#পরীজান
#পর্ব ৫৯
#Ishita_Rahman_Sanjida(Simran)
❌কপি করা নিষিদ্ধ ❌
সূর্য এখনও দিগন্তে দেখা দেয়নি। সহজে দেখা দিবে বলে মনে হয়না। কুয়াশাচ্ছন্ন চারিদিক,দূর দূরান্তের কিছুই দেখা যাচ্ছে না। যদিও কার্শিয়াং এর শীত দার্জিলিং এর মতো তীব্র নয়। এখানকার আবহাওয়া সারাবছরই আরাম দায়ক। তবুও আজ যেন কুয়াশা আর শীত অন্যদিনের তুলনায় একটু বেশিই। কাছের কিছুও স্পষ্ট দেখা যায় না। ধোয়াশা লাগছে সব, প্রকৃতিও যেন অপরূপ সৌন্দর্য ঢেলে দিয়েছে ধরণিতে। সেজন্যই বোধহয় কুয়াশাচ্ছন্ন পৃথিবীটা মোহনীয় লাগছে। ধীর পায়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে শায়ের। নারী অবয়বটির মুখটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না কুয়াশার জন্য। তাই সে সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।
কুয়াশা ভেদ করে সে এলোকেশী তনয়ার সামনে এসে দাঁড়াল। সাত বছর পর মধুরতম কন্ঠস্বর শায়েরের কানে পৌঁছাল,
‘আসসালামুআলাইকুম মালি সাহেব!!!’
বহুদিনের তৃষ্ণা যেন নিবারণ হতে চলেছে শায়েরের। তবুও গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে ওর। শুষ্ক গলায় সালামের উত্তর দিল সে,’ওয়ালাইকুম আসসালাম পরীজান!!!’
-‘কেমন আছেন?’
পরীর এই প্রশ্নের জবাব দিল না শায়ের। উল্টে নিজেই প্রশ্ন করে বসল,’আমি কি আপনাকে জড়িয়ে ধরতে পারি? তৃষ্ণায় বুকটা খাঁ খাঁ করছে!! শীতকালকেও আমার কাছে তেজস্ক্রিয় চৈত্রের মত মনে হচ্ছে।’
দুকদম এগিয়ে এল পরী। পায়ে তার জুতো নেই। শীতল কার্শিয়াং কে সে পরিপূর্ণ ভাবে আজ উপলব্ধি করতে চাইছে সে। শায়েরের এই প্রশ্নের পরিবর্তিতে সেও প্রশ্ন করে,’আমি কি আপনাকে অনুমতি দিতে পারি?’
পরী মুচকি হাসল কথাটা বলে। বিপরীতে শায়ের ও মুচকি হাসল। তবে সে খেয়াল করল তার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। পরীর চোখেও অশ্রুকণা সে দেখতে পেল। শায়ের কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পরী নিজেই এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরে শায়ের কে। স্বামীর গলায় মুখ ডুবিয়ে দিয়ে তার শরীরের ঘ্রাণ চুম্বকের মতো টেনে নিল নাকে। শক্ত করে শায়েরের গলা আঁকড়ে ধরে রইল সে। নিজের অর্ধাঙ্গিনীকে ধরে সাত বছরের তৃষ্ণা মেটাতে লাগল শায়ের। এত কাছে আসার জন্যই তো এত দূরত্ব ছিল তাদের মধ্যে। এরকম সুন্দর সমাপ্তি পাওয়ার জন্য সাত বছর কেন সাত যুগ দূরে থাকতে শায়ের রাজি। তবুও যেন ওর সমাপ্তিটা তার পরীজানের সাথেই হয়। পরীকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে ওর সারা মুখে চুমু খেয়ে আবার জড়িয়ে নিল নিজ বক্ষে। পরী শুধু স্বামীর পাগলামো দেখতে লাগল। আর অশ্রু বিসর্জন দিতে লাগল। পরীকে বুক থেকে সরিয়ে সোজা করে দাঁড় করাল শায়ের। তারপর বলল,’আপনি শীতের কাপড় পড়েননি কেন? ঠান্ডা লাগবে তো!’
তৎক্ষণাৎ নিজের গায়ের চাদরখানা পরীকে পড়িয়ে দিল সে।
-‘শীত আপনার লাগবে না? ঠান্ডা তো আপনারও লাগবে।’
-‘পাথরের অশ্রু আসে না,তেমনি ছেলেদের কষ্টও কষ্ট মনে হয় না।’
পরী মৃদু হাসল,’অনেক কথা জমে আছে মালি সাহেব। পাহাড় সমান কথা। আপনি শুনবেন??’
-‘আল্লাহ আপনার জন্যই আমাকে সৃষ্টি করেছেন। আমি আপনি সবসময়ই একে অপরের কথা শুনব। দূরে থাকলে একে অপরের কথা ভাববো। আপনি বলুন। আমি আজ আর কিছুই বলব না আপনার সব কথা শুনে যাব শুধু।’
-‘আমাদের দূরত্ব তাহলে ঘুচলো!!’
-‘আপনার আমার মাঝে দূরত্ব কখনোই ছিল না। এই সাত বছর আমি আপনার মধ্যেই ছিলাম। আর আপনি আমার ভেতর।’
-‘অনেক কষ্ট দিয়েছি আপনাকে আমি। ক্ষমা করুন আমাকে!!’
পরীর ঠোঁটে আঙুল চেপে ওকে চুপ করিয়ে দিয়ে শায়ের বলে উঠল,’আপনি ক্ষমা চাইছেন কেন? আপনি আপনার স্থানে সঠিক ছিলেন আর সর্বদা থাকবেন। আমি সেই আগের পরীজান কে সবসময় দেখতে চাই!!’
-‘কথা দিচ্ছি আর কখনোই আপনাকে দূরে ঠেলে দিব না। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার সময় ও আপনাকে আমার চোখ দুটো খুঁজবে।’
-‘আমি যতটা নিঃশ্বাস নেব তা আপনার সাথেই নেব। যত দূর্গম রাস্তাই হোক না কেন তা আপনার সাথেই হাটব। আল্লাহ যদি তার ইবাদত ব্যতীত কারো ইবাদত করার হুকুম দিত তাহলে আমি একমাত্র আপনার ইবাদত করতাম পরীজান।’
টলমল চোখে পরী বলে,’এত সুখ আমি কোথায় রাখি
মালি সাহেব? আপনার ভালোবাসার গভীরতা যে আমি মাপতে পারছি না!’
-‘আমার ভালোবাসা অনেক গভীর পরীজান। এই গভীরতা মাপতে গেলে আপনি তল খুঁজে পাবেন না।তলে হারিয়ে যাবেন।’
প্রকৃতিকে চমকে দিয়ে কুয়াশা সরে যাচ্ছে। হয়তো সূয্যিমামা শীঘ্রই উঁকি দিবে। তার যেন হিংসে হচ্ছে এই মুহূর্তে। সে ব্যতীত প্রকৃতি স্বাক্ষী হয়েছে শায়ের পরীর ভালোবাসার। শায়ের পরীকে আবার বুকে টেনে নিয়ে সুধায়,’অবাধ্য মন শুধু আপনাকে পাওয়ার জন্য আরাধনা করে। আমার হৃদস্পন্দন শুনে বুঝতে পারছেন কি?’
পরী জবাব দেওয়ার সময় পেল না। তার আগেই নিজের সন্তানের মুখে ‘আম্মিজান’ ডাকটা তার হৃদস্পন্দন বাড়িয়ে দিল। শায়েরের বুক থেকে মাথা তুলে শোভনের দিকে তাকাল। দৌড়ে আসছে শোভন। পরী এগোল না,শোভন কাছে আসতেই হাটু মুড়ে বসে সে জড়িয়ে ধরল ছেলেকে। খুশিতে আত্মহারা মাকে পেয়ে শোভন। পরী ছেলের কপালে বার কয়েক চুমু খেল। এর থেকে সুন্দরতম দৃশ্য বোধহয় প্রকৃতিতে আর হতেই পারে না। সূর্য ধরণিতে উঁকি দিতেই শায়ের,পরী,শোভন সেদিকে তাকাল। এক নতুন দিনের সামিল হল তিনজন। সাথে নতুন জীবন শুরু করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা বদ্ধ হল ওরা। শোভন দুহাতে মায়ের গাল ধরে দেখতে লাগল মাকে। ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে বলল,’আমার আম্মিজানের থেকে সুন্দর নারী এই পৃথিবীতে কেউ নেই।’
ছেলের কথায় হাসল পরী। মা ছেলেকে দেখে শায়ের ও হাসল। পরী আর ওর দূরত্ব শায়ের মেনে নিতে পেরেছে কিন্ত মা ছেলের দূরত্ব মানতে শায়েরের অনেক বেশি কষ্ট হয়েছে। তবে এছাড়া তখন কোন উপায় ছিল না। নাঈম তখন পরীর সাথে শোভনকে দিতে রাজি হয়নি। ওতটুকু বয়সে শোভনের কষ্ট হতো। পরীরা তখন পালিয়ে এসেছিল বাংলাদেশ থেকে। নৌকা করে পাড়ি দিতে হয়েছিল নদী। বর্ডার পার হতে অনেক কসরত করতে হয়েছে। নাঈম তা ভেবেই শোভনকে পরীর সাথে শোভন কে যেতে দেয়নি। সেদিন পরী বারবার অশ্রুসিক্ত নয়নে ছেলেকে দেখছিল। বেশিক্ষণ বুকে জড়িয়ে ধরে রাখতে পারেনি। সময় খুব কম তাই জীবন সঙ্গী আর সন্তান কে বিদায় দিয়ে পরী পাড়ি জমায় ভারতের কার্শিয়াং শহরে। সাথে ওর পরিবার ও। তবে সবাই আলাদা আলাদা ভাবে বর্ডার পার হয়ে এসেছে। পরবর্তীতে সবাই এক হয়েছে। জুম্মান পিকুল কে নিয়ে আগেই সেখানে ছিল। রুপালিকে জমিদার বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার আগেই জুম্মান আর পিকুল কে সে পাঠিয়ে দেয় কার্শিয়াং এ। পরবর্তীতে পরীরাও জুম্মানের কাছে চলে আসে। তার পর জুম্মান ই পরীর চিকিৎসা করায়। ভারতের চিকিৎসা পরিস্থিতি অনেক ভাল। ডাক্তার দেখানোর পর তারা পরীকে প্লাস্টিক সার্জারির কথা বলে। এতে সে তাড়াতাড়ি সুস্থ হবে। কিন্ত পরী জানত এতে ওর চেহারায় বেশ পরিবর্তন আসবে। সেজন্য পরী নিজেই নাকচ করে দেয়। থাক না তার পোড়া মুখ। সে তার মালির পরীজান হয়েই বাকি জীবনটুকু কাটিয়ে দিতে পারবে। কিন্ত বোনের সিদ্ধান্ত মেনে নিল না জুম্মান। প্লাস্টিক সার্জারি না করলেও চিকিৎসা চালিয়ে গেল সে। পরী শুধু বিষ্মিত নয়নে জুম্মান কে দেখেছিল সেদিন। এই কি সেই ছোট্ট জুম্মান? যাকে কোলে পিঠে করে বড় করেছে ও? সেই ছোট্ট জুম্মান আজ পরিপূর্ণ যুবকে পরিণত। সবার ভালোবাসায় পরীর চিকিৎসা বিফলে যায়নি। দ্রুতই সুস্থ হয়েছে পরী।
আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে বাড়ির পথ ধরেছে পরী। তার একহাত শায়েরের হাত ধরে আছে। শোভন শায়েরের কোলে। নতুন দিনের নতুন সূচনা। জীবনে সবকিছুই আজকে নতুন লাগছে পরীর কাছে। পথ পেরিয়ে বাড়িতে এসে পৌঁছাল ওরা। দরজা খুলল জুম্মান। শায়ের পরী ভেতরে প্রবেশ করতেই জুম্মান বলে উঠল,’পরী আপা তোমার ছেলে ভিশন চতুর। সুন্দর ভাই বাইরে যেতেই সেও ইচ্ছা পোষন করে তোমার কাছে যাবে। আটকাতে পারলাম কই? ওকে পাহাড়ে নিয়ে যেতেই আমাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিল!!’
শোভন ঠোঁট ফুলিয়ে রাগ দেখিয়ে বলে,’মা বাবা আর ছেলের মাঝে অন্য কাউকে আসতে নেই তা জানো না বুঝি মামা?’
জুম্মান ভড়কে গেল শোভনের কথায়,’জানলে কীভাবে আমি তোমার মামা?’
শোভন হাসল জুম্মানের কথায়। ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে পরী জিজ্ঞেস করে,’চিনলে কীভাবে মামাকে? বলে দাও!’
-‘সেটা বলা যাবে না। বাকি সবাই আসুক দেখি চিনতে পারি কি না?’
শায়েরের কোল থেকে নেমে হট্টগোল শুরু করে দিল শোভন। একে একে সবাই এসে হাজির। শোভন প্রথমে মালার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। সম্পূর্ণ অবলোকন করল মালাকে। গায়ে শাল জড়ানো সুন্দর নারীটিকে চিনতে অসুবিধা হল না শোভনের। ওই খাতার বর্ণনা অনুযায়ী শোভন মালা আর জেসমিন কে চিনে ফেলল। কুসুম আর শেফালির নাম বললেও কোনটা কুসুম আর কোনটা শেফালি তা বলতে পারল না। মায়ের মতো সুন্দর আরেকটি নারীকে দেখে শোভন বলে উঠল,’তুমি মেজ আম্মু তাই না? কিন্ত তুমি তো মারা গিয়েছো? তাহলে?’
—-
দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। পুড়ছে কাগজগুলো। চেয়ারে বসে এক দৃষ্টিতে তা দেখছে নাঈম। পরীর পাঠানো সমস্ত চিঠি সে আজ পুড়িয়ে দিয়েছে। আর কোন বিন্দুমাত্র প্রমাণ সে রাখবে না। রুমি নাঈমের পাশে বসে বলল,’আমি এখন সব সত্য জানতে চাই নাঈম। এই চিঠিগুলো পরী আমার কাছে পাঠাত। কিন্ত পরী আর শায়ের এতদিন আলাদা ছিল কেন? পরীর বাবা কাকাকে যদি শায়ের খু*ন না’ই করে থাকে তাহলে কে করল? পরী?’
দীর্ঘশ্বাস ফেলে নাঈম,’কে বলেছে পরীর বাবা আর কাকা মারা গেছে?’
-‘মানে? এই বিষয়টা নিয়ে এতকিছু। আর তুই বলছিস ওনারা বেঁচে আছে? কীভাবে? তাহলে এত সব নাটকের প্রয়োজন ছিল কি? আরেকটু হলেই তো শায়েরের ফাঁ*সি কার্যকর হয়ে যেত!!’
নাঈম হেসে উঠল বলল,’শায়ের কে এতটাই বোকা মনে করিস তুই? তোর কি মনে হয়? ছোট্ট ছেলেকে ফেলে কি পরী এত সহজেই জমিদার বাড়িতে চলে গেল? আর কতগুলো মানুষ কে খু*ন করে চলে এল? সবকিছু কি এতই সহজ? আর শায়ের কে কি পুলিশ গ্রেফতার করেছে? নাহ শায়ের নিজেই ধরা দিয়েছে।’