সর্ণালি কিছু একটা বলতে চেয়েও বলল না। হয়ত সবার মুড খারাপ হয়ে যাবে যাওয়ার আগে। এনোন গাড়িতে বসতেই দেখে সিনান ও নিনি পেছনের সিটে বসেছে এনোন বিরক্ত ভঙ্গিতে পেছনে ফিরে বলে,, তোমাদের ড্রাইবার না আমি, কেউ একজন আমার পাশে বসো।” বলে সামনে ফিরে সে। সিনান নিনি কে হাতে গুঁতা দিয়ে দিয়ে বলে,, গিয়ে সামনে বসো।” নিনি ও বাধ্য মেয়ের মত সামনে এসে বসলো এনোন আড়চোখে তাকায় নিনি সিট বেল্ট বাঁধেনি এনোন তার দিকে না তাকিয়ে বলে,, সিট বেল্ট লাগিয়ে নাও।”
নিনি না শুনে তার দিকে প্রশ্নাত্তুর দৃষ্টিতে তাকালো বলল,, হু?” এনোন যেন মহা বিরক্ত হলো সে আর কথা না বাড়িয়ে নিনির পাশে সিট বেল্ট টেনে লাগিয়ে দিল তারপর ড্রাইভ করতে লাগল। এতক্ষণ সব আড়চোখে তাকিয়ে ছিল সিনান আর মুচকি মুচকি হাসছিল।
____________________
চারপাশ নিস্তব্ধ। পুরো শহর ডুব দিল আঁধারে গহীনে। দিনে জ্যামজট আর রাতে নিস্তব্ধ পরিবেশ ঢাকার। তিন পথিক হাঁটা দিচ্ছে তাদের পথে। আধাঘণ্টা আগেই তারা ঢাকা পৌঁছালো। এখন প্রায় বারোটা ছুঁই ছুঁই। কিছু মানুষ ব্যস্ত তাদের আপন কর্মে। আবার কিছু মানুষ ব্যস্ত কাউকে খোঁজার। রাস্তার এক পাশে উঁচু উপর প্রান্তে থাকা ফুল গাছটি কিছু টা ঝুঁকে পড়েছে সেখান থেকে বইয়ে আসা মিষ্টি মন মাতানো সুবাস যা পুরো নগর কে ভরিয়ে দিচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে বড় এক ফ্লাটের সামনে এসে দাঁড়ালো তারা। এনোন পাসওয়ার্ড দিয়ে দরজার লক খুলে ভিতরে প্রবেশ করল নিনি অবাক চোখে তাকিয়ে ছিল। এসব বিষয়ে সে কিছু জানে না। এনোন শুধু তার নিজের ব্যাগ নিয়ে রুমে চলে গেল সাথে সিনান ও চলে গেল নিজের রুমে। বাকি রইল নিনি সে কোন রুমে যাবে? এনোনের রুমে গেলে তো সে ছ্যাঁত করে উঠবে তার উপর গেস্টরুম টাও তালা মারা। সে বসে রইল সোফায়। একটু পর সিনান রুম থেকে ফ্রেশ হয়ে আসে নিনি কে সোফায় বসে থাকতে দেখে ভ্রুকুটি করে নিচে নামে সে। নামতেই সোজা প্রশ্ন ছুড়ে মারে,, তুমি এখানে বসে আছো কেন? যাও রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসো?”
নিনি চোখ তুলে তাকিয়ে বলে,, গেস্টরুম তো তালা মারা তো কোথায় ফ্রেশ হবো?” এমন উদ্ভট প্রশ্নে চেহারা এক প্রকারে করে ফেলে সিনান তার হাত ধরে উঠে দাঁড় করিয়ে বলে,, ভাইয়ার রুমে ফ্রেশ হও।” নিনি একটু দূরে সরে দাঁড়িয়ে বলে,, তোমার ভাই আমার সাথে ছ্যাঁত করে উঠবে রুমে গেলে, এর চেয়ে ভালো গেস্টরুমের চাবি দাও সেখানে ফ্রেশ হয়ে আসি।” সিনান একটু চিন্তা করে বলে,, চাবি আমার কাছে নেই ভাইয়ার কাছে আছে যাও গিয়ে ভাইয়ার কাছ থেকে নিয়ে আসো।” নিনি একটু ঘাবড়ালো তার কাছ থেকে কিছু চাওয়া মানে সিংহ মুখ থেকে খাবার টেনে নেওয়া একই কথা। নিনি হাত নাড়িয়ে না বলল সে পারবে না। সিনান তাকে ঠেলে আনতে আনতে বলে,, তোমার বর এতো ভয় পাওয়ার কি আছে? খেয়ে ফেলবে নাকি!”
বলেই রুমে ঢুকিয়ে দেয় নিনি রুমে ঢুকে দেখে পুরো রুম অন্ধকার এনোন বেডের এক কোনায় বসে ল্যাপটপ কিছু কাজ করছে ল্যাপটপের আলোয় পুরো রুমে আবছা আলো আছে। নিনি চমকে ভ্রু কুঁচকে আসে। এটায় একমাত্র বলদ যে সারাদিনের জার্নি হওয়ার পরেও এক মুঠো শক্তি নিয়ে ল্যাপটপে মনোযোগ সহকারে কাজ করছে যেন সে ক্লান্তই হয়নি! নিনি এসব চিন্তা বাদ দিয়ে একটু একটু হেঁটে কাছে এসে মিইয়ে যাওয়ার কন্ঠে বলে,, গেস্টরুমের চাবি টা একটু দেন তো!” এনোন খেয়াল করিনি যে এক মানবী তার রুমে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল প্রশ্ন করতেই সে চমকে উঠে। এনোন কর্কশ গলায় বলে,, কিহ্? আর পারমিশেন ছাড়া রুমে ঢুকলা কোন সাহসে?” নিনি চাওয়ার হাত সরিয়ে নেয় মুহূর্তেই মাথা গরম হয়ে যায় তার সে নিজেকে শান্ত রেখে শান্ত গলায় বলে,, আমার গেস্টরুমের চাবি লাগবে।”
এনোন পুনরায় ল্যাপটপ কোলে রেখে কাজ করতে শুরু করল যেন সে কিছুই শুনেনি। নিনি ভ্রুদ্বয় কুঁচকে বলে,, চাবি চাচ্ছি, চাবি দেন!” এনোন কিছু বলল না নিনি এবার চেঁচিয়ে উঠল এনোন সাথে সাথে দাঁড়িয়ে যেতেই সে চুপ করে যায়। এনোনের চোয়াল শক্ত করে বলে,, কানা! গিয়ে দেখো গেস্টরুম আগের থেকেই খোলা, বেকুব!” বলে সে বসে ল্যাপটপে মনোযোগ সহকারে কাজ করতে লাগলো। মুহূর্তেই নিনির মুখ হা হয়ে যায় তাকে কানা ও বেকুব ডাকছে! কত অপমানের বিষয়। নিনি রাগ নিয়ন্ত্রণ রাখতে না পেরে বলে দিলো,, গাধা কোথাকার! এনোন কিহ্ বলে দাঁড়াতেই এদের মধ্যে যে মহাভারত শুরু হয়ে যাবে তা বুঝতে পেরে সিনান দরজার ওপাশ থেকে নিনি বলে জোরে ডাক দিয়ে ভেতরে এসে নিনির হাত ধরে টেনে নিয়ে যায়।
#১৬_পৃষ্ঠায়
পর্ব – ৭ (বাকি অংশ)
লেখিকা – Zaira Insaan
নতুন সকাল নতুন পর্ব। ঠান্ডাময় এক মসৃণ প্রভাত। চারিদিকে গুমোট ভাব। এনোন, নিনি, সিনান সকালের নাস্তা খেতে টেবিলে বসে। সিনান ওদের দিকে তাকিয়ে দেখে দুইজন দুই প্রান্তে বসেছে বাংলাদেশ ইন্ডিয়া বর্ডারের তফাৎ! সিনান এদের মাঝখানেই বসেছে। সে খেতে খেতে হুট করে এনোন কে বলল,, আজ বিকেলেই চট্টগ্রাম ফিরবো আমি।”
এনোন ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলে,, মানে?” সাথে নিনি ও তাকালো ভ্রু কুঁচকে। সিনান বলে,, মানে আবার কি? বললাম না ফিরবো আজকেই!” এনোন খাবার রেখে ওর দিকে তাকিয়ে বলে,, দুই দিনের জন্য এসেছিলি?” সিনান হালকা মাথা নেড়ে বলে,, হ্যাঁ, আর আমার সামনে এক্সাম তাই ফিরতে হবে।”
এনোন বুঝলো সে শুধু নিনি কে রাখার জন্যই এসেছিল। সে আর কথা বাড়ালো না মোবাইল হাতে নিতেই সিনান বলে,, মোহান কে আমি আগে বলে দিছি তোমার কল করতে হবে না।” এনোন আর কিছু না বলে উঠে চলে গেল কারণ সিনান সব জায়গাতেই পন্ডিত গিরি করে।
_________________________
সিনান কে দিয়ে পৌঁছিয়ে আসতেই বাসায় ফিরে এনোন। দেখতে প্রচুর ক্লান্ত মনে হচ্ছে সে সোজা নিজের রুমে চলে যায়। নিনি কিছু বলতে চেয়েও বলল না যদি তার রাগ উঠে যায়? সে চুপ করে রইল। এখন রাত নয়টা ছুঁই ছুঁই এনোন কিছুক্ষণ পর পর সিনান কে কল তার অবস্থা জানতে চাইছে। খাবার শেষে দুজনেই নিজেদের রুমে চলে যায় নিনি রুমে ঢুকে ফ্যান অন করতেই দেখে ফ্যান চলছে না। নিনি আবারো অন অফ করলো। বারবার করছে কিন্তু ফ্যান চালু হচ্ছে না। এখন সে ঘুমাবে কিভাবে?
সে গিয়ে গুটি গুটি পায়ে এনোনের দরজায় টোকা দেয়। দরজা বন্ধ। সে আবারো দেয় দ্বিতীয় বারে দরজা টোকা পড়তেই দরজা খুলে এনোন পরনে কালো গেঞ্জি চুলগুলো এলোমেলো, হয়ত শুয়ে ছিল! এনোন গম্ভীর গলায় বলে,, কি?” নিনি জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলে,, রুমে ফ্যান চলছে না।” এনোন দুই এক সেকেন্ডের মাথাই চোখ বন্ধ করে খুলে বিরক্ত ভঙ্গিতে বলল,, সিনানের রুমে যাও।” বলেই দরজা হালকা করে বন্ধ করে দেয়। নিনি সিনানের রুমে ঢুকতেই দেখে রুমে ফ্যান নেই শুধু এসি! নিনির ভ্রু কুঁচকে যায় সে এসে এসির রিমোট হাতে নিল কিন্তু রিমোটের কিছুই বুঝলো না। ‘ধুর’ বলে সে আবার এনোনের রুমের সামনে দাঁড়িয়ে টোকা দিতে লাগল। তিনবার টোকাতে দরজা খুলে এনোন মুখে প্রচন্ড বিরক্ত ছাপ। বিরক্ত সুর টেনে বলল,, কি?” নিনি রিমোট এগিয়ে দিয়ে মাথা নিচু করে মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে বলে,, রুমে ফ্যান নেই শুধু এসি আছে কিন্তু এসি চালু করবো কিভাবে?” এনোন মুখ দিয়ে বিরক্ত শব্দ বের করে নিজের রুম থেকে বেরিয়ে যায়। পিছু পিছু নিনিও আসে। রুমে এসে এনোন এসি চালু করে দেয় তারপর নিনির দিকে ফিরে চোখ মুখ বিরক্তিতে কুঁচকে বলে,, আর কিছু?” নিনি মুখে হাসি ফুটে উঠে সে দ্রুত না সূচক মাথা নাড়ল। এনোন চলে যায় তার রুমে। নিনি এসে ধপ করে বিছানায় শুইয়ে গা এলিয়ে দেয়।
________________________
আঁধারের জাল কেটে ফুটে উঠেছে ভোরের আলো।
চকচকে আলোয় ঝলমল করে উঠল পরিবেশ। নতুন এক স্নিগ্ধ সকাল। নিনি এপাশ ওপাশ করে চোখ খুলতেই সর্ব প্রথম চোখ যায় তার ঘড়ির দিকে। সাড়ে নয়টা! এতো দেরি? সে হুড়মুড় করে উঠে বসে সাথে সাথে মাথাটা ঘুরিয়ে উঠে। বিছানা ছেড়ে এসির রিমোট হাতে নেয় সে। ভালোভাবে দেখতে লাগল রিমোটের দিকে কিছু বুঝছে না কিভাবে বন্ধ করতে হবে। সে রিমোট হাতে নিয়ে নিচে ছুটে যায়। এনোন নেই! এনোন নেই বাসায়? সে এতো তাড়াতাড়ি চলে গেল অফিসে? নিনি সবখানে খুঁজে এনোন কে না পেয়ে মাথায় এক হাত রেখে নিজেকে ইচ্ছামত শায়েস্তা করতে লাগল। এসির বাতাস খেয়ে ঘুমানোর দরকার কি জন্য তার?
এখন পস্তাচ্ছে সে। উপায় না পেয়ে সে ডাইরেক্ট ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। আশেপাশে সব ফ্লাটের দরজা বন্ধ। সে ভালোভাবে চোখ বুলাতেই দেখে এক যুবক নিজের ফ্লাট থেকে সবেমাত্র বেরিয়েছে। নিনি তারদিকে দ্রুত ছুটে যায় যুবকটির সামনে এসে বলে,, ভাইয়া এসি কিভাবে অফ করতে হয় জানেন?” আচমকা কেউ এসে হুট করে এই বেহুদা প্রশ্ন করতেই যুবকটির ভ্রুদ্বয় কুঁচকে আসে সে ভালোভাবে নিনি কে পর্যবেক্ষণ করে দেখে বলে,, হ্যাঁ জানি, বাট আপনি কে?” নিনি বলে,, ভাইয়া প্লিজ আমাকে সাহায্য করেন, এসি কিভাবে বন্ধ করতে হয় জানিনা।” ছেলেটি মাথা নাড়তেই সে ছেলেটিকে নিজের ঘরে নিয়ে এসে রুমে নিয়ে যায়। ছেলেটি আসতে চাইনি কিন্তু জোর করাতে সে আসতে বাধ্য হয়। রুমের এসি করতেই এক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে নিনি। ভদ্রলোকটি ড্রয়িং রুমে এসে হেঁসে হেঁসে কথা বলতে লাগল নিনির সাথে। নিনির ঘাড় ধরে এলো ছেলেটির সাথে কথা বলতে বলতে কারণ ছেলেটি বেশ লম্বা এনোনের মতন। ছেলেটি হেসেই ফ্লাট থেকে বেরিয়ে যায়।
নিজের ফ্লাট থেকে অপরিচিত এক লোক কে বের হতে দেখে ভ্রু কুঁচকে যায় এনোনের। সে সবমাত্র মিটিং শেষ করে কেবিনে বসে ফাইল চেক করছিল হঠাৎ ই তার চোখ যায় ট্যাবের দিকে। সে ঘরে সিসি ক্যামেরা লাগিয়ে ছিল অনেক আগে এ কারণে সে দেখতে পেল। সে ট্যাব টি হাতে নিয়ে পেছনে ব্যাক করে পুরো ভিডিও দেখলো সাথে সাথে তার মেজাজ চোওড়া ভাবে খারাপ হয়ে গেল সে দাঁড়িয়ে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নেয়।
নিনি আলমারিতে ল্যাগেজ এর কাপড় গুলো গুছিয়ে রাখছিল। হঠাৎ ই সে কেঁপে উঠে পুরুষালী কর্কশ গলায় আওয়াজ পেয়ে,, তোমার সাহস হয় কিভাবে আমার ঘরে অন্য কাউকে আনার?” কথাটি বেশ ধমকে বলে এনোন। নিনি ফিরে তাকায় ঢোক গিলে কারণ এনোন কে দেখতে বেশ রাগান্বিত লাগছে। এনোন এসে নিনির দুবাহু শক্ত করে চেপে ধরে আলমারির সাথে পিঠ ঠেকে দেয়। নিনি ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠে। এনোন রাগান্বিত কন্ঠে বলে,, কে ছিল সে তোমার এক্স বয়ফ্রেন্ড?” নিনি বুঝলো না ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে রইল। এনোন আবারো বলে,, তোমার মত থার্ড ক্লাস মেয়েরা এসব ই করে থাকে একজনের সাথে আর লাইন মারে আরেকজনের সাথে, ভোগবিলাসী মেয়ে তুমি।” বলেই ছেড়ে দেয় তাকে নিনির চোখে পানি জমে আসে। এনোন গরম হয়ে বলে,, বের হোও আমার ঘর থেকে।” বলেই তার হাত একদম শক্ত করে চেপে ধরে তার ল্যাগেজ নিয়ে নিচে নামতে লাগলো। এমন ভাবে ধরেছে যেন এখনি হাত ভেঙে যাবে নিনি ব্যাথাতুর কন্ঠে বলে,, আহহ্, আমার লাগছে প্লিজ ছাড়েন!” এনোন নিচে এসে দরজা খুলে ধাক্কা মেরে বের করে দেয় নিনিকে সাথে তার ল্যাগেজ সহ। নিনি ধপ করে নিচে পড়ে যায় সে দাঁড়িয়ে এগিয়ে এসে কিছু বলার জন্য উদ্দেগ হতেই ঠাসস করে মুখের সামনে জোরে দরজা বন্ধ করে দেয় এনোন। নিনি থমকে দাঁড়ায় কিছুক্ষণ পড়ে সে ছলছল চোখে ল্যাগেজ নিয়ে চলে যায়।
চলবে…