উত্তরে হাওয়া নিয়ে আসছে শীতকাল৷ প্রকৃতি জুড়ে হিমহিম ঠান্ডা গায়ে শিহরণ জাগিয়ে তোলে। সেই শিহরণ আজ দ্বিগুণ হলো, প্রণয় পুরুষটির প্রগাঢ় আর উষ্ণ আলিঙ্গনে। যে আলিঙ্গনে অন্তঃকরণ শত সহস্রবার প্রার্থনা করে, সময়টা থেমে যাক। এই নিরাপদ বুকটায় কেটে যাক যুগের পর যুগ। শেষতক এই বুকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে বিদায় নিক পৃথিবী ছেড়ে। প্রশান্তির ঘুম ঘুমাক চিরতরে। আজ যেন দু’টো শরীর, দু’টো হৃদয় এক সুতোয় বাঁধা পড়েছে৷ এক উষ্ণ অনুভূতিতে শিহরিত হচ্ছে দু’জন। একে অপরকে অনুভব করছে নিখুঁতভাবে৷ সৌধর বুকে একদম মিলিয়ে আছে মেয়েটা৷ ছোট্ট দেহশ্রীটুকু বিড়ালছানার মতো ঘাপটি মেরে আছে। এদিকে রোজকার নিয়মে তাহানী আসছে তার ভাবিপাকে ডাকতে। বিয়ের আগে সিমরানকে আপু, আপাই ডাকত তাহানী। তাই বিয়ের পর ভাই বউ হওয়ার সুবাদে ভাবি, আপা মিলিয়ে ভাবিপা ডাকে।
সিমরান মেয়েটা ভীষণ ঘুমকাতুরে। সৌধ যখন কাছে থাকে তখন সৌধর আদুরে ডাকেই তার ভোরবেলা ঘুম ছুটে যায়৷ আর দূরে থাকলে নিয়ম করে ভোরবেলা ওঠতে পারে না। তার এই ব্যাধি সারাতেই সৌধ সাত বছরের তাহানীকে একদম রায় বাঘিনী ননদিনী হতে আদেশ করে। যত ভালোবাসাই থাকুক তার ভাবিপার প্রতি। কোনোক্রমেই যেন বেলা করে ঘুমাতে না দেয়। চৌধুরী বাড়িতে সবাই ভোরবেলা ঘুম থেকে ওঠে৷ বেলা করে ঘুমানোর স্বভাব এক ঝুমায়না ভাবিরই আছে৷ ছোট্ট তাহানীকেও তার বাবা ভোরবেলা ঘুম থেকে ওঠতে শিখিয়েছে। বাবা যখন বাড়িতে থাকে তার সঙ্গে রোজ সকালে হাঁটতে বেরোয় সে। আর ব্যবসায়ীক কাজে বাবা ঢাকা চলে গেলে বড়ো মার সঙ্গেই সময় কাটায়। সৌধ তার পরিবারের সকলের গতিবিধি সম্পর্কে জানে৷ তাই তাহানীকেই বেছে নেয় সিমরানের প্রভাতের সঙ্গী হিসেবে। ছোটো ভাইয়ার আদেশ অনুযায়ী তাহানীও রোজ চিৎকার, চ্যাঁচামেচি করে, দরজা ধাক্কিয়ে ভাবিপাকে জাগিয়ে তুলে। এরপর ওরা ছাদে গিয়ে শরীর চর্চা করে বা বাগানে গিয়ে হাঁটাহাঁটি করে, ফুল তুলে। কখনো কখনো সৌধ ওদের সঙ্গে ভিডিয়ো কলে সঙ্গও দেয়। নিয়ম মেনে আজো তাহানী ডাকতে এলো। এসে দরজা খোলা দেখে খুশি হলো ভীষণ। ভাবল, ‘ বাহ আজ তো ভাবিপা গুড গার্ল হয়ে গেছে।’ এসব ভাবতে ভাবতে গুটিগুটি পায়ে যেই না ঘরে ঢুকল বুকের ভেতর অল্পখানি ভয়ে ছ্যাঁত করে ওঠে। আকস্মিক দু’হাতে চোখ দু’টো ঢেকে ভয়ে ভয়ে বলে,
‘ সরি সরি, আমি জানতাম না, ট্রাস্ট মি। ‘
মিহি, ভীত স্বরটি কর্ণে পৌঁছাতেই একে অপরের থেকে ছিটকে সরে যায় সৌধ, সিমরান। তীব্র লজ্জায় সর্বাঙ্গ থরথর করে কেঁপে ওঠে সিমরানের। গাল দু’টো হয়ে যায় রক্তাভ। তাহানী আর এক মুহুর্ত দেরি করে না। সে কত বড়ো ভুল করে ফেলেছে ভাবতেই চোখ দু’টো টলমল হয়ে যায়। মাথা নিচু করে অপরাধীর মতো সিঁড়ি বেয়ে বড়ো মায়ের ঘরে ঢুকে কাঁদতে শুরু করে। ছোটোবেলা থেকে তাকে শেখানো হয়েছে কারো ঘরে গেলে অবশ্যই অনুমতি নিয়ে যাবে। সাত বছর বয়স তার৷ বর্তমান জেনারেশনের বাচ্চারা অনেক বেশি স্মার্ট হয়। তাহানীর মাঝে সেই স্মার্টনেস পরিপূর্ণ ভাবে রয়েছে। এর পেছনে তার পরিবার এবং সুললের মতো কঠিন ব্যক্তিত্বধারী বাবার অবদান অপরিসীম। যে শিক্ষা তাকে দেয়া হয়েছে তাতে আজ যে ঘটনা ঘটে গেছে এই নিয়ে যেমন লজ্জিত তেমন ভীতও। স্মৃতি আপু তাকে বলেছিল, ‘ কারো ঘরে নক ছাড়া তো যাবেই না, ম্যারেড কাপলদের বেলায় আরো বেশি সতর্ক থাকবা। ‘ সে জানত ছোটো ভাইয়া আজ আসবে। তাই বলে এত সকালে এসে যাবে তা তো জানত না। ভাই, ভাবির ভালোবাসার সময় সে গিয়ে ডিস্টার্ব করল! ছোট্ট হৃদয়টুকু অস্বস্তি, লজ্জায় বিচলিত হয়ে রইল।
সিমরান লজ্জায় সেই যে মাথা নুইয়েছে আর তুলেনি। সৌধকে তেমন বিচলিত দেখাল না। সে শরীর টানটান করে দাঁড়িয়ে একহাত পকেটে গুঁজে দিল। এরপর অপর হাতে নিজের এলোমেলো, উষ্কখুষ্ক চুল গুলো ঠিক করতে করতে বলল,
‘ সিনু সারারাত ঘুম হয়নি। আমি একটু ঘুমাব। তুই তাহানীর কাছে যা৷ ও ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছে। ভয়, লজ্জা দুটোই পেয়েছে। তুই গিয়ে ওকে স্বাভাবিক কর৷ বল, আমরা একটুও মাইন্ড করিনি। উই নো ইট’স আ স্মল মিস্টেক। ‘
.
.
সুজা এমপির বাড়িতে শুক্রবার মানেই আলাদা আমেজ৷ সেই আমেজে গাঢ় হয়ে ওঠল সুজা, সুলল দুই ভাই। সৌরভ, সৌধ দু’ভাই। আর সিমরান, ঝুমায়না দুই পুত্রবধূর উপস্থিতিতে। আজ তারা সবাই মিলে দুপুরের আহার একসঙ্গে গ্রহণ করবে৷ এত মানুষের ভীড়ে তাহানী মিস করছিল স্মৃতি আপুকে। যে বরের সাথে ফের কানাডায় পারি জমিয়েছে। রান্নাঘরে আজ এলাহি আয়োজন। কাজের মেয়েরা কা’টাকুটি, থালাবাসন ধোঁয়া এসবে ব্যস্ত। আর বউরা ব্যস্ত সুস্বাদু খাবার তৈরিতে। তাহানী ভিডিয়ো কলে তার স্মৃতি আপার সাথে গল্প করছে। পাশাপাশি ঘুরে ঘুরে দেখাচ্ছে আর বড়ো মা আর ভাবিপা মিলে কী দারুণ দারুণ রান্না করছে। দাদুনি ড্রয়িং রুমে বসে পান চিবুচ্ছে আর ছোটো ছেলে সুললের বকুনি শুনছে৷ সুলল কাকু পান খাওয়া একদম পছন্দ করে না৷ তার ভাষ্যে পান খায় রুচিহীন মানুষেরা। এটা রুচির দুর্ভিক্ষ। ছেলে আর নাতিদের বেলায় দাদুনি যেন নতুন বউ৷ একদম মুখে কুলুপ এঁটে বকুনি খায়, জ্ঞান বাক্য শুনে৷ ঝুমায়না নীরব দর্শক হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কখনো দাদুনির কাছে এসে বসছে তো কখনো শাশুড়ি, জায়ের রান্নার ঘ্রাণ শুঁকে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে ছেলে সুরের দুষ্টুমি গুলো ক্যামেরা বন্দি করে ফেসবুকে আপলোডও দিচ্ছে। এমন সময় আজান ধ্বনি শুনতে পেয়ে সিমরান তড়িঘড়ি করে উপরে ছুটল। সৌধ ভাইকে জাগিয়ে দিতে হবে এখন। বাবা, চাচা আর ভাইয়ের সঙ্গে নামাজে যাবে সে।
সৌধর ঘুম ছুটেছে আরো মিনিট, পাঁচেক আগে৷ ঘুমের ঘোরে আকস্মিক সিমরানের ফোনের রিংটোন শুনতে পায় সে। অমনি ত্বরিত ওঠে বসে ফোন হাতে নেয়৷ নাম্বার সেভ করা নেই বিধায় ভ্রু কুঁচকে রিসিভ করে কানে ধরে। সঙ্গে সঙ্গে শুনতে পায় একটি পুরুষালী কণ্ঠের উত্তেজিত কিছু বাক্য,
‘ সিমরান! ফোন ধরছ না কেন? আরে বাবা আমি সরি বলেছি তো৷ আই এম এক্সট্রিমলি সরি ইয়ার। তুমি প্লিজ বিকেলে বেরোও। লুনা, দিলারা ওরাও বেরুবে। উদ্যানে আসো প্লিজ। কান ধরে ক্ষমা চাওয়ার সুযোগটুকু দাও। আমার আসলেই বোঝা উচিত ছিল, যে মেয়ে বিয়ের আগেই আমাকে একসেপ্ট করেনি সে বিয়ের পর কীভাবে করবে? তুমি ঠিক বলেছ বন্ধুত্বের মাঝে প্রেম শব্দটা আনাই মারাত্মক ভুল হয়েছে। ট্রাস্ট মি আমি তোমার বন্ধু হয়েই থাকব৷ প্রেম শব্দটা আনব না৷ তবু প্লিজ ব্লক লিস্ট থেকে আমার আইডি ছাড়াও। আমার নাম্বার গুলোও ব্ল্যাক লিস্ট থেকে মুক্ত করো। প্লিজ, প্লিজ। ‘
সদ্য ঘুম ভেঙে ছিল সৌধর৷ ঠিকঠাক মস্তিষ্ক সজাগ হতে না হতেই বউয়ের ফোন রিসিভ করে বসেছে৷ কিন্তু এমন একটা বিষয়ের সম্মুখীন হবে ভাবতেও পারেনি৷ সহসা মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে পড়ল ওর। বুকের ভেতর সম্পূর্ণ নতুন একটি অনুভূতির সৃষ্টি হলো। এই অনুভূতিটাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করা যায়? এক বালতি তীব্র গরম পানিতে কেউ মুখ ঠেশে ধরলে যেমন লাগে অমন নাকি সম্পূর্ণ অন্ধকার, বায়ু চলাচল ছাড়া গুমোট ঘরে বন্দি করে রাখলে যে অনুভূতি হয় তেমন বোধগম্য হলো না। তবে ভেতরটা জ্বলে যাচ্ছে। মাথাচাড়া দিয়ে ওঠছে ভয়াবহ এক ক্রোধ। এই পৃথিবীতে কার এত স্পর্ধা? যে সৌধ চৌধুরীর অর্ধাঙ্গিনীকে প্রেম নিবেদন করবে। যে মেয়েটাকে এত যত্ন করে আগলে ধরে জীবনে জড়িয়েছে। যে মেয়েটাকে সম্পূর্ণ হালাল রূপে নিজের করে পেয়েছে। অথচ একবারটি গভীর করে ছুঁয়ে দেখেনি। তীব্র পৌরুষ চাহিদা থাকা সত্ত্বেও ধৈর্য্য ধরে সময় গুনেছে। বিয়ের পর থেকে কত রাত সে না ঘুমিয়ে বিছানায় ছটফট করে কাটিয়েছে৷ পাশের মানুষটির থেকে সম্পূর্ণ আশকারা পেয়েও ভুলেও নিয়ন্ত্রণহারা হয়নি। তিলে তিলে নিজেকে কষ্ট দেওয়ার পাশাপাশি বুকের ভেতর গড়ে তুলেছে মেয়েটার জন্য প্রগাঢ় প্রণয়, দৃঢ় ভালোবাসার মহাসিন্ধু। যার জন্য জীবনের খেই হারিয়ে নতুন করে বাঁচতে শিখেছে, শূন্য দু হাত আর শূন্য এক বুকে যে আকাশসম পূর্ণতা নিয়ে কাছে এসেছে। সেই তাকেই কিনা অন্য একটা পুরুষ প্রেম নিবেদন করেছে! চোখ দু’টো রক্তিম বর্ণ ধারণ করল সৌধর। চোয়াল দু’টো দৃঢ় হতে হতে হাড় ফুলে ফেঁপে ওঠল। অত্যধিক ক্রোধে কান দু’টো গরম হয়ে ধোঁয়া ছাড়তে শুরু করল যেন। শ্বাসনালি আঁটকে রইল এক মুহুর্ত। ফোনের ওপাশে ছেলেটা বলেই যাচ্ছে,
‘ সিমরান, কথা বলছ না কেন? তুমি তো জানো হঠাৎ করে তোমার বিয়ের খবর শুনে আমি কতটা কষ্ট পেয়েছি। তাই পরবর্তী যা করেছি সব আবেগে পড়েই৷ কিন্তু তুমি আমাকে ব্লক করার পর আমার বিবেক জেগে ওঠেছে৷ প্লিজ ক্ষমা করো, আমাদের বন্ধুত্ব টুকু শেষ করে দিও না। ‘
আর নিতে পারল না সৌধ। বিছানা থেকে তড়াক করে নেমে দাঁড়িয়ে কানে ফোন চেপে দাঁতে দাঁত পিষে বলল,
‘ স্ক’উন্ড্রেল, বাস্টা’র্ড তোর সাহস কী করে হয়? ‘
ক্রোধে জর্জরিত সৌধ উচ্চ কণ্ঠে এ পর্যন্ত বলতেই দরজার সামনে দাঁড়ানো সিমরান হতভম্ব হয়ে গেল। পায়ের গতি বাড়িয়ে ত্বরিত ঘরে ঢুকে বিচলিত কণ্ঠে বলল,
‘ কী হয়েছে সৌধ… ‘
ভাই টুকু উচ্চারণের পূর্বেই ফোন কানে ধরে ক্রোধে ভয়ানক রূপ ধরা সৌধ এমন করে তাকাল যে অন্তর আত্মা কেঁপে ওঠল মেয়েটার৷ নিমেষে ঢোক গিলে স্তম্ভিত মুখে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল। ফোনের ওপাশে থাকা ব্যক্তিটি ততক্ষণে ফোন কেটে বিপদের ভয়ে ফোনটা বন্ধ করে দিয়েছে। সৌধ সিমরানের থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে ফোনের দিকে রাখল। নিজেকে শান্ত করতে প্রায় এক মিনিট সময় লাগল ওর৷ এরপর বড়ো বড়ো করে শ্বাস নিল কতক্ষণ। সিমরান সরাসরি দৃষ্টি না দিয়ে আড়চোখে দেখল ওর ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে সৌধ ভাই। অনাকাঙ্ক্ষিত ভয়ে হাঁটু কাঁপতে শুরু করল ওর। মেরুদণ্ড দিয়ে বেয়ে গেল শীতল স্রোত। নিজের রাগটা নিয়ন্ত্রণ করতে দীর্ঘ সময় নিল সৌধ। এরপর ধীরেসুস্থে এসে দাঁড়াল সিমরানের মুখোমুখি। হাতে থাকা ফোনটা এগিয়ে ধরে চোয়াল কাঁপিয়ে দৃঢ় স্বরে শুধাল,
‘ নাম্বারটা কার? ‘
নাম্বারটা অচেনা। মন দিয়ে দেখল সিমরান৷ এদিক ওদিক মাথা নাড়িয়ে বুঝাল সে চিনে না। সৌধর দৃষ্টি কঠিন হলো। তপ্ত মেজাজে ধমকে বলল,
‘ কে বিরক্ত করে তোকে? ম্যারেড জেনেও কে তোকে প্রপোজাল দেয়? কতবার বলেছি এসব ছেলেমেয়ে সাথে মিশবি না। ‘
আকস্মিক বীভৎস ধমক খেয়ে কাঁধজোড়া কেঁপে ওঠে সিমরানের। নিমেষে ভোরের স্নিগ্ধ শীতল পরিবেশের উষ্ণ আদরটুকু ভুলে গিয়ে একরাশ ভয় আর দুঃখে কাতর হয়ে কাঁদতে শুরু করে। দমে যায় সৌধ। সরে যায় ওর সম্মুখ থেকে৷ তবে হাতে ধরিয়ে দেয় ফোনটা। সিমরান ফোন হাতে নিয়ে নাম্বারটা দেখে। ব্ল্যাক লিস্টে ঢুকে দেখতে পায় পরশের অগণিত ফোন আর ম্যাসেজ। তাহলে পরশই কল করেছিল? নিজের ক্রোধ টুকু সামলে নিয়েছে সৌধ৷ নিশ্চুপ বসে আছে বিছানায়। দু পা ফ্লোরে রাখা। হাঁটুতে কনুই ভর করে দু-হাত মুঠো করে কপালে মৃদু মৃদু ঘু ষি দিচ্ছে। সিমরানের বুক কাঁপতে শুরু করে। সৌধ ভাইকে পরশ কী বলেছে? ভুলভাল কিছু বলেনি তো? সৌধ ভাই তাকে ভুল বুঝল কী? সন্দেহ করল কী? এত রেগে গেছে কেন? কী বলেছে পরশ? না চাইতেও শব্দ করে কান্না চলে এলো মেয়েটার৷ ভয়ে ভয়ে এগিয়ে এলো সৌধর সামনে। এরপর ধপ করে বসে পড়ে হেঁচকি তুলে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
‘ আমি কিছু করিনি বিশ্বাস করো। তুমি ছাড়া আমার জীবনে কোনো পুরুষ আসেনি আর আসবেও না। ‘
সৌধর মাঝে কোনো পরিবর্তন দেখা গেল না৷ সিমরান যেন পাগলপ্রায় হয়ে গেল এবার। ওর সমস্ত ক্রোধ গিয়ে পড়ল পরশের ওপর৷ পরশকে পড়ে দেখে নেবে। আপাতত বরকে শান্ত করা চাই। সৌধ ভাই নিজ মুখে স্বীকারোক্তি না দিলেও সে টের পেয়েছে মানুষটা ধীরেধীরে তার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছে। ভালোবাসাটাও তৈরি হয়ে গেছে। এবার শুধু গভীর প্রণয়ে সিক্ত হবার পালা। এত ফাইট করে, সেক্রিফাইস করে অবশেষে মানুষটাকে আপন করে পেতে চলেছে সে। আর আজ কিনা সেখানে সন্দেহ, ভুল বোঝাবুঝি আসবে? তাও কিনা পরশের কারণে? নিমেষে ফুঁসে ওঠে সিমরান৷ ত্বরিত কল করে পরশের নাম্বারে। নাম্বার বন্ধ দেখায়। হতাশ হয় সে। অশ্রুসিক্ত চোখ আর অসহায় মুখে তাকায় স্বামীর পানে। ক্রন্দনরত কণ্ঠে বলে,
‘ সৌধ ভাই, তুমি আমাকে ভুল বুঝ না৷ এত রেগে থেকো না। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। ‘
অকস্মাৎ ভ্রু কুঁচকে তাকায় সৌধ। দেখতে পায় অশ্রুতে ভেজা লাল টকটকে মুখশ্রী। ঢোক গিলে ত্বরিত। কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলে,
‘ কেউ ডিস্টার্ব করলে আমাকে জানানো উচিত। ‘
‘ আসলে ও আমার বন্ধু ছিল। বন্ধু থেকে প্রেমিক হওয়ার আবদার করার পর থেকে সম্পর্ক নষ্ট হয়ে গেছে। আর সেদিন যখন আমি ম্যারেড জানার পরও পাগলামি করে এরপর থেকে সম্পূর্ণ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিই। ‘
সৌধর চোখ দু’টো থমকে আছে৷ সিমরান সে চোখে তাকিয়ে ভাষা গুলো বুঝতে পারল না। বোঝার কথাও নয়। সৌধর মস্তিষ্ক জুড়ে যে আকস্মিক হানা দিয়েছে নিধি আর অর্পণ। সে যেন তার আর সিমরানের মাঝে আজ ওই দু’জনকে দেখে নিল। কিন্তু ওই ছেলেটার মাঝে সে নেই৷ কারণ নিধির প্রতি তীব্র অনুভূতি থাকার পরও সে অন্যের বউ জানার পর একবারো ভালোবাসার দাবি নিয়ে সামনে দাঁড়ায়নি, ফোন করেনি। বরং সব সময় চেয়েছে নিধি ভালো থাকুক। মন দিয়ে সংসার করুক। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সৌধ। মনে প্রশ্ন জাগে আজ তার যে অনুভূতি হচ্ছে অর্পণেরও কি একই অনুভূতি হয়েছিল? নাহ তা কী করে হবে? সে তো কখনো ওদের জীবনে যাওয়ার চেষ্টা করেনি। পরোক্ষণেই মনে পড়ল, ঝোঁকের বশে হলেও নিধি তো চেয়েছিল। একজন পুরুষের কাছে এটা কতখানি যন্ত্রণার সে আজ টের পেল। সিমরান অমন কিছু চায়নি। তাকে শুধু একটা ছেলে প্রপোজ করেছে ব্যস এতেই তার সবটা কেমন উথাল-পাতাল হয়ে যাচ্ছিল! স্তব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সৌধ। সিমরানের চোখ গলে পানি পড়ছেই। হঠাৎ হাত বাড়িয়ে দু-চোখের পানি মুছে দিল সে। সিমরান ওর মন বুঝে ওঠে দাঁড়ালে সৌধ ওকে নিজের পাশে বসিয়ে শান্ত ভেজা কণ্ঠে বলল,
‘ নাম কী ছেলেটার? ‘
‘ পরশ। ‘
‘ থাকে কোথায়? ‘
সিমরান লোকেশন বলল ভয়ে ভয়ে। সৌধ ফের প্রশ্ন করল,
‘ কেমন বন্ধু?
ভীত হয় সিমরান৷ ক্ষীণ গলায় বলে,
‘ কী বলেছে পরশ? ‘
‘ ক্ষমা চেয়েছে। বিকেলে মিট করতে বলেছে।’
স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে সিমরান বলল,
‘ আমি মিট করব না। ওকে ক্ষমা করে দিলাম। পরেরবার যদি এমন ভুল করে তোমাকে জানাব। ‘
সৌধ শান্তি পেলো না। মনের ভেতর অদ্ভুত অশান্তি বিরাজ করতে লাগল। পরশ ছেলেটার খোঁজ নিতে হবে। এরপর যদি মনে হয় শায়েস্তা করা উচিত করবে নয়তো না। রুদ্ধশ্বাস ত্যাগ করে দেয়াল ঘড়িতে সময় দেখল। এরপর সিমরানের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ ভয় পেয়েছিস? ‘
সিমরান ঠোঁট কামড়াল। সৌধ স্মিত হেসে ওকে কাছে টেনে নিয়ে বলল,
‘ তোর তো খুশি হওয়া উচিত সিনু। আমি আজ নিজের প্রতি নিজেই অবাক হয়েছি। পাশাপাশি অনেক বড়ো দু’টো সত্যি অনুভব করেছি। প্রথম সত্যিটা আগামীকাল ভোরবেলা বলব। দ্বিতীয় সত্যিটা কী জানিস? ‘
সিমরান কিছু বলল না। দু’হাতে সৌধর পিঠ জড়িয়ে বুকে মাথা চেপে রইল। সৌধ ওর মস্তকে গাঢ় চুম্বন করে বলল,
‘ পরশ আমার চোখে যেমন আমিও অর্পণের চোখে তেমনি বোধহয়। তবে পরশের মতো ছ্যাঁচড়া ব্যক্তিত্ব আমার নয়। যে পরের বউকে প্রেম নিবেদন করব। ‘
.
.
চারিদিকে ফজরের আজান ধ্বনি শুনতেই চট করে চোখ খুলল সৌধ। পাশ ফিরে তাকাতেই দেখল, গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন সিমরান। বাঁকা হাসল আচমকা। বরাবরের মতো তার ঘুম প্রেয়সীর উষ্ণ, নরম ঠোঁটে আলতো ঠোঁট ছুঁইয়ে ত্বরিত ওঠে বসল৷ ঘুম কাতুরে সিমরান জানতেও পারল না এই নিয়ে ছ’বার তার অর্ধাঙ্গ তার অগোচরে ঠোঁটে ঠোঁট রাখল৷ রয়েসয়ে শীতল কণ্ঠে ডাকতে শুরু করল সৌধ৷ শীত মৌসুমে এই সময়টায় ওঠা তীব্র কষ্টের সিমরানের জন্য। তবু ওঠতে হবে। তাই আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে ওঠে বসল৷ এরপর ওরা দু’জন মিলে ফজরের নামাজটা সেরে নেওয়ার পর সৌধ বলল, জলদি পোশাক পরিবর্তন করতে। তাকে নিয়ে বেড়াতে যাবে সে। সিমরান প্রথমে বুঝতে না পরক্ষোণেই বুঝতে পারল জন্মদিন উপলক্ষেই তার বর তাকে নিয়ে ঘুরতে বেরুবে। বারোটায় উইশ করে ঘুমিয়েছিল সে৷ ফের এখন উইশ করে কাভার্ডের দিকে এগুলো। সৌধ ওর যাওয়ার পথে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলল,
‘ আজ সারাদিনটা যেমন স্মরণীয় হবে। তেমনি দিনশেষে যে রাতটা আসবে ওটাও তোর সমস্ত সত্তায় স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ‘
একটু হাঁটাহাঁটি করতে বেলকনিতে গেল সৌধ৷ সিমরান গাঢ় সবুজ রঙের একটি স্কার্ট আর লাল রঙের লেডিস শার্ট বের করে বিছানায় রাখল৷ মনে পড়ল রুমটা ঝাড় দেয়া হয়নি৷ নিজের ঘর এখন নিজেই ঝাড়ু দেয় সে। তাই চটজলদি রুম ঝাড়ু দিয়েই বাথরুম ঢুকে পড়ল। অল্প পরিসরে গোসল সেরে নিলেও চুল ভেজাল না৷ ভেজা কাপড় ছেড়ে শুকনো কাপড় পরতে উদ্যত হতেই আচমকা খেয়াল হলো, সে রুম ঝাড়ু দিয়ে কাপড় না নিয়েই বাথরুমে ঢুকেছে!
বেলকনিতে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ সুহাসের টেক্সট নজরে আসে সৌধর। রাত দু’টোয় টেক্সট এসেছে।
‘ দোস্ত দুই তারিখ ভিসা আসার কথা না? আর নয়দিন তাই না? সময় এত স্লো যাচ্ছে মেজাজটাই খারাপ লাগতাছে। ‘
টেক্সটটা পড়তে পড়তে ঘরের ভেতর এলো সে। সহসা নজড়ে পড়ল বিছানায় সিমরানের কাপড় আর বাথরুমের দরজা বন্ধ। ভ্রু কুঁচকে ফেলল অমনি। গলা উঁচিয়ে বলল,
‘ সিনু, কাপড় নিস নি কেন? ‘
প্রশ্নটা করেই মনে মনে ভাবল,
‘ আমার বোধহয় তুই ডাকটা শুধরানো উচিত। ‘
সিমরান ভেতর থেকে বলল,
‘ সৌধ ভাই, তাড়াহুড়োয় কাপড় রেখেই চলে আসছি। একটু দাও না।। ‘
ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ছেড়ে মৃদু হাসি ঠোঁটে এঁটে কাপড় গুলো নিয়ে সিমরানকে দিয়ে এসে বিছানায় বসল। ফোনের স্ক্রিনে চোখ বুলিয়ে সহসা ডানপাশে চোখ যেতেই থমকে গেল হৃৎস্পন্দন। কাপড় গুলোর সাথে সাদা রঙের একটি অধোবস্ত্র ছিল। যা বিছানাতেই রয়ে গেছে। নিমেষে মাথা ঝাড়া দিয়ে ওঠল সৌধ৷ হালকা কাশিও ওঠল বেচারার৷ এরপর স্বাভাবিক ভঙ্গিতে দু আঙুলে ছোট্ট বস্ত্রটা তুলে ধরে নিয়ে গেল বাথরুমের সামনে। সে নিশ্চিত এখন এটা দেয়া মানে আজ সারাদিন মেয়েটা লজ্জায় টইটম্বুর হয়ে থাকা। তবু পিছুপা হলো না৷ অনেক তো হলো জড়তা, ভীরুতা। অনেক হলো দূরত্ব। এবার সম্পর্কে পূর্ণতা দেয়ার পালা৷ তাছাড়া দিন পেরিয়ে রাত ঘনালেই আজ মেয়েটাকে সম্পূর্ণরূপে নিজের করে নেবে। উজার করে দেবে নিজের সবটুকু। এ মুহুর্তে হয়তো সিমরান অতি লজ্জায় কয়েকশতবার কোমা পেশেন্টদের মতো আচরণ করবে। ব্যাপার না, এখন থেকে বউয়ের সব লজ্জা শুষে নেয়ার দায়িত্ব তার৷
®জান্নাতুল নাঈমা
আর এক পর্ব। এরপর অতীত শেষ। অতীতটাকে মিস করব ভীষণ। কিন্তু বর্তমানে তো ফিরতেই হবে। আমাদের সবার প্রিয় নামী আর তার ছোট্ট শিশুটির খবর নিতে হবে না?