এলোকেশী রাঁখি শাক তুলতে রাস্তার ধারে এসেছে। রাস্তার পাশে পাট খড়ির তৈরি জানালা গুলো বাঁশের সাহায্যে দাঁড় করানো। পুঁই শাক গাছের লতাগুলো ছড়িয়ে আছে চারিদিক। বেশ দেখতে হয়েছে। ভাইয়ের ঘাড়ে বসে আর কতদিন খাবে সে? ভাইয়ের বউ কথা শোনাতে পারলেই বাঁচে। তাই শাক সবজি চাষ করে দুটো টাকা রোজগার করে। সম্পান থাকলে কি এই দূর্দিন দেখতে হতো? ছেলেটা অভিমান করে তাকে ছেড়ে চলে গেল। সেই সময়ে লখা যাচ্ছিল সেখান দিয়ে। হাতে তার গাঁধা ফুলের মালা। রাঁখির মনে পড়ে গেল আজ ইন্দুর ছোট ছেলের অন্নপ্রাসণ। মহা ধুমধামে তা পালন করা হচ্ছে। রাঁখি মনে মনে ভাবে যদি বিন্দু সম্পান থাকত তাহলে ওদের ঘরেও সন্তান থাকতো। লখা রাঁখিকে দেখে জিজ্ঞেস করে,’কি’বা আছো মাসি? শরীর ভালা তো?’

রাঁখি মলিন হাসিতে জবাব দিল,’ভালা রে লখা। ইন্দুর পোলা কি ভালা আছে?’

-‘ভালাই আছে। তুমি একটু পরে যাইও কিন্তু। আমার খারানের সময় নাই।’
লখা দ্রুত পায়ে প্রস্থান করে। লখার চলে যাওয়ার পর পরই চুল দাড়ি ভর্তি একটা পাগলের আবির্ভাব হলো। চুল দাঁড়ি এতই ঘন যে তাকে চেনার উপায় নেই। চেহারার ও বিচ্ছিরি অবস্থা। গ্রামের কিছু ছেলে মেয়ে পাগলটাকে উত্যক্ত করছে আর তার পিছু পিছু আসছে। রাঁখি আবার মুখ ফেরাল। এই পাগলটাকে দেখে ঘৃণা হচ্ছে তার। কি নোংরা!! সুখানের পর আরো দুজন পাগল নূরনগরে দেখা গিয়েছে। তারা কোথা থেকে এসেছে নাম কি তা কেউই জানে না। চেহারা দেখে কিছু বোঝার উপায় ও নেই। এতে গ্রামের কোন ব্যক্তি মাথা ঘামায় না। পাগলের আবার কিসের পরিচয়? রাঁখি শাক তুলে নিয়ে চলে গেল। পিছন ফিরে ছেলে মেয়ে গুলোকে হাসি ঠাট্টা করতে দেখে হাসল সে। আস্তে করে বলে উঠল,’যেমন কর্ম তেমন ফল। যে রাজ্য চায় সে হয় ভিখারি।’

চোখের জল মুছে রাঁখি নিজ গন্তব্যে চলে গেল।

শোভন আজকেও একটা হলুদ খামের চিঠি পেলো। পিয়ন চিঠিটা দিতেই ওলট পালট করে দেখল সে। চিঠিটা কোথা থেকে এসেছে তা দেখতে চাইল। কিন্ত প্রেরকের কোন ঠিকানা নেই। বিরক্ত হল শোভন। নাকের ডগা ক্রমশ লাল হতে লাগল তার। সামনের দোকানে চিনি কিনতে গিয়েছিল সে। শায়ের বারণ করা সত্ত্বেও সে চিনি কিনে বাসায় ফিরছিল। বাসার গেইটের সামনে এসে দাঁড়াতেই পিয়ন চিঠিটা ধরিয়ে দিয়ে গেল। শোভন ধীর পায়ে ঘরে ঢুকতেই চেয়ারে বসা নুরুজ্জামানের দিকে চোখ গেল ওর। শায়েরের সাথে হাত নাড়িয়ে কথা বলছেন তিনি। চিঠিটা মুড়িয়ে মুঠোবন্দি করে নিল সে। যথা স্থানে চিনি রেখে শায়েরের সামনে গিয়ে দাঁড়াল সে। নুরুজ্জামান এতক্ষণে শোভন কে খেয়াল করে। শোভন পকেট থেকে চিঠিটা বের করে শায়েরের দিকে তুলে ধরে বলে,’আব্বু তোমার চিঠি এসেছে।’

শায়ের থমকালো!! নুরুজ্জামানের সামনেই দিতে হল চিঠিটা!! বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দিল শায়েরের কপালে। ছোঁ মেরে চিঠিটা নুরুজ্জামান কেড়ে নিলেন। খাম খুলে চিঠি বের করে পড়তে লাগলেন। তবে লেখাগুলো পড়ে তার ভাব ভঙ্গি পরিবর্তন হয়ে গেল। তারপর শায়েরের দিকে সেটা এগিয়ে দিল। শায়ের ভেবাচেকা খেয়ে গেল। সে নিজেও পড়া শুরু করল,
“আমি তোমাকে খুব ভালবাসি আব্বু। তুমি পৃথিবীর সেরা আব্বু। আমাকে কত আদর করো!! আমি তোমার সাহসী রাজকুমার।”

চোখ তুলে শায়ের ছেলের দিকে তাকাল। শোভন খিলখিল করে হেসে উঠল। তাজ্জব বনে গেল নুরুজ্জামান। তিনি এসেছিলেন শায়েরের সাথে কেস নিয়ে আলোচনা করতে কিন্ত আশানুরূপ কিছুই পেল না। উল্টে বোকা বনে গেল। সে ভেবেছিল এই চিঠিতে বোধহয় কিছু আছে। কিন্তু তার ধারণা ভুল প্রমাণিত হল। নুরুজ্জামান চলে যেতেই শোভন পকেট থেকে আসল চিঠিটা বের করে দিল। শায়ের বেশ অবাক হল ছেলের কান্ডে। এতটা চতুরতার সাথে কাজটা করল কীভাবে সে? ভয় পাইয়ে দিয়েছিল!! মায়ের মতোই হয়েছে একদম। শায়ের হাসল আবার। শোভন জিজ্ঞেস করে,’আমরা কবে যাচ্ছি আব্বু??’

-‘খুব শীঘ্রই যাব আমার রাজকুমার। তোমার জন্য অনেক বড় উপহার আছে সেখানে।’

-‘উপহারটা কি তা আমি জানি!!’
-‘তুমি জানো? কীভাবে?’

শোভন কিছু বলল না। চুপ করে নিজের ঘরে চলে গেল। স্কুল ব্যাগটা খুলে একটা খাতা সে বের করল। সিমেন্টের মলাটের খাতাটা শোভনের অনেক বার পড়া হয়ে গেছে। বাংলা রিডিং সে খুব ভাল করেই পড়তে পারে। শোভন এই খাতাটা মুসকান কে অনেক বার পড়তে দেখেছে। তাই নিজের ব্যাগে করে খাতাটা সে নিয়ে এসেছে। এই খাতাটা অনেক বার তারও পড়া হয়ে গেছে। শেষে কিছু বাক্য পরী শোভনের জন্য লিখে গেছে,”আমার রাজকুমার আল্লাহর অনুমতি তে আমাদের আবার মুলাকাত (দেখা) হবে।”

সেই লেখাটায় হাত বুলিয়ে খাতাটা বুকে চেপে ধরল। মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে উঠল,’আল্লাহ অনুমতি দিয়ে দিয়েছেন আম্মিজান।’
দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে শায়ের ছেলের কথা শোনে। এতটা বুদ্ধিমত্তার অধিকারী এই ছেলে!! যা শায়ের কে প্রতি পদে পদে বিষ্মিত করে দিচ্ছে। নুরুজ্জামান কে যেভাবে ঘোল খাওয়ালো!! ভাবতেই হাসি পেল ওর।

—-
মুসকান কে তাড়া দিচ্ছে নাঈম। তৈরি হতে সময় লাগছে বলে মৃদু ধমকাচ্ছে। আপাতত নাঈমের কথায় পাত্তা দিচ্ছে না মুসকান। সবুজ রঙের শাড়িটি পরিপাটি করে পড়ে তারপর বের হল সে। আজকে দুজনেই কাজ থেকে ছুটি নিয়েছে। কিন্ত মুসকান জানে না নাঈম তাকে এখন কোথায় নিয়ে যাবে? অনেক বার জিজ্ঞেস করেও কোন উত্তর মেলেনি স্বামীর কাছ থেকে। তাই হতাশ হয়ে নাঈমের পিছু ধরে সে। মুসকানের একটা হাত চেপে ধরে নাঈম। এতে মৃদু হাসি ফুটল মুসকানের ওষ্ঠাধরে। নাঈম রিক্সা ডেকে তাতে উঠে পড়ে। মুসকানের এতদিনে মনে হচ্ছে ওরা স্বামী স্ত্রী। এতগুলো বছর শোভন ছাড়া নাঈম কিছুই বোঝেনি কিন্তু আজ নাঈম মুসকানের এত কাছে এসেছে। ভালোই লাগছে মুসকানের। এতদিনে অন্তত স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক টা গাঢ় হয়েছে।
রিকশা থেকে নেমে ট্যাক্সি নিল ওরা। নাঈম এখনও মুখ খোলেনি।
ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনে ট্যাক্সি থামে। মুসকান অবাক হয়ে চারিদিক দেখে। সাংবাদিক হওয়ার দরুন দেশের সব জায়গাতেই সে গিয়েছে। এই স্টেশন থেকে ঢাকা টু কলকাতার ট্রেন ছাড়ে। মানে ভারত যাওয়ার ট্রেন। মুসকান অবাক হল এই ভেবে যে নাঈম এখানে কেন আসল? মুসকান কে সাথে নিয়ে আসার কারণ কি? নাঈমের তো কোন আত্মীয় ভারত থাকে না। তাহলে এখানে আসার কারণ টা কি? এসব ভাবতে ভাবতেই হাতে টান পড়ল। নাঈম ওর হাত ধরে স্টেশনের ভেতর নিয়ে গেল। মুসকান ও পা চালায় নাঈমের পিছু পিছু। কিছুদূর গিয়ে শায়ের কে দেখেই থমকে যায় সে।
সাদা রঙের পাঞ্জাবি পড়ে দাঁড়িয়ে আছে শায়ের। হাতা কনুই পর্যন্ত গোছানো। চোখে সুরমা দেওয়া। ঠোঁটে সুন্দর হাসি। পরীর বলা মালির সৌন্দর্য চোখের সামনে দেখছে সে। পরীর বর্ণনা হুবহু মিলে গেছে। তবে মুসকান আরও অবাক হল শোভন কে দেখে। অবিকল বাবার বেশ ধারণ করেছে সে। টানা টানা চোখে সুরমা পড়েছে বাবার মতো। সাদা পাঞ্জাবি গায়ে জড়ানো। মুসকান কে চোখে পড়তেই শোভন দৌড়ে গিয়ে ওর কোলে উঠে পড়ল। মুসকান শোভন কে বুকে জড়িয়ে ধরে নাঈমের দিকে তাকাল সে। নাঈম বুঝল এবার তার চুপ থাকলে চলবে না,’শায়ের শোভন কে নিয়ে কলকাতা চলে যাচ্ছে। ওখানেই থাকবে ওরা।’

বিষ্ময়বিমূঢ় মুসকান!! তাহলে তো আর ওর দেখা হবে না শোভনের সাথে। ওর চোখের পানি আটকাতে পারেনি শায়ের আর শোভনকে। ট্রেন ছাড়ার সময় আসতেই নিজ কামরায় গিয়ে বসে ওরা। শোভন জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে শেষবারের মতো নাঈম মুসকান কে বিদায় জানায়। অতঃপর শায়ের কে বলে,’কিছু পেতে হলে কিছু ত্যাগ করতে হয় তাই না আব্বু?’
ছেলের কথায় মুচকি হাসল শায়ের,’অবশ্যই!! সবকিছু একসাথে পাওয়া অসম্ভব। দুনিয়া কে তুমি যা দেবে দুনিয়াও তোমাকে তাই দেবে।’

-‘তুমি দুনিয়াকে কি দিয়েছিল আব্বু? যার জন্য এতদিন কষ্টে ছিলে?’
দীর্ঘশ্বাস ফেলে শায়ের জবাব দিল,’কিছু সময় আমি দুনিয়াকে কষ্ট দিয়েছিলাম তাই আমিও কষ্ট পেয়েছি। তবে আমি ভালোবাসাও দিয়েছি। তাই তো এখন বাকি জীবনে দুনিয়াও আমাকে ভালোবাসা দেবে।’

-‘কিন্তু আমি সবসময় এই দুনিয়া কে ভালোবাসা দেব।’

ছেলের কথায় হাসল শায়ের। লম্বা ভ্রমণ শেষে ট্রেনটি ভারত পৌঁছাল। তবে কলকাতা স্টেশনে নামল না শায়ের। আবার নতুন গন্তব্য ধরল ট্রেনটি। এবার গিয়ে থামল জলপাইগুড়ি স্টেশনে। ব্যাগ থেকে গরম কাপড় বের করে দুজনেই পড়ে নিল। শীত শীত ভাবটা আরো এগোলে আস্তে আস্তে তীব্র হবে। যদিও এখন অনেক কম শীত করছে। স্টেশন থেকে নেমে দার্জিলিং এর বাস ধরে শায়ের। নিউ জলপাইগুড়ি গুড়ি থেকে দার্জিলিং এর কার্শিয়াং শহর ৫৩ কিলোমিটার দূরের পথ। মধ্য প্রহরের শেষের দিকে কার্শিয়াং এর বাসে ওঠে ওরা। বাকি রাত টুকু বাসেই কাটে বাবা ছেলের। পাহাড়ি রাস্তা তার উপর প্রচন্ড শীত। ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরেছে শায়ের। গরম কাপড় পড়া সত্ত্বেও উষ্ণতা দিতে চাইছে সে। শোভন পরম নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে বাবার বুকে। গন্তব্যে পৌঁছেও শোভনের ঘুম ভাঙল না। তখন ফজরের আযান পড়েছে। ছেলেকে কোলে তুলে নিয়ে আরেক হাতে ব্যাগ ধরে বাস থেকে নেমে পড়ল সে। গাড়ি নিয়ে হাজির হল ছোট্ট একটা বাড়ির সামনে। ততক্ষণে শোভনের ঘুম ভেঙে গেছে। দরজায় টোকা দিতেই একটা যুবক এসে দরজা খুলে দিল। শোভনের কাছে সম্পূর্ণ অচেনা সেই যুবকের চেহারা। তবে যুবক টা যেন শায়ের কে চেনে। কারণ শায়ের হাসছে সামনের যুবককে দেখে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই অচেনা পুরুষটি কোলে তুলে নিল শোভন কে। কিছু বলছে না শোভন। শুধু চেয়ে চেয়ে দেখছিল সবকিছু। ঘরের ভেতরে ঢুকতেই আরো কয়েকজন নতুন মুখের সম্মুখীন হল সে। কাউকেই চিনতে পারছে না শোভন।
এই ভোর বেলা কি তার জন্যই এই মানুষ গুলো জেগে ছিল? কিন্ত কেন? এরা কারা? একমনে এসব ভেবে চলছে সে। বাবার দিকে তাকিয়ে দেখল ওর বাবাও অস্থির নয়নে আশেপাশে চোখ বুলাচ্ছে। শায়েরের অস্থিরতা দেখে অচেনা যুবকটি বলে উঠল,’সে ঘরে নেই সে পাহাড়ে।’

বাক্যটা শেষের সাথে সাথে শায়েরের অস্তিত্ব যেন মুহূর্তেই মিলিয়ে গেল। শায়ের ছুটল পাহাড়ের দিকে।
তবে তাকে কেউ বাঁধা দিল না। বাঁধা দেওয়ার সাহস যেন কারো নেই। প্রকৃতিও চায় শায়েরের পদচরণ পাহাড়ে পড়ুক। শীতের কুয়াশা গুলো যেন স্বাক্ষী থাকলে চায় উতলা পুরুষটির ভালোবাসার। তাই তারাও শায়েরের সাথে ধেয়ে যাচ্ছে পাহাড়ে। গন্তব্য যখন শেষ হল দূরে একটা নারী অবয়ব ভেসে উঠল। এই শীতের মধ্যেও নারীটির শরীরে নেই শীত নিয়ন্ত্রিত বস্ত্র। পাতলা শাড়ি পড়ে সে খোলা চুলে দাঁড়িয়ে আছে। দাঁড়িয়ে আছে বললে ভুল হবে। কোমল হাতে সে স্পর্শ করছে চা পাতা গুলোতে। কচি পাতা ছিঁড়ে রাখছে হাতে থাকা ছোট্ট ঝুরিতে। কিছু পল থেমে গিয়ে ধীমি পায়ে সামনে এগোচ্ছে শায়ের। ঠোঁটজোড়া প্রসারিত করে সে একটা শব্দ উচ্চারিত করতেই নারী অবয়বটির হাত থেমে গেল।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।