ত্রিধারে তরঙ্গলীলা | পর্ব – ৬১

ভোরের স্নিগ্ধ আলোকরশ্মি চোখে পড়তেই ঘুম ভেঙে যায় নিধির৷ ক্ষণকাল ব্যয় করে মস্তিষ্ক সজাগ করে। পাশে তাকিয়ে দেখে অর্পণ ঘুমিয়ে৷ বুকের মাঝে অনিরূপকে আগলে নিয়ে। নিষ্পাপ শিশুটি বাবার বক্ষদেশে কী নির্ভার, প্রশান্তিময় ঘুম ঘুমাচ্ছে৷ দৃষ্টিজোড়ায় মুগ্ধতা ছড়িয়ে পড়ে। স্মিত হেসে মুগ্ধ দৃষ্টিদ্বয় ফিরিয়ে নেয় নিধি৷ ত্বরিত খোলা চুলে হাত চালায়। দৃঢ় করে খোঁপা বাঁধে। বিছানা ছাড়তে উদ্যত হলে আচমকা থেমে যায়। সেলফোন খুঁজে সময় দেখে৷ লক ছাড়িয়ে ঢুকে ফেসবুক অ্যাপে। নিউজফিড স্ক্রল করতে গিয়ে চোখ আঁটকে গভীর রাতে সৌধর আইডি থেকে পোস্ট করা একটি ভিডিয়োতে। সৌধর রুম৷ ফ্লোরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে ওর কাজিন মহল আর বন্ধুরা৷ সকলের মাঝখানে গিটার হাতে সৌধ৷ পাশে কফির মগ হাতে আইয়াজ বসে। সৌধর মুখে হাসি নেই৷ চোয়াল দ্বয় দৃঢ়, চোখ দু’টো এক মনে গিটারে স্থির। দেখে কেউ বলবে না রাত পেরুলে তার শুভবিবাহ। পুরু ঠোঁটজোড়া নড়ছে বিরতিহীন। কী তীক্ষ্ণ সুর, কী গভীর ছন্দ!
কবিতা,
তুমি স্বপ্নচারিণী হয়ে খবর নিও না..
কবিতা,
এই নিশাচর আমায় ভেবোনা সুখের মোহনা।
দেখবে আমাদের ভালবাসা,
হয়ে গেছে কখন যেন
পদ্ম পাতার জল, পদ্ম পাতার জল।
কবিতা,
তুমি স্বপ্নচারিণী হয়ে খবর নিও না
কবিতা,
এই নিশাচর আমায় ভেবোনা সুখের মোহনা।
বেদনা সিক্ত অশান্ত এই মন
খুঁজে ফেরে মেটায় প্রয়োজন,
যতদূর জানে এ ব্যাকুল হৃদয়
নীল বিষের পেয়ালা মনের বাঁধন।
দেখবে আমাদের ভালবাসা,
হয়ে গেছে কখন যেন
পদ্ম.. পাতার জল,
পদ্ম.. পাতার জল।
কবিতা,
তুমি স্বপ্নচারিণী হয়ে খবর নিও না…।
.
.
ভিডিয়োর সমাপ্তিতে সকলের হাততালি। সৌধর অধরে বাঁকা হাসি৷ নিমেষে নিধির বুক ধক করে ওঠে। থম মেরে বসে রয় দীর্ঘক্ষণ৷ পরোক্ষণেই হৃৎস্পন্দন কেঁপে ওঠে। আজ যে সৌধ, সিনুর বিয়ে! সে সহ তার পুরো পরিবার আমন্ত্রিত। এই আমন্ত্রণ এসেছে চৌধুরী বাড়ি থেকে৷ সুহাসের তরফ থেকেও এসেছে। সৌধ বা সিনু দু’জনের কারো থেকেই আলাদা ভাবে আমন্ত্রণ বাক্য পায়নি। এক টুকরো দীর্ঘশ্বাস বেরোয় বুক চিরে। বেলাশেষে সৌধর প্রতি যাই অনুভব করুক না কেন৷ আজ তার কোনো মূল্য নেই৷ কিন্তু বেলা ওঠতে যে অনুভূতি নিয়ে দুপুর গড়িয়ে বিকেল এসেছে তাদের জীবনে? সেই বন্ধুত্ব। সেটাও কি ঠুনকো হয়ে গেছে? নিঃশ্বাসে অস্থিরতা বাড়ে নিধির। অনেকক্ষণ নিশ্চুপ বসে থেকে মনে মনে বলে, তার প্রতি সৌধর অনুভূতি মিথ্যে ছিল না৷ যতই নিজেকে সামলে নিক। গুছাতে উদ্যত হোক। পুরোনো স্মৃতি, অতীতে পাওয়া আঘাত কোনোটাই মুছে যায়নি৷ ভুলে যায়নি সৌধ। আর এই যে আজ সে বেলাশেষে নিজের অনুভূতিকে পুরোপুরি জেনে গেল৷ সেটাও মিথ্যা না৷ সব চন্দ্র, সূর্যের মতোই সত্য আর দৃশ্যমান। সৌধ তার জীবনে বেস্ট ফ্রেন্ডের চেয়েও বেশি কিছু ছিল। যা সময় থাকতে সে বুঝতে পারেনি। অনেক সময় হয়তো বুঝেও অবহেলা করেছে। সবশেষে সে সবার কাছে অপরাধী। নিজের কাছেও। সময় থাকতে নিজের অনুভূতিকে গুরুত্ব না দেওয়া, সময় চলে গেলে আপনাআপনিই অনুভূতিদের টের পাওয়া অপরাধই বটে। এই দায় আসলে নিজেরই। অন্য কারো নয়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিধি। ঘুরে তাকায় স্বামী, পুত্রের দিকে। ভাবে, ভালোই হয়েছে। সৌধ বা সিনু তাকে আমন্ত্রণ করেনি। ওদের বিয়েতে তার উপস্থিতি কারো জন্যই স্বস্তিকর হবে না। সবচেয়ে বেশি অস্বস্তিতে পড়বে অর্পণ, সে, সৌধ আর সিনু। কী দরকার এক সঙ্গে দুই দম্পতিকে অস্বস্তিতে ফেলার? ঠোঁটের কোণে হাসি থাকলেও চোখের কার্ণিশে জল গড়াল। টের পেয়ে আঁতকে ওঠল নিধি৷ গতরাতে অর্পণের বলা কথাগুলো স্মরণ করে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে আনল। দু’টো চোখ উপর দিকে নিয়ে শ্বাস আঁটকে মনে মনে আওড়াল,
‘ এ পৃথিবীতে অগণিত নারী অনুভূতির দাবানলে জ্বলে। একদিন সব ঠিক হবে। সবাই সবার মানুষটাকে নিয়ে সুখী হবে৷ সে বা সৌধ কেউই এর ব্যতীক্রম নয়৷ তবু দিনশেষে সৌধর হৃদয়ে নিধি নামক নারী নৈরাশ্য হয়ে ধরা দেবে। আর তার হৃদয়ে সৌধ কেবলই আফসোস। ‘
ঘোরের ভেতরে থাকা মনো ভাবনা গুলোর সমাপ্তি টানল নিধি৷ চোখ বুঁজে ঘনঘন কয়েকবার নিঃশ্বাস ছেড়ে অর্পণের গায়ে হাত রাখল৷ ডাকল বারকয়েক। স্বামীর ঘুম ভাঙলে সে বলল,
‘ আজো অফ ডে। চলুন না কোথাও গিয়ে বেড়িয়ে আসি। ‘
ঘুম ছুটিয়ে ওঠে বসে অর্পণ। অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
‘ আজ না তোমার বন্ধুর বিয়ে? ‘
‘ আপনি যাবেন? ‘
সহসা চুপ মেরে যায় অর্পণ। সেদিন একটা ভুলকে কেন্দ্র করে ওরা যা ঘটিয়েছে। এরজন্য উপযুক্ত শাস্তি দিতে পারত সবাইকে। শুধুমাত্র না জেনে বুঝার ভুল, নিধির খুব ভালো বন্ধু আর সৌধ সুজা এমপির ছেলে
বলে ক্ষমা করে দিয়েছে। হাঁপ নিঃশ্বাস ছাড়ল অর্পণ।
কণ্ঠে দৃঢ়তা ফুটিয়ে বলল,
‘ সরি, আমার কাজ আছে। ‘
মুখ ফুলিয়ে নিধি বলল,
‘ আপনার সঙ্গে ঘুরতে যাব বলে বেস্ট ফ্রেন্ডের বিয়ের দাওয়াত ইগনোর করছি। আর আপনি আমাকে কাজ দেখাচ্ছেন? ‘
ছোটো ছোটো করে তাকায় অর্পণ। পাশ থেকে চশমা তুলে দেয় নিধি। বলে,
‘ চশমাটা পড়ুন৷ এরপর দেখুন। ‘
‘ ভেবে বলছ? বিয়েতে যাবে না ‘
‘ একদম। ‘
বুকের ওপর থেকে যেন বিশাল পাথর সরে গেল অর্পণের। সে বোঝে নিধিকে। কেন যেন অনায়াসেই এই মেয়েটার মন বুঝে। চোখের ভাষাগুলো পড়তে পারে। একজন স্বামীর জন্য এই সত্যিটা খুবই নির্মম। তার স্ত্রী অন্য এক পুরুষের গভীর প্রণয়কে ভুলবশত উপেক্ষা করার দহনে জ্বলছে। তার প্রতি এক সময় নিধির মুগ্ধতা ছিল৷ যা ভালোবাসায় রূপ নেবার পূর্বেই সবকিছু লন্ডভন্ড হয়ে যায়। গতরাতে নতুন করে আশার আলো খুঁজে পেয়েছে। নিধি প্রাণপণে চাইছে নিজেকে সুস্থির করার৷ তাকে আপন করে নেয়ার। স্বামী হিসেবে সম্মানের সঙ্গে সাপোর্ট দেবে সে৷ দৃঢ় বিশ্বাস উপরওয়ালা নিরাশ করবে না৷ সে তার ধৈর্য্য, সম্মান, কর্তব্যবোধ আর ভালোবাসা দিয়ে নিধিকে জয় করে নেবে। এতদিন নিধি তাকে সুযোগ দেয়নি৷ এবার যখন দিচ্ছে পূর্ণ সৎ ব্যবহার করবে৷ দু’দিক থেকেই যখন আঁকড়ে ধরার পায়তারা চলে কার সাধ্য ছিন্ন করার?
.
.
আজ আদরের বোনটার বিয়ে৷ সারা বাড়ি ফুল আর ঝিলিক বাতি দিয়ে সাজানো হয়েছে। রাত হলেই বিয়ে বাড়ির চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য ফুটে ওঠবে৷ এলাহি আয়োজন, বিয়ে বাড়ির উৎফুল্লতা চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। এতসবের ভীড়ে সকাল থেকে বুক ভার সুহাসের। কারো দিকে চোখ তুলে তাকাচ্ছে না। আর না কেউ তার মুখের দিকে তাকাতে পারছে। সোহান খন্দকারের অবস্থাও কাতর৷ মানুষটা সকাল থেকে কিছু মুখে তুলেনি৷ আজ ভীষণ মনে পড়ছে উদয়িনীকে। শত তিক্ততার ভীড়ে উদয়িনী তার হৃদয়ের কতটুকু দখল করে ছিল। সময়ের স্রোতে তা দৃঢ়ভাবে অনুভব করছে। আজ যদি উদয়িনী বেঁচে থাকত তাহলে বোধহয় এতটা নিঃসঙ্গ লাগত না৷ ছেলের বিয়েতে যত সুখ মেয়ের বিয়েতে ততই শোক৷ বুকে কম্পন ধরে সোহানের৷ মেয়েটা চলে গেলে তার পুরো বাড়িটাই শূন্য। এমতাবস্থায় পুত্রবধূ, প্রিয় নিলুর মেয়েকে স্মরণ হয়৷ আফসোসে ডুবে যায়। নামীকে তো সে মেয়ের চেয়ে কম কিছু ভাবেনি৷ তবে কেন আজ তার বাবা সত্তার অসহায়ত্বে নামী কাঁধে হাত রাখল না? তবে কী সে ভুল করেছে সুহাসের সাথে নামীর জীবন গেঁথে দিয়ে? তীব্র অসহায় বোধে ভুগে সোহান খন্দকার। বুকের পাঁজরে ব্যথায় বিষিয়ে ওঠে। কলিজাটা ভীষণ ছটফট করছে। যেন আর কিছু সময় এরপরই তার শরীর ভেদ করে কলিজা ছিঁড়ে নেয়া হবে৷ মেয়ের বিয়েতে প্রতিটি বাবার হৃদয়ে হওয়া রক্তক্ষরণ কেউ কি দেখতে পায়? শুনতে পায় কি কেউ মেয়ে বিদায়ে বুকের ভেতর চলা বাবাদের আর্তনাদ গুলো?
আব্বু আর ভাইয়ার অবস্থা দেখে সিমরানের চোখের পানি বাঁধ মানে না৷ বিয়ে নিয়ে এতদিন যে চঞ্চল অনুভূতিটা ছিল৷ প্রিয়জনকে নিজের করে পাওয়ার যে তীব্র আকাঙ্ক্ষা সবই যেন থমকে যায়। অন্তঃকোণে বাবার বিষণ্ণ মুখ, ভাইয়ের আঁধারে নিমজ্জিত চোখ তার সমস্ত সত্তা নাড়িয়ে দেয়৷ আম্মুকে মনে পড়ে খুব৷ বুকের ভেতর বিশাল একটা জায়গা জুড়ে কেবল শূন্য শূন্য লাগে। বিয়ে শব্দটা সহজ হলেও এর ভাবার্থ কত কঠিন৷ বিয়ে শব্দে দুটো অক্ষর থাকলেও, বিয়ে দুই নর নারীর মধ্যে সংঘটিত হলেও এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে বহু ত্যাগ, তিতিক্ষা। বিয়ে শুধু ছেলে, মেয়ের মাঝেই সম্পর্ক স্থাপন করে না৷ দু’টো পরিবারকেও এক সুতোয় গেঁথে দেয়। ঘরের দেয়ালে টাঙানো পারিবারিক ছবির দিকে তাকায় সিমরান৷ জ্বলজ্বল করছে মায়ের মুখটা। কী সুন্দর হাসি! মায়ের ডানপাশে মায়ের আদলের লম্বাটে ভাই সুহাস৷ বাম পাশে গম্ভীর মুখে বাবা দাঁড়িয়ে। তার বুকের অতিনিকটে মিষ্টি হাসিতে দাঁড়িয়ে আছে সে নিজে। নিঃশ্বাস আঁটকে যায় মেয়েটার। এই ছবিটা আর কখনো জীবন্ত হবে না। আম্মু কখনো ফিরে আসবে না। আজ তার বিশেষ দিনেও না। তৃষ্ণা পায় তার। বীভৎস তৃষ্ণা। মায়ের বুকে একবারটি মাথা রেখে রুদ্ধশ্বাস ছাড়তে আকুল হয় হৃদয়। মনে মনে সৃষ্টিকর্তাকে বলে,
‘ আজ আমার বিয়ে। আব্বু, ভাইয়ার মতো আম্মু পাশে থাকলে বুকের ভেতরটা ফাঁকা ফাঁকা লাগত না। সেই ছোট্ট থেকে নিজের কোনো বিশেষ দিনেই ওই মানুষটাকে পাশে পেলাম না৷ আজো না। ‘
ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে সিমরান৷ একদিকে সাজানো হয়। অন্যদিকে কেঁদে গাল ভাসায়। ইতিমধ্যেই সে মনে মনে কঠিন এক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। আজ রাতে, বাসরঘরে একান্ত মুহুর্তে সেই সিদ্ধান্তটি জানাবে সৌধকে। নিজের জীবনের নির্মম অভিজ্ঞতা গুলোই এই সিদ্ধান্ত নিতে তাকে বাধ্য করল।
সাজ প্রায় কমপ্লিট। বাকি রয়ে গেছে শুধু চুল। চুল বাঁধা শেষ হলেই লেহেঙ্গা পরবে। আকাশি নীল রঙের গর্জিয়াস, ব্রাইডাল ল্যাহেঙ্গা। এই রঙটা সৌধর ভীষণ পছন্দের। পছন্দ সিমরানেরও। সবচেয়ে বড়ো কথা সিমরান চেয়েছিল তার বিয়ের সবকিছু ডিফারেন্ট টাচে থাকবে। আর সৌধ তার পুরো ব্যক্তিত্বেই ডিফারেন্ট টাচ রাখে৷ তাই বিয়ের সাজে, পোশাকে দু’জনের পছন্দ খাপে খাপ মিলে গেল।
চুল বাঁধা শেষে লেহেঙ্গা আর জুয়েলারি পরার পূর্বে মেয়ের ঘরে সোহান খন্দকারের আগমন ঘটে। পেছন পেছন আসে সুহাস। পার্লার থেকে আসা মেয়েদের নিয়ে বাইরে চলে যায় প্রাচী৷ ফারাহ আর সিমরানের মামি আসে গরম গরম খাবার নিয়ে৷ তারা খাবার গুছিয়ে চলে গেলে সুহাস দরজা আঁটকে দেয়৷ সৌধদের আসার সময় হয়ে এসেছে। বরপক্ষ আসার পূর্বে তারা বাবা, ছেলে সিমরানের সঙ্গে একান্তে কিছু সময় কাটাতে চায়৷ একসঙ্গে খাবার খেতে বসল ওরা৷ তিনজনের কারো পেটেই দানাপানি নেই। সুহাসের নানুমনিই তাই বুদ্ধি করে মেয়ের জামাই আর নাতিকে সিমরানের ঘরে পাঠালো। নিজের হাতে তুলে খাবে না সিমরান৷ বাবা, আর ভাইয়ের হাতেই খাবে। সোহান খন্দকার ঝাপসা দৃষ্টিতে হাসিমুখে মেয়ের মুখে খাবার তুলতে উদ্যত হলে হঠাৎ সিমরান বাঁধা দেয়। ছলছল চোখে মৃদু হেসে বলে,
‘ ওয়েট আব্বু। আম্মুকে নিয়ে আসি। আমার কোনো বিশেষ দিনেই আম্মু পাশে থাকেনি৷ ছুটি নেই, কাজের ব্যস্ততা এই সেই৷ আজ যখন কাজ নেই, ছুটি আছে৷ তখনও আম্মু নেই৷ এসব কেমন নিষ্ঠুরতা বলো তো? ‘
কথাগুলো বলতে বলতে ওঠে দাঁড়ায় সিমরান। বিছানার পাশের টেবিলে মায়ের একটি সিঙ্গেল ছবি রয়েছে। দু’দিন আগেই রেখেছে৷ সেটা নিয়ে এসে কোলে রেখে আব্বু আর ভাইয়ের দিকে তাকায়। কান্নারত মিষ্টি হেসে বলে,
‘ আমাদের পরিবার কমপ্লিট। ‘
কথাটা বলেই হা করে। সোহান খন্দকার চোখে পানি ছেড়ে দিয়ে মেয়ের মুখে খাবার তুলে দেয়। সুহাস ঠোঁট কামড়ে কান্না আঁটকায়। টলমল দৃষ্টিতে একবার বোন আরেকবার মায়ের ছবি দেখে। বুকচিরে বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস। মনে মনে বলে,
‘ না বোন। আমাদের পরিবার কমপ্লিট সেদিন হবে যেদিন আমার পাশে নামী বসবে। ‘
.
.
বরপক্ষের এগারোটা গাড়ি, তেত্রিশটা বাইক তৈরি। তৈরি চৌধুরী বাড়ির সদস্যরাও। শোনা যাচ্ছে বরও তৈরি। শুধু রাজকীয় পাগড়ি আর নাগরা জুতো পরা বাকি। যা আইয়াজ, আজিজ এসে ঝটপট পরিয়ে দিল৷ আয়নার সামনে স্তম্ভিত মুখে দাঁড়িয়ে সৌধ। এ প্রথম নিজেকে ট্রাডিশনাল লুকে দেখতে পাচ্ছে সে। পরনে অফ হোয়াইট কালার শেরওয়ানি, মাথায় আকাশি নীল রঙের কারুকাজখচিত, শুভ্র পালকশোভিত পাগড়ি, পায়ে আকাশি নীল রঙা নকশা করা নাগরা জুতা। দাঁড়িমোচ ছেঁটেছে বিধায় মুখবায়বেও কিঞ্চিৎ পরিবর্তন ঠেকছে। সব মিলিয়ে নিজেকে পুরোনো দিনের কোনো এক রাজ্যের যুবরাজ মনে হচ্ছে। যেন আজ তার অভিষেক। মৃদু হাসল সৌধ। ঘুরে দাঁড়িয়ে বুক টান টান করে শ্বাস নিল দীর্ঘ৷ আইয়াজকে বলল,
‘ তোরা যেতে থাক আমি আসছি। ‘
সঙ্গে সঙ্গে আইয়াজ বাকিদের নিয়ে বেরিয়ে গেল। সবাই বেরিয়ে গেলে একটু স্বস্তি পেল সৌধ। ত্বরিত পা বাড়িয়ে দরজা আঁটকে দিল৷ এরপর ধীর পায়ে গিয়ে বসল বিছানায়। ঘনঘন নিঃশ্বাস ছেড়ে চোখ বুজল সন্তর্পণে। আবেগ স্মরণ করল নিধিকে। বিবেক স্মরণ করল সিমরানকে। জীবনে চলার পথে আবেগ ক্ষতিকর হলেও বিবেক ক্ষতিকর হয় না৷ বিশেষ দিন, বিশেষ মুহুর্ত আচমকা সৌধর ভেতরের সত্তায় কম্পন সৃষ্টি হলো। এই দিনটা নিয়ে একদিন সে স্বপ্ন দেখেছিল। স্বপ্নের নারীটি ছিল নিধি৷ স্বপ্নের দিন সত্যি হতে যাচ্ছে। কেবল দুঃস্বপ্ন হয়ে গেছে নারীটি৷ চোখ খুলল সৌধ। বিরবির করে সৃষ্টিকর্তার নিকট প্রার্থনা করল,
‘ প্রথম জীবনের শোক দ্বিতীয় জীবনের সুখে বিলীন হোক। আজ থেকে আমার দ্বিতীয় জীবন শুরু। আমার জীবনে সিনু দ্বিতীয় নারী হয়ে নয় শেষ নারী হয়ে থাকুক। আমার সবটুকু আবেগ, অনুভূতি, ভালোবাসা ওকে ঘিরে তৈরি হোক। যে আমাকে অনুভব করিয়েছে সে ছাড়া কেউ আমাকে ভালো রাখতে পারবে না। তার প্রতি আমার অন্তহীন ভালোবাসা জন্মাক। হে প্রভু, ভাঙা হৃদয় গড়িয়ে নেয়ার যুদ্ধে আমি বা সিনু কেউ যেন না হারি। ‘

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।