তড়িৎ গতিতে রুমের ভেতর আপাদমস্তক কালো পোশাক পরিহিত এক লম্বা চওড়া ব্যাক্তি ঢুকেই দরজাটা বন্ধ করে দিলো।
হকচকিয়ে গেলো রুমাইশা। ভয়ে হাতে ভর দিয়ে বিছানার এক কোণায় সরে গিয়ে আয়েশা কে কল দেওয়ার জন্য ফোনের সুইচ টিপলো ও,
‘এ কি! ফোনের নেটওয়ার্ক নেই কেন! কি হলো নেটওয়ার্কের, একটু আগেও তো ছিলো!”
বিস্ফোরিত নয়নে আগন্তুকের দিকে একবার তাকিয়ে আবার ও ফোনের দিকে তাকালো রুমাইশা! জোরে জোরে নিঃশ্বাস পড়তে লাগলো ওর। ভয়ে বুকের ভেতর দিড়িম দিড়িম করছে।
আগন্তুক ধীর পায়ে হেটে বিছানার নিকটবর্তী হলো।
ফোনের আশা ছেড়ে দিয়ে চিল্লানী দেওয়ার প্রস্তুতি নিতেই আগন্তুক গম্ভীর গলায় বলে উঠলো,
— চিল্লিয়ে কোনো লাভ হবে না, কারণ মামা মামি এখন খুব দারুণ ঘুম দিচ্ছেন। আর বাড়ির পুরো নেটওয়ার্ক সিস্টেম ডাউন।
কণ্ঠ টা কানে আসা মাত্রই চমকে তাকালো রুমাইশা। ওর সমস্ত ভয়, সমস্ত উৎকণ্ঠা নিমিষেই যেন উবে গেলো। দ্রুতগতিতে চলা হৃৎপিণ্ড টা আবার ও তার স্বাভাবিক ছন্দে ফিরে এলো৷
— সাফওয়ান ভাইয়া! আপনি! এত রাতে, এখানে! কখন এসেছেন আপনি? আর কিভাবে এসেছেন? গেট তো বন্ধ!
বিস্মিত হয়ে বলল ও।
— তুই যখন লাউ বেগুনের স্বাস্থ্য দেখছিলি তখন।
নির্বিকার গলায় বলল সাফওয়ান।
— আপনি তখন এসেছেন, তাহলে আপনাকে দেখিনি কেন? কোথায় ছিলেন আপনি? আর আপনি এখানে এত রাতে কি করছেন?
রুমাইশার প্রশ্ন গুলোকে সম্পুর্ন উপেক্ষা করে চোখের গগলস টা খুলে বিছানায় উঠে বসলো সাফওয়ান, তারপর বাম হাত টা বাড়িয়ে দিলো রুমাইশার দিকে।
— এদিকে আয়, দেখি তোর জ্বর কতখানি কমেছে।
কিছুক্ষণ ইতস্তত করে বিছানার কোণা থেকে আস্তে আস্তে এগিয়ে এসে সাফওয়ানের থেকে কিছুটা দরত্ব রেখে বসলো রুমাইশা।
সাফওয়ান ওর বরফ শীতল হাত টা রুমাইশার কপালে স্পর্শ করলো।
তপ্ত কপালে এমন শীতল স্পর্শ পেয়ে আবেশে চোখ বুজলো রুমাইশা। চোখে মুখে ওর তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠলো।
রুমাইশার তৃপ্তি মাখা মুখের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সাফওয়ান। ঠোঁটের কোণে স্মিত হাসি ফুটে উঠলো ওর৷
— বললেন না তো আপনাকে দেখিনি কেন!
চোখ দুটো বন্ধ রেখেই জিজ্ঞেস করলো রুমাইশা
— আই ক্যান কেমোফ্লজ, দ্যাটস হোয়াই।
সাথে সাথেই চোখ মেললো রুমাইশা।
‘কেমোফ্লজ! অজগর টা কেমোফ্লজ ও করতে পারে! অজগর থেকে এখন গিরগিটি নাম দিতে হবে নাকি?” মনে মনে ভাবলো রুমাইশা।
ভাবনা চিন্তার পাট চুকিয়েই ঝাঝালো গলায় জিজ্ঞেস করলো,
—আপনি কেন এসেছেন? কাল আমাকে ওভাবে টর্চার করে আপনার শান্তি হয়নি? আপনি আবার কেন এসেছেন? আর কি করেছেন আমার বাবা মায়ের সাথে, যে আমি চিল্লাইলে তারা শুনতে পাবে না?
—খাবার পানির সাথে স্লিপিং পিল মিশিয়ে দিয়েছি।
রুমাইশার কপাল থেকে হাত সরিয়ে নিতে নিতে নির্বিকার গলায় বলল সাফওয়ান।
—স্লিপিং পিল মানে কি? আপনি তাদের কে স্লিপিং পিল কেন খাইয়েছেন?
উচ্চ কণ্ঠে বলল রুমাইশা।
—চিল্লাবিনা, তোর কিছু বিষয়ে ক্লিয়ার হওয়ার দরকার আছে। আর এই কাজের মাঝখানে কোনো রকমের ডিস্টার্বেন্স আমি চাই না৷ সে কারনেই ওনারা ঘুমাচ্ছেন, গভীর ঘুম।
শক্ত গলায় বলল সাফওয়ান।
প্রচন্ড রেগে গেলো রুমাইশা,
—কি এমন বিষয় ক্লিয়ার করবেন আপনি যে আমার বাবা মা কে আপনার স্লিপিং পিল দিতে হলো! আমাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করে সফল হতে পারেননি বলে কি এখন আমার বাবা মা কে শেষ করার পথে নেমেছেন?
—তোকে একবার বলেছি চিল্লাবিনা! এত অল্প ডোজে কেউ মরে না, তাই তোর বাপ মা ও মরবে না৷ এখন চুপচাপ আমার কথা শুনবি।
—মরে কি মরে না সেটা বিষয় না। আপনি কাউকে স্লিপিং পিল কেন দিবেন?
তেজী কন্ঠে বলল রুমাইশা৷
সাফওয়ানের ধৈর্যের বাধ ভেঙে গেলো এবার। চোয়াল শক্ত করে দাঁতে দাঁত চেপে রুমাইশা কে হ্যাচকা টান দিয়ে শুইয়ে দিলো বিছানায়, তারপর ডান হাতের আঙুল গুলো দিয়ে ওর চোয়ালদ্বয় চেপে ধরে বলল,
—তোকে বলেছি চিল্লাবিনা, বেশি কথা বলবি তো মেরে পুতে ফেলবো একদম৷
—আমার কাছে আপনি কি ক্লিয়ার করবেন? কেন করবেন? আমি তো ক্লিয়ার হতে চাইছি না। আমি কি একবারও….
বাক্য টা শেষ না হতেই সাফওয়ানের দিকে চোখ গেলো ওর , অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সাফওয়ান ওর দিকে।
তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে নিলো রুমাইশা, বাক্য টা আর শেষ করলো না চুপ হয়ে গেলো।
— আমি এখন যা বলবো চুপচাপ শুনবি, কথার মাঝখানে কোনো প্রশ্ন করবি না৷ তোর সব প্রশ্নের উত্তর তুই আমার কথাতেই পেয়ে যাবি, এরপর ও যদি তোর কোনো প্রশ্ন থেকে থাকে তাহলে তোকে প্রশ্ন করার সুযোগ দেওয়া হবে তখন করবি৷
একটু থেমে সাফওয়ান আবার বলল,
—প্রথমত আমি চাই তুই আমাকে অন্য সব স্বাভাবিক মানুষের মতো করেই ট্রিট করবি; তৃতীয়ত, আমাকে কোনো ভয়ঙ্কর প্রানী মনে করবি না; চতুর্থত, ছোটবেলার ওই দুর্ঘটনা টা কেন ঘটেছে, এর পেছনে কারণ কি, আর ওই ঘটনার পর আমার সাথে কি কি হয়েছে, কি কি ইমপ্যাক্ট পড়েছে সেগুলো সম্পর্কে ধারনা রাখবি এবং আমাকে ভুল বুঝবি না৷
—দ্বিতীয়ত?
চোখ ছোট ছোট করে জিজ্ঞেস করলো রুমাইশা।
—সেটা কথা শেষ হলেই জানতে পারবি৷
— আগে বললে কি হবে?
সাফওয়ানের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো রুমাইশা
কিন্তু পরক্ষনেই সাফওয়ানের কটমট চাহনি দেখে রিনরিনিয়ে বলল,
—ঠিক আছে, ঠিক আছে, আমি কিছু বলছিনা আর! হাইপার হওয়ার দরকার নেই। আপনি বলেন কি বলতে চান।
রুমাইশা কে জানানোর জন্য সাফওয়ান আজ আবার তার অতীত স্মৃতি চারণে ফিরে গেলো…….
” রুনিয়া আর ইশতিয়াকের বিয়ের ৩ বছরেও যখন সন্তান হচ্ছিলো না তখন রুনিয়ার শাশুড়ী সহ অন্যান্য আত্মিও স্বজন আর পাড়াপ্রতিবেশি রা রুনিয়া কে কটু কথা বলতে শুরু করে, এমনকি কেউ একজন একদিন বলেই ফেলে, ‘বাজা মেয়ে’।
একটা সন্তানের জন্য সমস্ত ডাক্তার কবিরাজ এক করে ফেলা রুনিয়া এই মানুষ গুলোর আচরণে প্রচন্ড কষ্ট পায়। ডাক্তার রা দম্পতির কোনো সমস্যা খুজে পায়না, কিন্তু বাচ্চা কেন হচ্ছে না সেটাও বুঝতে পারে না৷
অতঃপর রুনিয়াকে এই সমস্ত অপবাদ থেকে বাচাতে ইশতিয়াক তার বাবা মোস্তফা আহমেদের পরামর্শে রুনিয়া কে সাথে নিয়ে যান দুবাইতে। মোস্তফা আহমেদ তার রিসার্চের কাজে তখন দুবাইতে ছিলেন।
রুনিয়া আর ইশতিয়াক দুবাই পৌছানোর পর মোস্তফা আহমেদের একজন চেনা শোনা ডাক্তারের কাছে যান৷ আর সেখানেই তারা জানতে পারেন টেস্ট টিউব বেবির ব্যাপারে। সন্তান হতে খুব সমস্যা হলে কাপল দের থেকে সিমেন আর এগ নিয়ে ল্যাবে ভ্রুণ ক্রিয়েট করে ফিমেলের জরায়ুতে প্রতিস্থাপন করা হয়৷
ডাক্তারের এই পরামর্শ শুনে সিদ্ধান্ত জানানোর জন্য কিছুদিন সময় নিলেন রুনিয়া আর ইশতিয়াক। সেদিন ফিরে এসে মোস্তফার সাথে আলোচনা করলেন দুজনেই। মোস্তফা বললেন এইটাতে কোনো সমস্যা নেই। বাচ্চা সাধারণ বাচ্চা দের মতোই হবে৷
এরপর বাড়িতে জানালেন তারা। রুনিয়ার মা আয়রা বেগম আর শামসুল প্রথমে একদমই রাজি ছিলেন না৷
রুনিয়ার বাবা আর শাশুড়ী অমত না করলেও মত দিলেন না৷
পরিবার থেকে তেমন সাড়া না পেয়ে আবার ও ভেঙে পড়লেন রুনিয়া। দিন রাত কান্না করতে থাকেন৷
রুনিয়ার একটি সন্তানের জন্য এমন হাহাকার দেখে শেষ পর্যন্ত রাজি হলেন শামসুল আর আয়রা বেগম৷
পরিবারের সম্মতি পেয়ে পরদিনই ডাক্তারের সাথে আবার যোগাযোগ করেন তারা৷ আর সেদিনই ভ্রুণ তৈরির কাজ শুরু করেন ডাক্তার গণ৷
এরপর প্রায় চার মাসের মাথায় রুনিয়ার জরায়ুতে ল্যাবে তৈরি ভ্রুণ টিকে স্থাপন করা হয়৷
ডাক্তার বলে দেন নিশ্চিন্তে বাড়ি ফিরে যেতে কারণ এর পরবর্তী সময়টা স্বাভাবিক প্রেগ্ন্যাসির মতোই কাটবে৷
কিছুদিন পর মোস্তফা আহমেদ সহ ওরা বাড়ি ফিরে আসে৷
কিন্তু প্রেগ্ন্যাসির তিন মাস না যেতেই ভয়ানক রকম অসুস্থ হয়ে পড়েন রুনিয়া৷ পেটের সন্তান যেন খুব দ্রুতই বাড়তে থাকে তার৷
কয়েকদিনের মধ্যেই পেটের আকার ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা নারী দের মতো হয়ে ওঠে রুনিয়ার।
প্রচুর খেতেন তিনি, কিন্তু তার গায়ে কিছুই লাগতো না৷
ক্রমে ক্রমে শুকিয়ে যেতে থাকেন রুনিয়া আর পেট ততোটাই বাড়তে থাকে৷ ঢাউস পেট নিয়ে হাটাচলা করাটাই অনেক কষ্টকর হয়ে পড়ে রুনিয়ার জন্য৷ পেটের সন্তানের এক এক বারের হাত পা ছোড়াছুড়িতে প্রাণ বের হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয় রুনিয়ার।
পুরো প্রেগ্ন্যাসির সময়টা একটিবার ও বমি করেননি রুনিয়া, কিন্তু পাঁচ মাসের মাথায় হঠাৎ করেই রক্তবমি করেন রুনিয়া।
আর এর পর পরই পুরোপুরি বিছানায় চলে যান রুনিয়া। পেটের সন্তান যেন তার সমস্ত শক্তি শুষে নিতে থাকে। হাড় আর চামড়া ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না রুনিয়ার শরীরে৷
প্রচণ্ড পরিমানে দুর্বল হয়ে যান তিনি, মাথা তোলার শক্তি পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেন৷
প্রায় সাত মাসের মাথায় ডেলিভারির পেইন উঠে রুনিয়ার৷ সেদিন হাসপাতালে নিতে নিতেই বুকের পাজরের নিচের দুইটা হাড় ভেঙে যায় গর্ভের সন্তানের চাপে৷ আকাশ বাতাশ কাপিয়ে যন্ত্রনায় চিৎকার করেন রুনিয়া৷
হাসপাতালে নিয়ে সিজার করে বাচ্চা বের করা হয়, কারণ রুনিয়ার শরীরে বিন্দুমাত্র শক্তি তখন আর বেচে ছিলো না৷
সাত মাসের মাথায় হওয়া বাচ্চা প্রিম্যাচ্যুর হবে ধারণা করা হলেও একদম সুস্থ সবল তরতাজা একটা বাচ্চা হয় সেদিন রুনিয়ার।
সিজারের পর রুনিয়ার বুকের পাজরের সার্জারী করা হয়৷
দুইটা মাস বাচ্চা সহ হাসপাতালেই থাকেন রুনিয়া৷ কিছুটা সুস্থ হওয়ার পর নিজ বাড়িতে ফিরে আসেন৷
বাড়িতে সবার আদরে বড় হতে থাকে সাফওয়ান, আর সেই সাথে বাড়তে থাকে তার ক্রোধ আর জেদ৷
এর পরের বছর শামসুল বিয়ে করেন আয়েশা কে৷ তার পরবর্তী বছরেই রাফসান আসে তাদের ঘরে। নতুন একটা খেলার সাথি পেয়ে প্রচন্ডরকম খুশি হয় সাফওয়ান৷ বার বার শুধু শামসুল দের বাসাতেই যেতে চায় রাফসান কে দেখার জন্য। রুনিয়াও সাফওয়ানের আবদারে নিজের বাবার বাড়ি যাওয়ার সুযোগ কিছুতেই মিস করতেন না৷ কয়েকদিনের বিরতিতেই চলে যেতেন৷
সাফওয়ান আট বছরে পড়লে শামসুল আয়েশার কোল জুড়ে আসে রুমাইশা। সেদিন সাফওয়ান সহ সবাই হাসপাতালেই ছিলো৷ একটা বোন হয়েছে শুনে আনন্দ আর ধরে না সাফওয়ানের, সবাইকে বলে রাখে বাবু কে আগে সে কোলে নিবে নইলে কাউকে কোলে নিতে দিবে না।
সাফওয়ানের জেদের কাছে হার মেনে তাই রুমাইশা কে সবার আগে তার কোলেই দেওয়া হয়। আর এই রুমাইশা নাম টাও তারই দেওয়া। ছোট্ট তুলতুলে পুতুলটা কে কোলে নিয়ে সেদিন আদরে আদরে ভরিয়ে দেয় সাফওয়ান৷
এরপর তিনজনই একসাথে সবার আদরে বড় হতে থাকে।
বিগত প্রেগ্ন্যাসির ধকলের কারণে আর পরবর্তীতে আর বাচ্চা নিতে চাননি ইশতিয়াক। কিন্তু রুনিয়ার ছিলো খুব পরিমানে মেয়ের শখ। রুমাইশাকে দেখে তার ও ইচ্ছা হতো একটা মেয়ে বাচ্চার। কিন্তু ইশতিয়াক সরাসরি না করে দেন।
এরপর রুনিয়া আর বাড়ির অন্যান্য দের জোরাজুরি তে শেষ পর্যন্ত রাজি হন বাচ্চা নিতে৷ সাফওয়ান ১০ বছরে পা দিলে আবার ও অন্তঃসত্ত্বা হন রুনিয়া প্রাকৃতিক ভাবেই। কিন্তু এবার আর কোনো সমস্যা হয়না।
প্রেগ্ন্যাসির সময় টাও আগের বার এর মতো খারাপ যায় না রুনিয়ার, স্বাভাবিক প্রেগ্ন্যাসির মতোই কাটে৷
যথাসময় বাচ্চা হয় রুনিয়ার, কিন্তু এবার ও ছেলেই হয়৷
যদিও তাতে আফসোস করেন না রুনিয়া, শাফিন কে খুব খুশি মনেই গ্রহণ করেন তিনি৷
আর নিজের মেয়ে হলে যতটা যত্ন করতেন ততটাই আদর ভালোবাসা দেন রুমাইশা কে৷
“””
সেদিনের সেই দুর্ঘটনার পর হাসাপাতালে যখন ডাক্তার বলেন রুমাইশার শরীরে ব্লাক মাম্বার বিষ পাওয়া গেছে সেদিন সবচেয়ে বেশি অবাক হন রুনিয়া।
মোস্তফা আহমেদ এন্টিভেনম নিয়ে আসার পর সবাই জিজ্ঞেস করেন, সে কিভাবে জানলো রুমাইশার শরীরে ব্লাক মাম্বার বিষ, তাকে তো বলা হয়েছে সাফওয়ান কামড়েছে৷
তখন তিনি বলেন যে, যিনি পরীক্ষা করেছেন তিনি সবার আগে মোস্তফা কেই ইনফর্ম করেছেন, কারণ মোস্তফার সাথে তার জানা শোনা ছিলো অনেক, আর যেহেতু মোস্তফা হারপিটোলজিস্ট তাই তার কাছে এমন রেয়ার সাপের এন্টিভেনম থাকতে পারে৷
রুনিয়া সেদিন স্বার্থপর হন অনেক ৷ নিজের সন্তান কে বাচানোর জন্য শামসুল আর রুনিয়াকে আড়ালে ডেকে নিতে গিয়ে হাতে পায়ে ধরে বলেন যে তারা কেউ যেন সাফওয়ানের নাম বলে না দেয় ডাক্তার কে৷
ডাক্তার যদি জানতে পারে সাফওয়ানের কামড়ে এমন হয়েছে তখন নিশ্চিত সাফওয়ানকে ল্যাবে নিয়ে যাবে ওরা, হয়তো মেরেও ফেলবে৷ রুনিয়ার শ্বশুর মোস্তফা আহমেদ ও অনেক কাকুতি মিনতি করেন সেদিন৷
সেদিন ডাক্তার কে সাফওয়ানের নাম না বললেও রুনিয়ার বাড়ির সাথে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করলেন শামসুল আয়েশা৷ রুমাইশা সুস্থ হওয়ার পর হাসপাতাল থেকে বাড়িতে নিয়ে যান তারা, এরপর প্রায় পাঁচ বছর রুনিয়া দের সাথে কোনো যোগাযোগ ও করেন নি তারা।
রুমাইশা সুস্থ হয়ে গেলেও শুরু হয় সাফওয়ানের জীবনের কালো অধ্যায়৷ সেদিনের পর সাফওয়ান হঠাৎ করেই একদিন আবিষ্কার করলো ও রাতের বেলা দেখতে পাচ্ছে সবকিছু স্পষ্ট। যদিও সেটা দিনের বেলার মতো রঙিন নয়, ব্লাক এন্ড হোয়াইট কিছুটা।
এরপর ক্রমে ক্রমে নিজের মধ্যে আর ও পরিবর্তন দেখতে পেলো সাফওয়ান৷
ওর চোখের রঙ হটাৎ ই পরিবর্তন হতে শুরু করলো৷ চোখের যন্ত্রনায় দাঁতে দাঁত চেপে কাদতো সাফওয়ান,
কালো রঙা মণি দুইটা ধীরে ধীরে ধুসর সবুজ রঙ ধারণ করলো। ওর গায়ের চামড়া ক্রমে খসখসে হতে শুরু করলো, হাত পায়ের গিটে অসহ্যরকম যন্ত্রনা হতো।
নিজের শরীরের এমন পরিবর্তন লক্ষ্য করার সাথে সাথেই নিজেকে ঘরবন্দী করে ফেললো সাফওয়ান৷ স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিলো, শুধু মাত্র পরীক্ষা গুলো কোনোরকমে দিতো, সেটাও ফুল স্লিভ শার্ট, মুখে মাস্ক, চোখে চশমা আর মাথায় ক্যাপ পরে।
রুনিয়া জিজ্ঞেস করলেও কোনো উত্তর দিতো না সাফওয়ান৷ রুনিয়া যেন কিছু টের না পায় তার জন্য দোতলার রুম টা ছেড়ে চিলেকোঠার রুমে শিফট হলো ও৷
একদিকে রুমাইশা কে আঘাত আর তার সাথে বিচ্ছেদের যন্ত্রণা, অন্যদিকে নিজের শরীরের এমন পরিবর্তন, দুই মিলিয়ে মানসিক চাপ যেন পিষে ফেললো সাফওয়ান কে৷
সাফওয়ান যখন পনেরো বছরে পড়লো তখন হঠাৎ ই একদিন ওর ক্যানাইন দাঁতে প্রচণ্ডরকম যন্ত্রণা শুরু হলো। যন্ত্রনায় চোখ মুখ ফুলে গেলো ওর, বিছানার চাদর মুঠি করে ধরে রাখতো তবুও শব্দ করতো না! মা জানলে তো সহ্য করতে পারবে না!
ওর ক্যানাইন দাঁতের অগ্রভাগ তীক্ষ্ণ হতে হতে ক্রমে ধারালো হয়ে উঠলো। নিজের দাঁতে নিজেই ক্ষতবিক্ষত হলো ও৷
কিন্তু কাউকে এসব না বললেও মোস্তফা আহমেদ কে বলল সাফওয়ান। কারণ দাদু ছিলো তার দাদু কম বন্ধু বেশি।
মোস্তফা আহমেদ খুটিয়ে খুটিয়ে দেখলেন সাফওয়ানের সমস্যা গুলো আর সেগুলো নোট করে রাখলেন৷
সাফওয়ানের এ পরিবর্তন গুলো জানার পর কেমন যেন নিঃস্তব্ধ হয়ে গেলেন মোস্তফা আহমেদ। সবার সাথে কথা বলা কমিয়ে দিলেন তিনি।
ছেলের সাথে সাথে বাবার ও এমন পরিবর্তন দেখে কি করবেন ভেবে পেলেন না ইশতিয়াক আর রুনিয়া৷
তার কিছুদিন পর মোস্তফা আহমেদ নিজের রুমে ডাকলেন রুনিয়া আর ইশতিয়াক কে৷
সাফওয়ান কে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দেন তিনি৷
এমন প্রস্তাবে খুব অবাক হন রুনিয়া আর ইশতিয়াক। কারণ জিজ্ঞেস করলে সাফওয়ান যে ডেকে পাঠান মোস্তফা।
সাফওয়ান এলে ওর শরীরের অবস্থা গুলো দেখান তাদের কে৷
নিজের প্রথম সন্তান, এত সাধনার সন্তানের এই অবস্থা দেখে হাউমাউ করে কাদলেন রুনিয়া। ইশতিয়াক বাকহারা হয়ে গেলেন৷
মোস্তফা বললেন, এইখানে থাকলে লোকে সন্দেহ করবে। আর যদি জানতে পারে ওর শরীরে ভেনম ক্রিয়েট হয় তাহলে ওকে মেরে ফেলতেও কেউ দুবার ভাববে না৷
তারপর সমস্ত সিদ্ধান্ত হুট করেই নেওয়া হলো, ইশতিয়াক সাফওয়ান কে বাইরে পাঠানোর তোড়জোড় শুরু করলেন৷ সিঙ্গাপুরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলেন সাফওয়ান কে
সিঙ্গাপুর ইশতিয়াকেরই এক বন্ধু ফ্যামিলি সহ থাকেন৷ সেখানের ই একটা স্কুলে এডমিট করার ব্যাবস্থা করে দিতে বললেন বন্ধু কে, আর আলাদা অ্যাপার্টমেন্ট ও বুক করলেন,
ইশতিয়াকের বন্ধু সাফওয়ান কে নিজেদের সাথে রাখার প্রস্তাব দিলেও তা গ্রহণ করলেন না ইশতিয়াক। কারণ এতে করে বিপদ বাড়বে বৈ কমবে না৷
কয়েক মাসের ভেতর পাসপোর্ট ভিসা সব রেডি করে ফেললেন ইশতিয়াক৷
নিজের পরিজন দের কে ছেড়ে যাওয়ার কথা চিন্তা করতেই বুক টা ফেটে যেতে লাগলো সাফওয়ানের। রুমাইশা কে একবার দেখার তৃষ্ণায় কাতর হয়ে রইলো, কিন্তু দেখা হলো না ওর সাথে, শামসুলের বাড়ির কেউ ফোন তুলল না৷
সাফওয়ানের ফ্লাইটের কিছুদিন আগে মোস্তফা ডাকলেন সাফওয়ান কে৷ রেপটাইল সম্পর্কিত কিছু বই আর রিসার্চ পেপার দিলেন ওকে৷ যেন ও বুঝতে পারে কোন প্রানীর কোন বৈশিষ্ট্য ও নিজের ভেতর দেখছে, আর সেই অনুযায়ী ব্যাবস্থা নিতে পারে৷
সাফওয়ানের ফ্লাইটের আগের দিন সকালে মোস্তফা আহমেদের লাশ পাওয়া গেলো তার রুমে, বিছানায় শোয়া অবস্থায়৷ আর তার পাশেই পাওয়া গেলো কয়েকটি সিরিঞ্জ আর চিঠি। আত্ম*হত্যা করেছেন মোস্তফা আহমেদ।
পুলিশ আসার আগেই চিঠিটা নিতে পড়ে ফেললেন রুনিয়া আর ইশতিয়াক, আর জীবনের সবচেয়ে বড় আঘাত টা বোধ হয় সেদিনই পেলেন তারা৷
চিঠিতে লেখা ছিলো,
” আমি জানিনা কিভাবে বলবো, হয়তো বলার ক্ষমতা নেই বলেই লিখছি৷ এই চিঠি তোমরা যখন পাবে তখন হয়তো আমি আর জীবিত থাকবো না, পরপারে পাড়ি জমাবো৷
আমাকে ক্ষমা করে দিও তোমরা৷ আমি ভুল করেছি অনেক বড় ভুল৷
আমার আদরের নাতি, আমার সাফওয়ানের এই অবস্থার পেছনে একমাত্র আমি দায়ী। ওর এই অবস্থা আমার কারণেই হয়েছে৷
আজ আমার নাতি আমার কারণে নিজের পরিবার, নিজের দেশ ছেড়ে অন্য দেশে পাড়ি জমাচ্ছে৷
ওর এই দেশ ছাড়ার দৃশ্য দেখার ক্ষমতা আমার নেই৷
আমি রেপটাইল নিয়ে গবেষনা করি, জানোই তোমরা৷ বিগত দশ বছর যাবৎ আমি হাইব্রিড ক্রিয়েচারের ওপর রিসার্চ করছি৷ অনেক অনেক প্রানীর ওপর আমি রিসার্চ করেছি, সফল ও হয়েছি৷ কিন্তু বন্য প্রাণির ওপর গবেষণা করতে করতে আমার মানব সন্তানের হাইব্রিডাইজেশনের কথা মাথায় আসে , কিন্তু সেটা বাস্তব করার জন্য কোনো হিউম্যান ভিকটিম কে আমি পাচ্ছিলাম না৷
আর তখনই আমার ছেলে ইশতিয়াক বিয়ে করে। নিজের উচ্চাকাঙ্খার কাছে হেরে গিয়ে আমি নোংরা এক পরিকল্পনা করি৷ রুনিয়ার খাবারে প্রেগ্ন্যান্সি রেসিস্টেন্স পিল মেশাতে থাকি যেন ওর সন্তান না হয়৷
রুনিয়া প্রতিবার ডাক্তার দেখিয়ে আসার পর ওর সব মেডিসিন আমি বদলে দেই। যেন কোনো ভাবেই রুনিয়া অন্তঃসত্ত্বা না হয়৷
আমার ওয়াইফ কে আমি রুনিয়ার বিরুদ্ধে উসকে দিতে থাকি যেন রুনিয়া একটা বাচ্চার জন্য মরিয়া হয়ে উঠে৷ আর আমি যেভাবে পরিকল্পনা করি ঠিক সেভাবেই হয়৷
এরপর ইশতিয়াক কে বলি রুনিয়া কে নিয়ে দুবাই আসতে৷ এইখানে ওরা যে ডাক্তার দেখিয়েছে সে আমারই বন্ধু, তাকে আমিই বলেছিলাম টেস্ট টিউব বেবির প্রতি রুনিয়া কে আকৃষ্ট করতে। আর ও সেটাই করে৷
যেদিন রুনিয়া আর ইশতিয়াকের থেকে এগ আর সিমেন নেওয়া হলো, সেদিনই আমি সেগুলো নিয়ে যাই আমার দুবাইয়ের ল্যাবে৷ সেখানে আমি সহ আমার আর ও কিছু সঙ্গী সাথি দের নিয়ে আমি ব্লাক মাম্বা, কিং কোবরা আর গাবুন ভাইপারের জিন কাটিং করে সদ্যজাত ভ্রূণের কোষে প্রতিস্থাপন করি৷
আর তারপর সেটা রুনিয়ার জরায়ুতে প্রতিস্থাপন করা হয়!
কিন্তু তার কিছুদিন পর থেকেই আমার প্রবল অনুশোচনা হতে থাকে।
নিজের ছেলে, বউমার সাথে এমন বিশ্বাস ঘাতকতা করার পর থেকে আমি অনুতপ্ত হতে শুরু করি, কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে যায়, সাফওয়ান চলে আসে পৃথিবীতে।
কিন্তু সাফওয়ান একদম সুস্থ সবল হয়েই জন্মালো, আমি বুঝলাম আমার রিসার্চ সফল হয়নি৷ সেদিন সুস্থ সবল সাফওয়ানকে দেখে আমার থেকে খুশি আর কেউ হয়নি।
কিন্তু আমার ভুল ভাঙলো সেদিন, যেদিন সাফওয়ান রুমাইশা কে কামড়ে দিলো আর ব্লাক মাম্বার বিষ পাওয়া গেলো ওর শরীরে। আমার খুশি হওয়ার কথা ছিলো কারণ আমার রিসার্চ সফল হয়েছে, কিন্তু আমি খুশি হতে পারলাম না৷
আমার সাফওয়ান ভবিষ্যতে আর কি কি বিপদে পড়তে পারে সেটা ভেবেই আমার শরীর কাপতে থাকে, নিজের ওপর ঘৃণা হতে থাকে আমার৷
আর সেই ভবিষ্যৎ এখন আমাত চোখের সামনেই বাস্তবায়ন হচ্ছে!
তোমরা সবাই আমাকে ক্ষমা করে দিও, আমি জানি আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত হয় না, তবুও ক্ষমা চাইছি আমি। রুনিয়া, তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও, তোমার সন্তানের এত বড় ক্ষতি করলাম আমি৷ আমাকে পারলে ক্ষমা করে দিও তোমরা৷
সাফওয়ান, দাদু! আমাকে ক্ষমা করে দিস৷ তোর জীবন টাকে জাহান্নাম বানিয়ে দিয়েছি আমি, নিজের হাতে তোকে ঠেলে দিয়েছি নিকষ কালো অন্ধকারে। তুই আমাকে ক্ষমা করে দিস৷ তোদের কারো সামনে দাড়ানোর মতো মুখ আমার নেই। তাই আমি চলে গেলাম।
আমাকে ক্ষমা করিস তোরা…….”
চিঠি পড়ে স্তব্ধ হয়ে গেলেন রুনিয়া, যেন শ্বাস নিতে ভুলে গেলেন তিনি!
আর নিজেরই বাবার করা এমন কর্মকাণ্ডে ইশতিয়াক যেন পাথর হয়ে গেলো৷ আর এ চিঠির প্রতিটা শব্দ রুমের বাইরে থেকে শুনে ফেললো সাফওয়ান।
নিজের প্রচণ্ডরকম প্রিয় মানুষ টার হঠাৎ মৃত্যু, আর সেই প্রিয় মানুষ টারই করা বিশ্বাসঘাতকার আঘাতে সাফওয়ানের হৃদয় চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেলো৷ সেদিনের পর থেকে ওর সমস্ত আবেগ গুলো যেন হাওয়ার মতো কোথায় ভেসে চলে গেলো!
পরদিনই সিঙ্গাপুরের উদ্দ্যেশ্যে রওনা দিলো সাফওয়ান। এরপর একটা দিনের জন্য ও বাড়িতে আর আসেনি। দীর্ঘ চৌদ্দ বছরের প্রবাস জীবনে একমাত্র মা ছাড়া আর কারো সাথেই কথা বলেনি, নিজের বাবা ভাইয়ের সাথেও না৷
নিজের এই অভিশপ্ত জীবন টাকে শেষ করে দেওয়ার জন্য কত ভাবে কত রকম চেষ্টা করেছে সে, কিন্তু আল্লাহর ভয়ে পারেনি। মৃত্যুর কথা চিন্তা করলেই রুনিয়ার মুখটা ভেসে উঠে ওর সামনে আর ভেসে উঠে একটা ছোট্ট সুন্দর তুলতুলে পুতুলের মুখ!
এরপর দীর্ঘ চৌদ্দ বছর পর দেশে ফিরেছে ও। সেটাও তার মায়েরই আপ্রাণ অনুরোধে।
নইলে কখনোই দেশে ফিরতো না সাফওয়ান৷ স্বজন বিহীন দেশেই নিজের একাকিত্ব কে সঙ্গী করে জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতো ও!
“””
বিছানায় পাশাপাশি শুয়ে একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছে সাফওয়ান আর রুমাইশা। গল্প করতে করতে কখন যে নিজেও বিছানায় মাথা ঠেকিয়েছে সেটা জানে না সাফওয়ান৷
রুমাইশার চোখের কোণ টা চিকচিক করছে৷
এই মানুষ টা এত কষ্ট নিয়ে কিভাবে এত স্বাভাবিক থাকে! নিজের আপন মানুষের এমন বিশ্বাসঘাতকার পর ও কিভাবে নিজেকে ঠিক রাখে? এই কারণেই কি এত শক্ত হয়ে গেছে সাফওয়ান!
চোখের কার্নিশের পানি ধারণ ক্ষমতা শেষ হতেই টুপ করে এক ফোটা পানি গড়িয়ে পড়লো বিছানায়৷
মৃদু হাসলো সাফওয়ান৷ ডান হাত টা বাড়িয়ে চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া পানির রয়ে যাওয়া রেশ টুকু মুছে দিলো।
কিছুক্ষন চুপ থেকে সাফওয়ান মৃদু কণ্ঠে বলল,
—সেদিন আমি তোকে আঘাত করতে চাইনি রিমু! মোটেই চায়নি! আমি জানিনা কিভাবে কি হয়ে গেলো!
তোকে আঘাত করার পর আমার অবস্থা টা যে কেমন হয়েছিলো সেটা আমি আর আমার আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না!
সাফওয়ানের কথাটা বুকে এসে লাগলো রুমাইশার! অবিন্যস্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিজের বা হাত টা বাড়িয়ে সাফওয়ানের ফুলে থাকা ঝাকড়া কোকড়া চুল গুলোতে বুলিয়ে দিলো।
মাথায় রুমাইশার নরম হাতের স্পর্শ পেয়ে আবেশে চোখ বুজে নিলো সাফওয়ান।
রুমাইশা নিজের হাত টা ধীরে ধীরে সাফয়ানের মুখের কাছে এনে মাস্ক টা খোলার চেষ্টা করলো।
কিন্তু বাধা দিলো সাফওয়ান,
—এখনো জর আছে তোর গায়ে। এমনিতেই কাল ভয় পেয়েছসি, এখন দেখলে আবার ভয় পাবি৷
—পাবোনা ভয়,
জোর গলায় বলল রুমাইশা৷
তারপর আস্তে আস্তে সাফিওয়ানএর মাস্ক টা খুলে ফেললো, মাস্ক টা পাশে রেখে দিয়ে হাতের তর্জনী দ্বারা সাফওয়ানের কুচকুচে কালো অধরজোড়া ছুয়ে দিয়ে ইশারা করলো ঠোঁট আলগা করার জন্য,
সাফওয়ান মাথা নাড়িয়ে না করে দিলো
কিন্তু রুমাইশা শুনলো না৷
—হা করুন একটু, আপনার দাঁত গুলো চেক করে দেখি, আমাকে আবার কোনোদিন কামড় দিলে কতখানি লাগতে পারে!
রুমাইশার চাপাচাপিতে অগত্যা মুখ খুললো সাফওয়ান৷
রুমাইশা ওর তর্জনী দিয়ে সাফওয়ানএর ডান পাশের ক্যানাইন দাঁত টার অগ্রভাগে চাপ দিলো, চাপ টা ক্রমে ক্রমে বাড়াতেই থাকলো৷
আর একটু বাড়াতেই হাত ধরে ফেললো সাফওয়ান।
রুমাইশার হাত টা নিজের মুঠির মধ্যে নিয়ে নিলো।
তারপর কিছুক্ষন রুমাইশার হাত টা নিজের হাতের মধ্যে রেখে ওর দিকে নিশপলক তাকিয়ে রইলো।
এরপর রুমাইশার আর ও একটু কাছে সরে এসে ওর চোখের দিকে সন্ধানী দৃষ্টিতে তাকিয়ে জড়ানো গলায় বলল,
—আমি অনেক একা রিমু। আমার কোনো বন্ধু নেই৷
নিজের সিকিউরিটির জন্য, আর অন্যের সিকিউরিটির জন্য কোনো বন্ধু হয়নি আমার কখনো! নিজের মনে করে দুট কথা বলার মতো কেউ নেই আমার!
আমার মা! আমার কলিজার টুকরা মা কেও আমি কখনো কিছু বলতে পারিনা, সে কষ্ট পাবে বলে। আমার খুব দরকার কাউকে, যে আমার কথা গুলো শুনবে ধৈর্য ধরে, আমার সমস্ত কষ্টু গুলোকে এক নিমিষেই মুছে দেবে! এমন কাউকে আমার খুব প্রয়োজন!
রুমাইশা অবাক চোখে দেখতে লাগলো সাফওয়ান কে।
এই শক্ত খোলসের মানুষ টার ভেতরে যে কারো সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য এতটা তীব্রতা থাকতে পারে তা সে কল্পনাতেও আনেনি৷
কিছুক্ষন চুপ থেকে সাফওয়ান হঠাৎ ই বলে বসলো, আমার বউ হবি রিমু?