ফ্লোরেনসিয়া – ৩৭

বৃহৎ কামরার একপাশটা সম্পূর্ণ খালি ছিলো। অন্যপাশটায় সকল শিক্ষার্থী টানটান উত্তেজনা নিয়ে দাড়ানো। চিত্ত জুড়ে অসামান্য উৎকন্ঠা। কঠিন প্রতিযোগীতা। একাডেমিতে থাকা-না থাকার প্রশ্ন। প্রত্যেকের দৃঢ় বিশ্বাস, ডোনা জিতবে। সিয়া আর ওর মধ্যে তুমুল দ্বন্দ্বযুদ্ধ চলছিলো। ডোনা যুদ্ধবিদ্যায় বেশ পারদর্শী। সিয়া ওর তুলনায় নেহাতই অদক্ষ। কিন্তু যুদ্ধে জয়-পরাজয়ের সাথে একাডেমি থেকে বহিষ্কার হওয়ার সম্পর্ক। কেউ কাউকে এতো সহজে ছাড় দিবে না। এদুয়ার্দোর শেখানো সবগুলো রণকৈশল প্রয়োগ করে সিয়া। ওর স্মৃতিশক্তি বরাবরই অত্যন্ত প্রখর। খুব সহজেই শৈলীগুলো আয়ত্ত করে নিয়েছিলো। ডোনার সাথে হাড্ডা হাড্ডি লড়াই হচ্ছিলো। মেয়েটা শেয়ালের মতো ধূর্ত। ওর মস্তিষ্কজুড়ে সিয়াকে গুরুতর আহত করার প্রবল উত্তেজনা। সিয়ার প্রতিটা পদক্ষেপ সিংহীর মতো ধীর,স্থির,শান্ত। অনেকটা উঁচুতে উঠে সিয়ার দিকে উড়ে আসে ডোনা। লক্ষ্য ছিলো বুকের পাজর। শক্তিশালী আঘাতে প্রথমেই সিয়াকে কাবু করে ফেলা। তবে সিয়া বেশ ভালো করেই জানতো মেয়েটার সাথে যুদ্ধে জিততে পারবে না।

দ্বন্দ্বযুদ্ধে জেতার জন্য শুধু শক্তি আর সুনিপুণ কৌশল জানা থাকলেই হয় না। সাথে বুদ্ধির প্রয়োজন। ডোনার করা আঘাতটা সম্পূর্ণ অবজ্ঞেয় করে সরে দাড়ায় সিয়া। শুরু হয় হাত আর পায়ের সাহায্যে দ্বন্দ্বযুদ্ধ। লাথি আর ঘুষির মাধ্যমে দু’জনে একে অপরের ঘাড়,কনুই আর হাঁটুতে আঘাত করছিলো। ডোনার করা শক্তিশালী আঘাতগুলো প্রতিহত করতে বেগ পেতে হচ্ছিল সিয়ার। শুধুমাত্র একটা মোক্ষম আঘাত করার সুযোগ পেলেই যুদ্ধে জিতে যাবে ও। এরই মাঝে ডোনা নিজের ডান হাতে সিয়ার পেট বরাবর একটা শক্তিশালী ঘুষি মারে। খানিকটা দুরে ছিটকে পড়ে সিয়া। মৃদু চিৎকার দিয়ে দু’হাতে নিজের মুখ চেপে ধরে ইনায়া। সিয়া একনজর ইনায়ার দিকে তাকিয়ে তৎক্ষণাৎ দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। ওর কাছে দৌড়ে আসা ডোনার হাস্যোজ্জ্বল মুখখানার দিকে তাকায়। সিয়া ত্বরিত উঠে দাড়ায়। পুনরায় আক্রমণের প্রস্তুতি নেয়। নবোদ্যমে আবারও লড়াই শুরু হয়।

সবগুলো স্টুডেন্টদের চোখে-মুখে ছড়িয়ে ছিলো প্রচন্ড উল্লাস। একদিকে অধীর আগ্রহ নিয়ে দ্বন্দ্বযুদ্ধ উপভোগ করছিলো ইজাবেল এবং ওয়েসলি। অন্যদিকে শঙ্কিত মুখাবয়বে দাঁড়িয়ে ছিলো ইনায়া আর আর্নি। আর্নি ভীষণ ভয় পাচ্ছিলো।

এদুয়ার্দো দেয়াল ঘড়িতে সময় দেখে নেয়। প্রায় দশ মিনিট ধরে ওদের লড়াই চলছে। ভাবলেশহীন মুখে সিয়ার দিকে তাকায়। তার চেহারায় কোনো ধরনের অভিব্যক্তি নেই। নিঃসন্দেহে এই লড়াইয়ে সিয়া হারবে। ওর মতো মাথা মোটা মেয়ের পক্ষে জেতা সম্ভব নয়।

একের পর এক আঘাত প্রতিহত করে হাঁপিয়ে উঠে সিয়া।ডোনাকে শক্ত আঘাত করার কোনো সুযোগ পায় না ও। আরও কিছুক্ষণ সময় গড়ায়। সিয়া আপ্রাণ চেষ্টা করে। ওর লক্ষ্য স্থির ছিলো। ইনায়া মনে প্রাণে ঈশ্বরের নাম স্বরণ করে। যেন অপ্রত্যাশিতভাবে জিতে যায় সিয়া। সহসা মোক্ষম একটা সুযোগ আসে। সিয়া নিজের পরিকল্পনা মোতাবেক ডোনার মাথায় কানের উপরে সজোরে আঘাত করে। মুহূর্তেই মেয়েটা অচেতন হয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে। উপস্থিত প্রতিটা ছাত্র-ছাত্রী স্তব্ধ দৃষ্টিতে অনিমেষ তাকিয়ে থাকে। যেন একবারও এরকমটা আশা করেনি ওরা। বীরদর্পে যুদ্ধ করতে করতে চোখের পলকে ডোনা মুখ থুবরে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে। তারপরই একটা ঠান্ডা কন্ঠস্বর শোনা যায়।

– যুদ্ধের এই কৌশলটা আমার বাবা শিখিয়েছিলেন। সুযোগ বুঝে প্রতিপক্ষকে অচেতন করে ফেলা। বেঁচে আছে ও। কিন্তু লড়াই করার মতো অবস্থায় নেই। যেহেতু ওর চেতনা নেই, আমি ওর সাথে যা খুশি তাই করতে পারি। ____সিয়া নিষ্প্রাণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে শান্ত গলায় কথাটা বলে। এদুয়ার্দো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়। তার অতি অল্প ভ্রু-কুঞ্চিত হয়। সিয়া দৃঢ় কন্ঠে জিজ্ঞেস করে তাকে,,,

-মহামান্য মাস্টার। আমি কি যুদ্ধে বিজয়ী?

এদুয়ার্দো কোনো প্রত্যুত্তর দেয় না। ভারী আর নিম্নস্বর যুক্ত কন্ঠে ডাকে,,,

– মাস্টার জোডিথ।

-জ্বি মাস্টার।

– ওকে নিয়ে যান। প্রিন্সিপালকে আমার সিদ্ধান্ত জানান। মেয়েটা আর কোনোদিনও এই একাডেমিতে প্রশিক্ষণ নিতে পারবে না। সব কাজ আপনি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে করবেন।

-জ্বি মাস্টার।___মাস্টার জোডিথ সবিনয়ে বলেন।

ইনায়ার চিত্ত পুলকিত হয়। আর্নির ভয় আরও দ্বিগুন বেড়ে যায়। ইনায়ার একহাত খামচে ধরে আতংকিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,,,

– কি প্রয়োজন ছিলো এই পি’শাচটার সাথে দ্বন্দ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার? ও ইনায়া, সিয়াকে বারণ করো না। বারণ করো ওকে।

– দেখা যাক কি হয়। সিয়ার উপর পূর্ন আস্থা আছে আমার।____ইনায়া মৃ’দু হেসে বলে।

ইজাবেল সিয়ার ব্যক্তিত্বে প্রভাবিত হয়। মেয়েটাকে বেশ লাগে। কেমন শান্ত স্বভাবের। অথচ দারুন বুদ্ধিমতী। ইজাবেল ঠোঁট ছড়িয়ে হাসে। অনুচ্চস্বরে ওয়েসলিকে জিজ্ঞেস করে,,,,

– ওর নাম সিয়া?

– পুরো নাম ফ্লোরেনসিয়া। সবাই সিয়া বলে ডাকে।___ওয়েসলি ফিসফিসিয়ে বলে।

-আনন্দদায়ক, মনোযোগী, উপযুক্ত, উদার, ভাগ্যবান, সক্রিয়, গুরুতর, অস্থির, বন্ধুত্বপূর্ণ। আরও বেশ কয়েকটা অর্থ আছে এই নামের।____ ইজাবেল মিষ্টি হেসে বলে।

-মেয়েটা ইন্ট্রোভার্ট স্বভাবের। কারো সাথে কথা বলে না। ক্লাস শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ আগে আসে। ক্লাস শেষ হতেই ফিরে যায়। সেদিন চিফ মাস্টারের দেওয়া কঠিন শাস্তি ভোগ করেছে। অথচ কতটা শক্ত ছিলো ও। ঠিক যেন পাথরের মতো সুদৃঢ়। আর বাকি দু’জন ওর বোন। ওরাও কারো সাথে কথা বলে না। আর বলবেই বা কি করে। ক্লাসের ছেলে-মেয়েগুলো যা শুরু করেছে ওদের সাথে।

– কেনো? কি করেছে ওরা?

– ব্রেক টাইমে তোমাকে সবটা খুলে বলবো।

– আচ্ছা।

দু’জন ছাত্রীর সাহায্যে মাস্টার জো অচেতন ডোনাকে কামরার বাইরে নিয়ে যান। এদুয়ার্দো কাউকে দিয়ে দু’টো লংসোয়ার্ড পাঠিয়ে দিতে বলে।

ক্ষণকাল সময় গড়ায়। ছাত্র-ছাত্রীরা বেশ হতভম্ব হয়ে দাড়িয়ে রয়। সবার সামনে ফাঁকা জায়গায় এদুয়ার্দোর থেকে কিছুটা দুরে তার পাশাপাশি সিয়া দাঁড়িয়ে ছিলো। চাপিয়ে রাখা দরজায় করাঘাতের শব্দ শোনা যায়। এদুয়ার্দো অনুমতি দেয়,,,

-আসুন।

লংসোয়ার্ড হাতে একজন লোক কামরায় প্রবেশ করেন। হয়তো তিনিও কোনো মাস্টার। মাথা ঝুঁকে এদুয়ার্দোকে সম্মান জানান। হাতের লংসোয়ার্ড দু’টো বাড়িয়ে দিয়ে শ্রদ্ধাভরে ডাকেন,,,

-মহামান্য মাস্টার।

এদুয়ার্দো সোয়ার্ড দু’টো হাতে নেয়। একপা দু’পা করে সিয়ার দিকে এগিয়ে যায়। একটা সোয়ার্ড ওর হাতে দিয়ে থমথমে ভরাট কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,,,,

– তুমি কি তৈরী?

– জ্বি মহামান্য মাস্টার।

এদুয়ার্দো কয়েক পা পেছনে সরে যায়। কামরায় উপস্থিত থাকা লোক’টাকে উদ্দেশ্য করে বলে,,,

– আপনি যেতে পারেন।

এদুয়ার্দোর কথামতো নিঃশব্দে কামরার দরজা লাগিয়ে লোকটা বাইরে বেরিয়ে যান। সম্পূর্ণ কামরায় আলো বলতে শুধু এদুয়ার্দো আর সিয়ার মাথার উপরে বিশাল ঝাড়বাতি জ্বলছিলো। সবগুলো ছাত্র-ছাত্রী পুনরায় টানটান উত্তেজনা নিয়ে অপেক্ষা করছিলো। হঠাৎই সিয়া উঁচু আওয়াজে দৃঢ় কন্ঠে বলে,,,,,

– মহামান্য মাস্টার। এই মুহূর্তে আপনি আমার প্রতিদ্বন্দ্বী। আমি আপনাকে সব ধরনের আক্রমণ করতে পারি। মারাত্মক আঘাত করে আহত করতে পারি। আপনাকে হা’রাতে যা খুশি তাই করতে পারি। আশা করি আপনি সব ধরনের আক্রমণ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে নিবেন। আমি জানি আপনি আমাকে সেরকম কোনো সুযোগ দিবেন না, কারন কোনো শ্রেষ্ঠ মাস্টার কখনো তার ছাত্রীর কাছে পরাস্ত হয় না।

এদুয়ার্দোর পরনে ছিলো জাপানের ঐতিহ্যবাহী পোশাক সামুরাই কিমোনো। কালো রঙের কিমোনোর উপর পরিধেয় কালো রঙের লম্বা কোটটা আগেই খুলে রেখেছিলো। সিয়া তলোয়ার হাতে নিয়ে শুরু থেকেই দাড়িয়েছিলো। এদুয়ার্দো থমথমে পায়ে হেঁটে একপা দু’পা করে এগোয়। মেয়েগুলো মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে। এদুয়ার্দোর হাঁটার ভঙ্গিমায় ওদের হৃদপিণ্ডে অস্বাভাবিক হৃদকম্পন সৃষ্টি হয়। ইজাবেল,ওয়েসলি আর ইনায়া উচ্ছ্বসিত নয়নে নির্নিমেষ তাকিয়ে রয়। আর্নির দু’চোখে তীব্র ভয়। সিয়া শব্দহীন পায়ে এদুয়ার্দোর চারদিকে ঘুরতে শুরু করে। সহসা আক্রমণ করে বসে।

কামরাজুড়ে দু’টো তলোয়ারের ঝংকার শোনা যায়। সিয়ার প্রতিটা আঘাত সিদ্ধহস্তে প্রতিরোধ করে এদুয়ার্দো। যেন সে কোনো ছোট বাচ্চার সাথে খেলছে। তার ঠোঁট দু’টো একপাশে সামান্য বেঁকে যায়। মনে হয় তার এমারেল্ড সবুজ চোখজোড়াও তাচ্ছিল্য ভঙ্গিতে হাসে। সিয়ার রাগ হয়। ভীষণ রাগ হয়।

ক্রোধের আধিক্যে মৃদুমন্দ শরীর কাঁপতে শুরু করে। কিন্তু মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নেয়। ওর মাথায় দুষ্টু বু্দ্ধি খেলে যায়। ঠিক দুষ্টু বুদ্ধি নয়। জেনে বুঝে একটা অভাবনীয় কাজ করে বসে সিয়া।এদুয়ার্দোর দিকে তাকিয়ে হঠাৎই চোখ মারে ও। অমায়িকভাবে হাসে। হৃদয় কাঁপানো মোহগ্রস্ত হাসি। এদুয়ার্দো স্তব্ধ হয়ে নিষ্পলক তাকিয়ে রয়। কয়েক সেকেন্ডের জন্য তার হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। অতঃপর হৃদয় ধুকপুক করে উঠে। কয়েক পল স্থির নেত্রে তাকিয়ে থাকে সে। সিয়া সুযোগটা কাজে লাগায়। আচমকা লাফ দিয়ে অনেকটা উঁচুতে উঠে এদুয়ার্দোর বুকে পরপর দু’বার তলোয়ারের স্ল্যাশ আঁকে। একটা ক্রশ চিহ্নের মতো। তারপর মাটিতে নেমে দাড়ায়। আরও কয়েকবার স্ল্যাশ বসায় এদুয়ার্দোর বুকে, পেটে আর কাঁধে।

ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে থাকা ছাত্র-ছাত্রীরা সম্পূর্ন নীরব হয়ে যায়। ওদের কন্ঠনালী থেকে কোনো শব্দ বেরোয় না। ইজাবেল স্তম্ভিত। আর্নি আর ওয়েসলির চোখগুলো যেন কোটরের বাইরে বেরিয়ে আসবে। শুধুমাত্র ইনায়া সগর্বে বুক বুলিয়ে ঠোঁট ছড়িয়ে হাসে। কে বলে, সিয়া পারবে না? সিয়া অবশ্যই পারবে।

সিয়ার হাসিতে কি এমন জাদু ছিলো বুঝতে পারে না এদুয়ার্দো। ঠোঁটমুখ কিঞ্চিত কুঁচকে ফেলে সিয়ার বীরাঙ্গনা রুপ দেখে সে।তলোয়ারের আঘাতে বুকের মাঝখানে কতগুলো ফালি হয়ে গেছে। টপটপ করে রক্ত গড়িয়ে পড়তে শুরু করে। পরিধেয় সামুরাই কিমোনোর মাঝখানে লম্বা ভাবে চিরে গেছে। পুরো পোশাকটার অবস্থা ছিন্ন-বিছিন্ন। কালো রঙের প্যান্ট টা দেখা যাচ্ছিলো। এদুয়ার্দো উল্টো ঘুরে দাড়ায়। যাতে ছাত্র-ছাত্রীরা তার ক্ষতগুলো দেখতে না পায়। সিয়ার জ্বলন্ত হৃদপিণ্ড যেন একটুখানি সুশীতল হয়। ঠোঁট বাকিয়ে ক্রুর হাসে। ওর হাসিটুকু মুহূর্তেই বদলে যায় যখন এদুয়ার্দোর ক্ষতগুলো আপনা আপনি সেরে যেতে দেখে। সিয়া হতবাক হয়। এতোগুলো আঘাত চোখের পলকে কিভাবে মিলিয়ে গেলো?

সিয়ার হাত থেকে তলোয়ার পড়ে যায়। মনে মনে ভাবে, যার ক্ষতস্থান এক নিমেষেই মিলিয়ে যায় তাকে কিভাবে বিনাশ করবে?

– শেষ? নাকি আরও কিছুক্ষণ লড়াই করতে চাও?___এদুয়ার্দোর হিংস্রাত্মক শীতল কন্ঠস্বর।

সিয়া ত্বরিত তলোয়ার তুলে নেয়। শ’য়তানটার হৃদপিণ্ডে ঢুকিয়ে দিবে বলে। দৌড়ে গিয়ে লাফ দিয়ে এদুয়ার্দোর বুকে দু’পায়ে আঘাত করে উল্টো ঘুরে দাড়ায়। পরিধেয় পোশাকের ঝুলে থাকা বাকি অংশটুকুও ছিড়ে যায়। সিয়ার করা পায়ের আঘাতের দাপটে পেছনে সরে যায় এদুয়ার্দো। পরতে গিয়েও নিজেকে সামলে নেয়। সিয়া জানে না এদুয়ার্দো কেনো ওকে সুযোগ দিচ্ছে, তবে ও সুযোগটা কাজে লাগাতে চায়। ওর হাতের তলোয়ারটা এদুয়ার্দোর বুকে ঢুকিয়ে দিতে পারলেই হবে। কিন্তু এদুয়ার্দোর বুকের দিকে নজর পড়তেই সিয়া স্তব্ধ হয়ে যায়।

এদুয়ার্দোর নগ্ন বুকে জ্বলজ্বলে তারার চিহ্ন। চোখ ধাঁধানো অলৌকিক সৌন্দর্য। বলশালী লোমহীন প্রশংসনীয় বুক আর মেদহীন পেটে শক্ত পেশির ভাঁজ দেখা যাচ্ছিলো। এদুয়ার্দো নিজের নগ্ন বুকের দিকে তাকাল। অতঃপর দৃষ্টি সরিয়ে সামনে দাড়িয়ে থাকা সব ছাত্রীগুলোকে একবার দেখে নিলো। মেয়েগুলো চোখ ফাটাফাটা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। ওদের দু’চোখের পলক পড়ছে না। ওষ্ঠদ্বয় একে অপরের থেকে অনেকটা পৃথক হয়ে গেছে। মুখখানা গম্ভীর,ভীষণ গম্ভীর দেখায় এদুয়ার্দোর। তীব্র বিরক্তবোধ করে। এই অপরাধের শাস্তি সিয়া অবশ্যই পাবে।

– এদুয়ার্দোর বুকে তারার চিহ্ন?এর মানে কি?এরকম হুবহু একটি তারার চিহ্ন আছে ফ্লোরেনসিয়ার বুকের উপর। দু’টোই এক। যেন সোনালী জরি দিয়ে দু’জনের বুকে খোদাই করে তারা দু’টো এঁকে দিয়েছেন কোনো সিদ্ধহস্তের কারিগর।_____ইনায়া মনে মনে ভাবে। বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। আচম্বিতে সম্পূর্ণ কামরায় অন্ধকার নেমে আসে। ছাত্রছাত্রীদের শোরগোল শোনা যায়। ঝাড়বাতির সবগুলো মোম একসাথে নিভে গেছে। সিয়া সম্বিত ফিরে পায়। এটা এদুয়ার্দোর কারসাজি বেশ বুঝতে পারে। তারার বিষয়টা পরে ভাবা যাবে, আপাতত এদুয়ার্দোকে খুঁজে।

সিয়া উৎকর্ন কানে চারপাশে নজর বুলায়। পাথুরে দেয়ালের এই কামরায় কোনো জানালা ছিলো না। দরজা বন্ধ করে দেওয়ায় বিন্দুমাত্র আলো প্রবেশ করার জো নেই। সিয়ার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে উঠে। জ্বলতে শুরু করে ওর কাঁধে থাকা ক্রুশচিহ্ন। সিয়ার মনে হয় বাম দিক থেকে ওর দিকে কোনো আক্রমণ ঘনিয়ে আসছে।

– শ’য়তানটা ওর স্বরূপে ফিরে এসেছে।____সিয়া মনে মনে ভাবে। এদিকে কামরাজুড়ে তখনো কোলাহল। অন্ধকারেই বাম দিকে তলোয়ার দিয়ে আঘাত করে সিয়া। কিন্তু ওর আঘাতটা প্রতিহত করে এদুয়ার্দো। সিয়ার দু’হাত একসাথে পেছন থেকে মুচড়ে ধরে। নিজের দুই পা দিয়ে সিয়ার দুই পা আঁটকে দেয়।হৃদপিণ্ড হিম হয়ে আসা অনুচ্চ স্বরে বলে,,,,

– কি ভেবেছিলে? আমাকে ধ্বংস করা এতোটাই সহজ?

সিয়া কোনো প্রত্যুত্তরে দেয় না। মোচড়ামুচড়ি শুরু করে। এদুয়ার্দো আরও ঘনিষ্ঠ হয়। কাঁধের কাছে মুখ নামিয়ে আনে। তার গরম নিঃশ্বাস আছড়ে পড়ে সিয়ার ঘাড়ে,কানের কাছে।

সিয়ার শরীর অবশ হয়ে আসে। বুক ধুকপুক করে উঠে। শরীরের প্রতিটা লোম কম্পিত হয়। সম্পূর্ন শরীর মৃদু মৃদু কাঁপছে। এদুয়ার্দো চমৎকার ভাবে হাসে। অন্ধকারে তার সবুজ নেত্রজোড়া জ্বলজ্বল করে উঠে। সিয়া উৎকর্ণ কানে তার হৃৎস্পন্দন শুনতে পায়। বক্ষস্থলে অস্থিরতা অনুভব করে। ভীষণ অস্থির অস্থির লাগে। আত্মা যেন নিষিদ্ধ কিছু করার ইঙ্গিত দেয়। যা সম্পূর্ণ অনুচিত। নিমেষেই সিয়া নিজেকে দূর্বল অনুভব করে। এদুয়ার্দো ওর কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে,,

– আমার শক্তিশালী মাসল। মেদহীন দেহে নাভির উপরে থাকা শক্ত পেশিগুলো দেখার এতো শখ ছিলো? আগে বলতে। সবার সামনে কেনো এরকম করলে? সেইমলেস গার্ল ।

-অ’সভ্য। তোমার প্রতি আমার কোনো আগ্রহ নেই।___সিয়া দৃঢ় গলায় প্রতিবাদ জানায়। এদুয়ার্দো ওর কন্ঠস্বরে আক্রোশ খুঁজে পায়।

– বারবার অসভ্য বলে, আমাকে অসভ্য হওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছো? দেখতে চাও রক্তচোষাদের ওভারলর্ড কতটা অসভ্য হতে পারে? ___এদুয়ার্দো শীতল কন্ঠে বলে।

– সাহস থাকলে আমার হাত ছেড়ে দাও।___ সিয়ার রাগান্বিত কন্ঠস্বর।

এদুয়ার্দো ওর হাত ছেড়ে দেয়। সাথে সাথে দরজা খুলে যায়। অন্ধকার কামরায় আলো প্রবেশ করে। ছাত্র-ছাত্রীগুলো স্বস্তির নিঃশ্বাস নেয়। দুম করে সব মোমবাতি নিভে যাওয়ার বিষয়টা যেন ওদের মাথা থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে যায়। অপ্রত্যাশিত ভাবে কামরার কোথাও এদুয়ার্দো নেই। উপস্থিত প্রত্যেকের মুখে একই প্রশ্ন,,,,

– চিফ মাস্টার কোথায়? মেয়েটা ওখানে একা দাঁড়িয়ে আছে কেনো?

ইজাবেল সবাইকে শান্ত করার উদ্দেশ্যে বলে,,,

– তোমরা তো দেখেছো তার পোশাকের কি অবস্থা হয়েছিলো। ক্লাসের নির্ধারিত সময় শেষ। তাই চলে গেছেন ভাই।

– কিন্তু মাস্টার লড়াই না করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলেন কেনো?___ পাশ থেকে জিজ্ঞেস করে একটা মেয়ে। তার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে অন্য একটা মেয়ে বলে,,,,

-মেয়েটা জাদুকরী। নিশ্চয়ই তাকে বশ করেছিলো।

সিয়া উৎকর্ণ কানে শোনে। ওর মাঝে কোনো ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না। ইজাবেল ওর মুখের দিকে তাকায়। আব্রাহামের বলা কথাটা মনে পড়তেই ঠোঁট ছড়িয়ে হাসে। সিয়া নিষ্প্রাণ চোখে দেখে। ইনায়া ওর পাশে গিয়ে দাড়ায়। কাঁধে হাত রেখে মিষ্টি মধুর হাসে। ঠিক তখনই কামরায় মাস্টার জোডিথ প্রবেশ করে।

_______

প্রাসকোভিয়া।

ধীরে ধীরে দিনের আলো ফুরিয়ে সন্ধ্যা নেমে আসে। দমকা বাতাসে বইছে। আবহাওয়া খুব ঠান্ডা। মোটামুটি ফাঁকা জায়গা দেখে তাবু খাটিয়েছিলেন ক্রিসক্রিংগল। তার মন বলছে, ঝড় আসবে হয়তো। এই গহীন অরণ্যে ঝড়ের সম্মুখীন হওয়াও একধরনের ভয়ংকর বিপদ। মার্টিনের কাছে পৌঁছাতে তিন ভাগের দু’ভাগ পথযাত্রা শেষ করেছেন তিনি। গত দু’রাতের পথযাত্রা ভয়াবহ দুর্বিষহ ছিলো। ম’রতে ম’রতে বেঁচে গেছেন তারা। ছুটে আসা তীরগুলো একটা ক্রিসক্রিংগলের পায়ে অন্য একটা মার্কসের কাঁধে লেগেছিলো। ভাগ্য সহায় ছিলো। বেশ মোটাকৃতির একটা অশ্বত্থ গাছের পেছনে লুকিয়ে পড়ায় প্রাণে বেঁচে গেছেন। তারপর ধীরপায়ে আহত শরীর নিয়ে আবারও অনেকটা পেছনে ফিরে আসেন। সামনে এগিয়ে যাওয়া বিপদজনক ছিলো। মৌমাছির মতো তীর ছুঁড়ছিলো ওরা। আর মাত্র এক-তৃতীয়াংশ রাস্তা। তারপর কতগুলো শতাব্দী পুরনো গুহা। ওখানেই কোনো একটা গুহায় আছেন মার্টিন লরেন্স। আহত শরীর আর মানচিত্র হাতে গোটা একরাত আর দু’টো দিন পার করেছেন ক্রিসক্রিংগল। আজ আরও একটা ভয়ংকর রাতের শুরু হবে। তাবুর মধ্যে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে মার্কস। ঘুমিয়ে গেছে। কাঁধের আঘাতটা বেশ গুরুতর। মার্কসের জন্যই সামনে এগিয়ে যাওয়ার সাহস পান না ক্রিসক্রিংগল। গতকাল বিকালের দিকে একটা হরিণ শিকার করে সেটাই আগুনে ঝলসে আজ বিকেল পর্যন্ত দু’জনে চালিয়ে নিয়েছিলেন। এরপর কি করবেন? ক্রিসক্রিংগল ভাবেন। মার্কসের গোঙ্গানির শব্দে তিনি ভাবনার ইতি টানেন। মৃদু আওয়াজে ডাকেন,,,

-মার্কস? মার্কস গ্রোসিয়াস।।

-জ্বি। ____ক্ষীণকন্ঠে প্রত্যুত্তর দেয় মার্কস।

– এখনো ব্যথা করছে কাঁধে?

– প্রচন্ড ব্যথা করছে।

– তোমাকে প্রথমেই বলেছিলাম, আমার সাথে এসো না। ফিরে যাও।

– আমি রাস্তা হারিয়ে ফেলেছিলাম । কিভাবে ফিরে যেতাম? আপনি আমাকে সাহায্য করুন।

– কোথা থেকে এসেছিলে? ___অকপটে জিজ্ঞেস করেন ক্রিসক্রিংগল।

– ভেনাস। খারকিভের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের একটি গ্রাম।

– প্রাসকোভিয়ায় কাদের সাথে এবং কেনো এসেছিলে?

– বন্ধদের সাথে ঘুরতে এসেছিলাম। শুরু থেকেই বলছি। কেনো বিশ্বাস করছেন না?

– তোমাকে কিভাবে সাহায্য করবো বলো? আমি আমার গন্তব্যের খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। এখন ফিরে যেতে পারবো না।

মার্কসের দিক থেকে কোনো সাড়া শব্দ শোনা যায় না। ছেলেটা হয়তো ঘুমিয়ে গেছে আবার। ক্রিসক্রিংগল দোটানায় ভুগেন। তার মন ফিরে যাওয়ার পক্ষে সায় দেয় না। এতো কষ্ট করে এতোটা দুর্গম রাস্তা পাড়ি দিয়ে লক্ষ্যের কাছাকাছি পৌঁছে তিনি কিভাবে ফিরে যেতে পারেন?

_____

ইম্যুভিল।

মাঝরাত। টেবিলের সামনে চেয়ার পেতে বসে বই পড়ছিলো সিয়া। ডিয়েটসের জাদুবিদ্যা শেখার বই। দিনলিপিটা ক্রিস্তিয়ান নিয়ে গেছে। তার পড়া শেষ হলে আবার ফেরত দিয়ে দিবে। গভীর মনোযোগ সহকারে পড়ছিলো সিয়া। কতগুলো জাদুর স্পেল আয়ত্ত করছিলো। একটা স্পেল ছিলো এমন, যেটা পাঠ করলে যেকোনো হালকা বা ছোট জিনিস সহজেই নিজের কাছে নিয়ে আসতে পারবে এবং সেগুলো তীব্র বেগে অন্যদিকে ছুঁড়ে দিতে পারবে। স্পেল শিখার পাশাপাশি সেগুলো প্রয়োগ করে দেখছিলো ও। অপ্রত্যাশিতভাবে সিয়া খুব সহজেই জাদুগুলো আয়ত্ত করে নিচ্ছিলো। কিন্তু বাবার অগোচরে এসব করা কি ঠিক হচ্ছে? ডিয়েটস বলেছিলেন, এই বইটা আর কখনো ছুঁয়ে না দেখতে।

হঠাৎই দম বন্ধ হয়ে আসে সিয়ার। বাবা আর দাদুর কথা ভীষণ মনে পড়ে। কে জানে,তারা কোথায় আছে। পড়ায় মনোযোগ বসে না ওর। বইটা বন্ধ করে টেবিলের দেরাজে রাখে। ধীরপায়ে হেঁটে দরজার সামনে গিয়ে দাড়ায়। বিছানার দিকে একনজর তাকিয়ে দরজা খুলে বারান্দায় চলে যায়। ও চলে যেতেই চোখ মেলে তাকায় ইনায়া। এতক্ষণ ঘুমিয়ে থাকার ভান করেছিলো। ও দেখতে চায়, প্রায়শই সিয়া গভীর রাতে কোথায় চলে যায়। কম্বল সরিয়ে দ্রুত পায়ে নেমে দাড়ায়। নিঃশব্দে পা ফেলে দরজা খুলে বারান্দায় চলে যায়।

বাড়ির পশ্চাদ্ভাদের উঠানে দু’দিকে দু’টো লন্ঠন জ্বলছিলো। ইনায়া চারপাশে খুঁজে। কিন্তু সিয়াকে কোথাও দেখতে পায় না ও।বাড়ির বাকিরা তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিলো।ইনায়া দ্রুতপায়ে বারান্দা থেকে উঠোনে নেমে দাড়ায়। সিয়া ততক্ষণে জলাশয়ের কাছে পৌঁছে যায়। জমে যাওয়া তুষার সরিয়ে ভেঁজা সিঁড়ির উপর বসে।

ইনায়া পা চালিয়ে হাঁটে। কিন্তু হঠাৎই একটা কালো ধোঁয়ার কুন্ডলী ওর চারদিকে ঘুরতে শুরু করে। ভয় পেয়ে দাড়িয়ে পড়ে ইনায়া। কালো ধোঁয়ার কুন্ডলীটা মানুষের অবয়ব ধারন করে। যাকে দেখা মাত্রই ভীষণ রেগে যায় ও। উচ্চস্বরে বলে,,,,

-তুমি?

ওর কন্ঠস্বর স্পষ্ট শুনতে পায় সিয়া। ত্বরিত উঠে দাড়ায়। দ্রুতপায়ে দৌড়ে যায় পশ্চাদ্ভাগের উঠানের দিকে।

ইনায়া যেন রাগে কাঁপছে। দর্শনেন্দ্রিয়ের সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকা ইনায়ার আঁখি যুগলের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আব্রাহাম। আক্রোশে অগ্নিমূর্তি ধারন করা ইনায়ার ক্রোধিত দৃষ্টির চাহনি যেন নিমেষেই তাকে ভস্ম করে দিতে চায়। অথচ সে মোহনীয় হেঁসে বলে,,,,

– তুমি রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকালে আমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়ে তীব্র ভয়ংকর নেশা। আমার হৃদয় সিক্ত হয়। ভীষণ বাজে ভাবে আমি তোমাতে আসক্ত হই। যেন তোমার এই গাঢ় ধূসর চোখজোড়ায় রেড ওয়াইনের স্বাদ খুঁজে পাই।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।