এক বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যা – সিজন ২ | পর্ব – ২

সূর্যমামা মাত্রই ঘুমের দেশে পাড়ি জমিয়ে পৃথিবীর উল্টো পিঠে অবস্থান করে চাঁদ মামাকে পৃথিবীতে জায়গা করে দিয়েছে।সূর্যের ডুবে যাওয়া আর চাঁদের উদয় হওয়া এই দৃশ্য বড়ই সুন্দর দেখতে।শহরে সন্ধ্যা নেমেছে এইতো কিছুক্ষণ হবে।পাখিরা ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে উড়ে যে যার নীড়ে ফিরছে,গাছের পাতায়, সবুজ ঘাসে ক্রমশ জমছে শিশির বিন্দু।চারদিকে কৃত্রিম আলো জ্বল জ্বল করছে।প্রতিটি বিল্ডিং এ জ্বলে উঠেছে লাল,সাদা কৃত্রিম আলো।রাস্তায় রোড লাইটের আলো চারদিক ঝলমল করছে।

ঘর্ণায়মান এই সুন্দর সন্ধায় আমাদের কাজিনদের চাঁদের হাট বসেছে।ছাদে রং বেরঙের লাইটিং করা হয়েছে।বাসার ঢুকতে পাতাবাহার গাছ গুলোতে রঙিন লাইটিং করা হয়েছে।জুনি লাইট গুলো, লাল,নীল,গোলাগি বিভিন্ন রঙের জ্বলছে আর নিভছে।পিচ্চি গুলো ছোটাছুটি করছে, এমন অপরূপ সৌন্দর্য আর লাইটিং দেখে বাচ্চা গুলো আনন্দে ছোটাছুটি করছে।তিয়াস ভাই,আর বিভোর ভাই গান চালাচ্ছেন ছাদে।বাসায় বিভিন্ন ধরনের দূর সম্পর্কের আত্মীয় এসেছে তাদের মাঝে এসেছে অনেক মেয়ে,ছেলে আমাদের বয়সী প্রায়,একটু বড়, ছোট ও হবে।রিয়া,মেহু আপুর হাতে মেহেদি পরিয়ে দিচ্ছে আর আমি রুশা আপুর হাতে।কোন কুওক্ষণে যে সৃষ্টিকর্তা আমাকে এই মহৎ প্রতিভা দিয়েছিলেন হাতে মেহেদীর সুন্দর ডিজাইন তোলার প্রতিভা।ঈদ হোক আর কোনো অনুষ্টান হোক পাড়ার মানুষের ভীড় পরে তারা আমার হাত থেকেই মেহেদী নিবে।বিভা আপুর কয়েক জন বান্ধবী কে মেহেদী লাগিয়ে দিয়েছি, এখন রুশা আপুর হাতে মেহেদী দিচ্ছি আরো কত জোড়া হাত আমার অপেক্ষা করছে।এ বলছে এর পর আমি তো ও বলছে এর পর আমি।আমি আছি মহা সংকটে।ঘাড় লেগে যাচ্ছে আর একটুও বসতে পারছি না,আবার কোমরেও প্রচন্ড ব্যাথা করছে।বেশ কয়েকমাস আগে হঠাত সেন্সলেস হয়ে পড়ে গেছিলাম কল পাড়ে সেখান থেকে কোমড়ের একটা হাড় চটে গিয়েছে।বেশীক্ষণ বসলেই কোমরে ভীষণ পেইন করে।ডাক্তার বলেছে ওষুধ খেতে খেতে এক সময় ঠিক হয়ে যাবে।হাতেও ব্যাথা করছে সাথে অবশ হয়ে যাচ্ছে।এই মুহুর্তে কেউ যদি আমাকে কোনো কাজে ডেকে নিয়ে উদ্ধার করতো বেঁচে যেতাম।এত গুলা আত্মীয়র মুখের উপর বলতেও পারছি না যে আমি আর দিতে পারবো না।জিনিস টা নিজের বিবেক এর কাছেই বাঁধা দিচ্ছে।

শান্ত পরিবেশ অস্হির করে তুললেন বিভোর ভাই হঠাত অদ্ভুত এক গান চালিয়ে।

“ও টুনির মা তোমার টুনি কথা শোনে না,
দিন রাত শুধু মিস কল মারে কল করে না,
টুনি স্কুলে যাইবো, টুনি বারান্দায় আইবো টুনিরে লইয়া আমি নৌকা দৌড়াবো।”

সবাই হতবাক এই মারাত্মক গান টা শুনে।সবাই এক প্রকার হুল্লোড় ছেড়ে দিলো গান টা শুনে।এই মুহুর্তে এই গান টা ছিলো মারাত্মক বিনোদনের খোরাক সবার কাছে।

“রিয়া মেহেদী টা ছুড়ে ফেলে দিয়ে বিভোর ভাই এর ফোন টা বক্স থেকে নিয়ে গান টা স্টপ করে বললো, এটা কি বিয়ে বাড়ি নাকি বেহারা বাড়ি”

“বিভোর ভাই অবাক হওয়ার মতো একটা ভান করে বললেন,বেহারা বাড়ি টা আবার কি রিয়া।”

“বেহারা মানে যারা পালকি বয়ে বেড়ায়।আপনাদের ওই পাড়ায় এক ঘর আদি বেহারা এখনো বেঁচে আছে তারা এসব উদ্ভট গান চালায়।”

“বিভোর ভাই অদ্ভুত এক হাসি দিয়ে বললেন,এখানে ওই বেহারা বাড়ির এক হবু বউ উপস্হিত আছে এ কারণেই গান টা চালালাম আরকি?”

“হোয়াট বেহারা বাড়ির হবু বউ কে বিভোর ভাই?একদম উল্টাপালটা বলবেন না কিন্তু।ঠিক করে বলুন কে এখানে।”

“ওই যে লিয়াকত বেটের ছেলে আতিক বেটে ওর বউ আমার একমাত্র দাদার দুইমাত্র ছেলের একমাত্র মেয়ে মানে আমাদের ফুফুর একমাত্র মেয়ের ছোট কাকার বউ এর একমাত্র বড় মেয়ে।ওদের নামের সাথে বেটে পদবী টা না বললে কেউ চিনেই না।তাহলে ভাবো রিয়া বাচ্চা কাচ্চা কেমন হবে?..”

আবির ভাইয়া,তিয়াস ভাইয়া,বিভা আপু,মেহু আপু, তোহা আপু সহ সবাই প্রচন্ড বিনোদনের সাথে হেসে উঠলো।

“রিয়া খানিক টা ভ্যাবাচেকা খেয়ে বললো, কি বললেন এত পেচিয়ে না বলে সোজা সুজি বলেন।আমি বুঝি নি আপনার কথা।”

“তোহা আপু উঠে গিয়ে বললো,আরে রিয়া বুঝিস নি তোকেই তো সেই লিয়াকত বেটের ছেলের বউ বললো ইয়াক রিয়া তোকে বিভোর ভাই এইভাবে পঁচালো।এতগুলো মানুষের মাঝে ছিঃছি আমার তো মন চাইছে কচু গাছে গলায় দড়ি দিতে।আমি হলে এত সময় গলায় দড়ি ই দিয়ে বসতাম।”

“রিয়া অগ্নিচোখে বিভোর ভাই এর দিকে তাকিয়ে বললো শকুনের দোয়ায় কি আর গরু মরে তোহা আপু।ওই বিভোর ভাই এর কপালে লিয়াকত বেটের বউ এর মতো মহিলা ই জুটবে।”

তৎক্ষনিক ছাদে প্রবেশ করলেন বিহান ভাই,গায়ে ব্লু পাঞ্জাবী,পরণে ব্লু জিন্স, পাঞ্জাবীর হাতা গোটানো, হাতে কালো ফিতার ঘড়ি উনার প্রবেশের অপেক্ষায় ছিলো এতক্ষণ সব মেয়েরা।উনি ছাড়া যেনো আড্ডা টা সবার কাছে খাপছাড়া মনে হচ্ছিলো।না না আসলে কিছুই জমে ক্ষির হয় না।উনার প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই মেয়ে গুলোর মুখের ভাব ভঙ্গি বদলে গেলো।আপুদের বান্ধবীরা এমন ভাবে দেখছে যেনো জীবনে ছেলেই দেখে নি অথচ তাদের হিরো বিষয় টা তে বিরক্ত হচ্ছে।মেয়েদের এমন ছ্যাচড়ামো দেখে রাগে শরীর রি রি করছে আমার।কি আছে উনার মাঝে যে গায়ে পড়তে হবে।আমার কোনো দোষ ত্রুটি পেলেই উনি বাজে কথা বলবেন,বলবেন তো আর থামবেন না তার থেকে বেটার মান ইজ্জত বাঁচাতে চুপ চাপ ই থাকি।সমস্যা মন কে বেঁধে রাখতে পারি না।মন উনার দিকে ছুটবেই।বার বার চোখ উনার দিকেই চলে যায়।তাছাড়া উনাকে আজ এমনিতেই অনেক সুন্দর লাগছে।দীর্ঘদিন পরে পাঞ্জাবীতে দেখলাম উনাকে।

উনি এসেই প্যান্টের পকেটে হাত গুজে স্ট্রাং হয়ে দাঁড়ালেন,কপালে এক গোছা চুল ও পড়েছে উনার।

“রিয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন,রিয়া তুমি একদম ই ঠিক বলেছো,ওর বিয়ে কোনো মহিলার সঙ্গেই হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই কিন্তু।লিয়াকত বেটে টাইপ কারো বউ এর সাথেই হবে আমি ড্যামন সিওর।”

“বিহান ভাই আপনিও বলছেন,ওহ ইয়েস বিহান ভাই আমাকে সাপোর্ট করেছে।”

“সাপোর্ট কেনো করবো না আমি সব সময় সত্যর সাথে আছি আর থাকবো।”

“বিভোর ভাই বললেন,বিহান এখানে অনেক মেয়েরা আছে আমাকে দেখে তারা ক্রাশ খাচ্ছে বলে আমার নামে বদনাম দিবি এটা জানতাম।এত জেলাস হয়ে লাভ নেই বিহান।তোর কপালে জিএফ নেই তাই বলে কি আমাদের প্রেমের মাঝে আগুন লাগাবি।সময় থাকতে ভাল হয়ে যা, ভালো হতে পয়সা লাগে না।”

“সে ক্রাশ খেতেই পারে।ছেলে তো আর তুই দেখতে খারাপ না তাইনা বিভোর।যেমন ও গায়ের রং তেমন ও চোখের কালার,তেমন ও সিল্কি চুল,তেমন ও হাইট যে কোনো মেয়ের প্রথম চয়েজ তুই হবি এতে কোনো সন্দেহ নেই।কিন্তু তোর যে একটু রাশিগত সমস্যা।”

“তোহা আপুর এক বান্ধবীর সাথে বিভোর ভাই এর বিশাল ভাব হয়েছে সে এসে বললো ভাইয়া কিসের সমস্যা আছে উনার।”

“বিহান ভাই বললেন,সিরিয়াস কিছু না বিবাহিত মহিলাদের প্রতি আসক্তি আছে এইটুকু যা।মানে বিবাহিত মহিলা দেখলে ওর মাথা ঠিক থাকে না।এই নিয়ে একাধিক বিবাহিত মহিলার সাথে রিলেশন আছে ওর।তবে ছেলে কিন্তু ও খারাপ না।চরিত্র ফুলের মতোই পবিত্র।সমস্যা শুধু ওই টুকুই।”

–উপস্হিত সবাই এক গাল হেসে দিলো।আবার সত্যি ও ভাবছে তারা।ভাবছে বিহান যখন বলছে হতেই পারে অস্বাভাবিক কিছু না।তাছাড়া এখানেই মেয়ে গুলো অনেক বার বিহান ভাই এর সাথে কথা বলার ট্রাই করেছে কিন্তু উনার মুড দেখে কেউ চান্স ই পায় নি।সবাই যেখানে মেয়েদের সাথে আড্ডা দিচ্ছিলো উনি বাড়ির মুরব্বি দের সাথে কিভাবে কি করলে ভাল হবে সেগুলো নিয়ে আলাপ আলোচনায় বিজি ছিলেন।উনার এই এটিটিউড মেয়েদের আরো বেশী আকৃষ্ট করে।তাছাড়া এমনিতেও উনি মেয়েদের সাথে খুব একটা কথা বলতে পছন্দ করেন না।কেউ নিজে থেকে এসে বললে যথা সম্ভব এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন।

–তোহা আপুর এক বন্ধবী বললো,ভাইয়া কি তাহলে সিঙ্গেল।ভাবা ই যায় না ভাইয়ার মতো এমন সুন্দর একজন ছেলে সিঙ্গেল।

–তোহা আপুর আরেক জন বান্ধবী বললো,ভাইয়া আপনি কি কথা কম বলেন?

–বিভোর ভাই বললেন সিঙ্গেল ছাড়া কি?ওর কপালে মেয়ে নেই।

বিহান ভাই কারো কথার ই উত্তর দিলেন না।খুব একটা ভাব ও নিলেন না।তবে বিভোর এর কথার উত্তর দিয়ে এক ই সাথে সবার কথার দিলেন।

“প্যান্টের পকেট থেকে ফোন বের করে টাইম দেখে ফোন আবার প্যান্টের পকেটে রেখে প্যান্টের পকেটে হাত গুজে বললেন,বিভোর আমার জিএফ নেই এটা ঠিক,আর আমার দ্বারা প্রেম হবে না এটাও ঠিক।তবে আমি যে সিঙ্গেল এই গ্যারান্টি কে দিলো।আমি কি বলেছি যে আমি সিঙ্গেল।আমার জিএফ না থাকলেও বিশেষ কেউ আছে আমার জীবনে।প্রেম হবে না কারণ প্রেম যা হওয়ার সেটা বহুকাল আগেই হয়ে গিয়েছে।এইযে এখন আমি তার সাথে আমার ভালবাসার কথা বলছি এটা শুনেও সে রেগে যাচ্ছে।সে তো এতটায় অবুঝ এই মুহুর্তে আমাকেই ভুল বুঝছে।আমি যদি অন্য মেয়েদের সাথে কথা বলি সে ভীষণ রেগে যাবে।আর আমি তার অগ্নিচোখ সব থেকে বেশী ভয় পায়।আমার উইকনেস মানেই সে আর তার রাগ।আমি তো আর বিভোরের মতো ক্যারেক্টর লেস নই যে জিএফ থাকতে অন্য মেয়ের পিছে ঘুরবো।এটা বিভোর এর সাথে যায় আমার সাথে না।”

সবার মাথায় মনে হয় আকাশ ভেঙে পড়লো উনার মুখে এমন প্রেম ভালবাসার কথা শুনে।উনি তো এইভাবে ভালবাসার কথা প্রকাশ করেন না।আমি সিওর এই মেয়েগুলোকে এড়াতেই এমন ডাহা মিথ্যা বলছেন উনি।

–তোহা আপু বলে উঠলো,আজ রাগ করতে পারিনা বলে বিহান ভাই এর জিএফ হতে পারলাম নাহ।

–আবির ভাইয়া বললো,বিহান সারাজীবন শুনেই এলাম তোর এই বিশাল প্রেম কাহিনী। কিন্তু কোনদিন দেখলাম না। আসলেই কি আছে।

–আলবাত আছে, ছোট মানুষ আগে বড় হোক দেখাবো।

মনে মনে ভাবছি আল্লাহ আমার কাছে যেনো না আসে।আমি বিভা আপুকে আড়াল করে বসে মেহেদী লাগাচ্ছি।

“মেহু আপু বললো,বিহান ভাই মেহেদী পরবেন না,সবাই পরছে।”

“এগুলা মহিলাদের ব্যাপার।পুরুষ মানুষের হাতে মেহেদী দিলে হাতের ইজ্জত যাবে। তাছাড়া এখানে ডিজাইনার কে মেহেদীর।”

“দিয়া”

“উনি অবাক হয়ে বললেন দিয়া।কথার মাঝে আশ্চর্যজনক ভঙ্গি।তাইতো বলি মানুষের সুন্দর সুন্দর হাত এইভাবে কে নষ্ট করছে।এত বিশ্রি ডিজাইন মানুষ কিভাবে করতে পারে ছিঃছি।একদম ই ভাল হচ্ছে না ডিজাইন।সবার হাত কি যে বিশ্রি লাগছে।বুঝলাম না যা পারবো না তা করে ক্রেডিট নেওয়ার কি প্রয়োজন।দিয়া তোর দ্বারা এসব কিচ্ছু হবে না।তোর কাছে মাফ চাই তুই আর মানুষের হাতের বারোটা বাজাস না।”

“মানুষের মাঝে এমন ভাবে অপমান করবেন সেটা জানতাম।এত এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলাম কিন্তু পারলাম না।”

“উনি আবার বললেন,সিরিয়াসলি বলছি গাইস আমার শ্বশুরের মেয়ে যে এত সুন্দর করে মেহেদী ডিজাইন করে,দেখলেই প্রাণ জুড়িয়ে যায়।”

“আমি মেহেদী দেওয়া বন্ধ করে দিয়ে বললাম,আপনার শ্বশুরের মেয়ে না ওসুরের মেয়ে তার প্রশংসা আর কত বিহান ভাই।”

“ওসুর!ওহ মাই গড।একদম ই ঠিক বলেছিস।ওসুর না হলে মেয়েকে এইভাবে আটক রেখে কি আর তার জামাই কে কষ্ট দিতো।”

“আমি খানিক টা মেহেদীর পেষ্ট হাতে নিয়ে উনার পাঞ্জাবী তে লাগিয়ে দিয়ে রাগে ফুলতে ফুলতে বেরিয়ে এলাম।”

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।