তোমাকে | মুন্নি আক্তার প্রিয়া | পর্ব – ৩১

বৃষ্টির ধারা মাত্রই শেষ হয়েছে। আকাশে এখনো মেঘ বিদ্যমান। কোথাও ঘন কুয়াশা আবার কোথাও বা শুভ্র মেঘ। ফজরের নামাজ পড়ে ছাতা মাথায় আধভেজা হয়ে মাত্রই মসজিদ থেকে ফিরেছে পরীর বাবা। ছাতাটা ড্রয়িংরুমে রেখে তিনি নিজের রুমে যান। রাতে রেহেনা বেগম পরীর রুমেই ছিলেন। এখন বোধ হয় রান্না বসিয়েছে। ঘরের ভেতর একা একা পায়চারি করছেন আর মনের ভেতর উশখুশ করছে। রাতে এভাবে পরীকে মেরে নিজেই অনুতপ্ত হচ্ছেন। বুকের ভেতর কষ্টে কান্না চলে আসছে। কিন্তু ছেলে মানুষদের তো হুটহাট কাঁদতে নেই। শত কষ্টেও নয়। নিজের রুমে আর থাকতে না পেরে এক প্রকার চোরের মতোই পরীর রুমে যান। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দেখেন পরী গুটিসুটি হয়ে শুয়ে আছে। মেঘের কারণে এখনো বাহিরে আবছা অন্ধকার। রুমের লাইট না জ্বালিয়েই তিনি পরীর কাছে যান। লাইট জ্বালালে যদি পরীর ঘুম ভেঙে যায়! নিজের ফোনের ফ্লাশ অন করে পরীর হাতের দিকে তাক করে। মারের দাগে হাত ফুলে লাল হয়ে আছে। বুকের ভেতর মোচর দিয়ে ওঠে তার। কী কষ্টই না পাচ্ছে তার মেয়েটা। কীভাবে তিনি এমন অমানবিকভাবে পরীকে মারলেন তা ভেবেই মনে মনে নিজেকে ধিক্কার দিচ্ছেন। চোখের কার্ণিশ বেয়ে কখন যে কয়েক ফোঁটা অশ্রুজল গড়িয়ে পড়েছে টেরও পাননি তিনি। তিনি সেখান থেকে আবার নিজের রুমে প্রস্থান করেন।

.
সকালে সবার জন্য নাস্তা বানিয়ে টেবিলে সাজিয়ে রেখে পরীর জন্য আলাদা নাস্তা নিয়ে আসে রেহেনা বেগম। পরীর কপালে হাত দিয়ে দেখেন জ্বর এখনো কমেনি। রাতেই শরীর কাঁপিয়ে জ্বর এসেছিল। রাত জেগে জলপট্টি দেওয়ায় তখন কিছুটা কমলেও এখন আবার জ্বর এসেছে। তিনি পরীকে কয়েকবার ডেকেও ঘুম থেকে উঠাতে পারেন না। তারপর নিজেই ধরে ওয়াশরুমে নিয়ে যায়। মুখ-হাত ধুইয়ে দিয়ে রুমে নিয়ে আসেন। খাবারের সামনে বসেও ঝিমুচ্ছে পরী। মা বারবার পরীকে খাওয়ানোর চেষ্টা করছে। পরী নাকমুখ কুঁচকে বলে,
“খেতে ইচ্ছে করছে না মা।”
রেহেনা বেগম পরীর মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,
“একটু খাও মা! আমার লক্ষী মা।”
অনেক জোরাজুরি করে তিনি একটুখানি রুটি পরীর মুখে তুলে দেন। পরী মুখটা বিকৃতি করে বলে,
“তেতো লাগছে খাবার!”
“জ্বরের মুখ তো তাই এমন মনে হচ্ছে। একটু কষ্ট করে খাও। তারপর ওষুধ খেতে হবে তো!”
অনেক কষ্টে কিছুটা খাবার খাওয়াতে সক্ষম হন তিনি। ওষুধ খাওয়ানোর সময় পড়েন আরেক ঝামেলায়। ট্যাবলেট খেলেও সিরাপ খাওয়ানোর সময় খুব বেগ পেতে হয় তাকে। ছোট থেকেই সিরাপের প্রতি প্রচণ্ড অনিহা পরীর। সিরাপ দেখলেই নাকি ওর বমি আসে। শেষমেশ অনেক বুঝিয়ে আদুরে কথা বলে সিরাপ খাইয়ে দেয়। খাওয়ার পর্ব শেষ হলে বালতিতে করে পানি নিয়ে আসে। পরীকে শুইয়ে দিয়ে কিছুক্ষণ মাথায় পানি ঢেলে দেয়। তারপর সুন্দর করে চুলগুলো মুছে দিয়ে টাওয়াল দিয়ে পেঁচিয়ে শুইয়ে দেয় আবার। গায়ে কাঁথা টেনে দিয়ে ড্রয়িংরুমে চলে যান। মাকে দেখে ফুপাতো বোন জিজ্ঞেস করে,
“পরীর জ্বর কমেছে মামী?”
“নাহ্ রে! রাতে একটু কমেছিল। এখন আবার জ্বর ওঠেছে।”
“ওষুধ খাইয়ে দিয়েছ?”
“হ্যাঁ। কত তালবাহানা করে তারপর খাওয়ালাম। জ্বর আসলে একদম বাচ্চাদের মতো হয়ে যায়।”
বড় আপু কিছুটা হেসে বলে,
“ও তো এমনই! একবার মনে আছে আমার সাথে ঘুমিয়েছিল পরী। তখন হুট করেই ওর জ্বর আসে। আর জ্বরের ঘোরে কীসব আবোলতাবোল বকে!”
বড় আপুর কথার প্রতুত্তরে রেহেনা বেগমও কিছুটা হাসার চেষ্টা করেন।
.
.
আজ ভোরেই সিলেট থেকে ফিরেছে তুর্যর বাবা। সপ্তাহ খানেক কাজের জন্য তাকে সিলেট যেতে হয়েছিল। বাবার সামনে সব বলবে বলেই রাতে কাউকে কিছু জানায়নি তুর্য। সকাল দশটা নাগাদ ঘুম থেকে উঠেন তুর্যর বাবা। পরীর বিষয়টা বাড়িতে জানাবে বলে আজ অফিসেও যায়নি তুর্য। খাওয়ার টেবিলে সবাই একত্রিত হয়েছে। তুর্যর বাবা বলেন,
“আজ অফিসে যাসনি কেন?”
তুর্য কোনো রকম প্রতিক্রিয়া ছাড়াই বলে,
“তোমাদের সাথে আমার কিছু কথা আছে।”
“তো বল কী কথা?”
“আমি পরীকে বিয়ে করতে চাই আব্বু।”
“পরী! পরী! আর পরী! ঐ মেয়ের মধ্যে কী পেয়েছিস তুই? কী বশ করেছে ও তোকে?” বেশ রাগ দেখিয়েই বললেন তাহমিনা বেগম। তাকে থামিয়ে দিয়ে বাবা বলেন,
“তুমি এর মধ্যে কথা বলছ কেন? আমি ওর সাথে কথা বলছি।”
“হ্যাঁ, বলো। আর বোঝাও ও’কে একটু। ঐ মেয়েকে আমি সহ্য করতে পারি না এটা জানার পরও কেন ঐ মেয়েকেই ও বিয়ে করতে চায়?”
তুর্য বেশ শক্তভাবেই উত্তর দেয়,
“কারণ ও’কে আমি ভালোবাসি।”
“পরীর পরিবার রাজি হবে তোর সাথে বিয়ে দিতে?” জিজ্ঞেস করলেন বাবা।
তুর্য বলে,
“ওর বাবা রাজি হচ্ছে না। কারণ মা পরীকে মেনে নিচ্ছে না।”
“মেনে নেবও না কখনো।” আবার রাগ দেখিয়ে বললেন তাহমিনা বেগম।
উত্তরে তিথি বলে,
“কী সমস্যা মা? ভাইয়া যদি পরীকে নিয়ে সুখী হয় তাহলে তোমার মেনে নিতে আপত্তি কোথায়?”
চুপ করে থাকেন তিনি। বাবা বলেন,
“তুর্য পরীকে বিয়ে করতে চায়। পরীও রাজি। ওরা দুজনই যখন দুজনকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তখন তোমার আর কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়। সন্তানের সুখই বাবা-মায়ের সুখ এই কথা ভুলে কেন যাচ্ছ তুমি?”
“তুমিও চাও ওর সাথে তুর্যর বিয়ে দিতে?”
“হ্যাঁ, চাই। পরী ভালো মেয়ে। ভালো পরিবারের। আমি তো কোথাও সমস্যা দেখি না। আসলে কী জানো? সমস্যাটা তোমার ভেতর। তোমার মনের ভেতর। মনকে হিংসা ও রাগমুক্ত করো। বিবেক ও বুদ্ধি দিয়ে সবটা ভাবো। নিজের রাগ, জেদকে বাঁচাতে গিয়ে ছেলে-মেয়ের ক্ষতি করে বোসো না। তখন কিন্তু আফসোস করতে হবে। তাই আমি আশা করব, তুমি এবার আর কোনো আপত্তি করবে না।”
তাহমিনা বেগম কোনো উত্তর না দিয়ে চুপ করে বসে আছেন। বাবা বলেন,
“তাহলে কি আর কোনো সমস্যা রইল ওদের নিয়ে?”
“যা তোমার মর্জি!”
বাবা এবার তুর্যর উদ্দেশ্যে বলেন,
“কবে বৌ-মা’র বাড়িতে যাব বল।”
“আজই। ওর বাবা অন্য জায়গায় ওর বিয়ে ঠিক করেছিল। পরী ছেলেকে আমাদের সম্পর্কের কথা সব বলে দিয়েছে। তাই বিয়েটা ভেঙে গেছে। এজন্য পরীর বাবা খুব মারধর করেছে পরীকে। আমি উনাকে কথা দিয়েছি দু’দিনের মধ্যেই মাকে রাজি করে ঐ বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাব।”
“তাহলে তো আর দেরি করা যাবে না। আজ বিকেলেই আমরা সবাই যাব পরীর বাসায়।”
খুশিটা তুর্য প্রকাশ করতে পারছে না। সবকিছু এত সহজেই মিটে যাবে ভাবতেই পারেনি তুর্য। তবে বাবার ওপর বিশ্বাস ছিল তুর্যর। একটা না একটা ব্যবস্থা হতোই। আর আলহামদুলিল্লাহ্‌ হয়েছেও।
————————
বাড়ি থেকে বের হয়ে পরীকে কল করে তুর্য। পরী তখন ঘুমে প্রায় আচ্ছন্ন। ফোন ভাইব্রেট করে রাখার কারণে কাঁপছিল। পরীর মস্তিষ্ক সেটা জানান দিলেও চোখ দুটো খুলতে পারছে না। ঘুমটা বেশিক্ষণ ধরে রাখতে না পেরে হাতরে বালিশের নিচ থেকে ফোন বের করে। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে তুর্য বলে,
“ঠিক আছো তুমি? কতবার ফোন দিলাম।”
পরী ঘুম জড়ানো স্বরে বলে,
“হু।”
“কী হু?”
“ঠিক আছি।”
“কথা এমন শোনাচ্ছে কেন? জ্বর কমেনি?”
“উঁহু!”
“ওষুধ খাওনি না?”
পরী এবার চোখ খুলে কপট রাগ দেখিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
“এহ্! কীসব বাজে বাজে ওষুধ খেয়েছি জানো? আবার বলো ওষুধ খাইনি!”
পরীর মুখের রিয়াকশনের কথা ভেবেই হাসে তুর্য। পরীর শরীরে যে অসহ্য ব্যথা হচ্ছে সেটা জানে তুর্য। তবুও যে মেয়েটার মুখে হাসি ফুঁটেই আছে। নিজের কষ্টটা একদম বুঝতেই দিতে চাচ্ছে না। তুর্যকে চুপ থাকতে দেখে পরী বলে,
“চুপ করে আছো কেন?”
“ভাবছি।”
“কী?”
“তুমি কত লক্ষী! আমার লক্ষী বউ।”
“বউ হলাম কবে আবার?”
“হওনি। তবে খুব শীঘ্রই হবে।”
“এত কনফিডেন্স নিয়ে কীভাবে বলছ?”
“কারণ মা আমাদের সম্পর্ক মেনে নিয়েছে। আজ বিকেলেই বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসব আমরা।”
পরী শোয়া থেকে লাফ দিয়ে বিছানায় বসে পড়ে খুশিতে। এতটাই খুশি আর অবাক হয়েছে যে ব্যথার কথাও ভুলে গেছে। শুধু তাই নয় চোখের কোণে পানিও চলে এসেছে। খুশিতে আত্মহারা হয়ে বলে,
“সত্যি বলছ তুমি?”
“তিন সত্যি।”
“আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না!”
“আচ্ছা যখন তোমার বাড়িতে আসব তখন বিশ্বাস হবে তো?”
“আমার যে কত খুশি লাগছে!”
“খুশিতে মনে হয় একদম সুস্থ হয়ে গেছ?”
“তাই তো মনে হচ্ছে।”
“তাহলে তো ভালোই! কিছু খেয়ে পড়তে বসো।”
পরী রাগ দেখিয়ে বলে,
“এত পড়া পড়া করো কেন সবসময়?”
“তোমার ভালোর জন্যই তো বলি। আজকের দিন গেলে শুধু কালকের দিনটাই পাবে। না পড়লে পরীক্ষায় লিখবে কী?”
“কাকের ঠ্যাং, বকের ঠ্যাং লিখব।”
তুর্য পিঞ্চ মেরে বলে,
“আমাদের বাচ্চাদেরও কি তাই শেখাবে?”
“এহ্! বিয়ের খবর নেই, বাচ্চা নিয়ে এসেছে! ওদের তুমি পড়াবে। আমি এত ভালো ইংলিশ আর গণিত পারি না। এই দুই সাবজেক্ট তুমি পড়াবে।”
তুর্য এবার শব্দ করে হাসে। বলে,
“আচ্ছা আমি পড়াব। এখন প্লিজ একটু পড়ো। কলেজের কোনো এক্সাম হলে এত বলতাম না। এটা বোর্ড এক্সাম পরী। সিরিয়াস হও একটু।”
“ঠিকাছে, ঠিকাছে। পড়তে বসব।”
“লক্ষী মেয়ে। এখন তাহলে রাখছি। পরে কল করব।”
“আচ্ছা।”
ফোন রাখার পর কিছুক্ষণ ওভাবেই বসে থাকে পরী। খুশির রেশ এখনো কাটেনি। নিজের খুশিতে আশেপাশের সবকিছুকেই খুশি মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে পরীর খুশিতে তারাও যোগ হয়েছে। অবশেষে পরিবারকে মানিয়েই এক হওয়ার পথে এসেছে দুজন। আচ্ছা বাবা মানবে তো? যদি ফিরিয়ে দেয় ওদের? মন বলছে দেবে না। সকালে বাবাকে দেখেছে পরী কেঁদে চলে যেতে। বাবার মনে নিজের স্থানটা পরী জানে। পরীর খুশিকে তিনি কখনোই দূরে ঠেলে দিতে পারবেন না। এখন অপেক্ষা শুধু তুর্যদের আসার!

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।