প্রানেশা ধপ করে নিচে বসে পড়লো৷ কী করে সম্ভব এটা? যদি রেয়ান সিঙ্গাপুরেই থাকে তাহলে দুইদিন আগেও এসে ওকে জড়িয়ে ধরলো সে কে? প্রশ্নে মাথা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। নাহ,আর চুপ করে থাকা যাবে না। নাহলে ভালোবাসা চিরকালের জন্য হারিয়ে ফেলবে প্রানেশা। দ্রুত উঠে দাড়িয়ে কপালের উপর জমা ঘাম মুছলো সে৷ দরজা খুলতে হাত বাড়াতেই, কেউ একজন দরজা টান দিয়ে খুলে ফেললো৷ হকচকিয়ে সামনে তাকালো প্রানেশা, রেয়ান দাঁড়িয়ে আছে। প্রানেশা মনে মনে ভাবলো ‘নাহ, এ রেয়ান হতে পারে না। ‘ রেয়ান অদ্ভুত ভঙ্গিতে মুচকি হেসে দাঁড়িয়ে আছে। প্রানেশা ভেতরে ভেতরে ভয়ে কাঁপছে। সাহস করে চিৎকার করে বললো-
‘কে আপনি? আপনি আমার রেয়ান হতে পারেন না ‘
রেয়ানের মাঝে কোনো আলাদা প্রতিক্রিয়া দেখা গেলো না। সে যেনো আগে থেকেই এই ব্যাপারে অবগত। চুপ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে প্রানেশার কোমর ধরে টেনে নিলো৷ প্রানেশা এত শক্তির সাথে না পেরে হাঁপিয়ে উঠলো৷ ব্যাক্তিটি প্রানেশার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো –
‘বলেছিনা প্রাণ? এত রাগ দেখাবে না। আর আমার সাথে তো নয়ই। এখনো চেনোনি আমায়। ‘
কিছুটা থেমে অস্বাভাবিক ভাবে ঘাড় বাকিয়ে বললো-
‘শোনো প্রাণ, আমাকে রাগিও না। এর ফল ভালো হবে না। শুনেছিলাম তোমার বাবার হার্টের অসুখ আছে। এর আগেও দুইবার এট্যাক হয়েছে। একমাত্র মেয়ের বিয়ের আসরে বিয়ে ভাঙলে নিশ্চয়ই সহ্য করতে পারবে না? এবার কিন্তু এট্যাক হলে মারা যাওয়ার সম্ভবনা ১০০ পার্সেন্ট’
প্রানেশা ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। এ কেমন পরীক্ষায় পরলো সে? ঠিকই, এবার যদি বিয়ের আসরে বিয়ে ভাঙে তাহলে আর সে সহ্য করতে পারবে না। কিন্তু বিয়ে করলে, রেয়ান কী করে সহ্য করবে! তার প্রথম ভালোবাসা রেয়ান। তাকে ভূলে এই বহুরূপীর সঙ্গে কী করে সংসার করবে ভেবে পাগল লাগছে নিজেকে প্রানেশার। জোর করে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে জোরে বলে উঠলো –
‘কখনোই না। আপনাকে বিয়ে করবো না আমি। আমার ভালোবাসা রেয়ান। ‘
ব্যাক্তিটি ভীষণ রেগে গেলো। নিজের গায়ের সব শক্তি লাগিয়ে প্রানেশার গলা চেপে ধরলো । ফুঁসতে ফুঁসতে বললো-
‘খবরদার, তোমার মুখে অন্য কারো নাম আমি সহ্য করবো না প্রাণ। তোমার চোখে মুখে, অন্তরে, তোমার দেহের সর্বাঙ্গে শুধু এই আমার বিচরণ চলবে। তুমি আমার প্রাণ, যে আমার প্রাণকে আমার কাছে থেকে ছিনিয়ে নিতে চাইবে তাকে কেটে টুকরো করতে আমি দুবার ভাববো না।’
প্রানেশা বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে । কেমন হিংস্র পশুর মতোন ব্যবহার। এই মানুষটাকে বিয়ে করলে বাঁচার সম্ভবনা আছে কী? মনে সংশয় জাগে প্রানেশার। চোখের পানি পড়তে পড়তে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে৷ ব্যাক্তিটি লম্বা শ্বাস ফেলে প্রানেশাকে ছেড়ে দিলো। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো-
‘বিয়ে ভাঙার কোনো চেষ্টা করবে না প্রাণ। চুপচাপ নিজে যাবে কবুল বলবে। যদি কোনো গন্ডগোল করার চেষ্টা করো তো তোমার রেয়ানকে সিঙ্গাপুরের মাটিতেই পুতেঁ রাখবো’
প্রানেশা শব্দ করা ভুলে গেছে। সে বুঝে গেছে সামনে দাঁড়ানো ব্যাক্তিটি সামান্য কেউ নয়। কতটা শক্তিশালী হলে, ফোনে রেয়ানের সাথে কথা বলে যে সত্যিটা প্রানেশা জেনে গেছে তা নিমিষেই ধরে ফেললো। অর্থ ও শক্তি দুটোই প্রচুর পরিমাণে আছে এর। কোনোভাবেই এখন পালানো সম্ভব না। প্রানেশাকে চুপ থাকতে দেখে লোকটি ঠোঁট এলিয়ে হাসলো । সে বুঝে গেছে প্রানেশা আর পালানোর চেষ্টা করবেনা। প্রানেশার কাছে দুই পা এগিয়ে গেলো সে। হাত দিয়ে গাল মুছে দিয়ে মাথার ঘোমটা টেনে আরেকটু বাড়িয়ে দিলো। মুখ বাড়িয়ে প্রানেশার চোখের পাতায় চুমু খেয়ে সরে গেলো। ধীর পায়ে গম্ভীর ভঙ্গিতে দরজা খুলে বেরিয়ে গেলো। প্রানেশা চুপ করে চেয়ারে পুতুলের ন্যয় শক্ত হয়ে বসে থাকলো৷ ব্যাক্তিটির সত্যিটা জানতে হলেও বিয়ে করতে হবে। মনে মনে স্থির করে এখন পালানোর পথ না পেলেও বিয়ের পর তো পাবে। এক না একদিন তো রহস্য বের করবেই সেদিনই এই হিংস্র বহুরূপীকে ডিভোর্স দেবে। এতে যা হওয়ার হোক৷ কিছুক্ষণ পরই কাজিনরা এসে তাকে নিচে নিয়ে গেলো৷ পুতুলের মতোই কবুল বলে বিয়ে সম্পন্ন করলো৷
বিদায়ের সময়ও প্রানেশা কাঁদলো না। অনুভূতিহীন ভাবে বসে থাকলো৷ গাড়ি দিয়ে যাওয়ার সময় মাথা এলিয়ে বসে নিজের ভাগ্যের উপর তাচ্ছিল্য হাসলো।
মনের তীব্র হাহাকার যেনো বেড়েই যাচ্ছে। কী হবে আগামীর ভবিষ্যৎ! রেয়ানকে সে কী জবাব দেবে? আর এই বহুরূপীকেই বা কী করে স্বামীর স্হান দেবে সে!
শ্বশুর বাড়ির সামনে গেট খুলতেই প্রানেশা বাহিরে বের হলো৷ বাড়ি দেখে অবাক না হয়ে পারলো না। কালো রঙের এমন বিশাল বাড়ি প্রথম বার দেখলো সে৷ প্রানেশার বাবারও যথেষ্ট টাকা পয়সা আছে৷ বাড়িও যথেষ্ট সুন্দর। কিন্তু এতবড় নয়, কালো রঙ দিয়ে এমন কেন করলে বাড়িটাকে প্রানেশা বুঝে উঠতে পারলো না। লম্বা শ্বাস ছেড়ে সবার সাথে ভেতরে প্রবেশ করলো।
রাহাত তেহজিব নিজের রুমে বসে চিন্তায় পায়চারি করছেন৷ মিসেস অদিতি তেহজিব ভেতরে প্রবেশ করে বললেন-‘কী হয়েছে?আপনি এভাবে পায়চারি করছেন কেনো?’
তিনি চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন-
‘তুমি বুঝতে পারছো না? কেনো আমি এত চিন্তা করছি! এমন করে মেয়েটাকে ধোঁয়াশায় রাখা উচিত হচ্ছে? ‘
মিসেস অদিতি ভাবলেশহীন ভাবে ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়ালেন৷ তিনি ভীষণ ক্লান্ত। ছেলের বিয়েতে খাটুনি কম হয়নি৷ এখন লম্বা একটা ঘুমের প্রয়োজন তার। হাতের চুড়ি গুলো খুলতে খুলতে হাই তুলে বললেন-
‘এত চিন্তা করো না। যা হয়েছে ভালোই হয়েছে। মেয়েটার জীবন নষ্ট হয়ে যেতো’
মিস্টার রাহাত অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন –
‘আর এখন? মেয়েটার জীবন এখন নষ্ট হয়নি? তোমার বড় ছেলে কেমন মানুষ তুমি জানো না! মেয়েটাকে বাঁচতে দেবে!‘