নিজের ভেজা দুটো টিশার্ট ছাদে টাঙানো রশিতে মেলে দিল সুহাস। ভেজা চুলে হাত নেড়ে পানি ঝেড়ে গিয়ে দাঁড়াল ছাদের কার্ণিশ ঘেঁষে। সদ্য গোসল করা সুহাসকে বেশ স্নিগ্ধ লাগছে। তার লোমহীন ধবধবে ফরসা বুকটাও আকর্ষণীয়। পাশের বাড়ির ছাদে চৌদ্দ, পনেরো বছর বয়সী এক কিশোরী। কাপড় নাড়ার পাশাপাশি লক্ষ্য করছিল সুহাসকে৷ দুরন্ত সুহাস টের পেতেই উৎফুল্ল হয়ে ওঠল। শিষ বাজিয়ে চেষ্টা করল বাচ্চা মেয়েটির মনোযোগ দৃঢ় করার। কাপড় নাড়া শেষে সম্পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকাল মেয়েটি। সুহাস দুষ্টুমি ভরে হাসল। ডান চোখ টিপ দিল। লজ্জা পেয়ে মুখ ফিরিয়ে নিল মেয়েটা। লাজুক হাসি এঁটে রইল ওর ওষ্ঠজোড়ায়। সুহাস ভেবেছিল বাচ্চা একটা মেয়ে৷ এক চোখ টিপ দিলেই ভয়ে দৌড়ে পালাবে৷ কিন্তু না, তাকে অবাক করে দিয়ে মেয়েটি ওড়নার কোণা কচলাতে শুরু করল। আর মাঝে মাঝে আড়দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখতে লাগল তাকে। ভড়কে গেল সুহাস। এ মেয়ে তো তার থেকেও এক ধাপ এগিয়ে। সে ফ্লার্ট করল আর মেয়েটা পটে গেল! নাহ পাশের বাড়ির অল্পবয়সী ললনাদের সঙ্গে ফ্লার্ট করা যাবে না। বলা যায় না কখন বাড়ি এসে বসে থাকে৷ এক কালনাগিনী নিয়েই তার জীবন ঝালাপালা। কালনাগিনীর দল আর ভারী করতে চায় না সে৷
সুহাসরা এই বাড়িটি নতুন করেছে। ডুপ্লেক্স এই বাড়িতে ওঠেছে মাসখানেক হলো। এর আগে এ শহরে তারা ভাড়া বাসায় থাকত। নিজস্ব এই বাড়িটা তার বাবা মায়ের খুব শখের। সারাজীবন যত রোজগার করেছে তার বেশির ভাগি ঢেলে দিয়েছে এই বাড়িতে৷ আশপাশের প্রতিবেশীদের সঙ্গে তার বাবা মায়ের আলাপ থাকলেও তার নেই। তাই পাশের বাড়ির অল্পবয়সী মেয়েটার সাথে আজি প্রথম দেখা। গলা খাঁকারি দিল সুহাস। জিজ্ঞেস করল,
‘ এই তোমার নাম কী ? ‘
মেয়েটা চমকাল। মুখ তুলে একবার তাকিয়ে হাসল লাজুকতা ভরে। এরপর মাথা নুইয়ে বলল,
‘ অতসী তালুকদার। ‘
‘ কোন ক্লাসে পড়ো? ‘
‘ ক্লাস সেভেন। ‘
বিস্মিত হলো সুহাসের দৃষ্টি। পরোক্ষণেই কেশে ওঠল সে। মেয়েটার চোখে কিঞ্চিৎ ব্যাকুলতা। সুহাস নিজেকে স্বাভাবিক করল সময় নিয়ে। এরপর বলল,
‘ তোমার বড়ো বোন আছে? ‘
মাথা দুলালো অতসী। সুহাস এবার প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছাড়ল। কুটিল হেসে বলল,
‘ তাহলে আমাকে দুলাভাই ডাকবে। আপুর নাম্বার মুখস্থ আছে? ‘
অতসীর মুখে মেঘ নেমে এলো। অমাবস্যার রাতের ন্যায় মুখ করে সে বলল,
‘ আপুর বয়ফ্রেন্ড আছে। ‘
এরপর আর এক মুহুর্তও দাঁড়াল না অতসী। তীব্র অভিমান নিয়ে ছাদ থেকে চলে গেল সে। এই মেয়ে আবার অভিমান করতেও জানে? মানুষ তো অভিমান করে তার কাছের লোকজনের সাথে। সুহাস তো তার কাছের কেউ নয়৷ তবে কেন অভিমান করল? বর্তমানে অল্পবয়সী মেয়েদের পাকনামি আকাশ ছোঁয়া। এরা মুহুর্তের মধ্যে প্রেমে পড়ে। মুহুর্তের মধ্যেই প্রেমে পড়ে যাওয়া পুরুষটিকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে। কেউ কেউ আবার সংসারও করে ফেলে। অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল সুহাস৷ হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে গেল তার। হাসি থামল তাদের গেট বরাবর দৃষ্টি যেতেই৷ তাদের গেটের সামনে ফারাহ দাঁড়িয়ে! নামীর বেস্ট ফ্রেন্ড ফারাহ। কী ব্যাপার? আকস্মিক গম্ভীর হয়ে গেল সুহাস। বোঝার চেষ্টা করল ঘটনা টা ঠিক কী?
এক মিনিট পর গেট খুলা হলো। নামীর হাসিমাখা মুখটা এক পলক দেখল মাত্র। ফারাহ ভেতরে ঢুকল। গেটে তালা লাগিয়ে ফারাহকে নিয়ে ভেতরে চলে গেল নামী। ছাদে ওঠার সময় ওপাশ থেকে খিচুড়ির ঘ্রাণ নাকে এসেছিল তার। সেলিনা আপাও খিচুড়ি করছে সেই ঘ্রাণ খুব একটা পায়নি। নামীও আজ খিচুড়ি করছে। সেই খিচুড়ি খেতেই কি বান্ধবীকে বাড়ি ডেকে আনল? তাহলে সে কেন চুপ করে থাকবে? তারও উচিত বন্ধু-বান্ধব ডেকে আনা৷ তারপর আনন্দ উল্লাস করে খিচুড়ি ভোজন করা। বাবা বাড়ি নেই। ফেরার আশঙ্কাও নেই। এই তো সুযোগ নামীকে জ্বালানোর। আর দেরি করল না সুহাস৷ ঝটপট ম্যাসেজ করল সৌধকে। সৌধ তার প্রস্তাব নাকচ করে দিল। সে খেয়েদেয়ে লম্বা একটা ঘুম দেবে৷ পুরো সপ্তাহ রাত জেগে পড়াশোনা করে। শুক্রবার দুপুরের পর কয়েক ঘন্টা ঘুমানোর অভ্যাস তার। তাই ঘুমের চেয়ে সুহাসের এই ফালতু প্রস্তাবকে বেশি গুরুত্ব দিল না ৷ নামীকে জ্বালানো ছাড়া আর কোনো লক্ষ্যই যেন সুহাসের নেই৷ নম্র, ভদ্র, শান্তশিষ্ট মেয়েটাকে অহেতুক অপমান, অসম্মান, বিরক্ত করাতে কখনোই পক্ষপাতিত্ব করেনি তারা৷কতগুলো মাস হয়ে গেল বোঝাচ্ছে সুহাসকে। মাতৃভক্তে এতটাই অন্ধ হয়ে গেছে ছেলেটা, যে নামীর ব্যাপারে ইতিবাচক পরামর্শ দিলে বন্ধুদেরও শত্রু ভেবে বসে থাকে। সৌধর থেকে পাত্তা না পেয়ে আইয়াজকে কল করল সুহাস৷ ব্যাপক পড়ুয়া ছাত্র আইয়াজও পাত্তা দিতে চাইল না। কায়দা করে সুহাস ফারাহ আসার কথা জানাল। আইয়াজ যে ফারাহ’র প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে টের পেয়েছে সে। ইদানীং ম্যাসেন্জারে ফারাহর সঙ্গে বেশ চ্যাটিং করে আইয়াজ। সব খবর আছে সুহাসের কাছে। তাই ফারাহ নামক টোপ ফেলল সে। মুহুর্তেই সে টোপ গিলেও নিল আইয়াজ৷ বলল,
‘ আসছি আমি। সাথে করে নিধিকেও নিয়ে আসছি। নিধির আসার খবরটা তুই শুধু সৌধকে বলে দে। ওর ঘুম উড়ার পাশাপাশি ফুড়ুৎ করে তোর বাসায় উপস্থিত হবে। ‘
আইয়াজের বুদ্ধি মানেই খাপে খাপ। আজ ওরা এলে রেখে দেবে। রাতেও যেতে দেবে৷ জম্পেশ আড্ডার পাশাপাশি নামীদামিকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাক করে দেবে। শান্তি ভরে শ্বাস নিল সুহাস। নিচে নামতে পা বাড়াল। তৎক্ষনাৎ মাথায় তোয়ালে প্যাঁচিয়ে বালতি হাতে ছাদে প্রবেশ করল নামী। মুখোমুখি হলো সুহাসের। সন্তর্পণে পাশ কাটিয়ে চলে গেল ছাদের মাঝ বরাবর। নামীর চলনবলন দেখলেই সুহাসের শরীর জ্বলতে শুরু করে। এই মেয়ে হাবভাব এমন দেখায় যেন সে এই দেশের মিনিস্টার। কাপড়ের পানি ঝেড়ে শুখা দিতে লাগল নামী। সুহাস নিচে গেল না৷ সে বিপরীত পাশে গিয়ে দাঁড়াল। তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রইল নামীর দিকে। নামী ভেবেছিল সুহাস চলে গেছে। তাই জামার নিচে পরিধেয় ছোট্ট বস্ত্র শুখা দিতে উদ্যত হলো। সে মুহুর্তেই বেজে ওঠল সুহাসের ফোন৷ চমকে ওঠল নামী। ধাতস্থ হয়ে অধোবস্ত্রটি লুকিয়ে ফেলল। সুহাস ফোন রিসিভ করলেও নামীর থেকে নজর সরাল না। নামী কতক্ষণ থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকল। এরপর কামিজের নিচে আলগোছে অধোবস্ত্রটি রেখে কামিজ টান টান করে শুখা দিয়ে নিচে চলে গেল। নামী চলে যেতেই ভ্রু কুঁচকে দাঁড়িয়ে রইল সুহাস। ব্যাপারটা কী ঘটল? ফোনের ওপাশে প্রীতি বকবক করেই চলেছে। সুহাসের সেদিকে হুঁশ নেই৷ সে মগ্ন নামীতে। নামী কী লুকাল? অমন দ্বিধান্বিত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল কেন? এসব প্রশ্নই ঘুরপাক খেতে লাগল মাথায়। একসময় ফোন কেটে দিয়ে ধীরপায়ে এগিয়ে এলো। কিঞ্চিৎ দ্বিধা ঠেকলেও দুরন্ত মস্তিষ্ক তাকে পাত্তা দিল না। চট করে জামা উঁচিয়ে দেখে ফেলল কাঙ্ক্ষিত বস্ত্রটি। নিমিষেই শরীর শিরশির করে ওঠল তার। হৃৎপিণ্ডে ধড়াস জনক একটি শব্দও হলো। কণ্ঠনালি শুঁকিয়ে নীরস হয়ে গেল। কেঁপে ওঠল জামা ধরে রাখা হাতটা। শ্বাস আঁটকে দাঁড়িয়ে রইল কতক্ষণ। নিজের প্রতি অভিযোগ আসল একবার। পরোক্ষণেই মনটা চনমনে হয়ে ওঠল। আশপাশে চোরা চোখে তাকিয়ে ছাদের দরজার দিকে সচেতন ভাবে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। এরপর ত্বরিত অধোবস্ত্রটি টান দিয়ে ভরে নিল হাতের মুঠোয়। ছাদের দরজা পর্যন্ত গিয়ে কী যেন ভেবে মুঠো ভরা বস্ত্রটি থ্রি কোয়াটার প্যান্টের পকেটে পুরে নিল। দৃষ্টিতে ঝলমল করল দুষ্টু হাসিরা। অধরে ফুটে ওঠল বক্র হাসি। ‘ আহ নামীদামি দারুণ জব্দ হবে তুমি। ‘ মনে মনে কথাটা বলেই বুকের ভেতর খেলে গেল পৈশাচিক আনন্দ।
***
বড়ো আপুকে খুব কষ্টে রাজি করেছে ফারাহ৷ যেন নামীর কাছে ক’দিন থাকতে দেয়৷ দু’জন মিলে একসঙ্গে পড়াশোনা করবে। নামী পড়াশোনায় কত ভালো সে গল্প শুনেছে ফারাহর বড়ো আপু। সে বরাবর ভালো স্টুডেন্ট’সদের সমীহ করে। তাই নামীর রিকুয়েস্ট ফেলতে পারেনি। তাছাড়া শুনেছে মেয়েটা একা থাকবে। তার বাবা গুরুত্বপূর্ণ কাজে দেশের বাইরে গেছে। মা মরা মেয়ে বড্ড মায়া হয়েছে নামীর জন্য৷ সোহান খন্দকার নামীর শশুর এ কথা ফারাহ জানলেও ফারাহর বড়ো বোনকে জানানো হয়নি। তাছাড়া সুহাস, নামীর সম্পর্কের কথা কেউ জানে না৷ কেবল ঘনিষ্ঠ কয়েকজন বন্ধু – বান্ধব ছাড়া। তাই খুব একটা সমস্যা হয়নি আপুকে পটাতে৷ দুই বান্ধবী মিলে দুপুরবেলা আচাড় দিয়ে পাতলা খিচুড়ি খেল। এরপর পড়াশোনা নিয়ে কিছুক্ষণ আলোচনা করে পড়তে বসল যে যার মতো।
সময় গড়াল অনেকক্ষণ। আকাশে গুড়ুম গুড়ুম শব্দে চমকে ওঠল নামী। ছুটে চলে গেল ছাদে, কাপড় আনতে। ফারাহও বই বন্ধ করে রুম ছেড়ে বেরিয়ে এলো। ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল সুহাস ভাইদের বাড়িটা। সদর দরজা দিয়ে ঢুকছিল আইয়াজ। ফারাহ এক পাশ থেকে অপর পাশে যেতে নিতেই নিজ ওড়নায় নিজেরই পা লেগে পড়ে গেল। স্বাস্থ্য ভালো নাদুসনুদুস মেয়েটা পড়ে গিয়ে আঘাত পেল তীব্রভাবেই। বাড়িতে ঢুকতে না ঢুকতেই অমন দৃশ্য দেখে নিজেকে সামলাতে পারল না আইয়াজ। ত্বরিত গিয়ে ধরল মেয়েটাকে। ভারিক্কি নরম শরীরটাকে ওঠে বসাতে বেশ বেগ পেতে হলো। দুই চোখ গলে পানি পড়ছে ফারাহ। তরতরা নাক, গোলাপি রাঙা ঠোঁটদ্বয় রক্তিম হয়ে ওঠেছে। আইয়াজের পেছনে নিধি ছিল। আতঙ্কিত হয়ে সেও ছুটে এসে ধরল ফারাহকে। দুই বন্ধু মিলে ওঠাল ওকে। ধীরেসুস্থে নিয়ে বসাল ড্রয়িং রুমের সোফায়৷ ওপর থেকে সুহাস নামী দু’জনেই ছুটে এলো। নামী ফারাহকে ধরে আতঙ্কিত কণ্ঠে বলল,
‘ কী হয়েছে ফারাহ! ‘
আইয়াজ চশমা ঠিক করতে করতে সরে গেল। নিধি বলল ঘটনাটি। নামী বকে ওঠল ফারাহকে। বলল,
‘ চশমা ছাড়া বেরিয়েছিস কেন তুই? ইস, কোথায় কোথায় লেগেছে বল আমায়। ‘
সুহাস বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে ফেলল। ব্যঙ্গ করে বলল,
‘ আসছে ডাক্তারনি। ‘
নামী তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল। ফারাহকে বলল,
‘ দেখি ওঠতে পারবি? রুমে চল। ‘
নিধি বলল,
‘ আমি সাহায্য করছি। ‘
নামী, নিধি দু’জন মিলে ধরে ফারাহকে নামীর ঘরে নিয়ে গেল। আইয়াজ ব্যথাহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ওদের যাওয়ার পানে৷ সুহাস তা দৃষ্টিপাত করে নিচু কণ্ঠে বলল,
‘ কীরে চক্কর কবে থেকে চলে? ‘
‘ কীসের চক্কর টুকটাক কথা হয় শুধু৷ আর কিছু নয়। ‘
‘ তাহলে ব্যথা কোথায় পাচ্ছিস চোখে না বুকে? ‘
‘ মানে কী বলছিস কী? ‘
দৃষ্টি লুকানোর চেষ্টা করল আইয়াজ। সুহাস তার চতুর্দিকে ঘুরপাক দিতে দিতে দুষ্টু হেসে বলল,
‘ বুকের ব্যথা চোখে ফুটে বন্ধু, চোখে ফুটে।‘