বৃষ্টি থেমেছে। জানালার থাই গ্লাসে বৃষ্টিফোঁটাদের চিহ্ন রয়ে গেছে। সেদিকে নির্নিমেষে তাকিয়ে অজস্র চিন্তায় নিমজ্জিত সিমরান। এ পৃথিবীতে আগত সবকিছুই বিদায়বেলা চিহ্ন রেখে যায়। পৃথিবীতে বৃষ্টি নেমেছিল। সে বৃষ্টি থেমেও গেছে। রেখে গেছে জানালার থাই গ্লাসে চিহ্ন। ঠিক তেমনি নামী এসেছিল সুহাসের জীবনে। চলেও গেছে। চিহ্ন হিসেবে রেখে গেছে এক গুচ্ছ ভালোবাসাময় স্মৃতি। শুধু কি চিহ্ন রেখেই গেছে নিয়ে যায়নি? সুহাসের ভালোবাসা, রাগ, জেদ, অভিমান, অপমানের পাশাপাশি আরো অনেক বড়ো একটি চিহ্ন নিজের ভেতর নিয়ে যায়নি? গিয়েছে তো। এ পৃথিবীতে এখন তাদের কাছে সবচেয়ে মূল্যবান যা ঠিক তাই চিহ্ন হিসেবে নিয়ে গেছে নামীপু। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সিমরান৷ শান্ত দৃষ্টিতে দরজার পানে তাকাল। খোলা দরজা। দৃষ্টি যতটুকু যায় ততটুকুই দেখে চোখ ফিরিয়ে নিল। সৌধ ভাই বোধহয় আসবে না৷ তার ভাইটা নিশ্চয়ই অনেক বেশি পাগলামি করছে? প্রিয় বন্ধুকে সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে সৌধ আর আইয়াজ ভাই৷ বিছানা ছেড়ে নেমে দাঁড়াল সিমরান৷ হাই তুলতে তুলতে ভাবল, সে ঘুমিয়ে পড়বে। মনটা ভারাক্রান্ত, দেহটাও আর সায় দিচ্ছে না। চোখ দু’টো খুলে রাখা দায় হয়ে পড়ছে। ধীরস্থির ভাবে হেঁটে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিল৷ ফিরে আসার পথে বাঁধা পেল মনে। রাত এখনো শেষ হয়নি। কেবল মাঝরাত। যদি সৌধ ভাই তার ঘরে আসে? আকস্মিক সিমরান অনুভব করল, তার বুকে শীতল শিহরণ বইছে। সময় কী নিদারুণ ভাবেই না বদলে যায়৷ এতদিন সে এ বাড়িতে এ ঘরে রাজত্ব করে বেরিয়েছে। এ বাড়ির মেয়ে সে৷ এ ঘরটা তার একদম নিজস্ব। অথচ আজ ঘুমাতে গেলেও ভাবতে হচ্ছে। দরজা আটকাতে গেলেও বোধ করছে দ্বিধা। এটাকেই কি বলে দায়বদ্ধতা? ভালোবাসা থাকলে সব ধরনের দায়বদ্ধতা গ্রহণ করেও শান্তি। সহসা ঘুরে গিয়ে দরজা খুলে ত্বরিত বিছানায় চলে এলো। সে এখন ঘুমাবে। যদি সৌধ ভাই আসে তাহলেও সমস্যা নেই। সে দরজা খোলাই রেখেছে। ওই মানুষটার জন্য তার মনের দরজা, ঘরের দরজা সব সময় খোলা। ভাবতে ভাবতে মনের কোণে মৃদু সুখ ঠোঁটের কোণে লাজুক হাসি বজায় রেখে ঘুমের দেশে পাড়ি জমালো।
.
.
সুহাসের বিছানাটা আলিশান৷ হাত, পা মেলে দিয়ে তিনজন অনায়াসে ঘুমাতে পারবে৷ তাই তিন বন্ধুর পাশাপাশি শোয়াতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয়নি। দীর্ঘ একটা সময় পর শান্ত হয়েছে ছেলেটা৷ বলা যায় সৌধ আর আইয়াজ মিলে শান্ত করেছে ওকে। রাত গভীর হতে হতে এক পর্যায়ে শান্ত হয় উন্মাদ সুহাস৷ কিন্তু দু-চোখ বেয়ে ঝরতে থাকে নোনাপানির ধারা। তিন বন্ধুর মাঝে সুহাস সবচেয়ে ডানপিটে স্বভাবের হলেও মনের দিকে প্রচণ্ড দুর্বল। এই দুষ্টুমি, অবুঝ রাগ আর দুর্বলতা গুলো আজ যেন ওর কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। চোখের সামনে সুহাস এভাবে ভেঙে পড়বে আর সৌধ, আইয়াজ সেটা দেখে চুপ থাকবে? এমনটা হতেই পারে না৷ তাই তো দু’জনই অর্ধাঙ্গিনীর কাছে না ফিরে বন্ধুর কাছে ঘাপটি মেরে পড়ে রইল। সুহাসও লম্বা একটা সময় স্থবির হয়ে শুয়ে থাকার পর অকস্মাৎ মুখ খুলল। সেদিন তার আর নামীর মাঝে কী কী ঘটেছিল বিবৃতি করল সবটা। সৌধ পুরো ঘটনাটিই জানত। তাই ওর মাঝে নতুন করে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। কিন্তু আইয়াজ ঘেমে ওঠল। মৃদু ক্রোধ প্রকাশ করে বলল,
‘ এই রাগটাই তোর সব খাচ্ছে! আর গায়ে হাত তুলতে গেছিস কোন দুঃখে? কার গায়ে হাত তুলেছিস! তোর বউ নামী। ভাই, মেয়েটাকে এখনো চিনতে পারিসনি তুই। নামী কোন ধরনের মেয়ে এটা যদি এখনো না বুঝিস তবে তো ওর তোকে ছেড়ে চলে যাওয়াই ভালো। শোন সুহাস, মুখ থাকলেই সব বলা যায় না৷ গায়ে জোর থাকলেই সবকিছু করা যায় না। তুই ভুল করেছিস। বউ হচ্ছে আদরের জিনিস। তাকে আদরে রাখতে হয়। নারীদের কোমলপ্রাণ। তাদেরকে সব সময় কোমল আচরণই দিতে হয়। রাগ, দেখিয়ে ব কাব কি করে, মারধর করে বউকে না ধরে রাখা যায় আর না বউয়ের মন পাওয়া যায়। আর তোর বউ এমনিতে শান্তশিষ্ট হলেও প্রখর আত্মমর্যাদা সম্পন্ন মেয়ে। যেমন একরোখা, তেমন জেদি। তাই এগুলো মাথায় রেখে বিবেচনা করে চলা উচিত ছিল। ‘
এক নিঃশ্বাসে বলা আইয়াজের কথা গুলো শুনে
সহমত পোষণ করল সৌধ। আইয়াজ ক্রোধান্বিত হয়ে কথাগুলো বললেও ওর কণ্ঠস্বর নিচে ছিল বলে সেগুলো স্বাভাবিকই শোনালো। সুহাস মন দিয়েই শুনল ওর কথা। এরপর সৌধ বলল,
‘ আমি সম্পূর্ণ দোষ আমার বন্ধুকে দিব না। কারণ এই পৃথিবীতে সব মানুষ সমান বোঝদার হয় না। সুহাসের উচিত হয়নি নামীর ক্যারেক্টার নিয়ে প্রশ্ন তোলার। নিঃসন্দেহে এটা ভুল। গায়ে হাত তুলেও অপরাধ করেছে। তাই নামীর অ্যাকশন এভাবে না নিয়ে অন্যভাবে নেয়া উচিত ছিল। যাইহোক এখন অনেক উচিত, অনুচিত কথা আমরা বলবই। কাল সকালে যখন বাড়ির সবাই এসব জানতে পারবে তারাও নানারকম মন্তব্য করবে৷ তবে সেই পরিস্থিতিতে দাঁড়ালে আমরা নিজেরা কতটুকু উচিত কাজ করতে পারতাম তা অবশ্য জানা নেই। ‘
এ পর্যন্ত বলেই থামল সৌধ। সময় নিয়ে ফের বলল,
‘ নামীকে আমি বোন বলি। সে হিসেবে আমার বোনের গায়ে হাত তোলার জন্য, তার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলার জন্য তোকে আমার মা রা উচিত সুহাস। আটকে গেছি দু’টো জায়গাতে, এক, বন্ধু আমার তুই, অপরাধ করে এতগুলো মাস ভুগছিস আজ থেকে ভুগান্তি আরো বেড়ে গেল। এতদিন বউয়ের জন্য মন কেঁদেছে এখন যোগ হলো বাচ্চার জন্য কান্না। মানসিক যন্ত্রণার উপর আর কোনো বড়ো শাস্তি আছে বলে জানা নাই। দুই নাম্বার হচ্ছে, তুই এখন সম্পর্কে সিনিয়র হয়ে গেছিস। ‘
তীব্র বিষাদ অনুভূতিও এক টুকরো হাসি দেখা দিল ওদের মাঝে৷ হঠাৎ তড়াক করে ওঠে বসল সুহাস৷ সবেমাত্র বিয়ে হয়েছে সৌধ, সিনুর৷ আজ বিয়ের দ্বিতীয় দিন, দ্বিতীয় রাত। অথচ সৌধ কিনা তার বোনের কাছে না গিয়ে তার কাছে পড়ে আছে। ওরা দু’জন কাছাকাছি না থাকলে সম্পর্কটা এগুবে কী করে? নিজের জীবনে সমস্যা বলে সেই সমস্যায় সবাইকে জড়ানোর মানে হয় না। আইয়াজটাও বউ ছেড়ে তার কাছে পড়ে আছে। সে অনিচ্ছায় বউ ছেড়ে হাপিত্যেশে ম রে যাচ্ছে। আর এরা স্বেচ্ছায় বউ ছাড়া রয়েছে। ভেবেই সৌধর দিকে বিব্রত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
‘ সিনুর ঘরে যা সৌধ। ‘
থতমত খেয়ে গেল তিনজনই। নিমেষে পরিস্থিতি আবার স্বাভাবিক করে ফেলল সৌধ৷ ওঠে বসে দৃঢ় গলায় বলল,
‘ সিনু এখনো জেগে নেই। নিজের ঘরে, একান্ত বিছানায় নিজের মতো ঘুমাচ্ছে ঘুমাক। আপাতত তোর ঘর ছেড়ে কোথাও যাচ্ছি না৷ তুই খুব একটা সুবিধার ছেলে না। এটা আমি খুব ভালো করেই জানি। ‘
সৌধর কথা শুনে আইয়াজের দিকে তাকাল সুহাস। আইয়াজও ওঠে বসতে বসতে বলল,
‘ আমিও আজ ফারাহকে ফ্রি করে দিয়েছি। তোকে ফ্রি করে আপাতত যাওয়া সম্ভব না৷ যা ক্ষ্যাপাটে তুই। উল্টাপাল্টা করে বসলে নামী বিধবা হবে। আর হবু ভাতিজা/ ভাতিজি বাপ হারাবে। ‘
স্তব্ধ হয়ে গেল সুহাস। ওরা মজার সুরে কথাগুলো বললেও ওর ভেতরটা তোলপাড় শুরু হলো। সে এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না, নামী মা হতে চলেছে। আর এমন একটা সুখবর, রক্ত শীতল করা সংবাদ না জানিয়েই নামী তাকে ছেড়ে চলে গেছে সুদূর অ্যামেরিকায়! সন্তর্পণে চোখ দুটো বুঁজে ফেলল সুহাস। নিশ্বাস ছাড়ল বড়ো বড়ো করে। অনুভব করল কাঁধে হাত রেখেছে সৌধ। আচমকা দৃষ্টি মেলে তাকাতেই ভরসার সঙ্গে সৌধ বলল,
‘ আমি জানি ভুল তুই করেছিস। সম্পূর্ণ দোষ তোর। কিন্তু নামীকে আমি সেভ সাইটে রাখতে পারছি না৷ তুই কেমন জানে ও। তাছাড়া সবকিছুর পরও তুই বাবা হতে যাচ্ছিস। তোরা স্বামী-স্ত্রী। তোর সন্তান ওর গর্ভে৷ ওর উচিত ছিল এটা তোকে জানানো৷ কী একটা কাণ্ড ঘটাল বলত। গর্ভের বাচ্চাকে মা একাই ক্যারি করে। নামীও করছে৷ কিন্তু সাপোর্ট হিসেবে তো স্বামীকে লাগে। পরিবারকেও প্রয়োজন হয়। ‘
নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে সুহাস বলল,
‘ বেবি কনসিভ করলে মেয়েদের মুড সুইং হয় সৌধ। নামীরও হচ্ছিল বোধহয়। তখন না বুঝলেও এখন বুঝতে পারছি। ওর মধ্যে অনেকরকম সিমটমস দেখা দিয়েছে। যা তখন খেয়াল না করলেও এখন করতে পারছি। হয়তো এজন্যই তখন ওর মাঝে রাগ, অভিমানটাই বেশি কাজ করেছে। ‘
‘ গ্রেট ইম্প্রুভমেন্ট! ‘
শব্দ দু’টো উচ্চারণ করেই পাশ থেকে আইয়াজ জাপ্টে ধরল সুহাসকে। সৌধর চোখ দু’টোও চকচক করতে লাগল। অনুভব করল, সুহাসের মাঝে এখন কোনো রাগ কাজ করছে না৷ এখন ওর মাঝে শুধু আবেগ, আর অনুতপ্ততা কাজ করছে। সবচেয়ে বড়ো কথা সুহাস এখন বাবা হতে চলেছে। বাবারা উদার হয়৷ উদার হতেই হয় তাদের। প্রশান্তি ভরে শ্বাস নিয়ে মৃদু হাসল সৌধ। শুনতে পেল নিজে থেকেই সুহাস বলছে,
‘ আসলে কী বলব আমি বুঝতে পারছি না। আমি কি আসলেই অমানুষ হয়ে গেছি সৌধ? আইয়াজ,
নামী নিশ্চয়ই আমাকে অমানুষ ভেবে কিছু জানায়নি। সেদিনের সেই আচরণ উফফ। ভাবতে পারছি না, আমাদের সন্তানও ছিল আমাদের মাঝে। মাই বেবি! ‘
তীব্র কষ্টে চোখ, মুখ কুঁচকে ফেলল সুহাস। বলল,
‘ আচ্ছা ওর মায়ের মতো অও কি আমাকে খারাপ ছেলে ভাবল? অমানুষ ভাবল? ‘
পরোক্ষণেই চমকে গেল। বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে পলক ফেলল বারকয়েক। থেমে থেমে বলল,
‘ আমি সেদিন নামীর সাথে প্রচণ্ড চ্যাঁচামেচি করেছি। আচ্ছা ও কি ভয় পেয়েছে? পায়নি নারে। ওর মা তো খুব সাহসী। ও ওর মায়ের মতোই সাহসী হবে দেখিস। ‘
সুহাসের বুক কাঁপছে। চোয়াল দু’টোও কম্পমান। ঠোঁট দু’টো বার বার শুষ্ক হয়ে ওঠছে। যা ভিজিয়ে নিচ্ছে জিভ দ্বারা। বন্ধুর আবেগঘন কথা শুনে
আইয়াজের চোখ চিকচিক করে ওঠে। সৌধ ঠোঁট চেপে দীর্ঘশ্বাস ফেলে শক্ত হাতে সুহাসের কাঁধ চেপে ধরে বলে,
‘ এত দুর্বল হলে চলবে না সুহাস। তোকে শক্ত থাকতে হবে। নিজের ভুলগুলো শুধরে সঠিক পথ বেছে নিতে হবে। সবচেয়ে বড়ো কথা এখন তোকে নামী অবধি পৌঁছাতে হবে, এট এনি কস্ট! ‘
‘ আমার মাথা কাজ করছে না। আমি ভুল করে ফেলেছি সৌধ। আমি আমার স্ত্রী, সন্তান দু’জনকেই কষ্ট দিয়েছি। নামী আমাকে ক্ষমা করবে না বলেই এভাবে দূরে চলে গিয়েছে। ও আমাকে অনেক বড়ো শাস্তি দিতে চায় সৌধ। ও আমাকে একেবারে নিঃশ্ব করে দিতে চায়। আমি নিঃশ্ব হতে চাই না। প্লিজ নামীকে বোঝা। ‘
মাথা নিচু করে কাঁপা স্বরে কথাগুলো বলতেই হঠাৎ সৌধ বলল,
‘ কাল সকালে তোর শশুরের সাথে যোগাযোগ করবি। যতদ্রুত সম্ভব ভিসা রেডি করে চলে যা অ্যামরিকায়। ফিরে আয়, নামী আর বাচ্চা দু’জন নিয়ে। ‘
চোখ দু’টো জ্বলে ওঠল সুহাসের৷ দপ করে মাথা তুলে টলমল দৃষ্টিতে কিয়ৎক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর ঠোঁট চেপে মাথা নাড়ল।
.
.
স্বভাবসুলভ ভোরবেলা বিছানা ছাড়ল সৌধ৷ সারারাত তিনজনের কারোরি ঘুম হয়নি। শেষরাতে চোখ বুঁজলেও প্রকৃতপক্ষে কেউ ঘুমাতে পারেনি। শরীরচর্চা আজ করা হবে না৷ তাই ঘরের বাইরে গিয়ে কিছুক্ষণ সময় হাঁটাহাঁটি করল সৌধ। এরপর ধীর পায়ে চলে এলো সিমরানের ঘরে। ভেবেছিল দরজা বন্ধ। নক করতে হবে। কিন্তু না বুঝতে পারল, দরজা খোলা রেখেই ঘুমিয়েছে। তবে কী সিনু অপেক্ষায় ছিল তার জন্য? এক মুহুর্ত থমকে দাঁড়িয়ে ভেতরে প্রবেশ করল। ঘরের বাতি জ্বালানো। দরজাটাও খোলা। যা বোঝার বোঝা হয়ে গেল সৌধর। ঘরে ঢুকতেই দৃষ্টি চলে গেল বিছানায়। নিমেষে দৃষ্টি সরিয়ে বিব্রত ভাবে বেলকনির দিকে চলে গেল৷ শুধুমাত্র একটি টিশার্ট আর ঢিলে পাজামা পরিহিত সিমরানের। আরামদায়ক এই পোশাকটা পরেই ঘুমিয়েছে সে। ঘুমের ঘোরে পাজামা উপরে ওঠে গেছে, ঢিলেঢালা টি-শার্টের লম্বা গলার জন্য বুকের কিঞ্চিৎ অংশ দৃশ্যমান৷ প্রথম দফায় স্ত্রীর ঘরে ঢুকছি এমন মনোভাব নিয়ে ঢুকলেও পরবর্তীতে সিনুকে এমন এলেমেলো দেখে, ঘুমন্ত অবস্থায় দেহশ্রীর আকর্ষিক অংশ গুলোয় চোখ পড়তেই কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেল। এক মন বলল, উচিত হয়নি ঘরে ঢোকা। আরেক মন বলল, সিনু আমার বউ, অনুচিতই বা হবে কেন? নিজেকে ধাতস্থ করতে অনেকটা সময় লাগল সৌধর৷ পুবাকাশে সূর্যের দেখা মিলেছে। চারপাশে ফিকে কমলা বর্ণটা ধীরেধীরে গাঢ় কমলায় পরিণত হচ্ছে। প্রকৃতিতে দৃষ্টি বুলিয়ে অকস্মাৎ সমস্ত আড়ষ্টতা ত্যাগ করে ঘরে গেল সৌধ। তাকাল সিমরানের দিকে। গতকাল কেমন গুটিশুটি মেরে শুয়েছিল তার ঘরে আজ নিজের ঘর, নিজের বিছানা পেয়েই সমস্ত জড়তা ভুলে নিজ ছন্দে ঘুমুচ্ছে। বাঁকা হাসল সৌধ। ধীরপায়ে এগুলো বিছানার দিকে। সিনু নিঃসন্দেহে সুন্দরী আর অনেক বেশি আদুরে। কিন্তু ঘুমুন্ত অবস্থায় ওর সেই সৌন্দর্যের মাত্রা এতবেশি বেড়ে যায় জানা ছিল না। পিচ্চি পিচ্চি আদলের এই ঘুমন্ত মেয়েটা এখন তার বউ৷ ভাবতেই বুকের ভেতর অচেনা তরঙ্গ বইতে লাগল। বিছানার একপাশে থাকা পাতলা চাদরটা টেনে ত্বরিত জড়িয়ে দিল সিমরানের শরীরে। না হলে পরিপূর্ণ ভাবে তাকাতে পারছে না। শত হোক আবেদনময়ী তরুণী দেহশ্রী। তার মতো প্রাপ্তবয়স্ক এক যুবকের চোখ সেখানে পড়লে শরীরের রক্তকণিকা ছুটোছুটি করবেই। বউয়ের শরীর ঢেকে দিয়ে রুদ্ধশ্বাস ছাড়ল সৌধ৷ এরপর দৃঢ় গলায় ডাকতে আরম্ভ করল,
‘ সিনু, অ্যাঁই মেয়ে। ওঠ, সকাল হয়ে গেছে৷ বেলা করে ঘুমানো শরীরের পক্ষে খুবই ক্ষতিকর। ‘
নড়েচড়ে ওঠল সিমরান৷ হালকা সজাগ হয়েছে বুঝতেই গলার স্বর কিঞ্চিৎ উঁচু করল সৌধ। বলল,
‘ ওঠে যা। এখন থেকে রোজ তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে ওঠবি৷ নামাজের অভ্যেস করতে হবে, শরীরচর্চা করতে হবে। বেলা বাড়িয়ে ঘুমিয়ে জীবন কাটানো যাবে না। ‘
চোখমুখ কুঁচকে ওঠে বসল সিমরান৷ ঘুম ছাড়িয়ে হাত, পা ছেড়ে বিরক্ত মুখে চোখ খুলতেই চোখের সামনে সৌধকে আবিষ্কার করল। নিমেষে কপালের সবগুলো ভাঁজ মিলিয়ে, ঘুম উড়ে গেল। শরীর ঝাড়া দিয়ে বসে স্তম্ভিত মুখে তাকিয়ে রইল। সৌধ ওর দিকেই তাকিয়ে। তাই টের পেল ওর ঘুমের রেশ পুরোপুরি কাটেনি। মৃদু কেশে ওঠল সে। শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে শীতল গলায় বলল,
‘ কফি ছাড়া সকাল শুরু হয় না আমার। তার ওপর সারারাত ঘুম হয়নি। মাথাটা ধরে আছে। দ্রুত ফ্রেশ হয়ে নিচে যাবি৷ কফি তো বানাতে পারিস? ‘
ত্বরিত মাথা ঝাঁকাল সিমরান। কাঁধ ঝাঁকিয়ে ওঠে দাঁড়াল সৌধ। বলল,
‘ অকে, দু মগ কফি নিয়ে আয়। বেলকনিতে বসে খাব। আর প্রাথমিক কিছু ব্যয়াম দেখাব ইউটিউবে। কাল থেকে এগুলো ফলো করবি। আমি যতদিন ছুটিতে আছি একসঙ্গে শরীরচর্চা করব। ‘
.
.
আইয়াজ আর ফারাহ ব্যাগপত্র রেডি করে বাড়ির সকলের থেকে বিদায় নিল। ওদের গাড়িতে ওঠিয়ে দিতে এগিয়ে এলো, বিষণ্ণ মুখের সুহাস৷ সৌধ আর সিমরানও এলো। ফারাহ সুহাস আর সৌধ ভাইয়ের থেকে বিদায় নিয়ে সিমরানের সামনে এসে ওকে জড়িয়ে ধরল। কানে কানে বলল,
‘ নতুন জীবনের জন্য শুভকামনা বনু। ধৈর্য রেখে শুধু ভালোবেসে যাও। আজ যতটুকু সেক্রিফাইস করছ কাল তারচে চারগুণ বেশি পাবে৷ কারণ তোমার নীতি ঠিক আর চয়েজটা মারাত্মক। ‘
আরক্ত মুখে হাসল সিমরান। বলল,
‘ দোয়া করো আপু। ‘
ফারাহ গাড়িতে ওঠে বসল। সৌধ আইয়াজকে বিদায় দেয়ার সময় বলল,
‘ টেনশন নিস না। আল্লাহ তায়ালা যখন চাইবে তোদের কোলজুড়েও ফেরেশতা আসবে। আর শোন, বউকে দূরে রাখিস না৷ চেষ্টা কর এক হসপিটালে থাকার। ‘
‘ করছিরে। টাকা, পয়সাও দিয়ে রাখছি। দু’জন এক জায়গায় থাকলে সুবিধা হয়। দূরে দূরে থেকে টাকা, পয়সার জন্য ছুটে জীবনে সংসার, পরিবার হয়ে ওঠে না৷ ‘
বুকে বুক মেলালো আইয়াজ, সৌধ। এরপর সুহাসের কাছে এসে সুহাসকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আইয়াজ বলল,
‘ চিন্তা করিস না, সব ঠিক হয়ে যাবে। ‘
বন্ধু, আর বন্ধুর বউ চলে গেলে সৌধ সিমরানকে বলল বাড়ির ভেতরে যেতে। সিমরান সঙ্গে সঙ্গে ভেতরে চলে গেল। সৌধ সুহাসের মুখোমুখি হয়ে বলল,
‘ ভেতরে গিয়ে আংকেলকে জানা বিষয়টা। আমি একটু বেরুচ্ছি। ‘
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সুহাস ভেতরে চলে গেল। সৌধ তৎক্ষনাৎ পকেট থেকে সেলফোন বের করে কল করল নিধিকে।