প্রকৃতির যৌবন মাস চলছে। আকাশ, বাতাস, মাঠ, মাটি সর্বস্তরই নিজের যৌবন দ্বারা সুবাসিত করে রেখেছে শরৎরানি৷ আকর্ষিত মানব চিত্ত। চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে শুভ্র আলোকরশ্মি আর স্নিগ্ধ আবহাওয়া। প্রকৃতির এই রূপকে ভীষণ ভালোবাসে নামী৷ তার সেই ভালোবাসায় মুগ্ধতা ছড়িয়ে দিল সুহাস৷ জানালো, পরশু তারা রাঙামাটি বেড়াতে যাবে। শুধু তারাই নয় আইয়াজ, ফারাহও যাচ্ছে। সরকারি ছুটি পড়েছে। এই সুযোগে ঘুরে আসবে তারা৷ কথানুযায়ী ব্যাগপত্র গুছিয়ে ঢাকা চলে এলো নামী। সুহাসের কোয়াটারে। এসেই জানতে পারল আইয়াজ, ফারাহও এসেছে। অনেকদিন পর প্রিয় বান্ধবীকে কাছে পেয়ে বিগলিত চিত্তে ফারাহকে জড়িয়ে ধরল নামী। সুহাস এ দৃশ্য দেখে ঢঙ করে আইয়াজকে জাপ্টে ধরল। নামী খেয়াল করে সঙ্গে সঙ্গে ফারাহকে ছেড়ে সুহাসের দিকে তেড়ে গেল। সুহাস অমনি বন্ধু আর বন্ধুর বউয়ের সামনে জড়িয়ে ধরল নামীকে। লজ্জায় মূর্ছা গেল নামী। সুহাসের বুলে কিল বসিয়ে বলল,
‘ নির্লজ্জ। ‘
সুহাস দুষ্টুমি ভরে হাসল। ওর ছোট্ট ললাটে গভীর ওষ্ঠ স্পর্শ দিয়ে বলল,
‘ ইয়েস সম্পূর্ণ লজ্জা বর্জিত স্বামী তোমার। ‘
ওদের কাহিনি দেখে আর সুহাসের কথা শুনে ফারাহর মুখটা লজ্জায় লাল টমেটো হয়ে গেছে৷ খেয়াল করে চোখের চশমা ঠিক করতে করতে গলা খাঁকারি দিল আইয়াজ। অমনি সুহাস ছেড়ে দিল নামীকে। বলল,
‘ ধূরর দুইজোড়া তাকালে সমস্যা ছিল না। এ তো দেখি চার জোড়া তাকিয়ে আছে। ‘
ফারাহ স্তব্ধ। এই সুহাস ভাই আর বদলালো না। একই রয়ে গেল৷ খুব লজ্জায় ফেলে দেয় সবাইকে। আইয়াজ বলল,
‘ তোরও একজোড়া চোখের প্রয়োজন। চশমাকে চোখ বলছিস। নামী এক কাজ করো তো সুহাসকে চোখের ডাক্তার দেখাও। ‘
বেশ লম্বা সময় ওদের খুনসুটি চলল। যার অবসান ঘটল আইয়াজের ফোনে সৌধর ফোনকল এলে। আইয়াজ ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে সৌধ বলল,
‘ এই বদমাশ! স্টেশনে থাকতে বলেছিলাম তোকে। ‘
‘ দোস্ত বিলিভ মি থাকতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ফারাহ অসুস্থ ফিল করছিল বলে চলে আসছি। ‘
‘ বউ ছাড়া দেড় মিনিট চলতে পারিস না সেটা বল। থাকার ইচ্ছে থাকলে বউ রেখেও আসতে পারতি। ‘
আইয়াজ প্রচণ্ড নার্ভাস ফিল করতে লাগল। খেয়াল করে ছোঁ মেরে ফোনটা নিয়ে নিল সুহাস৷ কতগুলো মাস হয়ে গেল। সৌধর সঙ্গে নিজে থেকে যোগাযোগ করে না সে। সৌধও ব্যস্ত খুব। নিজের স্বপ্ন পূরণে সম্পূর্ণ মনোনিবেশ করেছে। দেড়মাস হলো চট্রগ্রাম মেডিকেলে হার্ট সার্জন হিসেবে জয়েন করেছে সৌধ। এর মাঝে কথা হয়েছে বার দুয়েক। তবু সে ফোন করেনি৷ সৌধ নিজেই ফোন করেছে৷ নিজের হালচাল জানিয়ে জেনে নিয়েছে তার হালচাল। বহুদিন পর বোধহয় স্বেচ্ছায় সৌধর সঙ্গে কথা বলল সুহাস। আইয়াজের থেকে ফোন নিয়েই সে বলল,
‘ পৌঁছে গেছিস? ‘
সৌধ একটু অবাকই হলো। পরোক্ষণেই ভাবল, পৃথিবীর কোনো শক্তি কি তাদের বন্ধুত্বে বিচ্ছেদ ঘটাতে পারবে? ভেবেই আলতো হেসে বলল,
‘ এইতো পৌঁছালাম। আগামীকালের টিকেট কেটেই আসছি। ‘
‘ আগামীকালই ফিরে যাবি? ‘
‘ ফিরব না কী করব? তোদের ব্যাগপত্রে ওঠিয়ে আমাকে সাজেক নিয়ে যাওয়ার ধান্ধা করছিস নাকি। শোন সুহাস, আমি ব্যাচেলর হতে পারি। কিন্তু কাবাব মে হাড্ডি না। ‘
দু বন্ধুর কথোপকথন চলল বেশকিছুক্ষণ। এরপর ফোন রেখে দিল সৌধ। সুহাস আইয়াজকে ফোন ফেরত দেয়ার সময় বলল,
‘ ওর ডেলিভারির ডেট কবে? ‘
আইয়াজ ধাতস্থ হয়ে উত্তর দিল,
‘ সামনে সপ্তাহ। রবিবার। ‘
‘ আমরা ঘুরে এসে নবজাতক সহ দেখা করব। কিন্তু সৌধ কি তখন আসতে পারবে? ‘
‘ মেবি না তবু কথা বলে দেখিস। নিধির ইচ্ছেটুকু জানাস। ‘
নিধি চায় ডেলিভারির আগে একবার বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে। কিন্তু ব্যস্ততা কাটিয়ে নিজেদের জন্য সময় বের করেছে আইয়াহ, সুহাস। যদি নিধির সঙ্গে সম্পর্কটা আগের মতো থাকত। তাহলে নিজেদের জন্য বাছাই করা সময় অনায়াসে দিয়ে দিত। কিন্তু পরিস্থিতিটা আজ এমন যে নিধিকে সময় দিতে গেলে ওদের বন্ধুদের তীব্র অস্বস্তি জড়িয়ে ধরে। সবচেয়ে বড়ো কথা যে স্থানে সৌধর থাকার কথা ছিল। সে স্থানে অর্পণ স্যারকে মেনে নিতে পারে না ওরা। শুনেছে অর্পণ স্যারের সঙ্গে ঝামেলা ঠিক হয়েছে নিধির৷ হবে নাই বা কেন? ক’দিন পর নতুন অতিথি আসবে। এসেই যদি বাবা, মা’কে সেপারেশনে দেখে ভালো লাগবে ওর? শিশুটা তো নিষ্পাপ। যা কিছু হচ্ছে এর জন্য ও তো কোনোভাবেই দায়ী নয়৷ নিধি, অর্পণ দু’জনই পূর্ণ বয়স্ক এবং শিক্ষিত। স্পেশালি দু’জনই ডাক্তারি প্রফেশনে আছে৷ তাই একটি শিশুর ভালো, মন্দ তারা দু’জনই খুব ভালো বুঝবে৷ পাশাপাশি নিজেদের ভুল গুলোও টের পাবে। দূরে গিয়ে ভুলবোঝাবুঝি বাড়ানোর চেয়ে। কাছে থেকে ভুল শুধরে নেয়াই বুদ্ধিমত্তার পরিচয়।
.
.
নামী আর ফারাহ মিলে রান্নাঘরে। আর তিন বন্ধু ড্রয়িং রুমে কফি আড্ডা দিচ্ছে। কখনো ওরা পুরোনো দিনে ফিরে গেল। কখনো বা ভবিষ্যত নিয়ে আলোচনা করল। হঠাৎ আইয়াজ বলল,
‘ সামনে সপ্তাহে নিধির ডেলিভারি। ও তো আমাদের খুব পুরোনো বন্ধু। আমাদের কি উচিত না ওর সঙ্গে একটিবার দেখা করা। নতুন অতিথিকে ওয়েলকাম করা? ‘
ওরা তিন বন্ধু ভীষণ ঘনিষ্ঠ। যখন একাকী একসঙ্গে সময় কাটায় তখন বাঙালি আর পাঁচ জন ছেলে বন্ধুদের মতোই মিশে যায়। একে অপরের সঙ্গে মারপিট করে, গালাগালি করে। সবচেয়ে বেশি গালি দেয় সুহাস। সৌধ দু একটা সহজ গালি দিয়ে ফেলে। আইয়াজ এমনিতে ভোলাভালা সভ্য হলে কী হবে। কলিজা পঁচানো গালি সেও জানে। প্রয়োজন পড়লে সে গুলো ব্যবহার করে প্রয়োজন ব্যতীত ব্যবহারিত হয় না৷ এ মুহুর্তে আইয়াজের বলা কথাগুলো আশা করেনি সৌধ। মানুষ কি তার জীবনের দূর্ঘটনা গুলো বার বার স্মরণ করতে চায়? দেখতে চায় ফেলে আসা দুঃস্বপ্ন? নিধি সৌধরও বন্ধু। তবু বন্ধুত্বের বাইরে গিয়ে নিধির প্রতি যে অনুভূতি সৃষ্টি হয়েছিল। তা যে আজ ক্ষতবিক্ষত। সে ক্ষত আজ সেরে ওঠলেই দাগ ঠিকই রয়ে গেছে। সে দাগকে দু-চোখে দেখার আগ্রহ পায় না সৌধ। তাই আওয়াজের বলা আকস্মিক কথাটায় মস্তিষ্ক বিগড়ে গেল তার। বেমালুম ভুলে গেল সে কোথায় আছে। মুখ ফস্কে বলে ফেলল,
‘ ধূরর বা*ল! এসবের জন্য ডেকে এনেছিস? ‘
‘ ছিঃ সৌধ ভাই! এসব বলে না। আপনিও এসব স্ল্যাং ইউজ করেন? ‘
থতমত খেয়ে গেল সৌধ। চমকে গিয়ে তাকাল নামীর দিকে। নিমেষে মুখ কঠিন হয়ে ওঠল ওর। নামী ভয় পেল একটু৷ সৌধ মুখ ফিরিয়ে নিল। সুহাস নামীর দিকে তাকিয়ে কপাল কুঁচকে বলল,
‘ কী চাই? ‘
‘ কফির মগ গুলো নিতে এসেছিলাম। ‘
‘ নিয়ে যাও। ফ্রেন্ড সার্কেল কথা বললে এসব হয়েই থাকে। তুমি কান দুটো বন্ধ করে কাজ করো। ‘
নামী আপাতত কিছু বলল না। সৌধ সম্পর্কে তার ধারণা অন্যরকম৷ তাই আকস্মিক ছোট্ট একটি গালি শুনে ভড়কে গিয়েছিল৷ খেয়াল করল সৌধও অস্বস্তি বোধ করছে৷ তার বোধহয় এভাবে প্রশ্ন করা উচিত হয়নি৷ সৌধ সবার কাছে যেমনি হোক৷ বন্ধুদের সঙ্গে নিশ্চয়ই বন্ধুসুলভই থাকে? ধূর বোকামি করে ফেলল। নামী কফির মগ নিয়ে রান্নাঘরে ফিরে গেলে মুখ খুলল সৌধ।
‘ বন্ধুর জন্য বড্ড বেশি দরদ উতলাচ্ছে তোদের। যা তোরা গিয়ে দেখা করে আয়। বেবিকে ওয়েলকাম কর। আমার পক্ষে পসিবল না। কারণ হিসেবে আপাতত উত্তর একটাই। ঐ বেবিটা আমার না। অথচ ও আমার হতে পারত! ‘
পরিবেশ গুমোট হয়ে গেল৷ নীরবতায় কাটল দীর্ঘক্ষণ। সুহাস, আইয়াজ নিধি বিষয়ে আর কথা এগুলো না। অন্য গল্পে চলে গেল সুহাস৷ চিন্তান্বিত গলায় বলল,
‘ ডিসেম্বরে নামী ইউ এস এ যেতে চায়। আমাদের দুজনেরই পাসপোর্ট আছে৷ ভিসার জন্য জোরাজোরি করছে। এদিকে মা বলেছে ডিসেম্বরে আনুষ্ঠানিক ভাবে নামীকে ঘরে তুলবে৷ দুজনের দুরকম সিদ্ধান্তের মাঝখানে পড়ে গেছি আমি। ‘
আইয়াজ কোনো মন্তব্য করল না। বিবাহিত জীবন সহজ নয়৷ পারিবারিক বহু জটিলতার সম্মুখীন হতে হয়৷ জানে সে। তাই নিশ্চুপ রইল। সৌধ পিঠ এলিয়ে বসেছিল৷ সুহাসের কথায় সোজা হলো। ভাবুক গলায় বলল,
‘ আন্টির কথা শুনে নামীর মতামত কী? ‘
‘ নামী জেদ করছে অত্যাধিক। এতদিন অপেক্ষা করানোর পর আরো সময় মা নেবে? মা যে খুশি মনে আমাদের জন্য আয়োজন করতে চাচ্ছে এটাই তো অনেক৷ নামী বুঝে না ব্যাপার গুলো। ‘
সৌধর বিশ্বাস হলো না। নামী এমন করতে পারে। তাই বলল,
‘ তুই বোঝাসনি? ‘
‘ ওর বাবা জানুয়ারিতে বাংলাদেশে আসবে। ও চায় অনুষ্ঠানে ওর পরিবারও উপস্থিত থাকুক। ‘
‘ চাওয়াটা অন্যায় নয়। এতবড়ো আয়োজন যখন হচ্ছে নামী বাবা উপস্থিত থাকুক। বেচারির মা নেই। বাবা থাকলে শান্তি পাবে। ‘
‘ কিন্তু মা…’
‘ তুই বুঝিয়ে বললেই বুঝবে। এ বছর তাহলে দু’বার হানিমুন হচ্ছে তোদের। এবার বেবি প্লানিং করে ফেল সুহাস। ‘
মজার ছলে সৌধ কথাটা বলতেই আইয়াজ সুহাসের কাঁধ চেপে ধরল। বলল,
‘ সিরিয়াসলি দোস্ত। নিধির একটা ছেলে হোক আর সামনে বছর তোর আর নামীর মেয়ে আসুক। তারপর তোরা বেয়ান, বেয়ানি সম্পর্ক পাতিয়ে ফেলবি। ‘
ঝোঁকের বশে। গল্পে মজে ফের নিধির কথা ওঠল। সৌধ দৃঢ় দৃষ্টিতে তাকাল আইয়াজের পানে। আইয়াজ থতমত খেয়ে বলল,
‘ সরি। ‘
সৌধ থমকানো গলায় বলল,
‘ সরি আমার বলা উচিত। আমার কারণে এত বছরের গভীর বন্ধুত্বে ফাটল ধরেছে। হাজার চাইলেও তোরা নিধিকে ভুলতে পারবি না। আসলে ভোলা যায়ও না। বন্ধু তো! ‘
গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল সৌধ। ভুলতে কি সে পারছে? পারছে না। সবকিছুর পরও কোথায় যেন একটা টান রয়ে গেছে। আচমকা নীরব হয়ে গেল সৌধ। চারপাশে অদ্ভুত স্নিগ্ধতায় ভরে ওঠল তার। অন্তঃকোণ বলে ওঠল,
‘ সামনে সপ্তাহে নতুন একটি প্রাণের আগমন ঘটবে। নিধির সন্তান সে। নিধি মা হচ্ছে… অথচ সে বাবা হতে পারল না। ‘
নিমেষে বুক ভার হয়ে গেল। আফসোস মিশ্রিত এক টুকরো নিঃশ্বাস বের হলো নাসিকা বেয়ে। বুকের গহীনে অসহ্য এক পীড়া শুরু হতেই ঝড়ের বেগে ভারিক্কি বুকটায় বর্ষণ নামল। একদম বিনা বজ্রপাতে। এ বর্ষণ আকাশ চিঁড়ে নয় এ বর্ষণের আগমন ঘটল কারো একজোড়া চোখ চিঁড়ে। কী আশ্চর্য! আজো ওই হরিণী চোখ দু’টির নোনাজল ভিজিয়ে তুলে তার বক্ষগহ্বরে খরায় আক্রান্ত মৃত্তিকাকে।
সৌধর শান্ত রূপ বন্ধুদের অশান্ত করে তুলল। সুহাস কাঁধ ধাক্কা দিয়ে বলল,
‘ কী ভাবছিস? ‘
চমকে ওঠল সৌধ। অধর কামড়ে ভাবুক কণ্ঠে বলল,
‘ ভাবছি না, বোঝার চেষ্টা করছি। ‘
‘ কী? ‘
‘ পুরোপুরি বোঝার পর বলব। ‘
জীবনে কখনো কখনো এমন একটি সময় আসে। যখন আমরা নিজেরাই নিজেদের বুঝতে পারি না, চিনতে পারি না৷ চেনা আমিটা যখন অচেনা হয়ে যাই। তখন চারপাশের সবকিছু অস্বস্তিকর মনে হয়। যে অস্বস্তি কখনো আমাদের অস্থির করে তুলে৷ কখনো বা জড়িয়ে ফেলে প্রগাঢ় নিস্তব্ধতায়।
সৌধর কথা শুনে সুহাস ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল। ওদিকে নামীর গলা শুনতে পাওয়া গেল,
‘ সুহাস, তোমরা কি এখনি ডিনার করবে? নাকি লেট হবে। ‘
‘ লেট হবে। ‘
গলা উঁচিয়ে বলল সুহাস৷ ফিরতি কথায় নামী শুধাল,
‘ তোমরা আজ একসাথে থাকবে তো। রুম গুছিয়ে দেব? ‘
‘ দাও। ‘
বহুদিন পর আজ তিন বন্ধু একসঙ্গে রাত কাটাবে৷ বহুদিন পর দুই বান্ধবীও একসঙ্গে ঘুমাবে। আজ ওরা প্রত্যেকেই ভীষণ উল্লসিত।
.
.
ওজন মাপার মেশিন এখন সিমরানের ঘরেই রাখা হয়েছে। অবসর নেয়ার পর থেকে বেশ মন দিয়ে সংসার সামলাচ্ছে উদয়িনী৷ সেই সঙ্গে ছেলেমেয়ের কাছে ধরাও পড়েছে। রোজ গাদাগাদা ওষুধ সেবন করে উদয়িনী। তার ডক্টর ছেলে একদিন ধরে ফেলল মায়ের দেহে ডায়াবেটিস আছে। প্রেশার সব সময় হাই। আজ থেকে ছয় বছর আগেও একদম সুস্থ, সবল ছিল মা। অথচ আজ দেহে নানারকম রোগ ভর করেছে। কঠোর নিয়মে চলতে হয় উদয়িনীকে। সে নিয়ম মানার পাশাপাশি সিমরানের যত্নে ত্রুটি রাখে না। সারাজীবনের সব যত্ন যেন একবারে ঢেলে দিচ্ছে মেয়েটাকে। তিনবেলার এক বেলাও নিজহাতে ভাত খেতে হয় না সিমরানকে। যেন দিন দিন তার বয়স বাড়ছে না কমছে। অন্তত মায়ের আদর, ভালোবাসা দেখে তো সিমরানের তাই মনে হয়৷ মাঝে মাঝে ভাবে ভাগ্যিস মা তার প্রতি কেয়ারিং হয়েছে। নয়তো সৌধ ভাইকে না পাওয়ার যন্ত্রণা একদিন নিঃশেষ করে দিত তাকে।
রাতের খাবার তৈরি। মেয়েকে ডাকতে এসে ভ্রু কুঁচকাল উদয়িনী। সন্ধ্যা থেকে ফোন ঘাঁটছে মেয়েটা৷ এখনো সেই তালেই আছে। তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল সে। এগিয়ে এসে শাসনের সুরে বলল,
‘ আম্মুজান? এখনো ফোনে কী? অতিরিক্ত ফোন দেখলে স্বাস্থ্যটা আবার খারাপ করবে। চোখের নিচে আবার ডার্ক সার্কেল দেখা দেবে। রাখো ফোন। নিচে চলো খেয়েদেয়ে পড়তে বসবে। ‘
মায়ের মিষ্টি বকা খেয়ে হাসল সিরমান। ফোন রেখে ওঠতে ওঠতে বলল,
‘ কিচ্ছু হবে না আম্মু। তুমি আছো তো আমার পাশে। তুমি পাশে থাকলে আমার কিচ্ছু হবে না। ডক্টর উদয়িনীর মেয়ে আমি। কোন অসুখের সাধ্য আমাকে গ্রাস করে? ‘
হিহি করে হেসে ফেলল সিমরান। মেয়েকে টেনে নিয়ে ওয়েট মেশিনে দাঁড় করাল উদয়িনী। উপরের ঠোঁট দ্বারা নিচের ঠোঁট চেপে ধরে ওজন দেখল। এরপর মৃদু হেসে বলল,
‘ বাহ নাইস! আটচল্লিশ হয়ে গেছ। ‘
আঁতকে ওঠল সিমরান। বলল,
‘ আল্লাহ! আর বাড়ানো যাবে না বুঝছ আম্মু। লোকে মটু বলবে। ‘
‘ ধূর পাগলী। পাঁচ ফুট তিন উচ্চতার মেয়েদের আটচল্লিশ কোনো ওজনই না। আরো বাড়াতে হবে। চলো খেয়ে নিবে। খাওয়ায় বড্ড অনিয়ম করো। আমার অনুপস্থিতিতে এসব করে করেই চেহেরার বাজে হাল করেছিলে। এখন আয়নায় গিয়ে নিজেকে দেখলে প্রাউড ফিল হয় না? ‘
হাসল সিমরান। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে নামতে উদয়িনী বলল,
‘ খাবারদাবার আর ঘুম এই দু’টো জিনিস ঠিকঠাক রাখবে। কোনোকিছু নিয়েই দুঃশ্চিতা করবে না। তাহলে মন, শরীর দু’টোই ফিট৷ আর সব সময় মনে রাখবে দুঃশ্চিন্তা তোমার জীবনে একবিন্দু সফলতাও এনে দিতে পারবে না। দুঃশ্চিন্তা মানুষকে গ্রাস করে নেয়।’
খাবার টেবিলে সব গুছানোই ছিল। উদয়িনী খুব যত্ন করে খাইয়ে দিল মেয়েকে। সিমরান নিজের ফোন ঘরে রেখে এসেছে। তাই মায়ের ফোন থেকেই বাবাকে কল করল। বাবা রিসিভ করতেই সে আহ্লাদী স্বরে বলল,
‘ মাঝে মাঝে কী মনে হয় জানো আব্বু? ‘
মেয়ের মুখ দেখেই মুখে হাসি ফুটল সোহানের৷ বলল,
‘ কী বাবা? ‘
‘ মনে হয় এতদিন আমি বড়ো ছিলাম। আর এখন শিশু বয়স পাড় করছি। ‘
কথাটা বলেই ক্যামেরা মায়ের দিকে তাক করল। উদয়িনীর মুখ দেখে হাসি প্রশস্ত হলো সোহানের। বলল,
‘ সেলিনা আসেনি আজ? ‘
‘ এসেছিল। সন্ধ্যায় চলে গেছে। ‘
মেয়ের মুখে খাবার তুলে দিয়ে উত্তর দিল উদয়িনী। সোহান খন্দকার বলল,
‘ তোমায় ভীষণ ক্লান্ত দেখাচ্ছে। ‘
সহসা চমকাল উদয়িনী। সোহান বলেছে তাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে। এর মানে সুক্ষ্ম নজরে সোহান খেয়াল করেছে তাকে। আচমকা চোখ ঝাপসা হয়ে এলো উদয়িনীর৷ স্বামী আর মেয়ের চোখে ধরা পড়ার ভয়ে দৃষ্টি নত করে ভাত তরকারি মাখাতে শুরু করল। সিমরান ক্যামেরা নিজের দিকে ঘুরিয়ে উৎসুক হয়ে বলল,
‘ কবে আসবে আব্বু? মিস ইউ… ‘
‘ এইতো মা পরশু ফিরছি। ‘
.
.
ঠিক তিনদিন পর। আজ সেলিনা আপা আসেনি। গতকাল থেকে তার ছেলের ভীষণ জ্বর। হাসপাতালে নিয়ে যাবে। উদয়িনী বলেছে ব্লাড টেস্ট করে রিপোর্ট এনে দেখাতে। গতরাতে উদয়িনী সিমরানকে জিজ্ঞেস করতে এসেছিল। সকালে কী খাবে সে? হঠাৎ করেই সরষে ইলিশ খেতে চেয়েছে সিমরান। কারণ তার মামা গতকাল অনেক বড়ো একটি ইলিশ মাছ পাঠিয়েছে। আবদার শুনে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে উদয়িনী বলে,
‘ এটা কখনো করিনি। ইউটিউব দেখে শিখে নিব। খারাপ লাগলে নাক কুঁচকাবে না। ‘
সত্যি বলতে উদয়িনী এতকাল সেভাবে কোনো রান্নাই পারত না। অবসর নেয়ার পর সেলিনার কাছে আর ইউটিউব ঘেঁটে শিখেছে অনেকটাই। সরষে ইলিশ এখন পর্যন্ত রাঁধেনি সে। সিমরানের আবদার শুনে সকাল সকাল ওঠে ইউটিউব দেখে রাঁধবে সিদ্ধান্ত নেয়। রাতে একবার রেসিপিটা দেখেছে৷ সকালে আর একবার দেখলেই হয়ে যাবে।
নতুন আরো একটি সকাল। বেলা তখন ন’টা পঁচিশ। প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে সিমরানের। ঘড়িতে সময় দেখে চমকে ওঠে সে।’ কী ব্যাপার! আম্মু আজ এখনো ডাকতে এলো না। ‘ নাক ফুলিয়ে বসে রয় মেয়েটা। পরোক্ষণেই খুশিতে চিত্ত চঞ্চল হয়। নিশ্চয়ই আম্মু সরষে ইলিশ ট্রাই করতে গিয়ে তাকে ডাকতে আসতে পারেনি। আজ সেলিনা আপাও নেই। ইশ আম্মুর ওপর চাপ হয়ে গেল৷ ভেবেই দেরি না করে চটজলদি ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমে আসে। রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে দেখে ঘরটা ফাঁকা। চুলা জ্বলছে না। তবে কি রান্না শেষ? আম্মু উপরে। ঠোঁট ফুলালো সে। গুটিগুটি পায়ে নাক বাড়িয়ে এগিয়ে গেল। প্রতিটি কড়াই, পাতিলের ঢাকনা উঁচিয়ে উঁচিয়ে খুঁজল সরষে ইলিশের ঘ্রাণ৷ নিমেষে নিরাশ হলো সে। অভিমানে বুক ভার। তবে কি আম্মু রান্না করেনি? তাহলে সে এখন খাবে কী? তার যে প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে। প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে উপরে ওঠে এলো সিমরান। মায়ের ঘরের সামনে গিয়ে স্বাভাবিক শক্তিতে দরজা ধাক্কা দিতেই বুঝল ভেতর থেকে দরজা আটকানো। প্রথমে বিস্মিত হলো। এরপর রাগান্বিত হয়ে দরজায় মৃদু থাপ্পড় দিয়ে ডাকল,
‘ আম্মু, আম্মু দরজা খোল। ‘
ভেতর থেকে সাড়াশব্দ পেল না। আশ্চর্যের চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেল যেন। মুহুর্তেই ভাবনায় এলো, আম্মু কি ওয়াশরুমে গেছে? ধূরর। হতাশ হয়ে নিজের ঘরে ফিরে এলো। ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে দু’টো চকোলেট ছিল। তার থেকে একটি নিয়ে খেতে খেতে ফের মাকে ডাকতে এলো। ফের দরজায় ঠকঠক করতে করতে বলল,
‘ অ্যাঁই আম্মু, কী করছ তুমি দরজা খুলছ না কেন? খিদে পেয়েছে আমার। ‘
মেজাজ ক্রমশ খারাপ হতে লাগল এবার। আকস্মিক খেয়াল করল জানালা খোলা। দেরি না করে ছুটে এলো জানালার কাছে৷ চকোলেট চিবুচ্ছে সে৷ পাশাপাশি জানালা গলিয়ে ভেতরে তাকাতেই আশ্চর্য হয়ে গেল। সে কী! আম্মু যে এখনো ঘুমুচ্ছে। এবার গলার স্বর উঁচু হলো সিমরানের। ডাকতে লাগল অবিরত। এক পর্যায়ে তার আম্মু আম্মু ডাক আচমকা থেমে গেল। কেউ যেন সহসা বুকের ভেতর বিশাল এক পাথর চেপে ধরল । শ্বাসরোধ হয়ে এলো নিমিষে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত থরথর করে কেঁপে ওঠল। ঠোঁট দু’টিও একসঙ্গে চেপে রইল না। কাঁপতে শুরু করল তিরতিরিয়ে৷ সর্বাঙ্গ অবশ হতে গিয়েও এক ঝটকায় স্বাভাবিক করে নিল নিজেকে। জোরপূর্বক মুখে হাসি টেনে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
‘ তোমার কি শরীর খারাপ আম্মু? ও আম্মু, দরজা খোলো। দরজা না খুললে তোমার কাছে যাব কীভাবে? কী হয়েছে তোমার, জ্বর হয়েছে? ‘
আশপাশে অদ্ভুত ভাবে তাকাল সিমরান। মাথাটা ঘুরছে। ধীরেধীরে পা এগুলো। নিজের ঘরে গিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে ফোন তুলল। কল করল আব্বুকে। ফোন রিসিভ হতেই ঢোক গিলে শান্ত গলায় বলল,
‘ আম্মু এখনো ঘুম থেকে ওঠেনি আব্বু। মনে হয় শরীর খারাপ। জানো আম্মু কী করেছে? দরজা ভেতর থেকে লক করে ঘুমিয়েছে। এত ডাকছি তবু ওঠছে না। এখন আমি কী করে ভেতরে যাব? ‘
কথাগুলো বলতে বলতে সিমরান অনুভব করল ওর কণ্ঠনালী দিয়ে আর কথা বেরুচ্ছে না৷ ওপাশে কী আব্বু কিছু বলল? সে তো শুনতে পেল না। যখন হুঁশ এলো দেখল ফোন কেটে গেছে। সিমরান শান্ত ভঙ্গিতে আবার মায়ের ঘরের সামনে চলে গেল। দরজা ঠকঠক শব্দে মুখরিত করল বারকয়েক। ডাকল,
‘ আম্মু, গলা শুঁকিয়ে যাচ্ছে ডাকতে ডাকতে। তুমি কি দরজা খুলবে নাকি রাগারাগি করব আমি? অনেকদিন আমার ভাঙচুর দেখো না তাই না। আমি কিন্তু খুব রেগে যাচ্ছি আম্মু। ‘
এবারেও কণ্ঠনালী রোধ হয়ে এলো। ঘামতে শুরু করল সিমরান৷ শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেল শীতল স্রোত। একটুক্ষণ থম মেরে দাঁড়িয়ে থেকে কল করল ভাই সুহাসকে। সুহাস রিসিভ করতেই সিমরান শান্ত কণ্ঠে থেমে থেমে বলল,
‘ অ্যাঁই ভাই, আম্মু এখনো ঘুম থেকে ওঠেনি জানো? এত ডাকছি ওঠছেই না৷ দরজা লক করে ঘুমিয়েছে। আমি ভেতরেও যেতে পারছি না। ‘
‘ সাড়ে দশটা বাজে আর মা ঘুম থেকে ওঠেনি? সিনু বাবাকে কল কর। মায়ের শরীর খারাপ হয়তো। আমি মাকে কল করছি। ‘
সুহাস কেটে দিল৷ কিয়ৎক্ষণ পরই উদয়িনীর শিয়রে থাকা ফোনটা বাজতে লাগল অনবরত। সিমরান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখল বার বার ফোনটা বেজে কেটে যাচ্ছে। অথচ তার আম্মু ওঠছে না। আম্মুর ঘুম তো এত প্রগাঢ় নয়। সে ঘুমালে তার রুমে কেউ হাঁটাহাঁটি করলেও জেগে ওঠে। আজ তাহলে এত ঘুমাচ্ছে কেন? ঘুমের ওষুধ খেয়েছে কী? আচমকা হাতে থাকা ফোনটির রিং বাজতেই কেঁপে ওঠল সিমরান। স্ক্রিনে বাবা নামটা জ্বলজ্বল করছে।