আজ ১৫ দিন হতে চললো হুর ফাইয়াজদের বাড়িতে আছে। এর মাঝে কয়েকবার নিজের বাড়ি থেকে ঘুরে এসেছে সে। ভালোই সময় কাটছে তার। ফরিদ সাহেব অফিসে যাওয়া একেবারে কমিয়ে দিয়েছেন। সব দায়িত্ব ফাইয়াজ কে বুঝিয়ে দিয়েছেন। তার মতে তার এখন বয়স হয়েছে। খুব প্রয়োজন ছাড়া তিনি অফিসে যান না। হুরের সাথে গল্প করে সময় কাটে তার।
এই কয়েকদিনে হুর অনেকবার ফারানের রহস্য খোঁজার চেষ্টা করেছে। কিন্তু কোনো প্রকার ক্লু পায় নি। হুরের মতে পুরো রুম সার্চ করা শেষ। কিন্তু এই রহস্য সমাধান হবে এমন কিছুই মিলে নি। ফাইয়াজ ও তার সাথে খুবই স্বাভাবিক আচরণ করে। হুর চায় ফাইয়াজ নিজের মুখে তাকে সব টা জানাক। তার বিশ্বাস আছে ফাইয়াজের উপর। নিশ্চয় বড় কোনো কারণ আছে এসবের পেছনে। ফাইয়াজের চোঁখে নিজের জন্য স্পষ্ট ভালোবাসা দেখে হুর। ফাইয়াজ যে তাকে পা’গ’লে’র মতো ভালোবাসে এটাও তার আচরণে স্পষ্ট। এইতো এই বাড়িতে আসার পরের দিনের ঘটনা। চুরি পড়তে গিয়ে অসাবধানতায় একটা চুরি ভে’ঙে হাতে ঢু’কে যায় হুরের। হালকা একটু ব্লি’ডিং ও হয়েছিল। তাতেই ফাইয়াজের সে কি পা’গ’ল পা’গ’ল অবস্থা। হুর কে যেমন ব’কে’ছে তেমনি যত্ন নিয়েছে ফাইয়াজ।
অবাক করা বিষয় হলো এই বাড়ির সম্পূর্ণ টা সিকিউরিটির মধ্যে থাকে। বাড়ির চতুর্দিক সিকিউরিটি গার্ড দিয়ে ঘেরাও করা। এতো গার্ড হুর আগের বার যখন এসেছিলো তখন দেখে নি। এখন কেনো এতো গার্ড রাখা হয়েছে জানা নেই হুরের। এই বিষয়ে ফরিদ সাহেব কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি জানিয়েছেন বিসনেস করার কারণে তাদের অনেক শ’ত্রু আছে। তারা যখন তখন এ’টা’ক করতে পারে। তারা সুযোগ খুঁজছে ক্ষ’তি করার। তাই ফাইয়াজ সিকিউরিটি কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। হুরের কেনো যেনো মনে হয় ফরিদ সাহেব ও কিছু লুকাচ্ছেন। কিন্তু জানার কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছে না হুর।
তবে একটা জিনিস হুরের বি’রক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজকাল হুর গার্ড ছাড়া কোথাও যেতে পারে না। ফাইয়াজ তার জন্য পার্মানেন্ট দুটো গার্ড দিয়ে রেখেছে। হুর কোথাও গেলে তারা সাথে করে নিয়ে যায় আবার নিয়ে আসে। হুরের নিজেকে ব’ন্দি পাখি মনে হয়। আগে স্বাধীন ভাবে ঘোরাফেরা করতো সে আর লিয়া। কিন্তু এখন কোথাও যেতে পারে না। ফাইয়াজ দুইদিন আগে ক’ড়াক’ড়ি ভাবে নিষেধ করেছে ভার্সিটি থেকে যেনো এদিক ওদিক না যায়। সোজা ভার্সিটি যাবে আর বাড়ি ফিরবে। ঘুরতে ইচ্ছা হলে সে নিয়ে যাবে। তাই লিয়া তাকে নিয়ে যেতে চাইলেও সে পারে না।
——–
— একটা মেয়েকে তোরা ধরে আনতে পারছিস না। তোদের মে’রে ফেলতে বললাম তা পারলি না। উঠিয়ে আনতে বললাম তাও তোদের দ্বারা হচ্ছে না। আজ এতগুলো দিন ধরে তোরা শুধু ব্যর্থই হয়ে যাচ্ছিস। আর ওই মেয়ে সুখে সংসার করছে। তোদের আমি এতো টাকা দিয়ে পুষি কেনো! ইচ্ছা তো করে জানে মে’রে ফেলি সব ক’টা কে ।
গ’র্জে উঠে বললেন মোস্তফা চৌধুরী। তার পোষা লোকদের মধ্যে লিডার ধরণের লোকটা মিনমিন করে বললো,
— স্যার আমরা তোহ এতক্ষনে সাকসেসফুল হয়েই যেতাম। কিন্তু তার জন্যই তো পারছিনা। হুর মেয়ে টা তো কতবার প্রায় ম’র’তেই বসেছিল কিন্তু….। আর এখনো তাকে ক’ড়া সিকিউরিটির মধ্যে রাখা হয়েছে।
মোস্তফা চৌধুরী ফের গর্জে উঠে বললেন,
— এসব শুনতে চাই না আমি। এই শেষবার, শুনেছিস শেষ বারের মতো সুযোগ দিলাম। দুইদিনের মধ্যে আমার ওই মেয়ে কে চাই। তবে এবার মৃ’ত না জীবিত অবস্থায় চাই ; জীবিত। এবার ব্যর্থ হলে উপরে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে নিস।
লোকগুলো মাথা নাড়িয়ে রুম ত্যাগ করলো। তারা জানে মোস্তফা চৌধুরী কতোটা ভ’য়া’ন’ক। সে যা বলে তাই করে।
মোস্তফা চৌধুরী দাঁড়িতে হাত বুলিয়ে দাঁতে দাঁত পি’ষে বললো,
— সময় এসে গেছে। এবার শুধু রাণী কে চাই না ; রানীর সাথে রাজাকেও নিজের হাতের মুঠোয় চাই। রাজার সামনে রাণী কে মা’র’বো তাহলেই না খেলায় মজা আসবে। তারপর রাজাকেও পি’ষে মা’র’বো। রাজা, রাণী, রাজ্য সব শেষ। অনেক ক্ষ’তি করেছিস আমার রে। সব কিছুর শো’ধ তো নিতেই হবে।
নিজের কথা শেষ করে ভ’য়া’ন’ক হাসিতে মেতে উঠলো মোস্তফা চৌধুরী।
———
অফ পিরিয়ডে ক্যান্টিনে বসে আছে লিয়া আর হুর। দুইজন কফি খেতে এসেছিলো। হঠাৎ করে হুর বলে উঠলো,
— দোস্ত কতদিন তোর সাথে আমাদের প্রিয় পার্কে যাই না বল! আমার না খুব যেতে ইচ্ছা করছে। এই বন্দি বন্দি জীবন আর ভালো লাগে না। ওই পাহালোয়ান মার্কা গার্ড গুলো সারাক্ষন আগে পিছে লেগে থাকে।
লিয়া মুখ টা গোমড়া করে বললো,
— আসলেই রে কতদিন যাই না। আমারও খুব ইচ্ছা করে। কিন্তু ফাইয়াজ ভাইয়ার অনুমতি ছাড়া….
নিজের কথা সমাপ্ত করতে পারলো না লিয়া। তার পূর্বেই হুর লাফিয়ে উঠে বললো,
— আইডিয়া! চল দোস্ত লুকিয়ে বের হয়ে যাই।
লিয়া বলে উঠলো,
— না,,, না পরে আবার কোনো সমস্যা হলে! আর ফাইয়াজ ভাইয়ার অনুমতি ছাড়া যাওয়া ঠিক হবে না। নিশ্চই কোনো সমস্যা হতে পারে বলেই তোকে ক’ড়া পাহারার মধ্যে রেখেছে। আমার মনে হয় না এভাবে যাওয়া ঠিক হবে।
হুর লিয়ার হাত ধরে বললো,
— আরে এতো পে’রা খাচ্ছিস কেনো! কিছুই হবে না। আমরা ভার্সিটির পেছন দিকে যে দরজা আছে ওখান থেকে বেরিয়ে যাবো। এক ঘন্টার মতো থেকে ক্লাস শেষ হওয়ার আগেই চলে আসবো। কেউ জানতে পারবে না। আর আমরা তো মাস্ক পড়ে যাবো কেউই চিনবে না আমাদের।
মনে দ্বি’ধা থাকা সত্ত্বেও রাজী হলো লিয়া। আসলে তারও যাওয়ার ইচ্ছা আছে। অনেক দিন ধরেই ইচ্ছা করছিলো কিন্তু ফাইয়াজের অনুমতি নেই তাই বলে নি। দুই বান্ধুবী চুপিচুপি পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে পড়লো নিজ গন্তব্যে।
——–
প্রায় ৫০ মিনিট হতে চললো লিয়া আর হুর পার্কে এসেছে। আজ পার্ক অন্য দিনের তুলনায় অনেক বেশি শান্ত। একেবারেই মানবশূন্য বলা যায়। অনেক দূরে দুই একজন মানুষ আছে। হুর আসার পথে কিছু চিপস আর কোল্ড্রিংকস নিয়ে এসেছিলো। অনেকদিন পর দুই বান্ধুবী ভালো সময় কাটিয়েছে। হুর লিয়াকে বললো,
— চল দোস্ত এবার উঠি। আর কিছুক্ষন পর ভার্সিটি ছুটি হয়ে যাবে। তার আগেই আমাদের পৌঁছতে হবে।
লিয়া সায় জানিয়ে উঠে দাঁড়ালো। কিন্তু পিছে ঘুরতেই আ’ত্মা কেঁ’পে উঠলো হুর আর লিয়ার। কয়েকজন গু’ন্ডা প্রকৃতির লোক বি’শ্রী হাসি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভ’য়ে লিয়া আর হুর একে অপরের হাত শ’ক্ত করে চে’পে ধরলো। চোখে চোঁখে ইশারা করে পাশ কা’টিয়ে যাওয়া ধরতেই পুনরায় সামনে আসলো লোকগুলো। হুর নিজের মন কে শ’ক্ত করে বললো,
— কি ব্যাপার পথ আটকাচ্ছেন কেনো আপনারা! যেতে দিন আমাদের।
লোকগুলোর মধ্যে একজন খুবই জ’ঘ’ন্য হাসি দিয়ে বললো,
— কি করে যেতে দেই মামুনী! কতো সাধনার পর আমাদের হাতের নাগালে পেলাম তোমায়। তোমাকে ছেড়ে দেয়া মানে আমাদের জীবনের মায়া ত্যাগ করা। এখন তুমি ভালোয় ভালোয় আমাদের সাথে যাবে নাকি অন্য পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে!
হুরের কা’ন্না চলে এলো লোকটার কথায়। এখন বুঝতে পারছে ফাইয়াজের কথা অমান্য করে কতো বড় ভুলটা করেছে। এই জন্যই হয়তো হুর কে এতো ক’ড়া পাহারার মধ্যে রাখতো ফাইয়াজ।
হুর লিয়াকে ইশারায় কিছু বোঝালো। এরপর হঠাৎ দুইজন প্রা’নপনে ছু’টতে লাগলো। হুররা পালাচ্ছে বুঝতে পেরে লোকগুলোও তাদের পিছু নিতে শুরু করলো। হুর আর লিয়ার হাত ছুঁ’টে গেছে অনেক আগেই।
লোকগুলোর মধ্যে একজন হাতে থাকা লোহার দন্ডটা হুরের দিকে ইশারা করে ছু’ড়ে মা’র’লো। মুহূর্তের মাঝে মাটিতে মুখ থু’ব’ড়ে পড়লো হুর। পা থেমে গেলো লিয়ার ও। প্রানপ্রিয় বান্ধুবীর এই অবস্থা সহ্য করতে পারলো না লিয়া। মুখ চে’পে ধরে কেঁ’দে উঠলো। লোকগুলোও থেমে গেলো। একে অপরের দিকে তাকিয়ে বি’শ্রী’ভাবে হাসতে লাগলো।
চোখেজোড়া নিভুনিভু করছে হুরের। মাথার পেছন দিক থেকে গরম তরল জাতীয় কিছু গড়িয়ে পড়ার অস্তিত্ব অনুভব করলো হুর। হুরের মনে হচ্ছে আজই তার জীবনের শেষ দিন হতে চলেছে।
লোকগুলোর মধ্যে একজন বললো,
— সাথের টাকেও ধর। একে স্যারের কাছে দিবো আর আরেকটা আমাদের কি বলিস তোরা!
সবাই মিলে বি’ক’ট শব্দে হাসতে লাগলো। লিয়া হুরের কাছে আসতে নিলে হুর অনেক ক’ষ্টে গলায় জো’র দিয়ে বললো,
— পা,,পালা লিয়া। আ,, আমার কাছে আসিস না।
লিয়া তারপরও আসতে চাইলে হুর হাত জো’র করে চোখ দিয়ে কা’কু’তি-মি’নতি করতে লাগলো যেনো লিয়া পালিয়ে যায়। তার ভুলের জন্য এই মেয়েটা কেনো শা’স্তি পাবে। তার ভাগ্যে যা আছে হবে। ফাইয়াজের নাম বিড়বিড়িয়ে জ্ঞান হারালো হুর।
হুরের চোখ দিয়ে করা অনুরোধ ফেলতে পারলো না লিয়া। চোঁখের পানি মুছে উল্টোদিকে দৌড় দিলো। বান্ধুবী কে এই অবস্থায় ছেড়ে যেতে বুকটা ছি’ন্ন বি’চ্ছি’ন্ন হয়ে যাচ্ছে লিয়ার। কিন্তু কিছু করার নেই। পালাতে পারলে ফাইয়াজ কে জানাতে পারবে। একমাত্র ফাইয়াজ ই পারবে হুরকে এই বি’প’দ থেকে রক্ষা করতে।
দুইজন লোক লিয়ার পিছনে ছুটলো কিন্তু লিয়াকে না পেয়ে ফেরত এলো তারা। নিজেদের মধ্যে হা হু’তাশ করতে করতে হুর কে গাড়িতে তুলে প্রস্থান করলো।