ত্রিধারে তরঙ্গলীলা | পর্ব – ৩৫

সুগন্ধা পয়েন্টে তিনটে কাপল রুম ভাড়া করেছে সৌধ। যার দু’টিতে কাপল থাকলেও একটিতে সে একা থাকবে৷ বিষয়টা মজার নাকি আফসোসের? আফসোসের হওয়ার কথা থাকলেও মনের ওপর জোর প্রয়োগ করে মজার হিসেবেই নিল। বিলাসবহুল হোটেল রুমে বিরহ যন্ত্রণা বুকে পুষে কাটিয়ে দিল শেষরাত। সূর্যোদয়ের সময় গলায় ক্যামেরা ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়ল বিচের উদ্দেশ্যে। কেউ বিরহে নিদ্রাহীন কাটায় তো কেউ তীব্র অনুরাগে। নামী আর সুহাসের জীবনে সবচেয়ে স্মরণীয় রাত ছিল আজ। আজকাল সুহাসের ভালোবাসায় খুব যত্ন মিশে থাকে। সময়ের সাথে সাথে একটা মানুষ কতটা বদলায় সুহাস তার চাক্ষুষ প্রমাণ। এই দুষ্টু ছেলেটাকে নামী এখন পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। বলা যায় তার পুরো পৃথিবীটাই এখন একমাত্র বর সুহাসকে ঘিরে। প্রথম হানিমুনের প্রথম ঘনিষ্ঠতার পর সুহাস যখন কানে কানে ফিসফিস করে বলল,
‘ মিসেস সুহাসিনী, সমুদ্রপাড়ে একসঙ্গে সূর্যোদয় দেখা কি বাকিই থাকবে? ‘
নামী নাজুক মুখে মুচকি হেসে মাথা নাড়ায়। বলিষ্ঠ বুকটায় মাথা রেখে গভীর নিঃশ্বাস ছাড়ে। বলে,
‘ নো মিস্টার সুহাস, একে একে একসঙ্গে সব স্বপ্নই পূর্ণ করব। ‘
এরপরই বেরিয়ে পড়ে দু’জন। পথিমধ্যে সুহাস, নামীর সাথে দেখা হয়ে গেল সৌধর। সুহাস উৎফুল্লতার সঙ্গে বলল,
‘ আরে দোস্ত ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিস! ‘
‘ তো আর কী করব? আমার তো বউ নেই যে তাকে নিয়ে বেরুবো। ‘
আকস্মিক কথায় থতমত খেয়ে গেল সুহাস। সৌধর মনের অবস্থা কী? কতখানি যন্ত্রণা বুকে পুষে ছেলেটা তাদের সঙ্গে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছে সবই বুঝতে পারল৷ এ মুহুর্তে উচিত ছিল সিঙ্গেল ভাবে সৌধকে সময় দেয়া। কিন্তু সৌধর জেদেই কাপল হয়ে আসতে বাধ্য হলো। সুহাসের থমকে যাওয়া দেখে সৌধ হো হো করে হেসে ওঠে বলল,
‘ কী রে মুখ চুপসে গেল কেন তোর? দ্রুত পা চালা কাপল পিক তুলে দিব। ‘
দুই বন্ধুর কথোপকথন চলছিল এদিকে নামী প্রচণ্ড লজ্জায় কাচুমাচু হয়ে রইল৷ কারণ, সে বুঝতে পারেনি সৌধর সঙ্গে এভাবে দেখা হয়ে যাবে। সাতসকালে তারা জামাই, বউ গোসল করে বেরিয়েছে। লজ্জা অবশ্য এটা নিয়ে পাচ্ছে না। লজ্জা পাচ্ছে তার ইয়া লম্বা, ঘন চুল গুলো ভেজা দৃশ্যমান বলে। লজ্জায় নিঃশ্বাস আঁটকে গলার ওড়না মাথায় তুলল চটপট। নামী লজ্জা পাচ্ছে টের পেয়ে সুহাস ওর গা ঘেঁষে ফিসফিস করে বলল,
‘ লজ্জা পাচ্ছ কেন? বন্ধু আমার ইজি থাকো। ‘
সৌধ খেয়াল করল সুহাস, নামী দু’জনেরই চুল ভেজা৷ ভোরবেলা সদ্য স্নান করে আসা কপোত-কপোতী। ভেবেই গোপনে হাসল সে। নামীর ভেজা চুল চুইয়ে পানি ঝড়ছে। ফলে কামিজের পেছনের অংশ ভিজে গেছে অনেকটা। ওড়না দিয়ে অর্ধেক চুল ঢাকা পড়লেও বাকিটা উন্মুক্ত। ত্বরিত
দৃষ্টি সরিয়ে নিল সৌধ। বন্ধুর বউ হলেও নামীকে সে নিজের বোনের চোখে দেখে। তাই ও লজ্জা পেয়েছে বুঝতে পেরে সুহাসকে বলল,
‘ তোরা যা আমি এদিকটার কিছু দৃশ্য বন্দি করে আসছি। ‘
একসঙ্গে সূর্যোদয় দেখে কিছু সময় সমুদ্রপাড়ে কাটিয়ে ফেরার পথে হঠাৎ সুহাসের নজর পড়ল একটি বাচ্চা মেয়ের দিকে। যে তার বাবা, মায়ের হাত ধরে বালুচরে হাঁটছে। প্রকৃতির শান্ত, স্নিগ্ধ বাতাস গায়ে মাখাচ্ছে। সকালবেলায় মিষ্টি রোদে এই মিষ্টি দৃশ্যটি দেখে আচমকা সুহাসের মন বিগলিত হলো। পাশে থাকা স্নিগ্ধ মুখের রমণীকে আকস্মিক ডাকল,
‘ নামী। ‘
ত্বরিত সে ডাকে তাকাল নামী। উত্তর করল,
‘ বলো? ‘
সুহাস চোখে ইশারা করে মিষ্টি পরিবারটিকে দেখাল। চোখেমুখে দীপ্তি ফুটিয়ে বলল,
‘ লেটস প্ল্যান অ্যা বেবি? ‘
হৃদয়ে যেন বিদ্যুৎ স্পর্শ করল নামীর! আকস্মিক কথাটির ধাক্কা সামলাতে না পেরে সুহাসের হাত ছেড়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে পড়ল। চোখে বিস্ময় ফুটিয়ে মুখ হা করে তাকিয়ে রইল সুহাসের পানে। সুহাস মিটিমিটি হাসতে হাসতে হাত দু’টো তার থ্রি কোয়াটার প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে বলল,
‘ কী সুইট না?’
নামী পুনরায় তাকাল। সত্যি সুইট। কিন্তু সুহাস কী বলল এটা? ভেবে বলল নাকি ঝোঁকের মাথায়? সে যাইহোক কথাটা তার হৃদয়ে লেগেছে। অদ্ভুত অনুভূতিতে গা শিউরে ওঠছে৷ কেমন যেন কাঁদতে ইচ্ছে করছে। ইচ্ছেটা আপনাআপনিই প্রকাশ হয়ে গেল। তার চোখ বেয়ে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল নিমিষেই। কেন এমন হলো? কী ছিল সুহাসের কথাটিতে? অমন একটি কথা বলে সুহাসেরও মাথায় হাত। কী এমন অপরাধ হয়ে গেল হঠাৎ। যে নামী কাঁদছে? মুখটা পাংশু বর্ণে পরিণত হলো সুহাসের। দ্বিধান্বিত ভঙ্গিতে নামীর হাত চেপে ধরে বলল,
‘ সরি জান। মজা করছিলাম। আমরা নিজেরাই তো বেবি। আমাদের আবার কীসের বেবি প্ল্যান? ‘
এ কথায় আরো বেশি কান্না পেল নামীর। দু-চোখ উপচে পানি গড়াল অবিরত। সুহাস হতভম্ব মুখে তাকিয়ে নামীর হাত টেনে ধরে বলল,
‘ চলো ফিরে যাই। বকাঝকা, কান্নাকাটি সব রুমের ভেতর করবে। প্লিজ এখানে রিয়াক্ট করো না। এই সৌধটা কই চলে গেল। ‘
কথার ফাঁকে আশপাশে নজর বুলাল সে। দেখতে পেল একটু দূরেই সৌধ দাঁড়িয়ে। গলা ছেড়ে ডাকল তাই,
‘ এই সৌধ চল ফিরে যাই। আয়াজের খবরটা নিতে হবে তো… ‘
হোটেলে ফেরার পর নিজেদের রুমে ঢুকে সুহাসকে কিছু বলতে দিল না নামী৷ তার পূর্বেই শক্ত করে জড়িয়ে ধরল ওকে। বুকে মাথা রেখে নিঃশব্দে কাঁদল কিছুক্ষণ৷ সুহাসের এত্ত মায়া লাগল যে কী করবে কী বলবে কিছুই ঠাওর করতে পারল না। ওর মনোভাব বুঝে নামী নিজেই মাথা তুলল। দু-হাত বাড়িয়ে সুহাসের সহজসরল মুখটায় আলতো করে চেপে ধরে ভাঙা কণ্ঠে বলল,
‘ আমাদের তো সংসার করা হয়নি সুহাস। কবে সংসার হবে আমাদের? ‘
এবারে মাথা খুলল সুহাসের। কান্নার কারণ তবে এটাই? কিয়ৎক্ষণ ভেবেচিন্তে নামীর হাত দু’টো চেপে ধরে ডান হাতের তালুতে চুমু খেল। এরপর হাত বাড়িয়ে নামীর চোখের অশ্রু কণাগুলো মুছতে মুছতে বলল,
‘ সিম্পল একটি বিষয় নিয়ে কেউ এভাবে কাঁদে পাগলী! ‘
সুহাসের হাতের কব্জি ধরে হুহু করে কেঁদে ওঠল নামী। সুহাস আচমকা শক্ত করে জড়িয়ে ধরল ওকে। মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
‘ প্লিজ নামী! ডোন্ট ক্রাই, আমরা সংসার করব। জাস্ট আর কয়েক মাস। আমার ইন্টার্নি শেষ হোক। তোমারো ফাইনাল ইয়ারটা কমপ্লিট হতে থাকুক। তুমি তো খেয়াল করেছ মা’কে। সে কতটা শান্ত, শীতল হয়ে গেছে। বাবার সঙ্গে এখন সব স্বাভাবিক। আমার দৃঢ় বিশ্বাস খুব শিঘ্রই মা আমাদেরও মেনে নিবে। পুত্রবধূর অধিকার দিয়ে ঘরে তুলবে তোমাকে।’
সুহাসের কথাগুলো সত্যি না মিথ্যা জানে না নামী৷ কিন্তু এই মুহুর্তে এতটুকু স্বান্তনা বাণীর খুব প্রয়োজন ছিল তার খুব।
.
.
দরজায় ঠকঠক শব্দ শুনে দরজা খুলল আইয়াজ৷ দেখতে পেল সৌধ দাঁড়িয়ে। মলিন হাসল সে। সরে গিয়ে বিমর্ষ কণ্ঠে বলল,
‘ আয়। ‘
রুমের ভেতর উঁকি দিয়ে সৌধ দেখল ফারাহ এখনো গভীর ঘুমে। বুঝল, ঘুমের ওষুধের রেশ এখনো কাটেনি। আইয়াজের চোখ দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে সে ঘুমায়নি। চোখের পাপড়ি দেখে পুরোপুরি বুঝে গেল, এই ছেলে কান্নাকাটি করেছে। ধীরপায়ে হেঁটে রুমের ভেতর প্রবেশ করল সৌধ। ভাবল, কান্নাকাটি করাটা কি স্বাভাবিক নয়? তার মতো শক্ত মনের পুরুষ যদি ভালোবাসার মানুষটির বিয়ে মানতে না পেরে চোখে অশ্রু ঝড়ায় আইয়াজের মতো নরম মনের পুরুষ প্রেমিকার ধ র্ষিত হওয়ার গল্প শুনে কাঁদবে না? দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। ডিভানে বসতে বসতে বলল,
‘ পোশাকটাও পাল্টাসনি! আমি বসছি যা ফ্রেশ হয়ে নে৷ একসঙ্গে ব্রেকফাস্ট করব। সুহাস, নামী ওয়েট করছে। ফ্রেশ হয়ে এসে ফারাহকে ডাকবি। ‘
সৌধর কথায় নিঃশ্বাস চঞ্চল হলো আইয়াজের। স্থির অচঞ্চল ছেলেটা আজ বড্ড অস্থির আর চঞ্চল হয়ে ওঠেছে। ফারাহকে এক সেকেণ্ডও চোখের আড়াল করতে নারাজ মন। কিন্তু এ মুহুর্ত সৌধ এসেছে। তাই ওর ওপর ভরসা করে ওয়াশরুম ঢুকল। ঢোকার পূর্বে অবশ্য বলে গেল,
‘ যদি ওঠে আমাকে ডাকবি। ‘
সৌধ বাঁকা হেসে বলল,
‘ এত টেনশন নিচ্ছিস কেন? যে ঘুম দিয়েছে না ডাকলে পাঁচ, দশমিনিটে ওঠার সম্ভাবনা নেই। চিল ম্যান। ‘
আইয়াজ ওয়াশরুম ঢোকার পর সৌধ নিজের ফোন ঘাটাঘাটি করছিল হঠাৎ ডিভানের এক কোণে আইয়াজের ফোনের স্ক্রিনে নজর পড়ল। প্রাচীর ম্যাসেজ এসেছে? ফোনটা যে অবহেলায় পড়ে আছে বুঝতে পেরে হাত বাড়িয়ে ফোন কাছে এনে লক ছাড়াল। সুহাস, আইয়াজের দু’জনেরই লক তার জানা। তাই অসুবিধা হলো না৷ আর এটাই বোধহয় কাল হয়ে দাঁড়াল। কারণ প্রাচী জানে না তারা কক্সবাজার এসেছে। প্রাচী কেন বন্ধুদের মধ্যে কেউই জানে না। প্রাচী লিখেছে,
‘ দোস্ত জানিস ডক্টর নাকি অর্পণ স্যারের হাওয়া বদল করতে বলেছে৷ শরীর ফিট হলেও মন নাকি ফিট না৷ তাই নিধি আর অর্পণ স্যার আগামীকাল বেড়াতে যাচ্ছে। শা লা আমাদের বন্ধুর মন ভেঙে নিজের মন ফুরফুরা করতে কক্সবাজার যাচ্ছে। আমার শরীর একবারে জ্বলে গেছে এসব শুনে। নিধিটার ওপর রাগ হয় আবার মায়াও হয়৷ শা লার পরিবারের চাপে মেয়েদের কত কীই করা লাগে উফফ। ‘
প্রাচীর প্রথম ম্যাসেজের পর সেকেণ্ড ম্যাসেজ ছিল,
‘ সৌধর কী অবস্থা দোস্ত? আম্মা অসুস্থ বলে আমি আর থাকতেও পারলাম না। তোরা ওকে দেখে রাখিস ভাই। আর শোন নিধি আর অর্পণ স্যারের ঘুরতে যাওয়ার ব্যাপারটা ঘুণাক্ষরেও সৌধকে বলিস না৷’
তৃতীয় ম্যাসেজ,
‘ কীরে ছ্যামড়া রিপ্লাই করস না ক্যান? সৌধকে নিয়ে ব্যস্ত কি তোরা… শোন শোন আরেকটা কথা, সুহাসকেও ব্যাপারটা বলিস না। ওর তো আবার পেটে কথা থাকে না। মুখ ফস্কে বলে দিলেই বিপদ। ‘
ম্যাসেজ গুলো দেখা শেষে ভীষণ উত্তেজিত হয়ে পড়ল সৌধ৷ হাতের শক্ত মুঠোয় আইয়াজের ফোনটা নিয়ে ভয়াবহ এক আছাড় দিতে নিয়েও হঠাৎ থমকে গেল। নিজের কপাল দোষে অন্যের যন্ত্র কেন নষ্ট করবে কেন? হতাশ ভঙ্গিতে ফোন কিঞ্চিৎ দূরে ছুঁড়ে মেরে শরীর এলিয়ে দিল ডিভানে। মুখ হা করে শ্বাস নিল ঘনঘন। যেভাবেই হোক এই যন্ত্রণা থেকে বেরুতে হবে তার। যেভাবেই হোক ওই বেইমানটার মুখোমুখি হওয়ার আগে কক্সবাজার ত্যাগ করতে হবে। তার মাথায় যে খু ন চেপেছে এই খু নের শিকার অর্পণ স্যার হোক চায় না সে। কারণ সবশেষে নিধি বিধবা তকমা পাবে এটাও তার সহ্য হবে না। আনমনেই বাঁকা হাসল সৌধ৷ নিজের অশান্ত বুকে হাত বুলাতে বুলাতে বিরবির করে বলল,
‘ ভালোবাসা এক রহস্যময় অনুভূতি।‘

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।