এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি থানায় এলো মাজহারুল ইসলাম। থানার ওসি কাসেম মির্জা তার বিশেষ বন্ধু। কাসেম মির্জার অধীনেই এস.আই পদে রমেশ নিয়োজিত রয়েছে। একমাস আগে একই পদে যুক্ত হয়েছে মি.সারিমও। কাসেম মির্জার সামনে চোখ মুখ কুঁচকে দীর্ঘ সময় বসে রইল মাজহারুল ইসলাম। কাসেম তার জন্য চা, পানির ব্যবস্থা করে নিজে থেকেই বলতে শুরু করল,
-‘ তুই কোন চিন্তা করিস না মাজহার। মি.সারিম অত্যন্ত লজ্জিত! অপরাধী তার হাতের নাগাল থেকেও পিছলে গেছে। ‘
কাসেমের বক্তব্য শোনামাত্রই রাগে গর্জে ওঠল মাজহারুল। রিরি করতে করতে বলল,
-‘ হাতের নাগাল থেকে যে অপরাধী পালিয়ে যায়, তাকে আর কোন উপায়ে ধরবে তোর সৈন্যদল?’
কাসেম মাজহারুলকে শান্ত করার যথাসাধ্য চেষ্টা করল। কিছুটা সতর্কতার সহিত পুনরায় বলল,
-‘ তুই চিন্তা করিস না। এই কেসের দায়িত্বটা রমেশের থেকে ছিনিয়ে নিয়ে এস.আই সারিম’কে দিয়েছি। আজ হোক বা কাল অপরাধী ধরা পড়বেই। তুই বরং কেসটা জোরালো করার চেষ্টা কর। বুঝতেই তো পারছিস, ড.প্রণয় চৌধুরী অলিওর চৌধুরীরই আরেক সন্তান। ‘
নিজেকে আর স্থির রাখতে পারলো না মাজহারুল। অস্থিরচিত্তে বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালো। সহসা তার দু-চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠল। কম্পিত কণ্ঠে বলল,
-‘ কাসেম, আমি অলিওরের সন্তানদের ঘাতক’কে নয়, আমি আমার একমাত্র কন্যার ঘাতক’কে ধ্বংস করার জন্য এ’দেশের মাটিতে পা রেখেছি। ওর ধ্বংস না দেখে এ দেশের মাটি আমি ছাড়বো না। আমার সন্তানের অতৃপ্ত আত্মার কসম, প্রণয় চৌধুরী’কে ধ্বংস না করে এ দেশের মাটি আমি ত্যাগ করব না। ‘
চোখেমুখে স্পষ্ট সন্তান হারানোর অসহনীয় বেদনা। বিধ্বস্ত, ভঙ্গুর বক্ষে প্রতিশোধের নেশা! বয়স যেন দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে মাজহারুল ইসলামের। শরীরে বার্ধক্যের চিহ্নও স্পষ্ট দেখতে পেলো কাসেম। মাজহারুল আর এক মুহূর্তও বিলম্ব করল না। কাসেম’কে ভালো, মন্দ দু’টি কথাও বলল না। কেবল নিজগতি পা চালিয়ে থানা থেকে বেরিয়ে গেল। উদ্দেশ্য পাঁচফোড়ন গৃহে গিয়ে মুনতাহার মুখোমুখি হওয়া। কাসেমও ত্বরান্বিত হয়ে কর্মচারী’কে বলল,
-‘ সালাম, মি.সারিমের বাড়ি থেকে যেসব জিনিসপত্র বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে অতিশীঘ্র তা চৌধুরী বাড়িতে পাঠানোর ব্যবস্থা করো। আর হ্যাঁ টাকাগুলো প্রয়াত জমিদার অলিওরের দ্বিতীয় স্ত্রীর হাতেই দেবে। ‘
পাঁচফোড়ন গৃহের সম্মুখে এসে গাড়ি থেকে ধীরগতিতে নেমে দাঁড়ালো মাজহারুল। মনে পড়ে গেল বহুবছর পূর্বে ফেলে যাওয়া এক মায়াময় স্মৃতি। সেই ছোট্ট মুখের আধোস্বরে আব্বু ডাক, নরম তুলতুলে দু’টি হাতে গলা জড়িয়ে ধরা, টোপ করে গালে চুমু খেয়ে খিলখিল করে হাসা। দু-চোখ বুজে দীর্ঘশ্বাস ফেলল মাজহারুল। কানের কাছে বার বার প্রতিধ্বনিত হতে শুরু করল, আব্বু আব্বু ডাকটির, চোখের তারায় ভাসতে লাগলো খিলখিল করে হাসতে থাকা পবিত্র সে মুখশ্রীর। মুখ থেকে অস্ফুট স্বরে বেরিয়ে এলো,
-‘ আমি এক অযোগ্য বাবা। আমাকে ক্ষমা করো প্রাচী! তোমার বোন’কে ভরসা করাটা আমার বড়ো অন্যায় হয়ে গেছে। আমাকে ক্ষমা করে দিস মা। নিরুপায় হয়ে তোকে ছেড়ে ছিলাম। সুন্দর একটা ভবিষ্যৎ দিতে চেয়েছিলাম। ওরা আমার বিশ্বাসের মর্যাদা দিতে পারেনি। ওরা তোকে সুনিশ্চিত জীবন দিতে পারেনি। ‘
হাতের উল্টো পিঠে চোখের পানি মুছে গৃহের ভেতরে প্রবেশ করল মাজহারুল। অমনি একজন পুরুষ কণ্ঠ খ্যাকখ্যাক করে ওঠল,
-‘ এই কে কে? ‘
মাজহারুল ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। বলল,
-‘ চন্দন নেই? ‘
-‘ না হেয় আজ একমাস ধরে কাম ছাড়ছে। ‘
-‘ ওহ তুমি তাহলে নতুন দৌবারিক? ‘
-‘ হ, আপনে কে? ‘
নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে একটু থামলো মাজহারুল। সহজ বাক্যে সে বলতে পারতো সে প্রেরণার ভগিনীপতি! কিন্তু তীব্র ক্রোধে মুখফুটে তা বের করতে পারলো না। বরং মুনতাহার সম্পর্কীয় আত্মীয় হিসেবে বলল,
-‘ আমি এই বাড়ির মেজো বউ মুনতাহার ফুপা। ‘
বাড়ি নয় যেন শ্মশানের মাটিতে পা রেখেছে মাজহারুল। পাঁচফোড়ন গৃহের আনাচে-কানাচে সূর্যের আলোকরশ্মিও বড়ো ফিঁকে মনে হচ্ছে। চারিদিকে কোন সাড়াশব্দ নেই। নিথর, নিস্তব্ধ, গুমোট হাওয়া বইছে চারিপাশে। হঠাৎ বাড়ির ভেতর থেকে বিধ্বস্ত রূপে দৌড়ে এলো প্রেরণা। তার শাড়ির আঁচল মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। পেছন পেছন আম্মা আম্মা ডাকতে ডাকতে ছুটে এলো, শবনম আর জেবা। প্রেরণা এক দৌড়ে এসে মাজহারুলের সম্মুখীন হলো। মাটিতে পড়ে থাকা আঁচলখানি ত্বরিতগতিতে তুলে নিয়ে মাথায় ঘোমটা দিয়ে চারপাশে বিক্ষিপ্ত নজর বুলিয়ে এক চিৎকার দিলো,
-‘ আমার প্রণয় আসেনি, আমার প্রণয় আসেনি? ‘
মাজহারুল হতভম্ব হয়ে প্রেরণাকে আপাদমস্তক দেখলো। কী বীভৎস দেখাচ্ছে প্রেরণাকে! আফসোসের সঙ্গে মাজহারুল বলল,
-‘ কু’সন্তানদের মা’য়ের এমন পরিণতি দেখে অতি আশ্চর্য হওয়ার কিছুই নেই। ‘
শবনম, জেবা দু’জনই এগিয়ে এসে মাজহারুলের পা ছুঁয়ে সালাম করল। শবনম ক্ষীণ কণ্ঠে বলল,
-‘ গাড়ির শব্দ পেয়ে আম্মা এভাবে ছুটে এসেছে। ‘
মাজহারুল তেমন সন্তুষ্ট হলো না। প্রেরণার দিকে দৃঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
-‘ তোমার এই পরিণতি কাম্য ছিল না। ‘
হাউমাউ করে কেঁদে ওঠল প্রেরণা। ধপ করে মাটিতে বসে আর্তনাদ করে বলল,
-‘ মাজহার ভাই আমার সব শেষ, আমার সব শেষ। ‘
শবনম গিয়ে প্রেরণাকে ধরলো। জেবাকে বলল,
-‘ তুমি ফুপামশায়কে ভেতরে নিয়ে যাও। আমি আম্মাকে নিয়ে আসছি। ‘
বৈঠকখানায় পল্লব আর মাজহারুল বসে আছে। তাদের সামনের কেদারায় বিষাদিত মুখে বসেছে অরুণা। প্রেরণা আবারও অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তার কক্ষে শবনম রয়েছে। বাড়ির অবস্থা, অঙ্গনের সুস্থতা সমস্তই ব্যক্ত করা হলো মাজহারুলকে। আগের তুলনায় অঙ্গন কিছুটা সুস্থ। তাকে দেখাশোনা করার জন্য বাইজি গৃহের এক ভৃত্যের কন্যা সখিনা’কে রাখা হয়েছে। অঙ্গন অসুস্থ আগের তুলনায় সুস্থ হলেও একেবারে স্বাভাবিক হওয়ার কোন সম্ভাবনাই দেখা যাচ্ছে না। এই ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রত্যেকেই বিচলিত। তাই প্রেরণার সিদ্ধান্ত ভৃত্য সখিনার সঙ্গে বিয়ে দেবে অঙ্গনের। এমন অসুস্থ ছেলেকে তো আর ভালো ঘরের মেয়েরা স্বামী হিসেবে গ্রহণ করতে চাইবে না। সখিনা দরিদ্র পরিবারের সন্তান। তার মা দীর্ঘ বছর ধরে বাইজি গৃহের দেখাশোনা করছে। বড়োই বিশ্বস্ত তারা৷ তাই এই সিদ্ধান্তে সকলেই মত দিয়েছে। অরুণার সমস্ত বক্তব্য শুনে মাজহারুল তাচ্ছিল্যের সহিত হাসলো। সে হাসিটি সবার দৃষ্টির অগোচরে ছিল। কারণ মুনতাহার থেকে আসল খবর ঠিক জেনেছে সে। সখিনা চারমাসের অন্তঃসত্ত্বা! জমিদার বাড়ির প্রয়াত ছোটো পুত্র রঙ্গনের অবৈধ সন্তানের মা হতে চলেছে সখিনা! তাই নিজেদের বংশধর’কে বৈধতা দিতেই এই মিথ্যার আশ্রয়, এই মিথ্যা বর্ণনা। শেষ পর্যন্ত এ বাড়ির মানুষ অঙ্গনকে ব্যবহার করে রঙ্গনের সন্তান’কে বৈধতা দিচ্ছে? অঙ্গনের প্রতি বিন্দুমাত্র রাগ নেই তার বরং রোমানার জন্য তার জীবনের এই দুর্দশা দেখে বড়োই ব্যথিত হয়েছেন তিনি৷ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো মাজহারুল। কথার ফাঁকে মুনতাহাকেও ডেকে পাঠালো। জেবা গিয়ে ডেকে আনলো তাকে। বাড়ির সকলের মুখেই মলিনত্বের ছাপ স্পষ্ট। কিন্তু প্রেরণা আর মুনতাহা যেন একেবারেই বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। মুনতাহার নিশ্চল, নিস্তব্ধ, মলিন দেহে দেখে মাজহারুল বড়ো আফসোস করল। ক্রোধ মিশ্রিত কণ্ঠে বলল,
-‘ তিনদিন পর আমি আবার আসবো আম্মাজান৷ সঙ্গে তোমার আব্বা’কে নিয়ে আসবো। তুমি তৈরি থেকো। ‘
বাড়ির প্রতিটি সদস্য চমকে ওঠল৷ মুনতাহা একই অবস্থায় ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। বাড়ির প্রত্যকেই খুব ভালো করে জানে চল্লিশ দিন অতিবাহিত হলেই মুনতাহাকে চিরকালের জন্য বাপের বাড়ি নিয়ে যাওয়া হবে!
বিষাদ মুখর পরিবেশেও আতিথেয়তার কমতি ছিল না৷ অথচ কোন কিছুই সন্তুষ্ট করতে পারলো না মাজহারুল’কে। দীর্ঘ সময় বাড়িতে কাটিয়ে বেরিয়ে পড়ল একমাত্র কন্যা রোমানার কবর দেখার জন্য৷
সঙ্গে গেল পল্লব। যাওয়ার পথে বাইজি গৃহে নজর পড়ল মাজহারুলের। গভীর দৃষ্টিতে ঐ গৃহে তাকালো সে। বুকের ভিতরের কষ্টটা পুনরায় মাথাচাড়া দিয়ে ওঠল৷ বিরবির করে বলল,
-‘ রতনে রতন চেনে শূকর চেনে কচু। জমিদারের বংশধর’রা বাইজিই চিনবে। ভদ্রঘরের মেয়েরাতো ওদের বদহজমের কারণ! ‘
[৯৬]
প্রণয়ের বিরুদ্ধ দু’টো খু/নের মামলা করা হয়েছে। দু’টো মামলাই করেছে মুনতাহার বাবা। তাকে ইন্ধন দিয়েছে স্বয়ং মাজহারুল ইসলাম। মুনতাহা বা প্রেরণা কাউকেই ভরসা করেনি মাজহারুল। শত হোক প্রেরণার গর্ভজাত সন্তান প্রণয় । যত যাই হোক না কেন মা হয়ে প্রেরণা কখনোই চাইবে না প্রণয় ফাঁসিতে ঝুলুক। পলাশের চরিত্র সম্পর্কে সবাই অবগত। রঙ্গনের চরিত্রও সুবিধার ছিল না। প্রেরণা চাইলেই প্রণয় যে কোনভাবে মুক্তি পেয়ে যাবে। তাছাড়া সে এখন পর্যন্তও বিশ্বাস করেনি খু/ন প্রণয় করেছে। মুনতাহা অতি সরলা একটি মেয়ে। যতই স্বামী ভক্তি থাকুক কোন অন্যায় তার দ্বারা হবে না৷ স্বামীর খু/নের বিচার চাইলেও প্রেরণার অনুরোধে প্রণয়কে ঠিক বাঁচিয়ে দেবে। এসব বিবেচনায় রেখেই সুযোগ পেয়ে দেশের বাইরে অবস্থান করেও কুকৌশলে সবটা করেছে মাজহারুল। রোমানার মৃত্যুর পর তার বুকের ভিতর যে আগুন জ্বলজ্বল করে ওঠেছিল। পলাশ, রঙ্গনের মৃত্যুতে সে আগুনে ঘি পড়েছে। সেই সাথে প্রণয়ের জীবনটাকে অতি সহজে ধ্বংস করার উপায়ও পেয়েছে। তার মেয়ে কোন অন্যায় করেনি। ভালোবেসে, নিজের সমস্তটা দিয়ে ঘরবাঁধার স্বপ্ন দেখেছিল। অথচ এক বাইজি কন্যার প্রেমে পড়ে তার মেয়ের স্বপ্ন’কে ধ্বংস করে দিয়েছে এই প্রণয়৷ যেখানে তার সন্তান অন্ধকার কবরে অতৃপ্ত আত্মায় হাহাকার করছে সেখানে প্রণয় চৌধুরী এক বাইজি কন্যার সাথে সুখের ঘর বেঁধেছে! সহ্য করতে পারেনি মাজহারুল। তাই দূর থেকেই নিজের লোকজনদের সাহায্যে আইনের মাধ্যমে প্রণয়ের মেডিকেল সার্টিফিকেট বাতিল করিয়েছে। দু’টো খু/নের মামলা করে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে ক্ষেপিয়ে দিয়েছে প্রণয়ের বিরুদ্ধে। কেসটা যাতে কোনভাবে থেমে না যায়, মুনতাহা যেন পিছিয়ে না আসে তাই যতদ্রুত সম্ভব দেশে এসেছে। উদ্দেশ্য একটাই প্রণয় চৌধুরীর বিনাশ!
সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে পাঁচফোড়ন গৃহে উপস্থিত হলো রমেশ। সারিমের বাড়ি থেকে প্রণয়, শাহিনুরের সকল জিনিসপত্র নিয়ে আসা হয়েছে। প্রেরণা শোনামাত্রই অসুস্থ শরীরে বৈঠকখানায় এসেছে। প্রণয়, শাহিনুরের সমস্ত জিনিসপত্র দু’হাতে জাবটে ধরে হাউমাউ করে কাঁদছে সে। রমেশ স্বান্তনা দেওয়ার মতো কোন ভাষা খুঁজে পেলো না। শুধু প্রণয়ের সুটকেসে থাকা টাকাগুলো প্রেরণার হাতে দিলো। সে টাকাগুলোর দিকে রক্তচক্ষুতে তাকিয়ে প্রেরণা আর্তনাদ করে ওঠল,
-‘ ওরে আমার প্রণয় খাবো কী? বাঁচবো কীভাবে? ওরে আমার পলাশ, রঙ্গন আর আমাকে আম্মা বলে ডাকব না৷ তোরা আমার প্রণয়কে আম্মা ডাকার সুযোগ দিস৷ ‘
শবনম এসে প্রেরণার কাঁধ চেপে ধরল। জেবা বেশ শব্দ করেই ডুকরে ওঠল। গৃহের প্রতিটি সদস্য, এবং ভৃত্যদের চোখে অশ্রু ঝড়ছে। পল্লব এসে প্রেরণাকে ডাকলো,
-‘ আম্মা…’
প্রেরণা পল্লব’কে দু’হাতে জাবটে ধরে চিৎকার করে ওঠল,
-‘ ওরে আমার প্রণয়’কে তোরা মারিস না। আমার প্রণয়কে রক্ষা কর। আমার বাছা কী খাবো? কীভাবে বাঁচবো? ওর বউ যে পোয়াতিরে! ‘
অরুণা এসে প্রেরণা’কে বুকে টেনে নিলো। প্রেরণা দুর্বল কণ্ঠে বার বার বলল,
-‘ আমি আর একজনকেও হারাতে চাই না। আমি মা হয়ে আমার রঙ্গন, আমার পলাশের খু/নি প্রণয়কে ক্ষমা করছি৷ ওরা কেন ক্ষমা করে না? ওরা কি আমার থেকেও বেশি হারাইছে? ওদের কি আমার থেকে বেশি গেছে? ‘
[৯৭]
চারিদিকে আজান ধ্বনি শুনতেই চমকে ওঠল প্রণয়। শরীরের সমস্ত শক্তি শেষ তার। আর এগোতে পারছে না। সেই রাত থেকে কোন পথে চলতে শুরু করেছে নিজেও জানে না৷ যেদিকে পথ খুঁজে পাচ্ছে সেদিকেই পা চালাচ্ছে। এর মধ্যে কয়েকবার প্রাকৃতিক প্রয়োজনে মানুষের বাড়িতে গিয়েছে। এরজন্য অবশ্য মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয়েছে। বুকের ভিতর সীমাহীন অসহায়ত্ব লালন করে প্রকাশ করেছে মিথ্যাদের। কেউ তাদের পরিচয় জানতে চাইলে মিথ্যা পরিচয় দিয়েছে, কোথায় যাবে, কোথায় থেকে এসেছে সবটায় শুধু মিথ্যা আর মিথ্যা উত্তর দিয়েছে। এত মিথ্যার বোঝা কাঁধে চেপে ক্লান্তি এসেছে খুব৷ তবুও নিরুপায় ক্লান্ত পথিকের ন্যায় চলেছে অবিরত। সারাদিন জঙ্গল, ঝোপঝাড়, চড়া ক্ষেত, পাহাড়ি পথ হাঁটতে হাঁটতে দুর্বল হয়ে পড়েছিল শাহিনুর। শেষে বাধ্য হয়ে গর্ভাশয়ে থাকা ছোট্ট অংশটাকে হারানোর ভয়ে তটস্থ প্রণয়’কে যখন বলল,
-‘ ডাক্তারসাহেব আমি আর পারছি না। ‘
নিজের সমস্ত ক্লান্তি, দুর্বলতাকে একপাশে রেখে মনোবল দৃঢ় করে গা’য়ে প্রবল শক্তি সঞ্চয় করে কোলে তুলে নিয়েছে শাহিনুরকে। সে অবস্থাতেই দীর্ঘ পথ অতিক্রম করেছে। সারা দিন পেটে দানাপানি বলতে শুধু পানি, ভাগ্যক্রমে একটি কলা পেয়েছিল রাস্তায়। পাহাড়ি অঞ্চলের কলা, হয়তো যানবাহন দ্বারা শহরে নিয়ে যাচ্ছিলো কেউ। সেখান থেকেই দু’একটা রাস্তায় পড়েছিল বোধহয়। সেই কুড়িয়ে পাওয়া একটি কলাই শাহিনুরকে খাওয়িয়েছে। খালি পেটে কলা খেতেও ভীষণ কষ্ট হয়েছে শাহিনুরের। তবুও বাচ্চাটার কথা চিন্তা করে বুকফাটা আর্তনাদ গুলো গোপন করে যেটুকু জুটেছে সেটুকুই খেয়ে নিয়েছে। স্বামীকে অভুক্ত রেখে নিজের ক্ষিধের জ্বালা মেটাতে একটা কলা একাই খেয়ে নিয়েছে।একটু ভাগও প্রণয়কে দিতে পারেনি৷
পুলিশের কাছে ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে এতটাই অস্থির হয়ে পালিয়ে এসেছে যে, একটা পয়সাও সঙ্গে করে নিয়ে আসেনি। যে অবস্থায় ছিল সে অবস্থায় কেবল নিজেদের রক্ষা করার জন্য পালিয়ে এসেছে। অর্থ বিহীন, বস্ত্র বিহীন কীভাবে জীবন পারি দেবে একবারো মাথায় আসেনি৷ পাঁচফোড়ন গৃহের জমিদার পুত্র ড.প্রণয় চৌধুরী। ভাগ্যদোষে আজ সে গর্ভবতী স্ত্রী সমেত ফেরারি। একেই বুঝি ভাগ্যচক্র বলে?
জনমানবশূন্য কোন এলাকায় ঢুকে পড়েছে বুদ্ধিগ্রাহ্য হলো না। শুধু বুঝল, পরিচিত শহর, গ্রাম ছেড়ে অনেক দূরে তারা। পাহাড়ি অঞ্চলেরই গ্রামীণ এক অংশ এটি৷ বুকের অতিনিকটে শরীর ছেড়ে ঘুমে বিভোর শাহিনুর। সূর্যের আলো মিলিয়ে চারিদিকে ঘন অন্ধকার নেমে এসেছে। দিনের শেষে রাতের সূচনা। ঠিক তাদের জীবনের আলো নিভে যাওয়ার পর অন্ধকারের আগমনের মতোই এই রাত্রিটা। নিজের মন্দ কপালের উপরই কিঞ্চিৎ তাচ্ছিল্য সহকারে হাসলো প্রণয়। সত্যি জগতে মানুষের পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী কিছুই হয় না। তাই তো নিজের শেষ সম্বলটুকুও ফেলে এসে ভিখারির মতো সারাদিন পার করেছে। হয়তো এর পর যে কয়টা দিন বেঁচে থাকবে ভিখারি হয়েই বাঁচবে। সহসা বুক কেঁপে ওঠল তার। কী হবে এরপর? কীভাবে বাঁচবে? কীভাবে বাঁচাবে নিজের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা দু’টো প্রাণ’কে? দূরে শেয়ালের হাঁক শোনা যাচ্ছে। তীব্র শীতের মৌসুম। হাড়কাঁপানো শীত যাকে বলে। তবুও প্রণয়ের দেহ থেকে স্বেদজল নিঃসৃত হচ্ছে। দুঃশ্চিতায়, তেষ্টায় গণ্ডস্থল থেকে বক্ষস্থল অবধি শুকিয়ে চৌচির। ক্ষুধার্ত পেট, তৃষ্ণার্ত বুক। কী অসহ্য যন্ত্রণা! নিজের ভারসাম্যটুকুও আর ধরে রাখার উপায় নেই। শরীর দুর্বল হয়ে হাত, পা অবশ হয়ে যাচ্ছে। না পেরে দুর্বল হয়ে আসা হাত দুটো কিঞ্চিৎ সবল করে শাহিনুর’কে আরেকটু বুকে টেনে নিলো। আবছা আলোতে বুঝতে পারলো তার পেছনে একটি গাছ রয়েছে। কী গাছ? বুঝতে পারলো না। মাথাটা প্রচণ্ড ঘুরছে তার, দু’চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। বমি বমি ভাব হচ্ছে। না পেরে গাছের শেকড়ের ওপর বসে পড়লো। নড়েচড়ে ফুঁপিয়ে ওঠল শাহিনুর৷ কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে প্রণয় বলল,
-‘ ভয় পেও না আমি আছি। ‘
প্রণয়ের কণ্ঠস্বর শুনে ভয়াবহ এক আর্তচিৎকার করল শাহিনুর৷ সঙ্গে সঙ্গে ওর মুখে হাত চেপে ধরল প্রণয়। অসহায় কণ্ঠে পুনরায় বলল,
-‘ চুপপ। আমি আছিতো। ‘
নিমিষেই শান্ত হয়ে গেল শাহিনুর। বারকয়েক ঢোক গিলে গলা ভেজানোর চেষ্টা করল। কিন্তু লাভ হলো না। ক্রমেই গণ্ডস্থল শুকিয়ে ওঠল। চারিদিকে নিস্তব্ধতা থাকলেও থেকে থেকে শেয়াল ডেকে ওঠছে৷ ক্ষণে ক্ষণে গাছের পাতা নড়ে ওঠছে। তীব্র শীতে শরীর কেঁপে ওঠছে। একটু পর পর প্রণয়ের বুকের মধ্যেখানে আরো গভীরে যাওয়ার চেষ্টা করছে শাহিনুর৷ নিজের শরীরের সবটুকু উষ্ণতা দিয়ে শাহিনুর’কে তীব্র ঠাণ্ডার পরশ থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে প্রণয়৷ এ মুহূর্তে এক সৃষ্টিকর্তা ছাড়া আর কারো সাহায্য পাওয়া সম্ভব নয়। তাই অতি সন্তর্পণে শাহিনুরকে বক্ষে চেপে, চোখ বন্ধ করে পরম করুণাময়ের নিকট সাহায্য চাইতে লাগলো।