ঠোঁটের কোণা বেয়ে পড়া রক্ত টুকু তর্জনীতে মুছে নিল নামী৷ মুছে নিল গাল বেয়ে পড়া অশ্রুটুকুও৷ এরপর নিজেকে যথাসম্ভব শক্ত করে নিয়ে দৃঢ় গলায় বলল,
‘ মিসেস উদয়িনী, অনেক বলেছেন আপনি। এবার আপনার শোনার পালা। ‘
চমকে গেল উদয়িনী। হতভম্ব মুখে তাকিয়ে রইল নামীর বিধ্বস্ত মুখপানে। বুক কেঁপে ওঠল বহু বছর পূর্বে দেখা সেই মুখটিকে মনে করে। সে মুখটা নিলুর। আজ নামী যেন নিলু রূপেই তার সামনে দাঁড়িয়ে। ঢোক গিলল সে। দৃষ্টিজোড়া তির্যক করে বলল,
‘ বেয়াদব মেয়ে নাম ধরে ডাকছিস আমার? ‘
‘ আপনি আমার খুব আদবের শাশুড়ি নন, অধিকারও দেননি যে শাশুড়ি মা বলে ডাকব। ‘
দাঁতে দাঁত পিষে কম্পিত গলায় বলল নামী। উদয়িনী স্তম্ভিত হয়ে গেল এই মেয়ের সাহস দেখে। তেড়ে আসল কষিয়ে আরো একটা থাপ্পড় লাগাতে। কিন্তু সফল হলো না। তার পূর্বেই নামী তার হাত ধরে ময়লা ঝাড়ার মতো করে ছুঁড়ে ফেলল। কিঞ্চিৎ ব্যথা পেয়ে মুখ হা হয়ে গেল উদয়িনীর। ডান বাহুতে চেপে ধরে চিৎকার করে ওঠল৷ তার সে চিৎকার শুনে রান্নাঘর থেকে সেলিনা আপা দৌড়ে এলেন। নামী আর এক মুহুর্ত দাঁড়াল না। এই নিচু মহিলার আর একটি কথা শোনা তো দূরে থাক মুখ দর্শনও করার ইচ্ছে নেই তার। শুধু সঠিক কিছু জবাব দিয়ে চলে যাওয়ার অপেক্ষা। এ ঘরে তার জন্য ছোট্ট একটা বুকশেলফ এনেছিল সোহান খন্দকার। উপরের তাকে শেষ দিকে কয়েকটা ডায়ারি। তার মধ্যে সবুজ রঙের সবচেয়ে পুরোনো ডায়ারিটা নিয়ে ফের উদয়িনীর সম্মুখে দাঁড়াল নামী। উদয়িনী অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে। নামী মুখে তাচ্ছিল্যতা মিশিয়ে হাসি ফুটিয়ে বলল,
‘ এই ডায়ারিটা আপনার ছেলেকে পড়তে বলেছিলাম। সে আপনাকে এতটাই বিশ্বাস করে। উহুম অন্ধ বিশ্বাস করে যে এটা ছুঁয়েও দেখেনি। ‘
ভয়ানক ভাবে চমকে গেল উদয়িনী। ত্বরিত তাকাল পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা সেলিনার দিকে৷ কড়া গলায় বলল,
‘ সেলিনা, তুই এখান থেকে যা। ‘
ভয়ে তৎক্ষনাৎ চলে গেল সেলিনা। উদয়িনী মানুষটাই এমন যার ভয়ে বাড়ির কাজের লোক থেকে পরিবারের সদস্য। সবাই তটস্থ থাকে। সেলিনা চলে যেতেই নামী আবারো তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল। বলল,
‘ এত ভয়! এটাই স্বাভাবিক। যারা অন্যায় করে ভয় তো তারাই পায়। ‘
‘ কী বলতে চাচ্ছিস তুই? ‘
চোখ, মুখ শক্ত হয়ে গেল নামীর। পৃথিবীতে বোধহয় এই মহিলাই প্রথম যে তার সঙ্গে কদর্য আচরণ করছে। তাই আর সময় নিল না সে। ডায়ারিটা দেখিয়ে বলতে শুরু করল,
‘ আমার কি মনে হয় জানেন? সুহাস ভয় পেত এটা পড়তে৷ যদি মায়ের বিরুদ্ধে কোনো চরম সত্যি জেনে যায়? পৃথিবীতে সবার বিশ্বাসঘাতকতা মেনে নেয়া যায়, কিন্তু জন্মদাত্রী মায়ের বিশ্বাসঘাতকতা না। যখন এটা বুঝতে পারলাম তখন থেকে আর চেষ্টা করিনি সুহাসের ভুল ভাঙাতে। আংকেলকেও নিষেধ করে দিয়েছিলাম। ডক্টর উদয়িনীকে দয়া করেছিলাম যেন তার ছেলে তাকে ভুল বুঝে দূরে চলে না যায়। আপনি কি জানেন, আপনার ভেতরের অমানবিকতা পুরোপুরি আপনার দুই ছেলেমেয়ে ধারণ করেনি। ওদের ভেতরে নিষ্পাপ একটা মন আছে? ‘
শেষ বাক্য দুটো ফিসফিস করেই বলল নামী। তীব্র ক্রোধে থরথর করে কাঁপতে শুরু করল উদয়িনী৷ ইচ্ছে হলো মেয়েটার গলা টিপে কণ্ঠনালী রোধ করতে৷ দু-হাত শক্ত মুঠ করে দাঁড়িয়ে রইল মূর্তির ন্যায়। নামী থেমে রইল না। সে বলতে থাকল লুকিয়ে রাখা সেই অতীত৷ যে অতীত ডায়ারিতে লিপিবদ্ধ করে গেছে নামীর মা নিলু।
‘ উদয়িনী আর নিলুফা বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল তাই না ডক্টর উদয়িনী? ‘
এ প্রশ্নে আতঙ্কিত হয়ে তাকাল উদয়িনী। নামী সব জানে সব৷ ঘামতে শুরু করল সে। ওড়নার কোণা ধরে মুছতে শুরু করল কপাল, মুখ আর গলা বেয়ে নিঃসৃত হওয়া স্বেদজল। নামী বলল,
‘ আম্মু আর আংকেলের সাত বছরের সম্পর্ক ছিল। আপনি ছিলেন আমার মায়ের ঘনিষ্ঠ বান্ধবী। আম্মু তার জীবনের সমস্ত ঘটনা আপনার সাথে শেয়ার করত৷ শেয়ার করেছিল আংকেলের কথাও। আপনাকে নিয়ে জাস্ট তিনবার দেখা করেছিল আংকেলের সাথে। প্রথম দেখাতেই আপনি চিনতে পারেন সোহান আংকেলকে। সোহান আংকেল আপনার বাবার বন্ধুর ছেলে। আপনার অহমিকায় আঘাত পড়ে সেদিনই। অত্যাধিক সুন্দরী হওয়া সত্ত্বেও আপনি নিখুঁত প্রেমিক আর ভালোবাসা পাননি। আর নিলু শ্যামলা চেহারার হয়েও সোহান খন্দকারের মতো সুদর্শন পুরুষের খাঁটি ভালোবাসা পাচ্ছে। ঠিক এখানটাতেই আঘাত পান আপনি। আপনার মনে হতে থাকে সোহান খন্দকার নিলুর জন্য পারফেক্ট নয়৷ উনি পারফেক্ট কেবল আপনার জন্যই। সেদিন থেকেই একের পর এক ষড়যন্ত্র শুরু করে দেন৷ আর আপনাকে সাহায্য করে আপনার বড়োলোক দাদুভাই, বাবা আর আপনার প্রয়াত শশুর, শাশুড়ি। তারা চাইতেন আপনার সঙ্গে আংকেলের বিয়ে হোক৷ এরপর আপনার বাবার সকল প্রোপার্টির মালিক হোক সোহান আংকেল। কারণ আম্মু মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে ছিল। মধ্যবিত্ত ছিল আংকেলের পরিবারও৷ তাই তারা আপনার মতো উচ্চবিত্ত পরিবারের মেয়েকে ঘরের বউ করার স্বপ্ন দেখেছিল। দু’জন মানুষের হৃদয় ভেঙে, স্বপ্ন ধ্বংস করে আপনারা সফল হয়েছেন৷ পূরণ করেছেন নিজেদের অন্যায় স্বপ্নকে। আম্মু যেদিন জানতে পারে তার ভালোবাসার মানুষটিকে কেড়ে নিয়েছে তারই প্রিয় বান্ধবী। সেদিন একদিকে ভালোবাসা হারানোর যন্ত্রণা অপরদিকে বান্ধবীর বিশ্বাসঘাতকতার বিষাক্ত ব্যথা সহ্য না করতে পেরে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। সে যাত্রায় আম্মু বেঁচে যায়৷ সোহান আংকেল সব বাঁধা পেরিয়ে হসপিটালে ছুটে আসে। নানা, নানু, মামাদের সামনে পা ধরে ক্ষমা চায় আম্মুর। আমার আম্মু নির্বাক হয়ে শুধু দুচোখে অশ্রু ঝাড়িয়েছিল। সোহান আংকেল বুঝে গিয়েছিল তার নিলু তাকে ক্ষমা করলেও তার সঙ্গে কথা বলতে বা তার মুখ দেখতে আগ্রহী নয়। ভালোবাসার মানুষকে চাইলেও ঘৃণা করা যায় না। আম্মুও পারেনি ঘৃণা করতে৷ তাই ক্ষমার সঙ্গে হৃদয়ে ধারণ করা পুরুষকে চিরমুক্তি দিয়ে দান করেছিল আপনাকে। আফসোস আপনার মনের কদর্যতার ভীড়ে সোহান আংকেল জায়গা পায়নি। একটা কথা চিরসত্য যা আম্মু স্পষ্ট করে লিখে গেছে, ঐ সময় পরিস্থিতি এমনই ছিল যে সোহান আংকেলকে পুরোপুরি দোষ দেওয়া যায় না৷ তবে আংশিক দোষী সে ছিলই৷ আমার কী মনে হয় জানেন মিসেস উদয়িনী? ওই ঘটনা গুলো যদি আজকের এই সময়ে ঘটত সোহান খন্দকারকে আপনি পেতেন না৷ আংশিক দোষীও সে হতো না। আফসোস সময়টা তখন অন্যরকম ছিল। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানরাই জানে পরিবারের প্রতি দায়বদ্ধতা কেমন হয় কী প্রকারের হয়? আংকেল মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান ছিল। আর মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদের সেক্রিফাইস করতে করতে জীবন, যৌবন সব ধ্বংস হয়ে যায়। যার চাক্ষুষ প্রমাণ সোহান আংকেল! তিনি তার নিলুকে এতটাই ভালোবাসত যে শেষে সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলে তার বন্ধু মানে আমার বাবার হাতে তুলে দেয় আম্মুকে। আম্মুও প্রেমিকের বাছাই করা পাত্রকে সাদরে গ্রহণ করে সুখের সংসার পাতে। আপনি হেরে গিয়েছিলেন, আবারো হেরে গিয়েছিলেন নিলুর কাছে। কারণ সে স্বামীর পরিপূর্ণ ভালোবাসা নিয়ে সংসার করেছে। যা আপনি আজো পারেননি। ‘
দু’হাতে কান চেপে ধরে চিৎকার করে ওঠল উদয়িনী।
‘ তুই থাম, থাম তুই নিলুর বাচ্চা! ‘
ঘৃণাভরে তাকায় নামী। একজন উচ্চশিক্ষিত মানুষ কতটা হিংসাত্মক হতে পারে উদয়িনীই তার প্রমাণ।
সে খেয়াল করল, উদয়িনীর দু’চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠেছে৷ কান থেকে হাত সরিয়ে বুকের বা’পাশে শক্ত করে চেপে ধরে আছে। তাই জিজ্ঞেস করল,
‘ কষ্ট হচ্ছে নিজের ব্যর্থতাকে স্মরণ করে? বয়স তো অনেক হলো তবু কেন বুঝতে পারছেন না, ষড়যন্ত্র করে আর যাইহোক জীবনে সফলতা অর্জন করা যায় না। ‘
‘ শাটআপ! ‘
‘ সত্যিই মানতে হবে.. মনে জোর না থাকলেও মুখে বেশ জোর আপনার। আম্মু ঠিকই বলেছে আই মিন ঠিকই লিখেছে। ‘
মৃদু হাসল নামী। যে হাসি উদয়িনীকে আরো বেশি ক্ষিপ্ত করে তুলল। আর সহ্য করতে পারছিল না সে। নামীও বুঝল যতটুকু বলার ছিল বলা শেষ। এবার যেতে হবে। তাই বলল,
‘ মিসেস উদয়িনী? আজ আমি এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছি। আপনার যদি ক্ষমতা থাকে স্বামী আর পুত্রকে আমার থেকে আটকে রাখবেন৷ যদি না পারেন সেই দায় আমার নয়। আমি স্টিল নাও সুহাস খন্দকারের স্ত্রী। আমার স্বামী যদি সম্মানের সাথে আমাকে গ্রহণ করতে চায় পৃথিবীর কারো ক্ষমতা নেই আমাকে ওর জীবন থেকে সরিয়ে দেয়ার৷ আর আমার স্বামী যদি আমাকে ত্যাগ করতে চায় পৃথিবীর কারো ক্ষমতা নেই তার জীবনে আমাকে আটকে রাখার জাস্ট মাইন্ড ইট। ‘
এরপরই নিজের জিনিসপত্র নিয়ে বেরিয়ে যায় নামী।
উদয়িনী নামীর মুখে অতীত শুনে কিছুক্ষণের জন্য অস্বাভাবিক হলেও পরোক্ষণেই সামলে ওঠে। আর মনে মনে বিজয়ের হাসি হাসে৷
দু’জন যুবক, যুবতী এক বাড়িতে রয়েছে। সম্পর্কে স্বামী – স্ত্রী৷ যতই ছেলের মনে বিষ ঢুকিয়ে দিক। পুরুষ মানুষ তো। আর নামী, সে তো নিলুর মতোই বশীকরণমন্ত্র জানে৷ নয়তো কীভাবে আকস্মিক তাদের জীবনে হানা দিল? স্বামী, সন্তানকে বশ করে কীভাবে প্রবেশ করল এ বাড়িতে? নিজের ভুলটা বুঝতে পারল উদয়িনী। একদমই উচিত হয়নি সুহাসকে এভাবে ছেড়ে রাখা। না জানি ঠিক কতটা গভীরতায় পৌঁছেছিল নামী আর সুহাসের সম্পর্ক। সে ভয়েই নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে উদয়িনী। মুখে যা ইচ্ছে তাই বলেই ক্ষ্যান্ত হননি। গায়েও হাত তুলেছে৷ কিন্তু ভাবতেও পারেননি এর পরিণাম ঠিক কী দাঁড়াতে পারে। যে ভয়ে সে নামীর সঙ্গে অমানবিক আচরণ করল। আজকের পর থেকে সেটাই যে সত্যি হবে ঘুণাক্ষরেও টের পেলেন না। সে কেবল নামীর বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়াটা উপভোগ করলেন। বহু বছর আগের মতোই মনে মনে মিথ্যা স্বান্তনা পেলেন। কিন্তু সে ভুলে গিয়েছিল সোহান খন্দকার নিলুকে ভালোবাসলেও বিয়ে করতে পারেনি। এই একটা জায়গায় আটকে ছিল সোহান।
আর সুহাস নামীকে ভালো না বাসলেও তিন কবুল পড়ে বিয়ে করেছে। আইনিভাবেও স্বীকৃত বউ নামী সুহাসের। যেখানে সম্পর্ক হালাল সেখানে মনের মিলন হতে কতক্ষণ? সৃষ্টিকর্তা হারাম সম্পর্কে রহমত দান না করলেও হালাল সম্পর্কে ঠিকই রহমত দান করেন৷
***
ক্লাস শেষ করে ক্যাম্পাসের পেছনে চলে এলো চার বন্ধু আর দুই বান্ধবী। পরপর সিঁড়িতে বসল সবাই। আইয়াজের মুখ ভার। তার মনের বিষণ্ণতা চোখ, মুখ উপচে বেরুচ্ছে। সর্বপ্রথম খেয়াল করেছে নিধি। ক্লাস টাইমেই সে খেয়াল করে আজ আইয়াজ অন্যমনস্ক। ক্লাসের সবচেয়ে মনোযোগী ছাত্রের অমনোযোগী রূপ দেখে শুধু বন্ধুরাই নয়। বায়োকেমিস্ট্রি লেকচারারও ধমকেছে। হঠাৎ করে কী হলো আইয়াজের? সবাই বেশ চিন্তিত। সৌধ আজিজকে বলল,
‘ ও তো কিছু বলবে না। নিজের সমস্যা গুলো বরাবরই চেপে রাখে৷ তুই’ই ওর এ কয়েকদিনের গতিবিধি জানা৷ ‘
আজিজ আর আইয়াজ হোস্টেলে একই রুমে থাকে। তাই আজিজ গড়গড় করে বলতে শুরু করল,
‘ আর বলিস না মাম্মা, কয়টা মাস ধরে এই শা’লার জন্য ঘুমাইতে পারি না৷ এগারোটা পর্যন্ত বইয়ে মুখ গুঁজে থাকে। তারপরই শুরু হয় ক্যালমা। এই ক্যালমা চলতে চলতে ফজরের আজানও দিয়া দেয়। তাও শা’লার ক্যালমা শেষ হয় না। ক্যালমা দেখাইতে দেখাইতে কাল রাত থেকে ভং ধরছে৷ ‘
আজিজের কথার ধরন দেখে সুহাস হেসে কুটিকুটি। প্রাচী সুহাসের মাথা গাট্টা মেরে বলল,
‘ সিরিয়াস মোমেন্টে হাসবি না সুহাস৷ ‘
সুহাস হাসি থামালে নিধি আজিজকে বলল,
‘ মন মেজাজ ভালো নাই আজিজ৷ ভণিতা না করে ভালোয় ভালোয় বল কাল রাতে কী হয়েছে? ‘
সৌধ নিধির কুঁচকানো কপালের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ তোর সমস্যা কী? ঠিক কাকে মেজাজ দেখাচ্ছিস তুই? ‘
সৌধর কথায় ভ্রুক্ষেপ করল না নিধি। আজিজের সামনে গিয়ে কড়া গলায় বলল,
‘ তুই বলবি? ‘
ঢোক গিলল আজিজ। বলল,
‘ আররে মাম্মি ডর দেখাস ক্যান।’
চোয়াল শক্ত করে কঠিন চোখে তাকাল নিধি। আজিজ ভড়কে গিয়ে বলল,
‘বলতাছি বলতাছি।’
ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে থম মেরে বসে থাকা আইয়াজের দিকে তাকাল নিধি। আজিজ বলল,
‘ কাল রাত দুইটার সময় ফারাহ ফোন করে নাকি অনেক কান্নাকাটি করেছে৷ আর বলেছে সম্পর্কটা আর আগানো সম্ভব না। ‘
‘ হোয়াট! ‘
সৌধ, নিধি, প্রাচী, সুহাস চারজন একইসঙ্গে চ্যাঁচিয়ে ওঠল। সৌধ বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়ল। বলল,
‘ মামাবাড়ির আবদার নাকি! আইয়াজ এই মেয়ে তোর ইমোশন নিয়ে খেলল না তো? ‘
প্রাচী ক্রোধ মিশ্রিত গলায় বলল,
‘ ভোলাভালা পোলাপানের সাথে এটাই হয়। ধূরর বা’ল ইনোসেন্ট পোলাডার জীবনে একটা প্রেম আসল তাও নাকি এমন। ‘
বলতে বলতেই আইয়াজের পাশে গিয়ে বসল প্রাচী৷ চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
‘ দোস্ত প্লিজ তুই ভেঙে পড়িস না। মাত্র কয়েক মাসেরই তো ব্যাপার। মুভ অন করে ফেল। ‘
প্রাচীর এহেন কথা আইয়াজ এমন ভাবে তাকাল যে উপস্থিত সকলেই ভয় পেয়ে গেল। সৌধ বুঝতে পারল আইয়াজের মনের অবস্থা তাই সবাইকে সরতে বলে ও গিয়ে বসল পাশে। বলল,
‘ কী কারণে ফারাহ এমনটা বলেছে? ‘
নিধি বলল,
‘ আমি কি একবার নামীর সাথে কথা বলব? ‘
তৎক্ষনাৎ সুহাস বলল,
‘ নামীদামির কারসাজি নয়তো? ‘
সৌধ ধমকে ওঠল। বলল,
‘ ফাইজলামি করবি না সুহাস৷ আমরা এখন সিরিয়াস আলোচনা করছি৷ ‘
এ কথা বলেই আইয়াজের কাঁধে হাত রেখে বলল,
‘ কারণ বলেনি? ‘
আইয়াজ মাথা নাড়িয়ে না বুঝিয়ে বলল,
‘ অনেক কান্নাকাটি করছিল আর সম্পর্কের ইতি টানতে চাচ্ছিল। এ-র বেশি কিছুই বলেনি। ‘
‘ তুই কি বললি? ‘
‘কিছু না, ফোন কেটে দিয়েছি। ‘
নিধি বলল,
‘ শখ করে ব্রেকআপ করলে কাঁদবে কেন? ‘
আইয়াজ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘ শখ করে করলে মেনে নিতাম। আমার মনে হচ্ছে বাধ্য হয়ে। ‘
সৌধ নাক খিঁচাল ভালোবাসার ঊর্ধ্বে কোনো বাধ্যবাধকতা থাকতে পারে না৷ তাই বলল,
‘ ব্রেকআপ চাইলেই ব্রেকআপ দিবি? মানানোর চেষ্টা কর৷ না মানলে তুলে এনে জাস্ট বিয়ে করাই দিব চিল ম্যান। ‘
সকলের মধ্যেই পিনপতন নীরবতা। নিধি নড়েচড়ে ওঠল সৌধর কথা শুনে৷ উপস্থিত সকলেই জানে সৌধ মোটেই ফাঁকা আওয়াজ দেয়নি। এ জন্যই মুখটা চুপসে গেছে নিধির। যা দেখে ফিচেল হাসল সৌধ। বলল,
‘ চল ওঠ সবাই। আর আইয়াজ তুই আমার সঙ্গে চল আজ আমার সাথে থাকবি৷ ফারাহকে বুঝাবি না বুঝলে আমি বুঝাব। আশা করছি সব ঠিক হয়ে যাবে৷ না হলে পরবর্তী পদক্ষেপ নিব৷ আপাতত প্রথমটা ট্রাই করব আজ। ‘
আইয়াজকে কথাটা বলেই সুহাসকে বলল,
‘ আর তুই নামীর কাছ থেকে জানার চেষ্টা করবি। বেস্ট ফ্রেন্ড ওরা৷ হতে পারে পার্সোনাল কোনো প্রবলেম যা আইয়াজকে বলতে পারছে না কিন্তু নামীকে বলেছে।’
***
বাড়ি থেকে বেরিয়ে ফারাহকে কল করেছিল নামী৷ ফারাহর ফোন বন্ধ। কী করবে কোথায় যাবে মাথা কাজ করছিল না তার। অতিরিক্ত রাগ আর দুঃশ্চিন্তায় মাথা ঘুরছিল খুব। কোনো উপায় না পেয়ে সিদ্ধান্ত নেয় আপাতত নিজের গ্রামের বাড়ি ফিরে যাবে। তারপর বাড়ির লোকের সাথে আলোচনা করে হোস্টেলে ওঠবে। বড়ো মুখ করে উদয়িনীকে বলে এসেছে তার ছেলে কাছে এলে গ্রহণ করবে। কিন্তু অতো সৌভাগ্য যে তার নেই সে খুব ভালো করেই জানে। সুহাস হয়তো এখন তার সঙ্গে আগের মতো খারাপ আচরণ করে না৷ তাই বলে তাকে বউ বলে মানে এমনটাও নয়৷ জেদের বশে উদয়িনীকে আঘাত করতেই কথাটা বলেছিল সে। ভেবেই রুদ্ধশ্বাস ত্যাগ করল। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রিকশা নিল বাসটার্মিনালের উদ্দেশ্যে। কিন্তু পথিমধ্যে হঠাৎ জ্ঞান হারিয়ে রিকশা থেকে পড়ে গেল মেয়েটা। মুহুর্তেই হুলস্থুল অবস্থা তৈরি হয়ে গেল রাস্তায়। জ্ঞানহারা মেয়েটাকে ধরাধরি করে নেয়া হলো সদর হাসপাতালে। নিধির এক বান্ধবী সে সময় ওই পথ দিয়েই বাড়ি ফিরছিল। চলন্ত রিকশা থেকে সে নামীকে চিনতে পারে। আর তৎক্ষনাৎ নিধিকে কল করে জানায়,
‘ এই নিধি আমাদের এক ব্যাচ জুনিয়র মেয়েটা আছে না? ঐ যে যার সাথে তোর বেশ ভালো সম্পর্ক। শ্যামলা করে মেয়েটা? সে তো সেন্স লেস হয়ে রাস্তায় পড়ে গেছে৷ সবাই ধরাধরি করে হাসপাতালে নিয়ে গেল! ‘
.
সুহাস মাত্রই বাড়িতে এসেছে। উদয়িনী তখন নিজ রুমে কিছু বই ঘাটাঘাটি করছিল। এই সুযোগে সেলিনা আপা সুহাসকে গড়গড় করে বাড়িতে ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলো বলে দিল। যতটুকু সে জেনেছে শুনেছে ঠিক ততটুকুই। এরপর ওড়না মুখে চেপে কেঁদে দিয়ে বলল,
‘ আহারে গো মেয়াডারে ক্যামনে মারল। চাচির মনে আল্লাহ দয়ামায়া দেয়নাই গো ভাই। মেয়েডা এত কষ্ট অপমান সহ্য করবার না পাইয়া চইলা গেল। আল্লাহ জানে চাচা রাইতে আইসা কী তাণ্ডব বাজায়! আল্লাহ জানে মেয়াডা কই গেল? মা নাই, বাবা দেশে নাই আহারে গো! ‘
সেলিনার বলা কথাগুলো আর হায় হুতাশ শুনে সুহাসের সমস্ত পৃথিবীই যেন থমকে গেল। তার মা হঠাৎ কেন এমন করল? বুকের ভেতর তীব্র অস্থিরতায় দম বন্ধ হয়ে এলো তার। হুঁশে হোক আর বেহুঁশে নিজের রুম পর্যন্ত আর গেল না সে।ড্রয়িংরুমেই ব্যাগ ফেলে অ্যাপ্রোন ফেলে মোবাইল আর বাইকের চাবি নিয়ে বেরিয়ে গেল। এদিকে প্রাচীকে নিয়ে নিধি সদর হাসপাতালের পথে পা বাড়িয়েছে। রিকশায় ওঠেই সৌধকে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে,
‘ সুহাসকে নিয়ে ইমিডিয়েটলি সদর হাসপাতাল চলে আয় সৌধ। ‘
সৌধকে কথাটা বলেই ফোন কেটে কল করল নামীকে। এদিকে সুহাসও নামীর ফোনে লাগাতার কল করে যাচ্ছে। এক পর্যায়ে নিধি, সুহাস একসঙ্গে ফোন দেয়া শুরু করল দু’জনই দু’দিকে থেকে নামীর ফোন ব্যস্ত পায়। সুহাসের ফোনে ঐ সময়ই একটি ম্যাসেজ আসে সৌধর,
‘ এই শা’লা তোর ফোন ব্যস্ত কেন? নিধি তোকে নিয়ে এক্ষুনি সদর হাসপাতালে যেতে বলল। আমি তোর বাড়ির কাছাকাছিই বের হ দ্রুত। ‘
সুহাসের বুকের ভেতর ধক করে ওঠল ম্যাসেজটা পেয়ে। হাসপাতালে কেন যেতে বলছে নিধি? নামীর কিছু হলো কী? ভীতিগ্রস্ত হয়ে চোখ, মুখ রক্তিম হয়ে ওঠল সুহাসের। বিড়বিড় করে বলল, ‘ না না নামী হাসপাতালে যাবে কী করে নিধি হয়তো অন্য কোনো দরকার বা অন্যকারো দরকারে যেতে বলেছে। ‘
অবিশ্বাস হলেও সত্যি সুহাসের এ মুহুর্তে নিজেকে বড্ড অসহায় লাগছে। নামীদামির জন্য দুঃশ্চিন্তায় নিজেকে এত অসহায় লাগছে কেন? আকস্মিক এ কোন সঙ্কটে পড়ল সে?