“অ্যাই মেয়ে ফুল ছিঁড়লে কেন?”
তোমাকে | মুন্নি আক্তার প্রিয়া | পর্ব – ০১
পিছন থেকে কর্কশকণ্ঠের কথা শুনে পরী হকচকিয়ে যায়। আমতা আমতা করে বলে,
“ইয়ে আসলে!”
“ইয়ে কী হ্যাঁ? চোর যেন কোথাকার! এজন্যই তো বলি প্রতিদিন গাছের ফুলগুলো কোথায় যায়। ফুলচোর যেন কোথাকার!”
পরীর মেজাজ এবার চটে যায়। এই বাসায় এসেছে আজ তিনদিন হলো। প্রথম দু’দিন তো ঘরদোর গোছাতেই শেষ। আজ একটু ফ্রি হয়ে ছাদে এসেছে। এত সুন্দর গোলাপ দেখে কী মনে করে যেন কেবলমাত্র একটা ফুল ছিঁড়েছে। ওমনি আইফেল টাওয়ার সিল্কি চুলওয়ালা একটা ছেলে এসে প্রতিদিনকার ফুলচোর অপবাদ দিয়ে দিল!
পরীকে কিছু বলতে না দিয়েই আবার বলতে শুরু করে,
“কবে থেকে এই পেশায় নেমেছ হু?”
পরী এবার দাঁত খিঁচে বলে,
“আপনার কি মাথাটা গেছে ভাই? সামান্য একটা ফুল ছিঁড়েছি তাতেই আপনি আমায় চোর অপবাদ দিলেন। এখন আবার বলছেন আমি এই পেশায় কবে থেকে নেমেছি? বলি কি এই একটা ফুল দিয়ে কি আমার বাড়ি-গাড়ি করার টাকা পাব?”
“পাঁকা পাঁকা কথা বলে পার পেয়ে যাবে ভেবেছ?”
“শুধু পাঁকা কেন কাঁচা কথা বলেও আপনার থেকে পার পাওয়া মুশকিল। আপনার মতো এমন ঝগড়ুটে ছেলে আমার জীবনে আমি কমই দেখেছি।”
“চোরের মায়ের বড় গলা তাই না? একই তো ফুল চুরি করেছ এখন আবার বড় গলায় কথাও বলছ।”
“চুপ করেন তো! সেই কখন থেকে চোর চোর বলে মাথাটা খেয়ে ফেলতেছেন। শুধু একটা ফুলই তো ছিঁড়েছি। এজন্য এত কথা শোনাতে হবে? আমি কালই একটা ফুলসমেত ফুলগাছ এনে দেবো। হয়েছে?”
“একটা কেন? প্রায় এক মাস হবে একটা একটা করে ফুল উধাও হচ্ছে প্রতিদিন সকালে।”
“আপনি বলতে চাচ্ছেন এই এক মাস ধরে আমি আপনার গাছের ফুলগুলো ছিঁড়ছি?”
“তা নয়ত আর কী? আজ তো তোমায় হাতেনাতে ধরলাম।”
“এতক্ষণ আমার কিঞ্চিৎ সন্দেহ ছিল আপনি সত্যিই মানসিক রোগী কীনা! কিন্তু এখন আমি পুরোপুরি শিওর। আপনি একটা মানসিক রোগী। ট্রিটমেন্ট করাচ্ছেন না?”
“কোনদিক থেকে আমাকে তোমার মানসিক রোগী মনে হচ্ছে?”
“সবদিক থেকেই। আমি এই বাড়িতে এসেছি আজ তিনদিন হলো। আর আপনি বলতেছেন এক মাস ধরে নাকি আমি ফুল চুরি করতেছি। একজন মানসিক সমস্যাগ্রস্ত মানুষ ছাড়া কেউ এই কথা বলতে পারে?”
“আমি কখনো মিথ্যা বলি না বুঝেছ?”
“ওহ আচ্ছা! আপনার কথাকে সত্যি প্রমাণ করতে হলে আমার এটা ধরে নিতে হবে যে আমার ভূত এসে ফুল চুরি করে চলে যেত।”
“আমার সাথে বিটলামি করা হচ্ছে?”
“দেখুন আমি শান্তিপ্রিয় মানুষ। শান্তি বজায় রাখতেই পছন্দ করি।”
“সেটাই! এতক্ষণ ধরে তোমার শান্তি বজায় রাখাটাই দেখলাম।”
দুজনের কথার মাঝে একটা গুলুমুলু ছোট ছেলে ছাদে এসে বলে,
“তুর্য ভাইয়া আম্মু তোমাকে ডাকছে।”
তুর্য বিরক্ত নিয়ে একবার পরীর দিকে তাকিয়ে বলে,
“যাচ্ছি।”
“যাচ্ছি নয়। এখনই যেতে বলল।”
তুর্য চলে যাওয়া ধরলে পরী পেছন থেকে ডেকে বলে,
“শুনুন, পাবনায় আমার এক পরিচিত আত্মীয় আছে। আপনি চাইলে আমি তার সাথে কথা বলে আপনার এডমিটের ব্যবস্থা করতে পারি।”
তুর্য চোখ গরম করে তাকিয়ে বলে,
“ফাজিল মেয়ে!”
তুর্য যাওয়ার পর পিচ্চিটা পরীর কাছে গিয়ে বলে,
“হাই বিউটিফুল লেডি।”
পরী চোখ বড় বড় করে তাকায়। এতটুকু পিচ্চির কথা বলার কী স্টাইল! পরী পিচ্চিটার গাল টেনে বলে,
“হ্যালো! নাম কী তোমার?”
“দিশান।”
“বাহ্! খুব সুন্দর নাম। কীসে পড়?”
“ক্লাস ওয়ান। তোমার নাম কী?”
“পরী।”
“তুমি কি আকাশে উড়তে পারো?”
পরী হেসে বলে,
“না।”
দিশান চিন্তিত ভাব ধরে বলে,
“তাহলে তোমার নাম পরী কেন রেখেছে?”
পরী ঠোঁট উল্টে বলে,
“জানি না তো!”
দিশান পরীর হাতে ফু্ল দেখে অবাক হয়ে বলে,
“একি! তুমি ফুল ছিঁড়েছ? তুর্য ভাইয়া কিছু বলেনি?”
“বলেনি আবার! কতগুলো কথা শুনিয়ে গেল। আমি নাকি একমাস ধরে ফুল চুরি করছি।”
দিশান মুখ টিপে টিপে হাসছে। পরী ভ্রু কুঁচকিয়ে বলে,
“হাসছ কেন?”
“একটা সিক্রেট কথা বলি?”
“হু।”
“কাউকে বলা যাবে না কিন্তু।”
“আচ্ছা।”
“আসলে ভাইয়া মিথ্যা বলেনি। প্রতিদিনই একটা করে ফুল গায়েব হয়। আর ফুলগুলো চুরি করি আমি।”
দিশান হাসতে থাকে। পরী জিজ্ঞেস করে,
“এটা ঠিক নয়। প্রতিদিন ফুল দিয়ে কী করো?”
“ঐশিকে দেই।”
“ঐশি কে?”
“আমাদের পাশের বাড়িতে থাকে। ওকে আমার খুব ভালো লাগে।”
পরী একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। চুরি করে কে আর ধরাটা খেল কে!
দিশান জিজ্ঞেস করে,
“তোমরা কি এই বাসায় নতুন এসেছ?”
“হ্যাঁ। চলো যাই আমাদের ফ্ল্যাটে। যাবে?”
“যাব।”
পরী দিশানকে নিয়ে চার তলার ফ্ল্যাটে যায়। দুই রুমের একটা ফ্ল্যাট। একটা কিচেন। দুই রুমেই এটাচড বাথরুম। রান্নাঘরের সাথেই ডাইনিং রুম আর ছোট একটা ড্রয়িংরুম। তিনটা সোফা আর একটা টি-টেবিল রেখেও অনেকটা জায়গা খালি পড়ে আছে। তিনজন মানুষের জন্য এরচেয়ে ভালো ফ্ল্যাট আর হয় না। পরীর গলার আওয়াজ শুনে শাহানা বেগম রান্নাঘর থেকে আসেন। দিশানকে দেখে বলেন,
“কে ও?”
“দিশান। ছাদে দেখা হলো। ওকে কিছু খেতে দাও তো।”
শাহানা বেগম ফ্রিজ থেকে পায়েস এনে দিশানকে দেয়। পরীকে বলেন,
“আমার রুমের ফ্যানটা কী হলো বলতো?”
“কী হয়েছে?”
“মাঝরাত থেকেই চলছে না। তোর আব্বুকে বললাম। সে তখন নাক ডেকে ঘুমে ব্যস্ত। সকালে বললাম। বলে অফিসে দেরি হয়ে যাচ্ছে। একটু দেখ না কী হয়েছে! আমি ঐদিকে রান্না বসিয়েছি।”
যতক্ষণ না পরী ফ্যানের কাছে যাবে ততক্ষণ কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করতেই থাকবে। পরীর রুমে ফ্যান তো ঠিক আছে। আব্বু না আসা পর্যন্ত তো ঐ রুমেই থাকা যায়। না, তা থাকবে না। তার রুমের ফ্যানই ঠিক হওয়া চাই আগে। তাই অগত্যা পরী দিশানকে খেতে বলে মায়ের রুমে যায়। খাটের ওপর দাঁড়িয়েও ফ্যানের নাগাল পাচ্ছে না। তাই কাঠের চেয়ারটা বিছানার ওপর নিয়ে দাঁড়ায়।
.
কলিংবেলের আওয়াজ শুনে শাহানা বেগম দরজা খুলতে যান। দরজা খুলে দিশানকে দেখে অবাক হয়ে যায়। সাথে আরো একটি ছেলে আছে। রান্না করায় ব্যস্ত থাকায় খেয়ালই করেননি কখন দিশান চলে গেছে। তুর্য শাহানা বেগমকে সালাম দিয়ে বলে,
“আসসালামু আলাইকুম আন্টি।”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম।”
“দিশান বলল ফ্যানে কী নাকি সমস্যা হয়েছে?”
“হ্যাঁ বাবা। কী যে হয়েছে বুঝতেছি না। তুমি ভেতরে আসো। ঐ রুমের ফ্যানটাতেই সমস্যা।”
শাহানা বেগম রুম দেখিয়ে দিয়ে আবার রান্নাঘরে চলে যান। রান্নার মতো ঝামেলা তার কাছে আর কিছুই মনে হয় না। তুর্য শাহানা বেগমের রুমে গিয়ে থ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। পরী হাত উঁচু করে কাজ করায় পরনের টি-শার্টও অনেকটা সরে কোমরের একাংশ দেখা যাচ্ছে।
তুর্য ঝাঁঝালো গলায় বলে,
“যেসব পোশাক শরীর ঢাঁকতে পারে না সেসব পরো কেন?”
আবারও তুর্যর একই গলা শুনে এবং হঠাৎ তার উপস্থিতিতে ভয় পেয়ে যায়। যার দরুণ প্রথমে চেয়ার থেকে বিছানায় এবং পরে বিছানা থেকে ফ্লোরে গড়িয়ে পড়ে। ব্যথায় কুঁকিয়ে ওঠে পরী। নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে হাতের কনুই ঘঁষতে ঘঁষতে বলে,
“আপনি তো আচ্ছা মানুষ! একটা মেয়ে আপনার সামনেই পড়ে গেল। আর আপনি ধরলেনও না?”
“আমি কেন ধরতে যাব? অসভ্য মেয়েদের আমি কোনো সাহায্য করি না।”
“কে অসভ্য?”
“তুমি অসভ্য। পেট দেখাও, কোমর দেখাও ইচ্ছে করে।”
“কথা ঠিক করে বলবেন বলে দিচ্ছি। আমি লং স্কার্ট আর টি-শার্ট পরেছি। আপনি ওমন হাত উঁচু করলে আপনারও পেট দেখা যাবে।”
“যাক! আমি ছেলে মানুষ। আমারটা দেখলে সমস্যা নাই।”
“আমি কি জানতাম নাকি আপনি সরাসরি বাসায় চলে আসবেন?”
“ও হ্যালো, আমি নাচতে নাচতে আসিনি ওকে? দিশান বলল নতুন ভাড়াটিয়ার নাকি কী সমস্যা ফ্যানে তাই আসলাম।”
“ইশ! জনদরদী একদম।”
“জনদরদী-ই। কিন্তু যদি জানতাম তোমরা সেই ভাড়াটিয়া তাহলে ভুলেও আসতাম না।”
“এহ্! এখন যেন মাথা কিনে নিয়েছেন।”
“এই যাও তো! ঝগড়া করবা না।”
“ঝগড়া তো আপনি করেন।”
“আর তুমি চেয়ে চেয়ে শুধু দেখো না?”
শাহানা বেগম রুমে আসায় দুজনই একদম চুপ হয়ে যায়। একদম শূনশান নীরবতা যাকে বলে। শাহানা বেগম দুজনের দিকেই তাকিয়ে বলেন,
“কী হলো এটা?”
পরী জোর করে হাসার চেষ্টা করে বলে,
“কী হলো মা?”
“কেমন যেন সব চুপ হয়ে গেল।”
“কী চুপ হয়ে গেল মা? আমরা তো চুপই ছিলাম।”
“ওহ্। আমি জিজ্ঞেস করতে আসলাম কিছু খা…”
পুরো কথা শোনার আগেই পরী বলে,
“না, না। আমি এখন কিছু খাব না।”
শাহানা বেগম দাঁতে দাঁত চেপে বলেন,
“তোকে জিজ্ঞেস করতে এসেছি নাকি? তুর্যকে জিজ্ঞেস করতে এসেছি।”
পরীর মুখটা একটুখানি হয়ে যায়। তুর্য মুখ টিপে হাসছে। হাসি চাপিয়ে বলে,
“না, আন্টি আমি কিছু খাব না।”
“তা বললে হয় নাকি? আমি ছাদে কাপড় নেড়ে দিয়ে এসে তোমার জন্য চা বানিয়ে দিচ্ছি।”
শাহানা বেগম চলে যাওয়ার পর পরী দাঁত কিড়মিড় করে বলে,
“খুব যে হাসছেন?”
“আমার মুখ দিয়ে আমি হাসছি। তাতে তোমার কী?”
“হুহ।”
“শোনো এসব যন্ত্রপাতি নিয়ে খাটের ওপর এসে দাঁড়াও। যখন যেটা চাইব সেটা দেবে।”
পরী মনে মনে বলে,
“হাতি কাদায় পড়লে চামচিকাও লাথি মারে এই কথার প্রয়োগ এই ছেলে ভালোই জানে।”
পরী তাও গিয়ে যন্ত্রপাতি নিয়ে দাঁড়াল। দিশান হাতপাখা নিয়ে এসে তুর্যকে বাতাস দিচ্ছে। তুর্যর নেউটা একদম। পরী বিরসমুখে দাঁড়িয়ে আছে। দিশানের মাথায় যে এত দুষ্টুমি বুদ্ধি কিলবিল করে সেটার প্রমাণও পেয়ে যায়। পাখার ডাঁট দিয়ে তুর্যর উন্মুক্ত পেটে গুঁতা দিতেই তুর্য নড়ে ওঠে। সাথে চেয়ারও নড়ে। টাল সামলাতে না পেরে একদম ধপাস করে নিচে পড়ে। আঁকড়ে ধরার সম্বল হিসেবে গাধাটা আর কিছু পায়নি। ধরেছিল ছোট দিশানের হাত। এই দিশান কি আর ওমন আইফেল টাওয়ারকে ধরতে পারবে? শেষে হলো কী! দিশান আঁকড়ে ধরল পরীর স্কার্ট। বেশ! কাম হো গ্যায়া! দিশানের সাথে ও নিজেও একদম নিচে কুপোকাত। তুর্যর গলায় মাথা দিয়ে পড়েছে পরী আর দিশান পড়েছে তুর্যর পেটের ওপর। এরপর যে কী হবে সেটা ভেবেই পরীর হাত-পা ভয়ে ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।