যত দিন যায়, অরুনার শারীরিক অবস্থার অধঃপতন হয়। সেই দিনের পর থেকে অরুনা কারুর সাথে কথা বলেনি, একদম চুপ করে গেছে, ভাবলেশহীন চেহারা, দুচোখ যেন কাঁচের তৈরি। দিন রাত পুবালির ঘরের মধ্যে কাটায়, প্রকাশহীন নয়নে চেয়ে থাকে টেবিলে ছড়ানো বই গুলর দিকে, পুবালির আল্মারির দিকে যেখানে পুবালি জামা কাপড় রাখত, ফটোর অ্যালবাম হাতে নিয়ে ওদের ছোটো বেলার ছবি দেখে। অরুনা পুবালির চেয়ে মাত্র তিন মাসের বড়, ছোটো বেলা থেকে হরিহর আত্মা ওরা দু’জনে, যেখানেই যেত বা যা কিছু করত, দু’জনে একসাথে করত। শুধু একজন একটু চঞ্চল আরেকজন শান্ত প্রকৃতির মেয়ে ছিল।
অভি মাঝে মাঝেই ওদের বাড়ি গিয়ে অরুনার খবরা খবর নিত। পরীর সাহসে কুলায় না যে অরুনার অভিব্যাক্তিহীন চোখের সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর। পরী নিজেই এত আঘাত পেয়েছিল যে নিজেকে একটা কচ্ছপের খোলের মধ্যে লুকিয়ে নিয়েছিল, ওর ছোটো মা ওর পাশে না থাকলে একদম ভেঙ্গে পড়ত।
পুবালির কাজের দিনে অভিদের যাওয়ার কথা। পরী কান্না শুরু করে, যে ও কিছুতেই ওই বাড়ি যাবে না, কিছুতেই ও অরুনার সামনে দাঁড়াতে পারবে না। মা আর অভি অনেক বুঝাতে চেষ্টা করে পরী কে কিন্তু পরী অটল, ও যাবে না।
শেষ পর্যন্ত বাবা ওকে বললেন, “দেখ সোনামা, আমাদের জীবন একটা নদীর মতন, নদী যেমন চলতে চলতে অনেক বাঁক অনেক বাধার সম্মুখিন হয়, তেমনি আমাদের জীবনেও অনেক বাঁধা বিপত্তি আসে, কিন্তু নদীর জল কি আর থেমে থাকে মা, সেত নিজের খেয়ালে বয়ে চলে সাগরের পানে। আমি তোকে পুবালিকে ভুলে যেতে বলছি না, আমি তোকে শুধু একটা অনুরধ করব যে জীবন কারুর একার জন্য থেমে যায় না।
ইংরাজিতে একটা কথা আছে সোনামা, Rolling stone gather no moss. তুই যদি জীবনের সাথে পা মিলিয়ে না চলিস তাহলে তুই পিছিয়ে পড়বি। সেই দিনের পর থেকে তুই অরুনার সাথে একবারের জন্যেও দেখা করিস নি। ভালো মেয়ের মতন চোখের জল মুছে আমাদের সাথে ওদের বাড়ি চল সোনামা।”
পরী দরজা বন্ধ করে বুক ফাটীয়ে চেঁচিয়ে ওঠে, “আমি বুঝি না কেন এই সব আদিখ্যেতা দেখানো? পুবালির চলে যাওয়া কেন লোক খাওয়ান? কোন বৃদ্ধ যদি জেতেন তাহলে আমি নিজেকে বুঝাতে পারতাম। কিন্তু ফুলের মতন নিস্পাপ, নিস্কলঙ্ক মেয়ের চলে যাওয়ায় এই সব কেন?”
বাবা, “দেখ মা, আমরা মানুষ, আমরা সামাজিক প্রাণী। এই সমাজের কিছু নিয়ম কানুন আছে, এই সমাজে থাকতে হলে আমাদের সেই নিয়ম, কানুন মেনে চলতে হয় নাহলে আমরা মানুষ বলে গন্য হব না।”
বাবার কথা শুনে, পরী দরজা খোলে, মা ওকে জড়িয়ে ধরে সান্তনা দেয়। বেশ কিছুক্ষণের মধ্যে ওরা সবাই ব্যানারজি কাকুর বাড়ি পৌঁছে যায়। এক মুহূর্তের জন্যেও পরী ওর ছোটমায়ের কাছ ছাড়ে না।
ওদের বাড়ি পৌঁছানর পরে, অভি ওপরে উঠে পুবালির ঘরের মধ্যে ঢোকে। যথারীতি, অরুনা চুপচাপ শুয়ে পুবালির বিছানার ওপরে। চুপ করে দরজায় দাঁড়িয়ে অভি ওর দিকে তাকিয়ে থাকে, ভেতরে গিয়ে ওকে কিছু বলার সাহস পায় না অভি। কিছু পরে, অরুনার মা ওকে ডেকে নিয়ে যান নিচে। বলেন যে অভির সাথে ওদের কিছু কথা আছে।
নিচে নেমে এসে দেখে যে একটা ঘরে বাড়ির সব লোক জন জড় হয়েছে। ব্যানারজি কাকু, কাকিমা, বাবা মা, পরী, পুবালির বাবা মা। অভি ঘরের মধ্যে ঢুকতেই সবাই ওর দিকে তাকিয়ে থাকে।
ব্যানারজি কাকু একবার বাবার দিকে তারপর অভির দিকে তাকিয়ে বলে, “অরুনার শারীরিক আর মানসিক সাস্থের দিনের পরদিন অধপতন হয়ে চলেছে, আর আমরা খুব চিন্তিত তাঁর জন্য। আমরা ওকে সাইকিয়েট্রিস্ট দেখিয়েছি, ওষুধ ও দেওয়া হচ্ছে কিন্তু ও কোন কথা না বলা পর্যন্ত বা কোন কিছু প্রকাশ না করা পর্যন্ত ডাক্তার জানিয়েছেন যে মানসিক অবস্থা আরও ভেঙ্গে পড়বে।”
অভি হাঁ করে সবার দিকে চেয়ে থাকে, ওরা সবাই অভিকে এই সব কথা কেন বলছে, কিছুই বুঝতে পারছে না অভি। পুবালির মায়ের গলা ধরে আসে কান্নায়, “অভিমন্যু আমি এক মেয়ে হারিয়েছি, আমার আর শক্তি নেই আরেক মেয়ে হারানর।”
অভি পরীর দিকে তাকায়, ইশারায় জিজ্ঞেস করে যে কি চলছে? পরী ইশারায় উত্তর দেয় যে এসব ওর মাথায় কিছুই ঢুকছে না।
অরুনার মা অভির দিকে তাকিয়ে বলেন, “অভিমন্যু, আমরা সবাই জানি যে তুমি অরুন্ধতিকে ভালোবাসো।”
অরুনার মায়ের কথা যেন অভির বুকে এক শক্তিশেল বানের মতন এসে গেঁথে। কান মাথা গরম হয়ে যায় অভির, ভাবাবেগে চোখ ফেটে জল বেড়িয়ে আসে। চোয়াল শক্ত করে নিজেকে সামলে পরীর দিকে তাকায়। পরী মায়ের চেয়ারে পেছনে দাঁড়িয়েছিল, প্রানপন শক্তি দিয়ে চেয়ারের পেছনটা ধরে থাকে। বুক ফেটে যায় ওর, ওই কথা শুনে।
অরুনার মা, “তুমি যদি আমার মেয়েকে ফিরিয়ে আনতে পার, তাহলে তুমি যা চাইবে তাতে আমাদের কোন আপত্তি থাকবে না।”
অভির পায়ের তলার মাটি যেন সরে গেল, চোয়াল শক্ত করে, চোখ বন্ধ করে বুকের মাঝের উত্তাল তরঙ্গ টাকে শান্ত করার প্রানপন চেষ্টা চালিয়ে গেল। কেউ যেন ওর মাথায় তরল আগুন ঢেলে দিয়েছে, “কি বলছে কাকিমা? এটা কি করে সম্ভব? দুঃস্বপ্নেও এই পাপের কথা ও চিন্তা করেনি। হ্যাঁ, সবার মনের ভেতরে এক ভ্রান্তি ছিল আর সেটা ওরা একদিন কাটিয়ে দেবে তাও ঠিক করেছিল, কিন্তু তাঁর আগেই এই সব?”
ও জানে যে পরী এই কথা শুনে, মরমে মরে যাচ্ছে। চোখ খুলে পরীর দিকে তাকিয়ে দেখে যে পরী নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে প্রাণপণে নিজের মনকে সামলানোর প্রবল চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে পরী, চেহারায় ফুটে উঠেছে এক অব্যাক্ত বেদনার ছাপ, সেই বেদনা ওই ঘরের কেউ টের পেলনা শুধু একমাত্র অভি ছাড়া। পরীর বুকের মধ্যে যেন এক স্টিম ইঞ্জন দউরাচ্ছে যেন, চোখের বাঁধ ভেঙ্গে গেছে। দুঃখে বেদনায় কান নাকের ডগা লাল হয়ে উঠেছে পরীর।
পরী ছাড়া বাকি সবাই অভির উত্তরের প্রতীক্ষায়। অভি সবার মুখের দিকে একবার তাকায়, নিরুপায় আজ বীর অভিমন্যু, জানেনা ওর প্রতিজ্ঞার ফল ওদের জীবন টাকে কোথায় নিয়ে যাবে, কিন্তু অভি সবার মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবে যে কিছু একটা পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, সবার আশা ভরশা এভাবে ভেঙ্গে দেওয়া ঠিক হবে না। অভিমন্যুর অভি বুকের ভেতর থেকে বলে ওঠে, “ভেবে চিন্তে পদক্ষেপ নেবে অভিমন্যু, তোমার ভালোবাসা আর তোমার স্নেহ আজ দুজনের পরীক্ষা, আজ দুজনেই তোমার সামনে হাত পেতে দাঁড়িয়ে।”
হাঁটু গেড়ে অরুনার মায়ের সামনে বসে পরে অভি, অরুনার মায়ের হাত নিজের হাতে নিয়ে বলে, “আমি কথা দিচ্ছি যে আমি তোমার মেয়েকে তোমার কোলে ফিরিয়ে দেব।”
আড় চোখে পরীর দিকে তাকায় অভি। পরীর দুচোখ শক্ত করে বন্ধ, মাথা নিচু। মুখে দেখে মনে হচ্ছে যেন বুক এখুনি ফেটে যাবে। প্রাণপণে চোখের জল আর বুকের অভিব্যাক্তি লুকিয়ে রেখেছে পরী। অভি যেন ঘরের মধ্যে পরীর হৃদয় ভাঙ্গার আওয়াজ শুনতে পায়। সবার চোখে, পরী অরুনার জন্য চোখের জল ঝরাচ্ছে, কিন্তু একমাত্র অভি ওর মনের অবস্থা জানে, কেন পরীর বুকের মধ্যে এই উত্তাল তরঙ্গ আছড়ে পড়ছে। রাগে, দুঃখে বেদনায়, পাথরের মতন দাঁড়িয়ে থাকে পরী।
অভি একবার মাথা নিচু করে মেঝের দিকে দেখে অরুনার মাকে বলে, “আমাকে কথা দাও যে আমি যা চাইব তাই যেন তোমরা মেনে নাও।”
ব্যানারজি কাকু ওর কাছে এসে কাঁধে হাত রেখে বলে, “তুমি যা চাইবে সেটা তুমি পাবে, আমরা সবাই মেনে নেব। আমি আজ সবার সামনে তোমাকে কথা দিচ্ছি।”
সবার সামনে অভি প্রতিজ্ঞা করে দিল কিন্তু জানেনা যে সেই প্রতিজ্ঞার ফলাফল, ওদের দুজনের জীবনকে কোন মোড়ে নিয়ে যাবে। নদী কোন খাতে বইতে চলেছে, কিছুই জানে না, পরীর আর অভির সম্পর্কের কি হবে জানে না, সবকছুই এক বিশাল অনিশ্চয়তার মধ্যে যেন ডুবে গেল। পুবালিকে প্রতিজ্ঞা করেছিল যে সুমদ্রনীল যেন অরুনাকে দেখে, সেই প্রতিজ্ঞা অভি কি করে পূরণ করবে, জানে না।
বাড়ি ফিরে যাবার আগে অভি পুবালির ঘরে যায় অরুনাকে দেখার জন্য। অরুনা এক রকম ভাবে বিছানায় শুয়ে এমন কি পাশ ফিরে দেখেওনি যে কে এল কে গেল। বুক ফেটে কাঁদতে ইচ্ছে করে অভির, কিন্তু সেই ভাঙ্গা বুকের কান্না কেউ শুনতে পায় না।
বাড়ি ফেরার সময়ে সারা রাস্তা কারুর মুখে কোন কথা ছিল না, বাবা মা অভি পরী, সবাই চুপ। সবার মনের মধ্যে এক সংশয়ের দানা বেঁধে উঠেছে, বাবা মায়ের চিন্তা অন্য খাতে। অভির মাথায় অন্য চিন্তা, কি করে পরীর প্রতি ওর ভালোবাসা রক্ষা করবে আর একদিকে ব্যানারজি কাকু দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবে।
বাড়ি ঢুকেই পরী নিজেকে ঘরের মধ্যে বন্ধ করে বিছানায় লুটিয়ে পরে কান্নায় ভেঙ্গে পরে। বাবা মা শুতে চলে যান, অভি নিরুপায় হয়ে কিছুক্ষণ বসার ঘরে বসে থাকে তারপরে ছাদে নিজের ঘরে চলে যায়।
ঘুম আসে না অভির, ছাদের মেঝেতে বসে খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে তারার মিটিমিটি চাহনি দেখতে থাকে। মাথা যেন খালি হয়ে গেছে, কিছুই ভাবার শক্তি নেই যেন। কয়েক দিনে আগে পূর্ণিমা ছিল তাই চাঁদ বেশ বড় দেখাচ্ছিল। সেই চাঁদও যেন ওর কাছে কাঁদছে, আকাশের তারার ঝিকিমিকি যেন ম্লান হয়ে এসেছে ওর বুকের বেদনার সামনে। অভির মনের মধ্যে উদ্দম ঝড় বয়ে চলে, “এ আমি কি করেছি? কি করে আমি আমার প্রতিশ্রুতি আর ভালোবাসা রক্ষা করব?
আমি পরীর কাছে কথা দিয়েছি যে ওকে ছেড়ে আমি যাবো না, ওদিকে পুবালি কেও কথা দিয়েছি যে সমুদ্রনীলের হাতে অরুনার হাত তুলে দেব। আবার ব্যানারজি কাকুর কাছেও প্রতিজ্ঞা করেছি যে অরুনাকে ফিরিয়ে দেব ওদের বুকে। কিন্তু কি করে হবে, একসাথে এত গুলো প্রতিশ্রুতি রক্ষা।”
মাথার নিচে দুহাত ভাঁজ করে ছাদের ওপরে শুয়ে পড়ল অভি। অল্পক্ষণ না অনেকক্ষণ জানে না, ওর চিন্তনের শৃঙ্খলা ভং হয় মৃদু পদক্ষেপের শব্দে। পরী ওর পাশে এসে বসে, জল ভরা ব্যাথা মাখানো চোখ নিয়ে তাকায় অভির মুখের দিকে। কেঁদে কেঁদে পরীর কাজল কালো চোখ দুটি জবা ফুলের মতন লাল হয়ে গেছে।
কাঁপা কাঁপা ঠোঁটে অভিকে জিজ্ঞেস করে, “তুমি ওইরকম একটা কথা দিতে গেলে কেন?”
অভি চুপ, উত্তর দেবার ভাষা নেই অভির কাছে। পরী ওর বুকের ওপরে লুটিয়ে পরে চাপা চেঁচিয়ে ওঠে, “অভি কথা বলো, কেন এই প্রতিজ্ঞা করতে গেলে তুমি? আমার ভালোবাসা কি কিছুই নয় তোমার কাছে? কেন আমার বুক ভেঙ্গে দিলে?”
অভি পরীকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে। পরী মুখ তুলে ওর বেদনা ভরা চোখের দিকে তাকায়, “তুমি কি একটি বারের জন্যেও আমার কথা ভেবে দেখলে না? আমি তোমাকে ছেড়ে কি করে থাকব, অভি?”
অন্ধকার আকাশের মাঝে পুবালির চোখ ভেসে ওঠে। পুবালি নেমে এসে অভির কানে কানে বলে, “তুই আমাকে কথা দিয়েছিলিস আর শুচিদি কেও কথা দিয়েছিলিস। তুই কারুর হৃদয় ভেঙ্গে দিতে পারিস না, অভি। তুই আজ মহাভারতের অভিমন্যুর মতন চক্রবুহ্যের মাঝে পরে গেছিস। কুরুক্ষেত্রর যুদ্ধে মহাভারতের অভিমন্যুর হার হয়েছিল, কিন্তু আমার অভিমন্যু হারতে পারে না। উঠে দাঁরা অভি, যুদ্ধ কর নিজের সাথে আর ততক্ষণ যুদ্ধ কর যতক্ষণ তুই তোর কারযে সফলতা প্রাপ্তি ঘটে।”
অভি পরীর মুখ হাতের মাঝে আঁজলা করে নিয়ে কপালে ছোটো একটা চুমু খায়। পরী অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে অভির মুখের দিকে, বুঝতে চেষ্টা করে যে অভির বুকের ভেতরে কি চলছে।
অভি, “তুমি কি ভেবেছিলে? যে আমি অরুনাকে বিয়ে করব?”
মাথা নাড়ায় পরী, “হ্যাঁ, আমি তোমার কথা শুনে তাই ভেবেছিলাম। তুমি অরুনার মুখ দেখে আর সবার চাপের সামনে মাথা নত করে শেষ পর্যন্ত হয়ত অরুনাকে কাছে টেনে নেবে। আমি জানি যে এক সময়ে অরুনার প্রতি তোমার কিছু দুর্বলতা ছিল।”
অভি, “পরী, আমি তোমাকে আর শুধু তোমাকেই ভালবাসি। তুমি ছাড়া এই বুকে আর কেউ স্থান নিতে পারে না, পরী।”
পরী, “তাহলে তুমি ওই রকম কথা দিলে কেন?”
অভি মৃদু হেসে বলে, “আমার মাথায় এক পরিকল্পনা এসেছে, যাতে করে সবার মন রক্ষা হবে।”
পরী অবাক হয়ে অভির মুখের দিকে চেয়ে থাকে।
অভি বলে, “অরুনাকে নিয়ে বেড়াতে যাবো আমরা, আমাদের সেই পুরানো জায়গায়। একটা নতুন পরিবেশ, নতুন জায়গায় আশা করি অরুনা ভালো হয়ে যাবে। ওকে শুধু ওর চারপাশের চাপা অবস্থা থেকে বের করা দরকার আর একটু স্নেহের ছোঁয়া দরকার যাতে ওর বুকের ভেতরে যে ব্যাথার পাথর জমে আছে সেটা গলে যায়।”
অভির কথা শুনে পরী চোখ বড় বড় করে অভির দিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করে ওর পরবর্তী পদক্ষেপ। অভি বলে, “আমার যতদূর ধারনা যে আমাদের সাথে গেলে ওর মনের অবস্থা ফিরে আসবে। ওকে ফিরিয়ে নিয়ে আসার পরে আমি ব্যানারজি কাকুকে ওর আর সমুদ্রনীলের সম্পর্কের কথা বলব। ব্যানারজি কাকু আমাকে কথা দিয়েছেন যে আমার কথা তিনি শুনবেন, সুতরাং আশা করি তিনি মর্মাহত হবেন না এবং আমার কথা রাখবেন।
এই ভাবে সবার কাছে করা প্রতিজ্ঞা রক্ষা হবে। শুধু একটা কথা, আমাদের সম্পর্কের কথা কাউকে এখুনি জানানো হবে না, কেননা এটা ঠিক সময় নয়। আমার হাতে আরো সময় দরকার পরী, আমাকে চাকরি পেয়ে দাঁড়াতে হবে যাতে আমি বাবা মায়ের সমকক্ষ হয়ে তাদের সম্মুখিন হতে পারি, আর যা আমার নিজের তা আমি দাবি করতে পারি।”
প্রায় একপক্ষ কাল পরে, পরীর মুখে হাসি দেখে অভি অভিভূত হয়ে গেল। এতদিন পরীর মনে শুধু অরুনার জন্য চিন্তা ছিল আর আজ অভির প্রতিজ্ঞা ওকে মৃতপ্রায় করে দিয়েছিল। অভির ঠোঁটের ওপরে আলতো করে ঠোঁট চেপে ধরে বলে, “তুমি কে?”
পরীর মধুঢালা স্বর পুনরায় শুনে অভির মন গলে গেল, ক্ষণিকের জন্যে ওর মনে হয়েছিল যে পরীকে হারিয়ে ফেলছে।
অভি ওর কোমর জড়িয়ে বুকের কাছে টেনে নিল, পরী যেন ওর উষ্ণ ছোঁয়া পেয়ে অভির বুকে গলে গেল। অভি ওর কানে কানে বলে, “মনে আছে একদিন তুমি আমাকে বলেছিলে যে তুমি আমার মন্ত্রী বুদ্ধিদাত্রি। আজ আমি তোমাকে বলছি, যে আমি তোমার মন্ত্রী, তোমার বুদ্ধিদাতা, আমি তোমার কার্ত্তিক, আমি বটবৃক্ষ তোমাকে ছায়া দেবার জন্য আর আগলে রাখার জন্য, আমি তোমার সস্নেহময় পিতা আর রতিক্রিয়ায় আমি কামদেব।”
পরীর চোখ ভাবাবেগে চিকচিক করে ওঠে। অভি ওকে জড়িয়ে ধরে নিজের শরীরের ওপরে টেনে নেয়। একে ওপরের আলিঙ্গন বদ্ধ হয়ে খোলা আকাশের নিচে শুয়ে থাকে। ওদের নিবিড় প্রেমালিঙ্গনের সাক্ষী হয় আকাশের চাঁদ আর ঝকমকে তারা।
একটু চিন্তা করার পরে অভি বলল, “কিন্তু এর মধ্যে একটা সমস্যা আছে, পরী।”
পরী, “কি সমস্যা আবার উদয় হল?”
অভি, “আমি অরুনাকে নিয়ে বেড়াতে যাব সেটা ঠিক আছে কিন্তু আমাদের সাথে যদি তুমি যাও তাহলে তোমার সন্দেহ বাতিক ছোটো মায়ের মনে সন্দেহের উদ্রেক হবে আর তোমাকে বাড়িতে আটকে রাখবে। সেই সমস্যার একটা সমাধান আছে আমার কাছে, তুমি কল্যাণী আর রানীকে ফোন করে বল, আমাদের সাথে ঘুরতে যেতে। তারপরে তুমি তোমার ছোটো মাকে জানাও যে তুমি রানী আর কল্যাণীদের সাথে হিমাচল প্রদেশ ঘুরতে যেতে চাও এবং সাথে অরুনাকে নিয়ে যেতে চাও।
তাহলে তোমার ছোটমা তোমাকে বারন করবে না এবং ব্যানারজি কাকুও তোমাকে বারন করবে না কারন তিনি জানেন যে তুমি অরুনাকে খুব স্নেহ করো। যখন অরুনা তোমার সাথে যাবে তখন সবাই আমাকেও তোমাদের সাথে যেতে বলবে, ব্যাস সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।”
নাকের ওপরে নাক ঘষে পরী মৃদুকনে বলে ওঠে, “আমি যে তোমাকে কত ভালবাসি বলে বুঝাতে পারব না অভি…”
অভি দেখল যে পরী হয়ত ভাবাবেগে এখুনি চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করে দেবে তাই ঝট করে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ওর ভাবাবেগ প্রেমের আবেশে বদলে দেয়। কিছু পরে নিজেকে অভির ঠোঁট থেকে মুক্ত করে লাজুক হেসে বলে, “তুমি না খুব শয়তান ছেলে।”
মাথা হেলায় অভি, “উম্মম হানি, আমি তোমার বুদ্ধিদাতা মন্ত্রী।”
মাথা নাড়িয়ে অভির সারা মুখে চুলের পরশ ছড়িয়ে দেয় পরী। মখমলের মতন চুলের পরশে প্রেমাবেগে চেপে ধরে পরীকে নিজের বুকের কাছে। পরীর কোমল বুক জোড়া অভির নগ্ন বুকের ওপরে পিষ্ট হয়ে যায়। পরীর কোমল পিঠের ওপরে হাত বুলাতে শুরু করে দেয় অভি, শিরদাঁড়ার ওপর দিয়ে নখের আলতো আঁচর কেটে দেয় মাঝে মাঝে। ওর ছোটো নরম গোল পেট অভির নগ্ন পেটের ওপরে মাখনের মতন লেপে যায়।
দুজানু জোড়া করে অভির জানুর ওপরে রেখে দেয় পরী। অভি ধিরে ধিরে হাত নিয়ে যায় সুগোল নিতম্বের ওপরে, আলতো করে চেপে ধরে কোমল নারী মাংস। উত্তপ্ত হাতের চাপে পরীর বুকের মাঝে কামনার আগুন জ্বলে ওঠে, শরীর গরম হয়ে ওঠে প্রেমের নিবিড় আলিঙ্গন পাশে।
তপ্ত নিঃশ্বাসে অভির মুখ ঝলসে যায় প্রায়, পরী মাথা নিচু করে অভির কাঁধে মুখ গুঁজে দিয়ে ঘাড়ে কানে চুমু দিতে থাকে। গালে গাল ঘষে বারবার। মৃদু ঘর্ষণের ফলে দুই শরীরে আগুনের ফুল্কি ছিটকে যায়। অভির বুকে কামনার উত্তাল তরঙ্গ দোল খায়, প্রেয়সীর কাছে আত্মসমর্পণ করার জন্য তৎপর হয়ে ওঠে। বাম হাতে পরীর মাথার চুল মুঠি করে ধরে মাঝে মাঝে আঁচরে দেয়। বুকে যেন কামনার বিশাল ঝড় শুরু হয়ে যায়।
অভি দুই পা একটু ফাঁক করে দেয়, পরীর জানু অভির মেলে ধরা পায়ের ফাঁকে গলে যায় আর অভি চেপে ধরে পরীর শরীর। প্রেমের আলিঙ্গনে এতই বিভোর দুই কপোত কপোতী যে ওরা ভুলেই গেছে যে ওরা তখন খোলা আকাশের নিচে।
গ্রীষ্ম কালের মৃদুমন্দ বাতাস ওদের বুকের আগুন যেন আরও জ্বালিয়ে তোলে। মিলে মিশে একাকার হয়ে থাকে দুই শরীর।
অভি ওর কানে কানে বলে, “বেবি…”
পরী ফিসফিস করে বলে, “ম্মম্মম্মম…… কি হল”
অভি ওর সুগোল নরম নিতম্ব চেপে ধরে বলে, “আমারা কি সেলিব্রেট করব?”
নিতম্ব চেপে ধরে পরীর নিম্নাঙ্গ টেনে ধরে নিজের তপ্ত কঠিন সিংহের ওপরে। পরী নিজের নিচে অভির তপ্ত শলাকার স্পর্শ পেয়ে মোচর দেয়। শরীরের মোচরের ফলে বারে বারে অভির সিংহ গিয়ে ধাক্কা মারে পরীর নারীত্বের দোরগোরায়। পরীর বক্ষোপরি তপ্ত নুড়ি অভির নগ্ন বুকে আঁচর কাটতে থাকে, পুড়িয়ে দেয় যেন অভির ত্বক। অভি থাকতে না পেরে চেপে ধরে ওর পুরুষ সিংহটিকে পরীর ঢাকা নারীত্বের দোরগোড়ায়। পরী মৃদুসুরে ককিয়ে ওঠে। প্রেমের দুধ সাগরে ডুব দেবার প্রস্তুতি আসন্ন। অভির মোচর আর চাপের ফলে পরী সিক্ত হয়ে ওঠে, কিছু টা ঘামে কিছুটা প্রেমে।
অভি আবার জিজ্ঞেস করে, “সোনা, আমার এবারে সেলিব্রেট করি?”
পরী ওর কাঁধ থেকে মাথা না উঠিয়ে কানে কানে বলে, “এত কিছু করে, আমার ভেতরে আগুন জ্বালানর পরেও তুমি জিজ্ঞেস করবে, শয়তান ছেলে।”
অভি দুষ্টুমি করে বলে, “ভদ্রলোকেরা সবসময়ে জানান দিয়ে ঘরে ঢোকে সোনা, আর তুমি ত আমার স্বর্গের অপ্সরা, তোমাকে না জানিয়ে কি করে…”
পরী, “উম্মম… কত আমার ভদ্রলোক। কিন্তু খোলা আকাশের নিচে নয়।”
অভি, “আমাদের কেউ দেখতে পাবে না বেবি।”
পরী, “শয়তান ছেলে, আমার কি লজ্জা করে না নাকি। এই রকম খোলা জায়গায় কি মানুষে এসব… ধুত তুমি না…”
পরী মাথা তুলে তাকায় অভির বাসনা তারিত চোখের দিকে। চিবুকের ওপরে চিবুক রাখে পরী, আলতো করে জিব বের করে চেটে দেয় অভির ঠোঁট। আধবোজা ঠোঁটের ভেতর থেকে উষ্ণ নিঃশ্বাস স্নান করিয়ে দেয় অভির সারা মুখ।
অভি সিনহটিকে মোচর দিয়ে পরীর জানুসন্ধিতে পিষে দিয়ে বলে, “আমি আর থাকতে পারছিনা বেবি। আমাকে তুমি তোমার আলিঙ্গন থেকে অনেক দিন হতে বঞ্চিত করে রেখেছ। আমার ভেতরে বাঁধ আজ যেন ভেঙ্গে যাবে তোমার কোমল ছোঁয়ায়, তোমাকে আমার সাথে মিলিয়ে নেব আজ এই রাতে।”
অভির হাত নিচে নেমে যায়, পরীর গায়ের কাপড় ধিরে ধিরে টেনে উঠাতে শুরু করে। গ্রীষ্মের মৃদু বাতাস পরীর নগ্ন পায়ের গুলির ওপরে বয়ে যায়। আরও ওপরে টানে পরীর রাত্রিবাস, জানুর মাঝে মৃদু বাতাস ছুঁয়ে যায়।
পরী চাপা চেঁচিয়ে ওঠে, “শয়তান ছেলে… এখানে নয়।”
অভি ওকে জড়িয়ে ধরে ঘুরে যেতে চেষ্টা করে, কিন্তু পরী সর্ব শক্তি দিয়ে অভিকে ছাদের মেঝের সাথে চেপে ধরে থাকে। পরী মৃদু সুরে বলে, “তুমি যদি আমার সাথে এই খোলা আকাশের নিচে… তাহলে কিন্তু আমি তোমার সাথে কোনদিন কথা বলব না।”
আস্তে করে পরীকে জড়িয়ে ধরে উঠে পরে অভি, পরী ক্ষণিকের জন্যেও অভির গলা ছারেনা। পরীকে কোলের ওপরে উঠিয়ে নিজের ঘরের মধ্যে ঢুকে বিছানায় শুইয়ে দেয়।
আলো জালাবার জন্য হাত বাড়ায় অভি, পরী চেঁচিয়ে ওঠে, “একদম আলো জ্বালাবে না কিন্তু।”
অভি, “কেন কি হল? আমি আমার পরীকে একবার পুরোপুরি দেখতে চাই।”
বিছানার চাদরে নিজেকে আস্টেপিস্টে জড়িয়ে নেয় পরী, ঠিক যেন মিশরের মমির মতন দেখায় ওকে। দুষ্টু হেসে পরী অভির দিকে তাকিয়ে বলে, “হ্যাঁ এবারে আলো জ্বালাতে পার তুমি, আমি এই বিছানার চাদর গা থেকে নামাব না।”
দু’চোখ প্রেমের আবেগে চিকচিক করে ওঠে, ঠোঁটে লেগে কামনার তপ্ত আগুন। অভির সারা শরীরে ঘাম দেয়, সিংহ মাথা উঁচু করে নিজের জানান দেয়, বারে বারে ভেতর থেকে গর্জে ওঠে। গালের টোল যেন উত্তপ্ত লাভার ছোঁয়া পেয়ে লাল হয়ে উঠেছে।
অভি আলো জ্বালিয়ে পরীর দিকে এগিয়ে যায়, “তুমি তাহলে আমার সাথে খেলা করতে চাও, দুষ্টু মেয়ে।”
অভি ওর পায়ের দিক থেকে বারে বারে চাদর টেনে নিতে চেষ্টা করে আর বারে বারে পরী পা ছুঁড়ে ওকে আটকে দিতে চেষ্টা করে। অভি বিছানার ওপরে চরে যায় আর পরী ঘুরে শুয়ে পরাতে গায়ের থেকে চাদর সরে যায়। সুযোগ বুঝে শয়তানি করে পরীর কাপড় জানু ওপরে উঠিয়ে দেয়, পেলব মসৃণ জানুর ওপরে অভির উত্তপ্ত চোখের চাহনি যেন ফোস্কা ফেলে দিতে থাকে।
সঙ্গে সঙ্গে পা ঢেকে দিয়ে খিলখিল করে হেসে ওঠে পরী। অভি আর থাকতে পারেনা আর শেষ পর্যন্ত ঝাঁপিয়ে পরে প্রেয়সীর ওপরে, পরী সঙ্গে সঙ্গে হাত বাড়িয়ে আলো নিভিয়ে দেয় আর সারা ঘর অন্ধকারে ঢেকে যায়। জানালা দিয়ে চাঁদের নির্মল আলো ওদের বিছানার ওপরে খেলা করে ওদের উষ্ণ শরীর স্নান করিয়ে দেয়।
ঘামে নাকের ডগা চাঁদের আলোয় চিকচিক করে, পরীর মুখ দেখে অভি নিজেকে আর দুরে সরিয়ে রাখতে পারে না। ওর ওপরে উঠে গিয়ে, দেহের দুপাসে হাত রেখে শরীরের নিচের অংশ পরীর ওপরে চেপে ধরে। পরীও শয়তানি করে জানু চেপে ধরে যাতে অভি ওর পায়ের ফাঁকে নিজেকে নিয়ে যেতে না পারে। অভি ঝুঁকে পরে পরীর মুখের ওপরে, পরীর দু হাত উঠে আসে অভির কাঁধের ওপরে আর ওর মাথা টেনে নিচে নামিয়ে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরে।
ঠোঁটের মধুতে ভরিয়ে দেয় অভি পরীর সারা মুখ, জিবের ডগা ঢুকিয়ে দাঁতের পাটির ওপরে আলতো করে বুলিয়ে দেয়। পরী আর যেন নিজেকে দুরে সরিয়ে রাখতে পারেনা অভি কামাগ্নির পরশ থেকে, ধিরে ধিরে জানু মেলে ধরে আহবান জানায় অভিকে। অভি নিম্নাগ চেপে ধরে পরীর নারীসুখের ওপরে। চুম্বন টিকে না থামিয়ে পরী চাদর টেনে দেয় ওদের গায়ের ওপরে। ওর যে ভীষণ লজ্জা। একে ওপরকে বাহু পাশে বেঁধে ফেলে ওরা।
শরীরের যত রমকুপ ছিল সবকটা উন্মুক্ত হয়ে ওঠে প্রেমের আগুনে, ধিরে ধিরে একে ওপরের হাত ধরে সুখের সাগরে ডুব দেয়। প্রেমের সেই সুন্দর স্বর্গ উদ্যানে ঘুরে বেড়ায়। রতিক্রীড়া শেষে অভির মনে একটা বেদনা থেকেই যায় যে প্রেয়সীর সম্পূর্ণ রুপ দর্শন সে আজও মন ভরে দেখতে পারল না।
লাহুল স্পিতি ভ্রমন (#01)
অভির সুকৌশল পরিকল্পনা অনুযায়ী, ওরা দুজনে একদম মেপে মেপে পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়। সর্বপ্রথম পরী কল্যাণী আর রানী কে ফোন করে পরিকল্পনার কথা জানায়। ওদের যে হেতু এখন কোন সন্তান নেই তাই ওরা সব শুনে পরীদের সাথে যেতে রাজি হয়। তারপরে পরী ব্যানারজি কাকুকে বাড়িতে ডাকে। ইচ্ছে করেই অভি সেই দিন বাড়িতে থাকে না। পরী, ব্যানারজি কাকুকে বুঝিয়ে রাজি করে যে ও অরুনাকে নিয়ে ঘুরতে যেতে চায়, যাতে অরুনার মনের পরিবর্তন হয়।
বাবা মা ওর কথায় খুব খুশি হয়ে মত দেন। অভি বাড়ি ফেরার পরে বাবা ওকে সব ঘটনা জানিয়ে বলেন যে মেয়েদের সাথে যেতে, যেহেতু বাড়ির কেউ পরীর বান্ধবীদের ভাল ভাবে চিনত না। সবকিছু অভির আর পরীর সুকৌশল পরিকল্পনার মতন হতে থাকে।
অভি ঠিক করে যে এবারে ও আরও দুরে যাবে। পুরো লাহুল স্পিতি উপত্যকা ঘুরবে, পরীকে নিজের অভিপ্রায় জানাতে পরী খুশিতে নেচে ওঠে। সবকিছু ঠিক হয়, যাবার দিন ঠিক হল যে ওরা জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের শুরুতে বেড়িয়ে পড়বে। পুর ট্রিপ করতে প্রায় চোদ্দ দিনের মতন লেগে যাবে। যাবার আগে অভি ভালো করে সেই জায়গার বিষয়ে পড়াশুনা শুরু করে দেয়, কোথায় কি ভাবে যাবে, কোথায় থাকবে সব খুটিনাটি তথ্য যোগাড় করে ফেলে।
পরীকে পুরো ঘোরার রাস্তা এবং সব কিছু তথ্য জানায়। ওরা নিউ দিল্লী থেকে কাল্কা হয়ে সারাহান, রেকংপিও হয়ে সোজা নাকো চলে যাবে। তারপরে নাকো থেকে এবারে আগে যাবে ওরা, তাবো, কাজা হয়ে কুনযুম পাস। তারপর রহতাং পাস হয়ে মানালি ঢুকে, মান্ডি হয়ে দিল্লী ফিরবে। পরীকে ভালো করে বুঝিয়ে দেয় ভ্রমণের পরিকল্পনা যাতে ও দিপঙ্কর কে বুঝিয়ে বলতে পারে। কেননা, অভির বাবা মা দিপঙ্করকে জিজ্ঞেস করবে যে ওরা কোথায় যাচ্ছে এবং সেই জায়গার সম্বন্ধে আরও তথ্য জিজ্ঞেস করতে পারে।
লোকজনকে কথা বুঝানোর ক্ষেত্রে পরী খুব পটু তাই দিপঙ্করকে বুঝিয়ে উঠতে ওর বেগ পেতে হল না, এবং সাথে সাতে ছোটো মাকেও হাতের মুঠিতে করে নিল।
ওদিকে অরুনার স্বাস্থ্য কিছুটা উন্নতি হয়েছে, কিন্তু মনের ভাব সেই এক, কেউ ওকে কথা বলাতে পারল না বা পুবালির ঘর থেকে বের করতে পারলনা। ব্যানারজি কাকু যখন ওকে জানালেন যে পরী ওকে নিয়ে ঘুরতে যেতে চায় তখন শুধু মাত্র মাথা নাড়িয়ে সায় দেয় অরুনা। সেই ভাবলেশ হীন অভিব্যাক্তি দেখে পরীর হৃদয় কেঁদে ওঠে।
অভি ওর পুরানো বন্ধু সুপ্রতিমদা কে ফোন করে, “এই সুপ্রতিমদা কেমন আছিস?”
সুপ্রতিমদা, “কিরে শয়তান, এত দিন পরে মনে পড়ল। তুই শালা কাজ না থাকলে মনে করিস না। বল এবারে আবার কাকে নিয়ে কোথায় প্লান করেছিস। শালা এবারে যদি দিল্লী এসে উড়ে পালিয়ে যাস তাহলে তোকে আর আস্ত রাখবো না।”
অভি, “নারে ভাই, এত রেগে যাস না। এবারে আমরা সাত জনের একটা গ্রুপ সেই হিমাচলে ঘুরতে যাব ভাবছি। তাই তোকে ফোন করে জানালাম। তুই আমাদের জন্য একটা ছোটো বাসের যোগাড় করে দিতে পারিস? এবারে কারন একটু অন্য ধরনের, এবারে আমি আমার এক বন্ধুকে নিয়ে যাচ্ছি আর তার অবস্থা আমি তোকে পরে জানাব।” অভি সুপ্রতিমদাকে অরুনার পুরো ঘটনা জানাতে, ও রাজি হয়ে যায়।
শেষ পর্যন্ত ঠিক হয় যে অরুনা, অভি আর পরী প্লেনে করে দিল্লী পৌঁছাবে আর দিপঙ্কর, কল্যাণীরা রাজধানি এক্সপ্রেসে করে দিল্লী পৌঁছে যাবে।
সুপ্রতিমদা দিন তিনেক পরে অভিকে ফোন করে, “শোন ভাই, আরও দুজন যদি তোদের সাথে যেতে চায় তাহলে কি নিবি?”
অভি জিজ্ঞেস করে, “কে কে যাবে?”
সুপ্রতিমদা হেসে উত্তর দেয়, “আমি আর আমার বান্ধবী।”
সুপ্রতিমদার কথা শুনে অভি অবাক, যে ছেলে শুধু চরে খেত আজ সে ছেলের মুখে অন্য কথা, “তুই জাবি আর আমি না করতে পারি নাকি। তা শেষ পর্যন্ত তুই টেস্ট ম্যাচ খেলার পিচ পেয়েই গেলি বল। তোর বউ কি দেখতে সেক্সি রে?”
সুপ্রতিমদা, “শালা নিজের একটা ব্যাটিং পিচ আছে না সেখানে গিয়ে ব্যাটিং কর না, আমার পিচের কথা তোর জেনে কি হবে।”
অভি, “রেগে যাচ্ছিস কেন রে তুই।”
সুপ্রতিমদা, “আচ্ছা শোন এবারে, আমি একটা ইনোভা ঠিক করেছি আর আমার ত টাটা সাফারি আছে। আমাদের কাছে তাহলে দু দুটো ড্রাইভার থাকবে, আর আমার ড্রাইভার বল্বিন্দারকে ত তুই আগে থেকে চিনিস। এবারে আমি ভাবছি কি যে আমি আর তুই আমার টাটা সাফারিতে আমাদের বউ নিয়ে যাব, বাকিরা ইনোভাতে যাবে।
তুই ড্রাইভ করতে জানিস আমিও জানি সুতরাং গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যেতে বিশেষ অসুবিধে হবে না। আর তুই যে সব জায়গার কথা আমাকে শুনালি সেসব জায়গায় আমি কোনদিন যাইনি, রিতিকা ত সব কথা শুনে খুব খুশি। তোর বউয়ের সাথে আমার বউয়ের দেখা হয়ে যাবে।”
অভি, “হুম্মম্ম… তাহলে তোর বউয়ের নাম রিতিকা, বেশ মিষ্টি নাম রে। তা তওর মনের মতন ত?”
সুপ্রতিমদা, “বোকা… এসে দেখে যা একবার। আর শালা একবার যদি কিছু কমেন্ট মেরেছিস রিতিকাকে দেখে তাহলে তোর টা কেটে তোর হাতে ধরিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেব।”
অভি, “গুরু বিয়ে হয়নি আর এখন থেকেই এত আগলে রাখছিস।”
সুপ্রতিমদা, “বোকা… ছাড় অসব কথা, এবারে বল কবে দিল্লী আসছিস।”
অভি, “পরের রবিবার, সকালের ফ্লাইট, ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্স আই.সি.264।”
যাবার দিন কাছে চলে আসে। ব্যাগ গুছানোর পালা প্রায় শেষ। ব্যাগে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ছাড়া গরম জামাকাপড় নেওয়া হয়। যে জায়গায় যাচ্ছে সেখানে ঠাণ্ডা ভীষণ। অভি পরীকে জিন্স নিতে বলে, পরী প্রথম প্রথম নারাজ হয়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত অভির কারত মিনতির সামনে হেরে যায়। এরই মাঝে পরী অরুনার বাড়ি গিয়ে ওর ব্যাগ গুছিয়ে দিয়ে আসে, অরুনার মানসিক অবস্থার কনো পরিবর্তন হয় না।
অরুনা যেমন চুপ ছিল সেইরকমই আছে, আর সেটাই সবার চিন্তার বিষয়। ব্যানারজি কাকু পরীর ব্যাবহারে ভীষণ খুশি। পরী জানতে চায় যে অভি কি করে অরুনার মানসিক সাস্থ্যের উন্নতি করাবে, অভির কাছে উত্তর দেবার মতন কোনো পরিকল্পনা থাকে না, শুধু এই টুকু জানায় যে কিছু একটা হয়ে যাবে, হয়ত নতুন জায়গায় গিয়ে বা অচেনা মানুষদের সাথে মিশে অরুনার মানসিক পরিবর্তন ঘটতে পারে বলে অভির ধারনা।
কল্যাণী দীপঙ্কর রা একদিন আগেই ট্রেনে চেপে দিল্লীর উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যায়।
বাবা আর ব্যানারজি কাকু অনেক চেষ্টা চরিত্র করে প্লেনের টিকিট এক্সিকিউটিভ ক্লাসে কাটে। যাবার দিন বাড়ির সবাই এয়ারপোর্টে ওদের ছাড়তে এসেছিলেন। অরুনা নিজের খেয়ালেই ছিল, পাথরের পুতুলের মতন নড়াচড়া করছিল। অরুনার মা আর অভির মা দুজনের চোখে জল এসে গেছিল অরুনার অবস্থা দেখে। ব্যানারজি কাকু অভিকে আবার মনে করিয়ে দেন ওর প্রতিজ্ঞার কথা, এবারে অভি হেসে জানায় যে ও ওর কথা রাখবে, এবং অরুনাকে ঠিক করেই ফিরিয়ে নিয়ে আসবে।
প্লেনে অরুনা আর পরী পাশাপাশি বসে, করিডোরের অন্য দিকে অভি। অরুনা জানালার ধারের সিটে বসে হাতের ওপরে মাথা রেখে একমনে জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকে। পরী একটা সুন্দর সবুজ রঙের সালোয়ার পড়েছিল। পরী প্রথম বার প্লেনে চাপে কিন্তু সেই উৎসাহ ছাপিয়ে ওর মনের ভেতরে অরুনার চিন্তা বেশি করে ভর করে। সকালের খাবার দিয়ে যায় এয়ারহোস্টেস, পরী খাবারের বহর দেখে অভির দিকে তাকায়। অভি ওকে জানায় যে ও এক্সিকিউটিভ ক্লাসে ভ্রমন করছে।
পরী অরুনার দিকে তাকায়, অরুনা ভাবলেশহীন চোখে জানালার বাইরে তাকিয়ে মেঘ দেখতে থাকে। পরী ওর কাঁধ ছুঁয়ে আলতো করে নারা দিতে, অরুনা পরীর দিকে খালি চোখ নিয়ে তাকায়। সেই চোখের চাহনি দেখে পরীর আত্মা যেন ককিয়ে কেঁদে ওঠে। পরী পাউরুটির এক টুকরো ছিঁড়ে তাতে মাখন লাগিয়ে ওর ঠোঁটের কাছে ধরে। অরুনা একটু খানি মুখ খুলে মুখের মধ্যে পাউরুটির টুকরো নিয়ে নেয়। পরী ওর চোখের দিকে তাকিয়ে কোনোরকমে চোখের জল সংবরণ করে আরও একটা টুকরো খাওয়াতে যায়।
অরুনার ঠোঁট কেঁপে ওঠে, “শুচিদি, ঠাণ্ডা লাগছে।”
অরুনার ঠোঁটের ওই তিনটি শব্ধ যেন অভির আর পরীর কানে মধুর মতন মনে হয়। পরী নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে মমতাময়ী হৃদয়ের খুশির জল চেপে রাখে। জল ভরা চোখ নিয়ে একবার অভির দিকে তাকায়। অভির দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে, এয়ারহোস্টেস কে অনুরধ করে একটা কম্বলের ব্যাবস্থা করে। পরী দুই সিটের মাঝের হাতল উঠিয়ে দিয়ে, অরুনার মাথা নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে। পরীর মমতাময়ী স্পর্শে অরুনার চোখে জল চলে আসে।
দুহাতে পরীকে জড়িয়ে ধরে বলে, “শুচিদি আমার খুব ঠাণ্ডা লাগছে।”
পরী ওর গালে হাত রেখে সান্তনা দিয়ে বলে, “অরুনা আমি তোর কাছে আছি। তোর আর ঠাণ্ডা লাগবে না।”
এয়ারহোস্টেস কম্বল দিয়ে গেলে, অভি অরুনার গায়ে কম্বল জড়িয়ে দেয়। পরী ওকে জড়িয়ে ধরে ওর মাথা নিজের বুকের ওপরে চেপে ধরে। অরুনা পরীর বুকে মাথা গুঁজে ফুফিয়ে ওঠে, বুকের মাঝের অন্তহীন বেদনা দুগাল বেয়ে বয়ে চলে অবিরাম ধারায়। ওর চোখের জলে পরীর বুক ভিজে যায়, কিন্তু একবারের জন্যেও পরী ওকে কাছছাড়া করে না।
পরী অভির দিকে তাকিয়ে বলে, “তুমি খেয়ে নাও।”
অভি বলে, “ওকে কিছু বলো?”
পরী, “না, ওকে কাঁদতে দাও। ওর ভেতরের সব জমানো ব্যাথা সব দুঃখ চোখের জল হয়ে বেড়িয়ে যাক। তাতে ওর মন অনেক হালকা হবে। যে অরুন্ধতি দিল্লী পৌঁছাবে সেই অরুন্ধতি অনেক বদলে যাবে কোলকাতার অরুন্ধতির থেকে।”
অরুনা কেঁদে কেঁদে শেষ পর্যন্ত পরীর কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পরে। পরী ওর ঘুমন্ত মাথা কোলের ওপরে নিয়ে আস্তে আস্তে মাথা গালে হাত বুলিয়ে দেয়। অরুনা পরীর কোলে ঠিক একটা বাচ্চা মেয়ের মতন ঘুমিয়ে থাকে, চেহারায় এক অনাবিল শান্তির ছায়া।
প্লেন ধাক্কা মেরে দিল্লী এয়ারপোর্টে নামে। ঝাঁকুনির জন্য অরুনার ঘুম ভেঙ্গে যায় আর পরীর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসি দেয়। পরী ওর মুখখানি আঁজলা করে নিয়ে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে আবেগে প্রায় চোখে জল চলে আসে। আঙ্গুল দিয়ে অরুনার গালে জলের দাগ মুছিয়ে দিয়ে কপালে ছোটো একটা চুমু খায়। প্লেন থামলে ব্যাগ হাতে নিয়ে নামার উদ্যোগ করে অভি, পেছনে অরুনা আর পরী।
অরুনা অভির কাঁধ আলতো করে ছোঁয়, অভি পেছন দিকে তাকায়। অরুনার ঠোঁট মৃদু কেঁপে ওঠে, “এই বিহারী আমরা কোথায় যাচ্ছি রে?”
শেষ পর্যন্ত অভির অনুপম দেবী প্রতিমা কথা বলল। অভির বুকের বাঁধ ভেঙ্গে গেল ওর গলার আওয়াজ শুনে। ওর মনে হল যেন হারিয়ে যাওয়া বহুমুল্যবান রত্ন আবার ফিরে পেয়েছে। অরুনার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে মাথার ওপরে চুমু খায়। অভিকে শান্তনা দেবার জন্য পরী আলতো করে পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়।
অরুনার ঠোঁটে আবার হাসি দেখে পরী আর অভি যেন স্বস্তির শ্বাস নেয়। পরীকে পেয়ে অরুনা যেন সেই পুরানো দিন ফিরে পেল। দুজনেই মেতে ওঠে গল্পে, অভি বিশেষ কান দেয় না মেয়েদের গল্পে। পরীকে বলল যে বাড়িতে ফোন করে জানিয়ে দিরে যে ওরা দিল্লী ঠিক ভাবে পৌঁছে গেছে। পরী জিজ্ঞেস করে যে ব্যানারজি কাকু যদি ওর কথা জিজ্ঞেস করে ত কি উত্তর দেবে পরী, সেই শুনে অভি বলল যে ব্যানারজি কাকু কে বলে দিতে যে ও পরে বাড়িতে ফোন করবে।
অভি চলে গেল কনভেয়র বেল্ট থেকে বাকি ব্যাগ নিতে, আর পরী আর অরুনা চলে গেল ফোন করার জন্য। বারবার মাথা ঘুরিয়ে অভি ওদের দিকে লক্ষ্য রাখে যাতে কোথাও হারিয়ে না যায়। অরুনার জন্য এটা প্রথম বার নয় যে ও দিল্লী এসেছে, কিন্তু অরুনার মানসিক অবস্থা এখন সেই পুরান অবস্থায় নেই ও এখন পরীর ওপরে নির্ভর।
ব্যাগ নিয়ে তৈরি অভি, কিছু পরে পরী আর অরুনা ফোন সেরে ওর কাছে চলে আসে। অভি জিজ্ঞেস করাতে পরী জানায় যে ও দুই বাড়িতে ফোন করে সব জানিয়ে দিয়েছে। বাড়ির সবাই খুব খুশি যে অরুনা আবার কথা বলছে। অরুনা পরীর হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকে আর অভির দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি করে হাসে।
অভি অরুনাকে জিজ্ঞেস করে, “কাকুর সাথে কথা বলেছিস?”
অরুনা ওকে হেসে উত্তর দেয়, “জানিনা তুই বাবা মা কে কি বলছিস, কিন্তু আমার কথা শুনে ওরা খুব খুশি। শুচিদি ও মায়ের সাথে কথা বলেছে, সবাই তোর কথা খুব জিজ্ঞেস করছিল।”
অভি, “ঠিক আছে, এবারে চল। এতক্ষণে হয়ত রাজধানি এক্সপ্রেস দিল্লী পৌঁছে গেছে আর সুপ্রতিমদাও হয়ত আমাদের জন্য বাইরে অপেক্ষা করছে।”
বাইরের দিকে হাঁটতে শুরু করে ওরা। অরুনা পরীকে জিজ্ঞেস করাতে, পরী ওকে পুরো ঘটনার বিবরন দেয় যে কি ভাবে অভির সুকৌশল পরিকল্পনায় এই সব সম্ভব হয়েছে। সব কথা শুনে অরুনা অবাক হয়ে যায়।
অরুনা অভির কাছে এসে চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করে, “তুই আমার জন্য এত সব করেছিস?”
অভি হেসে ফেলে, ওর মাথায় ছোট্ট চাঁটি মেরে উত্তর দেয়, “ধুর তোর জন্য করতে যাবো কেন আমি। আমি তিন জনের কাছে তিনটে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, সেই প্রতিজ্ঞা রক্ষা করার জন্য এই সব পরিকল্পনা।”
পরী ঠোঁট জোড়া ছোটো গোল করে অভির দিকে একটা চুম্বন ছুঁড়ে দেয়। অরুনা তর্জনী দিয়ে চোখের কোল মুছে পরীর হাত জড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ক্ষণিকের জন্যেও যেন ও পরীকে কাছ ছাড়া করতে চায় না।
ওরা বাইরে বেড়িয়ে দেখল যে সুপ্রতিমদা একজন সুন্দরী মেয়ের সাথে দাঁড়িয়ে, ওদের জন্য গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে। মেয়েটির বেশ সুন্দরী দেখতে, পরনে সাদা জিন্স আর বাদামি রঙের টপ, গায়ের সাথে এটে আসে পরনের পোশাক। শরীরের প্রতিটি বাঁক পোশাকের নিচে ভালোভাবে ফুটে উঠেছে। চুল ঘাড় পর্যন্ত, মাথার পেছনে বাঁধা একটা ছোট্ট পনি টেলের মতন।
চোখ মুখ বেশ মিষ্টি, কালো কালো চোখ দুটি একটু ছোটো, পরীর মতন অচ বড় নয় কিন্তু বেশ চঞ্চল। অভি দেখে মৃদু হেসে দেয়, এটা হয়ত দিল্লীর ফ্যাসান। অভি একবার পরী আর মেয়েটিকে মনে মনে তুলনা করে কে বেশি সুন্দরী, কিন্তু অভির মনের ভেতরে পরীর বাস, তাই আর বেশি কিছু ভাবতে পারল না অভি।
সুপ্রতিমদা ওদের কে দেখে অভির দিকে এগিয়ে এসে হাত মেলায়। পরী আর অরুনা উৎসুক চোখে সুপ্রতিমদাকে দেখে। সুপ্রতিমদা অভির পাশে দুটি মেয়ে কে দেখে বিভ্রান্ত হয়ে জিজ্ঞেস করে, “এর মধ্যে কে শুচিস্মিতা?”
পরী আর অরুনা দুজনেই ওর প্রশ্ন শুনে হেসে ফেল। অভি হেসে কিছু উত্তর না দিয়ে সুন্দরী মেয়েটার দিকে এগিয়ে গিয়ে নিজের পরিচয় দেয়, “আমি অভিমন্যু তালুকদার আর তুমি নিশ্চয় রিতিকা চতুর্বেদী।”
রিতিকা হেসে বলে, “হ্যাঁ আমি জানি তোমাদের কথা। আমি ওর কাছে থেকে তোমাদের হস্টেলের কথা অনেক শুনেছি। গত বার তুমি দিল্লী এসেই পালিয়ে গেলে দেখা না করে। ও আমাকে বলেছে যে তুমি নাকি তোমার বান্ধবীকে নিয়ে একা একা কোন এক দুর্গম পাহাড়ি জায়গায় বেড়াতে গেছিলে। হুম তুমি শুধু মাত্র সাহসী বললে ভুল হবে তুমি দুঃসাহসী ছেলে। এবারে বলত এদের মধ্যে কে শুচিস্মিতা?”
অভি পরীদের দিকে হেসে রিতিকাকে উত্তর দেয়, “আন্দাজ করো, তবে তোমার কাছে একটাই সুযোগ।”
রিতিকা পরীকে দেখিয়ে বলে অভির দিকে হেসে বলে, “ওই যে সবুজ রঙের সালোয়ার পরে আছে সেই শুচিস্মিতা।”
রিতিকা এগিয়ে যায় পরীর দিকে। তিন জনে মেয়ে এসে অপরকে সংবর্ধনা জানিয়ে মিশে যায়। মেয়েদের নিজেদের মধ্যে মিশতে বেশি সময় লাগেনা আর ওদের গল্প শুরু হয়ে যায়। সুপ্রতিমদা অভির দিকে তাকিয়ে হেরে যাওয়ার হাসি দেয়। অরুনার চেহারায় পুরান হাসি দেখে পরী একবার অভির দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে, মাথা নাড়ায়।
সুপ্রতিমদার গাড়ি চেপে ওরা সবাই সি.আর.পার্কের ওর বাড়ির দিকে যাত্রা শুরু করল। সুপ্রতিমদা গাড়ি চালাচ্ছে আর অভি পাশে বসে, মাঝখানের সিটে বসে তিন জন মেয়ে যেন পাখীর মতন কিচিরমিচির শুরু করে দিয়েছে।
সুপ্রতিমদা অভিকে জিজ্ঞেস করে, “হ্যাঁ রে আমরা কখন দিল্লী থেকে রওনা দেব?”
অভি সুপ্রতিমদাকে জিজ্ঞেস করে, “আরে তুই নিউ দিল্লী রেলস্টেসানে কাউকে পাঠিয়েছিস কল্যাণীদের বাড়ি আনার জন্য।”
সুপ্রতিমদা, “হ্যাঁ রে বাবা, বল্বিন্দার ওদের আনতে চলে গেছে। আমি ওর হাতে একটা প্লাকারডে দিপঙ্করের নাম লিখে দিয়েছি, খুঁজতে কোন অসুবিধে হবে না।”
অভি, “ভাবছিলাম ত যে দুপুরে খাওয়ার পড়েই বেড়িয়ে পড়ব কিন্তু এখন ভাবছি কিছু তাবু আর বাকি সরঞ্জাম নিয়ে গেলে হয়।”
সুপ্রতিমদা আঁতকে ওঠে, “শয়তান ছেলে, আগে বলতে পারিস না। বোকা… এখন দুপুরে কি করে হবে?”
অভি, “না না দুপুরে নয়, রাতে বের হব আমরা। এদের বাড়িতে রেখে, আমি আর তুই টেন্টের খোঁজে বের হয়ে যাব।”
সুপ্রতিমদা, “হটাত করে তোর মাথার প্লান বদলে কেন গেল।”
অভি পিছনে ঘুরে একবার অরুনার দিকে তাকিয়ে উত্তর দেয়, “অরুনা যখন প্লেনে উঠেছিল তখন ওর মানসিক অবস্থা এখন যা দেখছিস তখন এই রকম ছিলনা। ওকে হাসতে দেখে আমি ভাবলাম কি আছে আবার কবে যাওয়া হবে ঠিক নেই, চল কাম্পিং করে আসি।”
সুপ্রতিমদা, “এখানে কেউ কিন্তু কাম্পিং করতে জানে না।”
অভির মুখে কাম্পিঙ্গের কথা শুনে পরী আর রিতিকা পেছন থেকে চেঁচিয়ে ওঠে, “এটা কি রকম হল? আগে থেকে কিছু বলা নেই কওয়া নেই, হটাত করে তোমরা সব প্লান বদলে দেবে কি করে হবে, আমরা খেলবো না।”
অভি ঘাড় ঘুরিয়ে ওদের দিকে দেখে বলে, “আরে ভদ্রমহিলা, ঘুরতে গিয়ে যদি কিছু আডভেঞ্চার না হয় তাহলে মজা কি?”
রিতিকা পরীকে জিজ্ঞেস করে যে ওরা কোথায় ঘুরতে যাচ্ছে। পরী ওকে পুর পরিকল্পনা জানায় আর জায়গার বিবরন দেয়। পরীর নাকো পর্যন্ত ঘোরা তাই সেই পাহাড়ের বিবরন দিতে বিশেষ অসুবিধে হয় না। পরীর মুখে স্পিতির গল্প শুনে অরুনা আর রিতিকা দুজনেই খুব উত্তেজত হয়ে ওঠে।
সুপ্রতিমদার বাড়িতে কল্যানিরা আগেই পৌঁছে যায়, পরী গাড়ি থেকে নেমে ওদের দেখে দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে কল্যাণীকে। বাড়িতে পাঁচটা মেয়ে যেন গল্পে মেতে ওঠে, ওদের দেখে মনে হল যেন একদল সুন্দরী পাখি একসাথে বসে কিচির মিচির শুরু করে দিয়েছে। খাওয়ার পরে অভি দীপঙ্কর আর রামানুজ কে বাড়িতে বিশ্রাম নিতে অনুরধ করে ওরা দুজনে বেড়িয়ে যায় কাম্পিঙ্গের সরঞ্জাম ভাড়া করতে।
কাম্পিঙ্গের সরঞ্জাম যোগাড় করতে করতে প্রায় ঘন্টা তিনেক লেগে যায়। দুটি বড় টেন্ট নেওয়া হয় আর একটা ছোটো টেন্ট নেওয়া হয়, সাথে নেওয়া হয় স্লিপিং ব্যাগ, দড়ি, মাদুর ইত্যাদি। সরঞ্জাম গাড়ির পেছনে রেখে বাড়ির দিকে যাত্রা শুরু করে।
অভি, “বস, একটু ওষুধের দোকানে দাঁড়াতে হবে আর বেশ কিছু সিগারেট কিনতে হবে।”
ওষুধের দোকানে দাঁড়ানোর কথা শুনে সুপ্রতিমদা বুঝতে পারে যে অভি কি কিনবে, হেসে বলে “বোকা… না নিয়েই বেড়িয়ে পরেছিস?”
অভি হেসে ফেলে, “শালা এত ঝামেলার মধ্যে কিনতে ভুলে গেছি।”
সুপ্রতিমদা, “আবে শুয়র, চিন্তা করিস না, আমার কাছ থেকে ধার নিয়ে নিস।”
অভি, “বোকা… মাঝ পথে যদি ফুরিয়ে যায় আর আমরা কন্ট্রোল না করতে পারি তাহলে শালা ন’মাস নিয়ে ফিরতে হবে কিন্তু।” দুজনেই হেসে ফেলে।
সুপ্রতিমদা, “তোর বউ খুব সুন্দরী আর তোর বান্ধবী দুজনকেই দেখতে বেশ সুন্দরী।”
অভি, “নজর দিস না যেন, দুজনেই এনগেজড কিন্তু।”
সুপ্রতিমদা, “তোর ত শালা ওখানে মাথা, সুন্দরী কে সুন্দরী বলেছি তাতেই গা জ্বলে গেল যেন তোর।”
অভি, “রিতিকাকে কোথায় পেলি?”
সুপ্রতিমদা, “আরে নেহেরু প্লেসে একটা টেকনিকাল কনভেন্সান ছিল, সেখানে ওর সাথে দেখা হয়। ওখানে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টে ছিল, ব্যাস আর কি, তিন মাস প্রেম আর তারপর সব ঠিকঠাক।”
ওষুধের দোকান থেকে ওষুধ আর বাকি জিনিস কিনে বিকেল পাচটার মধ্যে বাড়ি ঢুকে যায়। মেয়েরা জামা কাপড় বদলে বেশ আরাম করে বসে গল্প করছিল। রিতিকার পোশাক দেখে দীপঙ্কর আর রামানুজের চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। রিতিকার পরনে হাল্কা গোলাপি রঙের আঁটো স্লাক্স আর সাদা হাত কাটা গেঞ্জি। ওর গায়ের কাপড় যেন ওর পেলব কমনীয় শরীরের একপ্রস্ত রঙের প্রলেপের মতন সেটে।
সুগোল নিতম্বের ওপরে অন্তর্বাসের স্পষ্ট দাগ বোঝা যাচ্ছে। অভি ওই দেখে একবার দিপঙ্করদের দিকে আর চোখে তাকায় আর সুপ্রতিমদাকে চোখ টিপে ইশারা করে। পরী, অভির মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে যে কি এত মন দিয়ে দেখছে। পরী, দীপঙ্কর আর রামানুজের দিকে তাকিয়ে ওদের চোখের চাহনি দেখে মৃদু রেগে যায়। একটু বিরক্ত হয়ে মেয়েদের নিয়ে অন্য ঘরের মধ্যে ঢুকে পরে।
অভি আর সুপ্রতিমদা শেষ বারের মতন বেড়াতে যাবার পুর পরিকল্পনা একবার পুনরালোচনা করে নেয়। অভি পরীকে ডাক দেয় ওদের সাথে বসে বেড়াতে যাবার কথা বলার জন্য। এবারে ঠিক করা হয় যে কে টিম লিডার হবে, সবাই এককথায় অভির নাম নেয়, তারপরে ক্যাশিয়ারের কথা ওঠে, সবার চোখ পরীর দিকে।
পরী চেঁচিয়ে ওঠে, “না না, আমি পয়সার হিসেব রাখতে পারব না।”
সুপ্রতিমদা পরীকে মজা করে বলে, “রানীরা সুখে দুঃখে সর্বদা রাজার পাশে থাকে, তাহলে এখন কেন পিছিয়ে যাচ্ছও? এর পরে ত সপ্তপদি বাকি আছে, তখন কি করবে?”
লাজুক হেসে সুপ্রতিমদার দিকে তাকায় পরী। রিতিকা সুপ্রতিমদাকে বলে, “ঠিক আছে অনেক হয়েছে ওর পেছনে লাগা, ওই ক্যাশিয়ার হবে।”
গাড়ির ব্যাপারে কথা উঠলে অভি জানায় যে কল্যাণীদের জন্য ইনোভা আর সুপ্রতিমদার গাড়িতে ওরা যাবে। কল্যাণীদের গাড়ি বল্বিন্দার আর আরেক ড্রাইভার চালাবে, আর অভি আর সুপ্রতিমদা নিজেদের গাড়ি চালাবে।
অরুনা অভির কথা শুনে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, “কিরে তুই আবার গাড়ি চালাতে কবে থেকে শিখলি?”
পরী ওকে গত বারের কথা জানায়।
অভি দিপঙ্করের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “তোমরা কি ড্রিঙ্ক করো?”
দুজনেই ওদের বউয়ের দিকে তাকায়। কল্যাণী বিরক্তি ভরা চোখ নিয়ে দিপঙ্করকে ইশারায় বারন করে। পরী একবার কটমট করে অভির দিকে তাকায়, অভি সেদিকে দেখেও না দেখার ভান করে। পরী ওর ভাব দেখে হাল ছেড়ে দেয়।
সুপ্রতিমদা ওদের দিকে হেসে বলে, “আরে ভাই, ঘুরতে গিয়ে এই রকম বাঁধনে থাকতে কি কারুর ভালো লাগে নাকি।” তারপরে অভির দিকে তাকিয়ে বলে, “বোতল কোথায়? কিনেছিস নাকি তুই?”
অভি মাথা নাড়ায়, “না রে কিনিনি, যাবার পথে আম্বালা থেকে কিনে নেব।”
সুপ্রতিমদা বিরক্ত হয়ে বলে, “বোকা…শূয়র, তুই একবারে সব কথা বলতে পারিস না।”
অরুনা অভির দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, “তুই কবে থেকে ড্রিঙ্ক করা শুরু করলি রে?”
পরী ওকে সুব্রতর বিয়ের সময়ের অভির কান্ডকারখানা শুনায়, ওই শুনে সবাই হেসে ফেলে। গল্প আবার চলতে শুরু করে। সুপ্রতিমদা আর অভি বিয়ারের ক্যান নিয়ে গলায় ঢালতে থাকে আর বাকিরা কোল্ডড্রিঙ্কস হাতে নিয়ে নেয়।
কিছু পরে পরী অভিকে বাইরে ডেকে বলে, “বাড়ি ফিরে ছোটোমা, বাবু আর ব্যানারজি কাকু কে কি বলবে কিছু ভেবেছ কি?” পরীর ধরা গোল শুনে অভির ওর কাঁধে হাত দেয়। পরী থাকতে না পেরে অভিকে জড়িয়ে ধরে বুকের ওপরে মুখ গুঁজে ভয়ে কেঁপে ওঠে, “আমার জানো, মাঝে মাঝে খুব ভয় করে, জানি না কি হবে।”
অভি ওর মাথায় ঠোঁট চেপে ধরে বলে, “কিছু হবে না, ভয় নেই, আমি আছি।”
অরুনা পরীকে বেড়িয়ে যেতে দেখে কিছু পরে কল্যাণী কে নিয়ে বাইরে আসে। এসে দেখে যে পরী অভিকে জড়িয়ে ধরে বুকে মুখ গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে। পরী ওদের দেখে অভিকে ছেড়ে দাঁড়ায় আর চোখের কোল মুছে নেয়। অরুনা প্রশ্নভরা চাহনি নিয়ে পরীর দিকে তাকায়। পরী মাথা নাড়িয়ে জানায় যে কিছু হয়নি। অরুনার সে কথা বিশ্বাস হয় না, পরীকে জিজ্ঞেস করে, “সত্যি যদি কোন কিছু না হয়ে থাকে তাহলে তুমি কাঁদছ কেন?”
অভি ওকে নিশ্চিন্ত করে বলে, “তুই এসব চিন্তা ভাবনা ছেড়ে আনন্দ কর, বুঝলি।”
রাত ন’টা নাগাদ ওরা সবাই সেই দূর পাহাড়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। সবাই বেশ হাল্কা জামাকাপড় পরে, রিতিকা একটু বেশি হাল্কা জামা কাপড় পরে। সুপ্রতিমদা আর অভি বারমুডা আর টিশার্ট গায়ে গলিয়ে নিয়েছে। দিল্লী ছাড়ার আগে ওরা পাঁচ বোতল ভদকা আর পাঁচ ক্যারেট বিয়ারের ক্যান কিনে নিয়েছিল, পরী তাতে একটু বিরক্ত হয়ে উঠেছিল, কিন্তু যেহেতু সবাই আনন্দে মেতে তাই অল্প সাবধান করে দিয়েছে অভিকে।
সুপ্রতিমদার গাড়িতে মাঝের সিটে রিতিকা আর অরুনা বসে আর ওরা দুজনে বিয়ার পেছনে বসে, নতুন ড্রাইভার আমজাদ গাড়ি চালাচ্ছিল। পরী অভিকে বলে যে ও রাত টুকু কল্যাণী আর রানীদের সাথে ইনোভায় যাবে যাতে ওরা নিজেদের পৃথক না ভাবে। পরীর কথায় বল্বিন্দার ওদের গাড়ি চালায়।
অরুনা যথারীতি চুপচাপ বসে, রিতিকা আর ওরা বেশ গল্পে মেতে ওঠে। দিল্লী ছাড়িয়ে বেড়িয়ে পরতেই গাড়ি দ্রুত গতিতে ধেয়ে চলে, সামনে ইনোভা আর পেছনে সাফারি। বিয়ারের ফলে অভি আর সুপ্রতিমদার নেশা লাগে, বেশ একটু ঝিমঝিম পায়। অভি সুপ্রতিমদাকে বলে যে একটা সিগারেট দরকার। কিছু দূর গিয়ে গাড়ি থামায় বল্বিন্দার। দু’জনেই গাড়ি থেকে নেমে একটা করে সিগারেট ধরিয়ে টান দেয়।
অরুনা এর মধ্যে নেমে এসে অভিকে বলে, “আমার ঘুম ঘুম পাচ্ছে। আমাকে ওই ইনোভায় পাঠিয়ে দিবি, প্লিস?”
অভি, “তোর ঘুম পাচ্ছে ত এখানে ঘুমিয়ে পর না।”
অরুনা অভির মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, “আমার ভালো লাগছে না, আমি শুচিদির কাছে যাবো।”
একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে অরুনার ঝাপসা হয়ে আসা চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, “ঠিক আছে আমি ওকে এই গাড়িতে আস্তে বলব খানে।”
বল্বিন্দার গাড়ি ছুটিয়ে দিল, কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা সামনের গাড়িকে ধরে ফেলল। গাড়ি থামিয়ে অভি পরীকে ওদের গাড়িতে আসতে বলে।
পরী কারন জিজ্ঞেস করাতে অভি একটু বিরক্ত হয়ে বলে, “আমাদের গাড়িতে এসে অরুনাকে সামলাও, ওর আবার মন কেমন করছে। ওকে সামলানোর দায়িত্ব তোমার, আমাকে যদি এই রকম অবস্থায় ফেলে যাও তাহলে দেখে নিও।”
পরী গাড়ি থেকে বেড়িয়ে এসে ওদের গাড়িতে চেপে যায়। অরুনাকে জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে, অরুনা চুপ করে ওর মুখের দিকে জল ভরা চোখ নিয়ে তাকিয়ে থাকে। পরীর বুঝতে দেরি হয় না যে ওর মনে আবার সেই পুরানো বেদনা জেগে উঠেছে। পরী ওর মাথা জড়িয়ে ধরে বুকের ওপরে, কিছুক্ষণের মধ্যেই অরুনা ওর কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পরে।
অভি দুই ড্রাইভারকে সোজা চায়েল নিয়ে যেতে নির্দেশ দেয়। সুপ্রতিমদা আর অভি সাফারির পেছনের সিটে বসে ঘুম লাগায়।
সকাল সাড়ে দশ’টা নাগাদ ওরা চায়েল পৌঁছে যায়। ছোট্ট শহর চায়েলের উচ্চতা বেশি নয়, চারদিকে সবুজে ঢাকা পাহাড়। চায়েলের আবহাওয়া বেশ মনোরম, চারদিকে উঁচু উঁচু পাইন, কেদার, শাল দেবদারুর বন। হোটেলে ওরা দুটো রুম নিয়ে নেয় একটু বিশ্রাম নেবার জন্য। সারা রাত ধরে ড্রাইভার গাড়ি চালিয়েছে তাই ঠিক করা হল যে দুপুরে খাওয়ার পরে ওর চায়েল ছেড়ে বের হবে।
দুপুরে একটু তাড়াতাড়ি খেয়ে দেয়ে আবার বেড়িয়ে পরে সবাই। এবারে অভির হাতে গাড়ির স্টিয়ারিং, পাশে পরী। সুপ্রতিমদা, রিতিকা আর অরুনা পেছনের সিটে বসে। পরীর মুখে সবাই সেই জায়গার গল্প শুনছে মন দিয়ে। পরীর বর্ণনা শুনে সবাই মুগ্ধ, রাস্তা ঘাটা যেন পরীর এত চেনা যে মনে হয় ও এখানে সবসময়ে ঘুরতে আসে।
পরী অভিকে জিজ্ঞেস করে, “আচ্ছা আমরা কি শতদ্রু নদীর তীরে দাঁড়াবো?”
অভি, “না এবারে নয়, কল্পা বাঁ রেকং পিও পৌছাতে দেরি হয়ে যাবে, বেবি।”
পরী, “ভিমাকালি মন্দিরে নিয়ে যাবে না?”
অভি, “বেবি, কি করে হবে? আমাদের হাতে সময় কম।”
পরী একটু মনমরা হয়ে বলে, “কেন সময় কম, আমাদের হাতে ত অনেক সময় আছে। তাহলে চলো না আজ রাতে চিতকুলে থেকে যাই আমরা।”
কথা বলতে বলতে গাড়ি চালাতে অসুবিধে হচ্ছিল অভির, চেঁচিয়ে ওঠে পরীর দিকে, “তুমি কি আবার চিতকুলে গিয়ে গতবারের মতন ঝগড়া করতে চাও?”
পরী খিলখিল করে হেসে অভির গালে টোকা মেরে বলে, “না সোনা, এবারে আর ঝগড়া করব না। কিন্তু বাকিদের কথা বলতে পারছিনা, অভি।”
সুপ্রতিমদা অভিকে জিজ্ঞেস করে, “কিরে, আমরা কি শেষ পর্যন্ত চিতকুল যাচ্ছি নাকি?”
পরী অভির হয়ে উত্তর দিল, “হ্যাঁ হ্যাঁ, আমরা চিতকুল যাচ্ছি। আমাদের হাতে অনেক সময় আছে আমরা আরামসে চিতকুলে দুই দিন কাটাতে পারি।” পরী অভির দিকে মিষ্টি হেসে চোখ টেপে।
রিতিকা আর সুপ্রতিমদা একসাথে বলে ওঠে, “কিন্তু চিতকুল ত আমাদের পথে ছিলে না, তাহলে?”
পরী, “কেন তোমরা ছেলেরাই ত বলেছিলে যে, ঘুরতে গিয়ে যদি এডভেঞ্চারের গন্ধ না পাও তাহলে ঘোরা আর ঘোরা কি। চলো এক নতুন দুর্গম জায়গায়, সেটাও এক রকমের এডভেঞ্চার বইকি।”
অরুনা অভিকে জিজ্ঞেস করে, “হ্যাঁ রে, তোরা কেন চিতকুলে গিয়ে ঝগড়া করেছিলিস?”
পরী পেছনে অরুনার দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচিয়ে উত্তর দেয়, “ধৈর্য ধর আর দেখ। চিতকুল পৌঁছে সব বুঝতে পারবি আমরা কেন ঝগড়া করেছিলাম।”
পরীর সেই শয়তানি হাসি আর চোখের ভাব দেখে অভির যেন ভেতরটা গলে গেল। সেই দুষ্টু হাসি ওকে মনে করিয়ে দিল সেই পুরানো দিনের কথা।
গাড়িতে তেল ভরানোর জন্য ওরা জিওরিতে থামে। সবাই গাড়ি থেকে নেমে একটু হাটাহাটি করে, এতক্ষণ বসে বসে সবার পা ধরে গেছে। সবাই পাহাড়ের অপরূপ সৌন্দর্য দেখতে দেখতে মুগ্ধ হয়ে যায়। হাইওয়ের পাশ দিয়ে শতদ্রু নদী বয়ে চলেছে। গতবারের চেয়ে এবারে রাস্তার অবস্থা একটু যেন ভালো। তেল ভরানোর পরে সুপ্রতিমদার সাথে গিয়ে, পরী পয়সা মিটিয়ে দিল।
অরুনা আর রিতিকা অভির কাছে এসে জিজ্ঞেস করে, “হ্যাঁ রে সত্যি কি আমরা চিতকুলে যাচ্ছি?”
অভি ম্লান হেসে উত্তর দেয়, “আমাকে জিজ্ঞেস করে কি লাভ আছে। তোমরা কি জানো না যে প্রানীদের মধ্যে মানুষ হচ্ছে সব থেকে বিপ্পজন্নক আর মানুষের মধ্যে তোমরা, মেয়েরা সব থেকে মারাত্মক। তোমাদের কথা না মানলে ত মহাভারত উলটে দেবে, তাই না।”
সুপ্রতিমদা পরীকে জিজ্ঞেস করে যে কখন ওরা চিতকুল পৌঁছাবে, পরী অভির দিকে তাকায়। অভি ঘড়ি দেখে অনুমান করে যে চিতকুল পৌছাতে ওদের রাত আটটা বেজে যাবে।
পরীকে বলে, “তুমি রাস্তার অবস্থা জানো, তা সত্তেও কেন ওদের নিয়ে চিতকুল যাবার জন্য জেদ করছ, সোনা?”
পরী অভির একদম কাছে এসে, বুকের ওপরে হাত রেখে মুখ উঁচু করে নেয়। ওর উষ্ণ নিঃশ্বাস অভির সারা মুখের ওপরে বয়ে যায়, মিষ্টি লালা ঠোঁটের কাতর আহবান অভি প্রত্যাখান করতে পারে না। পরীর কোমর জড়িয়ে ঠোঁট নামিয়ে নিয়ে আসে আর পরী ওর চোখের দিকে তাকিয়ে মধুর সুরে বলে, “আমার একটা কথা রাখবে না, সোনা?”
অভি ঠোঁট নিচে নামিয়ে বলে, “এটা কিন্তু ব্লাকমেইল করা হচ্ছে বেবি।”
অভি পরীর ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়াতে যায়, পরী সবার দিকে চেঁচিয়ে বলে ওঠে, “আমরা চিতকুল যাচ্ছি।”
বলেই অভির হাতের বাঁধন ছেড়ে বেড়িয়ে যায়। অভির দিকে মিষ্টি হাসি ছুঁড়ে ইশারায় বলে, “ওই চুমুটা পাওয়ার জন্য তোমাকে অপেক্ষা করতে হবে, সোনা।”
গাড়িতে উঠে অভি, চিতকুলের হোটেলের ম্যানেজারের ফোন নাম্বার খুঁজে টাকে ফোন করে জানিয়ে দিল পাঁচটা রুম বুক করার কথা। ম্যানেজার রাতের খাবারের কথা জিজ্ঞেস করাতে অভি বাকি সবাই কে জিজ্ঞেস করে রাতের খাওয়ার ব্যাপারে। সবাই আঁতকে ওঠে যে বিকেল বেলায় রাতের খাবার। পরী ওদের জানায় যে চিতকুল পৌঁছতে পৌঁছতে অনেক রাত হয়ে যাবে আর যেখানে যাচ্ছে সেখানে গিয়েই বুঝতে পারবে কেন রাতের খাবারের কথা এত তাড়াতাড়ি অর্ডার দেওয়া হচ্ছে।
রকছাম ব্রিজ পৌঁছতে সন্ধ্যে নেমে এল। অভি মনে মনে একটু ভয় নিয়েই পরীর দিকে তাকাল, পরী হেসে ওকে আসস্থ দেয় যে এবারে ও আর রাগবে না। অরুনা গাড়ি দাঁড় করাতে অনুরধ করে নিচে নেমে নদী দেখতে চায়। গাড়ি দাঁড়াতেই সবাই নেমে নদীর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে থাকে। এর মাঝে সুপ্রতিমদা অভির কাছে এসে জিজ্ঞেস করে যে ওর গাড়ি চালাতে অসুবিধে হচ্ছে কিনা। অভি হেসে বলে যে পরী যতক্ষণ ওর পাশে আছে ততক্ষণ ওর শরীরে ক্লান্তি আসতে পারেনা।
সুপ্রতিমদা ওর মাথায় চাঁটি মেরে বলে, “শালা, আজ রাতে তাহলে এক প্যাকেট কন্ডম শেষ করবি।”
অভি, “এমন বলছিস যেন তুই হাতে ধরে নাড়াবি। শালা তুই কি থেমে থাকবি নাকি?” সিগারেট জ্বালিয়ে দুজনেই হেসে ফেলে।
বল্বিন্দার এর মাঝে এসে জিজ্ঞেস করে অভিকে যে ওই রাস্তায় চালাতে পারবে কিনা। রাত ঘনিয়ে আসে, অভি বড় এক নিঃশ্বাস নিয়ে বলে যে ও চালাতে পারবে। চারদিকে অন্ধকার নেমে আসে, অভির পাশে সুপ্রতিমদা বসে। খুব সাবধানে গাড়ি চালাতে শুরু করে অভি, সঙ্কীর্ণ পাহাড়ি রাস্তায় রাতের অন্ধকারে গাড়ি ধিরে ধিরে উঠতে শুরু করে। কিছু দুরে দুরে অন্ধ বাঁক, সামনে থেকে কোন গাড়ি না আসাতে গাড়ি চালাতে বিশেষ অসুবিধে হয় না।
পাথুরে রাস্তায় গাড়ি দোল খায়, অরুনা আর রিতিকার ভয়ে দম বন্ধ হয়ে আসে। পরীর দিকে ভয়ার্ত চোখে তাকায় দুই মেয়ে, জিজ্ঞেস করে যে ওরা ঠিক রাস্তায় যাচ্ছে কি না। পরী ওদের অভয় প্রদান করে, আয়নায় অভির দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসে, মনে পরে যায় প্রথম বার যখন পরী এখানে এসেছিল তখন ও ঝগড়া করেছিল অভির সাথে।
রাত সাড়ে আটটা নাগাদ ওর সবাই চিতকুল পৌঁছে যায়। গাড়ি সোজা হোটেলে নিয়ে যায় অভি। ম্যানেজার পরী আর অভিকে দেখে চিন্তে পেরে যায় আর ওদের থাকার জন্য রুম দেখিয়ে দেয়। ম্যানেজার জানায় যে রাতের খাবার একদম তৈরি, ওরা যেন খাওয়ার আগে একটু খবর দেয়।