মোবাইল হাতে বসে আছে সিমরান৷ চাতক পাখির ন্যায় তাকিয়ে আছে সময়ের দিকে৷ আর মাত্র একঘন্টা। সৌধ ভাইয়ের ঊনত্রিশতম জন্মদিন। বুক ধুকপুক করছে। প্রতি বছরই এমন সময় পাড় করে সে৷ হৃৎপিণ্ডের অবস্থা নড়বড়ে হয়ে যায়। জন্মদিনের ছোট্ট একটা উইশ। বিনিময়ে সৌধর থেকে ছোট্ট একটি থ্যাংকস পায়। এতেই যেন এক জীবনের সকল সার্থকতা পেয়ে যায় মেয়েটা৷ অতীতে পেড়িয়ে আসা বছর গুলোর চেয়ে এ বছরের ধুকপুকানি সম্পূর্ণ আলাদা। এত বছর সৌধ জানত না সে তাকে ভালোবাসে৷ তার জন্য ওর হৃদয়ে প্রণয়ানুভূতি আছে৷ আজ জানে। হয়তো বুঝতেও পারবে এত বছর কেন বাইশ সেপ্টেম্বর এলে রাত বারোটার সময় অন্য সবার মতো সিমরানও তাকে উইশ করে। মোবাইলে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে একবার বিছানায় শুয়ে থাকছে। আরেকবার ঘরময় ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাগদান উপলক্ষে সিমরানের বেস্ট ফ্রেন্ড লুনা এসেছে। মা বেঁচে নেই। ভাবি থেকেও নেই। সে বার ফারাহ ছিল। আজ ফারাহও নেই। তাই বান্ধবীকে নিয়ে এসেছে। দিনের আলো ফুটতেই তার দুই মামা আসবে। আর চৌধুরী বাড়ির লোকজন আসবে৷ সৌধ ভাই, সুজা আংকেল, অর্থাৎ পুরুষ সদস্যরা আসবে দেরিতে। শুনেছে পারিবারিক কয়েকজন আত্মীয়, স্বজন উপস্থিত থাকবে। বন্ধু, বান্ধব কেউ এ মুহুর্তে ফ্রি নেই। ঘনিষ্ঠ যারা ছিল তারা প্রত্যেকেই জানিয়েছে, বিয়েতে আসবে। সৌধও আর জোরাজোরি করেনি৷ সবাই এখন নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত। একটা সময় পর ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবন দু ক্ষেত্রেই ব্যাপক ব্যস্ততা বেড়ে যায়। যা মেনে নিয়ে, মানিয়ে নিয়ে আমাদের চলতে হয়।
লুনা খ্রিস্টান ধর্মের মেয়ে। সিমরানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু সে। যার সঙ্গে নিজের সুখ, দুঃখ অনায়াসে ভাগাভাগি করতে পারে সিমরান। মানুষ সব ক্ষেত্রে নিজের সুবিধাজনক একটি স্থান খুঁজে বেড়ায়। বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যে লুনাই হতে পেরেছে সিমরানের কমফোর্ট জোন। এগারোটা বেজে ঊনষাট মিনিট৷ বিছানায় উপুর হয়ে শুয়ে ফোন টিপছিল লুনা৷ সময় দেখতেই লাফিয়ে ওঠে বলল,
‘ সিনু সিনু, ঊনষাট ঊনষাট। ‘
সিমরান ম্যাসেজ লিখে রেখেছে। শুধু পাঠানোর অপেক্ষা। তাই লুনাকে শান্ত করতে বেলকনি থেকে ঘরে এসে বলল,
‘ জাস্ট সেন্ট করব। ‘
হলিউড মুভি দেখছিল সৌধ। ঘড়ির কাঁটা কখন বারোটায় এসে ঠেকেছে খেয়াল করেনি৷ যখন খেয়াল করল একটু চমকাল৷ পরোক্ষণেই আবার স্বাভাবিক হয়ে গেল। আজ বাইশ সেপ্টেম্বর। সময় রাত বারোটা। তার জন্মদিন। জীবন থেকে একটা বছর হারিয়ে গেল। উহুম শুধু বছর নয়। এর সঙ্গে হারিয়েছে অনেক কিছু। চেনা এক মুখ অচেনা হয়েছে। চেনা আরো এক মুখ আরো চেনা হয়ে ওঠছে। সবই সময়ের ব্যবধান৷ ঠোঁটের কোণ ঘেঁষে আলতো হাসির রেখা ফুটল সৌধর৷ সে হাসিতে অল্প ব্যথা, অল্প সুখের সংমিশ্রণ ছিল। আজ দিনের আলো ফুটে দুপুর গড়ালে বাগদান অনুষ্ঠান। বুকের ভেতর অদ্ভুত এক অনুভূতি হলো। মুভি দেখায় বিরতি টেনে প্রস্তুতি নিল ঘুমানোর। গা এলিয়ে দিল নরম বিছানায়। অভ্যেস অনুযায়ী একবার মেবাইল হাতে নিয়ে স্ক্রিনে আঙুল ছোঁয়াতেই দেখতে পেল, ফেসবুক নোটিফিকেশন, ম্যাসেন্জার, হোয়াটসঅ্যাপ এবং ইন্সটাগ্রাম মিলে হাজার খানেক ফ্যান, ফলোয়ারের উইশেষ ভীড় জমাচ্ছে। কিন্তু সৌধ সেসবে গুরুত্ব না দিয়ে হোয়াটসঅ্যাপে পরপর দু’জনের ম্যাসেজে মন দিল। প্রথম ম্যাসেজটা নিধির। ছোট্ট করে লিখেছে,
‘ হ্যাপি বার্থডে সৌধ। গড ব্লেস ইউ। ‘
দ্বিতীয় ম্যাসেজ সিমরানের। সে ইংরেজিতে গুছিয়ে লিখেছে,
‘ Happy Birthday Soudh Bhai. Only one prayer to the creator that I can make you happy and make you smile. ‘
যার বাংলা অর্থ দাঁড়ায়, ” শুভ জন্মদিন সৌধ ভাই। সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করি আমি যেন তোমায় সুখী করতে পারি এবং তোমার হাসি মুখের কারণ হতে পারি। ”
প্রতি বছর সিমরান জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানায় তাকে। সেখানে শুধু লেখা থাকে ‘ হ্যাপি বার্থডে সৌধ ভাই ‘ সে উত্তরে ধন্যবাদ জানিয়ে দেয় সৌধ। এ বছরের শুভেচ্ছায় আলাদা কিছু রয়েছে। একজন প্রাপ্তবয়স্ক যুবক হিসেবে বুঝতে অসুবিধা হয়নি তার৷ এই আলাদা কিছুর বিনিময়ে শুঁকনো ধন্যবাদ দিতে আগ্রহ বোধ করল না। তাই লিখল,
‘ ঘুমিয়ে পড়। ‘
সিমরানকে ম্যাসেজটা দিয়েই নিধির কনভার্সেশনে
ঢুকল। শুভেচ্ছার প্রতিত্তোরে লিখল,
‘ আজ আমার আর সিনুর এনগেজমেন্ট। তুই না জানিয়ে বিয়ে করে ফেলেছিস। শেষ পর্যন্ত আমি এনগেজমেন্টের কথা না জানিয়ে পারলাম না। লুকোচুরি খেলাটা আমি ঠিক পারি না। ‘
ম্যাসেজটি দেয়ার ছ’মিনিট পর নিধির রিপ্লাই এলো,
‘ শুনেছিলাম…। তবে সিয়র ছিলাম না। আমার ওপর জেদ করে সিনুর জীবন নষ্ট করছিস না তো? বিয়েটাকে নিজের জেদে রূপান্তর করিস না। ‘
শুয়ে ছিল সৌধ। ম্যাসেজটি দেখে নিজেকে স্থির রাখতে পারল না৷ ওঠে বসল। ত্বরিত আঙুল চালিয়ে লিখে পাঠালো,
‘ সিনু আমার জেদ না। ‘
‘ ভালোবাসা? ‘
বাঁকা হেসে সৌধ লিখল,
‘ না। তবে আমার হৃদয়ের তৃতীয় নারী সিনু। আম্মা, আপার পর যার চোখে আমার জন্য স্বার্থহীন, নিখুঁত ভালোবাসা খুঁজে পেয়েছি আমি। ‘
লাইক ইমোজি দিল নিধি। বহু বছরের বন্ধুত্ব থেকে পুরোপুরি নিধিকে না চিনলেও এটুকু বুঝল তার কথাকে অবজ্ঞা করল নিধি। করাটা বোধহয় স্বাভাবিক। তাই বর্তমানে সিনুর প্রতি তার প্রকৃত অনুভূতিটুকু বোঝাতে সেই সঙ্গে নিধির প্রতিও তার এ মুহুর্তের অনুভূতি জানাতে লিখল,
‘ ঘুরিয়ে, প্যাঁচিয়ে কথা বলি না আমি। তুই সেই নারী যাকে ইহকালে পাওয়ার যুদ্ধে হেরে গেছি। সিনু সেই নারী যে পরকালে আমাকে পাওয়ার যুদ্ধে জিতে গেছে। সিনু আমার বউ হবে৷ সিদ্ধান্তটি আমি দেরিতে নিলেও সৃষ্টিকর্তা অনেক আগেই লিখে রেখেছেন। স্বামী, সন্তান নিয়ে সুখী হো। তোর বিয়ের কার্ড পাইনি তো কী হয়েছে? আমারটা ঠিক সময় পৌঁছে যাবে। আল্লাহ হাফেজ। ‘
ম্যাসেজটি দিয়েই মৃদুভাবে ফোনটি বিছানার একপাশে ছুঁড়ে ফেলল৷ অনুভব করল বুকের বা’পাশে সেরে ওঠা ঘা’তে জ্বলছে। এ জ্বালায় আর কতদিন জ্বলতে হবে? নিধি নামক আগুনপোকার হাত থেকে কবে রেহাই পাবে? বিধ্বস্ত হৃদয়ের উত্তপ্ত, ভারিক্কি নিঃশ্বাসে ঘরময় ছন্দ তুলল। যে ছন্দে তাল হারিয়ে দু’ চোখের পাতা এক করল সৌধ৷ নিভৃতে ডান চোখের কার্ণিশ বেয়ে এক ফোঁটা গরম জল গড়িয়ে পড়ল। অতীত পিছু ছাড়ে না। সৌধর এই অতীত কখনোই পিছু ছাড়বে না৷ সে নিজেও পারবে না পুরোপুরি ছাড়তে। এজন্যই বোধহয় বলা হয় বন্ধুত্বের সম্পর্কে প্রণয়ানুভূতিকে প্রশ্রয় দিতে নেই। পরিণয় না পেলে জ্বলতে হয় পুরো জনম ভরে৷ সময়ের স্রোতে অগ্নি জ্বালা ফিকে হয় অবশ্য কিন্তু পুরোপুরি নিঃশেষিত হয় না। প্রতিটি মানুষের জীবনেই সুপ্ত কিছু ব্যথা থাকে। থাকে ব্যর্থতা। না পাওয়ার গ্লানিতে ভুগে আজন্মকাল। পৃথিবীতে সব মানুষ এক রকম হয় না৷ কেউ প্রথমবার ব্যর্থ হলে দ্বিতীয়বার ওঠে দাঁড়ায়। ভুলে যায় প্রথমবার না পাওয়ার বেদনাটুকু। আবার কেউ ওঠে দাঁড়ালেও ভুলতে পারে না। জীবনে দ্বিতীয় কাউকে ভালোবাসা সম্ভব হলেও প্রথম জনের থেকে পাওয়া আঘাত ভুলা সম্ভব হয় না৷ দীর্ঘদিন একটি আশা নিয়ে বেঁচে থাকার পর ব্যর্থ হলে কি ভুলা যায়? নিধি আজ অন্য কারো বউ। কাল সে অন্য কারো বর হবে। তাই বলে কি পুরোনো দিন গুলো মুছে যাবে? মুছবে না বলেই নতুন করে বাঁচার লড়াই করতে হয়৷
.
.
বাড়ি ভর্তি মানুষ। জাঁকজমক আমেজে পরিপূর্ণ। বাড়ির প্রতিটি কোণায় মৃদু সুখ লেপ্টে আছে৷ প্রতিটি সদস্যের মুখে ঝলমল করছে খুশিরা৷ রান্নার জন্য বাবুর্চি আনা হয়েছে। তাদের তদারকি করছে সুহাসের দুই মামা৷ সোহান খন্দকার সুজা চৌধুরীর সঙ্গে ফোনে কথা বলছে। সৌধর বাড়ি থেকে কাজিন ঊর্মি আর তাহানী এসেছে। সিমরান তৈরি হচ্ছে। ঘুরে ঘুরে পুরো বাড়ি দেখল সুহাস। প্রত্যেকের খবরাখবর নিল। এরপর নিজের ঘরে পা বাড়াতেই হঠাৎ পা দু’টো থমকে গেল একটি ঘরের সামনে৷ যে ঘরটায় এক সময় নামী থাকত। হ্যাঁ এ বাড়িতে এই ঘরটা নামীর ব্যক্তিগত৷ সেদিন সন্ধ্যার পর তাদের মাঝে তুমুল ঝগড়া হলে সে বেরিয়ে যায়। যখন ফিরে আসে নামীকে আর নিজের ঘরে পায় না। এরপর খোঁজাখুঁজি করতে গিয়ে দেখতে পায় নামী এই ঘরে শুয়ে আছে। যা দেখে নিজের ঘরে ফিরে আসে। অনুভব করে নামীর মতো তারও একা থাকা প্রয়োজন। সেই যে একা থাকতে চেয়েছিল তা ক্ষণিকের জন্য। যা নামী দীর্ঘ করে পরেরদিন সকালে কাউকে না জানিয়ে বাড়ি থেকে চলে যায়। আকস্মিক বুকের ভেতর তীক্ষ্ণ এক যন্ত্রণা অনুভব করে সুহাস৷ নিজের ঘরে না গিয়ে নামীর ঘরে গিয়ে চুপচাপ বসে রয়৷ দীর্ঘক্ষণ বসে থাকার পর শরীরটা অবশ হয়ে আসতে শুরু করে। ইচ্ছে করে নামীর একান্ত ব্যক্তিগত বিছানায় গা এলিয়ে আরামদায়ক একটি ঘুম দিতে। চমকে ওঠে নিমেষে। ইচ্ছেটা এ মুহুর্তে অবাঞ্ছিত। একটু পর সৌধরা আসবে৷ সিমরান সৌধ দু’জনের জীবনেরই বিশেষ একটি দিন আজ। বোন আজ কত খুশি। চোখ, মুখে কী প্রসন্নতা! এত দীপ্তি, এত খুশিতে আঁধার নামাতে চায় না সে৷ তাই দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওঠে দাঁড়াল। ঘর থেকে ফিরে যেতে উদ্যত হতেই হঠাৎ দৃষ্টি আটকালো একটু দূরে স্থির দাঁড়িয়ে থাকা ছোট্ট ওয়ারড্রবের দিকে। ভ্রু কুঁচকে গেল নিমেষে। কী ব্যাপার ওয়ারড্রবের নিচের ড্রয়ার হালকা ফাঁক কেন? এ ঘরে তো কেউ আসে না৷ তাহলে কী নামীই এভাবে রেখে গিয়েছে? বড্ড তাড়াহুড়ো নিয়ে বেরিয়ে গেছে নিশ্চয়ই? মুখটা বিষণ্ন হয়ে ওঠল। ধীরপায়ে এগুলো ওয়ারড্রবের দিকে। যেই নিচু হতে যাবে অমনি সেলিনা আপা ডাক দিল। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বেশ তাড়া নিয়ে বলল,
‘ সুহাস ভাই, মেহমানরা এসে পড়েছে। আপনারে খুঁজতেছে, তাড়াতাড়ি আসুন। ‘
.
.
চৌধুরী বাড়ির সদস্যরা বসে আছে৷ তাদের আপ্যায়ন করছে সুহাসের দুই মামা, সুহাস আর সোহান খন্দকার। এরই মধ্যে সৌধর বড়ো ভাইয়ের ছেলে সুর কান্না শুরু করল। সৌধর বড়ো ভাই সৌরভ এখন দেশে নেই। তার স্ত্রী ঝুমায়না আর তাদের একমাত্র ছেলে সুরকে দেশে রেখে বন্ধুদের নিয়ে বেড়াতে গেছে সে। সুরের জন্ম কানাডায়। তার মাতুলালয়ে। ঝুমায়না জন্মসূত্রে কানাডিয়ান৷ বৈবাহিক সূত্রে বাংলাদেশি। বাংলাদেশের গরমের সঙ্গে অভ্যস্ত না তারা৷ দু, একমাসের জন্য শশুর বাড়িতে বেড়াতে আসে তবু বেছে বেছে শীতকালে। এবার গরমে আসা হয়েছে একমাত্র দেবরের বিয়ে উপলক্ষে। তীব্র গরমে ঝুমায়নার সমস্যা হলেও মানিয়ে নিচ্ছিল৷ কিন্তু ছেলের কান্নায় আর সম্ভব হলো না। সৌধও ভাতিজা আর ভাবির অসুবিধা বুঝতে পেরে সুহাসকে বলল, তার ভাবিকে উপরে নিয়ে যেতে৷ উপরে তিনটে ঘরে এসি আছে৷ এর মধ্যে সুহাস বা সিমরান যে কারো ঘরে নিয়ে বসাতে বলল। সুহাস মাথা নেড়ে ঝুমায়না ভাবিকে নিয়ে উপরে যেতে উদ্যত হতেই সকলের দৃষ্টি আঁটকে গেল সিমরানের দিকে। সিঁড়ি পেরিয়ে কি এক হুরপরী আসছে? যাকে দেখে উপস্থিত সকলের চোখ ধাঁধিয়ে ওঠল? কাজিন ব্রাদার্সরা শুরু করে দিল ফটোগ্রাফি। হঠাৎ সকলকে থমকে যেতে দেখে সৌধও তাকাল সিঁড়ির দিকে। লাইট অরেঞ্জ কালার গর্জিয়াস গাউন পরিহিত একটি বারবি ডল যেন সিমরান। আজ তাকে দেখে বাংলাদশি তরুণী মনে হচ্ছে না। ঝুমায়না দেখতেও মারাত্মক সুন্দরী। চেহেরায় বাঙালিয়ানা নেই। গায়ের বর্ণ দুধ সাদা। চুল গুলো বাদামি বর্ণ। ঝুমায়নার মুখে শোনা যায়, এক বলিউড প্রডিউসার নায়িকা হওয়ার জন্য অফার করেছিল তাকে। সৌরভের সঙ্গে সম্পর্কে না জড়ালে সে ওই জীবনটাই বেছে নিত বোধহয়। সেই ঝুমায়নার সৌন্দর্যও যেন সিমরানের পাশে ক্ষীণ হয়ে গেল আজ। একপাশে বান্ধবী লুনা আরেক পাশে ছয় বছরের তাহানী৷ মাঝখানে সিমরাম৷ গাউনের দু’পাশে ধরে এক এক করে সিঁড়ি পেরুচ্ছে। মাথায় ফ্লোরাল হেডপিস। পেছন দিয়ে লাইট অরেঞ্জ কালার লম্বা দোপাট্টা একদম পা ছুঁই ছুঁই। মুখে প্রসাধনী ব্যবহার করেছে ঠিক৷ কিন্তু সেগুলোর এত সুন্দর ফিনিশিং টেনেছে যে একদমই ন্যাচারাল লাগছে। লুনা যেন মনের মাধুরি মিশিয়ে সাজিয়েছে বান্ধবীকে। এছাড়া মনের মানুষের জন্য সাজতে পারলে ভেতরে যে উৎফুল্লতা থাকে। তাও যেন সিমরানের চোখে মুখে উপচে পড়ছে। যা তার সৌন্দর্যকে গগনচুম্বী তুলে দিয়েছে। ঝুমায়না উপরে যাওয়ার কথা ভুলে গিয়ে অপলকভাবে তাকিয়ে রইল। সিমরান নিচে নেমে এসে সকলকে সালাম দিতেই হুঁশ ফিরল তার। আশপাশে তাকিয়ে খেয়াল করল নিজের দিকে কেউ তাকিয়ে আছে কিনা। না নেই। সবার নজর এখন সিমরানের প্রতি। যা তার ভেতরে ঈর্ষার আবির্ভাব ঘটাল। তিন বছরের ছেলেটাকে কোলের বা পাশ থেকে ডান পাশে নিয়ে সুহাসকে বলল,
‘ আমার ছেলেটার কষ্ট হচ্ছে। প্লিজ উপরে নিয়ে চলুন৷ এসি ছাড়া এক মিনিট থাকা ওর জন্য যন্ত্রণার। আপনাদের ড্রয়িংরুমে এসি নেই কেন বুঝতে পারছি না! ‘
ঈষৎ বিস্ময় ঝুমায়নার কণ্ঠে। সুহাস সহজ বুদ্ধির ছেলে। সে না টিটকারি বুঝল আর না ঈর্ষা বুঝল। সে মৃদু হেসে সহজ গলায় উত্তর দিল,
‘ আপনাদের বাড়ির মতো যৌথ পরিবার নয় আমাদের। আমরা বাড়িতেই থাকি না। কালেভদ্রে আসা হয়। সিনু ওর রুমেই সর্বক্ষণ কাটায়। তাই প্রয়োজন পড়েনি। যখন প্রয়োজন মনে হবে অবশ্যই ড্রয়িংরুমে এসি লাগাব। ‘
কথা গুলো বলতে বলতে ঝুমায়নাকে নিয়ে উপরে চলে গেল। তানজিম চৌধুরী সিমরানকে নিজের পাশে বসালেন৷ সৌধর দাদুনি তীব্র অসন্তুষ্টির চোখে তাকিয়ে। সে শিক্ষিত নারী হলেও খাঁটি বাঙালি। পারিবারিক নিয়ম রীতিও মান্য করে খুব। তাই শাড়ির পরিবর্তে এসব গোলগাল চমকওয়ালা পোশাকে সিমরানকে দেখে পছন্দ করলেন না। তবু আনুষ্ঠানিকতার জন্য চুপ থাকলেন। সুজা চৌধুরী স্ত্রীকে ইশারা করলেন পারিবারিক ধারা বজায় রেখে বাগদান সেরে ফেলতে। তানজিম চৌধুরী মুচকি হেসে নিজের হ্যান্ড পার্স থেকে একটি গোল্ডের নেকলেস বের করে পরিয়ে দিলেন সিমরানকে। এরপর দাদুনিকে ইশারা করা হলো। দাদুনি হঠাৎ ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন,
‘ নাকে তো ফোঁড়া নাই৷ নাকফুল পরাব কী করে? ‘
সহসা দাদুনির কথায় সকলের মাথায় ছোটোখাটো বিস্মরণ ঘটল। দাদুনি যে কঠিন মানুষ। ঝুমায়নার মতো মেয়েকে বিয়ের দেড় বছর পর নাক ফোঁড়া করিয়ে ছেড়েছে৷ সেখানে সিমরান! ঢোক গিলল সকলেই। শান্ত রইল কেবল সুজা চৌধুরী আর সৌধ। সোহান খন্দকার এগিয়ে এসে বললেন,
‘ চাচি আমি খেয়াল করিনি বিষয়টা৷ বুঝেনই তো মা নেই। বউ মাও পড়াশোনার জন্য দূরে থাকে। সবমিলিয়ে ভুল হয়ে গেছে। ‘
সিমরান ভীত চোখে বাবার দিকে তাকাল। তার এই ট্রাডিশন একদম পছন্দ নয়। বিয়ে করে দু’হাতে চুড়ি পরে ঘুরো, নাকফুল দিয়ে ঘুরো। তবু শখ করে চুড়ি পরা যায়৷ কিন্তু নাক সুঁই দিয়ে ফুটো করে সেখানে গহনা অসম্ভব। কান ফুটো কবে কখন করিয়েছে। মনে নেই। নাক সে ফুটো করবে না । গা শিউরে ওঠল ভয়ে। এদিকে দাদুনি তীব্র রোষানলে ফেটে পড়ছে। এমনিতেই সিমরানকে পছন্দ না তার। এর ওপর এসেই দু দু’টো ভুল চোখে পড়েছে৷ মুখে আঁধার নামিয়ে বসে রইল দাদুনি৷ তানজিম চৌধুরী ছেলের দিকে তাকাল৷
শুভ্র রঙা পাঞ্জাবি পরিহিত সৌধ। পাঞ্জাবির ওপর লাইট অরেঞ্জ কালার কটি৷ গাল ভর্তি চাপ দাঁড়ি। দৃঢ় চোয়ালে লেপে আছে৷ দেখেই বোঝা যাচ্ছে সদ্য ছেঁটেছে দাঁড়ি গুলো। সিমরানের বান্ধবী লুনা সুক্ষ্ম নজরে দেখছে সৌধকে। বান্ধবীর হবু বরের মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণ করল তিনটে জিনিস। এক হিরোদের মতো ফুটনেস৷ দুই স্বচ্ছ গভীর একজোড়া দৃষ্টি। আর তিন হলো ওষ্ঠজোড়ার উপরে চৌকা নাকের নিচে কিঞ্চিৎ রাজকীয় স্টাইলে রাখা মোচ। এর আগে বহুবার দূর থেকে দেখেছে। ছবিতেও দেখেছে। কিন্তু আজ এত কাছ থেকে দেখে মনে মনে বলল,
‘ বান্ধবী এত্ত হট একটা জামাই পাইতেছিস!জিতছস জান জিতছস! ‘
দাদুনির কথায় সৌধ বিরক্ত হচ্ছিল। কিন্তু সিমরান নাক ফুটো করেনি বিষয়েটা সে জানত না৷ কেউই বোধহয় খেয়াল করেনি। নাই করতে পারে৷ বিষয়টা এত জরুরি নয়৷ ভেবেই সিমরানের দিকে তাকাল। এরপর দৃষ্টি ঘুরিয়ে বাবার দিকে শীতল দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। ছেলের ঠান্ডা চোখের ভাষা বুঝতে পেরে গজগজ করতে থাকা মায়ের দিকে তাকালেন সুজা চৌধুরী। শীতল গলায় বললেন,
‘ আম্মা নাক তো ফুটা নাই। তাহলে বাকি কাজ সেরে ফেলা যাক। ‘
দাদুনি মানতে নারাজ হয়ে কিছু বলতে উদ্যত হতেই সুজা চৌধুরী মাকে চোখের ভাষায় নিয়ন্ত্রণ করে ফেললেন। এরপর মুচকি হেসে মধুর স্বরে বললেন,
‘ সৌধ আংটি পরিয়ে ফেলুক। অনুমতি দিন আম্মা। ‘
দাদুনি গম্ভীর হয়ে তাকালেন সৌধর দিকে। সৌধ একপেশে হেসে ভ্রু উঁচালে বললেন,
‘ আচ্ছা পরাও। ‘
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন তানজিম চৌধুরী। সৌধর কাজিন সাদি, সালমান দু’জনই ভিডিয়ো আর ফটোশুটে ব্যস্ত। শান ব্যস্ত লুনার সাথে লাইন মারার চেষ্টায়। ঊর্মি সৌধর বড়ো আপু স্মৃতিকে ভিডিয়ো কল করেছে। আদরের ভাই, প্রিয় সিনুর বাগদানে উপস্থিত থাকতে না পেরে মন খারাপ তার। হাজব্যন্ডের ছুটি না হওয়াতে আসতে পারেনি। দেশের বাইরে থাকলে যে কোনো সময় আসা সম্ভব হয় না৷ তাকে ছাড়া এনগেজমেন্ট হলেও বিয়েটা হবে সে আসার পরই। তাই ভাইয়ের এনগেজমেন্ট ভিডিও কলেই উপভোগ করল সে।
পাশাপাশি বসে সৌধ, সিমরান। সৌধ যখন আলতো হাতে সিমরানের বা’হাত ধরে ডায়মন্ডের আংটি পরাচ্ছিল৷ সে সময় আপনাআপনিই সুহাসের চোখ দু’টো মুগ্ধতায় ভরে ওঠে। তার মনে হতে থাকে এত সুন্দর দৃশ্য এ পৃথিবীতে আর দু’টি দেখেনি। আর সৌধ যখন সিমরানকে স্পর্শ করল। আংটি পরাল অনুভব করল সিমরানের হাত কাঁপছে। এতে একটু বিস্মিত হয় সে। তাকায় সিমরানের মুখশ্রীতে। দেখতে পায়, কমলার কোষের মতো ঠোঁট দু’টি তিরতির করে কাঁপছে। নিমেষে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। মৃদুস্বরে বলে,
‘ ভয় পাচ্ছিস? ‘
ওই স্বর সিমরান ব্যতীত কেউ শুনতে পায় না। মুখে কিছু উত্তর দিতে পারে না সিমরান। আবেগান্বিত হয়ে পড়েছে। মাথা দিয়ে না বুঝাতে গিয়েও কেঁদে ফেলে৷ তানজিম চৌধুরী কাঁধ চেপে ধরে ওর। আদরে, আহ্লাদে ভরিয়ে তুলে। সুহাস এসে সম্মুখে বসে। আদুরে কণ্ঠে বলে,
‘ কাঁদছিস কেন? একটুও কাঁদবি না৷ চুপ। ‘
ভাই কাছে আসাতে কান্না গুলো বাঁধ ভাঙে। মনে পড়ে আম্মুকে। কী অদ্ভুত এক যন্ত্রণায় জর্জরিত হয় হৃদয়। বোঝাতে পারবে না কাউকেই। শুধু অনুভব করে এত সুখেও কিছু একটা নেই। মা ছাড়া যে প্রতিটি সন্তানই অসম্পূর্ণ। সৌধর খারাপ লাগে। এত মানুষের ভীড়ে স্বান্তনা দেয়ার মতো কিছুই খুঁজে পায় না। তবু কান্না থামাতে শান্ত চোখে তাকায়। শীতল গলায় শুধায়,
‘ কাঁদতেই থাকবি, আমাকে রিং পরাবি না ? ‘
আচমকা চুপ হয়ে যায় সিমরান। হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকায় সৌধর পানে। সৌধ নিজের বা’হাত এগিয়ে দিয়ে বলে,
‘ জলদি বাগদান সম্পন্ন কর সিনু। খিদে পেয়েছে আমার। খেতে দিবি না?‘