৮৬. আহমেদ ভিলায় সকাল থেকেই সাজ সাজ রব। আত্মীয় স্বজনেরা দ্রুত পায়ে এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছে৷ ছোটো ছোট বাচ্চা গুলোর কোলাহলে সারা বাড়ি মুখোরিত। রুনিয়া আজ মহা ব্যাস্ত। তার হাক ডাক শোনা যাচ্ছে থেকে থেকে। আয়েশা কেও দেখা যাচ্ছে প্রচন্ড ব্যাস্ততায় তিনি এঘর থেকে ওঘরে গিয়ে কিসব জিনিস পত্র সংগ্রহ করে এদিক ওদিক ছুটছেন৷
মেহমান রা সব বাড়ির ছাদের দিকে এগোচ্ছে৷ সেখানে চিলেকোঠার রুমের পাশের ফাকা জায়গাটাতে স্টেজ তৈরি করা হচ্ছে, রাতের জন্য৷ গায়ে একটা সাদা রঙা পাঞ্জাবি পরে রাফসান সেসবের তদারকি করছে৷ স্টেজ তৈরির লোকজন দের কে ইন্সট্রাকশন দিচ্ছে ও৷
রাফসানের স্ত্রী, আফসানা এলো রান্না ঘরে, দরজায় দাঁড়িয়ে রুনিয়া কে আমতা আমতা করে বলল,
— ফুপ্পি, শাফিন ভাইয়া কি বাইরে সবার সামনে গোসল দিতে রাজি হবে? ও তো আবার একটু অন্যরকম! গায়ে হলুদ টলুদ ছোয়াতে দিবে কিনা কে জানে?
রুনিয়া আয়েশার সাথে রান্না ঘরে বসে ছোট ছেলের গায়ে হলুদের নাস্তার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, আর নিজেদের ভেতরে টুকটাক গল্প করছিলেন৷ আফসানার কথায় মুখের স্মিত হাসি টা তার নিভে গেলো। তার তো মনেই ছিলো না, যে তার ছোট ছেলেটা আর আগের মতো নেই, বদলে গেছে অনেক। শুধু তার ছোট ছেলে নয়, বদলে গেছে সেও। তার পরিবারের সবাই!
চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে এলো রুনিয়ার। কিন্তু চোখের বাস্প কে আবার চোখেই টেনে নিয়ে হাতের কাজ টা সরিয়ে রেখে তিনি বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে আফসানা কে বললেন,
— আমি ওর কাছে শুনে আসছি। ও যেভাবে বলে সেভাবেই প্রস্তুতি নিও তোমরা। তার বেশি কিছু করার দরকার নেই। জানোই তো ওর মেজাজ কেমন!
আফসানা মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো। রুনিয়া রান্নাঘর থেকে চলে যেতেই আয়েশা জিজ্ঞেস করলেন,
— রাফসান কোথায় আফসানা?
আফসানা রুনিয়ার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ছিলো। আয়েশার কথায় চমকে তাকিয়ে বলল,
— উনি ছাদে আছেন আম্মা, স্টেজের ওইখানে আছেন৷
আয়েশা রান্না ঘরের বাইরের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলেন,
— রাদিফ আর রুহানি কোথায়? আশেপাশে তো দেখছিনা!
— ওরা বাইরে অন্য বাচ্চাদের সাথে খেলছে আম্মা! এতক্ষন এখানেই ছিলো।
আয়েশা একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
— বাচ্চা গুলোর ওপর নজর রেখো, কোথায় যাচ্ছে, কি করছে না করছে! কোথাও আঘাত টাঘাত লাগিয়ে না বসে!
আফসানা শাশুড়ির কথায় সায় জানিয়ে বলল,
— ঠিক আছে আম্মা, আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। আমি এখন ওদিক টায় যাই, গিয়ে দেখি ওরা কতদূর কি এগোলো।
আয়েশা আচ্ছা বললে আফসানা চলে গেলো রান্নাঘরের দরজা থেকে। আজ আট বছর হলো সে রাফসানের বউ হয়ে এসেছে, দুই বাচ্চার মা হয়েছে। তবুও কোথায় যেন কিছু একটা ফাকা তার থেকে যায়। এই দুই পরিবারের কিছু একটা মিসিং। কেউ তেমন হাসে না, কারো সাথে কথা বলে না! আর বললেও সেটা অনেক চাপা সুরে, যেন কেউই সেটা শুনতে না পারে৷ এখন রান্না ঘরে গিয়েও সে দেখলো তার শাশুড়ী আর ফুফু শাশুড়ী নিজেদের ভেতর চাপা সুরে কিসব আলোচনা করছে।
তার স্বামী রাফসানও তার দেবর শাফিনের সাথে এইভাবে চাপা গলায় আলোচনা করে প্রায় সময়। বিয়ের পর প্রথম প্রথম যখন সে রাফসান কে দেখতো ফোনে কারো সাথে আস্তে আস্তে কথা বলছে, তখন তার মনে কি সন্দেহ টাই না দানা বেধেছিলো! কিন্তু পরবর্তী তে যখন জানলো যে ফোনের ওপাশের ব্যাক্তি টা আর কেউ না তারই ফুফাতো দেবর, তখন সে যেন আকাশ থেকে পড়লো! ভাইয়ে ভাইয়ে এমন গুজুরগুজুর ফুসুরফুসুর করার মানে টা কি সে বুঝে উঠতে পারতো না। এখনো পারেনি। কেউ তাকে কিছুই বলে না, যে কোথায় কি চলছে, তাকে দেখলেই সবাই কেমন চুপ হয়ে যায়। তাকে সবাই পর পর ভাবে যেন। সেই অভিমানে এখন আর আফসানা কিছুই শুনতে চায় না কারো কাছে!
.
শাফিন নিজের ঘরে বসে জামা কাপড় গোছাচ্ছিলো। দরজায় কড়া নড়তেই শাফিন কাপড় গোছানো রেখে দরজা খুলে দিলো। তারপর আবার নিজের কাজে লেগে পড়লো৷ রুনিয়া ভেতরে এসে বসলেন বিছানায়৷ শাফিন মায়ের দিকে দৃষ্টি দিচ্ছে না। রুনিয়া বসে বসে ছেলে কে দেখতে লাগলেন। তার ছোট্ট ছেলেটা আজ কত বড় হয়ে গিয়েছে৷ বয়স তার এখন ত্রিশ ছুই ছুই। আগের সেই হাসি খুশি শিশুসুলভ মুখের জায়গায় এখন এক খোচাখোচা দাড়ি ওয়ালা, রুক্ষ, গম্ভীর মুখ স্থান পেয়েছে৷ ভ্রু দুটো কুচকে আছে বিরক্তিতে, ঠিক সাফওয়ান এর মতো। ভাইয়ের রাস্তাতেই হাটছে এটাও৷
কিছুক্ষণ চুপ থেকে তিনি শাফিন কে জিজ্ঞেস করলেন,
— আফসানা রা তোর গায়ে হলুদ ছোয়াবে বলছে, গোসল ও করাবে। তোর কোনো সমস্যা আছে?
শাফিন ইস্ত্রি করে রাখা কাপড় গুলো দক্ষ হাতে ভাজ করতে করতে গম্ভীর গলায় বলল,
— এসব যে আমার ভালো লাগে না, সেটা তুমি ভালো করেই জানো মা! আমার গোসল আমি একাই করে নিবো। এসব হলুদ টলুদ ছোয়ানোর কোনো নিয়ম কোথাও নেই। এসব রীতি আমি ফলো করতে পারবো না। তারা সম্পর্কে আমার ভাবি হয়, আর তাদের কে আমি অতো ভালো ভাবে চিনিও না, তারা কেন আমার গায়ে হাত দেবে মা? রুমি আপু হলে আমি সব মেনে নিতাম। কিন্তু সে নেই, তাই এসবের ভেতরেও আমি নেই।
রুমির কথা উঠতেই রুনিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। তারপর চোখে মুখে অসহায়ত্ব ফুটিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— ওরা কি আর একবার ও যোগাযোগ করেছে?
শাফিনের রাগ লাগলো খুব! ভাইয়ের কথা মনে পড়তেই ওর বুক ভারী হয়ে আসলো৷ অভিমানে গলা ধরে আসলো ওর৷ তারপর রুনিয়ার কথার জবাবে তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
— তারা যোগাযোগ করবে কখন? সময় কোথায় তাদের? লাস্ট যোগাযোগ করেছে তিন টা বছর হয়ে গেছে! বলেছিলো যে সময় পেলেই যোগাযোগ করবে। তাদের সে সময় এখনো আসেনি। আমি গত দু মাস ধরে তাদের কে মেইল করছি যে আমার বিয়ে, কিন্তু তাদের কোনো রেসপন্স নেই। আমার মেইল গুলোও হয়তো দেখার সময় হয়নি কারো৷
রুনিয়া ছেলের অভিমানে ভরা মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন, কিন্তু তার ও যে কিছুই করার নেই। বড় ছেলে কে এক নজর দেখার জন্য তো সেও আজ বারোটা বছর ধরে অপেক্ষা করছে! আর তাদের আদরের রুমি! তাকেও এক পলক দেখার জন্য বুকের ভেতর সারাক্ষণ খচখচ করে!
দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন রুনিয়া আবার ও৷ তারপর ধীর গতিতে উঠে দাড়ালেন বিছানার ওপর থেকে। এরপর ধীর পায়ে চলে গেলেন রুমেই বাইরে৷ পেছন থেকে শুনতে পেলেন শাফিন রাগে তার সদ্য ভাজ করে রাখা পোশাক গুলো ছুড়ে ফেললো কোথাও৷
ছেলে টা বড্ড ভালোবাসে তার ভাই আর রুমি আপুকে। ওরা এ দেশ ছেড়ে চলে যাবার পর থেকেই ছেলেটা পুরোপুরি অন্য রকম হয়ে গেছে। আগের সেই শাফিন কে এখন আর তিনি খুজে পান না৷ সেদিনের পর থেকে শাফিন পুরোপুরি নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। বাইরে বেরোলেই মানুষের নানা কথায় জর্জরিত হতে হতে শাফিন এখন চুপ হয়ে গেছে।
নিজেকে পুরোপুরি পড়াশোনার ভেতরেই ঢুকিয়ে ফেলেছিলো ও, মানুষের কথায় কান না দিয়ে নিজের ভবিষ্যৎ কে আলোকিত করতে সে উঠেপড়ে লাগে একসময়। এরপর বুয়েটে এডমিট হয় সিএসই তে। এরপর আর পেছনে ফেরা লাগেনি। তার পরিবার কে নিয়ে মানুষের সমালোচনা এক সাইডে রেখে সে নিজেকে প্রমাণে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে। প্রতি সেমিস্টারে টপের কাছাকাছি রেজাল্ট করে একসময় বের হয়ে আসে ভার্সিটি থেকে। বাইরে পড়তে যাওয়ার সুযোগ থাকলেও যায়নি ও, শুধমাত্র মা বাবার কথা ভেবে। বড় ভাই তো চলেই গেছে, এখন সেও চলে গেলে তার বাবা মা কে দেখবে কে? মানুষের ওপর আর বিশ্বাস করে না শাফিন। সবার আসল চেহারা দেখা তার শেষ। তার ভাই চলে যাওয়ার পর কে কি কথা বলেছে, কে কি করেছে তাদের সাথে সে সব কিছুই সে মনে রেখেছে। আর এসব তিক্ততার মুখোমুখি হতে হতে সে এখন বদলে গেছে পুরোপুরি। কিন্তু আশার আলো একটাই যে এসবের ভেতরেও সে কারো হাত ধরেছে৷ আর আগামী কাল সে প্রতিশ্রুতি রক্ষার পালা।
রুনিয়া আস্তে আস্তে সিড়ি বেয়ে নেমে এলো নিচে। এখন আর শরীরে আগের মতো জোর নেই। চুল গুলো সব পেকে গেছে। কিছু কিছু কাচা আছে এখনো। তবে ইশতিয়াকের একটা চুল ও আর কালো নেই। তিনি ঘর থেকেই বের হননি সকাল থেকে। লাঠি ছাড়া এখন এক পাও চলতে পারেন না। তার ওপর বৃদ্ধ কালের রোগ ব্যাধি তো লেগেই আছে সারাক্ষন। সব কাজের জন্য তিনি এখন রুনিয়ার ওপর নির্ভরশীল। বাসায় এখন একজনের বদলে দুজন হেল্পিং হ্যান্ড রাখা হয়েছে। তারপর ও সব কাজে তার রুনিয়া কেই লাগবে৷
রুনিয়া সিড়ি থেকে নেমে রান্না ঘরের দিকে যাচ্ছিলেন৷ আফসানাও সেই মুহুর্তে এদিকেই আসছিলো। আফসানা কে হাতের ইশারায় ডাকলেন তিনি। তারপর বললেন,
— শাফিন ওসব করবে না বলেছে বৌমা, ও বলছে গোসল ও একাই দেবে! তোমরা কি প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছিলে?
আফসানা মুখ ভার করে বলল,
— হ্যা ফুপ্পি, আমরা তো গ্যারাজের সামনে টাতে ওর গোসলের সব প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছি। অন্যরা দাঁড়িয়ে আছে সেখানে শাফিনের গোসল দিবে বলে।
রুনিয়া আফসানার বাহুতে হাত ঠেকিয়ে বলল,
— মন খারাপ করে না, জানোই তো এরা ভাই গুলো সব এরকম! আগে এমন ছিলো না। এখন এসে সব অন্যরকম হয়ে গেছে। তুমি ওদের কে ভেতরে আসতে বলো, আর জিনিসপত্র গুলোও ভেতরে নিয়ে আসো। ও একা একাই গোসল দিক। জোর জবরদস্তি করতে গেলে আর ও বেকে বসবে। যাও মা!
রুনিয়ার এমন স্নেহের আবেদনে আফসানার মুখে হাসি ফুটে উঠলো। সে সায় জানিয়ে চলে গেলো বাইরে। রুনিয়া আবার গেলো রান্নাঘরের দিকে। তারপর আবার নানা রকমের নাস্তা বানানোয় লেগে পড়লো সবাই মিলে।
আফসানা বাইরে বের হতে হতে ওর শ্বশুর বাড়ির কথা ভাবতে লাগলো। এখানে যে কিছু একটা হয়েছিলো সেটা ও জানে, তবে কি হয়েছিলো তা জানে না। জিজ্ঞেস করলেও কেউ বলেনা। রাফসান ও না। রাফসানের সাথে তার অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ। বিয়ের আগে খুব বেশি চেনা জানা তার সাথে আফসানার হয়নি। তখন থেকেই রাফসান কে সে গম্ভীরমুখো আর রগচটা দেখে আসছে।
তার শাশুড়ি প্রায়ই বলেন যে রাফসাম আগে এমন ছিলো না, অন্যরকম ছিলো। কিন্তু এমন হওয়ার কারণ কি সেটাই ও জানে না। ওর নাকি একটা ননদ ও আছে! কিন্তু তাকে আজ পর্যন্ত দেখেনি। তার বিষয়ে কেউ কোনো কথাও বলেনা বাড়িতে। আফসানার দৃঢ় বিশ্বাস যে ওই ননদ টার জন্যই কিছু একটা ঝামেলা লেগেছে বাড়িতে। ননদ টাকে দিনরাত ও মনে মনে অভিশাপ দেয়। অকারণে দুট পরিবার কে এইভাবে নিরানন্দ করার জন্য।
আফসানা গ্যারাজের সামনে গিয়ে সবাইকে বললেন যে শাফিন বাইরে গোসল দিবে না। হলুদ ও ছোয়াবে না। গোসল ও নিজের বাথরুমেই করবে। তারপর সব জিনিস পত্র উঠানোর কাজে লেগে গেলো। কয়েকজন বয়োজ্যেষ্ঠ মহিলা শাফিনের এমন সিদ্ধান্তে বর্তমান প্রজন্মের প্রতি কয়েকটা বিরক্তিকর বাক্য বলে ঘরের দিকে এগোলো।
আফসানার জিনিসপত্র গোছানো যখন প্রায় শেষের পথে ঠিক তখনি তাদের বাড়ির গেইটে এসে হর্ণ দিলো একটা কালো রঙা গাড়ি। আফসানা সহ বাকিরাও তাকালো সেদিকে। মাস ছয়েক আগে নিযুক্ত দারোয়ান গিয়ে বাড়ির মেইন গেইট টা খুলে দিলো। আর তখনি একটা ল্যামবরগিনি উরুজ এস ইউ ভি এসে ঢুকলো আহমেদ ভিলায়।
আফসানা সহ বাকিরা হা হয়ে তাকিয়ে রইলো সেদিকে। গাড়ি টা যে খুবই দামি গাড়ি সেটা বুঝতে আর কারো বাকি রইলো না। সবাই এই হঠাৎ আগন্তুক গাড়িটাকে দেখে স্থীর হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। গাড়িটা এসে থামলো গ্যারাজের ঠিক সামনে। তারপর ড্রাইভিং সিটের পাশের দরজা খুলে বেরিয়ে এলো এক অত্যান্ত লম্বা সুপুরুষ। ফুল স্লিভের একটা অ্যাশ কালারের টি শার্ট আর আর নেভি ব্লু রঙা প্যান্ট পরণে তার৷ বিশাল শরীর টার পেশি গুলো টি শার্টের ওপর দিয়ে ফুটে উঠেছে। লং স্লিভ টা তার বাহুর বিশাল পেশি গুলোকে যেন আকড়ে ধরে আছে৷ কনুই পর্যন্ত হাতের স্লিভ টা গুটিয়ে রাখা, যার কারণে হাতের ওপর ভেসে ওঠা শিরা গুলো এক অদ্ভুত সৌন্দর্য ফুটিয়ে হাত দুটোকে অসম্ভব আকর্ষণীয় করে তুলেছে৷
মুখ ভর্তি খোচা খোচা দাড়ি গুলো এক সমান হয়ে তার পৌরুষত্ব টা আরও ভালোভাবে ফুটিয়ে তুলছে। মাথা ভর্তি ঝাকড়া চুল গুলো রোদ পড়ে চকচক করছে যেন। কপালের ওপর এক ফালি চুল এসে পড়ে আছে তার। চোখের সানগ্লাস টা অনিন্দ্য সুন্দর হয়ে তার মুখের ওপর সেটে আছে।
গাড়ির দরজা আটকে সে এগিয়ে এলো আফসানাদের দিকে। আফসানার হঠাৎ মনে হলো সে যেন তার সামনে হেনরি ক্যাভিল কে দেখছে! চোখের পলক পড়লো না ওর কিছু সময়ের জন্য। লোক টার বয়স টা আন্দাজ করতে আফসানার খুব বেগ পেতে হচ্ছে।
সে এগিয়ে আসতেই চারপাশ এক অন্যরকম নিরবতায় ছেয়ে গেলো। আশে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অন্যান্যরা হা হয়ে দেখছে এই আগন্তুক কে। উজ্জ্বল শ্যমলা রঙা এই অদ্ভুত সুন্দর লোক টা যেন তাদের কথা বলার ক্ষমতা সামান্য সময়ের জন্য কুক্ষিগত করে নিয়েছে!
লোক টি তার ভারী ভারী পা ফেলে সদর্পে এগিয়ে এসে আফসানা সহ অন্যান্য মহিলাদের সামনে দাড়ালো। তারপর গমগমে কন্ঠে জিজ্ঞেদ করলো,
— শাফিন আহমেদ বাড়িতে আছে?
আফসানা এতক্ষন কিঞ্চিৎ হা হয়ে ছিলো। প্রশ্ন শুনে সম্বিত ফিরে পেলো ও। তারপর গলা খাকারি দিয়ে বলল,
— জ্বী তিনি বাড়িতেই আছেন। কিন্তু আপনি কে? আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না!
লোক টা নিজের সানগ্লাস টার মাঝ বরাবর আঙুল দিয়ে সেটাকে চোখের ওপর ঠিকঠাক ভাবে বসিয়ে বলল,
— আপনি আমাকে চিনবেন না। শাফিন কে গিয়ে বলুন ওর ক্যাম্পাসের বড় ভাই এসেছে৷ নেইম, সাদ্দাদ হুসেইন। আর বলবেন, তার সাথে তার স্ত্রী আর সন্তানেরা আছে।
আফসানা জ্বী বলে প্রস্থান করলো৷ লোক টা সানগ্লাসের ভেতর দিয়েই তীক্ষ্ণ চোখে চার দিক টা পর্যবেক্ষন করলো৷ তারপর ভারিক্কি পায়ে আবার হেটে গেলো নিজের গাড়ির দিকে। তারপর গাড়ির জানালায় টোকা দিলো দুইবার৷ আর পরক্ষনেই গাড়ির জানালার কাচ টা একটু খানি নিচে নামলো।
উৎসুক জনতা সে কাচের ফাকে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করলো ভেতরে আর কারা আছে কিন্তু এত দূর থেকে ওইটুকু ক্ষুদ্র জায়গা দিয়ে তারা ভেতরের কিছুই টের পেলো না। লোক টা নিচু হয়ে ঝুকে কয়েক টা কথা বলল গাড়ির ভেতর থাকা রহস্যময়ী কোনো মানবীর সাথে। তারপর কথা বলা শেষ হতেই গাড়ির কাচ টা আবার ওপরে উঠে গেলো।
কিছুক্ষন পরেই বাড়ির মেইন ডোর ঠেলে বের হয়ে এলো শাফিন। গা তার খালি, শুধু কাধের ওপর দিয়ে একটা গামছা ফেলে রেখেছে বুকের ওপর দিয়ে। সে কেবল মাত্র গোসলে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলো। বাথরুমে ঢুকতে যাবে, এমন সময়ে আফসানা এসে বলল কেউ একজন নাকি তার খোজ করছে, তার ক্যাম্পাসের কোন বড় ভাই, সাদ্দাত হুসেইন নাম৷ তার সাথে নাকি তার স্ত্রী সন্তান ও আছে।
শাফিন এমন নামে কাউকে চেনে বলে মনে হয়না, তবুও কৌতুহল বসত ও বাইরে বেরিয়ে এসেছে। উৎসুক মহিলা গুলো এখনো সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে, লোক টার সাথে শাফিনের কেমন সম্পর্ক সেটা দেখার জন্য।
লোক টা পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে ছিলো, বাড়ি টার আশপাশ টায় সে নজর বুলিয়ে যাচ্ছে এসে থেকে। শাফিন কিছুদুর এগিয়ে গিয়েই একটা ধাক্কা খেলো। পেছন থেকে লোক টাকে দেখে মনে হচ্ছে অবিকল তার বড় ভাই দাড়িয়ে আছে। সেই উচ্চতা, সেই চওড়া কাধ, সেই পেশিবহুল শরীর, সেই ঝাকড়া চুল, সেই হাতের ফুলে থাকা শিরা! সব, সব মিল! কে এই লোকটা! সে কি সত্যিই সাদ্দাত হুসেইন!
শাফিন দ্বিধাভরে ধীর পায়ে এগিয়ে এলো লোকটার আরও কাছাকাছি। আর কারো পায়ের শব্দ কানে আসতেই লোক টা ফিরে তাকালো নিজের পেছন দিকে৷ আর তাকে দেখে নিজের জায়গায় স্থির হয়ে গেলো শাফিন। শাফিন কে দেখে লোক টার মুখে ফুটে উঠলো অসম্ভব সুন্দর এক মিষ্টি হাসি৷
শাফিন যেন নিজের চোখ কে বিশ্বাস করতে পারছে না। তার সামনে সত্যিই তার বড় ভাই দাঁড়িয়ে আছে! তার ভাইয়া! তার সাফওয়ান ভাইয়া! এটা কি আদৌ সম্ভব! শাফিন হতভম্বের মতো কিছুক্ষন নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে রইলো, চোখে ওর প্রবল উত্তেজনা আর মুখে বিস্ময়!
আর এরপর ঘোর কাটতেই ও নিজের জায়গা থেকে ছুটে এসে সাফওয়ানের বুকে ঝাপিয়ে পড়লো এক প্রকার। আর মুখ দিয়ে শুধু একবার চাপা সুরে উচ্চারণ করলো,
— ভাইয়া!
.
আফসানা শাফিন কে ডেকে দিয়ে রান্না ঘরে গেলো। সেখানে রুনিয়া আর আয়েশা অন্যান্য দের সাথে মিলে প্লেটে খাবার সাজাচ্ছে। আফসানা গিয়ে রুনিয়া আর আয়েশার মাঝখানে বসে পড়লো তারপর ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,
— শাফিন ভাইয়া তো বলেছিলো ভাইয়ার কোনো বন্ধু বান্ধব কে দাওয়াত দিবেনা। দেখেছো, ঠিকই দিয়েছে, শুধু আমাকে বলেনি! কেউ আমাকে কিচ্ছু বলেনা!
আফসানার এমন ঠোঁট ফোলানোয় আয়েশা মিটিমিটিয়ে হাসলো তারপর বলল,
— ও আবার কাকে দাওয়াত দিয়েছে? আমরাও তো জানিনা! ওর কেউ এসেছে নাকি?
আফসানা উৎসাহী গলায় বলল,
— হ্যা, একজন লোক এসেছে। বলছে সে নাকি ভাইয়ার ক্যাম্পাসের বড় ভাই। খুব বড়োলোক। কি সুন্দর একটা গাড়ি নিয়ে এসেছে জানোনা! কুচকুচে কালো, চকচক করছে। সে লোক টা ইয়ায়ায়া লম্বা, আর হেব্বি সুন্দর দেখতে! বডি কি তার! আমি তো দেখে হা হয়ে গেছি!
আফসানার মুখ থেকে এমন বর্ণনা শুনেই রুনিয়ার বুকের ভেতর ধড়াস করে উঠলো, চকিতে একবার সে আয়েশার দিকে তাকালো, দেখলো আয়েশা ও তার দিকেই তাকিয়ে আছে। কিন্তু সে সম্ভাবনা কে মাথা নাড়িয়ে, উড়িয়ে দিলো রুনিয়া। বুক চিরে তার দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। সেটা কি কখনোই সম্ভব! তার ছেলে কি কখনোই ফিরে আসবে? একটা চাপা কান্না কে ঢোক গিলে নিজের ভেতর টেনে নিলো রুনিয়া। আয়েশা শাড়ির আচলের কোণা দিয়ে চোখ মুছে নিলো। দুজনেই হঠাৎ করেই নিরব হয়ে গেলো। এই নিরবতার কারণ আফসানার বোধগম্য হলো না। একটু আগেও তো হাসিখুশি ছিলো দুজিনেই! সে কি এমন বলে ফেললো! মুখ ভার হয়ে গেলো ওর।
কিছুক্ষণ পরেই রুনিয়ার হেল্পিং হ্যান্ড নাজমা এসে বলল,
— খালাম্মা, শাফিন ভাইজান চিলেকোঠার ঘরের চাবি দিতে কয়ছে। ওনার নাকি কারা আসছে, তাগের থাকতি দেবে! ঘর ডা পরিষ্কার করতি কয়ছে এক্ষুনি।
চিলেকোঠার রুমের কথা শোনা মাত্রই রুনিয়ার মাথা গরম হয়ে গেলো। তিনি বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে কঠিন গলায় বললেন,
— শাফিনের কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? বাড়িতে কি আর কামরা নেই? যে চিলেকোঠার রুমে থাকতে দিতে হবে! মোটেও যেন ওই ঘরে কেউ না ঢোকে, ওকে গিয়ে বল যে আমি মানা করেছি। অন্য রুমের ব্যাবস্থা করতে বল।
নাজমা আইচ্ছা বলে আবার ফিরে চলে গেলো। রুনিয়া ফোস ফোস করতে লাগলো। তারপর দাঁড়িয়ে দাড়িয়েই গজরাতে গজরাতে বলল,
— মাথা খারাপ হয়ে গেছে সবগুলার! আমার ছেলেবৌমার রুমের চাবি চায়! চিলেকোঠার রুমের চাবি চায়! ও আসুক আগে ভেতরে! কোথাকার কে এসেছে, তার জন্য ও চিলেকোঠার রুমের চাবি চাচ্ছে!
আফসানা উঠে এসে রুনিয়া কে ধরলো। রাগে রুনিয়ার গা কাপছে! আফসানা রুনিয়াকে স্থীর হয়ে বসতে বলল, কিন্তু রুনিয়া বসবেনা, সে আগে শাফিনের সাথে কথা বলবে তারপর তার আর কাজ। আফসানা বুঝলো তার ফুফু শাশুড়ী বেজায় ক্ষেপেছে! কিন্তু সামান্য রুম নিয়ে এত ক্ষেপে যাওয়ার কি আছে সেটাই বুঝলো না ও৷ রুনিয়া কে ধরে ওভাবেই দাঁড়িয়ে রইলো ও৷
কিছুক্ষণ পরই শাফিন এলো রান্না ঘরের দরজায়। তাকে দেখেই রুনিয়ার সামান্য ঠান্ডা হওয়া মাথা আবার গরম হয়ে গেলো। তেড়ে এলেন তিনি ছেলের দিকে, তারপর বললেন,
— কি সমস্যা তোর? তুই চিলেকোঠার রুমে কারে থাকতে দিতে চাস হ্যা? তোর কি বিবেক বুদ্ধি লোপ পেয়েছে?
শাফিন তাড়াতাড়ি করে মাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরলো, তারপর বলল,
— মা মা, শান্ত হও, এত হাইপার হইয়ো না। ডাক্তার কি বলেছিলো তোমাকে? মোটেও প্রেশার বাড়ানো যাবে না। তুমি একটু এদিকে আসো, তোমার সাথে খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে। কথা টা শোনার পর তুমি আর এক ফোটাও রাগ করবানা, আমি শিউর!
ছেলের দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো রুনিয়া। তারপর ছেলে কি বলে সেটা শোনার জন্য সে এগিয়ে এলো ডাইনিং টেবিলের কোণাটার দিকে। শাফিন আয়েশা কেও ডেকে নিলো নিজের কাছে। তারপর আয়েশা, রুনিয়া দুজনেই যখন এলো তখন শাফিন চাপা সুরে বলল,
— মা, আর মামি! আপনাদের জন্য বিশাল বড়ো একটা সারপ্রাইজ আছে। তবে শর্ত একটাই, কেউ কোনো রিয়্যাক্ট করবেন না সেই সারপ্রাইজ দেখে। দুজনে একেবারেই স্বাভাবিক থাকবেন, যেন কিছুই হয়নি এমন। এখন দুজনেই বাইরে যাবেন, দরজার সামনে দুজন গেস্ট দাঁড়িয়ে আছে, তাদের কে রিসিভ করবেন। আর আমি যা বলেছি তা মাথায় রাখবেন, নো রিয়্যাক্ট! ওকে?
আয়েশা রুনিয়া দুজনেই ক্রুদ্ধ চোখে তাকালো ওর দিকে, তারপর ও ছেলের কথা রাখতে তারা দুজনেই বলে উঠলো,
— ওকে!
শাফিন এবার ডান হাত টা রুনিয়ার সামনে পেতে দিয়ে বলল,
— এখন চিলেকোঠার চাবি টা দিন, কারণ যারা এসেছে তাদের কে আপনি চিলেকোঠার কামরাতেই থাকতে দিতে চাইবেন, তাই সেটা আগে ভাগেই পরিষ্কার করা দরকার।
রুনিয়ার এবার যেন সন্দেহ হলো। আয়েশার দিকে চকিতে একবার তাকালেন তিনি। দেখলেন আয়েশার চোখ দুইটা কেমন যেন চকচক করছে অজানা কোনো আশায়! রুনিয়া চোখ বড়বড় করে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আবার একবার শাফিনের দিকে তাকালো, আর মায়ের সে চোখ দিয়ে করা প্রশ্নের উত্তরে শাফিন উপরে নিচে মাথা নাড়ালো। চোখ দুটো নিজের অজান্তেই ঝাপসা হয়ে এলো ওর!
রুনিয়ার মনে হলো উনি মাথা ঘুরে পড়ে যাবেন এখনি! শেষ মুহুর্তে নিজেকে সামলে নিলেন তিনি। শাফিন আর ও একবার সতর্ক করে দিলো, বলল,
— আবার ও বলছি, নো রিয়্যাক্ট! তার নাম এখন সাদ্দাত হুসেইন। আমার ক্যাম্পাসের বড় ভাই! মানুষের সামনে তাকে তোমরা সেভাবেই ট্রিট করবা। তোমাদের আবেগ গুলো সব অন্দরমহলের জন্য তুলে রাখো। এখন তোমরা ওদিক টা দেখো, আমি ছাদে গিয়ে রাফসান ভাইয়া কে খবর টা দিয়ে আসি, আর ছাদের কামরা টা পরিষ্কার করতে বলে আসি।
বলেই শাফিন মা আর মামি কে ছেড়ে দৌড়ে গেলো ছাদের দিকে। আর রুনিয়া আয়েশা দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে চোখের পানি ফেললো দু ফোটা। তারপর দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলো দরজার দিকে! কতক্ষন ধরে ওরা বাইরে দাঁড়িয়ে আছে তার ঠিক নেই!
মেইন দরজা তখনো দেওয়া। দরজার এপাশে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে জোরে নিঃশ্বাস ফেললেন রুনিয়া। তার বুকের ভেতর টা ধুকপুক করছে অজানা এক আতঙ্কে। আয়েশা মুখ আচল চেপে দাঁড়িয়ে আছেন, শাফিন সাবধান করার পরও তিনি তার আবেগ কে চাপিয়ে রাখতে পারছেন না। রুনিয়া সেটা খেয়াল করে আয়েশা কে কনুই এর গুতা দিয়ে স্বাভাবিক হতে বললেন। আয়েশা নিজের চোখ মুছে নিয়ে স্বাভাবিক হলেন৷ তারপর রুনিয়া দরজা খুলে মেলে ধরলেন নিজের সামনে!
আর দরজা খুলতেই তারা দেখলেন তাদের সামনেই দাঁড়িয়ে আছে বিশালদেহী সাফওয়ান, যার শরীরের বিশালতার কারণে পেছনের আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না! মুখে তার মিষ্টি হাসি। দাড়ির আড়াল থেকে সে হাসি ছিটকে বের হচ্ছে! তার কোলে তুলতুলে একটা মেয়ে বাচ্চা, পিটপিট করে সে দেখছে তার সামনে দাঁড়ানো এই দুই মমতাময়ী নারী কে।
রুনিয়া আর আয়েশা দুজনেই নিজেদের আবেগ কে চাপা দিয়ে সাফওয়ানের অসাধারণ সুন্দর মুখ টার দিকে তাকিয়ে আছে! যেন কত শত বছরের তৃষ্ণা মিটিয়ে নিচ্ছে দুজনেই। নিজেদের জায়গায় স্থীর হয়ে দাড়িয়ে আছেন তারা। আয়েশার চোখ জোড়া অধীর হয়ে অন্য কাউকে খুজছে। ঠিক সেই মুহুর্তেই সাফওয়ানের পেছন থেকে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এসে রুনিয়া আর আয়েশার সামনে দাড়ালো বছর দশেকের জমজ দুই ছেলে বাচ্চা, যাদের মুখ টা দেখেই আয়েশা রুনিয়া দুজনেই চমকে উঠলো, এ যেন সাফওয়ানের ছোট বেলার ভার্সনের দুইটা কপি দাঁড়িয়ে আছে তাদের সামনে!
খুশিতে রুনিয়া উচ্ছাসের সাথে এসে উঠে মেঝেতে বসে পড়লেন, তারপর বুকে জড়িয়ে নিলেন বাচ্চা দুটোকে। আর সাফওয়ানের কোল থেকে সেই তুলার মতো তুলতুলে বাচ্চা টাকে টেনে নিজের বুকের মাঝে ঠেসে ধরলেন আয়েশা।
সাফওয়ান দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তার মা আর মাতৃসম মামির এই আদরে ভাসিয়ে দেওয়া মুহুর্ত টা উপভোগ করতে থাকলো!
ঠিক তখনই সিড়ির ওপর থেকে ধুপধাপ আওয়াজে কারো নিচে নেমে আসার শব্দ পাওয়া গেলো। আর কিছুক্ষনের ভেতরেই রাফসান কে দেখা গেলো হলরুমে। মুখে এক রাশ হাসি নিয়ে সে এগিয়ে এসে আয়েশা আর রুনিয়ার মাঝখান দিয়ে ফাক গলিয়ে ঝপাৎ করে সাফওয়ান কে জড়িয়ে ধরলো। তারপর জড়িয়ে ধরেই বলল,
— সাদ্দাত হুসেইন! ভাই আমার!
সাফওয়ান শব্দ করে হেসে উঠলো, তারপর চাপা কণ্ঠে বলল,
— কি করছিস, ছাড়, সবাই দেখছে!
সাফওয়ানের কথায় রাফসান ছেড়ে দিলো ওকে, তারপর সাফওয়ান কে ভালোভাবে দেখে নিয়ে ও বলল,
— একটা ফোটাও চেঞ্জ হওনি! যেমন ছিলে তেমনই আছো! আর আমাকে দেখো! ভুড়ি বেড়ে গেছে আমার।
তোমাকে দেখে তো হিংসা হচ্ছে আমার, ভাই!
তারপর আশেপাশে চোখ বুলিয়ে বলল,
— মিসেস কই?
সাফওয়ান চোখ থেকে সানগ্লাস টা খুলতে খুলতে বলল,
— তিনি গ্যারাজে গাড়ি রাখতে গিয়েছেন।
রাফসান সাফওয়ানের চোখের দিকে তাকালো, বাদামী রঙা চোখ জোড়ায় অদ্ভুত সতর্ক দৃষ্টি। তীক্ষ্ণ নজরে চারদিকে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে সে চোখ দুইটা।
আয়েশা আর রুনিয়া বাচ্চা গুলোকে নিয়ে ভেতরের দিকে গেলেন, কত পথ এসেছে, কত কষ্ট হয়ে গেছে তার ঠিক ঠিকানা নেই।
রাফসানও সাফওয়ান কে ভেতরে নিয়ে আসতে আসতে বলল,
— বাবা! ড্রাইভিং ও শিখিয়ে ফেলেছো দেখছি তোমার বউ কে!
সাফওয়ান রাফসানের দিকে একবার তাকিয়ে আবার সামনের দিকে দৃষ্টি দিয়ে মুখে হাসি ফুটিয়ে গর্বের সাথে বলল,
— ইয়েপ! মাই ওয়াইফ হ্যাজ টু বি অলরাউন্ডার!
ততক্ষনে শাফিন ও নিচে নেমে এসেছে। আয়েশা, রুনিয়া বাচ্চাদের নিয়ে গিয়ে সোফায় বসেছে। রাফসান আর সাফওয়ান ও গিয়ে বসলো সেখানে। মেহমানদের কিছু অংশ উৎসুক দৃষ্টিতে দেখছে নতুন আসা এই মেহমান দের কে। অনেকেই নিজেদের ভেতর চাপা কণ্ঠে কথা বলছে আগন্তুক দের নিয়ে। আফসানাও এসে দাড়ালো ওদের কাছে। রাফসান আফসানাকে দেখেই ইশারায় নিজের কাছে ডাকলো, তারপর সাফওয়ানের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল,
— মিট মাই ওয়াইফ, আফসানা মিমি।
সাফওয়ান সৌজন্য সূচক মাথা নাড়ালো। রাফসান এবার আফসানা কে বলল,
— আফসানা, ইনি সাদ্দাত হুসেইন, আমাদের বড় ভাই হন । আমাদের ফ্যামিলির সাথে ওনার খুবই ভালো সম্পর্ক। ওনার সম্পর্কে আস্তে আস্তে তুমি আর ও কিছু জানতে পারবে। এখন বাচ্চা গুলোর জন্য কিছু নাস্তার ব্যাবস্থা করো।
আফসানাও সাফওয়ানের দিকে সৌজন্য সূচক মাথা নাড়িয়ে রান্না ঘরের দিকে এগোলো। সবাইকে হঠাৎ করেই অন্যরকম খুশি লাগছে। এমন টা এর আগে কখনো দেখেনি আফসানা। তার খটকা লাগলো, কিছু একটা তো আছেই এই লোকটার মাঝে৷ রান্না ঘরে শরবত আর কিছু নাস্তা রেডিই ছিলো সেগুলো ট্রে তে করে নিয়ে আবার হলরুমের সোফার দিকে এগুলো আফসানা। তখনি মেইন ডোর ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলো একটা নারী অবয়ব।
তাকে দেখে চমকে উঠলো আয়েশা রুনিয়া সহ শাফিন আর রাফসান ও! তাকে দেখে কোনো ভাবেই চেনার উপায় নেই যে সে এই পরিবারেরই মেয়ে। মুখের আদল বদলে গিয়েছে অনেক খানি। সেই ফোলা ফোলা চোয়াল দুইটা মুখের সাথে মিশে গিয়ে তীক্ষ্ণ হয়ে আছে, জ্ব লাইন দুটি ধারালো হয়ে তার শক্ত ব্যাক্তিত্ব জানান দিচ্ছে। বাদামী রঙা মণিযুক্তি ধারালো চাহনির চোখের ওপরে অবস্থানরত ভ্রু দুইটা টান টান হয়ে আছে। গায়ের রঙে পরিবর্তন এসেছে অনেক। ফোলা ফোলা কমলা রঙের প্রলেপ দেওয়া ঠোট দুইটা টস টস করছে। সেই মোলায়েম মুখ টা এখন কঠোরতায় পরিপূর্ণ।
সাদা আর আকাশি রঙের মিশেলের একটা কামিজ, আর আকাশি রঙা সালওয়ার আর ওড়না পরে আছে সে। গাঢ় খয়েরী রঙা ঘন চুল গুলো পিঠ ময় ছড়িয়ে আছে। সৌন্দর্য যেন ঠিকরে পড়ছে তার। কে বলবে সে তিন বাচ্চার মা! মুখে দীপ্তিময় হাসি ফুটিয়ে সে এগিয়ে আসছে ধীর পায়ে সোফায় বসা মানুষ গুলোর দিকে, তার আজন্ম কাছের মানুষ!
আফসানা এতক্ষন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এই অতীব সুন্দরী মেয়েটার দিকে তাকিয়ে ছিলো। কিন্তু মেয়েটা কাছাকাছি আসতেই ওর চোখ গেলো নিজের স্বামীর দিকে। অসম্ভব রকমের ভালোবাসা পূর্ণ দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে আছে আগন্তুক মেয়েটার দিকে। আফসানার রাগ হলো ভিষণ! তার স্বামী এই মেটার দিকে এইভাবে তাকিয়ে আছে কেন মাথায় এলো না ওর৷ কোথাকার কার বউ, তার দিকে তার স্বামী তাকিয়ে আছে! অথচ রাফসান তার দিকে কখনো এত ভালবাসার সহিত তাকিয়েছে কিনা তা আফসানার মনে পড়ে না। মনে মনে ভেবে নিলো, আগে রাফসান কে জায়গা মতো পাক, তারপর বুঝিয়ে দেবে কত ধানে কত চাল!
মেয়েটি এগিয়ে আসলে শাফিন সাফএয়ানের পাশ থেকে উঠে গিয়ে জায়গা করে দিলো তাকে বসার। ওর মুখে হাসি ধরছে না। অবাক চোখে ও তাকিয়ে আছে আগন্তুক মেয়ে টার দিকে৷ শুধু ও না, সবাই-ই তাকিয়ে আছে। আফসানা লক্ষ্য করলো সেটা। কারো মুখেই যে হাসি ধরছে না সেটা সে খেয়াল করলো৷ তার আজীবন গোমড়ামুখে থাকা এই কাছের মানুষ গুলোর এমন হঠাৎ আনন্দ তার বোধগম্য হলো না।
মেয়েটি পাশে এসে বসতেই সাফওয়ান তার দিকে প্রেমপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে উঠলো,
— ইনি আমার স্নেহের স্ত্রী, রাইয়ানা তাসনিম।
রুমাইশা চোখ চোখা করে তাকালো একবার সাফওয়ানের দিকে। তারপর সাফওয়ানের ওপর থেকে চোখ সরিয়ে নিজের মা আর ফুপ্পির দিকে তাকিয়ে রইলো বড় বড় চোখ করে। আয়েশা ছোট্ট মেয়েটাকে কোলে নিয়ে উঠে আসলো রুমাইশার কাছে, রাফসান জায়গা করে দিলো মাকে বসার জন্য। তারপর আয়েশার কোল থেকে পিচ্চিটা কে নিলো। আয়েশা রুমাইশার পাশে বসে রুমাইশার হাতের ওপর নিজের হাত টা রেখে চাপা গলায় বলল,
— এতদিন পর আমার মেয়েকে কাছে পেয়েও আমি একটু জড়িয়ে ধরতে পারছিনা! একটু কেদে মন টা হালকা করতে পারছিনা! সুখ টা বুকের ভেতরেই কোথায় যেন বেধে আছে, ছড়িয়ে যেতে পারছে না সেটা সারা শরীরে।
রুমাইশা মায়ের চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে নরম গলায় বলল
— চিন্তা করো না মা, কোলাহল আর লোকসমাগম কমলেই যতক্ষণ ইচ্ছা আমাকে জড়িয়ে ধইরো, যত ইচ্ছা কান্না কইরো। এখন কিছুই কইরো না মা! লোকে সন্দেহ করলেই সমস্যা!
রাফসান পাশ থেকে ওর কোলের বাচ্চা টাকে দেখিয়ে রুমাইশা কে জিজ্ঞেস করলো,
— এই তুলার পুতুলে টার নাম কি?
রুমাইশা সহ বাকিরাও হেসে উঠলো ওর প্রশ্ন শুনে। হাসি থামিয়ে রুমাইশা বলল,
— শায়রী হুসেইন রাশা!
এদের জমজ ছেলে দুটো এতক্ষন রুনিয়ার কাছেই ছিলো। এখন মা চলে আসায় গুটি গুটি পায়ে রুনিয়ার কাছ থেকে সরে এসে ওরা মায়ের কাছে এসে দাড়ালো। রুনিয়া কোলে তুলে নিলো একটাকে। আর এইটাকে কোলে তূলে নেওয়ায় অন্য টা গাল ফুলিয়ে সাফওয়ানের কোলে গিয়ে বসলো। সাফওয়ান তাকে ভালোভাবে নিজের কোলে বসালো! নতুন পরিবেশে এসে দুজনেই চুপচাপ হয়ে গেছে। রুনিয়া বলে উঠলেন,
— এদের দুজন কে তো আলাদা করে চেনার উপায়ই নেই দেখছি! কার কি নাম?
রুমাইশা হেসে নিজের কোলের দিকে নির্দেশ করে বলল,
— ইনি শাহমীর হুসেইন,
তারপির সাফওয়ানের কোলের ওপর বসা টার দিকে নির্দেশ করে বলল,
— আর উনি সাদমান হুসেইন।
আয়েশা ভ্রু উচু করে বলল,
— তুমি কিভাবে চিনতে পারো? আমি তো দু মিনিট পরেই ভুলে যাবো কে কোন টা?
সাফওয়ান পাশ থেকে বলে উঠলো,
— ওনার অনেক গুন, উনি কিভাবে যে চিনেন, সে রহস্য আমিও সমাধান করতে পারিনি এখনো!
তখনই সাফওয়ানের কোলে বসা সাদমান গাল ফুলিয়ে তেজী কন্ঠে বলে উঠলো,
— বাবা কখনোই আমাদের কে চিনতে পারে না! আমাকে শাহমীর বলে ডাকে, আর শাহমীর কে বলে সাদমান! বাবা সারাক্ষণ শুধু সবকিছু ঘোলায়!
ছেলের এমন অভিযোগ শুনে সাফওয়ান আর রুমাইশা দুজনেই শব্দ করে হেসে উঠলো। শাফিন বেশ মজা পেলো, ও এগিয়ে এসে রুমাইশার কোল থেকে শাহমীর কে টনে নিয়ে নিজের কোলে উঠিয়ে সাদমান কে উদ্দেশ্য করে বলল,
— আর কি কি করে তোমাদের বাবা?
কিন্তু সাদমান কিছু বলার আগেই শাহমীর ভ্রু কুচকে বলে উঠলো,
— সারাক্ষণ মাম্মাম কে বিরক্ত করে, নিজে মাম্মামের কাছে ঘুমায়, কিন্তু আমাদের কে ঘুমাতে দেয়না! ঘুমালেও অন্য রুমে রেখে আসে! মাঝে মাঝে তো আমাদের কে মাম্মামের কাছে ঘুমাতে দেবে না বলে দরজা দিয়ে দেয়, আর খোলেই না! খুবই অসুবিধা করে বাবা!
শাহমীরের কথা শুনে হোহো করে হেসে উঠলো সাফওয়ান, ওর সাথে হাসিতে যোগ দিলো রাফসান আর শাফিন! রুমাইশা লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে হাসতে শুরু করলো।
অবস্থা বেশি ভালোনা দেখে রুনিয়া গলা খাকারি দিলো তারপর বলল,
— গল্প পরে করা যাবে, তোমরা এখন রুমে গিয়ে চেঞ্জ করে আসো। শাফিনের এখনো গোসল হয়নি। ও গোসল সেরে নিক।
রুনিয়ার কথায় সায় মানলো সবাই। কিন্তু সবার মুখেই মিটিমিটি হাসি লেগে রইলো। আয়েশা উঠে চলে গেলো দেখতে নাজমা মেয়েটা চিলেকোঠার কামরা টার কদ্দুর কি করলো। শাফিন সাদমান কেও সাফওয়ানের কোল থেকে টেনে নিয়ে শাহমীর কে কোল থেকে নিচে নামিয়ে দুজনের হাত ধরে বলল,
— চলো তোমাদের দুজন কে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেবো। শুধু তোমাদের কার নাম কি সেটা আমাকে মাঝে মাঝে মনে করিয়ে দিও। ঠিক আছে?
সাদমান আর শাহমীর দুজনেই অতি উৎসাহে মাথা নাড়িয়ে শাফিনের সাথে এগোলো। রুমাইশা আর সাফওয়ান একে অপরের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট টিপে হাসতে লাগলো। রাফসান ওদের কে হলরুমে রেখেই আবার ছাদের দিকে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো, আর বলে গেলো,
— রুম ঠিকঠাক হলেই তোমরা চলে এসো। আমি ছাদেই আছি। স্টেজ সাজানোর দায়িত্ব আমার ওপরে পড়েছে।
রুমাইশা মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো। রাফসান দ্রুত পায়ে চলে গেলো ছাদের দিকে। ওরা সোফাতে বসেই নিজেদের ভেতর কথা বলতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর আয়েশা নেমে এসে খবর দিলো কামরা তৈরি হয়ে গেছে। দুজনেই ওরা সোফা থেকে উঠে ছাদের দিকে পা বাড়ালো। জার্নির কারণে শরীর ওদের ক্লান্ত। এখন বিশ্রাম নিতেই হবে।
ছাদে উঠে ওরা আত্মীয় স্বজন দের ঠেলে চিলেকোঠার কামরা টার দিকে এগোলো। বহুবছর পর এই কামরা টার সামনে দাঁড়িয়ে পুরোনো স্মৃতি গুলো তাজা হয়ে উঠলো দুজনেরই৷ দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো রুমাইশা। ওর পেছন পেছন ভেতরে ঢুকলো সাফওয়ান। ঢুকেই দরজা লাগিয়ে দিলো। কামরা টা অল্প সময়ের ভেতরেই চকচকা করে দিয়েছে।
এত গুলো দিন পর এই রুম টাতে এসে রুমাইশার বুকের ভেতর টাতে অন্যরকম এক আলোড়ন তৈরি হলো। উচ্ছাসের সাথে হেসে ও পেছন ফিরলো, তারপর দু হাত বাড়িয়ে দিলো সাফওয়ানের দিকে। সাফওয়ান ঘর টার চার পাশে নজর বুলাচ্ছিলো, কোনো পরিবর্তন হয়েছে কিনা দেখার জন্য, কিন্তু কোনো পরিবর্তন ই তার চোখে পড়লো না, ঘর টা সম্পুর্ন আগের মতোই আছে। আর তখনই রুমাইশার বাড়িয়ে দেওয়া হাতের দিকে নজর গেলো ওর। ফিক করে হেসে ও এগিয়ে গেলো রুমাইশার সেই বাড়িয়ে দেওয়া হাতের দিকে, তারপর রুমাইশার আলিঙ্গনে নিজেকে আবদ্ধ করে নিলো।
নিজেদের বিবাহ পরবর্তী সময় টার কথা মনে পড়ে গেলো ওদের। কত খুনশুটি, কত ঝগড়া, কত মনোমালিন্যের সাক্ষী এই ছোট কামরাটা! কত শত স্মৃতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কামরা টার প্রতি পরতে পরতে তার হিসাব নেই। দুজন দুজন কে জড়িয়ে ধরে সেই স্মৃতি গুলোই নিজেদের মস্তিষ্কের ভেতরে আর ও একবার ঝালাই করে নিলো!