ফ্লোরেনসিয়া – ৪২ (দ্বিতীয় অংশ)

রাত আটটা বেজে গেছে। কিছুক্ষণ আগে বাড়িতে ফিরে এসেছে ক্রিস্তিয়ান আর স্ট্রিকল্যান্ড কুরী। গায়ে কম্বল জড়িয়ে বিছানায় শুয়ে বই পড়ছিলো আর্নি। চেয়ারে পিঠ ঠেকিয়ে চোখ বুঁজে বসে আছে সিয়া। সশব্দে দরজা খুলে কামরায় প্রবেশ করে ইনায়া। তীব্র ঠান্ডায় ঠকঠকিয়ে কাঁপতে শুরু করে। দরজা চাপিয়ে রেখে দৌড়ে গিয়ে কম্বলের নিচে ঢুকে। সিয়া চোখ মেলে তাকায়। মানচিত্র আর নকশাগুলো নিয়ে ওর গবেষণা সম্পন্ন। এবার শুধু এক এক করে সবগুলো জায়গা ঘুরে দেখতে হবে। কিন্তু কিভাবে? যদিও শুধুমাত্র রাতে সুযোগ থাকে, তবে কিছুদিন ধরে ইনায়া সিয়াকে নজরে নজরে রাখে।

সহসা দরজায় করাঘাতের শব্দ শোনা যায়। ওপাশ থেকে ক্রিস্তিয়ান মৃদু আওয়াজে ডাকে,,,

– সিয়া, ইনায়া।

– দরজা খোলাই আছে। এসো।____ ইনায়া বলে।

ক্রিস্তিয়ান কামরায় প্রবেশ করে। ওর হাতে কয়েকটা লম্বাকৃতির কাগজ দেখা যায়। মুখখানা কেমন শুকনো। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে সিয়ার পাশে গিয়ে দাড়ায়। সিয়া নিষ্প্রভ চোখে দেখে। ম্লান কন্ঠে জিজ্ঞেস করে তাকে,,,

– কিছু বলবে?

– হ্যাঁ।

– আচ্ছা। বসে কথা বলো।

ক্রিস্তিয়ান টুলের উপর বসে। গলা ঝেড়ে দীর্ঘশ্বাস টেনে নেয়। সময় নিয়ে বলে,,,

– একসময় বাবা খুব ভালো তৈলচিত্র আঁকতেন। তার আঁকা কিছু তৈলচিত্র তোমরা আগেও দেখেছ। জানিনা তিনি হঠাৎ কেনো তৈলচিত্র আঁকা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু আজ সকালবেলা একটা জিনিস দেখে আমি বেশ হতবাক হয়েছি। তার কামরায় কিছু তৈলচিত্র খুঁজে পেয়েছি। সবথেকে আশ্চর্যের বিষয়, নয়টি তৈলচিত্রের মধ্যে একটা তৈলচিত্র আব্রাহাম স্যাভেরিনের ছিলো।

আর্নি আর ইনায়া চমকায়। সোজা হয়ে বসে। সিয়ার নিষ্প্রাণ চোখজোড়ায় যেন দপ করে আগুন জ্বলে উঠে। অকপটে বলে,,,

– আমি সবগুলো তৈলচিত্র দেখতে চাই।

– আমি সাথে করে নিয়ে এসেছি। দেখো।

ক্রিস্তিয়ান তার হাতের কাগজগুলো সিয়ার দিকে বাড়িয়ে দেয়। ত্বরিত কাগজগুলো হাতে নিয়ে সিয়া উল্টে পাল্টে দেখে। আর্নি আর ইনায়া বিছানা থেকে নেমে আসে। মনোযোগ দিয়ে দেখে। দুর্ভাগ্যবশত ওরা কেউই তৈলচিত্রের নারী-পুরুষগুলোকে চিনতে পারে না। চারজন নারী আর পাঁচজন পুরুষের তৈলচিত্র আঁকা ছিলো। সিয়া দৃঢ় গলায় বলে,,,,

– এদুয়ার্দোর নির্দেশে ওরা নয়জন কাস্ত্রোরুজ থর্পে গিয়েছিলো। আমাদের বাড়িতে। নৃশংসভাবে আমার মা, দাদিন আর হানিকে হ’ত্যা করেছিলো। পিদর্কা, ভিক্টোরিয়া, ক্যারলোয়েন, অ্যালিস, ব্রাংকো, স্যান্ড্রি, উড্রো উইলসন, জ্যাসন মিকারলি আর আব্রাহাম। চারজন নারী এবং পাঁচজন পুরুষ।

ইনায়ার হৃদপিণ্ড জ্বলতে শুরু করে। দু’চোখ ছাপিয়ে অবাধ অশ্রুকনা গড়িয়ে পড়ে। প্রিয়জনদের রক্তশূণ্য মৃতলাশগুলো চোখের সামনে ভাসে। দরজায় করাঘাতের শব্দ শুনে হাতের দু’আঙ্গুলে চোখ মুছে ও। দ্রুতপায়ে হেঁটে গিয়ে দরজা খুলে দেয়। তড়িঘড়ি করে কামরায় প্রবেশ করেন স্ট্রিকল্যান্ড কুরী। উদ্বিগ্ন কন্ঠে ক্রিস্তিয়ানকে জিজ্ঞেস করেন,,,

– আমার আলমারি থেকে কিছু তৈলচিত্র নিয়েছিলে?

ক্রিস্তিয়ান তার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগেই সিয়ার হাতের দিকে তাকান স্ট্রিকল্যান্ড কুরী। তৈলচিত্রগুলো একপ্রকার ছিনিয়ে নেন তিনি। রাগমিশ্রিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করেন,,,

– এগুলো তোমাদের কাছে কেনো? কে নিয়ে এসেছে এখানে?

– সেই দুঃস্বপ্নে ঘেরা ভয়ংকর সন্ধ্যায় এই শ য়তান গুলোই আমাদের বাড়িতে আক্রমণ করেছিলো। তাইনা আঙ্কেল?

স্ট্রিকল্যান্ডের মুখখানা ফ্যাকাশে হয়ে যায়। কন্ঠস্বর অবরোধ হয়ে আসে। আমতাআমতা করে বলেন,,

– কি বলছো এসব? ওদের কারো চেহারা মনে নেই আমার।

– আপনার গলা কাঁপছে। আপনি ভীত। কারণ সত্যি বলতে ভয় পাচ্ছেন। আমি শতভাগ নিশ্চিত। এই তৈলচিত্রের নয়জন নারী-পুরুষ আমার মা, দাদিন আর হানির হ’ত্যাকারী।___সিয়া আত্মবিশ্বাসী কন্ঠে বলে।

স্ট্রিকল্যান্ড কোনো কথা বলেন না। চারজোড়া চোখ তার দিকে প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে নির্নিমেষ তাকিয়ে রয়। স্ট্রিকল্যান্ড নিশ্চুপ, নির্বাক। তাকে নীরব থাকতে দেখে সিয়া শান্ত গলায় বলে,,,

– আপনি আমার জন্য দুশ্চিন্তা করছেন। আমি বুঝতে পেরেছি। কিন্তু একটা কথা কি জানেন? যখন লক্ষ্য থাকে পাপিষ্ঠ আত্মাদের বিনাশ করার, তখন স্বয়ং ঈশ্বর সহায় হন। তিনিই আমাকে সাহায্য করবেন। ঈশ্বর চান আমার হাতেই ঐ শ’য়তানগুলো ধ্বংস হোক।

স্ট্রিকল্যান্ডের মনে ঠিক এই ভয়টাই ছিলো। তিনি সিয়ার সম্পর্কে জানেন। ও যা কিছু করতে পারে। শুধুমাত্র সুযোগের অপেক্ষায় আছে। এরই মাঝে বিস্মিত কন্ঠে ক্রিস্তিয়ান জিজ্ঞেস করে,,,

– তুমি এই তৈলচিত্রগুলো কখন এবং কেনো এঁকেছো বাবা?

– আমাকে ক্রিসক্রিংগল আঁকতে বলেছিলো। প্রথমে আমি রাজি ছিলাম না। কিন্তু সে অনুরোধ করায় বাধ্য হয়েছি। সবাই ঘুমিয়ে যাওয়ার পর গভীর রাতে এই তৈলচিত্রগুলো এঁকেছিলাম আমি।

– আপনি কি জানেন বাবা কোথায় গেছেন?___উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞেস করে ইনায়া।

– না। ক্রিসক্রিংগল বলেছিলো, মার্টিন লরেন্সকে নিয়ে সে দ্রুত ফিরে আসবে। ততদিন পর্যন্ত আমি যেন তোমাদের খেয়াল রাখি।

– মার্টিন লরেন্স!! ___অস্ফুটস্বরে নামটা উচ্চারণ করে সিয়া। ওর হৃদয় কম্পিত হয়। অজানা আতংকে সমস্ত শরীর অবশ হয়ে আসে। কারণ ওর বাবা বলেছিলেন, মার্টিনের খোঁজে যাওয়া মানুষগুলো আর কখনো ফিরে আসে না।

_______

কিয়েভ, স্যাভেরিন ক্যাসল।

রাত দশটা। দুর্গের বিস্তৃত হলরুমে আনন্দের ফোয়ারা বইছে। সবাই একসাথে বসে র’ক্তপানে উন্মত্ত হয়ে উঠে। তারা হেসে হেসে একে অপরের সাথে খোশগল্প করে। পিদর্কা স্যাভেরিনের ডানপাশে নীলাভ নেত্রের একজন সুদর্শন যুবক বসে আছে। সে নিজের হাতে থাকা গ্লাসের রক্তটুকু পান করে সোফার উপর গা এলিয়ে দেয়। কিছুক্ষণ সময় গড়ায়। ফ্রন্ট ডোরের বাইরে থেকে তাদের উচ্চহাসির শব্দ শোনা যায়।

আচম্বিতে বিকট শব্দে ভেঙ্গে যায় ওক কাঠের ভারী দরজাটা। সোফায় বসে থাকা সবাই চমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। ভীত চোখে তাকায় ভেঙ্গে যাওয়া দরজাটার দিকে। কোথাও কেউ নেই। ঝড়ের বেগে ছুটে যায় ব্রাংকো। দরজার ওপাশে খুঁজে দেখে। কিন্তু কাউকেই দেখতে পায় না সে। শঙ্কিত মুখে কামরায় প্রবেশ করে। অকস্মাৎ পেছন থেকে কেউ শক্তহাতে তার গলা চেপে ধরে। উপরে তুলে অদুরে ছুঁড়ে ফেলে। ভীত-সন্ত্রস্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন পিদর্কা স্যাভেরিন। বিস্মিত হয়ে অস্পষ্ট স্বরে ডাকেন,,,,

-এদুয়ার্দো!!

এদুয়ার্দোর চোখের মনি দু’টো ভয়াবহ লালবর্ণ। মনে হয় এখুনি রক্ত গড়িয়ে পড়বে। মুখাবয়বে অসামান্য হিংস্রতা ফুটে উঠে। ক্রোধের আধিক্যে যেন চোয়াল দ্বয় অবিরত কাঁপতে শুরু করে। পিদর্কা স্যাভেরিন তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটার দিকে তাকান। ছেলেটা ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে। তার দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে পিদর্কা স্যাভেরিন এদুয়ার্দোর দিকে তাকান। আদুরে গলায় ডাকেন। উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলেন,,,

– বাবা এদুয়ার্দো। তোমার কি হয়েছে? দেখো আব্রাহাম সুস্থ হয়ে গেছে। এই খুশিতে সবাই একসাথে বসে কিছুটা সময় আনন্দ উপভোগ করছিলাম। তোমাকে সংবাদ পাঠাতাম। কিন্তু তার আগে তুমি নিজেই চলে এসেছ। আমি ভীষণ খুশি হয়েছি। এসো,,এসো আমার কাছে।

এদুয়ার্দো একপা দু’পা করে এগোয়। ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আব্রাহামের দিকে। পিদর্কার পাশে গিয়ে দাড়ায়। মায়ের দিকে না তাকিয়ে আব্রাহামের গলা টিপে ধরে। হাসি হাসি মুখখানা রাগে বদলে যায় আব্রাহামের। এদুয়ার্দো তাকে দেয়ালে ছুঁড়ে মারে। পিদর্কা স্যাভেরিনসহ কামরায় উপস্থিত থাকা প্রত্যেকে স্তব্ধ হয়ে যায়। এদুয়ার্দো ক্রোধিত কন্ঠে হুংকার দিয়ে বলে,,,,

– এসবকিছুর পেছনে আপনি ছিলেন মা?

– কোন সবকিছুর পেছনে? কি বলতে চাইছো?

– ইউক্রেনের সব সুন্দরী যুবতীদের নিরুদ্দেশ হওয়ার পেছনে, ডিয়েটসের পরিবারের সদস্যদের হ’ত্যার পেছনে। ফ্রাঙ্কলিনের বাড়িতে আক্রমণ করার পেছনে। সবকিছুর পেছনে মা, সবকিছুর পেছনে। এই বিশ্বাসঘাতকগুলোও আপনার সঙ্গ দিয়েছিলো।

– তোমাকে এসব কে বলেছে? বলো।

এদুয়ার্দো বিদ্রুপাত্মক হাসে। অতঃপর চোয়াল শক্ত করে হিংস্রাত্মক কন্ঠে বলে,,,

– কেউ বলেনি মা। আমি স্বচক্ষে দেখেছি সবকিছু। কিভাবে আপনি ডিয়েটসের বাড়িতে আক্রমণ করেছিলেন। তার স্ত্রী, পুত্রবধূ আর সাসোলি কুরীকে হ’ত্যা করার আদেশ দিয়েছিলেন? আমি স্ট্রিকল্যান্ডের মস্তিষ্ক পড়েছি। তার চোখে সবটা দেখেছি মা। এবারও কি বলবেন আপনি নির্দোষ, আপনাকে কেউ ফাঁসাতে চাইছে?

এদুয়ার্দো জেনে গেছে সবটা। অস্বীকার করার উপায় নেই। পিদর্কা স্যাভেরিন স্পষ্ট গলায় দৃঢ় কন্ঠে বলেন,,,

– হ্যাঁ। আমি গিয়েছিলাম। মে’রে ফেলেছি ওদেরকে। এই অপরাধের অপরাধী আমি। কিন্তু তোমার করা বাকি অভিযোগ গুলো মিথ্যে। তুমি শুধুমাত্র সন্দেহের বশে আমাকে দোষারোপ করছো। তাছাড়া সেদিন ওদেরকে মে’রে ফেলার যথেষ্ট কারণ ছিলো।

পিদর্কা আরও কিছু বলতে চান। কিন্তু এদুয়ার্দো তাকে হাতের ইশারায় থামিয়ে দিয়ে বলে,,,,

– ব্যস। এতটুকুই যথেষ্ট। আমার অগোচরে যে অপরাধ আপনি করেছেন। সেই অপরাধের শাস্তি আপনিসহ আপনার সঙ্গ দেওয়া বাকি সবাই ভোগ করবে। আমার জীবনে বিশ্বাসঘাতকতার কোনো ক্ষমা নেই।

– ডিয়েটস তোমার বাবার হত্যাকারী ছিলো। ওর জন্য তোমরা সবাই অনাথ হয়েছ। তোমাদের বাবার আদর, স্নেহ, ভালবাসা থেকে সর্বদা বঞ্চিত। আমার জীবন দুর্বিষহ হয়ে গিয়েছিলো। তবুও বলবে ওদের হ’ত্যা করে আমি ভুল করেছি?___ পিদর্কা অশ্রুসজল চোখে কাতর কন্ঠে বলেন।

– প্রতিশোধ স্পৃহা আপনাকে অন্ধ করে দিয়েছে মা। আপনি বদলে গেছেন। আমি আমার কোমল হৃদয়ের মমতাময়ী মাকে খুঁজে পাচ্ছি না।____এদুয়ার্দোর ম্লান কন্ঠ।

– তুমি কি নিজের বাবার মৃ’ত্যুর প্রতিশোধ নিতে চাওনা?

– আপনি যাদের প্রাণনাশ করেছেন, তারা কি বাবার হ’ত্যাকারী ছিলো?

পিদর্কা স্যাভেরিন কোনো উত্তর দিতে পারেন না। এদুয়ার্দো তার সামনে গিয়ে দাড়ায়। অকপটে জিজ্ঞেস করে,,,,

– আপনি আমাকে কিভাবে প্রতিশোধ নিতে বলছেন মা? ঐ নিষ্পাপ মেয়ে দু’টোকে হত্যা করে? আমার বাবার যখন মৃ’ত্যু হয়েছিলো তখন যাদের জন্মই হয়নি, তাদের হ’ত্যা করে?

– তুমি ভুলে যাচ্ছো, তুমি কার সাথে কথা বলছো। উনি আমাদের মা।_____ জোর গলায় কথাটা বলে ভিক্টোরিয়া।

এদুয়ার্দো রক্তচক্ষু নিয়ে তাকায়। ভিক্টোরিয়া দমে যায়। এদুয়ার্দো বজ্রধ্বনি তুলে জিজ্ঞেস করে,,,

– তুমি কে? আমাদের মাঝখানে কথা বলার দুঃসাহস হয় কি করে? আমার বড় বোন? নাকি আমার অনুগত দাস? যেহেতু তোমাদের দু’জনকে বোন বলে গণ্য করিনা, অতএব এই মুহূর্তে তোমাদের সামনে ভাম্পায়ার সাম্রাজ্যের ওভারলর্ড দাড়িয়ে আছে।

কিছুটা দুরে দাঁড়িয়ে থেকে আব্রাহাম সবটা দেখে। মনে মনে ক্রুর হাসে। ঠিক এরকমটাই চেয়েছিলো সে। মা আর ছেলের মধ্যে বেশ বড়সড় দ্বন্দ্ব লাগিয়ে দিতে। কয়েকপল সময় গড়ায়। এদুয়ার্দো কঠিন কন্ঠে বলে,,,

– আমার বিশ্বাস ভঙ্গ করার শাস্তি অবশ্যই পাবেন। আপাতত কেউ এই দুর্গের বাইরে যেতে পারবেন না।

পিদর্কা স্যাভেরিনের কলিজা শুকিয়ে যায়। বিচলিত কন্ঠে বলেন,,,

– বাবা এদুয়ার্দো। শান্ত হও। প্রথমে সবটা শোনো।

পিদর্কার কথায় কর্নপাত করে না এদুয়ার্দো। থমথমে পা ফেলে সম্মুখ দরজার দিকে এগিয়ে যায় সে। পেছন থেকে পিদর্কা স্যাভেরিন উচ্চস্বরে বলেন,,,,

– এদুয়ার্দো শোনো। ঐ তলোয়ারটাই আমাদের বি’নাশ করার একমাত্র অস্ত্র।

এদুয়ার্দো ত্বরিত দাঁড়িয়ে পড়ে। পেছন ফিরে দেখে। পিদর্কা স্যাভেরিন অশ্রুসজল চোখে উপর নিচ মাথা ঝাঁকান। ব্যথাতুর কন্ঠে বলেন,,,

– ওদের কাছে থাকা বই, পাথর, তলোয়ার একটার সাথে আরেকটা সম্পৃক্ত। ওগুলো ওদের কাছে থাকা বিপদজনক। একমাত্র ঐ তলোয়ারই ব্রুড গোত্রের সবগুলো ভাম্পায়ারদের ধ্বংস করতে পারে। এমনকি তোমাকে আর আমাকেও। আমার সব সন্তান আর প্রিয়জনদের বাঁচাতেই আমাকে এতটা নিষ্ঠুর হতে হয়েছিলো। আমি অপরাধ করেছি, কারন তোমাদের কাউকে হারাতে চাইনি।

এদুয়ার্দো অবিশ্বাস্য ভঙ্গিতে ডান দিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। পুনরায় মায়ের দিকে তাকায়। তাচ্ছিল্য ভরা কন্ঠে অকপটে বলে,,,

– এ ব্যাপারে আপনি আমাকে আগে জানাতে পারতেন। আমি নিয়ে আসতাম আপনার কাঙ্ক্ষিত জিনিসগুলো। কিন্তু না। আপনি যা যা করেছেন, সবটাই আমার অগোচরে। এই অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য। এই মুহূর্ত থেকে আপনাদের দুর্গের বাইরে যাওয়া নিষিদ্ধ। মনে থাকে যেন।

কথাটুকু বলে এদুয়ার্দো আর এক মুহূর্তও দাড়ায় না। ধোঁয়ার কুন্ডলী হয়ে হলরুমের বাইরে বেরিয়ে যায়। পিদর্কা স্যাভরিন পাথরের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে রয়। বাকিরা ভয়ে তটস্থ। কে জানে এদুয়ার্দো তাদের জন্য কি শাস্তি নির্ধারণ করে।

____

ইম্যুভিল।

গভীর রাত। ইম্যুভিলের চারদিকে নিগূঢ় অন্ধকার। কিছুক্ষণ হলো ঘুমিয়ে পড়েছে ইনায়া। ওর ভারি নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যায়। অতি সাবধানে বিছানা থেকে নেমে দাড়ায় সিয়া। নিঃশব্দে পা টিপে টিপে কামরার বাইরে বেরিয়ে যায়। আলগোছে বাইরে থেকে দরজা আঁটকে দেয়। পশ্চাদ্ভাগের উঠোন পেরিয়ে জলাশয়ের কাছে গিয়ে দাড়ায়। মৃদু আওয়াজে ডাকে,,,,

-থ্যাসো।

ভয়াল রাতের প্রগাঢ় অন্ধকার বিদীর্ণ করে ছুটে আসে স্বর্গীয় ঘোড়া। সিয়ার চোখ জুড়িয়ে যায়। প্রশান্তি অনুভব করে। থ্যাসো মাটিতে নেমে দাড়ায়। সিয়া ওর গলায় হাত বুলিয়ে দেয়। আদুরে কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,,,,

– আমাকে কাস্ত্রোরুজ নিয়ে যাবে? আমার বাড়িতে? রাতের অন্ধকার ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই এখানে ফিরে আসতে হবে। পারবে তো?

থ্যাসো লেজ নাড়ায়। সিয়া রক্তিম ঠোঁটে মলিন হাসে। থ্যাসোর পিঠে চড়ে বসে। আলোর বেগে ছুটতে শুরু করে থ্যাসো। সিয়া শক্ত হাতে ওর লাগাম টেনে ধরে। পেঁজা তুলোর মতো মেঘের উপর দিয়ে থ্যাসো যাত্রা শুরু করে কাস্ত্রোরুজের দিকে। অদুরে জ্বলজ্বলে তারার মেলা দেখে সিয়ার চিত্ত চঞ্চল হয়ে উঠে। যেন হাত বাড়ালেই স্পর্শ করা যাবে।

ইম্যুভিল পেরিয়ে প্রাসকোভিয়া জঙ্গলের উপর পৌঁছাতেই সিয়ার হৃদয় মুষড়ে উঠে। দুরুদুরু বুক কাঁপতে শুরু করে। এই জঙ্গলেই কোনো একটা জায়গায় থাকতে পারে ওর বাবা। কিন্তু কোথায়?

বিষন্ন মুখখানা আরও বিষন্ন হয়ে উঠে। থ্যাসো প্রাসকোভিয়া পেরিয়ে যায়। সিয়া নিষ্প্রভ চোখে দেখে। উপর থেকে দেখে মনে হয় পাহাড় পর্বতগুলো মাটিতে মিশে গেছে। বড় বড় সবুজ পাতার বৃক্ষগুলোকে দুর্বাঘাসের মতো লাগে।

রাতের অন্ধকারে জায়গা গুলো চিনতে পারে না সিয়া। কাস্ত্রোরুজের সীমানায় পৌঁছায়। সিয়ার পরনে মোটা উলের শীতবস্ত্র ছিলো। প্রাসকোভিয়া জঙ্গল পর্যন্ত শীত শীত অনুভূতি হলেও এখন বেশ গরম লাগছে। কাস্ত্রোরুজের সিমানা পেরিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই থ্যাসো সিয়াদের বাড়িতে পৌঁছায়। পশ্চাদ্ভাগের উঠানে নেমে দাড়ায়। সিয়ার বুক ধক করে উঠে।

বাড়িটা যেন কোনো সমাধিক্ষেত্র। চারদিকে প্রগাঢ় নিস্তব্ধতা। সহসা মাথার উপর দিয়ে একঝাঁক পাখি উড়ে যায়। ভয় পেয়ে চিৎকার চেঁচামেচি জুড়ে দেয়। বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করার সাহস হয় না সিয়ার। চোখের সামনে ভেসে উঠে মায়ের হাস্যোজ্জ্বল মুখ। কর্ণকুহরে বাজে তার শাসনের সুর। উরসুলার আদুরে ডাক। ডিয়েটসের উচ্চস্বরে হাসির শব্দ। সবকিছু যেন সিয়ার কানে কানে বাজে। প্রতিধ্বনিত হয়ে বারবার ফিরে আসে।

সিয়া দু’হাতে কান চেপে ধরে। দু’চোখ ঠেলে কান্নারা ভিড় জমাতে চায়। সিয়া নিজের মনকে শক্ত করে নেয়। কাঁদবে না। একফোঁটা অশ্রু ঝড়াবে না। চোখ থেকে অশ্রু নয় আগুন ঝড়বে। তবেই না জানোয়ারগুলোকে সেই আগুনে জ্বালিয়ে মা’রবে। পুড়িয়ে ছাই করে দিবে। সিয়ার দম বন্ধ হয়ে আসে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। এখানে আর এক মুহূর্তও নয়। ও মনের দিক থেকে দুর্বল হয়ে পড়বে।

সিয়া থ্যাসোর গলায় হাত রাখে। অস্পষ্ট স্বরে বলে,,,

– আমি মায়ের কাছে যাবো।

থ্যাসো দু’দিকে কিঞ্চিত মাথা নাড়ায়। কি বুঝাতে চাইছে ও? বারণ করছে? কেনো বারণ করছে? সিয়া অনুরোধের সুরে কাতর কন্ঠে বলে,,,

– কথা বলতে ইচ্ছে করছে। খুব দেখতে ইচ্ছে করছে মাকে।

থ্যাসো নিশ্চুপ হয়ে স্থির দাঁড়িয়ে থাকে। সিয়া ওর পিঠে চড়ে বসে। শেষ বারের মতো দেখে নেয় বাড়িটাকে। থ্যাসো উড়তে শুরু করে। কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে আবারও মাটিতে নেমে আসে। সমাধি ক্ষেত্রে পৌঁছে গেছে ওরা। থ্যাসোর শরীর থেকে ছড়ানো অত্যাধিক সাদা আলোয় ইলহামা আর উরসুলার সমাধি ফলক স্পষ্ট দেখা যায়। অবশ হয়ে আসা পায়ে সিয়া এগিয়ে যায় মায়ের কাছে। নিঃশব্দে বসে পড়ে সমাধির পাশে। ম্লান স্বরে ডাকে,,,

– “মা”

সিয়া বার কয়েক ডাকে। বিষন্ন বদনে নিষ্প্রাণ কন্ঠে জিজ্ঞেস করে মাকে,,,

– কেমন আছেন আপনি?

ভেতর থেকে কেনো উত্তর আসে না। আসা সম্ভব না। কিন্তু সিয়া মানতে চায়না। ওর মনে হয় এই বুঝি ইলহামা সাড়া দিবেন। সিয়া সেই আশায় বসে থাকে। কতশত কথা বলে। যেন এতদিনের সব জমানো কথা নিজের মাকে শোনাতে চাইছে। কিন্তু ইলহামান কি শুনতে পাচ্ছেন?

সিয়া ঠায় বসে থাকে। এই শুনশান সমাধিতে ওর বিন্দুমাত্র ভয় করে না। কারন মা আছে। ও উরসুলার সমাধিতে হাত রাখে। ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখে। এভাবেই কয়েক পল সময় গড়িয়ে যায়। সহসা সিয়ার মুখখানা কঠিন হয়ে উঠে। ও দৃঢ় গলায় বলে,,,,,

– মা, আমি ঐ শ’য়তান নরপি’শাচগুলোকে দেখেছি। কিন্তু আমি জানি না, ওদের কোথায় খুঁজে পাওয়া যাবে। হয়তো থ্যাসো আমাকে ওদের কাছে পৌঁছে দিতে পারবে। কিন্তু আমি যে ওদের বিনাশ করার উপায় জানিনা। ওরা সাধারণ অস্ত্রের আঘাতে মা’রা যায় না।

বাবা মার্টিন লরেন্সের খোঁজে গেছেন। আমার ভয়াবহ দুশ্চিন্তা হচ্ছে। কিন্ত ইনায়াকে একা রেখে আমি কিভাবে খুঁজতে যাবো তাকে? আপনি ঈশ্বরকে বলুন না, তিনি যেন বাবাকে তাড়াতাড়ি ফিরিয়ে দেন আমাদের কাছে। তাকে ছাড়া আমরা দু’জন ভীষণ অসহায়।

মা, আমাকে ক্ষমা করে দিন। আমি এখনো আপনার হত্যাকরীদের কাউকে শাস্তি দিতে পারিনি। কিন্তু ভরসা রাখুন। আমি আমার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করবো।

থ্যাসো অদ্ভুত শব্দ করে লেজ নাড়াতে শুরু করে। সিয়া চমকে পেছনে ফিরে। থ্যাসোর এমন আচরণের কারণ বুঝতে পারে না ও। এরই মাঝে হঠাৎই ওর ক্রুশচিহ্নটা জ্বলতে শুরু করে। সমাধির চারপাশে একসাথে কতগুলো কালো ধোঁয়ার কুন্ডলী চক্রাকার ঘুরে। কালো কুচকুচে দেখতে অসংখ্য বাদুড় উড়ে আসে।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।