অঙ্গনে হৃদরঙ্গন | পর্ব – ১

মাঝরাত, প্রকৃতিতে ছড়িয়ে আছে ঘন অন্ধকার। সাথে হালকা কুয়াশা, ডেকে আনছে শীতের আভাস। তবে আকাশটা ঝকঝকে। জোছনা নেই তবুও উজ্জলতা বিদ্যমান। সময়টা দুই’টার কাছাকাছি। সাদাফ বিরতিহীন পা ফেলে হাটছে। হাতে সিগারেট, কখনো বাতাসের সংঘর্ষে জ্বলে যাচ্ছে, কখনো বা মুখে টেনে জ্বালিয়ে শূন্যে ধোঁয়া ছাড়ছে। মাঝে মাঝে এদিক সেদিক তাকাচ্ছে অহেতুক। বড় রাস্তার দিকে ল্যাম্পপোস্ট ছিলো, কিন্তু গলির এই সরু রাস্তাগুলোতে তার উপস্থিতি নেই। কোনো কোনো ঘরবাড়ি হতে ছুটে আসা একটু আধটু আলো আর দোকানের বারান্দায় জ্বালানো লাইটে যতটুকু আলোকিত করে তুলেছে এই রাস্তাকে। হাটতে হাটতে সে নুরুমিয়ার ঘরের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। কাঠের দরজায় দু’তিন বার ঠকঠক শব্দ করতেই ভেতর থেকে সাড়া এলো,
“কে রে?”
“সাদাফ।”
জবাবের পরপর হাতের অবশিষ্ট সিগারেটে শেষ টান দিয়ে মাটিতে ফেলে দিলো। পা দিয়ে সেটাকে পিষে ধুলোর সাথে মিশিয়ে দিলো। নুরুমিয়া তড়িঘড়ি করে দরজা খুলে মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো,
“আরে, ভাইজান যে! আসো, আসো। ভেতরে এসে বসো।”
সাদাফ মুখের ধোঁয়া উড়িয়ে, উড়ন্ত ধোঁয়া হাতে মুখের সামনে থেকে সারাতে সরাতে বললো,
“ঘুমের ডিস্টার্ব করলাম নাকি?”
নুরুমিয়া মুখে হাসির রেখা প্রশস্ত করে বললো,
“আরে, না! কি যে কও মিয়া! তুমি আসবা আর ঘুমের আবার ডিস্টার্ব! তা হঠাৎ এতো রাতে কি মনে করে?”
সাদাফ ঘরে প্রবেশ করতে করতে বললো,
“তোমার কাছে আবার কি মন নিয়ে আসতে হয়?”
নুরু মিয়া অহেতুক হেসে বললো,
“না সেইটা না। এদিকে কোনোদিকে গিছিলা নাকি? নয়তো এতো রাতে কোত্থেকে?”
“দাবা ঘরে ছিলাম। ভাবলাম সপ্তাহ যাবত পালিয়ে বেড়াচ্ছো, একবার তোমাকে ধরা প্রয়োজন। রাতে অন্তত ঘরে পাওয়া যাবে। তা এবার আমার পাওনা বুঝিয়ে দাও। দিন গুণতে গুণতে তো বছর পেরিয়ে গেলো। আমারও হাত টান পড়েছে।”
বলতে বলতে কাঠের চেয়ারটায় হেলান দিয়ে বসলো সে। নুরু মিয়া ইতস্ততবোধ করে বললো,
“না, মানে.. এতো রাতে.. আমি কিভাবে কি!”
“রাত আর দিন কি? হাতে থাকলে দিতে সময় লাগে নাকি? আর দিনে তোমাকে পাওয়া যায় নাকি?”
“আর কয়টা দিন সময়…”
“সময় অনেক দিন চলে গেছে। এবার তুমি আমাকে মাফ করো। জলদি টাকা দাও, বাড়ি ফিরে একটু ঘুমাতে হবে। দুদিন যাবত ঘুম হয় না।”
“ভাই, বিশ্বাস করো। পাঁচটা টাকাও আমার সঞ্চয় নাই। তাহলে কি বারবার তোমার এভাবে চাইতে হয়। আমারই লজ্জা লাগে, বারবার তোমাকে খালি হাতে ফেরত দিতে হয়।”
“তাহলে লজ্জা কি আমার লাগার কথা?”
“না, তা কেন! প্রাণপণ চেষ্টা করছি তোমার ঋণ পরিশোধ করার। আগামী সপ্তায় পুরাটা না হইলেও অর্ধেকটা দিমুই। তোমার আসাও লাগবো না। আমি নিজে যামু তোমার বাড়ি।”
“শুনো, এতো বাহানায় কাজ নেই। আমি টাকা না নিয়ে নড়ছি না এখান থেকে।”
“তুমি এখানে থাকো, খাও আমার আপত্তি নাই। তবুও এইটুকু বিশ্বাস করো, আমার হাতে পাঁচটা টাকা সঞ্চয় নাই। সেখানে তোমার ত্রিশ হাজার তো বহুদূর!”
“পাঁচ টাকা না থাকলে খাও কি? বাঁচো কি করে?”
“সেই কোনোমতে। দেখোই তো অবস্থা।”
“এতো দেখাদেখির প্রয়োজন নেই। ত্রিশের জায়গায় দশ হলেও দাও এখন।”
নুরু মিয়া মেঝেতে বসে সাদাফের হাটুতে হাত রেখে বললো,
“বিশ্বাস করো, আগামী সপ্তায় ঠিক যামু।”
“বিশ্বাস, তা-ও আবার তোমাকে? আজ না পারলে আগামী সপ্তাহেও পারবে না। আমার এখনই লাগবে। হতে পারে আগামী সপ্তাহে তোমাকেই আর পাওয়া যাবে না।”
“না, ভাই। না। এখন চাইলে তুমি আমার জানটা নিয়া যাইতে পারো, কিন্তু হাতে টাকা ধরানোর সাধ্য আমার নাই।”
“এতো চুরি বাটপারি করো, তাও হাতে টাকা থাকে না! সেই টাকা যায় কোথায়, হ্যাঁ? এদিকেও সংসার বাঁধছো নাকি দুচারটা?”
নুরু মিয়া লজ্জাবোধ করে বললো,
“ছি! ছি! নিজের জীবন চলে না। দেশে বউ বাচ্চারে কিছু পাঠাইতে পারি না। আবার নতুন সংসার! তা-ও আবার তোমার মতো লোকের ঋণ রাইখা! এতো দয়ালু…”
“তোমার মুখে প্রশংসা শুনতে আসিনি, টাকা পেলেই আমি চলে যাই।”
নুরু মিয়া পা টিপতে শুরু করে বললো,
“ভাই, সত্য কথা। ঘর তল্লাশি কইরা দেখো। যদি কিছু পাও, নিয়া যাও। আমি মানা করমু না। একটু সময় চাই তোমার কাছে।”
“বয়স হয়েছে, একটু লজ্জা হওয়াও উচিত ছিলো। এভাবে আর ক’জনের পা টিপাটিপি করো এই বয়সে? সেদিনও আশি হাজার টাকার মামলা থেকে বাঁচিয়ে দিলাম। আমি নিজেও ছাব্বিশ হাজার টাকা মওকুফ করলাম। নেওয়ার সময় এতো ফন্দি, দেওয়ার সময় নেই কেন? ছাড়ো!”
সাদাফ বিরক্তি নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। বেরিয়ে যাওয়ার আগে বলে গেলো,
“আগামী সপ্তাহে যেন আবার আমাকে এখানে না আসতে হয়। মাথায় থাকে যেন।”
“হ্যা, হ্যাঁ থাকবো।”
সাদাফ কপাল কুচকানো রেখে বেরিয়ে গেলো। যে গতিতে হেটে এসেছিলো তার চেয়ে কিছুটা দ্রুত গতিতে হেটে নিজের আশ্রয়স্থলে ফিরে এলো। তালা খুলে ঘরে প্রবেশ করে জগ থেকে ঢেলে এক গ্লাস পানি পান করলো। তারপর আবার বেরিয়ে বাথরুমে এসে পা ধুয়ে পকেট থেকে আরেকটা সিগারেট নিলো। লাইটার নিতে নিতে ঘরে এসে দরজা আটকে লাইটারটা আবার পকেটে রেখে দিলো। সিগারেটটাও না জ্বালিয়ে মুখ থেকে নামিয়ে নিলো হাতের মুঠোয়। ঘুম জড়িয়ে এসেছে চোখে তাই আপাতত সিগারেট খাওয়ার ইচ্ছাটা বাদ দিলো। হাত পা ছড়িয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লো বিছানায়। মুঠোয় ধরা সিগারেটটাও ছেড়ে দিলো ধীরে ধীরে। মগ্ন হয়ে গেলো গভীর ঘুমে।
কখনো খেয়ে কখনো না খেয়ে কাটে তার দিন। কিন্তু ধুমপান চলে নিত্যদিন। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন প্রায় চার বছর। দিনগুলো এভাবেই কেটে আসছে এতো বছর ধরে। কখনো শহুরে দালানকোঠা কেনাবেচা কিংবা জমিজমার ব্যাপারে দালালি করে কিছু আয় করছে, কখনো বা পৈত্রিকসূত্রে পাওয়া নিজের অংশ বিক্রি করে প্রয়োজন মেটাচ্ছে। বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবনা তার নেই। চাইলে এই দালালি করেও সে নিজের জীবন সচ্ছলভাবে পরিচালিত করতে পারে। কিন্তু একাধারে কাজ করার কোনো ইচ্ছা এবং প্রচেষ্টা তার নেই। প্রয়োজন পড়লে একটু আধটু করে, অনেক লোকজন এসে ধরলেও একটু আধটু অগ্রসর হয়। হাতে কিছু টাকা এলেই অগ্রগতি থেমে যায়। যত্রতত্র উড়িয়ে ছাই করে ফেলে। নুরু মিয়ার মতো অনেকেই এসে হাত পাতে তার কাছে। ইচ্ছে হলে দেয়, নয়তো দেয় না। আবার সেই টাকা কেউ ফিরিয়ে দেয়, কেউবা পালিয়ে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। এমনই ছন্নছাড়া জীবন চলছে তার। হয়তো এভাবেই চলতে থাকবে।
পরবর্তী সপ্তাহের ঠিক প্রথম দিনেই নুরু মিয়া হাজির এখানে। সাথে এসেছে একজন যুবতী। সময় তখন সকাল সাড়ে দশটা। বেশ কিছুক্ষণ সাদাফের দরজায় কড়া নাড়ার পর সাদাফ চোখেমুখে বিরক্তি নিয়ে দরজা খুললো। নুরু মিয়াকে দেখে বললো,
“সকাল সকাল এই তোমার মুখ দেখতে হলো! তার আগে তো কেউ এসে ডাকতে পারতো।”
বিপরীতে নুরু মিয়া দাঁত বের করে হেসে বললো,
“তা প্রত্যাশা করতেই পারো। কিন্তু সকাল হলো তো অনেক্ক্ষণ। দুপুরের বেলা গড়িয়ে আসছে।”
“আসুক, তাতে তোমার কি? কেন এসেছো সেটা বলো। পাওনা এনেছো তো?”
“হ্যাঁ, এনেছি বটে। ভেতরে তো আসতে দাও…”
সাদাফ পাশে দাঁড়িয়ে থাকা শ্যামকালো যুবতীকে উদ্দেশ্য করে ব্রু কুচকে বললো,
“সে কে?”
মেয়েটি মাথার গুছানো আঁচলই আবার টেনেটুনে ঠিক করে নিলো। নুরু মিয়া জবাব দিলো,
“সে ই তো সব। ভেতরে আসতে দাও। ঠান্ডামাথায় সব বলি।”
সাদাফ দরজার বাইরে এসে তাদের যেতে দিয়ে বললো,
“যাও, বসো গিয়ে। আমি হাতমুখ ধুয়ে আসছি। কোনো জিনিসপত্রে হাত লাগিয়ো না যেন।”

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।