ত্রিধারে তরঙ্গলীলা | পর্ব – ৫১

সংসার জীবন সম্পর্কে ধারণা কম সিমরানের। কিন্তু স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেকার তিক্ত সম্পর্কে ধারণা বেশ৷ ছোটো থেকে বাবা মায়ের মধ্যে তিক্ততা দেখে বড়ো হয়েছে। ঝগড়া, বিবাধ করে কতকাল বাবা, মা একে অপরের মুখ দেখেনি হিসেব ছাড়া। তবে শেষদিকে এসবের অবসান ঘটেছিল। আফসোস একটাই সময়টা ছিল খুবই অল্প। দুঃখের দিনগুলো এত বেশি। সুখের দিন এত অল্প কেন? উত্তর জানা নেই মেয়েটার৷ তবে এবার মনে মনে তীব্র আতঙ্কিত হলো। বাবা, মায়ের অতীত জীবনের পুনরাবৃত্তি ঘটবে না তো? ভাই, ভাবির জীবনে!
নামী কোথায় গিয়েছিল? এই প্রশ্নের উত্তর মেলেনি। সুহাসও নাছোড়বান্দা। উত্তরের জন্য পিছু পিছু বেডরুমে গেছে। নিচ থেকে স্পষ্ট তর্ক শুনতে পেল সিমরান৷ ক্ষণে ক্ষণে দীর্ঘশ্বাস ফেলল মেয়েটা। আর ভালো লাগে না এসব। কবে সমাপ্তি ঘটবে এই অশান্তির? কবে একটু হাঁপ ছেড়ে নিঃশ্বাস নেবে সে।
ইদানীং বাবাকেও কেমন বিষণ্ণ লাগে। মায়ের মৃত্যুর পর বাবাও ভালো নেই। সারাজীবন ভালো না বেসে যে নারীর সঙ্গে সংসার করল। যে নারী তাকে দু’টো সন্তানের বাবা হওয়ার সুখ দিল। সেই নারী বিয়োগে এটুকু বিষণ্নতা স্বাভাবিকই। সিমরান অনুভব করল তাদের বাড়ি থেকে সুখ বিলীন হয়ে গেছে। আর মন থেকে ওঠে গেছে শান্তি৷ তারা এখন বিরাজ করছে সুখহীন অশান্তির রাজ্যে। এ রাজ্য থেকে কবে মুক্তি পাবে সে? দম বন্ধ হয়ে আসে ওর। চারপাশে দেখতে পায় শুধু ঘন অন্ধকার। একটু প্রশান্তির শ্বাস, কিঞ্চিৎ আলোর দেখা এ জন্মে পাবে তো? নিভৃতে ওর গাল বেয়ে দু ফোঁটা অশ্রু ঝড়ে পড়ে৷ সে অশ্রুকণা সন্তর্পণে মুছে নিয়ে নিজের রুমে গিয়ে হ্যান্ড পার্স আর সেলফোন নিয়ে বেরিয়ে পড়ে বুকভরে শ্বাস নিতে৷ এই দমবন্ধকর বাড়িটায় আর এক মুহুর্তও থাকতে ইচ্ছে করে না। তবু কিছুক্ষণের জন্য রেহাই পাওয়ার প্রত্যাশায় ছুটে বেরিয়ে যায়।
.
অনেকক্ষণ ধরে তর্ক করেও নামী মুখ ফুটে বলল না। কোথায় গিয়েছিল? সুহাসের ক্রোধ এবার গগনচুম্বী। নামী বুঝতে পারল তবু নিজের ক্রোধটুকু দমাতে পারল না। আপাতত সুহাসের মুখ দেখতে ইচ্ছে করছে না৷ মাথাটা দপদপ করছে। নতুন একটি সেলোয়ার-কামিজ বের করে তোয়ালে নিয়ে বাথরুম ঢুকে পড়ল সে। সুহাস অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দেখল সবই। নামী গোসল করে ভেজা চুলে তোয়ালে প্যাঁচিয়ে বেরুতেই ফের সে প্রশ্ন করল,
‘ কোথায় ছিলে সারাদিন? কোথায় গিয়েছিলে? ‘
বিরক্ত হলো নামী। এই ঘ্যানঘ্যান আর ভালো লাগছে না। খিদে পেয়েছে খুব। শরীরটা দুর্বল লাগছে। তাই কিছুই বলল না। চুপচাপ গিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসল। চুলগুলো ভালো করে মুছে নিয়ে মুখে ক্রিম লাগালো। সুহাস উত্তর না পেয়ে মুখের লাগাম হারালো এবার। বলল,
‘ কার সঙ্গে ফূর্তি করে এলি! যে বলতে লজ্জা করছে?’
নিমেষে চটে গেল নামী। তড়াক করে ওঠে এসে তর্জনী উঁচিয়ে ক্রোধান্বিত কণ্ঠে বলল,
‘ মাইন্ড ইউর ল্যাংগুয়েজ ডক্টর. সুহাস খন্দকার। আমার ক্যারেক্টার তোমার মতো জঘন্য নয়। ‘
‘ তা তো দেখতেই পাচ্ছি। কার সঙ্গে ডেটে গিয়েছিলে সেটা বলো। ‘
সুহাস ইচ্ছে করে ঘাঁটতে শুরু করল। যাতে রাগান্বিত হয়ে সত্যিটা বলে দেয় নামী। সে নিজেও জানে নামী কেমন চরিত্রের মেয়ে৷ তবু খোঁচাখুঁচির স্বভাব তার। সুহাসের মনোভাব পুরোপুরি বুঝতে পারেনি নামী৷ সকালের ঘটনাটি নিয়ে তীব্র ক্রোধে জর্জরিত ছিল সে। তাছাড়া ইদানীং ঘনঘন মেজাজ হারাচ্ছে তার। মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে ত্বরিতবেগে। সবচেয়ে বড়ো কথা এই সুহাসকে তার অসহ্য লাগছে। তাই ওর বলা কথাটি মারাত্মক ভাবে আঘাত করল মাথায়। ফলশ্রুতিতে চিৎকার করে বলল,
‘ কী বললে তুমি? সবাইকে নিজের মতো চরিত্রহীন ভাবো? তোমার মতো ল’ম্পট চরিত্রের অধিকারী আমি না সুহাস খন্দকার! ‘
আকস্মিক নামীর মুখে এমন কথা শুনে সুহাসের ক্রোধও নিয়ন্ত্রণ হারালো। মস্তিষ্ক বিগড়ে গেল নিমেষে। চোখ, মুখ খিঁচিয়ে বলল,
‘ আমি চরিত্রহীন! ল’ম্পট! তুমি যদি এতই সৎ চরিত্রের অধিকারী হও। সাহস করে বলতে পারছ না কেন কোথায় গিয়েছিলে? আমি ল’ম্পট? আমি? তাহলে… তাহলে ইউ আর অ্যা বেড কিড! শুনতে পেয়েছ? ইউ আর এ বেড কিড! এজন্যই ঠিক এজন্যই স্বামীর মুখোমুখি হয়ে বলতে পারছ না সারাদিন কোথায় কার সাথে কাটিয়ে এলে। ‘
সহসা থরথর করে কেঁপে ওঠল নামী। ক্রোধে চোখ দু’টো রক্তিম বর্ণ ধারণ করল। শেষ পর্যন্ত বাবা, মা পর্যায়ে চলে গেল সুহাস? সে খারাপ মানুষের সন্তান? আচম্বিতে মায়ের সরল মুখটা ভেসে ওঠল চোখের পাতায়৷ মুহুর্তেই আত্মাটা হুহু করে কেঁদে ওঠল মেয়েটার। আচমকা তেড়ে এসে সুহাসের কলার চেপে ধরে বলল,
‘ আমার মৃত মাকেও ছাড়লে না তুমি! আমার মা খারাপ নয় সুহাস। আমার মা মাটির মতো মানুষ ছিল। যার সঙ্গে জোচ্চুরি করেছিল তোমার মা৷ বিশ্বাস না হলে তোমার বাবাকে জিজ্ঞেস করে দেখো। তাহলেই বুঝতে পারবে আমার মা কী ছিল? আর তুমি যে মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতে পারোনি বলে আমার সঙ্গে দূরত্ব বাড়িয়েছ সে মা কী ছিল। ‘
নামী কথার সমাপ্তি দিতে পারল না। নিজের মাকে জোচ্চর বলাতে সুহাসের মাঝে ভর করল পশু রূপি পৌরুষ। সহসা নামীর দু’গাল প্রচণ্ড শক্ত করে চেপে ধরে বলল,
‘ কী বললি! আমার মা জোচ্চর, আমার মা জোচ্চর?’
বলতে বলতে নামীর গাল চেপে ধরা অবস্থাতেই এগুতে লাগল। আর নামী পিছুতে পিছুতে একদম দেয়ালের সঙ্গে ঠেকে গেল৷ পুরুষালি শক্ত চাপে গাল দু’টো ব্যথায় টন টন করে ওঠল তার। অনুভব করল তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। সর্বাঙ্গ অবশ। আচমকা স্মরণ হলো, আজ দুপুরের কাঙ্ক্ষিত মুহুর্তের কথা। যে সময় প্রথম জানতে পারল সে মা হচ্ছে। তার গর্ভে বেড়ে ওঠছে তার আর সুহাসের ছোট্ট একটি অংশ। দু-চোখ বেয়ে অশ্রু গড়াল মেয়েটার। সুহাসের ক্রোধ মিশ্রিত রক্তিম চোখে তাকিয়ে মাথা দু’দিকে নাড়াল। অর্থাৎ, সুহাসের মা জোচ্চর ছিল না। একজন মৃত মানুষকে এভাবে বলতে চায়নি নামী। ক্রোধের বশে কীভাবে বলে ফেলল জানে না। সুহাস বলেছে বলে তারও বলতে হবে? তাহলে দুজনের মধ্যে তফাৎটা কোথায় থাকল? আচমকা নিজের একটা হাত তলপেটে চলে গেল নামীর। ওখানটায় কেমন কাঁপছে। বাবা, মায়ের ঝগড়াতে ভয় পাচ্ছে কি তার ছোট্ট সোনামুনিটা? বাবা মাকে কষ্ট দিচ্ছে বলে তারও কি কষ্ট হচ্ছে খুব?
নামীর ক্রন্দনরত অসহায় মুখশ্রী দেখে শেষ পর্যন্ত ছেড়ে দিল সুহাস৷ রাগে হিসহিসিয়ে বেরিয়ে গেল রুম থেকে। আর নামী ওখানেই বসে পড়ল। অঝড় কান্নায় ভেঙে পড়ল মেয়েটা। চিৎকার করে কাঁদল। তার কান্নার শব্দ সিঁড়ি পেরুতে পেরুতেও শুনল সুহাস।
.
.
দেড়মাস পর:
সেদিনের পর যে সকালটা এসেছিল। সে সকালে আর নামীর দেখা পায়নি কেউ। শুধু সেদিন নয় আজ সাতচল্লিশ দিন হয়ে এলো নামীর দেখা নেই। আর না আছে কারো সঙ্গে যোগাযোগ। সেদিন স্বামী-স্ত্রীর মাঝে কী ঘটেছে কেউ জানে না। কিন্তু যত দিন এগুতে লাগল সুহাস যেন নিভে যেতে শুরু করল। মারাত্মক ডিপ্রেশনে ভুগতে ভুগতে শেষ পর্যন্ত নামীর সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করল সে। প্রথমে সবগুলো নাম্বার বন্ধ পেল। তার বাবা, আর বোন বহু আগে থেকেই যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে। বরাবরই ব্যর্থ হয়েছে। তাদের ধারণা সুহাসের সাথে রাগ করে সবার সাথেই যোগাযোগ বন্ধ করেছে নামী। কিন্তু সুহাসের মনে কু ডাকছে। সে জানে নামী আমেরিকা যাবে। কতদিনের জন্য সেটা জানে না। সে আর নামী গেলে বিশ, পঁচিশ দিনের জন্য যেত৷ যেহেতু সে যাচ্ছে না। তার সঙ্গে নামীর সম্পর্কের ফাটল ধরেছে। সেহেতু নামী একাই যাবে। কিন্তু গিয়ে যদি আর না আসে? এই ভয়েই নামীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে মরিয়া হয়ে ওঠে ছেলেটা। ফোনে না পেয়ে নামী যেখানে থাকে সেখানে যায়৷ জানতে পারে পিএইচডি করার জন্য দেশের বাইরে যাবে নামী। কিন্তু কবে, কখন আর বর্তমানে নামী কোথায় আছে এসব কিচ্ছু জানতে পারেনি। কেউই সঠিক বলতে পারেনি।
নামীর ওখান থেকে ফিরে এসে সৌধর সঙ্গে যোগাযোগ করে সে। আর কাউকে কিছু না বললেও সৌধকে খুলে বলে সবটা। সব শুনে প্রচুর গালাগাল করে সৌধ৷ হু’মকি দেয়,
‘ সামনে পেলে তোকে মে’রে তক্তা বানিয়ে দেব শা’লা। ‘
সুহাস বিষণ্ন চিত্তে জবাব দেয়,
‘ তক্তা এমনিতেই হয়ে গেছি দোস্ত। প্লিজ নামীকে খুঁজে দে। ‘
‘ তোর মতো লিজেন্ড আমি দু’টো দেখিনি। আর কতবার বউ হারাবি তুই? ‘
সুহাস ধরা গলায় বলে,
‘ আমি ভুল করেছি সৌধ৷ আমি আর পারছি না এভাবে থাকতে। আমার নামীকে চাই, আমার নামীদামিকে চাই সৌধ। ‘
‘ এক মিনিট, ফারাহর সঙ্গে কথা বলেছিস? ‘
সহসা চমকে ওঠল সুহাস৷ কোনোকিছু না বলেই ফোন কেটে দিয়ে সেই মুহুর্তেই কল করল ফারাহকে। ফারাহ রিসিভ করেই উত্তেজিত গলায় বলল,
‘ আরে সুহাস ভাইয়া, কেমন আছেন? ভাবছিলাম আপনাকে কল করব। এই নামীটার কী হয়েছে বলুন তো? ফোন অফ, ফেসবুক আইডি বন্ধ করে রেখেছে। হোয়াটসঅ্যাপেও এক্টিভ নেই। ‘
নিমেষে নিঃশ্বাস আঁটকে গেল সুহাসের। দু-চোখ বেয়ে না চাইতেও জল গড়িয়ে পড়ল৷ ফোন কেটে দিল আচমকা। ফের কল করল সৌধকে। সৌধ শুনতে পেল নাক টানার শব্দ। হকচকিয়ে বলল,
‘ কী রে ভাই! বউ হারিয়ে হাত, পা ছড়িয়ে কাঁদছিস নাকি? ‘
ধরা গলায় সুহাস বলল,
‘ ফারাহ কিচ্ছু জানে না৷ ও নিজেও নামীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছে। ‘
এ পর্যায়ে সৌধও চিন্তিত হলো। সে ডিউটিতে আছে বলে তাড়া নিয়ে বলল,
‘ দোস্ত আমি ডিউটিতে। ডিউটি শেষ করে ফোন দিই। তুই কোনো চিন্তা করিস না। নামী যেখানেই আছে ভালো আছে৷ ও খুব বুদ্ধিমতী মেয়ে। নিজেকে ভালো রাখার মন্ত্র খুব ভালো করেই জানে। নামী ভালো আছে এটুকুতেই তুই শান্ত থাক। রাগ, অভিমান করে বউ হারালে বউ খুঁজে পাওয়া যায় নো টেনশন। ‘
.
.
পরিবার নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় ভুগছে সোহান খন্দকার। গোপনে সে খবর পেয়েছে নামী আমেরিকায় যাওয়ার তোরজোর শুরু করেছে। ভিসা রেডি। নামীর ওপর অভিমান হলো মানুষটার৷ মেয়েটাকে এত ভালোবাসে। আর সে সুহাসের সাথে অভিমান করে তার সঙ্গেও যোগাযোগ বন্ধ করে দিল! নিজের বাড়ির লোকের সঙ্গে যোগাযোগ করে নামী৷ তাদের মাধ্যমেই জানতে পেরেছে, খুব তাড়াতাড়িই সে আমেরিকায় পারি জমাবে। তাই নামীর বাবা বন্ধু আখতারুজ্জামানের সাথে যোগাযোগ করেছে সোহান। নামী যাচ্ছে অসুবিধা নেই তার। নিজের স্বপ্ন পূরণ করুক মেয়েটা। অনেক সময় দূরত্বও কাছে আসতে সাহায্য করে। যদি সৃষ্টিকর্তা সুহাস, নামীর সংসার চায়। তাহলে ওরা আবার এক হবে। সে আর জোরজুলুম করবে না। অনেক হয়েছে আর না৷ ছেলেমেয়ে এখন বড়ো হয়েছে। তার শাসন বারণ আর মানে না। তাই যদি মানত সে এত বোঝানোর পরও, নিষেধাজ্ঞা করার পরও নামী বাড়ি ছাড়া হতো না৷ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রাখত না। বয়স হয়েছে সোহানের। দুনিয়ার ঝুটঝামেলা আর ভালো লাগে না। সেই কবে নিলু হারিয়ে গেল জীবন থেকে। এরপর একদিন শুনতে পারল দুনিয়া থেকেও বিদায় নিয়েছে মানুষটা। হারিয়ে গেল উদয়িনীও। এত তাড়াতাড়ি কেন তারা চলে গেল? এই গোটা পৃথিবীতে নিজেকে সম্পূর্ণ নিঃশ্ব লাগে সোহানের। দুনিয়ার মোহ, মায়া ত্যাগ করতে ইচ্ছে করে। পারে না শুধু মেয়েটার জন্য।
সোহান খন্দকারের ঘনিষ্ঠ এক বন্ধু এসব শুনে তাকে পরামর্শ দিল আল্লাহর দরবারে যেতে। তাহলেই তার সব সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে। হৃদয়ে প্রশান্তি আসবে৷ জীবনে টাকা, পয়সা অনেক রোজগার করেছে। এবার পরকাল নিয়ে চিন্তা করতে পরামর্শ দিল। বন্ধুর কথাটি মনে ধরল সোহানের। সায় দিল সে। তখন বন্ধু বলল, ‘ ছেলেকে তো বিয়ে করিয়েছ। এবার মেয়ের ব্যবস্থা করো। তারপর চলো দু’জন একসাথেই হজ্জে চলে যাই। আমার সবগুলো বিয়ে করানো শেষ। ছোটো মেয়ে ইন্টারে পড়ে। তবু বিয়ে দিয়ে দিছি। শশুর বাড়ির লোকেদের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে পড়াশোনা শেষ না হওয়া পর্যন্ত মেয়ে আমার ঘরেই থাকবে। ‘
বন্ধুর এহেন কথা শুনে সহসা নড়ে ওঠে সোহান খন্দকার। সিমরানের বিয়ে! এটা নিয়ে তো আর ভাবা হয়নি। অথচ ভাবা উচিত ছিল তার। চোখের সামনে মেয়েটা সারাক্ষণ মনমরা হয়ে থাকে৷ একাকীত্বে ভুগে টের পায় সে। অনার্স শেষ হতে আর দেড়, দু’বছর। এবার বাবা হিসেবে ওর জীবন গুছিয়ে দেয়া উচিত। তার আদরের মেয়েটা এমন বিষণ্নতায় ভুগছে। ছন্নছাড়া জীবন কাটাচ্ছে। আর সে একবারো ভাবেনি তার জন্য উপযুক্ত সঙ্গী বাছাই করার? মনের সঙ্গে বোঝাপড়া করে বন্ধুকে বলল,
‘ আমার একটামাত্র মেয়ে জাবের। কোনদিকেই কোনো কিছুর কমতি নেই। সুপাত্রের খোঁজ পেলে জানিও। ‘
ঠিক এর পনেরো দিনের মাথায় বন্ধু জাবের আলী ফোন করল সোহান খন্দকারকে। জানালো,
‘ তোর মেয়ের জন্য যোগ্য পাত্র পেয়েছিরে সোহান। ছেলে এডভোকেট। ‘
পাত্রের বিবৃতি দিতেই পছন্দ করে ফেলল সোহান। বলল আগামীকালই ছেলেকে দেখতে যাবে সে। তার যদি সবকিছু মিলিয়ে পছন্দ হয়। তবেই মেয়ের সঙ্গে আলোচনায় বসবে। কথানুযায়ী ছেলেকে দেখে এসে সিমরানের সঙ্গে আলোচনায় বসে সোহান খন্দকার। বাবার মুখে বিয়ের কথা শুনে মুখে আঁধার নেমে আসে সিমরানের। ছেলের বিবৃতি শুনে স্তম্ভিত হয়ে যায়। এ জীবনে কি আর কাউকে হৃদয়ে স্থান দিতে পারবে? অসহায় বোধ করে খুব। সোহান খন্দকার টের পায় মেয়ের অনুভূতি। তাই বোঝায়,
‘ মা আমরা যা চাই সব সময় কি তা পাই? পাই না। জীবন অনেক কঠিন রে মা। সৃষ্টিকর্তা আমাদের যা দেয় তাই নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। যা দেয় না তা নিয়ে আফসোস করতে হয় না। মনে রাখতে হয়, যা কিছু পেলাম তাতে নিশ্চয়ই মঙ্গল আছে। যা পেলাম না তা আমার জন্য মঙ্গলদায়ক না। ‘
মন কাঁদছে সিমরানের। কিন্তু বাবাকে বুঝতে দিল না। সে জানে তার বাবা ভালো নেই। ছেলেমেয়েদের নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় ভোগে খুব। কিয়ৎক্ষণ মাথা নিচু করে বসে রইল সে। সোহান খন্দকার চাতক পাখির ন্যায় মেয়ের অনুমতির অপেক্ষা করতে লাগল। সিমরানের গাল বেয়ে টপটপ করে অশ্রু গড়াল৷ তীব্র কষ্টে কেঁপে কেঁপে ওঠল বুক। ভেতরটা হাহাকার করে বলল, ‘ সৌধ ভাই, আমি অন্য কারো বউ হয়ে যাব! আমার জন্য অন্য কাউকে বাছাই করেছে আব্বু। জাস্ট অনুমতি দিলেই অন্য কেউ এসে আমাতে অধিকারত্ব পাবে! ‘
আচমকা হুহু করে কেঁদে ফেলল সিমরান। সোহান খন্দকার চমকে ওঠল৷ কাছে টেনে নিল মেয়েকে। বাবার বুকে মুখ লুকিয়েও কাঁদল খুব৷ মেয়ের কান্না দেখে সোহান খন্দকারের চোখ বেয়েও জল গড়াল। মনে মনে ভাবল,
‘ তোর যন্ত্রণা আমি বুঝি রে মা। কিন্তু কী করব বল? আমরা যে নিরূপায়। যার হাতে দিব সেই তো তোকে নিতে চায় না৷ বাবা হয়ে কী করে এমন কারো হাতে তোকে তুলে দেই। যে তোকে গ্রহণ করতে অনাগ্রহী। নিজ জীবন দিয়ে যা উপলব্ধি করেছি তা অন্য কাউকে করাতে চাই না। আর না তোর জীবনটা তোর মায়ের মতো হোক এটা চাই। ‘
মুখে বলল,
‘ জোর নেই মা। তুই না চাইলে আমি আর কথা আগাব না। ‘
সহসা মাথা তুলল সিমরান। কান্না থেমে গেছে তার। তবু চোখ দু’টি অশ্রুসিক্ত। ওষ্ঠদ্বয় ভেজা। নিজেকে প্রাণপণে সংযত করার চেষ্টা করে বলল,
‘ আমার না চাওয়ার কোনো কারণ নেই আব্বু। তুমি কথা আগাও। কোনো সমস্যা নেই আমার। এই পৃথিবীতে সবাই তার ভালোবাসার মানুষকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পাবে, এর কোনো মানে নেই।’

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।