিয়া ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে বলল,
‘ কী আশ্চর্য! আপনার কি স্মৃতিশক্তি গেল না কী?’
আমি মারিয়া। আপনি ডাকেন ম্যালেরিয়া। মনে নেই?’

সাদিফ মুখের ওপর বলল ‘ না নেই। প্রয়োজন ছাড়া মনে রাখিনা কাউকে। ‘
মারিয়ার বুঝতে বাকী নেই, এই ব্যাটা ইচ্ছে করে এমন করছে। নাটক করছে তাকে না চেনার। সে কট*মট করে বলল,
‘ অফিসে কী করছেন,যাত্রাপালায় নাম লেখালেই পারেন। ‘
‘ এক্সকিউজ মি! দ্যাটস নান অফ ইয়র বিজনেস। আপনার সাথে কথা বলে সময় ন*ষ্ট করার ইচ্ছে নেই আমার। যেখানে দেখি ঝগ*ড়া করতে লাফিয়ে পরে। ঝগ*ড়ুটে মেয়ে কোথাকার! ‘

মারিয়া পুরোটা শুনল। চেঁতে -টেতে একাকার হওয়ার কথা ছিল। অথচ আঙুল তুলে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলল,
‘ এইত চিনতে পেরেছেন। তার মানে সত্যিই নাটক করছিলেন আপনি। ‘

সাদিফ থতমত খেয়ে চোখের চশমা ঠেলল আবার। বলল,’ হোয়্যাটেভার! চিনেছি। তো?’

‘ তো মানে কী? ঢং করছিলেন কেন?’
সাদিফ জবাব না দিয়ে, পালটা প্রশ্ন ছুড়ল,
‘ আপনি এই অফিসে কী করছেন? আমাকে ফলো করে এসেছেন নিশ্চয়ই? ‘
মারিয়া অবাক হলো,
ব্যঙ্গ করে বলল,’ কী আমার সালমান খান এলেন,ওনাকে ফলো করে আসতে হবে। আমি এই অফিসে চাকরী পেয়েছি। আজ থেকেই আমার জয়েনিং।’

কথাগুলো বলতে পেরে তার বুক গর্বে ফুলে উঠল। বিশাল দপ্তরে সে কাজ করে ভাবতেই রোমাঞ্চিত অনুভব হয়। হোক সামান্য কর্মচারী,তাতে কী? তাও হওয়া ভাগ্যের।
সাদিফ মুখ কুঁচকে ভাবল,
‘ একে কে চাকরি দিলো? মাথার চেয়ে মুখ চলে বেশি।’
মুখে বলল,
‘ ও। ‘
চলে যেতে ধরলে মারিয়া জিজ্ঞেস করল,
‘ আপনি কোন পোস্টে আছেন?’
সাদিফের কাঠ উত্তর,
‘ সেটা আপনাকে কেন বলব? ‘
‘ না বলার কী আছে?’
‘ আমি অকারণে কোনও কথা বলিনা। এত ইন্টারেস্ট থাকলে নিজে জেনে নিন।’
মারিয়া মুখ বেকিয়ে বলল,’ আমার বয়েই গেছে। ‘

থামল। আবার বলল,
‘আপনি কি পিওন এখানে? আপনার জন্য এই পোস্টটা ঠিকঠাক। চা-পানি এগিয়ে দিতে অনেক ছোটাছুটি করতে হয়, সেজন্য গায়ে শক্তি লাগে। আপনার গায়ে তো অনেক শক্তি, গ্রামে বর্ষাকে তুলছিলেন শুনলাম । ‘
বলে,ঠোঁট চে*পে মিটিমিটি হাসল সে।
সাদিফের মুখ কুঞ্চন আরো গাঢ় হলো। কটম*টিয়ে উঠে আবার শান্ত হয়ে বলল,
‘ দেখুন, আজ আমার মনটা খা*রাপ। আপনার সাথে ফালতু তর্কে যাওয়ার ইচ্ছে নেই। নিজের কাজে যান তো।’

মারিয়ার কিছু যায় এলোনা। কাঁধ উচিয়ে বলল,
‘ খা*রাপ মন,খা*রাপই তো থাকবে। ‘
সাদিফ তেঁতে কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেল। অফিসের চারপাশে চোখ বুলিয়ে আস্তে করে বলল,
‘ আপনি আসলে একটা যা তা মেয়ে। কোনও দিন শুধরাবেন না হয়ত।’
মারিয়াও একইরকম কণ্ঠ করে বলল,
‘ কিছু কিছু মানুষের জন্য আমার স্বভাব অপরিবর্তিত। আপনি হলেন তার মধ্যে একজন।’
‘ আপনি ইচ্ছে করে ঝগ*ড়া করতে চাইছেন তাইনা? ভদ্রতার সুযোগ নিচ্ছেন। ‘
পরক্ষনে সন্দিহান গলায় বলল,
‘না কী আমার মতো সুদর্শন ছেলের সাথে কথা বলার লোভ সামলাতে পারছেন না?’

শেষ কথায় মারিয়া হা করে ফেলল। পরমুহূর্তে খ্যাক করে বলল,
‘ আপনি সুদর্শন? এই মিথ্যেটা কে বলেছে আপনাকে?’
সাদিফ ভ্যাবাচেকা খেয়ে বলল ‘ মানে?’
‘ মানে,আপনাকে যে গোবর গনেশের মত দেখতে কেউ বলেনি?’
‘ আমাকে গোবর গনেশের মত দেখতে?’
গোবরের চিত্র চোখে ভাসতেই তার গা গুলিয়ে এলো। মারিয়া স্পষ্ট বলল,
‘ আমার মনে হয় আপনি দুঃখ পাবেন বলে কেউ বলেনি। সমস্যা নেই,বড় হয়েছেন, এখন সব বুঝবেন। আমি আপনাকে প্রথম বার সত্যিটা বলছি শুনুন, আপনাকে দেখতে কিছুটা বিদেশী মুরগীর মতোও। যাকে আমরা বলি ফার্মের মুরগী। আপনার গায়ের রঙ ঠিক ওইরকমই। ক্যাটক্যাটে সাদা। দেখলে মনে হয় ফ্লোরে চুন ঢেলে দিয়েছে কেউ। আপনার সাথে ফার্মের মুরগীর তফাত হলো, ও এক পা হেঁটে দু পা ঝিমায় আর আপনি একটার জায়গায় দশটা কথা বলেন। ‘

সাদিফ হতবাক হয়ে চেয়ে রইল। এক্ষুনি এই মেয়ের গলাটা টি*পে দিতে পারত যদি! কিংবা এক থা*প্পড়ে রুটি বানিয়ে ফেলতে পারলে শান্তি পেতো।
একে মাথা ঠিক নেই,দুইয়ে অফিস। এখানে তার রেপুটেশন আলাদা বলে চুপচাপ হজম করল সবটা। উল্টোপথে গটগটিয়ে হেঁটে গেল। নির্ভেজাল উপেক্ষা দেখে মারিয়া বিভ্রান্ত হয়ে বলল,
‘ কিছু বলল না কেন?’
সে ঘাড় চুল্কে এসে নিজের জায়গায় বসল। পানির বোতল টেবিলে রেখে
আশেপাশের সব জায়গায় চোখ বোলাল। বোকার রাজ্যে বসবাস করা নারী ভেবেই নিয়েছে, সাদিফ এই ডেস্কের কোথাও থাকবে। সেই মোতাবেক খুঁজে খুঁজে ক্ষান্ত হলো। না পেয়ে তার জিজ্ঞাসু লিপ্সা হুরহুর করে বাড়ে।
মিহি কণ্ঠে ‘ ভাইয়া শুনুন ‘বলে পাশের ডেস্কের ছেলেটিকে ডাকল। অফিসে এসে এর সাথে আলাপ হয়েছে তার।
ছেলেটি তাকালে শুধাল,
‘ সাদিফ নামে কাউকে চেনেন? ‘
‘ যার সাথে এতক্ষণ কথা বলছিলেন, ওনার নামই সাদিফ।’
মারিয়া খুশি হয়ে গেল। এর মানে ছেলেটি চেনে। সে আগ্রহভরে শুধাল,
‘ উনি এখানে কোন পোস্টে? ‘
‘ ম্যানেজার।’

‘ম্যানেজার’ শুনেই মারিয়ার চোখ তালুতে ওঠে। খুশির দফারফা, মুখটা চুপসে গেল ওমনি। সেতো এখানে সামান্য একটা পোস্টে চাকরী পেয়েছে। মাসে মাত্র চৌদ্দ হাজার টাকা বেতন। সাদিফ ম্যানেজার? এই লোকটা তো তাকে দেখতেই পারেনা। এখন কী এর আন্ডারেই থাকতে হবে?
হায় হায়!
সে মনে মনে আক্ষেপে শেষ। ঘুরেফিরে এখানেই চাকরী জুটল!
দুদিকে ত্রস্ত মাথা নেড়ে বলল ‘ আর ঝগ*ড়া করা যাবেনা।’

***
তখন রাত। ভীষণ অন্ধকারে ঢাকা মেঘশূন্য আকাশ। ঘড়িতে নয়টার বেশি বাজে। ইকবাল চোরের মত লুকিয়ে আছে একটা বড় গাছের আড়ালে। রু*দ্ধ শহরে তার শ্বাসও রু*দ্ধকর। সামনে সিকদার বাড়ির বিশাল লোহার গেট। বাড়ির চারপাশ আলোতে ডু*বছে। একবার ভেবেছিল সবাই ঘুমালে আসবে। গভীর রাতে। কিন্তু মনের দ্বিগবিদিক কাতরানোর কাছে হার মেনে আগেই হাজির হলো। ধূসর বাড়িতে নেই সে কনফার্ম। কারণ ওর আগে আগে সে ছুঁতো দিয়ে পার্টি অফিস থেকে ছুটে এসেছে এখানে। ফেরার পূর্বেই তার কাজ হয়ে যাবে নিশ্চয়ই।
গেটের ধারে টুলে বসে ঘুমে ঢলছেন দারোয়ান। একটু পরপর চটক কে*টে ঠিকঠাক হচ্ছেন। তার ডিউটি এগারটা অবধি। এরপর আরেকজন। এইজন্যে এখনই ঘুম পাচ্ছে ভীষণ। আবার ঢলে পরছেন দেখে ইকবাল বিড়বিড় করে বলল
‘ হয় ঘুমান,নাহলে ভাগুন। দুইয়ের মধ্যে ঝুলে থাকা ভালো না।’

দারোয়ানের কানে কথাগুলো গেলোনা। হাঁটুর ওপর লাঠির ভর রেখে সে তখনও ঘুমে টলছে। ইকবাল একবার তুষাতুর চোখে দ্বিতীয় তলার বারান্দার দিক তাকাল। ঘরের আলো জলছে এখান থেকে স্পষ্ট দেখা যায়। এর মানে পুষ্প রুমেই, তাহলে ফোন টা কি কাছে নেই? তুলছেনা কেন? কেনই বা কল ব্যাক করছেনা?
এইভাবে তার হৃদয় নিয়ে খেলার কোনও মানে হয়?।

পুষ্প ফোন হাতে নিয়ে ঠোঁট উলটে বসে রইল।
ভেতর ভেতর তার ছটফটানি কিছু কম হচ্ছেনা। ইকবালের কল রিসিভ করার জন্য আঙুলগুলো নিশপিশ করছে খুব। কিন্তু ধূসর ভাই যে মানা করলেন।
ফোন ধরলেই যদি জ্বিভ ফস্কে কথা বেরিয়ে যায়,ভাইয়া রা*গ করবেন। কিন্তু সরাসরি এড়িয়ে যাওয়াও অসম্ভব । মনটা অস*হ্য রকমের আনচান করছে। কী করবে জানেনা। মনঃদ্বিধা বাড়ছে। কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে করছে। কোন কুক্ষণে সেজো চাচার মাথায় বিয়ের ভূত চাপল কে জানে!

এর মধ্যে টুং করে আওয়াজ হলো ফোনে। মেসেজ এসেছে। স্ক্রিনেই ভেসে উঠল,
‘ বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছি। বারান্দায় না আসা অবধি এখানেই থাকব ইনশাআল্লাহ। ‘
প্রেরক ইকবাল। পুষ্পর বুক ধ্বক করে উঠল ভ*য়ে। প্রকট চোখে বারান্দার দিক তাকাল। পরপর ত্রস্ত, এলোমেলো পায়ে ছুটল সেদিকে।

এক প্রকার বারান্দার রেলিং ধরে ঝুলে পরল সে। হন্যে চোখে গেটের দিক চেয়ে ইকবাল কে খুঁজল। দেখা যাচ্ছেনা। মিথ্যে যে বলেনি সে নিশ্চিত। এই ছেলের দুঃসাহস প্রবল।
তাকে দেখেই পুরূ ঠোঁটে হাসি ফুটল ইকবালের। গাছের সাথে হেলান দেয়া থেকে চট করে সোজা হয়ে দাঁড়াল।

পুষ্প কাঁ*পা কাঁ*পা হাতে ফোন করল। একবার রিং হতেই রিসিভ হয়। সে কিছু বলার আগেই ইকবালের ব্যথিত কণ্ঠে ভেসে এলো,
‘ এতক্ষনে আমায় মনে পড়ল মাই লাভ?’

পুষ্পর হৃদয় নাড়িয়ে দিলো এই ডাক। যা বসুমতীতে তার সবথেকে প্রিয়। মন, হৃদয়, মস্তক সব আবেশিত হয়,জুড়িয়ে যায়। ভেসে বেড়ায় আবেগের স্রোতস্বীনিতে। সে গলতে গিয়েও শ*ক্ত হলো। কপট রা*গ নিয়ে বলল,
‘ কোথায় তুমি?’
বলতে বলতে আশেপাশে মাথা ঘোরাল। নিরবে খুঁজল ইকবালকে। সে একটু এগিয়ে এসে দাঁড়ালে দৃশ্যমান হলো তার চওড়া দেহ। পুষ্প কিছু বলার পূর্বেই তার অশান্ত প্রশ্ন এলো,
‘ সাদিফের সাথে তোমার বিয়ে পুষ্প?’
পুষ্প চমকে গেল একটু। অবাক হয়ে বলল,
‘ তুমি কী করে জানলে?’
‘ এর মানে কথাটা সঠিক!’
ইকবালের আ*হত স্বর। পুষ্প মিনমিন করে জানাল,
‘ কথাবার্তা চলছে।’
সে ফুঁ*সে ওঠে,
” কেন চলবে? কীসের জন্য চলবে? এই পৃথিবীর সবাই জানে তুমি আমার বউ হবে। তাহলে? ‘

‘ বোকা বোকা কথা বোলোনা ইকবাল। তুমি আর আমি ছাড়া আমাদের সম্পর্কের কথা কে জানে?’
‘ আচ্ছা,কেউ জানেনা। তুমিতো জানো পুষ্প,তারপরেও বিয়েতে রাজী কেন হয়েছ?’
‘ তোমাকে কে বলল আমি রাজী? পিউ?’
‘ ধূসর!’
পুষ্পর কপালের ভাঁজ মিলিয়ে গেল। ভাইয়া বললে কারণ ছাড়া বলেননি। ঠোঁট গোল করে বলল,
‘ ও আচ্ছা।’
‘ ও আচ্ছা মানে? তুমি সত্যিই সাদিফকে বিয়ে করতে চাও?’
‘ না চাওয়ার কী আছে,ভাইয়া বললেন সাদিফ ভাই ভালো ছেলে। তাছাড়া বিয়ের পর বাড়ি ছেড়েও যেতে হবেনা।’
বলতে বলতে সে ঠোঁট চে*পে হাসল।
ইকবাল বিস্মিত। কণ্ঠে অবিশ্বাস ঢেলে বলল,
‘ কী! আর আমার ভালোবাসা?’
‘ আমি কী করব? বাড়ির সবাই মিলে ঠিক করল ইকবাল। না বলি কী করে?’
ইকবাল উদ্ভ্রান্তের ন্যায় আওড়াল,
‘ আর ইউ ক্রেজি? কী বলছো নিজে জানো? দুটো বছর ধরে আমরা একে অপরকে ভালোবাসি। এইত কদিন আগেই আমার হাত ছুঁয়ে কথা দিলে সারাজীবন পাশে থাকবে। হঠাৎ বদলে গেলে কেন মাই লাভ?’
শেষ দিকে গলা ধরে এলো তার। পুষ্পর মুখ কালো হয়ে যায়,মায়া হয়। এক্ষুনি জানিয়ে দিতে ইচ্ছে করে সত্যিটা।
ধূসরের নিষেধ মনে করে বলল না।
ইকবাল আবার বলল,
‘ আমি অত শত জানিনা, বউ হলে তুমি আমার হবে পুষ্প। নাহলে…. ‘
‘ নাহলে কী করবে?’
ইকবাল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল ‘ ম*রে যাব।’
পুষ্প আঁত*কে ওঠে। আর্ত*নাদ করে বলে
‘ এসব বলছো কেন?’
‘ তো কী শুনতে চাও? ভালোবাসলে আমাকে,আর পরিবারের কথায় বিয়ে করবে সাদিফকে? দিনশেষে সব মেয়েই এক?’
মুহুর্তমধ্যে পুষ্পর নাকের পাটা ফুলে ওঠে।
‘ কটা মেয়েকে চেনো?’
‘ তোমার মধ্য দিয়ে হাজার মেয়েকে চিনলাম।’
পুষ্প দাঁত পি*ষে বিড়বিড় করল।
‘ উজবুক! ওনার জন্য আমি কেঁদেকে*টে ম*রছি। সারাদিন পর রাতে দুটো দাঁনা পরেছে পেটে। আর সে আমার এক কথায় মেনে নিল আমি অন্য কাউকে বিয়ে করব? এই তার বিশ্বাস!’

‘ কী, চুপ করে আছো কেন?’
‘ কী বলব?’
‘ এখন আমার সাথে কথা বলতেও খুঁজতে হচ্ছে পুষ্প?’
‘না, আসলে সাদিফ ভাই উঁকিঝুঁকি দিচ্ছেন ঘরের ভেতর। কিছু বলবেন হয়ত। শুনে আসব?’

কথাটা ইচ্ছে করে রা*গাতে বলেছে সে। সফল ও হলো। ইকবাল তেলে-বেগুনে জ্ব*লে উঠে বলল,
‘ হা*রাম*জাদা আমার বউয়ের ঘরে উঁকি মা*রবে কেন? কোন সাহসে? ওর উঁকি মা*রা চোখ আমি তুলে নেব।’
পুষ্প গম্ভীর হওয়ার ভাণ করে বলল,
‘ সে আমার হবু বর ইকবাল। তুমি তাকে এভাবে বলতে পারোনা।’
ইকবাল দ্বিগুন নি*হত হয়ে ডাকল ‘ পুষ্প!’
‘ পুষ্প, পুষ্প করোনা তো। এত ভালোবাসলে বাড়িতে এসে বাবার কাছে আমাকে চেয়ে নাও। আমিতো না বলিনি। বলিনি তোমাকে বিয়ে করব না। তাহলে হাত গুটিয়ে বসে আছো কেন? অহেতুক ফোনের বিল না উঠিয়ে কাজের কাজ কিছু করো।’

‘ তোমার কী মনে হয়? আমি এমনি এমনি হাত গুটিয়ে বসে? আজ যদি তুমি ধূসরের বোন না হতে, তুলে আনতেও দুবার ভাবতাম না। বন্ধুত্ব আমার হাত পা বেঁ*ধে দিলো।’

‘ ভাইয়াতো তোমার বন্ধু নতুন হয়নি। ছোট বেলা থেকে তোমরা বেস্টফ্রেন্ড। জেনে-শুনেই তো আমার সাথে প্রেম করেছো৷ ‘
ইকবাল বিরোধিতা জানাল,ধীরস্থির কণ্ঠে বলল
‘ প্রেম করা যায়না মাই লাভ,হয়ে যায়।
মন দেয়া যায়না,হারিয়ে যায়।’

হৃদয়টা থমকে থমকে দাঁড়াল পুষ্পর। কালবৈশাখীর ন্যায় তু*ফান বইল মনে। নিরুপদ্রব হাওয়ায় ভেতরটা দুলছে।
পরক্ষণে অনমনীয় কণ্ঠে বলল,
‘ এসব কাব্যিক কথায় গলছিনা। প্রেম যখন করেছো,বিয়ে করতে হবেনা?নাহলে বসে থাকো,তোমার সামনে দিয়ে আমি সাদিফ ভাইকে বিয়ে করে চলে যাই। ও যাব কোথায়,আমাদের বাড়িতো একটাই।’

ইকবালের ভাসা ভাসা অক্ষিদ্বয় জ্ব*লছে। চিকচিক করছে অন্ধকারে। করূন কণ্ঠে বলল,
‘ তুমি কি মজা করছো মাই লাভ? এমন মজা কোরোনা,যাতে ইকবালের নিঃশ্বাস আটকে আসে। ‘
পুষ্পর বুক কেঁ*পে উঠল। ইকবালের মিহি নিনাদ অন্তকরন স্পর্শ করল নিদারূন ভাবে। অনেক মজা হয়েছে। মানুষটার অনুভূতি নিয়ে জেনেবুঝে ঠাট্টা করা উচিত নয়। ক*ষ্ট পাচ্ছে ও। সে নরম হলো। ভিজে গলায় বলতে গেল,
‘ আসলে…. ‘
আচমকা কথা থেমে গেল তার। চোখদুটো বড় বড় করে খট করে লাইন কা*টল। তারপর দ্রুত পায়ে ঢুকে গেল কামড়ায়। ইকবাল ঘটনার আগামাথা বোঝেনি। পুরোটাই ঘটেছে তার চোখের সামনে। তবুও সে অনবরত ‘হ্যালো হ্যালো’ করতে থাকে। মেয়েটার অদ্ভূত,অপরিচিত আচরণ বিভ্রমে ভোগাচ্ছে। এলোমেলো করে দিচ্ছে তাকে। পুষ্পতো এরকম নয়।
সেই ক্ষনে কাঁধে একটা শ*ক্ত, পুরুষালী হাত পরল। চমকে গেল ইকবাল। ঘুরে চেয়ে বিশালাকার হো*চট খেল।
ধূসরের ভ্রুঁ এক জায়গায় জড়োসড়ো। চেহারায় বিস্ময়ের ছাপ। ইকবাল ত্রস্ত ফোন নামিয়ে পকেটে ঢোকায়। হাসার চেষ্টা করে।
‘ তুই এখানে?’
ইকবালের গলা শুকিয়ে গেল। ভ*য়ে ভ*য়ে বক্র চোখে একবার দেখে নিলো পুষ্পর বারান্দার দিকে। পর্দার আড়ালে লুকিয়ে থাকা মেয়েটাকে অতদূর থেকে চোখে পড়ে না। ‘
‘ বাসায় যাওয়ার জন্য এত তাড়াহুড়ো করলি,বেরও হলি সবার আগে। তাহলে এখানে কেন?’
তার কণ্ঠের গাম্ভীর্যে ইকবাল ঢোক গি*লল দুবার৷ ঠোঁটের আগায় যা পেল তাই বলল,
‘ তোকে খুঁজতে এসেছিলাম।’

পুনরায় হাসার ব্যর্থ চেষ্টা করল সে। ধূসরের চোখ-মুখ শিথিল হলোনা। ভ্রুঁ নাঁচাল,
‘ আমাকে খুঁজতে? ‘
ইকবাল মাথা ঝাঁকাল।
ধূসর বলল ‘ ফোন করলেই হতো।’
সে আমতা-আমতা করে বলল,
‘ হয়েছে কী,ফোনে ব্যালেন্স নেই। আবার বিকাশ ও ফাকা তাই ওই….”

ধূসর মাঝপথেই কলার ধরে টান মার*ল ‘ চল।’
ইকবাল চকিতে বলল ‘ কোথায়?’
‘ ভেতরে।’
সে ধা*ক্কা খায়,চমকিত হয়ে বলে ‘ ভেতরে কেন?’
‘ গেলেই বুঝবি।’

তীব্র অনিচ্ছা আর প্রকান্ড কৌতুহল নিয়ে ধূসরের সঙ্গে পা মেলালো ইকবাল। যেতে যেতে বহুবার পুষ্পর বারান্দায় দেখল। ধূসর তাকে সাথে নিচ্ছেনা, যেন আ*সামী টানছে।

সে চৌকাঠ পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই ঘাব*ড়ে গেল। বসার ঘরে আনিস আর সাদিফ ব্যতীত সবাই আছেন। এত মানুষকে একসাথে দেখে নার্ভাসনেসে হাত পা শীতল। শরীরটা কেমন থরথর করছে।

আমজাদের গায়ে কোর্ট-প্যান্ট, টাই ঝুলছে গলায়। আফতাবেরও একই। আজমল শুধু পরে আছেন বাসার পোশাক। বাকী দুজন কিছুক্ষন আগেই অফিস থেকে ফিরেছেন। তাদের মধ্যে কিছু নিয়ে হৈহল্লা চলছে। এতজনের কণ্ঠ আলাদা করা মুশকিল। সকলের ঠোঁটেই চওড়া,বিস্তৃত হাসি। পুষ্প ঘর থেকে উড়ে এলো প্রায়। ইকবালকে ভেতরে ঢুকতে দেখে তার কলিজা দা*পাচ্ছে। আমজাদ বললেন,
‘ তাহলে তোমরা টেবিলে খাবারের বন্দোবস্ত করো। আমরা ফ্রেশ হয়ে আসি মিনা।’
‘ আচ্ছা যাও। ‘
আমজাদ উঠতে যাবেন, এর আগেই ধূসর বলল,
‘ একটু পরে যান বড় আব্বু।’

সকলের কথাবার্তা স্থগিত হলো তার আওয়াজ পেয়ে। আমজাদ থামলেন, তবে ইকবালকে দেখেই তৎপর মুখ বিকৃত হলো তার। অথচ গৃহীনিরা গদগদ হয়ে গেলেন। মিনা বেগম দুপা এগিয়ে বললেন,
‘ ওমা ইকবাল! কতদিন পর এলে! এসো এসো।’

ইকবাল হাসল। আড়চোখে পুষ্পকে দেখতে দেখতে এগোলো। আজমলের সাথে বহুদিন পর সাক্ষাৎ বিধায় দুজন করমোর্দনের সাথে একে অন্যকে জড়িয়ে ধরল। আমজাদের একটুও পছন্দ হলোনা এসব। মনে মনে আওড়ালেন ‘ আদিখ্যেতা’

পুষ্পর বুক ঢিপঢিপ করছে। মিনা বেগম এত জোরে ইকবালের নাম উচ্চারণ করেছেন যে,পিউয়ের ঘর অবধি পৌঁছে গেল। সে চটজলদি সোজা হয়ে বসল। কী মনে করে হূল*স্থূল বাধিয়ে দৌড়ে এলো সিড়ির কাছে। নীচে নামলোনা, ওপরে দাঁড়িয়ে থাকল। পাছে কেউ বলে ফ্যালে ‘ পড়া রেখে এখানে কী!’
সবার আগে তার চোখ আটকায় লম্বাদেহী প্রিয় মানুষটার ওপর। ওইত দাঁড়িয়ে আছেন। ইশ,কেউ এমনি দাঁড়িয়ে থাকলেও এত ভাল্লাগে দেখতে?
ধূসরকে দেখেই চঞ্চল পিউয়ের হৃদয় নুইয়ে আসে ফের। গতকাল রাতের পর মানুষটার সুতনু চেহারার দর্শন পেলো এতক্ষনে । ভোরে উঠতে পারেনি বিধায় দেখা হয়নি। সারাটাদিন সে ব্যস্ত,আর ও ছিল পরীক্ষার হলে। অথচ অন্তরিন্দ্রিয়ের আনাচে-কানাচেও ধূসর নামের একটা জ্বল*জ্যান্ত প্রদীপ শিখা ছলকে বেরিয়েছে বহুবার। মোহিত তরঙ্গ আছড়ে পরেছে চিত্ত পাড়ে। নিবিষ্ট, অনুরক্ত মন, তার হাসি,রা*গ ভেবে ভেবে অদূরে হারিয়েছে।
পিউয়ের গাল দুটো লজ্জ্বায় র*ক্তাভ হয়েছে ততবার,যতবার মানস্পটে ভেসেছে ধূসরের ঠোঁট যূগল ধেঁয়ে আসার দৃশ্য। কাল সে ওখানে দাঁড়িয়ে থাকলে সাংঘাতিক কিছু ঘটে যেত নিশ্চিত৷ ইশ!
কুন্ঠায় যখন মরিম*রি অবস্থা, কানে এলো রিনরিনে চাপা, ফিসফিসে কন্ঠ। কে যেন নাম ধরে ডাকছে! পিউ সচকিত হয়ে এদিক সেদিক তাকাল। পুষ্প তাকে ইশারা করছে নিজের পাশে এসে দাঁড়াতে।
পিউ আস্তেধীরে সিড়ি বেয়ে নামে। কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই, সে প্রশ্ন ছুড়ল
‘ ভাইয়া ইকবালকে এনেছেন কেন বলতো!’
তার চিন্তিত, উদ্বীগ্ন কণ্ঠ। পিউ চোখ বড় বড় করল। ইকবাল ভাই এসেছেন না কী? সে তল্লাশি চোখে সামনে তাকাতেই ইকবাল কে দেখে স্তম্ভিত হয়। অস্পষ্ট আওড়ায়, একী কান্ড!’

‘ আমিতো ভেবেছিলাম ইকবাল বোধ হয় আমাদের বাড়ির রাস্তা ভুলেই গেছে। আজ এতদিন পর দেখে অবাক হয়েছি। ‘
জবা বেগমের কথায় ইকবাল আবার হাসল। এই মুহুর্তে এই বোকা-বোকা হাসি ছাড়া তার কাছে কিছু নেই।
রুবায়দা,সুমনা ঝটপট কিছু নাস্তা আনতে ছুটলেন।

আমজাদের মেজাজ খা*রাপ । তিক্ত, ত*প্ত চোখে তিনি ধূসরকে দেখছেন। এই ছেলেকে তার রগে রগে অপছন্দ। একেই বাড়িতে আনতে হলো?
তিনি ধূসরের সাথে কথা বলেন না। অফিসেও না।
তাকে আটকালকেন, জেদের বশে জিজ্ঞেসও করলেন না। আবার উঠতে নিলে ধূসর এসে সামনের সোফায় বসল। বলল,
‘ অনেক তাড়া বড় আব্বু?’
তিনি একটু থতমত খেলেন। চাইলেন উত্তর দেবেন না। পরমুহূর্তে সিদ্ধান্ত পালটে গম্ভীর গলায় বললেন,
‘ অফিস থেকে এসেছি। ফ্রেশ হতে হবেনা?’
‘ হ্যাঁ, সেতো হবেন। আসলে একটা দরকারে আপনাকে আটকাচ্ছি। কাজ মিটুক,চলে যাবেন। ততক্ষণ না হয় একটু বসলেন।’

‘ কী কাজ?’
‘ বলব। সাদিফ আসছেনা কেন? দশটা ওভার,আসার তো কথা।’
সে হাতঘড়ি দেখল। বলতে না বলতেই দোরগোড়ায় সাদিফের পদধূলি পরে। সে এত মানুষের ভিড় দেখে আর ওপরে গেল না। নিজে থেকেই এসে ভীড়ে গেল সেখানে। অভ্যাসবশত পিউয়ের কাছে পানি চাইল প্রথমে। পরক্ষনে থেমে বলল,
‘ না,তোকে আনতে হবেনা। মা নিয়ে এসো।’
জবা বেগম হেসে মাথা ঝাঁকিয়ে এগোলেন। পিউ তার যাওয়ার দিক চেয়ে গাল চুল্কে আবার সবার দিক তাকাল। ধূসরের সাথে সোজা-সাপটা চোখাচোখি হতেই লজ্জা পেলো। কুণ্ঠিত ভঙিতে নামিয়ে নিলো দৃষ্টি। তার গালের লালিত আভা দেখে সাদিফের বুক ভারী হয়। ব্যকুলতা বাড়ে। সে চুপচাপ সোফায় বসে। হঠাৎ ইকবালের দিক খেয়াল পরতেই সজাগ চোখে তাকায়। চোখের কোনা দিয়ে একবার পর্যবেক্ষণ করল পুষ্পকে। ঘনঘন আঁখি ঝাপটে তার পাশে বসে শুধাল,
‘ ইকবাল ভাই,হঠাৎ? ‘
ইকবাল ধূসরের দিক তাকিয়েছিল। তার ভেতর ঘূর্নিঝড় শা শা বেগে বইছে। ঠিক তার নাক বরাবর দাঁড়িয়ে পুষ্প। এত এত মানুষকে ফেলে তার হচ্ছে করছে ছুটে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরতে। গলা ফাটিয়ে আর্তচি*ৎকার দিতে ‘ তুমি শুধু আমার মাই লাভ। তোমাকে পাওয়ার অধিকার আর কারো নেই।’

সাদিফ পাশে বসতেই ইকবাল সচেতন হয়ে বসল। অচিরেই আবিষ্কার করল, ছেলেটাকে তার সহ্য হচ্ছেনা। মেয়েরা মেয়েরা সতীন হলে সাদিফ তার সতান নিশ্চয়ই? সতান কে কারো ভালো লাগে? অত উদার সে নয়। জোরপূর্বক হেসে বলল,
‘ ধূসর নিয়ে এলো। ‘
‘ ওহ।’

আকষ্মিক মনে পড়ল,পুষ্প বলেছিল সাদিফ ঘরে উঁকি মা*রছে। ওতো মাত্রই ফিরল অফিস থেকে। এর মানে মেয়েটা তার সাথে ফাজলামো করছিল? তাও এরকম সেন্সিটিভ ব্যাপার নিয়ে? ইকবাল রে*গে পুষ্পর দিক তাকাল। ভ*য়ে,চিন্তায় মেয়েটার শুষ্ক,আধম*রা চেহারা দেখেই টুপ করে ক্রো*ধটুকু ঝরে গেল আবার।

‘ সবাই এসেছে,তাহলে কাজের কথা শুরু করি?’
মিনা বেগম ঘাড় কাত করলেন। প্রত্যেকে একটু নড়েচড়ে বসল। আগ্রহী চোখ গুলো সব ধূসরের শ্যামলা মুখশ্রী জুড়ে। সে ঘোষনার মত উঁচু কণ্ঠে বলল,
‘ আগামীকাল ভোরে আমি সিলেট যাচ্ছি। ফিরব সপ্তাহখানেক পরে। তাই চাইছিলাম পুষ্প আর সাদিফের এনগেজমেন্টের দিনক্ষণ জেনে যেতে। তাছাড়া সেজো চাচ্চুর ছুটিও বেশিদিন নেই। এই নিয়ে আজকেই একটা সিদ্ধান্ত নিলে ভালো হয়না?’

ইকবাল -পুষ্পর বক্ষস্থল ছ্যাত করে উঠল। স্তব্ধ হয়ে গেল দুজনে। পুষ্প খপ করে চে*পে ধরল পিউয়ের হাত।
শ*ঙ্কিত,ক*ম্পিত স্বরে বলল
‘ ভাইয়া এসব কী বলছেন?’
পিউ ভেতর ভেতর আ*তঙ্কিত, ভ্রান্ত হলেও,বোনকে আস্বস্ত করতে বলল,
‘ ওনার নিশ্চয়ই কোনও পরিকল্পনা আছে। অপেক্ষা করি।’
আফতাব কপালে ভাঁজ ফেলে শুধালেন,
‘ হঠাৎ সিলেট।’
‘ একটু কাজ পরেছে।’
‘ রাজনৈতিক? ‘
‘ ওরকমই।’

ইকবাল জ্বিভ দিয়ে ঠোঁট চাটল। তার চোখ দুটো গুটিয়ে এক জায়গায় পৌঁছেছে। রাজনীতির কোনও ব্যাপারে ঢাকার বাইরে যাওয়ার কথা তো হয়নি। হলে সে জানত নিশ্চয়ই।

ইকবাল কী করবে ভেবে পাচ্ছেনা। বিয়ে নিয়ে ধূসর উতলা, আগ্রহী। এটাই স্বাভাবিক। ও তো আর কিছু জানেনা। কিন্তু বন্ধু তাকে ভালোবেসে এখানে আনল,তারই ভালোবাসার মানুষের বিয়ের দিন ঠিক হওয়া দেখাতে?
ইকবাল নিজেকে স্থির রাখতে বিফল। সে গাঢ় কৌতুহলকে দ*মাতে পরাজিত। ধূসরের কানের কাছে মুখ নিয়ে শুধাল,
‘ সিলেট যাওয়ার কথা কবে হলো?’
ধূসরের সহজ উত্তর ‘ তুই আসার পর।’
সে চুপ করে গেল। পরমুহূর্তে আবার নীচু কণ্ঠে শুধাল,
‘ আমাকে এখানে কী বিয়ের কথাবার্তা শোনানোর জন্য আনলি?’
‘ হ্যাঁ। ‘
ইকবাল অক্ষি বিকট করে বলল ‘ কেন?’
‘ তুই আমার বন্ধু,আমার বোন তোরও বোন। এসব শোনার অধিকার আছে তোর। এখন চুপ কর,আমাকে কথা শেষ করতে দে।’
ইকবালে দাঁত পি*ষে,বহুক*ষ্টে স্বাভাবিক হয়ে বসল। পেট, ক্রো*ধে ফাটছে। ধূসরের চোখা নাকে একটা ঘু*ষি মা*রতে পারলে ভালো হোতো। ঠান্ডা হোতো মাথাটা। দুনিয়ায় আর কোনও মেয়ে নেই? যে পুষ্পকেই তার বোন বানাতে হবে? নিজে তো পিউকে বোন বললে ক্ষে*পে যায়। তখন?

পিউয়ের চোখমুখ অন্ধকার। ধূসর ভাই সপ্তাহ খানেকের জন্য সিলেট গেলে কতগুলো ঘন্টা দেখা হবেনা। কী করে থাকবে সে? উনি একটাবার ওকে জানালোওনা। সপ্তদশীর ক্ষুদ্র অন্তঃপুরে অভিমান জমলো। মাথা নামিয়ে কপাল কুঁচকে রইল।

‘ বড় মা,সেজো মা,অসুবিধে আছে তোমাদের?’
দুজনেই এক এক করে বললেন,
‘ না না কীসের অসুবিধে?’
‘ তাহলে কবে করতে চাইছো?’
জবা বললেন,
‘ তোর চাচ্চুতো পনের তারিখ যাবেন বলছেন। এখন ফাল্গুন মাস চলছে। এর মধ্যে করলে ভালো হতো না?’
আজমল মাথা দোলালেন ‘ আমারও তাই মনে হয়। ভাইজান,তোমরা কী বলো?’
আমজাদ বি*রক্ত মেজাজে, চুপ করে বসে। না পারতে মাথা নাড়লেন অল্প। আফতাব ও বড় ভাইয়ের পন্থা অনুসরন করলেন।

ইকবালের কপাল ঘামছে। এসির মধ্যেও পড়নের শার্ট ভিজে লেগে গিয়েছে গায়ে। দুইহাতের তালু ঘষে ঘষে খসখস শব্দ করছে। চিবুক ফুটছে উত্ত*প্ত তাওয়ার ন্যায়৷
পুষ্প -পিউ আর ধূসরকে বাদে বাকী সবাইকে গু*লি করে খুলি উড়িয়ে দিতে মন চাইছে।

ধূসর বলল ‘ ভালো হলে ওইদিনই করো। সমস্যা নেই।’

ইকবাল নিস্তব্ধ হয়ে পরে। বৃহৎ নেত্রে ধূসরের দিক চাইল। আর একটুও সহ্য হলোনা এসব। তার ধৈর্যের বেড়ি গুড়ো গুড়ো হয়ে গিয়েছে। মাথার ভেতর দাউদাউ করে বহ্নি*শিখা জ্ব*লছে। সে ছিটকে ওঠার মতন বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেল। তারস্বরে চি*ৎকার করে বলল,
‘ না, সমস্যা আছে,আলবাত সমস্যা আছে।’

পুষ্পর মাথা চক্কর কা*টল ওকে দাঁড়াতে দেখে। পিউয়ের হাতে দা*বিয়ে দিল নখ। হাঁস*ফাঁস করে বলল,
‘ আমার বুকে ব্য*থা করছে পিউ।’
পিউ বিড়বিড় করে বলল’ আমার তো সব জায়গায় ব্য*থা করছে।’

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।