এক বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যা | পর্ব – ৪৮

সবুজ মেরুর দেশে শুধুই সবুজের সমারোহ।চারদিকে সবুজ ধান ক্ষেত হয়তো পনেরো দিনের মাঝেই ফুল আসবে গাছে।প্রসস্ত বিলের মাঝে চিকন একটা পিজঢালা রাস্তা যার চারদিকের কুল কিনারা দেখা যাচ্ছে না।বাতাসে ধানক্ষেতের ধানের পাতা গুলো দোল খাচ্ছে যেনো স্রোত বয়ে যাচ্ছে ধানের পাতায়।মাঝে মাঝে কাক তাড়ুয়া ও আছে।কৃষক রা ধান হওয়ার আগেই কাকতাড়ুয়া লাগিয়ে রেখেছে।আমি অটো থেকে মুখ বের করে হাওয়া লাগাচ্ছি শরীরে।আমার সামনে থাকা চুল গুলো উড়ে উড়ে চোখে মুখে পড়ছে আর আমি হাত দিয়ে সরিয়ে সরিয়ে কানের পিছনে গুজে দিচ্ছি।কাক তাড়ুয়ার গায়ে শার্ট পরানো, কালো হাড়ি দিয়ে মাথা বানানো মধ্যরাতে নিশ্চিত কেউ প্রেতাত্মা ভেবে ভয় পাবে।
বিহান ভাই এক নজরে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন উনার চোখের মনিতে আমার চোখে মুখে উড়ে আসা চুল গুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।বিভোর ভাই বিহান ভাই কে বললেন বিহান দেখ জায়গা টা সত্যি সুন্দর না।বাবা কিন্তু দেখে শুনে একটা জব্বর শ্বশুর বাড়ি বানিয়েছেন।এই এলাকায় বিয়ে না করলে এত সুন্দর জায়গা ফ্রি তে দেখতে পেতাম না।বিহান ভাই অন্যমনস্ক ভাবে উত্তর দিলেন হ্যাঁ দেখছি তো নজর কাড়া প্রকৃতি, প্রকৃতির এমন সুন্দর রুপ আগে দেখি নি।বলেই নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে হালকা হাসি দিলেন।আমি উনার দিকে তাকাতেই চোখে চোখ পড়ে গেলো দুজনের।অটোতে সামনা সামনি বসে আছি দুজনে।দুজনের চোখ দুজনের দিকে রয়েছে একভাবে।দুজনের চোখের তারায় দুজনকে দেখা যাচ্ছে।কয়েক সেকেন্ড উনার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতেই লজ্জারা চারদিক থেকে ঘিরে ধরলো আমাকে।ইস এইভাবে কারো চোখের দিকে কি তাকিয়ে থাকা যায়।লজ্জার সম্পূর্ণ আবেশ চোখে মুখে লেগে আছে আমার উনার চোখে মুখে হাসি খেলা করছে উনার কোনো ভাবগতি নেই চোখ মুখের,তাকিয়েই আছেন একভাবে।উনি মনে হয় অনেক্ষণ পর চোখের পলক একবার ফেললেন।লজ্জামাখা হাসি আমার ঠোঁটের কোণে জড় হয়েছে আমি আবার চোখ ফিরিয়ে প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে তাদের মুগ্ধতা উপভোগ করছি।
আড়চোখে উনার দিকে তাকিয়ে দেখি উনি আমার দিকে তাকিয়েই আছেন।সাদা ফিটিং প্যান্ট,পরণে খয়েরী পাঞ্জাবী, পাঞ্জাবীর হাতা গোটানো,হাতে কালো ফিতার ঘড়ি,পায়ে আজ জুতা নেই উনার, দুই ফিতার চটি।চুল গুলো উড়ছে উন্মুক্ত বাতাসে।এত সিম্পল পোশাকে,সিম্পল একটা চটিতে একটা ছেলেকে এতটা সুন্দর লাগতে পারে তা উনাকে না দেখলে বুঝতাম না।উনার পায়ের দিকে তাকিয়ে আছি আমি,উনার পায়ের নখ দেখে যে কোনো মেয়েই ক্রাশ খাবে।একদম ই সাদা আর পরিপাটি,হাত পায়ের নখ গুলো কখনো বড় হতে দেখি নি আমি এই পরিপাটি ভাবেই দেখে আসছি ছোট বেলা থেকে।এলোমেলো বাতাসে গায়ের জরজেট উড়না উড়ে খানিক টা সরে গিয়েছে।বেখেয়ালে সে হুঁশ ই নেই আমার।ফোনে টুং করে মেসেজ এর সাউন্ড শুনে তাকিয়ে দেখি বিহান ভাই এর মেসেজ।বিহান ভাই নিচু হয়ে বসে ফোন চাপছেন পূর্ণ মনোযোগ মনে হয় ফোনের দিকেই তার।ফোনের মেসেজ দেখে ভাল লাগা আরো বহুগুন বেড়ে গেলো আমার।
“জীবনে অনেক বার প্রকৃতির রূপ দেখেছি কিন্তু প্রকৃতির এত মন কাড়া রুপ দেখি নি।সে প্রকৃতির সাথে মিশে গিয়ে প্রকৃতি কে তার পূর্ণ সৌন্দর্য ফিরিয়ে দিয়েছে।তাকে খোলা চুলে এতটা সুন্দর না লাগলেও পারতো”
মেসেজ টা পড়ে উনার দিকে তাকাতেই উনি ছোট মামিকে ডাকলেন।কাকিমনি দেখো এই জায়গা টা অনেক সুন্দর তাইনা।মামি অটো থেকে মুখ বের করে দেখতে গেলো তখনি বিহান ভাই মামির দিকে তাকিয়ে থেকেই উনার অন্য হাত দিয়ে আমার পড়ে যাওয়া ওড়না আমার গায়ের উপর তুলে দিলেন।আমি বুঝতে পেরে দ্রুত ওড়না ঠিক ঠাক করে বসলাম।উনি কি যাদু জানেন এক হাত দিয়ে মামিকে বাইরে কিছু দেখাচ্ছেন তো অন্য হাতে ওড়না ঠিক করছেন।
উনি এত কিছু করার পর ও আমি কথা বলছি না।গতকালের রাগ টা পুষে রেখেছি।উনি যথা সম্ভব চেষ্টা করেই যাচ্ছেন কিন্তু আমি পাত্তা দিচ্ছি না।আমার কাছে এসে আস্তে করে বললেন,অটো ড্রাইভার আয়নায় দেখছিলো তোকে ঠিক ঠাক ভাবে বসতে পারিস না।খাবার যত্ন করে তুলে রেখেছি আমি এখনো ছুয়ে ও দেখলাম না আর খাবে অন্য কেউ। ঠিক ঠাক ভাবে বস বলেই উনি মামির দিকে তাকালেন।
অতপরঃআমরা এসে পৌছালাম বিভোর ভাই এর মামাবাড়ি।বিভোর ভাই এর নানি রাস্তায় ই দাঁড়িয়ে আছেন।উনার বয়স খুব একটা হয় নি, দেখতে বেশ ইয়াং ই লাগে।বিহান ভাই কে দেখে বিভোর ভাই এর মামা মামি কাজিন সবাই অন্যরকম খুশি।তার পর উনি এখন নামকরা একজন ডাক্তার।সবাই বিহান ভাই এর সাথে কুশল বিনিময় করছে,কেউ কেউ হ্যান্ডশিপ ও করছে মনে হলো কোনো সেলিব্রিটির দারোয়ান হয়ে উনার পাশে দাঁড়িয়ে আছি।কারণ কেউ আমাকে পাত্তাই দিচ্ছে না সবার মমনোযোগ উনার দিকেই আছে।আমাকে দেখে বিভোর ভাই এর মামাদের বাড়ির আশে পাশের মহিলারা বলছে শাহিনা এই মেয়েটা কে রে?বিভোর ভাই এর মামি বললেন শাহিনার ননদের মেয়ে এইতো সেই দিয়া।আগে কত এসেছে ছোট বেলা চিনতে পারছো না।মহিলা রা বললো ওহ আচ্ছা এই যে সেই মেয়েটা তারা খুব সুন্দর ভাবে বললো কেমন আছো মা।আমিও হেসে উত্তর দিলাম জ্বী ভাল আছি।
বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করেই দেখি বিভোর ভাই এর মামি আগে থেকেই খাবার রেডি করে রেখেছেন।বিহান ভাই এর তাড়া আছে অনেক ব্যাস্ততার মাঝেও এসেছেন।এইজন্য আমরা দুপুরে খেয়েই বেরিয়ে যাবো।বিভোর ভাই এর মামাতো বোন বার বার বিহান ভাই এর দিকে তাকাচ্ছে।আমার মন সব সময় নেগেটিভ চিন্তায় থাকে মনে মনে ভেবে নিলাম বিহান ভাই কে মনে হয় পছন্দ করে মেয়েটা।মেয়েটা বিহান ভাই এর এক্সট্রা খাতির করছে ব্যাপার টা মোটেও ভাল লাগছে না আমার।আমাদের সামনে বিভিন্ন পিঠা ফল এর নাস্তা দেওয়া হয়েছে।সবাই টুকটাক খাচ্ছি।
এমন সময় বিভোর ভাই এর কাজিন আরিফ এসে বললো আরে দিয়া যে কেমন আছো।হেসে উত্তর দিলাম জ্বী ভালো আছি।আরিফ এসে আমার পাশেই বসলো প্রায় গা ঘেষেই বলা চলে।সবাই মিলে গল্প করছি বিহান ভাই বার বার আমার দিকে তাকাচ্ছেন আর আমি ইচ্ছাকৃত ইগনোর করেই যাচ্ছি। আরিফ ভাইয়ার সাথে ইচ্ছা করেই হেসে হেসে কথা বলছি।আরিফ ভাইয়া ফোনে উনার বিভিন্ন পিকচার তুলেছেন সেগুলা দেখাচ্ছেন আর আমি দেখছি।
বিভোর ভাই এর মামা বললেন শাহিনা বিভোর কে তো বিয়ে দিতে হবে মেয়ে দেখবো না।বিভোর ভাই পাঞ্জাবীর কলার ঝাকি দিয়ে বললেন মামা এটাই তো আপনার বোন আর ভগ্নিপতি বুঝতে চাইছে না।দেখুন মামা সোজা কথা আমি কিন্তু আমার ফরজ দ্রুত আদায় করতে চাই।আপনাদের মতো বুড়ো হয়ে বিয়ে শাদী করতে পারবো না।আপনার আব্বা তো ছেলে বিয়েই দিতে চাইতো না।আমার বাবা জোর না করলে বিয়েই হতো না।আমি বুড়ো বয়সে বিয়ে করে বাবা ডাক শুনতে চাই না।বিভোর ভাই এর কথা শুনে সবাই হেসে গড়াগড়ি গেলো।বিভোর ভাই এর মামা বললেন ভাগ্নে চিন্তা করো না তোমাদের দুই ভাইয়ের বিয়ে আমি দিবো।মেয়ে আছে আমার হাতে।পাশের এলাকায় একটা মেয়ে আছে এবার ইন্টার পাশ করেছে বিভোর এর জন্য দেখেছি মেয়েটা।আমি বিভোর ভাই এর দিকে তাকিয়ে হেসে দিলাম।বিভোর ভাই বললেন,,মামা আমার বিয়ে আমার পছন্দে করবো মেয়ে আমি নিজেই দেখবো।বিভোর ভাই এর আম্মু বললেন তুই যে রিয়া কে বিয়ে করার প্লান করছিস তা কি আমি জানিনা।সেদিন তোর রুম ঝাড় দিতে গিয়ে দেখলাম ইয়া এক চিঠি লিখেছিস রিয়ার নামে।ভেবেছিস আমি কিছুই জানিনা।বিভোর ভাই ভ্রু কুচকে বললেন,কোন রিয়া আম্মু।বিভোর ভাই এর আম্মু বললেন,এখন কিছুই বুঝছিস না তাইতো।বিভোর ভাই হালকা কেশে নিয়ে বললেন,আম্মু রিয়া কিন্তু খারাপ না যায় বলো।
বিভোর ভাই এর মামা বিহান ভাই এর দিকে তাকিয়ে বললেন,বিহান বিয়ে শাদী করবা না।
বিহান ভাই ভদ্রতাসহিত উত্তর দিলেন এখনো ভাবি নি কিছু মামা।
বিভোর ভাই এর মামা বললেন,আমাদের আসমা কিন্তু এবার মেডিকেল এ চান্স পেয়েছে।দেখতে শুনতে মাসআল্লাহ মানাবে ভালো।
আসমা মেয়েটা মনে হয় মারাত্মক লজ্জা পেয়েছে।ওড়নার এক কোনা গালে দিয়ে চিবোচ্ছে।আমি আড়চোখে বিহান ভাই এর দিকে তাকালাম। বিহান ভাই এর কপালে গোটা কয়েক ভাজ পড়েছে ভীষণ বিরক্তিতে।এই বিয়ের ব্যাপার টা উনার ভাল লাগছে না আবার আরিফ আমার পাশে।আরিফ আমাকে বললো তোমার সাথে পারসোনাল কিছু কথা আছে দিয়া।আমি আরিফ এর সাথেই গেলাম।কিন্তু দু মিনিটের মাঝেই বিহান ভাই আর বিভোর ভাই উপস্হিত আরিফ তার মনের কথা শেষ করতে পারলো না।বিহান ভাই বললেন কি ব্যাপার আরিফ আমাদের খাতির করছো না যে।আরিফ ভাইয়া হেসে বললো না মানে কিছু স্পেশাল কথা ছিলো তাই।ভাইয়া আসুন আমরা পিকচার তুলি।আরিফ তার ক্যামেরা এনে আমাদের কিছু পিক তুললো।বিহান ভাই এর হাতে ক্যামেরা দিয়ে বললো আমাদের কিছু পিক তুলে দিন ভাইয়া।বিহান ভাই ক্যামেরা হাতে নিয়ে আমার দিকে আড়চোখে তাকালেন একবার মাত্র।গোটা কয়েক ফটো তোলার পর আরিফ ভাইয়া বললো দেখি কেমন পিকচার হয়েছে।আরিফ ভাইয়া তাকিয়ে দেখে শুধু আরিফ ভাইয়ার ই পিকচার আমার পিকচার একটাও নেই।আরিফ ভাইয়া বললো কি ব্যাপার বিহান ভাই দিয়ার পিক তো ওঠে নি।বিহান ভাই আমার দিকে তাকিয়ে বললো,ওই পেত্নির পাশে তোমাকে ভাল দেখা যাচ্ছে না আরিফ।তোমার মতো সুন্দর দেখতে ছেলেটার ছবি এইভাবে নষ্ট হোক চাই না।দিয়াকে সবার সাথে মানায় না। ওর মতো পেত্নি কে মানায় নিশ্চিত কোনো রাক্ষস এর সাথে তাইনা দিয়া।উনার কথা শুনে যা রাগ হলো কিন্তু কিছুই বললাম না।আরিফ ভাইয়া বললো কি বলেন ভাইয়া দিয়া তো অনেক সুন্দর দেখতে।বিহান ভাই বললেন আসলেই সুন্দর।
বিভোর ভাই এর মামা বাড়ি থেকে ফিরে দেখি মামা মামি কেউ বাসায় নেই।আমি আমার মতো একটা রুমে বসে রইলাম।
বিহান ভাই আমার কাছে এসে বললেন কি সমস্যা কথা বলছিস না কেনো?উনার দিকে তাকিয়ে দেখি রেগে আগুন হয়ে আছেন।কারণ আমি ক্যানো কথা বলছি না এটা উনি জানেন না।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।