মর্মাহত, পরাজিত অভি একাকী রাস্তা দিয়ে হাঁটতে থাকে, কি করনীয় কিছু বুঝে উঠতে পারে না। চোখ জ্বালা করছে কিন্তু সে চোখে জল আসে না, সব জল যেন শুষে নিয়েছে ওর বিবেক। কি পাপ করে ফেলেছে অভি, প্রেয়সীর প্রেম সরিয়ে রেখে এক বিষকন্যার হাতছানির ডাকে সারা দিয়েছে। কোথায় গেলে নিজের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে পারবে সেই কথা ভাবে।
ঘড়ি দেখল, রাত সাড়ে আটটা বাজে, বাড়ি ফেরার মন নেই। সারা রাত যেন এই রাস্তায় কাটিয়ে দিলে ভাল হয়। বুকের ভেতরে সেই সাহস টুকুও নেই যে অরুন্ধুতি বা শুচিস্মিতার সম্মুখিন হতে পারে। নিজের ওপরে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছে অভি, এতদিন মা ওকে বলতেন যে তুই ত একটা অকাঠ মূর্খ ছেলে, আজ সেই কথা যেন সত্যি হয়ে দাঁড়াল। পরী কি কোনদিন ওকে ক্ষমা করতে পারবে?
বাড়িতে ফোন করল অভি, মাকে জানাল যে রাতে দেবাশিসের বাড়িতে থেকে যাবে, প্রক্টিকালের কিছু কাজ বাকি। মায়ের কাছে দেবাশিসের ফোন নাম্বার নেই, তাই মা খবর নিতে পারবেন না যে অভি রাতে কোথায় ছিল। ঢাকুরিয়া থেকে বাসে চেপে এসপ্লানেড চলে এল।
এস্প্লানেড এসে শহিদ মিনারের নিচে অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইল। রাতের অন্ধকার ঘনিভুত হয়ে আসে অভির চারপাশে। লোকজনের কোলাহল যেন অভির কাছে বিষাক্ত হয়ে ওঠে। আসে পাশের সব লোকজন যেন অভির চেয়ে অনেক খুশি আর শান্তিতে দিন জাপন করছে, সব ব্যাথা সব বেদনা যেন অভির একার। না অভি বাকিদের কথা চিন্তা করল না, নিজের কিথা চিন্তা করল অভি। কত বড় নিচ আর হীন প্রকৃতির ছেলে সে। সেই অন্ধকার রাতে ওর পশ্চাত্তাপ শোনার জন্য ওর পাশে কেউ নেই।
একটা সিগারেট ধরিয়ে পাশের একটা চায়ের দুকান থেকে চা খেল। ট্রাম স্ট্যান্ড থেকে হাঁটতে হাঁটতে বাস স্ট্যান্ডের দিকে এগতে থাকে। রাস্তা পার করার পরে অভি লক্ষ করে যে ফুটপাথে একটা লোক বসে আছে, গায়ে ছেঁড়া জামা মাথার চুল উস্ক খুস্ক। অভির ওকে দেখে মনে হল যেন ওই লোকটা পাগল অথবা ভিখারি। হয়ত অতীত জীবনে কোন পাপের শাস্তি পেয়ে ওই লোকটার বর্তমান অবস্থা পাগলের মতন। অভির মনে হল যেন চোখের সামনে নিজের ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছে। কিছু দুরে দাঁড়িয়ে অভি একমনে লোকটাকে দেখতে থাকে। ওই পাগল প্রকৃতির লোকটা অভিকে লক্ষ্য করে।
হাত বাড়িয়ে ভিখে চায় অভির কাছে, “আল্লাহ র নামে কিছু দিয়ে দে বাবা, আল্লাহ তোর ভালো করবেন।”
অভি ধিরে ধিরে লোকটার দিকে এগিয়ে একটা দশ টাকার নোট বের করে ওর হাতে দেয়। লোকটা নোটের দিকে তাকায় একবার আর একবার অভির মুখের দিকে তাকায়। কিছু পরে লোকটা অভিকে বলে,
“তু বদর নেহি জো শামস সে রোশন হো। (তুই চাঁদ নয় যে সূর্যের আলোয় আলোকিত হয়)
তু বদর নেহি জো শামস সে রোশন হো। (তুই চাঁদ নয় যে সূর্যের আলোয় আলোকিত হয়)
তু উন সিতারো মে হ্যায় (তুই আকাশের সবথেকে উজ্জ্বল নক্ষত্র )
জো ভটকে রুহ কো রাহ দিখায়ে (যে হতাশা পূর্ণ লোকেদের পথ দেখায়)
রেহেনুমা বন আউর আপনে কলব কি পুকার সুন” (নিজের ভেতরের আওয়াজ শুনে জেগে উঠে অন্যদের পথ দেখা)
ওই লোকটা এবারে মনে হল না যে উনি কোন পাগল লোক। মাথা নত করল অভি অনার সামনে, হাত তুলে আশীর্বাদ করলেন সেই ফকির।
ফকিরের কথা শুনে অভি চিন্তা করে দেখল, না ওকে পরাজিত সৈনিকের মতন পালিয়ে গেলে চলবে না, লুকিয়ে থাকলে চলবে না, ওর প্রেয়সীর ডাক ওকে সেই বিষকন্যার কবল থেকে মুক্ত করেছে। দেরি হয়ে যাবার আগেই ওকে ওর প্রেয়সীর সামনে নিজেকে আত্ম সমর্পণ করতে হবে, জানাতে হবে সব ঘটনা। বুকের ভেতরের ঘা থেকে একমাত্র ওর প্রেয়সী পারবে ওকে মুক্ত করতে।
বাইরের এক পি.সি.ও থেকে কল্যাণী কে ফোন করল অভি, ঘড়িতে তখন রাত ন’টা।
অভি, “হ্যালো অভিমন্যু? আমাকে চিনতে পারছো?”
কল্যাণী এত রাতে অভির ফোন পেয়ে খুব অবাক হয়ে যায়। গ্রামের দিকে বেশির ভাগ লোকজন তাড়াতাড়ি শুয়ে পরে, ওরাও শুয়ে পড়েছিল। কল্যাণী, “হ্যাঁ হ্যাঁ, তোমার কথা কি করে ভুলবো। তুমি ত এখন বেশ তাজা, পরী ত সবসময়ে তোমার কথা বলে। তা এত রাতে ফোন করেছ, কি ব্যাপার?”
অভি কাতর সুরে বলে, “আমার পরীর সাথে কথা বলা খুব দরকার, কিন্তু ফোনে নয়।”
কল্যাণী, “তাহলে কি করে?”
অভি, “তুমি দিদাকে কিছু একটা বলে ওকে তোমার বাড়িতে ডেকে আনতে পার?”
কল্যাণী দুষ্টু হেসে উত্তর দেয়, “কেন কেন, বাসন্তি পুজো পর্যন্ত অপেক্ষা করা যাচ্ছে না, যে এখুনি পরীকে চাই? শয়তান ছেলে…”
অভির গলার আওয়াজ ভারী হয়ে আসে, “না কল্যাণী অইসব নয়। দয়া করে পরীকে ডেকে আনতে পারো?”
কল্যাণী অভির গলার আওয়াজ শুনে বুঝতে পারে ওর মনের ব্যাথা, “তুমি এখন কোথায়?”
অভি, “আমি এখন এসপ্লানেড বাসস্টান্ডে, আমি শেষ বাসে তোমার বাড়ি আসছি।”
কল্যাণী, “ঠিক আছে আমি দেখি কি করে পরীকে নিয়ে আসতে পারি। সাবধানে এস আর দিপঙ্কর বাসস্টান্ডে তোমার জন্য অপেক্ষা করবে খানে।”
অভি ওকে প্রান থেকে ধন্যবাদ জানিয়ে বাসে উঠে পরে। অন্ধকার রাত কেটে বাস এগতে শুরু করে। বসিরহাট যত কাছে আসে, অভির বুকের আলোড়ন যেন তত চাগিয়ে ওঠে। কানের মধ্যে মাথার মধ্যে যেন কেউ দামামা বাজায়। চিন্তা করে পায় না যে ওর সব কথা শুনে পরীর প্রতিক্রিয়া কি হবে।
রাত প্রায় বারোটা নাগাদ অভি বসিরহাট পৌঁছায়। দিপঙ্কর ওর জন্য দুটি সাইকেল নিয়ে অপেক্ষা করছিল। ওকে দেখে একটু চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করে, “ব্যাপার কি বলতো, এত রাতে শুচিস্মিতাকে ডেকে পাঠালে?”
অভির কথা বলার মতন মনের অবস্থা ছিল না, “আমি কিছু অসুবিধায় পড়েছি আর তাই পরীর সাথে একটু সেই ব্যাপারে কথা বলার দরকার তাই পরীকে চাই।”
কল্যাণীদের বাড়ি পৌঁছে অভি লক্ষ্য করল যে পরী আর কল্যাণী উৎসুক নয়নে ওর পথ চেয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে। অভিকে দেখেই পরী দৌড়ে এসে ওর জামার কলার খামচে জল ভরা চোখে জিজ্ঞেস করে, “ছোটো মায়ের কি হয়েছে?”
ছোটমায়ের প্রতি ওর এত ভালবাসা দেখে, অভির চোখ ফেটে জল আসে, “তুমি কে?”
অভি নিজেকে সামলে উত্তর দেয়, “তোমার ছোটো মা আর বাবু ভালো আছেন।”
বুকের ভেতর থেকে যেন এক বড় পাথর নেমে যায় পরীর।পরী, “তাহলে তোমার কি হয়েছে? অরুন্ধতির সাথে কি ঝগড়া হয়েছে?”
মাথা নাড়ায় অভি, না ওর সাথে ঝগড়া হয়নি, অরুনা ভাল আছে। পরী হেসে জিজ্ঞেস করে, “তাহলে কি চুরি ডাকাতি করেছ নাকি না কাউকে খুন করেছ?”
গালের ওপরে হাত বুলিয়ে পরী ওর মুখের দিকে ভাল করে তাকায়। পরী লক্ষ্য করে যে অভির দু’চোখ ছলছল করছে আর ঠোঁট জোড়া তিরতির করে কাঁপছে। পরী ওই চোখ দেখে বুঝতে পারে যে অভির মনের মধ্যে এক বিশাল ঝড় দানা বেঁধে আছে।
পরী ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করে, “আমার কথা খুব মনে পড়ছিল তাই তুমি আমার সাথে দেখা করতে এসেছ তাই না?”
অভি, “আমি তোমার সাথে একটু একা কথা বলতে চাই।”
অভি ধরা গলার আওয়াজ শুনে পরী বুঝতে পারে যে, যাই ঘটেছে সেটা বেশ সঙ্গিন। অভির মনের ভেতরে যে এক বিশাল ঝড় দানা বেঁধেছে আর সেটা যে অভিকে কুরে কুরে শেষ করে দিচ্ছে সেটা বুঝতে পরীর দেরি হয় না। পরী কল্যাণীর দিকে তাকাল। কল্যাণী বলল যে ওরা ওদের শোবার ঘরে যেতে পারে, কেউ ওদের কিছু বলবে না। কল্যাণীরা অন্য ঘরে শুয়ে পড়বে।
পরী অভিকে টেনে ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। অভির দিকে উৎসুক চোখে তাকিয়ে থাকে পরী। সামনে এসে বুকের কাছে হাত জড় করে দাঁড়িয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করে যে কি হয়েছে অভির। অভি কলেজের ব্যাগ বিছানার ওপরে ছুঁড়ে ফেলে পরীর সামনে হাঁটু গেড়ে মাথা নিচু করে বসে পরে।
ধরা গলায় বলে ওঠে, “আমি পাপ করেছি পরী।”
পরী বিশ্বাস করতে পারে না অভির কথা, আঁতকে ওঠে, “কি?” পরী ওর চুলের মুঠি ধরে অভির মুখ ওপর দিকে করে, সোজা চোখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, “কি বলতে চাইছ?”
অভির দুগাল দিয়ে চোখের জল গড়িয়ে পরে, চাপা সুরে বলে,”অরুনিমা…”
পরী যেন নিজের কান কে বিশ্বাস করতে পারেনা। চুলের মুঠি ছেড়ে দিয়ে চিবুকে আঙ্গুল স্পর্শ করে জিজ্ঞেস করে, “অরুনিমা কি? কি করেছ ওর সাথে?”
অভি, “মৈথিলী ও ছিল…”
আঁতকে ওঠে পরী, “না” ধুপ করে বিছানার ওপরে বসে পরে। বুকের মধ্যে এক বিশাল ঝড় শুরু হয়ে যায়, “আমি বিশ্বাস করি না।”
ঘরের মধ্যে নিস্তব্ধতা নেমে আসে। পরীর চোখে দুখের নয়, রাগে চোখ ফেটে জল আসে। কান আর গাল গরম হয়ে যায় ওর, রাগে কাঁপতে থাকে পরী।
চিৎকার করে ওঠে অভির দিকে, “ওদের সাথে কি করেছ তুমি?”
অভি, “আমি কিছু করিনি…”
চিৎকার করে ওঠে পরী, “একদম মিথ্যে কথা বলবে না আমার সামনে, কি করেছ ওদের সাথে সত্যি করে বল? কিছুই যদি করনি তাহলে এত রাতে আমার কাছে কেন এসেছ?” তারপরে বুক ফেটে কান্না বেড়িয়ে আসে পরীর, “হাঁ ভগবান, আমি যাকে ভালবাসি সেই কেন আমার সাথে এই রকম করে? আমি ছোটো ছিলাম আমার বাবা কে ভগবান নিয়ে নেন। আমার দিদিরা আমাকে সারা জীবন কষ্ট দিয়ে গেছে, আমার মা আমাকে ছোটো বেলায় ঠিক করে দেখেনি।
ছোটো মা যে আমাকে দেখেছিল, তাকেও ভগবান আমার থেকে দুরে সরিয়ে নেয়। চব্বিশ বছর পরে আমি আমার ভালবাসা খুঁজে পেলাম তোমার কাছে আর? পরের সপ্তাহে তোমার জন্মদিন, আমি কত স্বপ্ন দেখেছিলাম যে তোমাকে আমি চমক দেব। আমার ভালবাসা কি এত কম, এত ছোটো, যে এক বারের জন্যেও তোমার আমার কথা মনে পরেনি?”
পরীর প্রশ্নের উত্তর অভির কাছে নেই। প্রথম পদক্ষেপ অভি নিয়েছিল সেই বিষকন্যের দিকে। অরুনা বারবার করে বারন করা সত্তেও অভি কান দেয় নি ওর কথায়। ঘরের প্রচন্ড নিস্তব্ধতা দুজন কেই কুরে কুরে খেয়ে চলেছে।
ধরা গলা অভি জিজ্ঞেস করে, “আমার ওপরে কি তোমার আস্থা আছে?”
বিভ্রান্ত পরী ওর ভেজা চোখ নিয়ে অভির চোখের দিকে তাকায়, “তোমার ওপরে আস্থা … কিন্তু মৈথিলী আমার বৌদি।”
পরী বিছানা থেকে নেমে এসে অভির সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পরে। অভির মুখ হাতের মধ্যে আঁজলা করে নিয়ে, চোখে চোখ রেখে বলে, “অভি আমার ভালবাসা একদিনে, এক মুহূর্তে এসেছে। সুব্রতদার বিয়ের রাতে, উঠানে তোমাকে প্রথম বার দেখে কেন জানিনা আমার মনে হয়েছিল যে তুমি সেই মানুষ।”
অভি কলেজের ব্যাগের দিকে দেখিয়ে বলে, “ওর মধ্যে একটা ওয়াকম্যান আছে, ওটা চালাও সব পরিষ্কার হয়ে যাবে।”
পরী ওয়াকম্যান হাতে নিয়ে একবার চালায়, পুরোটা শোনে, নিজের কান কে বিশ্বাস করতে পারেনা পরী, বার বার চালিয়ে শোনে।
কপালে করাঘাত করে মাথা নাড়িয়ে অভিকে বলে, “এটা কি, অভি? আমি যা শুনছি সেটা কি ঠিক শুনছি?”
অভি, “এটাই সত্যি।”
দু’জনে অনেকক্ষণ ধরে চুপ করে বসে থাকে। অভির বুকের মধ্যে ধুকপুকানি বেড়ে চলে, পরী সব শুনে কি প্রতিক্রিয়া করবে। পরী ওয়াকম্যান শুনে থ হয়ে বসে, বাড়ির নতুন বউ, ওর ছোটো বৌদি শেষমেস এই রকম এক নিচ নারী?
মাথা নাড়ায় পরী, “আমার বৌদি শেষ পর্যন্ত আমার সাথে এই রকম করতে পারল? বিয়ের পরেও কি করে তোমার সাথে ওই রকম ব্যাবহার করতে সাহস করে? আমি কিছুতেই কিছু বিশ্বাস করতে পারছি না।”
অভি পরীর বিভ্রান্ত জল ভরা চোখের দিকে ম্লান হেসে বলল, “চুরনি জানে না যে আমি তোমাকে ভালবাসি।”
অবশেষে পরী চোখের জল মুছে হেসে দিল, “তুমি না একটা মস্ত গাধা, কিন্তু তুমি আমার গাধা।”
অভির গালের ওপরে আলতো করে চাঁটি মেরে দেয়।
অভি পরীর হাত ধরে ফেলে, “আউচ, আমাকে মারলে কেন?”
পরী, “এই চাঁটি ওদের দিকে পা বাড়ানোর জন্য।”
হাত ছাড়িয়ে অভির গালে আরেক থাপ্পর মারে পরী, এবারে আগের চেয়ে জোরে। অভি চমকে যায়, পরীর দিকে তাকায়।
পরী একটু রেগে গিয়ে বলে, “এটা অরুন্ধতির নাম নেওয়ার জন্য। তুমি অন্য কারুর নাম নিতে পারতে।”
মাথা চুলকে মাথা নিচু করে উত্তর দিল অভি, “তখন আমার মাথায় কিছু আর আসছিল না, পরী।”
পরী অভির মুখখানি আঁজলা করে নিয়ে আস্তে করে কপালে চুমু খায়, “এটা আমার ভালবাসা আর আস্থার জন্য যে তোমাকে আমি আবার কাছে ফিরে পেয়েছি।”
অভি পরীর কোমর জড়িয়ে ধরে বুকের মধ্যে মুখ লুকিয়ে নেয়। অভির মনের ভেতরে এক অনাবিল শান্তি, শেষ পর্যন্ত পরী ওকে ক্ষমা করে দিতে পেরেছে। পরী ওর মাথার চুলে হাত বুলিয়ে আদর করতে থাকে।
কিছু পরে পরী ওকে জিজ্ঞেস করে, “তুমি বিকেল থেকে কিছু খাওনি, তোমার খিদে পেয়ে থাকবে নিশ্চয়।”
অভি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, “তুমি কে? তুমি কেন আমাকে এত ভালোবাসো?”
অভির চোখ থেকে চশমা খুলে গালের ওপরে জলের দাগ মুছে উত্তর দেয়, “তুমি যে আমার সেই ছোট্ট রাজকুমার। দেখি কিছু খাবার পাওয়া যায় কিনা।”
পরীকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে অভি বলে, “আমার খিদে নেই পরী, শুধু তুমি আমার কাছে থাকো তাহলেই হবে।” বুকের মাঝে, গলায় আলতো করে নাক ঘষতে শুরু করে দেয় অভি। পরী ওর পিঠের ওপরে আদর করে হাত বুলিয়ে দেয়, মাথার চুলে আঙ্গুল দিয়ে আঁচরে দেয়, ঠিক যেন মা তার ছেলেকে সস্নেহে আদর করছে।
কিছুক্ষণ অভিকে আদর করার পরে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলে, “খিদে পেয়েছে, খেয়ে নাও নাহলে এবারে সত্যি সত্যি মার খাবে, আর অরুন্ধুতির ফোন নাম্বার আমাকে দাও, আমি ওর সাথে কথা বলতে চাই।”
অভি, “কেন?”
পরী, “তুমি আবার জিজ্ঞেস করছ, কেন? যেন তুমি জানো না তুমি কি করেছ। আমি ওকে ফোন করে সব জানাব তুমি কি কি করেছ।”
অভি কাতর মিনতি করে পরীর সামনে, “প্লিস অরুনাকে বোলো না। ও আমাকে মেরে ফেলবে তাহলে।”
পরী, “তোমার একটু মার খাওয়া প্রয়োজন। ওই ঠিক করবে তোমাকে আমি নয়।”
পরী দরজা খুলে অভির জন্য খাবার আনতে বেড়িয়ে গেল। চুপ করে বসে থাকল অভি। কিছু পরে কল্যাণীর সাথে পরী খাবারের থালা নিয়ে ঘরের মধ্যে ঢোকে। কল্যাণীকে দেখে অভির বুক কেঁপে উঠল, ওর মান সন্মান সব যেন মাটিতে মিশে গেছে।
কল্যাণী ওকে দেখে হেসে বলল, “তুমি কি রকম মানুষ…”
পরী ভাতের থালা নিয়ে অভির পাশে মাটিতে বসে পরে। আলু সিদ্ধ ভাত আর ডাল দিয়ে ভাত মেখে অভিকে ঠিক বাচ্চা ছেলের মতন খাওয়াতে শুরু করে।
কল্যাণী পরীর খাওয়ান দেখে হেসে বলে, “পরী, তুই ওকে আদরে বাঁদর করে দিবি।”
পরী ওর দিকে হেসে উত্তর দেয়, “আমি ওর খেলার পুতুল আর ও আমার ছোট্ট রাজকুমার।”
অভিকে খাওয়ানর পরে, অভির মুখ আঁচল দিয়ে মুছিয়ে দেয়।
কল্যাণী জিজ্ঞেস করে অভিকে, “ঠিক কি হয়েছে?”
পরী অভিকে বিছানায় উঠে যেতে বলে আর কল্যাণীর দিকে তাকিয়ে ওদের একটু একা ছেড়ে দিতে অনুরধ করে।
পরী, “প্লিস, সব কথা জানতে চাস না। যে টুকু বলেছি সেটাই ঠিক। আমাকে ভুল বুঝিস না কল্যাণী, আমি চাইনা ও হেনস্থা হক। অনেক ঝড় গেছে ওর উপর দিয়ে, একটু শুতে দে ওকে।”
কল্যাণী ওদের দিকে দুষ্টু হেসে বলে, “তোদের কে একা ছেড়ে ত যাচ্ছি। এত কান্না আর এত আদর খাওয়ার পরে আবার যেন কিছু করে বসিস না যেন।”
কল্যাণীকে ঠেলে ঘর থেকে বের করে দেয় পরী অনুরধ করে যে ওদের কে যেন সাড়ে পাচটায় উঠিয়ে দেওয়া হয়। প্রথম বাসে অভিকে ফিরে যেতে হবে, বাড়ির কেউ অভিকে যদি দেখে ফেলে তাহলে বিপদ হয়ে যাবে। কল্যাণী বলল যে ও দিপঙ্করকে বলে দেবে যাতে অভিকে সকাল বেলায় বাসস্টান্ডে ছেড়ে আসে।
পরী ঘরের লাইট বন্ধ করে ছোটো লাইট জ্বালিয়ে অভির পাশে শুয়ে পরে। ওর দিকে ফিরে, অভির মাথ বুকের কাছে নিয়ে আদর করে। অভি পরীর কোমর জড়িয়ে ধরে নিজের দিকে টেনে নেয়।
পরী ওর কানে কানে বলে, “এবারে আমাকে পুর ঘটনা একদম প্রথম থেকে বলো ত।”
মুখ উঁচু করে পরীর গভীর কালো চোখের দিকে দেখে অভি, কপালে কপাল ঠেকিয়ে অভির মুখের দিকে দেখল পরী। অভি পরীর কাছে কিছুই লুকালো না, সব কথা সত্যি সত্যি করে বলে দিল। সব কথা শুনে পরী বিস্ময়ে মাথা নাড়ায়। দুজনে অকেঙ্কক্ষণ চুপ করে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকে। একে অপরকে জড়িয়ে আলিঙ্গনের উষ্ণতায় নিজেদের কে ডুবিয়ে দেয়।
অভির নাকের ওপরে পরী ওর নাক ঘষে কানে কানে বলে, “মহাভারতের অভিমন্যু অনেক বীর এবং সাহসী ছিলেন, কিন্তু কেন হেরে গেছিলেন জানো? কেননা মহাভারতের অভিমন্যুর কাছে এই শুচিস্মিতা ছিল না। আমার ছোট্ট সোনার কাছে সর্বদা তার পরী আছে, সে কখন হেরে যেতে পারে না।”
আবেগে দুচোখ বন্ধ করে নিয়ে অভির ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরে পরী। প্রেমের নিবিড় আলিঙ্গনে এঁকে অপরকে প্রাণপণে জড়িয়ে ধরে। সারা রাত দুজনে দুজনকে চুপচাপ জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকে, আদরের যেন শেষ নেই আর। পরীর গভীর কালো চোখের মাঝে নিজেকে হারিয়ে যেতে দেখে অভি।
পুব আকাশে নতুন ঊষার ছটা। বাইরে পাখিদের কিচির মিচির কিছু পরে আকাশ বাতাস মাতিয়ে তোলে। এক নতুন সকাল এক নতুন দিন নিয়ে আহ্বান জানায় পরী আর অভিকে। দূর থেকে এক বাউল ভিখারি গান গায়, সেই গানের মিটে সুর ঘরের মধ্যে ভেসে আসে…
“রাই জাগো রাই জাগো শুখো শারি বলে
রাই জাগো রাই জাগো শুখো শারি বলে
কত নিদ্রা যাও গো রাধে শ্যাম নায়রের কোলে।
রাই জাগো রাই জাগো শুখো শারি বলে…”