অফিডিয়ান | পর্ব – ৫৮

৬৯. রুমাইশা ওর কালো পোশাকে নিজেকে আবার আবৃত করে নিতে নিতে সাফওয়ানকে বলল,
— আগামী কাল দুপুর ঠিক একটায়, আপনার জন্য যে পোশাক টা এনেছি সেটা পরে তৈরি থাকবেন। ব্লুটুথ ডিভাইস টা নিতে ভুলবেন না। ওটার সাহায্যে আপনার সাথে যোগাযোগ করবো আমি। সময় মতো আপনাকে এখান থেকে বের করে নিয়ে যেতে আসবো আমি। এখানে আসার সময় আমি গোপন রাস্তা দিয়ে এসেছি, কিন্তু এখন ফেরার সময়ে আমি ওদের সামনে দিয়েই বের হবো। আর আগামী কাল আমি ওদের সামনে দিয়ে এখানে প্রবেশ করবো, কিন্তু আপনাকে নিয়ে গোপন রাস্তা দিয়ে বের হবো।

সাফওয়ান রুমাইশার কথা শুনছে আর জোনাসের দেওয়া ম্যাপ টা দেখছে। কিন্তু সেখানে নিজের অবস্থানের কোনো চিহ্ন দেখলো না ও। ইভেন এই রুমটারই কোনো অস্তিত্ব নেই সে ম্যাপে। সাফওয়ান কিছু টা অবাক হয়ে রুমাইশার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— তুই আমাকে খুজে পেলি কিভাবে? ম্যাপে তো এই রুম টার ই কোনো অস্তিত্ব নেই। ম্যাপের হিসাব মতে তো মেইন ল্যাব রুম গুলো সব দক্ষিনের দিকে, আর উত্তরের এই জায়গাটাতে তো কিচেন আর পরিত্যক্ত খালি জায়গা হিসেবে দেখানো হয়েছে! তাহলে তুই আমাকে খুজে পেলি কিভাবে? এই এরিয়ায় যে আমি থাকতে পারি, সেটাই বা তুই বুঝলি কি করে?

ওর কণ্ঠে বিস্ময়ের সুর৷ রুমাইশা নিজের মুখ টা কালো কাপড়ে কায়দা করে বাধতে বাধতে মৃদু স্বরে বলল
— এই পৃথিবীতে যদি আমার সবচেয়ে বেশি চেনা কোনো ঘ্রাণ থাকে, তবে সেটা আপনার শরীরের ঘ্রাণ৷ তাই আপনি পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুন না কেন, আমার এই নিঃশ্বাসই আমাকে আপনার কাছে পৌছে দিবে৷

সাফওয়ান নিচের ঠোঁট টা কিঞ্চিত ফুলিয়ে, ভ্রু জোড়া উঁচু করে রুমাইশার এই গুণের তারিফ করলো নিরবে৷
মুখ বাধা শেষ হলে রুমাইশা ওর লম্বা পোশাক টার হুডি টা নিজের মাথায় চড়িয়ে নিয়ে হুডির সাথে সংযুক্ত অন্য একটা পুরু, কালো কাপড়ে নিজের চোখ দুইটা ঢেকে নিলো। এতে ওর চোখের উজ্জলতা পুরোপুরি না হলেও বেশ অনেক খানিই আড়াল হয়ে গেলো।

রুমাইশা পুরোপুরি তৈরি হয়ে নিয়ে বলল,
— আমি এখনি বেরিয়ে যাবো৷ আপনি তৈরি হয়ে থাকবেন সময় মতো। আর বিশেষ অসুবিধা না হলে প্লান এ কোনো চেঞ্জ হবে না। গোপন রাস্তার ওপারে জোনাস আর আপনার বড়োলোক বন্ধু রিচার্ড ওর প্রাইভেট জেট নিয়ে অপেক্ষা করবে। আমরা এই খান থেকে সহিহ সালামতে বের হতেই পারলেই আর কোনো চিন্তা থাকবে না। সোজা আপনার বহুল আকাঙ্ক্ষিত আমাজনে গিয়ে পৌছাবো৷

কথা গুলো বলে নিজের বাধা মুখের ওপর দিয়েই টুক কর সাফওয়ান এর ঠোঁটে একটা চুমু বসিয়ে দিয়ে নিজের প্যান্টের পকেট থেকে সাফওয়ানের টু সাইডেড সৌর্ড টা বের করে সাফওয়ানের কোলের ওপর ছুড়ে দিলো। আর এরপর নিজের কালো রঙা ব্যাকপ্যাক টা নিয়ে ও দরজা খুলে বেরিয়ে গেলো৷
সাফওয়ান ওর সৌর্ড টা হাতে নিয়ে একবার তার ওপর চোখ বুলিয়ে, তাকিয়ে রইলো ওর রিমুর যাওয়ার পানে৷ মনে মনে নিজের স্ত্রীর নিরাপত্তার জন্য সৃষ্টিকর্তার নিকট দুয়া করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো ও৷ তারপর আবার জোনাসের দেওয়া ম্যাপ খানার দিকে নজর বোলাতে লাগলো। মাথার ভেতর ম্যাপের চিত্র টা গেথে নেওয়ার চেষ্টায় আছে ও এখন৷

রুমাইশা দরজা দিয়ে বেরিয়েই সামনের লম্বা বারান্দা দিয়ে হেটে যেতে লাগলো, বারান্দাটার দু পাশেই সারি সারি কামরা। সেগুলো সব পরিত্যক্ত। সাফওয়ান কে অন্যান্য সাধারণ ল্যাব কর্মচারীদের থেকে লুকাতে বিশেষ ভাবে ওই রুম টি তৈরি করা হয়েছে। এবং সন্দেহের তালিকায় না আসার জন্য এইদিকে কোনো গার্ড ও রাখেনি ওরা৷ শুধুমাত্র বারান্দাতে ঢোকার মুখে লেজার ট্র‍্যাপ দিয়ে রেখেছে, যেটার কথা ম্যাপে উল্লেখ করা না থাকলেও রুমাইশার চোখে স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়েছে সেটা। সাধারণ মানুষের দৃষ্টি সীমার বাইরের বিশেষ কিছু লাইট আর পার্টিকেল দেখার ক্ষমতা রুমাইশা পেয়েছে তার শরীরে দেওয়া ফ্লুইডের কারণে৷

কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে অ্যাশলি মেয়েটার নিথর দেহ টা চোখে পড়লো ওর৷ ওকে এখনো কেউ খেয়াল করেনি, এইদিকে কারো আসার প্রয়োজন পড়েনি বোধহয়। কিন্তু পরক্ষনেই অ্যাশলির মৃত্যুর খবর টা বিশেষ লোক গুলোকে জানানোর একটা মতলব খেললো ওর মাথায়। বাকা হাসলো ও৷ তারপর আবার হেটে হেটে এগোতে শুরু করলো৷

ও বর্তমানে যে ফ্লোরে আছে সেটা ফোর্থ ফ্লোর। প্রতিটা ফ্লোর দশটি বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত। এই ফ্লোরের অন্য দিকের প্রথম পাঁচ টা ভাগ জুড়ে ল্যাব তার পরের তিন টা ভাগে ল্যাবের কর্মি আর কিছু শিক্ষানবিশ দের রেসিডেন্স এরিয়া। আর তার পরের দুইটা ভাগ পরিত্যক্ত, যেখানে ওরা সাফওয়ান কে রেখেছে৷ এইদিকে কেউই থাকে না।
রুমাইশা বারান্দার মুখের কাছে পৌছালে লেজার ট্রাপ টা দেখতে পেলো। ঈষৎ লাল আর ঈষৎ সবুজ রঙের লেজার রশ্মি গুলো তীর্যক ভাবে বারান্দার মুখের স্থান টার ছাদ আর ফ্লোর স্পর্শ করে এক অদ্ভুত নির্দিষ্ট নকশায় সাজিয়ে আছে৷ যে কেউ এই রশ্মি গুলো ভেতর দিয়ে অতিক্রম করলে সাথে সাথেই সাইরেন বেজে উঠবে৷

রুমাইশা সেই লেজার রশ্মি গুলোর নকশা অনুসরণ করে, লেজার রশ্মির খালি জায়গা গুলোর ভেতর দিয়ে দক্ষতার সাথে নিজের শরীর গলিয়ে অপর পাশে চলে গেলো।
জোনাসের দেওয়া ম্যাপ টা মাথার ভেতর গেথে নিয়েছে ও৷ বিল্ডিং এর কোথায় কি আছে সব ওর নখদর্পনে এখন৷

এই এরিয়া টা পার হয়ে রেসিডেন্স এরিয়াতে ঢুকলো রুমাইশা। রাতের এখন প্রায় তিন টা৷ প্রায় সবাই এখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন৷ এই এরিয়া টা পুরো সিসি ক্যামেরার আওতাধীন। সে গুলো বারে বারে মুভ করছে, করে চার পাশ টা নজরে রাখছে। কোথায় কোথায় সিসি ক্যামেরা গুলো সেট করা সেটা রুমাইশা একবার মাথার ভেতর একে নিলো। রেসিডেন্স এরিয়ার দুই নম্বর খন্ডে মাইকেলের কামরা। রুমাইশার গন্তব্য সেখানেই৷

বড় করে একটা দম নিলো রুমাইশা৷ আর এরপর ই নিজের দম আটকে ধরে ছুটে চলে চলল ও৷ এতটাই দ্রুত গতিতে পুরো এরিয়া টা ও পার করলো, যে কোনো সিসি ক্যামেরা কোনো ধরনের আনওয়ান্টেড এনটিটি ডিটেক্ট করতে পারলো না। এটা ওর ফিজিক্যাল চেঞ্জেস এর ভেতর আর একটা৷ প্রচন্ড দ্রুত গতিতে ছোটা, যা খুবই উন্নত মানের ক্যামেরা ছাড়া ডিটেক্ট করা খুবই কষ্টকর৷

এক ছুটে রুমাইশা চলে এলো মাইকেল এর কামরার এদিকটায়। কিন্তু সমস্যা এখানেই। মাইকেলের রুমের দরজার দিকে তাক করিয়ে রাখা আছে একটা সিকিউরিটি ক্যামেরা। এটার ক্ষমতা অন্য ক্যামেরা গুলোর থেকে বেশি। মাইকেলের মতো গুরুত্বপূর্ণ একজনের কামরায় কখন কে ঢুকছে বা বেরোচ্ছে, সেগুলো নজরদারিতে নিয়োজিত ব্যাক্তি রা নজরে রাখে চব্বিশ ঘন্টা৷ কিন্তু মাইকেলের রুমের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতে হলে রুমাইশা কে তো স্থীর হতে হবে কিছুক্ষণের জন্য হলেও, এতে ও সবার নজরে পড়ে যাবে৷

তাই রুমাইশা মাইকেলের কামরার কিছুটা আশেপাশে এসে একটা ক্যামেরা বিহিন জায়গা দেখে লুকিয়ে পড়লো। এইখান থেকে মাইকেলের রুমের সামনের সিসি ক্যামেরা টা দেখা যাচ্ছে। সেটা যে কোনো আনওয়ানটেড এনটিটি ডিটেক্ট করতে পারলেই সেদিকে মুভ করবে৷

রুমাইশা আবার ও দম নিলো। আর এরপরেই প্রচন্ড দ্রুত গতিতে ছুটে গিয়ে ক্যামেরা টা ওকে ডিটেক্ট করে ফেলার আগেই মেঝে থেকে লাফিয়ে দক্ষতার সাথে নিজের পা টা ঘুরিয়ে প্রচন্ড গতিতে একটা লাথি দিলো ক্যামেরাতে৷
ক্যামেরা টা ওর স্টান্ড থেকে ভেঙে খুলে গিয়ে নিজের জায়গা থেকে বিশ ত্রিশ হাত দূরে গিয়ে পড়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেলো৷ আর ক্যামেরা টাকে সরানোর পরই ও ঢুকলো মাইকেলের কামরায়।

এদিকে ক্যামেরা টা হঠাৎ ব্লাকআউট হয়ে যাওয়ায় নজরদারি তে থাকা লোক গুলো সতর্ক হয়ে উঠলো। কিভাবে কি হলো ওরা কিছুই বুঝলো না। ক্যামেরা ব্লাকআউট হয়ে যাওয়ার আগ মুহুর্তের ফুটেজ গুলো ওরা চেইক করলো কয়েকবার কিন্তু সন্দেহ জনক কিছুই পেলো না। তাই বেশি কিছু না ভেবে ওরা ধীরে সুস্থে এগোতে থাকলো নতুন ক্যামেরা টার বর্তমান অবস্থা দেখতে।

.

মাইকেল বেঘোরে ঘুমাচ্ছে৷ নাক ডাকাচ্ছে মাঝে মাঝে। নিঃশ্বাসের সাথে পঞ্চাশোর্ধ মাইকেলের কিঞ্চিৎ মেদ যুক্ত পেট টা ওঠানামা করছে৷ এমন সময় কেউ যেন ওর কানের কাছে এসে ভৌতিক ভাবে ফিসিফিস কন্ঠে বলতে লাগলো,
— মাইকেল, মাইকেল! আ’ম অ্যাশলি, হেল্প মি! আ’ম ডাইং মাইকেল, মাইকেল! আ’ম অ্যাশলি, হেল্প মি! মাইকেল…..

মাইকেলের ঘুম পাতলা হয়ে এলো কানের কাছে শব্দ গুলো আর একবার ধ্বনিত হতেই চোখ মেলে তাকালো ও। আর তাকাতেই অন্ধকারের ভেতর নিজের পেটের ওপর কাউকে বসে থাকতে দেখলো ও। কিন্তু ঠিক কে বসে আছে তা বুঝতে পারলো না, চশমা টা সাইড টেবিলের ওপর রাখা আছে৷
প্রথমে অবয়ব টাকে অ্যাশলি ভেবে মাইকেল খুশি হয়ে হাত বাড়াতে গেলো অবয়ব টার দিকে। আর ঠিক সেই মুহুর্তেই অবয়ব টা তার চোখ দুইটা মেলে ধরলো। সবুজাভ হলুদ রঙা, হিংস্রতায় পরিপূর্ণ চোখ দুইটা থেকে আলো ঠিকরে পড়ছে!
অন্ধকারের ভেতর এমন দৃশ্য দেখে মাইকেলের হৃদপিণ্ড থেমে গেলো যেন। ভয়ে আতকে উঠে ও চোখ দুইটা বড় বড় করে হাপাতে লাগলো। আর তার এই প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে যাওয়ার মুহুর্তেই অবয়ব টা হঠাৎ করেই দাঁত মেলে হাসলো। আর অন্ধকারের ভেতরে সাদা রঙা দাঁত গুলো চকচক করে উঠলো। নাঁকি সুরে হিহি হাসি বেরিয়ে এলো অবয়ব টার মুখ থেকে।

মাইকেলের হার্টফেইল হবার যোগাড় হলো। গোঙাতে গোঙাতে মুখ দিয়ে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে থাকলো সে৷ এরপর সাইড টেবিল টা হাতড়ে কোনো রকমে চশমা টা খুজে চোখে দিয়ে টেবিল ল্যাম্প টা জ্বালিয়ে দিয়ে আবার নিজের পেটের ওপর তাকালো ও। নাহ, কেউ নেই। এসব কি তাহলে তার স্বপ্ন ছিলো! স্বপ্ন কি এমন বাস্তবের মতো হয় কখনো?

মাইকেল উঠে বসলো বিছানায়। সাইড টেবিলে রাখা পানির গ্লাস টা থেকে পানি খেলো দুই ঢোক। আর তারপর নিজের কপালে জমে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘাম গুলো মুছলো। উফ, কি ভয়টাই না পেয়েছে সে। স্বপ্ন দেখেও যে মানুষ এত টা ভয় পেতে পারে তা নিজেকে না দেখলে মাইকেল বুঝতোই না। নিজের ছেলেমানুষী তে নিজেই খানিক হেসে নিলো সে। কিন্তু এরপর অ্যাশলির কথা মনে হতেই বিছানা থেকে নেমে বাইরে চলে গেলো মাইকেল।

আর তার রুমের ভেতর, কাবার্ডের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রুমাইশা ফিসফিসানি শব্দে হে হে করে হেসে উঠলো। তার পর নিজের মনে মনেই বলে উঠলো, ‘শালার বুইড়া, তোর জন্য সারপ্রাইজ রেডি রাখছি। গিয়ে দেখে আয়৷
আর তারপর কাবার্ডের পাশ থেকে বেরিয়ে এসে নিজেও রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।

আর এরপর প্রচন্ড দ্রুতগতিতে ছুটে ও ফোর্থ ফ্লোর থেকে বেরিয়ে গ্রাউন্ড ফ্লোরে চলে এলো। আসার সময় নজরদারি তে নিযুক্ত কয়েক টা লোককে ও পাশ কাটিয়ে চলে এলো। ওরা হাতে একটা নতুন ক্যামেরা নিয়ে ফোর্থ ফ্লোরে যাচ্ছে। যদি পুরোনো ক্যমেরা টা ঠিক হওয়ার মতো অবস্থায় না থাকে তবে নতুন টা লাগাবে৷

লিফট টাতে একটু সমস্যা দেখা গিয়েছে। বাটন গুলোর কয়েক টা হঠাৎ করেই কাজ করছে না, তাই ওরা সিড়ি বেয়েই উপরে উঠছিলো। সিড়ি গুলো তে স্বল্প আলো। সেই স্বল্প আলোর ভেতর দিয়েই রুমাইশা বুলেটের গতিতে ওদের কে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। সবার প্রথমে থাকা ছেলেটা তার সামনে দিয়ে চলে যাওয়া কোনো এনটিটির উপস্থিতি টের পেলেও বাকি রা পেলো না৷
রুমাইশা ওদের পাশ দিয়ে চলে যেতেই প্রথম জন দ্বিধান্বিত হয়ে দাঁড়িয়ে গেলো। তারপর পেছন একবার তাকিয়ে দেখলো আসলেই সেটা কিছু ছিলো কিনা। এতে পেছনের লোক গুলো বিরক্ত হলো। প্রথম লোক টাকে ওরা ধমক দিলো রাস্তার মাঝে হঠাৎ করে দাঁড়িয়ে যাওয়ায়। প্রথম লোক টাও আর বেশি কিছু না ভেবে আবার হাটা চালিয়ে গেলো।

গ্রাউন্ড ফ্লোরে ভার্সিটির স্টুডেন্ট রা কেউ কেউ ঘুর করছে এখনো। তাই রুমাইশার একটু সুবিধাই হলো। ও স্বাভাবিক মানুষ জন দের মতো করেই বেরিয়ে এলো সেখান থেকে। আর তখনি ফোর্থ ফ্লোর থেকে এক সাথে অনেক গুলো চিৎকার চেচামেচির আওয়াজ পাওয়া গেলো। ওরা হয়তো অ্যাশলির লাশ পেয়ে গেছে। কালো পোশাকের আড়ালে হাসলো রুমাইশা। উপযুক্ত একটা কাজ করেছে সে, ফালতু মেয়ে!
আশে পাশে থাকা গার্ড গুলো রুমাইশা কে খেয়াল করলো, কিন্তু স্টুডেন্ট হতে পারে ভেবে কেউ কিছু বলল না, কিন্তু সন্দেহের চোখে তাকালো। রুমাইশা সেসব দৃষ্টি উপেক্ষা করেই মাথা উচু করে সদর্পে হেটে হেটে একসময় ভার্সিটি এরিয়া থেকে বেরিয়ে এলো।

৭০. সকাল বেলা সেরেনার ডাকে ঘুম ভাঙলো রুমাইশার। গতকাল ভার্সিটি থেকে ফিরেই ও এসে ঘুমিয়ে পড়েছে। পোশাক টাও বদলায়নি। ওভাবেই ঘুমিয়েছে ক্লান্তির কারণে৷

সেরেনার ডাকে উঠে বসলো রুমাইশা। সেরেনা ওকে বলল,
— হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেস হয়ে নাও রুমাইশা কাদের, খাবার দিয়েছি আমি। আর জোনাসের তোমার সাথে খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে৷ দ্রুত আসো।

রুমাইশা একটু অবাকই হলো, প্লানে আবার কোনো পরিবর্তন হলো নাকি! কিন্তু পরিবর্তন কেন হবে? ও বিছনা থেকে নামতে নামতে সেরেনার উদ্দেশ্যে বলল,
— তুমি যাও, আমি ফ্রেস হয়ে এখনি আসছি৷

ওর কথা শুনে সেরেনা হাসিমুখে চলে গেলো রুম থেকে। রুমাইশা দ্রুত ফ্রেস হয়ে ডাইনিং রুমে এলো। জোনাস আর সেরেনা আগে থেকেই বসে আছে সেখানে। রুমাইশার জন্য অপেক্ষা করছে ওরা৷ রুমাইশা এসে টেবিলে বসলে ওরাও খাওয়া শুরু করলো।
রুমাইশা একবার আড়চোখে দেখে নিলো জোনাস কে। জোনাসের মুখ খানা থমথমে। বরাবরের মতো ফানি মুডে নেই সে। রুমাইশা বুঝলো, গুরুতর কিছু হয়েছে৷

খাবার টেবিলে কেউ কোনো কথা বলল না, চুপ চাপ খাওয়া শেষ করে সেরেনা উঠে চলে গেলো ওর রুমে। আর জোনাস খাওয়া শেষে ডাইনিং টেবিল থেকে উঠে, রুমাইশার খাওয়া শেষ হওয়ার অপেক্ষায় টেবিল থেকে কিছুটা দূরে রাখা সোফার ওপর গিয়ে বসলো।

রুমাইশা একটু দ্রুত গতিতেই খাওয়া শেষ করলো। এক প্রকার পানি দিয়ে খাবার গুলো গিলে ফেললো ও৷ তারপর নিজেও উঠে গিয়ে জোনাসের বিপরীত দিকের সোফায় গিয়ে বসলো। এরপর পাশ থেকে একটা কুশন বালিশ নিয়ে কোলের ওপর রেখে ও জোনাস কে বলল,
— জ্বি বলুন, আমি শুনছি। কি হয়েছে? প্লানে কোনো চেঞ্জ?

জোনাস একটু নড়েচড়ে বসলো, তারপর বলল,
— সাফওয়ান কে দেখা শোনা করতো একটা মেয়ে, কাল রাতে সে মারা গেছে। আপাতদৃষ্টিতে দেখে মনে হচ্ছে সে দুর্ঘটনার কারণে মারা গেছে। তাকে পোস্টমর্টেমের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছে আজ সকালে। কিন্তু ওই মেয়ে টাকে তুমি খুন করেছো বলে আমার ধারণা।

রুমাইশা জোনাসের কথায় উপরে নিচে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। জোনাস সেটা দেখে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো একটা। তারপর আবার বলল,
— ওখানের একটা সিকিউরিটি ক্যামেরা কেউ একজন ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছে। আর এইসব ঘটনার কারণে ওরা কাউকে আর বিশ্বাস করছে না। পুরো ভার্সিটিতে ওরা সিকিউরিটি বাড়িয়ে দিয়েছে, বিশেষ করে ল্যাব এরিয়াতে৷ এখন সাধারণ মানুষও ভালোভাবেই বুঝতে পারছে যে সেখানে কিছু একটা আছে যাকে ল্যাব পার্সনস রা আড়াল করার চেষ্টা করছে। আর তার চেয়ে বেশি দুঃখের ব্যাপার হলো ওরা ল্যাব এরিয়া তে যে গার্ড মোতায়েন করেছে তারা সব হারবার্ট এর গার্ড। সবাই অস্ত্রধারী। সুতরাং সাফওয়ান কে ওখান থেকে বের করা সহজ হবে না। আর পোস্টমর্টেম রিপোর্টে যদি ওই মেয়েটার অস্বাভাবিক মৃত্যুর কথা লেখা থাকে, তবে সাফওয়ান কে সেখান থেকে বের করা এক প্রকার অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে৷ আর ল্যাব এরিয়ায় স্টুডেন্ট দের কেও ঢুকতে দিচ্ছে না, স্পেশাল পারমিশন ছাড়া৷ । এতে করে তুমিও আর স্টুডেন্টের বেশ ধরে সেখানে ঢুকতে পারবেনা৷

রুমাইশার মুখের ওপর চিন্তার ছাপ দেখা গেলো। কিছুক্ষণ চুপ থেকে ও জোনাসের উদ্দ্যেশ্যে বলে উঠলো,
— আপনাদের ফ্রেন্ড, রবার্ট, তার পারসোনাল জেট প্লেইন টা নিয়ে আসার প্লানে কোনো চেঞ্জ হবে না তো?

জোনাস মাথা নাড়িয়ে বলল,
— না, ওর বা আমার কারো কোনো সমস্যা হবে না৷ একবার প্লেইনে উঠে পড়তে পারলে আর কোনো সমস্যায় পড়তে হবে না আমাদের। কিন্তু সে প্লেইন পর্যন্ত আসাই সবচেয়ে কঠিন ব্যাপার। হারবার্টের গার্ড গুলো অনেক দক্ষ, তাদের কে ফাকি দিয়ে সাফওয়ান কে নিয়ে বেরিয়ে আসা খুবই কষ্টকর হবে। সাফওয়ান যদি সুস্থ থাকতো তবে কোনো চিন্তাই ছিলো না৷ হারবার্টের ওসব দক্ষ গার্ড রা ওর কাছে ডালভাতের মতো। কিন্তু ওর শরীরের অবস্থা টা তো তুমি গিয়ে দেখেছো৷ হাড়লিকলিকে হয়ে আছে, প্রচণ্ড দুর্বল ও এখন। এই অবস্থায় ফাইট করা ওর পক্ষে এক প্রকার অসম্ভব। আর এই লাইনে তুমি নতুন, তুমি এখনো দক্ষ হয়ে উঠোনি, তাই তোমাকে ওদের মাঝে একা ছেড়ে দেওয়া মোটেই ঠিক হবে না৷

রুমাইশা মেঝের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ, তারপর দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে বলল,
— প্লানে কোনো চেঞ্জ হবে না জোনাস, আপনি চিন্তা করবেন না, আমি আর সাফওয়ান সব টা সামলে নেবো। আপনি শুধু জেট প্লেন টাকে সময় মতো সঠিক জায়গায় নিয়ে যাওয়ার ব্যাবস্থা করবেন৷ আপনার আর রবার্টের সাথে আমি ব্লুটুথ ডিভাইসের মাধ্যমে যোগাযোগ রাখবো সারাক্ষণ। পরিস্থিতি সম্পর্কে আপনাদের কে আমি প্রতি মুহুর্তে ইনফর্ম করবো।

জোনাস ওর কণ্ঠের এমন দৃঢ়তা আর এমন সাহসিকতা দেখে সত্যিই অবাক হলো৷ মনে মনে বলল ‘ সাফওয়ানের উপযুক্ত বউ”। তারপর মুখে বলল,
— ঠিক আছে। তোমাদের কোনো সমস্যা না হলে আমার এইখানে আর কিছুই বলার নেই৷ আমি রবার্ট কে ইনফর্ম করে দিচ্ছি। আমি আর ও সময় মতো, প্লান মাফিক নির্ধারিত জায়গায় গিয়ে অপেক্ষা করবো। তোমরা কোন বিপদে যেন না পড়ো তার জন্য গডের কাছে প্রার্থনা করি৷

রুমাইশা দৃঢ়তার সাথে নিজের মাথা নাড়ালো। চোখে ওর আত্মবিশ্বাসের ঝলক। জোনাসের সাথে আলাপ শেষ করে ও উঠে নিজের রুমে গেলো। তারপর দুপুরের অভিজানের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে লাগলো।

৭১. এই মুহুর্তে হারভার্ডের মেইন গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে রুমাইশা। স্কিন টাইট একটা কালো রঙা প্যান্টের সাথে ছাই রঙা ক্রপ টপ পরে আছে ও, পায়ে ওর সাদা কালো মিশেলের হাইকিং শু, পিঠে কালো রঙা ব্যাকপ্যাক। বব কাট দেওয়া চুল গুলো রোদ পড়ে চকচক করছে। কালো রঙা গগলসের নিচে উজ্জল চোখ দুটো প্রিয়তম কে দেখার আশায় মুখিয়ে আছে।
চোখ মুখ আজ ওর কিছুই ঢাকা নেই। নিজেকে আজ উন্মুক্ত করে এসেছে ও কাজের সুবিধার্থে। কালো আর খয়েরী সংমিশ্রণের ঠোঁট দুটোতে অদ্ভুত সুন্দর হাসি।
মুখে হাসি ফুটিয়েই গেইটের ভেতর দিয়ে দৃঢ় পায়ে হেটে ভেতরে ঢুকলো ও। নিজের অভিযানের সফলতা যেন চোখের সামনে ভাসছে ওর৷

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।