ত্রিধারে তরঙ্গলীলা | পর্ব – ১৭

লিভিং রুম থেকে গিটারের শব্দ ভেসে আসছে। ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসা সিমরান সে শব্দ শুনেই লাফিয়ে ওঠে বলল,
‘ ও মাই গড! সৌধ ভাই গিটার বাজাচ্ছে! ‘
নামী ওর চুল আঁচড়ে দিচ্ছিল। আকস্মিক লাফিয়ে ওঠায় ভয় পেয়ে গেল সে। শুনেছিল সুহাস, সৌধ দুজনই দারুণ গিটার বাজাতে পারে। গানের গলাও অসাধারণ। তাই জিজ্ঞেস করল,
‘ কী করে বুঝলে সৌধ ভাইয়া? তোমার ভাইয়াও তো হতে পারে। ‘
সিমরান উত্তেজিত কণ্ঠে বলল,
‘ উহুম কখনোই না। বিলিভ না হলে চলো দেখলেই বুঝবে আ’ম রাইট৷ এত্ত স্লোলি গিটার ব্রো বাজাতে পারে না। ব্রো মানেই ধুমধাড়াক্কা। ‘
বলতে বলতেই আয়নায় নিজেকে দেখে ত্বরিত নামীর কাঁধ জড়িয়ে ধরল। বলল,
‘ থ্যাংকিউ সো মাচ নামীপু। এবার জলদি রেডি হয়ে নাও একসঙ্গে ওখানে যাব। ‘
বারকয়েক পলক ফেলে তৈরি হয়ে নিল নামী। এরপর সিমরান নিজেই তার হাত চেপে ধরে নিয়ে গেল লিভিং রুমে। নিধি, প্রাচী মিলে বেশ ভালোই বুঝিয়েছে সিমরানকে। শুধু তাদের বুঝানোতে অবশ্য এতটা গলেনি সিমরানের মন। কথার ছলে যখন শুনল নামীকে সৌধ নিজের বোনের চোখে দেখে৷ তাছাড়া এ বাড়িতে পার্টি হচ্ছে। অথচ নামী এ বাড়িতে থাকা সত্ত্বেও পার্টিতে অংশগ্রহণ করবে না৷ এটা একদমই ভালো দেখায় না। বিশেষ করে সৌধর চোখে। বনেদি পরিবারের ছেলে সৌধ। তাদের পরিবার সম্পর্কে নিধি, প্রাচীর থেকেও সুহাস, সিমরান বেশি অবগত। পারিবারিক ভাবে ঐ পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কটা অনেক বেশি গাঢ়৷ চৌধুরী বাড়ির প্রায় সব অনুষ্ঠানে সোহান খন্দকার, সুহাস, সিমরান উপস্থিত থাকে৷ উদয়িনীও উপস্থিত থাকার চেষ্টা করে৷ সময় সাপেক্ষে হয়ে ওঠে না৷ একটা যৌথ পরিবারের বন্ধন কেমন হয় তা সৌধর পরিবার দেখে শেখা উচিত। অমন পরিবারের ছেলে সৌধ৷ তার ব্যক্তিত্ব সম্পর্কেও অজানা নয় সিমরান। দেখা গেল নামীর অনুপস্থিতি দেখে তাদের দু’ভাইবোনের ওপর নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হলো। যে ধারণা তার জীবনেও প্রভাব ফেলতে পারে৷ সিমরান কোনো ঝুঁকি নিতে চায়নি। সমস্যা তার বাবা, মা আর নামীর মধ্যে। তার ভাইও জড়িয়ে। সে এসবে জড়িয়ে নিজের ভালোবাসার মানুষের চোখে খারাপ হতে চায় না৷ তাই মায়ের আদেশ আর নামীর ওপর রাগ দূরে সরিয়ে নামীকে নিজের জন্মদিন পার্টিতে নিয়ে এলো। ওদের দু’জনকে একসঙ্গে দেখে নিধি, প্রাচী মিটিমিটি হাসছিল৷ সুহাস অবাক হয়ে আইয়াজকে বলল,
‘ কীরে কাহিনি কী? সিনু ওর সাথে! ‘
আইয়াজ নিধি, প্রাচীকে দেখিয়ে বলল,
‘ সব এদের জাদু। ‘
সিমরান, নামী চলে এলেই সৌধর হাত থেমে গেল। নামীকে দেখে একহাত দূরে বসা নিধির দিকে তাকিয়ে অমায়িক ভঙ্গিতে একটি হাসি উপহার দিল। নিধি মাথা দুলিয়ে, ভ্রু নাচিয়ে বুঝাল,
‘ এই নিধির পক্ষে সব সম্ভব। ‘
সৌধ আপ্লুত হয়ে ঠোঁটজোড়া চোকা করে চুমু দেখাল। নিধি বসা থেকে লাফিয়ে ওঠে আকস্মিক সবার সামনেই মারতে শুরু করল সৌধকে। সকলে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকাল ওদের দিকে৷ নামী আর সিমরানও দুই বন্ধুর খুনসুটি দেখে হাসল৷ সৌধ নিধিকে থামাতে ওর দু-হাতের কব্জি ধরে বলল,
‘ কী আশ্চর্য! হুটহাট আক্রমণ করছিস। শরীর ঠিক আছে তোর? ‘
সুহাস, আইয়াজ, প্রাচী তিনজনই সুক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে। ওরা তিনজন স্পষ্ট বুঝতে পারছে নিধি এমনি এমনি ক্ষেপেনি৷ সৌধ নাটক করছে এও স্পষ্ট। এই নাটক কেন করছে তাও বুঝল ওরা৷ দু’জন জুনিয়র সদস্য উপস্থিত বলেই সৌধ এই নাটকটা করতে বাধ্য হচ্ছে। মারতে মারতে হাত ব্যথা হয়ে গেলে থামল নিধি৷ ক্লান্ত শরীর এলিয়ে দিল সোফায়। প্রাচী ব্যস্ত হলো সিমরানের কেকের ছবি তুলতে। নিধি হাঁপিয়ে ওঠা কণ্ঠে নামী সিমরানকে খেয়াল করে নামীকে বলল,
‘ খুব সুন্দর সাজিয়েছ তো সিনুকে। ‘
সিমরান খুশিতে গদগদ হয়ে গেল। কোমরের দু’পাশের গাউন ধরে এগিয়ে গেল ভাইয়ের সামনে। বলল,
‘ কেমন লাগছে আমাকে ব্রো বললে না তো! ‘
প্রশ্নটা সুহাসকে করলেও নামী বাদে সবাই এক সুরে বলল,
‘ সো প্রিটি আওয়ার বেবিডল। ‘
খুশিতে আত্মহারা হয়ে সকলের দিকে তাকাল সিমরান। সৌধ সহ সবাই ওঠে দাঁড়িয়েছে। সুহাস বোনের দু’কান চেপে ধরে কপালে চুমু খেয়ে বলল,
‘ হ্যাপি বার্থডে মাই প্রিন্সেস সিস্টার। ‘
একে একে সবাই উইশ করল। নিধি সুহাসকে বলল,
‘ সিনুকে সব ড্রেস আর সব সাজেই মারাত্মক লাগে তাইনারে৷ ‘
সুহাস বেশ ভাব নিয়ে নামীর দিকে এক ঝলক তাকাল৷ এরপর বলল,
‘ বোনটা কার দেখতে হবে না? ‘
প্রাচী বলল,
‘ তোরা কি এভাবেই সময় শেষ করবি? কেকটা কাটবি কখন? সিনু তুই এদিকে আমার কাছে আয়। ‘
সিমরান সঙ্গে সঙ্গে ছুটে চলে গেল। দেয়ালের একপাশ জুড়ে হালকা গোলাপি রঙের পর্দা টাঙানো। তার সামনে হালকা গোলাপি, নীল রঙের বাটারফ্লাই বেলুন দিয়ে বৃত্ত আকারে ডেকোরেট করা। বৃত্তের মধ্যবর্তী স্থানে লেখা ” হ্যাপি সেভেনটিন্স বার্থডে সিনু” সবটায় দৃষ্টি বুলিয়ে কেকের দিকে তাকাল সিমরান৷ তার একদম বাচ্চা বয়সের একটি ছবি বসানো কেক। কেকটাই দেখানো হয়নি তাকে। এখন দেখে ভাইয়ের দিকে বিস্মিত চোখে তাকাল। মৃদু হাসল সুহাস। বোনের খুশি দেখলেই অদ্ভুত শান্তি লাগে তার। মনে হয় পৃথিবীর সমস্ত খুশি ওর পায়ের কাছে সমর্পণ করতে। বার্থডে কেকের পুরো আইডিয়াই সৌধর। নিজ দায়িত্বে নিজ খরচে সবটা করেছে ও৷ তাই সৌধর দিকে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
‘ তোর ভাই কেমন অকর্মণ্য জানিস তো? এসব সৌধর মাথা থেকে এসেছে ইভেন কেকটা সৌধর তরফ থেকেই তোর বার্থডে গিফ্ট। ‘
আচমকা সৌধর দিকে তাকাল সিমরান৷ সৌধ ওর তাকানো দেখে মুচকি হাসি উপহার দিল। বুকের ভেতর ছলাৎ ছলাৎ করে ওঠল মেয়েটার। উত্তেজনায় গা শিরশির করছে। এদিকে নিজেকে অকর্মণ্য বলে হঠাৎ নামীর দিকে চোখ পড়ে সুহাসের। দেখতে পায় নামী তার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট টিপে হাসছে। অমনি ভ্রু কুঁচকে ফেলে। এমনিতেই এই মেয়ের ওপর ভয়ানক রেগে আছে সে। সকালের ব্যাপারটা নিয়ে মারাত্মক রাগান্বিত। আর এই মেয়ে কিনা গা জ্বালানো হাসি দিচ্ছে! সে অকর্মণ্য এটা বোনকে জাস্ট ফর্মালিটি করে বলেছে। তাই বলে এভাবে হাসার কী আছে? ক্ষুব্ধ নিঃশ্বাস ফেলল সুহাস৷ নামী ততক্ষণে সুহাসের ক্ষুব্ধ দৃষ্টিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নিধির সঙ্গে সিমরানের কাছে চলে গেছে। কেক কাটার আগে সৌধ সবাইকে সাবধান করে দিল কেউ যেন কেক ছোড়াছুড়ি না করে। কিন্তু সুহাস মনে মনে ছক কষে ফেলেছে নামীকে একটা শিক্ষা দেবে। কোন সাহসে সে পাশের বাড়ির মহিলার সঙ্গে মিষ্টি মুখে কথা বলেছে? কোন সাহসেই বা পাশের বাসার আন্টি এসে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে যায়? এটা ঠিক কোন ধরনের ইতিহাস? যে জামাইয়ের কাছে বউয়ের বিয়ের প্রস্তাব আসে ছিঃ! পরোক্ষণেই আবার মত পাল্টাল। পাছে দেখা হলো নামীদামি তেজ দেখিয়ে পার্টি থেকেই চলে যাবে।
মোমবাতি নিভিয়ে কেক কাটল সিমরান৷ সর্বপ্রথম কেক খাইয়ে দিল সুহাসকে। এরপর সৌধকে খাইয়ে দিতে গেলে সৌধ নিজে না নিয়ে পাল্টা ওকেই খাইয়ে দিল। মৃদু হেসে নাজুক ভঙ্গিতে একে একে সবাইকে কেক খাইয়ে শুরু করল কিছু সেলফি তুলতে। সবার সাথে সেলফি নিয়ে নামীর সাথে নিতেও বাদ রাখল না। সব শেষে সেলফি নিতে গেল সৌধর কাছে। সৌধ দু’টো সেলফি নিয়ে হঠাৎ অবাক কণ্ঠে বলল,
‘ সিনু, আমাদের ড্রেস তো ম্যাচিং হয়ে গেছে। ‘
সিমরান মুখ ফসকে বলে ফেলল,
‘ কাপল লাগছে না? ‘
সৌধ ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘ উহুম, যতই ম্যাচিং হোক বাচ্চাদের সাথে কাপল লাগে না। ‘
কথাটা বলেই কিছু একটা ভেবে আবার বলল,
‘নিধিরে ডাক তো বল আমি ডাকছি। ‘
মুখটা চুপসে গেল সিমরানের। বাচ্চা, বাচ্চা শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা। কবে সে বড়ো হবে? কবে অনার্সে পড়বে? কবেই বা সৌধ ভাইকে প্রপোজ করতে পারবে? বুকে অস্থিরতা শুরু হলো সিমরানের। নিধির কাছে গিয়ে বলল,
‘ আপু সৌধ ভাইয়া ডাকে। ‘
নিধি আইয়াজের সাথে কয়েকটা সেলফি নিয়ে সৌধর কাছে গেল। সৌধ ওর সঙ্গে কয়েকটা সেলফি নিতে নিতে নিচু কণ্ঠে বলল,
‘ চুলটা ছেড়ে দে। ‘
নিধি আড়চোখে তাকিয়ে ওর মতো করেই বলল,
‘ না রে গরম লাগে খুব। ‘
সৌধ এবার মুখটা আরেকটু নিচু করে বলল,
‘ তোর বাঁধা চুলে আমার আরো বেশি গরম লাগছে। ‘
সৌধর দৃষ্টি আর কণ্ঠ শুনে চাপা আর্তনাদ করে ওঠল নিধি,
‘ মানে! ‘
‘ ঘাড়ের এই তিলটা অসহ্য করে তুলছে আমায়। চুল না ছেড়ে ওটা আড়াল না করলে না জানি কখন জাপ্টে ধরে ফাঁকা ঘরে নিয়ে যাই আর চুমুতে চুমুতে অসহ্য করে তুলি তোকে! ‘
ঘাড়ে ঠিক যেখানটায় তিল সেখানে তর্জনী ছুঁয়ে কথাটা বলল সৌধ। কান গরম হয়ে চোখ দু’টি বড়ো হয়ে গেল নিধির। সর্বাঙ্গে কম্পন ধরে গেল নিমিষেই। অবিশ্বাস্য চোখে কয়েক পল তাকিয়ে রইল সৌধর মুখপানে। এরপর আচমকা মুখটা কঠিন করে বলল,
‘ আমাদের বন্ধুত্বের সমাপ্তি টানতে না চাইলে নিজেকে কন্ট্রোল কর সৌধ। ‘
সহসা সৌধর মুখো ভঙ্গি পাল্টে গেল। নিধি খেয়াল করল সৌধর চোয়াল জোড়া ক্রমশ শক্ত হচ্ছে। ঢোক গিলে আশপাশে তাকাল সে। সবাই সেলফি নিতে ব্যস্ত। এরপর সৌধর দিকে তাকিয়ে কাঁপা গলায় বলল,
‘ সৌধ… ‘
বাকিটুকু আর বলতে দিল না সৌধ। পাশ কাটিয়ে চলে যেতে উদ্যত হলো৷ অমনি খপ করে হাত চেপে ধরল নিধি৷ বলল,
‘ রাগছিস কেন? ‘
ভ্রু বাঁকিয়ে সৌধ বলল,
‘ রাগব কেন? তুই ভুল বা অন্যায় কিছু বলিসনি। ‘
নিধি অপরাধীর সুরে বলল,
‘ সৌধ প্লিজ, আমি জানি তুই ভয়ংকর রেগে গেছিস।’
ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল সৌধ। আশপাশে তাকিয়ে দেখল তাদের দিকে কারো নজর নেই। তাই চট করে নিধির হাত টেনে নিয়ে গেল ডাইনিং রুমে। এরপর দরজাটা সপাৎ শব্দে বন্ধ করে দিল।
নামী প্রাচীর সাথে ছবি তোলার ফাঁকে এ দৃশ্যটা দেখে গম্ভীর হয়ে গেল। তাকাল ভাইয়ের সাথে খুনসুটিতে মেতে থাকা সিমরানের দিকে৷ এরপর কে কে সিমরানের জন্য কী গিফ্ট এনেছে এসব দেখানো শুরু করল প্রাচী৷ সিমরান সবাইকে ধন্যবাদ জানাচ্ছে। এমন সময় নামী বলল,
‘ আমার গিফ্ট তোলা রইল সিমরান। পেয়ে যাবে। ‘
সুহাস ফোড়ন কেটে বলল,
‘ আমার বোন বাসি জিনিস নেয় না। ‘
সুহাস ভেবেছিল নামী তার সঙ্গে এবার তর্ক দেবে৷ কিন্তু না সে তর্ক দিল না। হঠাৎই মনটা খুব খারাপ করে চুপ হয়ে গেল। সিমরান তাকে পছন্দ করে না। ভেবেছিল বার্থডে পার্টিতেও আসা হবে না৷ তাই গিফ্ট নিয়ে ভাবা হয়নি৷ অথচ আসা ঠিকি হলো, গিফ্ট দেয়া হলো না৷ এ নিয়ে আর কেউ ছাড় দিলেও সুহাস দিল না৷ আত্মসম্মানে আঘাত পড়ল খুব। তাই চুপ রইল সে। তার এই চুপ থাকাটাও সহ্য হলো সুহাসের। প্রথমে ইনিয়ে-বিনিয়ে তর্ক করার চেষ্টা করল। লাভ হলো না বলে শেষে ভদ্র হয়ে এসে বসল নামীর পাশে। এতে শুধু নামীর সাথে হকচকিয়ে গেল উপস্থিত সবাই। সিমরান বলল,
‘ নামীপু তো আমাকে এত সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়েছে। এটাও তো একটা উপহার৷ ‘
প্রাচী ওর কাঁধে চাপড় দিয়ে বলল,
‘ বাহ দারুণ বললি তো। ‘
নামী কৃতজ্ঞতার দৃষ্টি নিক্ষেপ করল সিমরানের দিকে। সিমরান মুচকি হাসি দিল। সুহাস বলল,
‘ আমার বোনকে পটালে কী করে? ‘
চমকে তাকাল নামী। সুহাসের মুখটা এক পলক দেখে দৃষ্টি ফিরিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল৷ সিদ্ধান্ত নিল ওঠে যাবে৷ সুহাসের পাশে বসার রুচি নেই তার৷ কিন্তু তার আগেই সুহাস আবার বলে ওঠল,
‘ যেভাবে পাশের বাসার ব্যাংকারকে পটিয়েছ? মানতে হবে চয়েজটা! কালাচাঁদ তাতে কি ব্যাংকার তো। ‘
ভ্রু কুঁচকে গেল নামীর। এসব কী বলছে সুহাস? কে কালাচাঁদ, কেই বা ব্যাংকার? মনের প্রশ্ন মুখে করতেই সুহাস ঠোঁট কামড়াল। নামী কি এসব জানে না? কৌতূহলী চিত্তে বলল,
‘ আমাদের পাশের বাসার ইয়ামিনকে চেনো না? ব্যাংকে জব করে? ‘
বিরক্ত সূচক শব্দ করে নামী জবাব দিল,
‘ না। ‘
***
দরজার কপাটের সাথে একদম পিঠ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে নিধি। দু’হাত কপাটে রেখে মধ্যস্থে নিধিকে বন্দি করে রেখেছে সৌধ। লাগাতার প্রশ্ন করে যাচ্ছে,
‘ আমি রাগি তাতে তোর কী? বন্ধুত্বের সুযোগ নিয়ে ভালোবেসে ফেলেছি। অপরাধ হয়ে গেছে। শাস্তি সরূপ বন্ধুত্বের শেষ টানবি৷ আমি রাগলাম না মরলাম তোর কী যায় আসে হু? ‘
সৌধর মুখের ভারিক্কি নিঃশ্বাস গুলো মুখের ওপর পড়তেই চোখ বুজে মুখ ঘুরিয়ে রইল নিধি। ঘনঘন নিঃশ্বাস ছেড়ে শক্ত কণ্ঠে বলল,
‘ ছাড় সৌধ। পাগলামি করিস না। ‘
‘ ধরে রাখিনি। ‘
‘ বেঁধে রেখেছিস। ‘
চ্যাঁচিয়ে বলল নিধি। মেজাজ খারাপ হয়ে গেল সৌধর। সুহাসের মতো দরজায় চিপায় না পড়লে এই মেয়েও মুখ খুলবে না৷ তাই ঘাড় বাঁকিয়ে সুইচবোর্ডে নজর বুলাল। এরপর তাকাল নিধির সরল মুখটায়। বলল,
‘ সোজা কথায় স্বীকার করবি না যখন বাঁকা কাণ্ড করতেই হবে৷ ‘
বলতে বলতেই তড়াক করে সুইচবোর্ডের কাছে গিয়ে বাতি নিভিয়ে পুনরায় নিধির সামনে চলে এলো। আকস্মিক রুম অন্ধকার হতে ভয়ে চিৎকার দিল নিধি৷ কিন্তু সে চিৎকার বাইরে গেল না৷ সৌধ ওর মুখ চেপে ধরল। নিধি ভয়ে গুটিশুটি মেরে বড়ো বড়ো করে শ্বাস নিতে শুরু করল। সৌধ ওকে শান্ত করতে দু’হাতে জড়িয়ে নিল বুকে। কানের কাছে মুখ নিয়ে মৃদুস্বরে বলল,
‘ আরে পাগলি মেয়ে ভয় কীসের আমি আছি৷ নে এবার ঝটপট বলত মনের ভেতরটা উগ্রে দে। ‘,
‘ প্লিজ সৌধ। ‘
‘ আই লাভ ইউ সৌধ বল। তারপর ছাড়ব। ‘
‘ বলব না৷ ‘
‘আমিও ছাড়ব না। ‘
কথাটা বলার পর নিধি খেয়াল করল সৌধ শ্বাস-প্রশ্বাস ঘন হয়ে এসেছে। ধীরেধীরে মুখ এগুচ্ছে ঘাড়ের দিকে। আচমকা সৌধর বুকে ধাক্কা মারল দুহাতে। বলল,
‘ আমাকে সময় দে দোস্ত প্লিজ প্লিজ প্লিজ। প্লিজ কিছু করিস না৷ মরে যাব, মরে যাব আমি। প্লিজ সৌধ আমাকে সময় দে। ‘
থেমে গেল সৌধ। ত্বরিত গিয়ে লাইট অন করে ছুটে এলো আবার৷ দু’হাতে আলতো করে নিধির গাল চেপে ধরে বলল,
‘ এই, এই কাঁদছিস কেন? কিছু করিনি আচ্ছা সরি সরি। আমারি ভুল সময় চাই তোর? ওকে ফাইন। আরে মেয়ে কাঁদবি না। একদম না। ‘
চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বলল সৌধ। নিধি ওর বুকে শক্ত দুটো কিল দিয়ে বলল,
‘ তুই খুব খারাপ সৌধ। ‘
আলতো হেসে সৌধ বলল,
‘ তোর জন্য আমি খারাপের সর্বোচ্চ পর্যায়ে যেতে পারি নিধি৷ আবার তোর জন্যই ভালোদের শীর্ষে থাকতে রাজি। ‘
অশ্রুসিক্ত নিষ্পলক নয়নে তাকিয়ে নিধি। মনে মনে বলল,
‘ অনেক ভাগ্য করে তোর মতো ছেলের ভালোবাসা পাওয়া যায় সৌধ। ‘
সৌধ কি শুনল কথাটা? অদ্ভুত ভাবে হাসল একটুখানি। এরপর ওর গলার ওড়না ঠিক করে দিল নিজ হাতে। চুলগুলোও ঠিক করে দিয়ে বলল,
‘ চল সবাই আমাদের খুঁজছে হয়তো। ‘
***
তিনদিনের ছুটিতে বাড়ি এসেছে উদয়িনী। এই তিনদিন নামীকে খুব সাবধানে থাকতে হবে৷ উদয়িনীর সামনে পড়া যাবে না একদম৷ এই মহিলা খুব সাংঘাতিক। অপমান করে কলিজা সিদ্ধ করে ফেলে। আর সে জবাব দিলেই সুহাস রেগেমেগে ভুত হয়ে ঝগড়াঝাটি শুরু করে দেয়। কয়েকমাস হলো সুহাসের মধ্যে বেশ পরিবর্তন এসেছে। পায়ে পা লাগিয়ে এখন আর ঝগড়া করতে আসে না। মাঝেমধ্যেই ছাদে দেখা হয়ে গেলে টুকটাক স্বাভাবিক কথাবার্তা হয় এখন৷ নামীর কেন যেন ভালো লাগে এই সুহাসকে। ইচ্ছে করে ছেলেটাকে ভালোবেসে আরো বদলে দিতে৷ যে ছেলে কয়েকটা কড়া কথায় এতটুকু পরিবর্তন হতে পারে। সে ছেলেকে ভালোবাসা দিয়ে বুঝালে আরো পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা রাখে। শুনেছে অরিন বাদে আর কারো সাথেই কথা বলে না সুহাস। অরিনের সাথেও খুব অল্প কথাবার্তা হয় এখন। নামমাত্র গার্লফ্রেন্ড। দেখাসাক্ষাৎ একেবারে বন্ধই করে দিয়েছে। এসব আইয়াজ বলেছে ফারাহকে। আর ফারাহ বলেছে নামীকে। কলেজ থেকে এসে খেয়েদেয়ে ঘুম দিয়েছিল নামী। ঘুম ভেঙে গেল দরজায় ঠকঠক শব্দ শুনে৷ দরজা খুলতেই দেখতে পেল উদয়িনী রণমুর্তি ধারন করে দাঁড়িয়ে আছে৷ সে দরজা খুলতেই দু’টো বস্ত্র ছুঁড়ে মারল মুখে। বস্ত্র দু’টির মধ্যে একটি নামীর ওড়না আরেকটি অন্তর্বাস। যা সুহাসের কাভার্ড গোছাতে গিয়ে পেয়েছে উদয়িনী। ছেলের প্রতি তীব্র অবিশ্বাস আর ক্রোধটুকু প্রকাশ করতে পারেনি সে৷ কারণ সুহাস ক্লাসে গেছে। পাঁচটার পর বাসায় আসবে। সুহাসকে পড়ে বুঝে নেবে। আপাতত নিলুর মেয়েকে শায়েস্তা করবে সে।
নামীর শরীর কাঁপতে শুরু করেছে। নিশ্চয়ই সুহাসের ঘরে এসব পেয়েছে মিসেস উদয়িনী? একদিকে লজ্জা অপরদিকে ভয়ে শরীরে ঘাম ছেড়ে দিল নামীর। আর উদয়িনী করে বসল ভয়াবহ এক ঘটনা। প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে সম্পূর্ণ ছাই ফেলল নামীর ওপর৷ আকস্মিক নিজের হাতের পাঁচটা আঙুল বসিয়ে দিল নামীর শ্যামলাটে নরম গালে। শুধু তাই নয় একাধারে কুরুচিপূর্ণ বাক্যে নামীর সমস্ত সত্তাকে নাড়িয়ে তুলল। ঠোঁটের কোণা বেয়ে রক্ত ছলকে পড়ছে নামীর। দু’চোখ উপচে বেরোচ্ছে অশ্রুধারা। সেদিকে খেয়াল নেই উদয়িনীর। সে নামীর শরীরে আঘাত করার পাশাপাশি মনকেও আঘাতে আঘাতে ভেঙে গুড়িয়ে দিতে ব্যস্ত৷ বাবা, মায়ের আদুরে সন্তান নামীর আজ কী এটাই প্রাপ্য ছিল? এ বাড়িতে সে রয়েছে শুধুমাত্র সোহান খন্দকারের অনুরোধে। সে যেচে পড়ে থাকতে আসেনি৷ এমনও নয় তার ভরণপোষণের দায়িত্ব সোহান খন্দকারের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশে তার দুটো ব্যাংক একাউন্ট। একটাতে আমেরিকা থেকে প্রতি মাসে বাবা টাকা পাঠায়৷ আরেকটাতে তার নামে টাকা রয়েছে পয়ত্রিশ লক্ষ। একজন সফল ব্যবসায়ীর মেয়ে হয়ে এভাবে ডক্টর উদয়িনীর অপমান, খাওয়া পরার খোঁটা শুনবে? কী ভেবেছে উদয়িনী তার হাজব্যন্ডের অর্থে সে চলছে৷ পড়াশোনা করছে? পৃথিবী উলটেপালটে যাক। ধ্বংস হয়ে যাক এ পৃথিবী। তবু এই অপমান সহ্য করবে না সে। মিসেস উদয়িনীকে আজ যোগ্য কিছু জবাব দিয়ে বেরিয়ে যাবে এ বাড়ি থেকে। তার কাছে সম্পর্কের চেয়েও, সোহান খন্দকারের অনুরোধের চেয়েও নিজের আত্মসম্মানটা বড়ো!

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।