এক বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যা – সিজন ২ | পর্ব – ৩৬

উনি ওয়াশ রুম থেকে বেরিয়ে ল্যাপটপ টা হাতে নিয়ে বিছানায় বসে ল্যাপটপের সাটার তুললেন।উনার টুইটারা একাউন্টে গিয়ে বিদেশি কারো সাথে চ্যাটিং করছেন মনে হয়।এদিক ওদিক কোনো খেয়াল নেই উনার।চোয়াল একদম ই শক্ত করে আছেন।চোখে মুখে ভীষণ গম্ভীর ভাব লেগে আছে উনার।পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে ল্যাপটপ দেখছেন উনি।চুল থেকে টুপটাপ করে পানি গড়িয়ে যাচ্ছে।পুরা রুম যেনো গম্ভীর আর থমথমে হয়ে আছে।এখুনি মনে হয় ভীষণ কোনো তুফান শুরু হবে।হৃদপিন্ড ভীতস্হ ভাবে আছে উনার মুড দেখেই।থর থর করে যেনন আমি কাঁপছি তেমন হৃদপিন্ড ও কাঁপছে।ভুল যেহেতু করেছি উনার বকা ঝকা শুনি আর যায় করি কথা আমাকেই আগে বলতে হবে।উনি ইহ জীবনে আমি মরে গেলেও নিজ থেকে কথা বলবেন না।কারো প্রতি রেগে গেলে উনি তো আর তার সাথে কথায় বলেন না।আমাকে নিয়ে বাজে কথায় বলার জন্য নিজের মামা বাড়িতে ঝামেলা করে সেখানে বিগত ৫ বছরে একবার ও যান নি উনি।ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে টাওয়াল নিয়ে এগিয়ে গেলাম উনার চুলের পানি মুছে দেওয়ার জন্য।উনার কাছে যেতেই উনি ড্রেসিন টেবিল থেকে ফোন নিয়ে কোথাও ফোন দিয়ে রেগে রেগে কথা বলছেন।ওপাশের কথা শোনা যাচ্ছে না তবে উনার কথা শোনা যাচ্ছে।উনি ভয়ানক রকম রেগে কথা বলছেন,”আপনার সাথে আমার সমস্ত চুক্তি আমি ক্যান্সেল করছি।অনেস্ট পারসন ছাড়া আমি কাউকে কোনোরূপ কাজের সুযোগ দিবো না।আপনার মতো মিথ্যুক ক্লাইন্ট আমার না হলেও চলবে।জীবনে দুইটা জিনিস ভীষণ ঘৃণা করি আমি সেটা হলো মিথ্যা আর মানুষ ঠকানো।সো নেক্সট টাইম ডোন্ট কল মি এগেইন।”উনি ফোন টা কেটে দিয়ে বিছানায় খুব জোরে ফোন ছুড়ে মেরে আবার ল্যাপটপের দিকে মনোযোগ স্হির করলেন।আমি কাঁপাকাঁপা হাতে টাওয়ল টা উনার মাথায় দিতেই উনি প্রচন্ড অগ্নিচোখে আমার দিকে তাকালেন।রাগে কপালে ভাজ পড়ে গিয়েছে উনার,চোখ রক্তজবার ন্যায় হয়ে আছে।উনার তাকানো দেখে আমি খানিক টা কেঁপে উঠে দু’পা পেছনে গেলাম।উনি আবার চোয়ল শক্ত করে ল্যাপটপের দিকে মনোযোগ দিলেন।আমি আবার ভীত মনে দু’পা এগিয়ে গিয়ে আবার টাওয়াল মাথায় দিয়ে বললাম,খা”খাবেন না।অনেক রাত হয়ে গিয়েছে।এত দেরী করলেন কেনো আজ।
উনি কোনো কথা না বলে রুমের বড় আলোর লাইট টা অফ করে ডিম লাইট অন করে বিছানায় এসে সুয়ে আমার বিপরিত দিকে কাত হয়ে ল্যাপটপ দেখছেন।উনার থেকে এক হাত দূরে ল্যাপটপ আর হাতের মধ্য মাউস।আমি আবার লাইট অন করে দিলাম।উনি বেশ বিরক্ত হয়ে উঠে বিছানায় পা মেলে বসে পায়ের উপর ল্যাপটপ রেখে দেখছেন।আমি খুব ভাল ভাবে বুঝতে পারলাম উনি আমাকে সম্পূর্ণ ভাবে ইগনোর করছেন এবং কথা বলতে চাইছেন না কোনভাবে।আমি আবার ও উনার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে টাওয়াল উনার মাথায় দিয়ে বললাম পানি পড়ছে চুল দিয়ে বিহান ভাই।স’স’সরি বিহান ভাই।উনি তাৎক্ষনিক প্রচন্ড জোরে ল্যাপটপের সাটার অফ করে দিয়ে আমার হাত প্রচন্ড জোরে চেপে ধরে বললেন,হাউ ডেয়ার ইউ টাস মি ড্যামেড।উনি এত জোরে হাত ধরেছেন এক্ষুনি মনে হয় ভেঙে যাবে।উনার রিয়্যাক্ট দেখে ভীষণ জোরে কেঁপে উঠলাম আমি।উনার মতো শক্ত পক্ত মানুষের চেপে ধরা হাত ভেঙে যাওয়ার থেকে কম কিছু নয়।ভয়ে আমার চোখে এমনি পানি চলে এলো।উনি আমার হাত ধরা অবস্থায় বিছানা ছেড়ে উঠে খুব জোরেই বললেন, ইন ফিউচার যদি আমাকে টাচ করা তো দূরের কথা আমার কোনো ব্যাপারে ইন্টারফেয়ার বা আমার সাথে কথা বলার চেষ্টা করলে আমি কতটুক ভয়াবহ হবো ভাবতেও পারবি না লাইয়ার কোথাকার।গেট আউট আই সে গেট আউট হেয়ার।উনি আমার হাত ছেড়ে দিলেন ভীষণ জোরে ধাক্কা দিয়ে।রাগ উনি কাঁপছেন আর আমি ভয়ে থরথর করে কাঁপছি।উনার রাগের মাত্র ক্রমস ই বাড়তে আছে।রেগে মাথার চুলে হাত চালাতে চালাতে এদিক ওদিক কিছু খুজছেন।তেমন কিছু না পেয়ে টেবিলের উপর রাখা প্লাসিকের জগ বারান্দায় ছুড়ে মারলেন।উনার যে এই মুহুর্তে পৃথিবীর সব লন্ডভন্ড করতে মন চাইছে সেটা আমি উনাকে রাগে হাঁপাতে দেখে বুঝতে পেরেছি।চোখ দিয়ে যেনো অগ্নি ঝরছে।

–আমার চোখ দিয়ে অনবরত পানি ঝরছে।কি বলবো আর কিভাবে উনার রাগ কমবে সেটাই বুঝতে পারছি না।

–উনার চেচামেচিতে মামি নিচ তলা থেকে চলে এলো।মামি আমাকে কাঁদতে দেখে বুঝতে পারলেন আমাদের মাঝে কোনো ঝামেলা হয়েছে।ছেলের রাগের মাত্রা দেখে মামিও কিছু বললেন না।একবার উনার দিকে আরেক বার আমার দিকে তাকাচ্ছেন।বিহান ভাই মামিকে দেখে বেশ চেচিয়ে বললেন,আম্মু আমার কি এ বাড়িতে কোনো স্বাধীনতা নেই।কি সমস্যা আম্মু।আমি কি বেশী হয়ে গিয়েছি এ বাড়িতে।এ বাড়িতে আমার পজিসন টা কি অবহেলিত।আমার দিকে কারোর কোনো খেয়াল নেই।আমি প্রয়োজন মতো কিছুই পাচ্ছি না এ বাড়িতে।এত অবহেলার কারণ কি আম্মু।তুমি ভাল ভাবেই জানো আমি কারো অবহেলা সহ্য করতে পারিনা।আমাকে নিয়ে যদি খুব সমস্যা হয় তাহলে বলে দাও আমি এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো।

–মামি শান্ত ভাবে বললেন,মাথা ঠান্ডা কর বিহান।তুই ছাড়া আমাদের কে আছে দিয়ার ই বা আর কে আছে।খাবার গুলো পড়ে আছে এখনো খাস নি কেনো। দিয়া কাটা হাতে দুপুর থেকে কষ্ট করে তোর জন্য রান্না করেছে। ছোট মানুষ পারে না তাও করেছে।তবুও বলছিস তোকে আমরা অবহেলা করি।

–প্লিজ আমু দয়াকরে অন্য কারো গুনগান গাইতে এসো না। আমি তোমাদের ছেলে আমি না খেয়ে থাকলে তোমাদের খারাপ লাগলে যে পৃথিবীর সবার খারাপ লাগবে এটা কিভাবে ভাবতে পারো।আমি না খেয়ে থাকলে কি কারো খাওয়া পড়ে থাকবে প্রয়োজনে রেস্টুরেন্টে গিয়ে খেয়ে আসবে।আম্মু আমি ভীষণ ক্লান্ত,আমার খাওয়া নিয়ে তো ভাবা তুমি ছেড়েই দিয়েছো অন্তত আমাকে ঘুমোনোর ব্যাবস্হা টুকু করে দাও।যেখানে নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারবো আমি।আমি নিচে যাচ্ছি ঘুমোতে এ বাড়ির কেউ যেনো আমাকে ডিস্টার্ব করতে না যায়।কথা গুলো বলেই উনি নিচে চলে গেলেন উনার বালিশ নিয়ে।উনার রাগ আজ বেশী দেখে মামি আর খাওয়ার জন্য জোরাজোরি করলো না।উনি বেরিয়ে গেলে আমি বেশ সোরালো করে কেঁদে দিলাম।বুকের মাঝে ভীষণ চিন চিন ব্যাথা করছে।অজানা ভয় বাসা বেঁধেছে। উনি কি আর কোনদিন কথা বলবেন না আমার সাথে।পৃথিবীর কেউ পারবে না উনার মন গলাতে।এই জীবনে উনি হয়তো আর কোনদিন আমার সাথে কথা বলবেন না।উনি কথা না বললে আমি বেঁচে থাকবো কিভাবে।উনি আমার সাথে কথা না বললে আমি থাকবো কিভাবে।পৃথিবীর সব রঙ নিমিষেই বেরঙ হয়ে গেলো।সব কিছু ফ্যাকাসে হয়ে গেলো আমার কাছে।এই মুহুর্তে মনে হচ্ছে এই পৃথিবী টা অসহ্যকর।ভালবাসার মানুষ রাগ করে কথা না বললে তার যন্ত্রণা যে এত তীব্র হতে পারে আমার কল্পনার বাইরে ছিলো। এত আসহায় লাগে নিজেকে।এত কষ্ট হয় তার এক সেকেন্ডের অনুপস্হিতিতে।পৃথিবীতে এত কঠিন যন্ত্রণা আছে আমি তো আগে উপলন্ধি করতে পারিঞ্জ সেটা।শুধু একবার উনি আমায় ক্ষমা করুক,রাগ কমাক আর কোনদিন উনার অবাধ্য হবো না।এই যন্ত্রণা টা আমি আর নিতে পারছি না।মামিকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে যাচ্ছি ভীষণ ভাবে।মামি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে আমাকে বিছানায় বসিয়ে বললেন কি হয়েছে দিয়া।কি নিয়ে রাগ করেছে বিহান।

–মামি বিভা আপু আর দুলাভাই এর সাথে রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়েছিলাম।তখন তোমার ছেলে মেসেজ করেছিলো রাস্তায় যাওয়ার জন্য।আমি ভেবেছি দুলাভাই এর ওখান থেকে উঠে চলে এলে দুকাভাই মাইন্ড করতে পারে পরে আবার বিভা আপুকে কথা শোনাতে পারে।বিভা আপু তো পরের বাড়িতে গিয়েছে তাকে যেনো এটা নিয়ে কটু কথা না শোনাতে পারে তাই মিথ্যা বলেছিলাম আমি অসুস্থ এখন বাইরে যেতে পারবো না।ভেবেছিলাম পরে উনাকে বুঝিয়ে বললে একটু বকবে কিন্ত রাগ করবে না।আমি মেসেজ করার পাঁচ মিনিট পরে উনি রেস্টুরেন্টে গিয়ে আমাকে দেখে ফেলেছেন।

–মামি আমাকে বললেন,বিহানের রাগারাগি দেখে তোর মামা আমাকে পাঠিয়ে দিয়ে বলেছে ছেলে হঠাত রেগে গেলো কেনো?তুমি একটু বুঝাও গিয়ে।
শোন দিয়া তুই একটুও মন খারাপ করিস না মা।বিহান যেমন রাগি তেমন পানির মতো।আর বিহান তোর সাথে রাগ করে থাকতেই পারবে না তুই দেখে নিস।আসলে বিহান তোকে অনেক ভালবাসেতো তাই এমন করছে, ওর রাগ দেখে কি কিছুই বুঝিস নি।বিহান রেগে থাকার থেকে কষ্ট বেশী পেয়েছে পাগলি।আমার ছেলে তো আমি জানি, ওর চোখ দেখেই বুঝেছি।কাল সকালে দেখিস রাগ কমে যাবে।আয় তো আজ মা মেয়ে এক সাথে ঘুমোবো আর গল্প করবো।

–আমার কাঁন্না যেনো থামতেই চাইছে না।মামির পাশে সুয়ে পড়লাম।মামি আমাকে বিভিন্ন গল্প বলেই যাচ্ছে কিন্তু আমার মন বিহান ভাই এর দিকেই রয়েছে।এক সময় মামি ঘুমিয়ে পড়লো আমার জন্য পার হলো একটা নির্ঘুম রাত।উনি কি ঘুমিয়েছেন নাকি আমার মতোই না ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিয়েছেন।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।